জ্যাঠা, এ হলো রমার ছেলে বৃন্দাবন। বিড়ালদাহ থেকে কালই এখানে এসেছে। ভাবলাম আপনার কাছে নিয়ে আসি।
সিধু জ্যাঠা তাঁর ইলিশ মাছের চোখ দিয়ে দেখলেন আমাকে। বললেন, আয়, মাদুরে বোস। দেখি তোর বাঁ হাত।
ঠাণ্ডা নরম হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতের তালু মেলে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, কী, ছেলে, রাতে ভয় লাগে? ন্যাংটা বুড়োর কথা মনে পড়ে?
মামা কিছু বুঝলেন না, তবে আমার গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। এ লোক অন্তর্যামী নাকি? বড় মামাকে কাছে ডেকে বললেন, বনস্পতি, এই দেখ তোর ভাগ্নের হাত দেখ। এর তো তেনার দর্শন হয়েছে রে।
কার দর্শন হয়েছে, জ্যাঠা? হাতেই বা কী দেখলেন?
তোর ভাগ্নে, এই বেন্দাবন জন্মেছে এক বিশেষ তিথিতে। তই তো কিছুই শিখলি না। সারাজীবন শুধ স্লেচ্ছদের গোলামি করলি। এর বাঁ হাতের তালুর দিকে চেয়ে দেখ। চন্দ্রের ক্ষেত্র থেকে ওই যে রেখাটা উঠে মঙ্গলের কাছে। ধনুকের মত বাঁক নিয়ে বুধের নিচে গিয়ে থেমে গেছে। অতি বিরল রেখা এটি। জাতকের হাতে এই বিশেষ রেখাঁটি থাকলে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী হয় সে। বরেন্দ্রের সবচেয়ে বড় তান্ত্রিক হলো রানী ভবানীর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা রাজা সূর্য নারায়ণ। বহুকাল আগের কথা। সে-ই সব তান্ত্রিকের গুরু। এই রেখা তার হাতে ছিল। এরই সাথে দেখা হয়েছে তোর ভাগ্নের। আর সেই থেকেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে বেন্দাবন। আমার কাছে এসে যখন পড়েছেই, ভয় ভাঙিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। পরশু শুক্লপক্ষের নবমী। সারাদিন উপোস করিয়ে রাখবি তোর ভাগ্নেকে। সন্ধ্যায় ওকে স্নান করিয়ে মন্দিরে নিয়ে আসবি। ভয়কে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেব।
সিধু জ্যাঠা ছিলেন ভয়ানক মুসলমান বিদ্বেষী। যদিও তাঁর রোগী বেশিরভাগই ছিল ওই গোত্রের লোকেরাই। চড়া ফি আদায় করতেন তাদের কাছ থেকে। লোকে বলত জ্যাঠা সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। উনি যা দাবি করতেন লোকে তাই-ই দিত তাকে।
ছয়
জ্যাঠার কথামত সন্ধের সময় বড় মামা আমাকে মন্দিরে নিয়ে গেলেন। মহাকালদেবীর মন্দির অনেক পুরনো। বহুকাল আগে বিরাট বড় ছিল। এখন শুধু অজস্র ভাঙা দেয়াল পিলারের ভেতর ছোট্ট একটি ঘরই টিকে আছে। সিধু জ্যাঠাই কোনওরকমে টিকিয়ে রেখেছেন। মহাকালদেবীর মূর্তি মন্দিরের যে ঘরটিতে ছিল সেটি বহু আগেই জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়েছে। এর সাথে গেছে আরও অসংখ্য কামরা আর প্রকোষ্ঠ। এখন শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে আছে মহাকালদেবীর মূর্তি যে ঘরখানাতে ছিল, তার পেছনের কামরাটি। সিধু জ্যাঠা সাধনা করেন ওই কামরাটিতেই। এটি তার কাছে খুবই পবিত্র এক সাধন পীঠ। কালো কষ্টি পাথরে তৈরি তিন ফুট লম্বা মহাকালদেবীর মূর্তি। চোখ ফেরানো যায় না এত সুন্দর। তবে এর ভেতরে কোথায় যেন ভয়ঙ্কর এক নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে। সাদা একটা থান পরিয়ে মূর্তির সামনে চিৎ করে শোয়ালেন আমাকে সিধু জ্যাঠা। আমার মাথাটা রাখলেন মূর্তির পায়ের কাছে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম দৈবী সরাসরি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। জ্যাঠা বললেন, ভয় পাসনে, বেন্দাবন। চোখ বন্ধ করে খুব আস্তে আস্তে শ্বাস নে। মুখটা একটু হাঁ কর, দুচামচ ওষুধ খাওয়াব তোকে।
ভীষণ তেতো কী একটা খাওয়ালেন আমাকে জ্যাঠা। কিছুক্ষণ পর মনে হলো আস্তে আস্তে খুব গভীর কোনও গর্তে পড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম আলো ঝলমলে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছি। সামান্য দূরে ছোটখাট একটা পাহাড়ের চূড়ায় লাল আর সোনালি রঙের অপূর্ব এক বৌদ্ধ মন্দির। বিকেলের আলোয় চকচক করছে। পেছনে সাদা ধপধপে বরফে ঢাকা হিমালয়ের অসংখ্য পাহাড়-চুড়ো। বরফে রোদ লেগে রংধনুর সাত রং বেরুচ্ছে। ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজতে লাগল মন্দিরটাতে। মন্দিরের সিঁড়িতে পা রাখব, এমন সময় খানিকটা দূরে একটা পাহাড়ের গুহা থেকে গলগলিয়ে ধোয়া বেরিয়ে আসতে দেখলাম। লক্ষ করলাম, ধোঁয়াগুলো আকাশে উঠতে উঠতে পৌরাণিক গল্প উপকথার বীভৎস সব প্রাণীর আকৃতি নিচ্ছে। খুব কৌতূহল হলো। কী হচ্ছে ওখানটাতে? গুহার কাছাকাছি যেতেই ধূপ এবং পোড়া ঘিয়ের গন্ধ পেলাম। গুহাটা সুড়ঙ্গের মত সামনে এগিয়ে ডানে। বাঁক নিয়েছে। বাঁকের কাছেই আলো ছড়াচ্ছে একটা জ্বলন্ত মশাল। চারদিক ঝকঝকে তকতকে। বাঁক ঘুরে দেখলাম গম্বুজের মত ছাদঅলা গোলাকার বিরাট এক হলঘরের মত। হলঘরের এখানে সেখানে পুড়ছে আরও অনেক মশাল। সামনেই গুহার দেয়াল কুঁদে বানানো চওড়া ধূসর বেদীর ওপর কালো কুচকুচে পাথরের বড় একটা মূর্তি। লাল চুনি পাথরের চোখ, কোঁকড়ানো চুল, চওড়া কপাল, পাকানো শরীর। পাতলা ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। মূর্তিটি অসম্ভব জীবন্ত।
বেদীর সামনে মেঝের ওপর গোল বৃত্তের ভেতর ছয়কোনা একটা তারা আঁকা। তার ওপর পদ্মাসনে বসে হোমের আগুন জ্বেলে, মন্ত্র উচ্চারণ করছে এক বৃদ্ধ। কোমরের ওপর থেকে গা খালি। মশালের আলোয় চকচক করছে শরীরের ফর্সা চামড়া। নিখুঁত কামানো মাথা, শরীরের কোথাও একটা লোম পর্যন্ত নেই। বিচিত্র এক ভাষায় গম্ভীর স্বরে অনর্গল মন্ত্র পাঠ করছে বুড়ো। মনে হলো গভীর রাতে ধানশ্রী রাগে বাঁশি বাজছে দূরে কোথাও। একটা ঘোরের ভেতর চলে গেলাম আমি। পুরোহিত আর বেদীর মাঝখানে জল ভর্তি সবুজ পাথরের শবাধারে একটি নগ্ন তরুণীর লাশ ভেসে থাকতে দেখলাম। পুরোহিতের বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে সাদা থান পরা এক যুবতাঁকেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে দেখলাম। মেয়েটির কোমর অবধি কোঁকড়ানো এলোচল। ধপধপে সাদা সুডৌল বাহু, গোলগাল পায়ের গোছা। ছোট্ট পাতলা দুটো পাতায় সরু নিপুণ আঙুল। গোলাপি নখ ডেবে আছে সাদা তুলতুলে মাংসের ভেতর। মেয়েটির চুলের প্রান্ত বেয়ে এক ফোঁটা দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে নিতম্বের কাছে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ আগেই স্নান করেছে বোধহয়। বুকের কাছে দুহাত জড় করে গভীর মনোযোগ দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করছে সে। মেয়েটিকে অসাধারণ সুন্দরী বললেও কম বলা হয়। এমন একটি মেয়ের সাথে সারাজীবনে অনেকের একবারও দেখা হয় না। মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এ সাক্ষাৎ স্বরস্বতী। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে তান্ত্রিকের ডান পাশে বসে পড়লাম।