জী, আমিই ডেকেছি।
আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আগে আপনার সাথে দেখা হয়েছে কখনও?
জী, তা একবার হয়েছে। আজ থেকে আট-দশ বছর আগে যখন আমার বাড়িতে এসেছিলেন, তখন দেখা হয়েছে।
ঠিক বুঝলাম না। খুব পরিচিত দুএকজন ছাড়া কারও বাড়িতে আমি কখনও যাই না। আপনার বাড়ি কোথায়? আর গিয়েইছিলাম বা কী কারণে-বলতে পারবেন?
আমার ধারণা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের স্মরণশক্তি প্রখর হয়। যা হোক, আমার বাড়ি নাটোরের বিড়ালদাহ মাজারের কাছে। আপনাদের কোনও এক আত্মীয়ের বিয়ে ছিল। আপনারা আমার বাসায় কিছু সময়ের জন্যে অতিথি হয়েছিলেন। আমার নাম বৃন্দাবন ঘটক এরপরও যদি চিনতে না পারেন, তো আর কিছু করার নেই।
আমার সবকিছু মনে পড়ল, কিছুটা লজ্জাও পেলাম। এঁর কথা ভুলে যাওয়া খুবই অন্যায় হয়েছে। তার হাত ধরে বললাম, বাবু, আপনাকে চিনতে না পারার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না।
আরে না। এরকম হয়। আসুন, কোথাও গিয়ে একটা বসি। আপনাদের এখন অন্য কোনও প্রোগ্রাম নেই তো?
আজ সন্ধ্যায় ঘোড়ামারায় একটা ভাল হোটেলে আয়োজকরা আমন্ত্রিতদের সম্মানে ডিনারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু সেকথা বৃন্দাবন ঘটককে আর বললাম না।
না। তেমন কিছু নেই। সন্ধেটা ফ্রি আছি। কোথাও যেতে ইচ্ছে হলে চলেন। মন খুলে কথা বলা যাবে।
পদ্মার পাড়ে বিকেলে হাঁটতে ভাল লাগে। চলুন। ওদিকটাতে যাই।
কোনও সমস্যা নেই। আপনি যেখানে ভাল মনে করেন।
চার
রাজশাহী শহরে পদ্মার ধার ঘেঁষে অনেক উঁচু আর বিশাল লম্বা বাঁধ দেয়া হয়েছে। বৃন্দাবন বাবু আমাকে নিয়ে বাঁধের ওপর উঠে হাঁটতে লাগলেন। সবথেকে ভাল লাগল ব্রিটিশ আমলের বড় বড় অফিসারদের বাড়িগুলো যেখানে, সেই জায়গাটা। পদ্মার ধারে লাইন দিয়ে প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডঅলা লাল রঙের বড় বড় সব বাড়ি। দরজার সমান বড় অসংখ্য জানালা তাতে। কোথায় বাড়ি করতে হবে সেটা ইংরেজদের চেয়ে ভাল আর কেউ জানত না। হাত-পা ছড়িয়ে বাঁধের ওপর বসলাম আমরা। এক বাদামঅলাকে ডেকে দুছটাক বাদাম কিনলেন বাবু। বললেন, আসুন, খেতে খেতে গল্প করি।
এইসব বাড়িগুলোতে কারা থাকে এখন?
ডিসি, এসপি, বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার এইসব লোকেরা। ইংরেজ সাহেবদের চেয়েও এদের ঠমক বেশি। দেশের সব ভাল ভাল জিনিস এরাই ভোগ করে। সাধারণ মানুষ আগে ইংরেজদের গোলামি করত, এখন করে এদের দাসত্ব। যেই লাউ সেই কদু।
এ হচ্ছে জর্জ অরওয়েলের দি এনিমেল ফার্ম। সিস্টেম একই থাকে, শুধু তোক পাল্টে যায়। ধনতন্ত্র অবিনাশী।
আগে কিন্তু এরকম ছিল না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে সবকিছু পাল্টে যেত। এই পুরাজ্যের কথাই ধরেন।
বাবু, আপনি পালি ভাষার বিষয়ে অনেক জানেন বলে মনে হচ্ছে। পুরনো জিনিসের মত পুরনো ভাষাতেও আপনার আগ্রহ আছে নাকি? : আগ্রহ ছিল না। তবে বিশেষ কারণে আগ্রহ হয়েছে। আপনার কখনও যাকে বলে অতিপ্রাকৃত এমন কোনও
অভিজ্ঞতা হয়েছে?
জী-না। আমি মানুষ হয়েছি শহরে। আমার ধারণা, অতিপ্রাকৃত ঘটনা শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি ঘটে। প্রাকৃত অপ্রাকৃত কোনও ঘটনা নিয়েই শহরের মানুষের মাথা ঘামানোর সময় নেই। যান্ত্রিকতা এবং ভৌতিকতা দুই মেরুর জিনিস।
এ কথা ঠিক না। শহরেও অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে। তবে সেটা জানাজানি হয় কম। যা হোক, আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে বলি। একদম সত্যি ঘটনা। তখন জানুয়ারির শেষ। আমি বিড়ালদাহ হাইস্কুলে মাত্র ক্লাস সিক্সে উঠেছি। স্কুল থেকে সিদ্ধান্ত হলো সেবছর বার্ষিক পিকনিক হবে নাটোরের রানী ভবানীর প্রাসাদে। চাল, ডাল, মশলা, ছাগল, তেল, হাঁড়ি-পাতিল, থাল, বাটি এসব নিয়ে শিক্ষক-ছাত্র কেরানী-পিওন ঠাসাঠাসি করে দুটো বাসে রওনা হলো। ভোরে বাস ছাড়ার পর সবাইকে কাগজের ঠোঙায় দেয়া হলো মুড়ি ও পাটালিগুড়ের নাস্তা। সেযুগে বোতলের পানি ছিল না। একজগ পানির সবটাই স্যররা খেলেন। আমরা এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকলাম কখন রানী ভবানীর প্রাসাদে পৌঁছব, সেই আশায়। প্রাসাদে পৌঁছে টিউবওয়েল থেকে পেট ভরে পানি খেলাম সবাই। তারপরই ঘটল বিপত্তি। ভোরে উঠে অনেকেই বাথরুম করার সময় পায়নি। দেখা গেল ওই কাজ এখন সমাধা না করলেই নয়। এত বাথরুম তো সেখানে নেই। ঝোঁপঝাড়ই ভরসা। আমি যেখানেই যাই, সেখানেই কেউ না কেউ বসে পেট খালি করছে।
হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম কম্পাউণ্ডের সর্ব দক্ষিণ কোণে। চারদিকে আম-কাঁঠালের বাগান। এরই আড়ালে জবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনদিকে টানা বারান্দাঅলা মন্দির। ধরনের প্রাচীন এক দালান। ছাদ ধসে পড়েছে, কয়েকটা থামে ভর দিয়ে দেয়াল তখনও খাড়া হয়ে আছে বটে, তবে ওগুলো ছেয়ে গেছে বট আর অশ্বত্থ গাছের শেকড়ে। লাল রঙের মেঝে এখনও যথেষ্ট উঁচু। একটাই ঘর, তবে ভেতরে ঢোকার পথ তিনটে। দেয়ালের সাথে ফিট করা লোহার ক্ল্যাম্প দেখে বোঝা যায়, আগে ওগুলোতে দরজা ছিল। ফেটে চৌচির সিঁড়ি বেয়ে উঠে ভেতরে উঁকি দিলাম। ঘরের মেঝে গাছের মরাপাতা, ভাঙা ইটের টুকরো ও ধুলোবালিতে বোঝাই। হঠাৎ চোখে পড়ল লাল-সাদা পাথরের মেঝের এককোণে কালো রঙের স্বস্তিকা আঁকা। স্বস্তিকার চার বাহুতে থেবড়ে বসে আছে হিন্দু ধর্মের চার প্রধান দেবদেবী। এদের চারজনের মাথার ওপর চার পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে এক গাভী। তার পিঠের ওপর কৃষ্ণের কাটা মাথা হাতে বসে আছে মহিষাসুর। পুরো চিত্রটা ছয়কোনা একটা লাল তারার ভেতর আঁকা।