গর্ভধারণ করল অব্জা, জন্ম হলো হারীতের। প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হয়েছিল এই হারীত। এক রাতে সে স্বপ্নে দেখল, মাঠের পর মাঠ সোনালি ধানের খেত। শীষে এত বেশি ধানের ছড়া যে নুয়ে পড়ছে গাছগুলো। কিন্তু ফসল তোলার আগেই হাড় জিরজিরে দুটো গরু খেয়ে সাফ করে দিচ্ছে একটার পর একটা ফসলের খেত। পর-পর তিন রাত একই স্বপ্ন! গণকদের ডেকে স্বপ্নের অর্থ জানতে চাইল হারীত। গণকেরা বলল, মহারাজ, ধন-রত্নে আপনি কুবেরকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ভয়ানক ঈর্ষাকাতর এই যক্ষ দেবতা কুবের। সম্পদ বাঁচাতে চাইলে একটা মন্দির তৈরি করে গোমুখী যক্ষকে উৎসর্গ করুন। গোমুখীই তখন আগলে রাখবে আপনার যত ধন-সম্পদ। গোমুখী যেখানে থাকে, সেখানে কখনও যায় না কুবের। তবে জায়গা নির্বাচনের বিষয় আছে। চারদিকে পাহাড় ঘেরা উপত্যকার এক অংশে, যেখানে পাহাড়ের প্রান্ত থেকে ত্রিশূলের মত তিনটে শৈলশিরা বেরিয়েছে, তার ঠিক উল্টোদিকে বানাতে হবে গোমুখী যক্ষের মন্দির।
এর কারণ, পৃথিবীতে নেমে আসার সময় ওখানেই প্রথম পা রেখেছিল গোমুখী। মন্দির তৈরি হলে পর এক শ মাদী মোষ বলি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলো গোমুখীর মূর্তি। ভেট হিসেবে দেয়া হলো এন্তার সোনা-রুপো, দামি-দামি রত্ন। তারও, অনেক পরে শিশুনাগ বংশের রাজা মহাপদ্ম নন্দ এখানে করেছিল শহরের পত্তন। ঘোষণা করেছিল, এই নগরীতে রক্তপাত নিষিদ্ধ। কোনও সেনাবাহিনী আনা যাবে না এখানে। হাত দেয়া যাবে না মন্দিরের ধন-রত্নে। এরপর মৌর্য সম্রাট বিন্দুসার এখানে গড়ে তোলে বিরাট এক দুর্গ নগরী। ততদিনে ফুলে ফেঁপে উঠেছে মন্দিরের রত্ন ভাণ্ডার।
ভালই চলছিল সবকিছু, তবে গোল বাধল মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের সময়ে। বিন্দুসারের অধস্তন সপ্তম পুরুষ এই বৃহদ্রথ। ঠিক সেসময় ব্যাকট্রিয়ার রাজা গ্রিক বীর ডেমিট্রিয়াস আফগানিস্তান আক্রমণ করে কাবুল থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত দখল করে বসল। তার মূল লক্ষ্য এখন পাটলিপুত্র বা বিহারের সম্রাট বৃহদ্রথ! চারদিকে সাজ-সাজ রব, বাজছে যুদ্ধের দামামা। মৌর্য বংশ তখন পড়তির দিকে। টাকা নেই রাজকোষে। ওদিকে যুদ্ধের জন্য চাই কোটি-কোটি টাকা। বৃহদ্রথ পাটলিপুত্র থেকে চলে এল এই নগরীতে। উদ্দেশ্য মন্দিরের গর্ভগৃহ ভেঙে অন্তত অর্ধেক ধন-রত্ন হাতিয়ে নেয়া। মন্দিরের পুরোহিতরা পইপই করে নিষেধ করল সম্রাট যেন এই কাজটি না করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বৃদ্ৰথকে তখন যমে ধরেছে!
সেই ক্রান্তিলগ্নে বিশাল এক কুচকাওয়াজের আয়োজন করল বৃহদ্রথের সেনাপতি পুশ্যমিত্র শুঙ্গ। হাজার বছরের নিয়ম ভেঙে এখানেই জড় করল মৌর্য সেনাবাহিনীর সব সদস্য। নগরীর তোরণের সামনে উঁচু ম্যারাপের ওপর বসল বৃহদ্রথ। উদ্দেশ্য, গ্রহণ করবে সেনাবাহিনীর অভিবাদন। কুচকাওয়াজ চলাকালেই পুশ্যমিত্র আর তার অনুসারীরা ম্যারাপের ওপর খুন করে ফেলল সম্রাট বৃহদ্রথকে। নিজেকে মগধের সম্রাট ঘোষণা করল শুঙ্গ বংশের পুশ্যমিত্র। ভয়ানক পরধর্ম বিদ্বেষী ছিল এই শুঙ্গ ব্রাহ্মণেরা। মৌর্যরা ছিল বৌদ্ধ। সূচনা হলো বৌদ্ধদের ওপর সীমাহীন নিপীড়নের প্রথম কাহিনীর। মন্দির গর্ভে গোমুখীর মূর্তি সরিয়ে বসানো হলো কুম্ভন যক্ষের মূর্তি। যক্ষরা ভাল-মন্দ দুধরনেরই হয়। কুম্ভন। হলো রক্তপিপাসু এক ভয়ঙ্কর অপদেবতা! কুঞ্জন দেবতার পায়ের নিচে থাকে লোহার দরজা আঁটা কষ্টিপাথরের তৈরি কাল-কুঠুরি। আট-দশ বছরের ছেলেদের স্নান করিয়ে, ভাল মন্দ খাইয়ে, দামি পোশাক পরিয়ে সিঁদুর-চন্দন লেপে এই কাল-কুঠুরিতে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় দরজা। খেতে না পেয়ে ধীরে-ধীরে শুকিয়ে মরে তারা। ক্রমাগত সাত দিন ধরে শোনা যায় তাদের কান্নার আওয়াজ। বাইরে বেরোবার জন্যে মাথা কুটে মরছে লৌহ-কপাটে! এখানেই শেষ নয়। পুশ্যমিত্র তেঁড়া পেটাল, প্রতিটি বৌদ্ধ পুরোহিতের কাটা মাথা এনে। দিলে দেয়া হবে এক শ স্বর্ণমুদ্রা। রাতারাতি উজাড় হয়ে গেল পাঁচ শ বৌদ্ধাশ্রমের হাজার-হাজার ভিক্ষু! শত-শত। বৌদ্ধ শিশু এনে ভরে দেয়া হলো কাল-কুঠুরিত্নে।
বাবারও বাবা থাকে। ডেমিট্রিয়াস, যাকে পুরাণে বলা হয়েছে ধর্মমিতা, সে এগিয়ে এল এই ক্রান্তিলগ্নে। গ্রিক দেবী অ্যাথিনার পূজারী ডেমিট্রিয়াস। অতি সূক্ষ্ম এর রুচিবোধ। এন্তার সুশৃঙ্খল গ্রিক পদাতিক আর দুর্ধর্ষ মোঙ্গলীয় ঘোড়সওয়ারে বোঝাই তার সেনাবাহিনী। ডেমিট্রিয়াসের বাহিনীর সামনে খড়কুটোর মত উড়ে গেল পুশ্যমিত্রের ধুতি পরা, অর্ধ-উলঙ্গ, খালি পায়ের বিহারী সৈন্যের দল। অবস্থা বেগতিক দেখে পাটলিপুত্র ছেড়ে পালাল পুশ্যমিত্র। পথে পড়ল বুদ্ধগয়া। এখানেই বিশাল এক ডুমুর গাছের নিচে বসে দশ বছর ধ্যান করে বোধি বা জ্ঞান লাভ করেন গৌতম বুদ্ধ। প্রচার শুরু করেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের। পুশ্যমিত্রের জন্মের চার শ বছর আগের ঘটনা সেটা। পুশ্যমিত্রের সাথে তখনও জনাবিশেক দেহরক্ষী ছিল। ঘোড়ার পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অজস্র ধন-রত্ন। সে ভাবল, নেড়েদের বিনাশ পুরোটা হয়নি। এখনও। শেষ বেলায় মহা-পবিত্র এই বুদ্ধগয়া ধ্বংস করে তারপর উত্তরে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেব। সঙ্গে যা টাকা পয়সা আছে, সেগুলো খরচ করে গড়ে তুলব অজেয় সেনাবাহিনী! তবে তার আগে চরম শিক্ষা দিতে চাই বৌদ্ধদের। মৌর্য সম্রাট ছাড়া অন্য কাউকে মানতেই চায় না এরা। এইবার বুঝবে পুশ্যমিত্রের ব্রাহ্মণ্যবাদ কী জিনিস! জয়, বাবা কুম্ভন যক্ষ, বলে বোধিবৃক্ষের দিকে লোকজন নিয়ে রৈ রৈ করে তেড়ে গেল সে। তবে গাছের গোড়ায় ছোট্ট মন্দিরটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। এ কী! মন্দিরের ভেতর বুদ্ধের মূর্তির সামনে মেঝের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে থাকা এই অপূর্ব রূপসী যুবতীটি কে? এত সুন্দর মানবীও আবার জন্মায় নাকি! এর ওপর থেকে তো চোখই সরানো যাচ্ছে না! দণ্ডের মত পুশ্যমিত্রেরও কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল। সব ভুলে লুটিয়ে পড়ল যুবতীর পায়ে। নিজেকে সমর্পণ করে বলল, প্রেম দাও, প্রিয়ে। তার বিনিময়ে নিয়ে নাও আমার যত ধন-রত্ন।