ওই সন্ন্যাসী আমাকে কিছুই বলেনি, তবুও বুঝতে পারলাম, এ বৈশালী নগরের রাজ পুরোহিত চিত্রকূট। যুবতী বৈশালী রাজকন্যা সঙ্মিত্রা। মূর্তিটি আদি পিশাচ দেবতা আহুরার। মন্ত্র পড়তে পড়তে হঠাই চিত্রকূট আমার বা হাতটা ধরল। মেঝেতে আঁকা তারার মত কাঠের একটি তারা আমার হাতের তালুতে রেখে হাতের মুঠো বন্ধ করল। ঠিক তখন সঙ্মিত্রাকে আটটি কস্তুরী মৃগনাভী, একদলা কর্পূর হোমের আগুনে নিক্ষেপ করতে দেখলাম। হোমের আগুন তৈরি হয়েছে চন্দন কাঠ দিয়ে। চারদিকের বাতাসে চন্দন পোড়ার মিষ্টি সুবাস। চিত্রকূট এবং সঙ্মিত্রার মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ এখন চাপা ও গম্ভীর। লক্ষ করলাম, সবুজ শবাধারের ভেতরকার তরুণীর লাশটি সটান দাঁড়িয়ে গেল। পানিতে ভিজে ভিজে ওটার শরীরের চামড়া নীলচে হয়ে গেছে। পেছন দিকে বেঁকে গেল লাশটার মাথা, খুলে হাঁ হয়ে গেল মুখ। খোলা মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে বেরুতে লাগল তীব্র আলোর রশ্মি। গম্বুজ ভেদ করে অনন্ত নক্ষত্রবীথি স্পর্শ করল সেই আলোর শিখা। একই সাথে লাশের শরীর থেকে নীলচে আলোর ঢেউ বেরিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল পুরো গুহা। এরই ভেতর দেখলাম জীবন্ত হয়ে উঠেছে আহুরার মূর্তি। • আগুন-গরম ইস্পাতের মত জ্বলজ্বল করছে, চুনির চোখ। একতাল আঁধার হয়ে বেদী থেকে নেমে এল পিশাচ দেবতা। বজ্রপাতের গুমগুম শব্দে গুহার দেয়াল কাঁপতে লাগল থরথর করে। সেই জমাট বাঁধা অন্ধকার এগিয়ে এসে চিত্রকূটের দেহ ভেদ করে গম্বুজের চূড়াকে দুভাগ করে মিলিয়ে গেল আকাশে। চারদিক থেকে ভেসে এল কানে তালা ফাটানো হা হা, হা-হা, হা-হা শব্দ। তরুণীর লাশ শবাধারের পানি সব উধাও। ছয়কোনা তারাটির মাঝে পড়ে আছে চিত্রকূটের পরিধেয় সাদা কাপড়। অদৃশ্য থেকে কে যেন বলল, ভয় পেয়ো না। এখন থেকে আমাকে সবসময় কাছে পাবে তুমি।
দীর্ঘক্ষণ কথা বলে থামলেন বৃন্দাবন ঘটক।
আমি বললাম, বৃন্দাবন বাবু, এই ঘটনা থেকে আপনি আসলে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? এখানে অতিপ্রাকৃত কোনও কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। মেক্সিকোর অ্যাজটেকরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পেয়োটি নামের এক জাতীয় ক্যাকটাস সেবন করত। সাংঘাতিক হ্যালুসিনেটরী ড্রাগ এটি। আপনার সিধু জ্যাঠা কবিরাজ মানুষ। তিনি এ জাতীয় কোনও কিছুর রস খাইয়ে থাকবেন আপনাকে।
এই ঘটনার পর কোনওদিনই কিন্তু আমি আর ভয় পাইনি।
না পাওয়াই স্বাভাবিক। ভয় সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার। আপনাকে সম্মোহিত করে স্ট্রং সাজেশান দিয়েছিলেন। আপনার সিধু জ্যাঠা। পুনরায় ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
এ কথার কোনও জবাব না দিয়ে বৃন্দাবন বাবু তাঁর বা হাতটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। চেয়ে দেখলাম তাঁর হাতের তালুর ঠিক মাঝখানে গাঢ় লাল রঙের ছয়কোনা একটি তারার ছাপ আঁকা। যেন ওখানটাতে উল্কি করিয়েছেন। যে বিষয়টিতে আমার সবচেয়ে বেশি খটকা লাগল, সেটি হলো তারার ছয়টি কোণ। আধুনিক তারা সবই পাঁচকোনা। ছয়কোনা তারা ব্যবহার হত সহস্র বছর আগে। কেউ যদি এর হাতে ট্যাটুও করে থাকে, তা হলে ওই তারা পাঁচকোনা হওয়ার কথা, ছয়কোনা কোনওভাবেই নয়। আমি বললাম, বাবু, সবই না হয় বুঝলাম। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেও গেল। সেটি হলো এসবের সাথে পালি ভাষার সম্পর্কটা আসলে কোথায়?
ওই ব্যাপারটি জানতে হলে আপনাকে আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতে হবে। এই রাম কাহিনি এখনও শেষ হয়নি।
হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত সাড়ে আটটা বাজে। প্রায় তিন ঘণ্টা হলো বাঁধের ওপর বসে আছি। নদীর জোরালো হাওয়ায় ভিজে ভিজে লাগছে শরীর, খিদেও পেয়েছে খুব। হিলহিলে ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। মনে হয় কেঁপে বৃষ্টি আসবে। বৃন্দাবন ঘটককে বললাম, বাবু, চলেন মিউজিয়ামের গেস্ট হাউসে যাই। ওখানে বাবুর্চি আছে। তাদেরকে বললেই খাবার রান্না করে দেবে। আজকে রাতে আমার সাথে খাওয়া-দাওয়া করেন।
ভেবেছিলাম বৃন্দাবন ঘটক রাজি হবেন না। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটা ঘটল। বাবু আমার সাথে যাওয়ার জন্যে রাজি হয়ে। গেলেন। গেস্ট হাউসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে নটা বাজল। আমার সাথে যারা ছিলেন, তারা সবাই ডিনারে। বাবুর্চিও রান্নাঘর সাফসুতরো করে তালাটালা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্যে রেডি। তার হাতে দেড়শো টাকা দিয়ে। বললাম, মুরগির ঝোল সরু চালের ভাত-ডাল আর ভাজি করার জন্যে। আরও বললাম, যদি খুশি করতে পারো, তা হলে আরও বিশ টাকা বখশিশ পাবে। সে সময়ে দেড়শো টাকা বেশ ভাল টাকা। বাবুর্চি বেশ চালাক-চতুর লোক। রান্নায় বসার আগেই আমাদের দুকাপ চা দিয়ে গেল। একটা পুরনো বাংলা টাইপের বাড়িকে গেস্ট হাউস বানানো হয়েছে। চা নিয়ে বেতের চেয়ার পেতে আমরা দুজন বারান্দায় বসলাম। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, কড়কড় করে বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। সেই সাথে চলে গেল কারেন্ট, শুরু হলো দমকা বাতাস। একই সঙ্গে বাংলোর টিনের চালে বড় বড় ফোঁটায় চড়চড় শব্দে বৃষ্টি পড়তে লাগল। নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমরা। বৃন্দাবন বাবু আবার তার কাহিনি শুরু করলেন। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু গলা শুনতে পাচ্ছি।
সাত
এই ঘটনার পর সিধু জ্যাঠার সাথে আমার ভাব হয়ে গেল খুব। প্রতিদিন বিকেলে যাই তাঁর কাছে। নানান গল্প কাহিনি শোনান জ্যাঠা আমাকে। একদিন শোনালেন রামপুর বোয়ালিয়ার ঘটনা। বললেন, তুই জানিস না, বেন্দাবন। এই রামপুর বোয়ালিয়া এক পুরনো জনপদ। এর ইতিহাসে ঘটনার ঘনঘটা। বারোশো সালের শেষের দিকে এদেশে মুসলমান দরবেশরা দলে দলে আসতে শুরু করে। শাহ তুরকান নামের এক আউলিয়া এখানে এসে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন। সেই সময়ে এই এলাকা শাসন করত। তান্ত্রিক রাজা অংশুদেব চওবন্দী আর তাঁর ভাই খের্জুরচণ্ড। এরা পুজো করত মহাকালদেবী নামে এক জাগ্রত প্রতিমার। এই দেবীকে তুষ্ট করার জন্যে তান্ত্রিক রাজারা ফি বছর তাঁর বেদীতে নারী ও শিশু বলি দিত। এই রাজাদের সাথে তুরকান। শাহর যুদ্ধ বাধল। তুরকান শাহর পক্ষে থাকল অন্যান্য দরবেশ, অসংখ্য অনুসারী। তান্ত্রিক রাজাদের সৈন্যরা প্রথমে হেরেই যাচ্ছিল। খবর পেয়ে তান্ত্রিক রাজা অংশুদেব সন্ধের সময় মহাকালদেবীর বেদীতে এক অল্প বম্বেসী মা আর তার। দশ মাসের শিশুকে একসাথে উৎসর্গ করল। রাতে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, পরদিন আবার যখন যুদ্ধ শুরু হবে, তখন বলি দেয়ার খড়গটি নিয়ে রাজাকে যেতে হবে যুদ্ধের ময়দানে। তবে দুপুর হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। দুপুরে যুদ্ধের ময়দানে নামাজ পড়তে দাঁড়াবেন তুরকান শাহ। এটা মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য। এই সময় পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে অংশুদেব যদি দেখে তিনটে শকুন চক্রাকারে ঘুরছে, তা হলে সাঁথে সাথে আঘাত হানবে সে।