শিশিটা পাভেলের গায়ে এসে পড়ল। তখনও সংবিৎ ফিরে পায়নি সে। কোনমতে কাঁপা কাঁপা হাতে শিশির মুখ খুলল। ওদিকে, পাভেলের হাতে শিশিটা দেখেই তীব্র আক্রোশে গর্জন করে উঠল দানবটা, আর তার ছটফটানির মাত্রাও বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
পাভেল আর দেরি করল না। শিশির ভেতরের তরলটুকু ছুঁড়ে দিল দানবটার গায়ে। মনে হলো আগুন ধরে গেছে, এভাবে চেঁচিয়ে উঠল শয়তানটা। কিন্তু ঘাড়ে চেপে বসে আছে জ্যোতিষীর বজ্রমুষ্টি, একচুলও শিথিল হলো না। ছটফট করতে করতে তীব্র আক্ষেপে ধারাল নখ দিয়ে নিজের গায়ের মাংস খুলে আনতে শুরু করল দানবটা, সেই সঙ্গে চলছে।
পাভেল এতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যের দিকে। হঠাৎ দেখল, দানবটার জায়গায় ছটফট করছে রুদ্র, সেই পুরানো রক্তমাংসের রুদ্র। মুখ তুলে পাভেলের দিকে তাকাল সে। দোস্ত, বড় কষ্ট হচ্ছে আমার! আমাকে বাঁচা, দোস্ত, আমাকে বাঁচা!
কেমন যেন ঘোর পেয়ে বসল পাভেলকে। ধীরে ধীরে দুপা এগিয়ে গেল সে, উদ্দেশ্য রুদ্রকে জ্যোতিষীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ধমক শুনতে পেল, খবরদার! ওর মায়ায় ভুলিস না! বিড়বিড় করে কী যেন বলে তীব্র ঘৃণায় এক দলা থুথু ছিটিয়ে দিল জ্যোতিষী রুদ্রর মুখে। পরক্ষণে আরেকবার বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠল রুদ্র। তারপর দপ করে আগুন জ্বলে উঠল তার শরীরে, নিমিষে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সে। ঘরের বাতাসে কেবল ভেসে রইল মাংস পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ।
এতক্ষণে হুঁশ ফিরে পেয়ে লোকটার দিকে তাকাল। পাভেল। আ-আ-আ-আপনি… তোতলাচ্ছে সে।
হ্যাঁ, আমি। মুচকি হাসল জ্যোতিষী। দেখা যাচ্ছে ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলাম।
কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?
ধ্যানে। তোর পিছনে আমি একটা কালো ছায়া দেখতে পাই। বুঝতে পারি তোর বড় কোন বিপদ আসন্ন এবং সেটা এই পৃথিবীর কারও কাছ থেকে নয়। আংটির ক্ষমতা খুব সামান্য, ওটা তোকে বাঁচাতে পারত না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে নিজেই আসতে হলো।
আর…আর রুদ্র?
এ রুদ্র নয়, সে তো নিজের চোখেই দেখলি। তোর বন্ধু রুদ্র তিন বছর আগেই মারা গেছে। এই প্রেত তোর পিছে লেগেছিল অনেক আগে থেকে। তোর জীবনে ইদানীংকালের ভেতর যেসব বিপদ এসেছে তার সবগুলোর পিছনেই এর হাত ছিল।
ত-তার মানে? আমাকে এসব বিপদে ফেলে ওর কী লাভ?
ও আসলে আমার কাছেই আসতে চেয়েছিল। কিন্তু খুবই নিম্নস্তরের শক্তি ধরে ওর মত অশরীরীরা, আমার ধারে কাছেও যে কারণে ও ভিড়তে পারত না। এজন্যেই ও তোর সাহায্য নিয়েছিল। প্রথমে তোকে নানা বিপদে ফেলে মানসিকভাবে দুর্বল করে নেয়। তারপর রুদ্র সেজে আসে তোর কাছে। জানত আমার কথা বললে পুরানো বন্ধুর কথা তুই ফেলবি না। আংটিটা আমার কাছে আছে এটা কেউ জানত না। আমি বেশিদিন হাতে রাখতে চাইনি, কারণ অশরীরী জগতে আমার একটু বেশিই আনাগোনা। যে কেউ জেনে যেতে পারত। এই আংটিটা দেখতে খুবই সাধারণ, কিন্তু এটা হাতে পেলে ওর শক্তি বহুগুণে বেড়ে যেত। জিনিসটা মানুষের চেয়ে অশরীরীদের জন্যেই বেশি দরকারী।
কিন্তু ও যদি ভালভাবে চাইত, তা হলেই তো আমি দিয়ে দিতাম। এর জন্য এত ঝামেলার কী দরকার ছিল?
ওই যে বললাম, নিম্নস্তরের অশরীরী। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। আংটিটা দেখে লোভের ঠেলায় মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আর এমনিতেও ও তোকে মেরেই ফেলত।
এখন তা হলে কী হবে? অসহায় মুখে প্রশ্ন করল পাভেল।
ওরা যেহেতু জেনে গেছে এটা তোর কাছে আছে, আমার মনে হয় আংটিটা তোর কাছে রাখা আর উচিত হবে না। আমি নিয়ে যাচ্ছি। আর তোর বিপদের কারণ উদ্ঘাটিত হয়ে গেল, আশা করা যায় আর কোন বিপদে তুই পড়বি না। সুতরাং এই আংটিরও আর কোন দরকার নেই তোর। আসি। মৃদু হেসে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল জ্যোতিষী। হতভম্বের মত দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল পাভেল।
.
শেষ চমকটা অবশ্য তখনও পাভেলের জন্য অপেক্ষা করছিল।
পরদিন সকালবেলা।
এমন ভয়ই পেয়েছিল পাভেল, শেষ পর্যন্ত একা একা নিজের বাড়িতে না থেকে পাশের আঙ্কেলের বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়েছিল। সাতসকালে বাড়িতে আসতেই দেখল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে দুজন লোক। সেই জ্যোতিষী! …আর…রুদ্র!
র-রুদ্র? তুই? তুই না মরে গেছিস? প্রায় ককিয়ে উঠল পাভেল।
আমি মরিনি। ভয় পাসনে। গায়ে হাত দিয়ে দেখ, আমি রক্তমাংসের মানুষ। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল রুদ্র। এ রুদ্রর হাত স্পর্শ করে ভয় অনেকটা কাটল পাভেলের।
তা ছাড়া সকালের আলো, চারদিকে, রাস্তা দিয়ে লোকজন। চলাফেরা করছে। কাল রাতের ঘটনাগুলো কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল এখন। কিন্তু…ওরা এখানে কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জ্যোতিষীর দিকে তাকাল পাভেল।
আংটিটা কোথায়? পাভেলের চোখ তার দিকে ফিরতে জিজ্ঞেস করল জ্যোতিষী।
কোথায় মানে? আমি না ওটা কাল রাতেই আপনাকে দিয়ে দিলাম? হকচকিয়ে গেল পাভেল।
সব কথা খুলে বল। গতকাল আমার কাছ থেকে আসার পর কী কী হয়েছে সবকিছু।
জ্যোতিষীর কথা মত সব খুলে বলল পাভেল। কথা শেষ হতেই হতাশায় মাথার চুল খামচে ধরল রুদ্র। সব শেষ হয়ে গেল, গুরু! হতচ্ছাড়া প্রেতটাকে কিছুতেই আটকানো গেল না!
চল, দেখি কী করা যায়। কিছুতেই ছাড়ব না ওই শয়তানকে আমি। দৃঢ় গলায় বলল জ্যোতিষী।