হঠাৎ ওই বৃত্তটা থেকে বাতাসের ছোট্ট একটা ঘূর্ণি উঠল। শুকনো পাতা, ধুলোবালি, পাখির পালক ঘুরপাক খেতে লাগল ঘূর্ণির ভেতর। আস্তে আস্তে একটি মানুষের আকৃতি পেল ঘূর্ণিটা। লালচর্মসর্বস্ব এক বুড়ো। গায়ে কোনও কাপড়চোপড় নেই। মাথায় জট পাকানো চুল, নীলচে লম্বা দাড়ি, হলদেটে চামড়া। দেখলাম সম্পূর্ণ নগ্ন ওই বুড়ো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুড়োর দৃষ্টি থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। এক ঘোরলাগা অবস্থা হলো। বারান্দা পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম দরজার দিকে। যেতেই হবে ওই ন্যাংটো বুড়োর কাছে। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের ভেতর পা রাখব, এমন সময় মেয়েলী গলায় পেছন থেকে কে যেন ডাকল আমাকে। ঘোর কেটে গেল। তৎক্ষণাৎ। ঝট করে পেছনে তাকালাম। কোথাও কেউ নেই। দূরে শিমুল গাছের ডালে বসে একটা ঘুঘু ডাকছে। জীবনে কখনও এত ভয় পাইনি। লাফিয়ে নেমে এলাম বারান্দা থেকে। পেছন ফিরে আর তাকানোর সাহস হয়নি।
এক দৌড়ে প্রাসাদের সামনে এসে দেখি জলিল স্যর সবাইকে একটা করে টোস্ট বিস্কুট দিচ্ছেন। এই স্যর সমাজ, বিজ্ঞান, বাংলা এইসব ক্লাস নেন। ইনি ক্লাসে কিছু পড়ান না, শুধু পড়া ধরেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে পিঠের ছাল চামড়া সব তুলে ফেলেন। একবার বাংলা ব্ল কবিতা যাকে আমরা বলতাম ছিপখান তিন দাঁড় পুরোটা মুখস্থ বলতে না পারায় আমাকে এত জোরে চড় মারলেন যে তিন দিন ধরে কানের ভেতর ঝিঁঝি পোকা ডেকে গেল। আমার তখন বুক কাঁপছে। তারপরও দুরমুশ জলিলের (স্কুলের ছেলেরা স্যরকে এই নামেই ডাকত) কাছ থেকে বিস্কুট নিলাম। বিস্কুট খেয়ে আমরা সবাই আরও এক রাউণ্ড পানি খেলাম। এর পরপরই পেট নেমে গেল আমার। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়লাম গাছের নিচে। আমার অবস্থা দেখে খেপে গেলেন জলিল স্যর।
সবাইকে শুনিয়ে বললেন, এইসব উটকো ঝামেলা তার একেবারে পছন্দ না। ক্লাস টেনের এক ছাত্রকে দিয়ে লোকাল বাসে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। আমাদের পাড়ারই ছেলে। তার আর পিকনিক খাওয়া হলো না। এরপর একমাস কালাজ্বরে ভুগলাম। ঘুমালেই হলদেটে ঝুলঝুল চামড়ার এক কুৎসিত নগ্ন বুড়োকে দেখতে পেতাম। সন্ধের পর একা থাকতে ভয় করত।
উনি থামতেই আমি বললাম, বৃন্দাবন বাবু, আপনি এটাকে অতিপ্রাকৃত ঘটনা কেন বলছেন? ওটা একটা হ্যালুসিনেশান। এই কাহিনির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ওই নগ্ন বুড়ো। সবদেশেই ভয়ানক বিকৃত রুচির কিছু বুড়ো থাকে। এরা শিশুদের সাথে নানারকম নোংরা কাজকর্ম করে। যৌন বিষয়ে শিশুদের কোনও ধারণা থাকে না। তাদের কচি মনে গভীর ছাপ ফেলে এইসব জঘন্য কর্মকাণ্ড। একটা ঘটনা বলি। ক্লাস নাইনে উঠে আমরা আগের বছরের ফেল করা এক ছাত্রকে পেলাম। প্রত্যেক ক্লাসেই এরকম একজন দুজন থাকে। তবে এর ব্যাপার আলাদা। এই ছেলেকে দিয়ে তাদের পাড়ার এক বুড়ো পায়ু মৈথুন করাত। বারংবার এই ঘটনা ঘটার পর তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে ছেলেটি। পরে বহুদিন ঘরে আটকে রেখে তার মানসিক চিকিৎসা করাতে হয়েছিল। হয়তো ছোটবেলায় আপনিও ভিকটিম হয়েছিলেন।
জী-না। একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি বড় হয়েছি কঠিন বেষ্টনীর ভেতর। বাড়িতে মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। বাইরে বের হলে সাথে বয়সে বড় কেউ না কেউ থাকতই। তবে এর পরের ঘটনাগুলো শুনলে আপনার কাছে। বিষয়টি আরও স্বচ্ছ হবে।
পরে আবার কী ঘটনা ঘটল, সে বুড়োর পরিচয় জানতে পারলেন?
সত্যি কথা বলতে কী, ব্যাপার কিছুটা সেই রকমই। এক বছর পরের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেই সমগ্ন গরমের ছুটিতে মা আমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন নানাবাড়ি রামপুর বোয়ালিয়ায়। রাজশাহী-বগুড়ার মাঝখানে এক প্রত্যন্ত অঞ্চল এটি। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও খুব বিখ্যাত। সন্ধের সময় অভ্যেসমত মায়ের আঁচল ধরে বসে আছি দেখে বড় মামা মাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, রমা, বিনু এত ভয় পাচ্ছে কেন?
মামাকে ভেঙেচুরে সবকিছু জানালেন মা।
তখন মামা বললেন, সিধু জ্যাঠার কাছে নিয়ে যাব কালকে। দেখি উনি কী বলেন৷
পাঁচ
পরদিন বিকেলের দিকে বড় মামা আমাকে সিধু জ্যাঠার কাছে নিয়ে গেলেন। ওই এলাকায় সবচেয়ে পুরনো আর বড় বংশই মামাদের বংশ। এই সিধু জ্যাঠা আমার নানার ভাই। ইনি দিনে করেন কবিরাজি আর রাতে মহাকালদেবীর পুজো। গাঁয়ের লোকেরা তাঁকে মনে করে তান্ত্রিক। ভাল জ্যোতিষী হিসেবে নাম-ডাক আছে। মন্দিরের কাছাকাছি সেবায়েতের যে পোড়ো বাড়ি ছিল, সেই বাড়িরই ভিটের ওপর বাড়ি করেছিলেন সিধু জ্যাঠার পরদাদা। সেই বাড়িও বলতে গেলে অনেক আগের। জ্যাঠা বিয়ে-শাদি করেননি। তার এক বাল্যবিধবা বোনকে নিয়ে একাই থাকেন ওই জড়ভরত বাড়িটাতে। দেখলাম জ্যাঠার পরনে লালসালু। লম্বা দাড়ি, কাঁচাপাকা চুল মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা। কপালের মাঝখানে রক্ত তিলক। রাত জেগে জেগে চোখ লাল। পোচ। পোঁচ কালি জমেছে চোখের নিচে। সম্পূর্ণ অনুভূতিশূন্য মরা মাছের চোখ। ওগুলোর দিকে তাকালে ধড়াস করে ওঠে বুকের ভেতর। ঘরের দাওয়ায় মাদুরে বসে ঝকঝকে কাঁসার বাটিতে নারকেল কোরা দিয়ে গুড়মুড়ি খাচ্ছেন সিধু জ্যাঠা। বড় মামাকে দেখে বললেন, বনস্পতি যে, তা এদিকে কী মনে করে?