দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বলল পাভেল।
অল্প কথায় বুঝিয়ে দিচ্ছি। জ্যোতিষী থেমে দাঁড়াল। ওই আংটিটা প্রেতজগতের অনেকেই হাতে পেতে চায়। রুদ্রর রূপ ধরে একটা প্রেত তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল আংটিটা হাতানোর জন্য। তোর মুখে রুদ্রর নাম শুনেই আংটিটা আমি তোকে দিই। কিন্তু রুদ্রর রূপধারী এই প্রেত আংটিটা দখল করার আগেই আরেকটা অশরীরী, এবং এ প্রথম প্রেতের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী, তোর বাড়িতে পৌঁছে যায় এবং প্রথম প্রেতকে সরিয়ে আংটিটা দখল করে।
তার মানে,..তার মানে… বিশ্বাস করতে পারছে না পাভেল।
তার মানে কাল রাতে দ্বিতীয় প্রেত আমার চেহারা নিয়েই তোর বাড়িতে গিয়েছিল। তুই বিনা দ্বিধায় তাকে আংটিটা দিয়ে দিয়েছিস।
আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি… কী বলবে বুঝতে পারল না পাভেল।
তোর কোন দোষ নেই। তুই তো আর আসল ঘটনা জানতিস না।
এবার রুদ্র মুখ খুলল। যাই হোক, দোস্ত, এবার আমরা যাই। অনেক কাজ বাকি। শয়তানটাকে ধরতেই হবে।
– হ্যাঁ, হাতে সময় বেশি নেই। তা হলে এবার তুই চোখ বন্ধ কর! পাভেলের দিকে তাকিয়ে বলল জ্যোতিশ্চন্দ্র। চোখ বুজল পাভেল।
এক…দুই…তিন!
বজ্রযোগীর প্রত্যাবর্তন – মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর
এক
বৃন্দাবন ঘটকের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার এক আত্মীয়ের বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে যাওয়ার সময়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ে-মুসলমানী এইসব অনুষ্ঠান আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। বিয়ে বাড়িতে যতবার গিয়েছি ততবারই আনন্দের চেয়ে বেদনাই বেশি হয়েছে। এখনকার কথা বলতে পারব না, তবে আগের দিনে কোনও একটা গণ্ডগোল মন কষাকষি কিংবা দুর্ঘটনা ছাড়া বিয়ে হওয়া অসম্ভব ছিল। আমার ছোট চাচার বিয়ে হয়েছিল বছরের সবথেকে ছোট দিন ২২শে ডিসেম্বর রাতে। উনপঞ্চাশ মাইল দূরে কনের বাড়ি। সারাদিনের পথ। সকাল সাতটায় বারাত বের হওয়ার কথা ছিল। সেটা বেরুতে বেরুতে বাজল এগারোটা। দাদা হাঁপানির রোগী। ভোর বেলায় ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছেন, এমন সময় শুরু হলো শ্বাস-কষ্ট। চোখের পাতাটাতা উল্টে বিশ্রী কাণ্ড। ওরে আমার কী হলো রে, বলে পাড়া মাথায় তুলে ফেলল দাদী। যমের জিম্মায় বাপকে রেখে কোন্ ছেলে আর বিয়ে করতে যাবে? ঘণ্টা তিনেক পর দাদা খানিকটা সুস্থ হয়ে হাঁসের মত ফ্যাসফাস করে বললেন, মেয়ের বাপকে পাকা কথা দেয়া আছে। এ বিয়ে হতেই হবে। এক্ষুণি বেরোও।
মফস্বলের বিয়ে হিটলারের প্যাঞ্জার বাহিনী না যে এক্ষুণি বেরুতে বলল আর তক্ষুণি লেফট-রাইট করতে করতে দশ প্লাটুন বেরিয়ে গেল। মেয়েরা সব কাপড়টাপড় খুলে স্নো পাউডার মুছে পানের বাটা নিয়ে বসেছে। ছেলেরা যে যার মত এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। চায়ের দোকানে বসে বিড়ি-সিগারেট ফুকছে। তাদের এত কীসের গরজ! যার বিয়ে সে বুঝুক। ছোট চাচা ফুসুরফুসুর করে আমার ফুপাকে বললেন, দুলাভাই, তাড়াতাড়ি করেন। অলরেডি অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। অত দূরের পথ…।
তা তো বটেই। তবে তার থেকে বড় জিনিস হলো পরীর (আমার ফুপাতো বোন) নানার যদি আবার হাঁপানির টান ওঠে, তা হলে তোর বিয়ের ফুল কুঁড়িতেই বিনাশ। নিপ ইন দ্য বাড। এদিকের লোকে বলবে, মেয়ে অলক্ষুণে, ওদিকের ওরা বলবে ছেলের বংশে হাঁপানি-পাগলামি এইসব আছে। এখানে বিয়ে দেয়া যাবে না। একবার বেরুতে পারলে হাঁপানি হোক আর হ্যাঁমারেজ, আগে বিয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। তোর ব্যাপারটা আমি বুঝি। একদম টেনশান করিস না। দুমিনিটের ভেতর বারাত বেরুনোর ব্যবস্থা করছি। তোর বিয়ে আজকেই হবে।
পরীকে ডেকে ফুপা বললেন, এই, পরী, তোর মাকে একটু ডাক তো। এমনি এমনি ডাকছে বললে এখন কিছুতেই আসবে না। বলবি, আব্দু প্রেশারের ওষুধ খুঁজে পাচ্ছে না। আব্দুর বমি-বমি লাগছে। বলবি আমি বিছানায় শুয়ে আছি।
ফুপু এলেন প্রায় সাথে সাথে।
ফুপা বললেন, জরী, জরুরি কথা শোন, ওই চিটার কন্ট্রাকটার ঝন্টুকে তো চেনো। এই হারামজাদা আজ দুবছর হলো দুলাখ টাকা নিয়ে আজ দেব কাল দেব করছে। শেষমেষ কানা কামালকে লাগিয়েছিলাম। টাকা দিতে পারবে ঝন্টু। তবে রাস্তার ধারে ওর পাঁচ কাঠা জমি আছে। ওটা লিখে দিতে চাচ্ছে। কানা কামাল খবর পাঠিয়েছে, কালকেই ঝন্টুকে রেস্ট্রি অফিসে ধরে নিয়ে আসবে। ভাবছি, জমিটা তোমার নামে রেস্ট্রি করাব। জামিলের বিয়েটা হয়ে গেলে ওখান থেকেই বাড়ির পথে রওনা হয়ে যেতাম। যে অবস্থা দেখছি তাতে বারাত আজ বের হবে বলে তো মনে হচ্ছে না। ওদিকে কাল যদি বাড়ি না পৌঁছতে পারি, তা হলে ঝন্টুকে আবার কবে ধরতে পারব কে জানে! এরা হলো ফটকাবাজ লোক। একপোজনের কাছে টাকা ধার করে বসে আছে।
পরী বলল তোমার প্রেশার, ওষুধ খুঁজে পাচ্ছ না। দাঁড়াও, ওষুধ খুঁজে দিচ্ছি। আগে ওষুধ খাও, তারপর বিয়ের ব্যাপারটা দেখছি।
এইবার কাজ হলো কারেন্টের মত। ছোট চাচার বারাত বেরিয়ে গেল দশ মিনিটের ভেতর। এক ধ্যাড়ধ্যাড়া বাসে আমরা চৌত্রিশজন বরযাত্রী রওয়ানা হলাম। রাস্তা খানা-খন্দে ভর্তি, গাড়ি চলছে খুব ধীরে। নাটোরের বিড়ালদাহ মাজারের কাছে রাস্তা ভাল পেয়ে ড্রাইভার স্পিড উঠাল। গাড়ি চলছে। সাঁই-সাই। জানালা দিয়ে হু-হুঁ করে বাতাস ঢুকছে ভেতরে। আরামে অনেকেরই চোখ বুজে এসেছে, দুর্ঘটনাটা ঘটল ঠিক সেই সময়। কোত্থেকে একটা ছাগল এসে দৌড়ে রাস্তা পার হতে শুরু করল। ড্রাইভার ছাগল বাঁচাতে যেয়ে এক বাগানে নামিয়ে দিল বাস। সামনের চাকা হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল এক চৌকো গর্তে। ভাগ্য ভালই বলতে হবে, হতাহত হয়নি কেউ। কাণ্ড দেখে আশপাশ থেকে কিছু লোকজনও এসে উপস্থিত হলো। জানা গেল পরিত্যক্ত এক গোরস্থানের বহু পুরনো কবর ওটা। বয়স্ক অনেককেই বেশ চিন্তিত মনে হলো। যাত্রার প্রথম থেকেই বাধা। কবরে যানবাহন পড়ে যাওয়া বড় ধরনের কুলক্ষণ। বিপদের হাত-পা নেই, কখন কোন্ দিক থেকে আসে কে জানে! বাস কবর থেকে উঠানো হবে কীভাবে? হলেও ওটা আবার চালু হবে কিনা সেটাই বা কে বলতে পারে? কনের বাড়ি এখনও ত্রিশ মাইল পথ। ভাল মুসিবতে পড়া গেছে। মেয়েদের কেউ কেউ বাথরুমে যাওয়ার জন্যে অস্থির। স্থানীয় কিছু লোক বলল একটু দূরেই বৃন্দাবন ঘটক নামে এক প্রাইভেট কলেজের শিক্ষকের দালান বাড়ি। মহিলারা সেখানে গেলে ভালভাবে বাথরুম করতে পারবে। মেয়েরা দল বেঁধে বৃন্দাবন ঘটকের বাড়ির পথে রওনা হলো। সাথে ছোট চাচা, ফুপা আর আমি।
দুই
জানালা দরজায় খড়খড়ি লাগানো ব্রিটিশ আমলের পুরনো দোতলা বাড়ি। বাগান ও বারান্দা সব ঝকঝকে তকতকে। বোঝাই যাচ্ছে এরা বনেদি পরিবার এবং এখনও সচ্ছল। এক রামুকাকু শ্রেণীর লোক আমাদের বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরে খবর দিতে গেল। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন বাড়ির মালিক বৃন্দাবন ঘটক। ধুতি-ফতুয়া পরা ছোট করে ছাটা চুল, স্বাস্থ্য একটু মোটার দিকে। তিনি আমাদের চা নাস্তা তো খাওয়ালেনই, সেই সঙ্গে একটা গাড়িরও ব্যবস্থা করে ফেললেন। ভদ্রলোক আমাদের তিনজনকে নিয়ে চা খেলেন তার পড়ার ঘরে। লক্ষ করলাম, কামরার আলমারিতে সাজানো অদ্ভুত দর্শন সেকেলে সব জিনিস। এসবের ভেতর তিনটে জিনিস দেখলে গা শিরশির করে। একটা হলো পূর্ণ বয়স্ক সক্ষম পুরুষদের অণ্ডকোষ চূর্ণ করে পুরুষত্বহীন বা খোঁজা করার যন্ত্র। আর একটি জিনিস হচ্ছে শূল। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিকে শূলে চড়িয়ে মারা হত। কাঠের মোটা পাটাতনের সাথে নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে শক্ত করে বসানো তীক্ষ্ণ মাথাঅলা সাড়ে তিন ফুট লম্বা লোহার প্রায় তিন ইঞ্চি মোটা একটা রড। রডে ভাল করে ঘি-তেল-কলা মাখিয়ে আসামিকে তার ওপর বসিয়ে দেয়া হত। রডের চোখা মাথা আসামির গুহ্যদ্বার দিয়ে ঢুকে গলা-মুখ কিংবা চোখের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যেত। অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক বীভৎস মৃত্যু। এর তুলনায় ফাঁসি অনেক আরামদায়ক। তিন নম্বর হলো ছোট লম্বাটে একটা কোদাল। কোদালের আকৃতি এবং গঠনই বলে দিচ্ছে ওটা মাটি কোপানো সাধারণ কোদাল না। খুব কৌতূহল হলো। বৃন্দাবন ঘটককে জিজ্ঞেস করলাম, এটা তো মনে হচ্ছে কোদাল, ঠিক না?