জী, কোদালই বটে। তবে সাধারণ কোদাল না।
কিছু লোক কথা বলার সময় নাটকীয়তা খুব পছন্দ করে। বৃন্দাবন ঘটককে সেই গোত্রের লোক বলে মনে হলো। বললাম, বাবু, বিষয়টা একটু খুলে বলেন না।
ওটা ঠগীদের কোদাল। ঠগীরা মনে করত মন্ত্রপূত কোদাল শক্তির উৎস। একটা দলের কাছে কোদাল থাকত একটাই। জানেন তো একেকটা দলে কোনও কোনও সময় তিন-চারশো ঠগীও থাকত। বিশাল সব কাফেলা। মানুষ শিকারের নেশায় পথ চলছে মাসের পর মাস। এদের হাতে পুরো ভারতবর্ষে প্রতি বছর খুন হত প্রায় পঞ্চাশ হাজার পথিক। চমকে ওঠার মত ফিগারই বটে। তবে নির্ভেজাল সত্যি।
কোদাল বানাতেও অনেক তন্ত্রমন্ত্র পুজোপাঠ, নররক্ত, পশুবলির দরকার হত। সময়ও লাগত প্রচুর। তবে একবার বানানো হয়ে গেলে কোদালের থাকত অলৌকিক ক্ষমতা। এই কোদালকে কুয়োর ভেতর ফেলে দিলেও ওটা একাই উঠে আসত। যাত্রা শুরুর আগে কোদাল মাটিতে ফেলে ঠগীরা জেনে নিত কোন পথে যেতে হবে। কোন পথে পাওয়া যাবে ধনী পথিক, পথ চলতি বণিক কিংবা রাজকর্মচারী অথবা তাদের পরিবার। ঠগীদের মতন নিষ্ঠুর এবং নিপুণ খুনির দল পৃথিবীতে বিরল। এটি আমার কথা নয়, ইংরেজ ঐতিহাসিকদের কথা। ঠগীরা ছিল আমাদের মতই ঘর সংসারী, নিপাট ভদ্রলোক, কিন্তু ছদ্মবেশী এবং নিষ্ঠুরতম খুনি। যে-কোনওরকম রক্তপাত ঠগীদের জন্যে ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এরা নরহত্যা করত গলায় ফাঁস লাগিয়ে। এরপর যেভাবে লাশ গুম করত, সেটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। তারা দেখিয়ে না দিলে কোনওভাবেই সে লাশ খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। মেয়ে-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এদের কাছে সবই সমান। খুনের পর সামান্যতম অনুশোচনাও কখনও অনুভব করেনি। ঠগীরা। কোদাল হারিয়ে ফেললে অর্থাৎ কোদাল নিজ থেকে চলে গেলে ঠগীদের মন ভেঙে যেত। অনেক সময় ভেঙে যেত দলও। বাড়ি ফিরে যতক্ষণ না সর্দার আরেকটি কোদাল তৈরি করতে পারছে, ততক্ষণ খুনোখুনির সব কাজ বন্ধ।
এত দুষ্প্রাপ্য জিনিস আপনি পেলেন কীভাবে?
ও-কথা না-ই বা শুনলেন।
হালকা হেসে কথাটি বলেছিলেন বৃন্দাবন ঘটক।
বৃন্দাবন ঘটকের সাথে পরিচয় এভাবেই। রাস্তাঘাটে খুব বড় উপকার যারা করে, সাধারণত তাদের সাথে এ জীবনে দেখা খুব কমই হয়। হলেও সেই উপকারের এক কণাও ফেরত দেয়া হয় না কখনও। বরং উল্টো এক ধরনের অস্বস্তি হয়।
বৃন্দাবন ঘটকের সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে।
তিন
রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘর, মধ্যযুগের পুণ্ড পাণ্ডুলিপি এবং পালি ভাষার চর্চা এই বিষয়টি নিয়ে এক জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করেছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রিত হয়ে সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম আমি। যাদুঘরের অডিটোরিয়ামে দুপুর দুটোয় বরেন্দ্র অঞ্চলে পালি ভাষার প্রসারের ওপর আমার পেপার প্রেজেন্ট করার পর শুরু হলো প্রশ্নোত্তর পর্ব। কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর ঘোষক যখন আমার প্রেজেন্টেশান শেষ হওয়ার ঘোষণা দিল, ঠিক সেই মুহূর্তে পেছনে একজন উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তার নাকি একটা প্রশ্ন আছে। মাইক্রোফোন ততক্ষণে দর্শকদের হাত থেকে ঘোষকের হাতে ফিরে গেছে।
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ।
আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময় এখন আর নেই, দুঃখিত, ঘোষণা করলেন ঘোষক।
স্টেজ থেকে নেমেই পড়েছিলাম। তারপরেও ঘোষককে বললাম, আচ্ছা, ঠিক আছে। দেখা যাক ওঁর প্রশ্নটা কী।
মধ্যযুগে পুণ্ড্রনগরী অর্থাৎ বগুড়ার মহাস্থান গড়ে পালি ভাষার ব্যাপক চর্চা করতেন একজন প্রখ্যাত মহিলা। যুবতী বয়সে ইনি আত্মহত্যা করেন। বলা হয় এঁর মৃত্যুর পরপরই এ অঞ্চলে পালি ভাষার চর্চা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আপনি এ ব্যাপারে কোনও আলোকপাত করেননি। কেন করেননি?
অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি মফস্বল শহরের এইসব সেমিনারে স্থানীয় কিছু লোক প্রায়ই উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। এরা চায় সেমিনারের বক্তাদের উটকো ঝামেলায় ফেলে বাহবা পেতে। এদের জন্যে একটা আলাদা প্রস্তুতি রাখতে হয়। তবে স্বীকার করতেই হবে, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। পেপার তৈরি করেছি তাড়াহুড়ো করে। এখন বুঝতে পারছি আমার আরও পড়াশুনা করার দরকার ছিল। কিন্তু সেই স্বীকারোক্তি এখন দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, সেই মহিলার নাম কি শীলাদেবী?
এটা একটা চালাকি ধরনের উত্তর। মধ্যযুগের ইতিহাসে শীলাদেবী বেশ প্রচলিত নাম। ভদ্রলোক যদি বলেন হ্যাঁ তা হলে বলব এটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এই ব্যাপারে ঐতিহাসিকরা কেউই একমত হতে পারেননি। ওটাকে কিংবদন্তি ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। আর ভদ্রলোক যদি বলেন না তা হলে বলব আপনি কোন মহিলার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। ইতিহাসে তো শুধু শীলাদেবীর উল্লেখ আছে। তবে তার অবদান তেমন বিশেষ কিছু নয়।
ভদ্রলোকের উত্তর হলো হ্যাঁ বাচক এবং আমিও হা-এর উত্তরে যা বলার তাই-ই বললাম। লক্ষ করলাম, উত্তর শুনে ভদ্রলোক সামান্য হাসলেন। অন্যান্য মফস্বলী পণ্ডিতদের মত তর্ক না জুড়ে বসে পড়লেন। বিকেল পাঁচটায় সেমিনার শেষ করে অডিটোরিয়াম থেকে আমরা সবাই বের হচ্ছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। ঘুরে তাকাতেই দেখলাম পঞ্চাশোর্ধ্ব এক হিন্দু ভদ্রলোক দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই প্রশ্নকর্তা। দেখে যেন মনে হয়: চিনি উহারে। এর আগেও এঁকে কোথাও দেখেছি। লোকটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি পেছন থেকে ডাকছিলেন আমাকে?