লোকটার হাত চেপে ধরল পাভেল। থামুন! ধমকে উঠল ও। যেসব কথা কারও জানার কথা নয় সেসব এই লোক কীভাবে জানে? কে বলেছে আপনাকে এসব কথা? জিজ্ঞেস করল ও।
তুই বলেছিস। এইমাত্র। ফিক ফিক করে হাসছে লোকটা, পাভেলের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে খুব মজা পেয়েছে যেন।
ভাষা হারিয়ে চুপ করে থাকল পাভেল। কিছুক্ষণ পর বলল, তা হলে আপনি এখন বলুন, আমি কী করব?
শোন। উপরে একজন বসে আছে। আঙুল দিয়ে উপরে দেখাল লোকটা। আমরা হচ্ছি তার হাতের সুতোয় বাঁধা পুতুল। সে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নাচায়। আমরা নাচি। তার ইচ্ছে রদ করার ক্ষমতা কোন বাপের ব্যাটার নেই। লোকটার গলা এখন কিছুটা নরম। আমারও ক্ষমতা নেই তোর জন্যে কিছু করার। সামনে আরও বিপদ আসতে পারে তোর। আমি সেগুলো আটকাতে পারব না। তবে এটা রাখ। এই বলে নোংরা পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী একটা বের করে পাভেলের হাতটা টেনে নিয়ে খোলা তালুর উপর রাখল লোকটা। জিনিসটা কালো রঙের একটা আংটি। খুব সম্ভব লোহার তৈরি। পাথরের জায়গায় একটা মানুষের মুখ খোদাই করা।
কী হবে এটা দিয়ে? জিজ্ঞেস করল পাভেল।
বাড়ি গিয়ে গোসল করে পরবি আংটিটা। সবসময় এটা পরে থাকিস। বিপদ-আপদ যা আসে আসবে। এই আংটিটা তোর বিপদ কাটাতে না পারলেও তোর মাথা ঠাণ্ডা রাখবে, কীভাবে বিপদ কাটবে সেটা বুঝতে সাহায্য করবে। কখনও খুলবি না। আর এইবার চোখ বন্ধ কর। আমি তিন পর্যন্ত। গোনার পর চোখ খুলবি।
চোখ বুজল পাভেল। লোকটা গুনতে শুরু করল, এক…দুই…তিন।
চোখ খুলতেই পাভেল দেখল, একা একা বসে আছে। সে। সামনে কেউ নেই। আশপাশে যতদূর চোখ যায় কোন জনমানুষের চিহ্ন নেই। স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন। লোকটা।
.
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল পাভেলের। মধ্যরাতের সুনসান গলি দিয়ে সে যখন বাড়ি ফিরছে তখন হঠাৎ ঘাড়ের কাছটা। শিরশির করে উঠল। পিছনে কার পায়ের শব্দ? ঘুরে তাকিয়ে অবশ্য কাউকেই দেখতে পেল না পাভেল। মনের ভুল ভেবে আবার পা চালাল সে। বাসায় ঢুকেই অবাক হয়ে গেল। পাভেল। বসার ঘরের আলো জ্বলছে। আর সোফায় বসে পা নাচাচ্ছে রুদ্র। পাভেল ঢুকতেই জ নাচাল। কী রে? দেখা হলো জ্যোতিশ্চন্দ্রের সাথে?
তা হয়েছে। কিন্তু তুই ভিতরে ঢুকলি কীভাবে? জিজ্ঞেস করল পাভেল।
অনেকদিন মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি, দোস্ত। নিয়মকানুন সব ভুলে গেছি। পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়েছি আর কী। পরে ছাদে উঠে তোদের বাসার ভেতর। ক্ষমাপ্রার্থনার হাসি দিল রুদ্র। এখন বল, কী বললেন জ্যোতিশ্চন্দ্র?
কী বলবেন? এই আংটিটা দিয়ে বললেন সবসময় পরে থাকতে। পকেট থেকে আংটিটা বের করল পাভেল।
আংটিটার দিকে চোখ পড়া মাত্র লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রুদ্র। মুখের ভাব আমূল বদলে গেছে। চোখে যে দৃষ্টি সেটা একমাত্র ছাগলের দিকে তাকিয়ে থাকা ক্ষুধার্ত বাঘের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। দেখি আংটিটা! পাভেলের দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা গলায় হুঙ্কার ছাড়ল সে।
ত-তুই এরকম করছিস কেন? রুদ্রর ভাবভঙ্গি দেখে ভড়কে গেছে পাভেল।
আংটিটা দে আমাকে! আবার গর্জে উঠল রুদ্র। মনে হলো বুকের অনেক গভীর থেকে উঠে এল গর্জনটা। গলার স্বরও বদলে গেছে তার। কেমন, ঘড়ঘড়ে, জান্তব আওয়াজ। চোখ দুটো জ্বলছে জ্বলজ্বল করে।
কী মনে হলো পাভেলের, আংটিটা মুঠোয় ভরে ফেলল সে। তারপর, হঠাৎ করে রুদ্রর বাড়ানো হাতের দিকে চোখ গেল তার। বহুদিনের পচন ধরে শুকিয়ে যাওয়া মড়ার মত শুকনো, কোঁচকানো সে হাতের চামড়া আঙুলের মাংসহীন হাড়গুলো জড়িয়ে রেখেছে। বড় বড় লোম উঠেছে এখানে সেখানে। পাঁচটা আঙুলের মাথায় তীক্ষ্ণ, বাকানো নখ! এ গলা শুকিয়ে এল পাভেলের। এ আর যে-ই হোক, রুদ্র নয়! প্রচণ্ড অবিশ্বাসে পিছু হটতে গিয়ে সোফায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। ওদিকে রুদ্রর মুখেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। স্বাভাবিক চেহারা দ্রুত বদলে রূপ নিচ্ছে এক ভয়াবহ দানবে। মুখের চামড়ায় কালচে রং ধরল, তারপর পচে গলে গিয়ে খসে পড়তে শুরু করল চামড়া। একটা চোখ কোটর থেকে খসে বাইরে ঝুলে পড়ল, চোয়ালের চামড়া দুফাঁক হয়ে বেরিয়ে এল তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত। লকলকে জিভ বেরিয়ে ঝুলে পড়ল মুখের এক পাশ দিয়ে। দমকা বাতাসের একটা ঝাঁপটার সঙ্গে পাভেলের উপর ঝুঁকে এল শয়তানটা। দে আংটিটা!
আংটি দেবে কী, পাভেল তখন ভয়ে আধমরা। থরথর করে কাঁপছে তার পুরো শরীর। দানবটা ধীরে-ধীরে পাভেলের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এল। এত কাছে যে বিচ্ছিরি পচা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল পাভেলের নাকে। যে কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারাবে সে। তারপর, হঠাৎ করে পাভেলের উপর থেকে সরে গেল বীভৎস মুখটা। মনে হলো কে যেন এক টান মেরে সরিয়ে নিয়ে গেল। তৃতীয় এক ব্যক্তি এসে ঢুকেছে ঘরে। সেই জ্যোতিষী!
রুদ্রবেশী দানবটার ঘাড় ধরে তাকে টেনে সরিয়ে এনেছে। লোকটা। নিষ্ফল আক্রোশে হাত পা ছুঁড়ছে দানবটা, কিন্তু জ্যোতিষীর কোন বিকার নেই। যেন একটা ছমাসের শিশুকে ধরে রেখেছে। তা হলে এই ব্যাপার? এই শয়তান তোর পিছনে লেগেছে? আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার! কথা কটা বলে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে পাভেলের দিকে ছুঁড়ে দিল লোকটা। এটা খুলে ওর গায়ে ছিটিয়ে দে দেখি!