মৃদু হেসে যুবতী বলল, শুধুই ধন-রত্ন! তোমার হৃদয় দেবে না আমাকে?
খালি হৃদয় কেন? আমার প্রাণটাই তো তোমার, প্রিয়ে।
সত্যিই প্রাণ দিতে চাও? ঠিক বলছ তো?
অবশ্যই সত্যি বলছি, স্বর্গের দেবী। আমার হৃদয়,
আমার প্রাণ-এসবই এখন তোমার। তোমার প্রেমে আত্মাহুতি দিয়েছি আমি!
এই যুবতী আসলে ছিল ক্রিমিশা যক্ষ স্বয়ং। ক্রিমিশা চাচ্ছিল নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনুক পাষণ্ড পুশ্যমিত্র, যাতে আত্মহননের দায়ে অনন্তকাল নরকবাস হয় তার। তৎক্ষণাৎ ভয়ঙ্কর পিশাচের রূপ ধরল ক্রিমিশা, চড়চড় করে পুশ্যমিত্রের বুক চিরে একটানে বার করে আনল তার হৃৎপিণ্ড। কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল সেটা। এরপর ঘোড়ার পিঠে বসা বিশজন দেহরক্ষীর দিকে ছুঁড়ে মারল পুশ্যমিত্রের প্রাণহীন ছিন্নভিন্ন দেহ। হা-হা করে হেসে উঠল আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। বাক্স-পেটরা ফেলে পড়িমরি করে ছুটল দেহরক্ষীর দল। কাকা, আপন প্রাণ বাঁচা! পিছু ধাওয়া করল পিশাচী। পেছন থেকে পিঠের ভেতর দিয়ে হাত ভরে টেনে বার করে আনল সব কটার কলজে। জড়সহ খেয়ে ফেলল সবগুলো হৃৎপিণ্ড!
এরপর ডেমিট্রিয়াস বা ধর্মমিতা পাটলিপুত্র ছেড়ে এল এখানে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল হাজার বছরের প্রাচীন নগরী। বিহারী সৈন্যদের মৃতদেহে গজাল মেরে ঝুলিয়ে রাখল পাঁচিলের গায়ে। শুরু হলো চিল-শকুনের মচ্ছব! তবে মন্দিরটা রেখে দিল। ঢকলই না ওখানে। দেব-দেবীর মন্দির ধ্বংস করা গ্রিক রণনীতি বিরোধী! সেই সাথে যক্ষ কুম্ভন আর শত-শত বলির-পাঁঠা হওয়া প্রেতাত্মার পাহারায়, মন্দিরের গোপন কুঠুরিতে রয়ে গেল অজস্র ধন-রত্ন!
এ পর্যন্ত বলে থামল কাপালিক।
কখন যে পাটে বসেছে সূর্য, খেয়ালই করিনি। তৎক্ষণাৎ রওনা হলেও ক্যাম্পে পৌঁছতে হয়ে যাবে মাঝরাত দেখলাম অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে কাপালিক। লক্ষ করলাম, সন্ন্যাসীর বাঁ কানের লতিতে তিরতির করে কাঁপছে লোহার ছোট্ট একটা রিং। মনে হলো হাজার প্রশ্ন করলেও এখন আর মুখ খুলবে না মানুষটা। রুটিদুটো আর জল খেয়ে ফিরতি পথ ধরলাম আমি।
চার
মাঝরাত হলো ক্যাম্পে ফিরতে-ফিরতে। ভাগ্য ভাল, আকাশে ছিল চাঁদ। ঊষর মরু এলাকায় চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় সবকিছু। না হলে, পথ চিনে ফিরতে পারতাম না ক্যাম্পে। চেক পোস্টে আটকাল আমাকে। সারারাত থাকতে হলো ওখানেই। পরদিন বেস কমাণ্ডারকে বললাম, নতুন জায়গা। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। হালকা শাস্তি দেয়া হলো আমাকে। পুরো ক্যাম্প ঘিরে দশ চক্কর মারতে হলো। তারপর আবার যে কে সেই। ট্রেনিং আর ঘরে বসে থাকা, ঘরে বসে থাকা আর ট্রেনিং। এভাবেই পেরিয়ে গেল আরও দুসপ্তাহ। এ সময়টায় মর্টার শেলিং আর মাটিতে মাইন পাতা শেখানো হলো আমাদেরকে। এরই ভেতর আরও দু শ নতুন রিক্রুট এসে হাজির। দলে-দলে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাচ্ছে। বাঙালি ছেলেরা এখন। জায়গায় হয় না ব্যারাকে। সারি-সারি তাঁবু পড়ল পুরো উপত্যকা জুড়ে। কুচকাওয়াজের ভেতর দিয়ে শেষ হলো ট্রেনিং। আয়োজন করা হলো উন্নতমানের খাবারের। অর্থাৎ পোলাও, আলুর চপ, আর চর্বি দিয়ে ভোলার ডাল রান্না! মাঝে একদিন ছুটি, এরপর রণাঙ্গন!
কোয়ার্টার মাস্টারকে ধরে পড়লাম আমি। আবারও একদিনের ছুটি চাই। শেষবারের মত ঘুরে দেখতে চাই জায়গাটা। জীবনে কখনও তো আর আসা হবে না। রণাঙ্গনে কে মরে, কে বাঁচে, তার নেই ঠিক। বিষয়টা কোয়ার্টার মাস্টারও বুঝল। বলল, ঠিক আছে, যাও। তবে ভোরে ভোরে যাবে, ফিরে আসবে সন্ধের আগেই। সামাঝ গায়া না?
বললাম, জী, ওস্তাদজি। বিলকুল সামাঝ লিয়া।
.
পরদিন সকালে সূর্য যখন উঠি-উঠি করছে, রওনা হলাম তখনই। রাতের খাবার থেকে রুটি বাঁচিয়ে রেখেছি। জলের। বোতলসহ পকেটে ভরে নিলাম ওগুলো। এরপর হাঁটা ধরলাম। ত্রিশূল পাহাড়ের পথে। এক মাসেরও বেশি ধরে ট্রেনিং করেছি। দৌড়-ঝাঁপ-ক্রলিং, অবস্ট্যাকল পেরনো-বাদ যায়নি কিছুই। হনহন করে হাঁটতে লাগলাম। মাত্র আড়াই ঘণ্টার মাথায় পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের ওপর অতএব মহুয়া গাছগুলোর কাছে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। গাছগুলোর মাঝখানে ঘেসো জমিনের ওপর কাঠের ছাই-কয়লা, মেটে আলুর খোসা। পাহাড়ের ঢালে এখানে-সেখানে ভুসভুসে মাটিতে হয় এই মেটে আলু। সন্ন্যাসীর জীবন তো দেখছি ভীষণ কৃচ্ছতার!
ওখানেই পাথরের চাঁইয়ের ওপর বসে খেলাম রুটি-জল। পরে খাব বলে বাঁচিয়ে রাখলাম কিছুটা। খাণ্ডালার দিকে হাঁ। করে চেয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। কিন্তু কোথায় সেই কাপালিক সাধুবাবা? এখনও অনেক জানার বাকি রয়ে গেছে তাঁর কাছ থেকে। মনে নানান চিন্তা। দেখব নাকি ওই হানাবাড়িতে গিয়ে কী আছে ভেতরে, নাকি ফিরে যাব। ক্যাম্পে? কী জানি অজানা কী বিভীষিকা ওঁৎ পেতে আছে। ওখানটায়! সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে উঠে দাঁড়ালাম। অদম্য কৌতূহল হচ্ছে খাণ্ডালার তোরণের কাছে গিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখার। যে শৈলশিরাগুলো ত্রিশূলের মত ছড়িয়ে আছে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে যাব তার গোড়ায়, ঠিক সেই সময় খনখনে গলায় পেছন থেকে কে যেন বলল, ওদিকে কোথায় চললে, বাবা?
ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। দেখতে পেলাম আগের সেই কাপালিককে। হালকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কটা রঙের ইয়া লম্বা জটা দাড়ি। বললাম, আরে, সাধুবাবা, আপনি! আপনার খোঁজেই তো এখানে আসা!