এরপর সন্ন্যাসী পরিষ্কার বাংলায় বললেন, এখানে এলেন কীভাবে? স্থানীয় লোকেরাই তো আসে না এ জায়গায়!
এখানে আসার পেছনের ইতিহাস ভেঙেচুরে বললাম আমি। সব শুনে উনি শুধু বললেন, এই কালান্তক যুদ্ধই শেষ করবে মানবজাতিকে। সেই যে শুরু হয়েছে আদ্যিকালে, এখনও চলছেই। সব মানুষ মেরে তারপর থামবে ওটা! ওই যে সামনে বিরাট নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখছেন? ওটার কারণও এই যুদ্ধ। লড়তে-লড়তেই শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার সব লোক। সর্বশেষ যারা বেঁচে ছিল, দাস হিসেবে বিক্রি হয়েছে তারা। ওটা এখন হানাবাড়ি বা হানাশহর, শত শত বছর ধরে পড়ে আছে ওভাবেই!
বললাম, কেউ নেই তাই বা বলি কী করে? আপনি তো আছেন? তা ছাড়া, কোনও বাঙালি যে কাপালিক সাধু হয়, তাই তো কোনওদিন শুনিনি। আপনার দেশের বাড়ি কি ওপারে কোথাও?
আমার কথা শুনে মৃদু হাসলেন কাপালিক। বললেন, সব প্রশ্নের উত্তর তো দেয়া যাবে না, বাবা। বরং সামনের ওই খাণ্ডালার ব্যাপারে বলি। এখনকার যে ভাঙা দালান দেখছ, ওগুলোর কিছু-কিছু নবাব শাহ ইউসুফ জাইয়ের আমলের। বিরাট এক নগরী ছিল তখন ওটা। সে-ও তিন শ বছর আগের কথা। এই নগরী আসলে আগে থেকেই ছিল। তৈরি হয়েছিল প্রায় তিন হাজার বছর আগে। দণ্ডকের ছেলে অযোধ্যার রাজা হরীত প্রথম তৈরি করে এটা। বিখ্যাত রাজা হরিশ্চন্দ্রের পূর্বপুরুষ সে। হারীতের বাবা দণ্ড হলো রাজা খাণ্ডের ছেলে। তো এই দণ্ডের ছিল চরিত্র দোষ। সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়লেই হলো। তাকে ধরে ধর্ষণ করবেই। সে কুমারী হোক কিম্বা বিধবা অথবা কুলবধু! দণ্ডের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে খাণ্ডের কাছে বিচার চাইল প্রজারা। রাজা দণ্ডকে বিয়ে দিয়ে শুক্র মুনির কাছে পাঠাল বিদ্যা শিক্ষা করে মন আলোকিত করার জন্যে। এই মুনি থাকত অরণ্যে। রাজকুমার দণ্ড ওই বনে যাওয়ার পর বনের নাম হলো দণ্ডকারণ্য। ওখানে একটা শহর বানাল দণ্ড, তারপর শুরু হলো তার বিদ্যা শিক্ষা। সারাদিন গুরুর ঘরে বসে লেখাপড়া করে, সন্ধের সময় কোনার ঘরে, অর্থাৎ নিজের কামরায়। জপতপ। এই শুক্র মুনির অব্জা নামে এক যুবতী মেয়ে ছিল। দেখতে শুনতে খুবই ভাল, অদ্ভুত সুন্দর তার দেহ-বল্লরী! একদিন মুনি গেল গহীন বনে সারাদিনের জন্যে তপস্যা করতে। দণ্ড বইখাতা বগলে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে এসে দেখে গুরু নেই ঘরে। ওদিকে অব্জাকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। অব্জাকে খুঁজতে-খুঁজতে তাকে পেল নীলাজ সরোবরের পাড়ে। স্নান সেরে কাঁখে জলের কলসি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল অব্জা। ভেজা কাপড়ে বাঙময় হয়ে উঠেছে অব্জার শরীরের প্রত্যেকটি বাঁক। সূর্যের কিরণ পড়ে চকচক করছে সুন্দর গোলগোল হাত-পা। পড়ালেখা মাথায় উঠল দণ্ডের, ভুলে গেল জপতপের কথা। এই রমণীকে তার এখনই চাই! অব্জাকে দেহ-মিলনের প্রস্তাব দিল সে। অব্জা হলো শুক্র মুনির মেয়ে, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব নেই তার। দণ্ডকে বলল, সম্পর্কে আমি আপনার গুরু বোন। এই দুর্মতি থেকে নিস্তার লাভ করুন, রাজন।
অব্জার কথা কানেও তুলল না দণ্ড। পথ আটকে পীড়াপীড়ি করতেই থাকল। শেষে অব্জা বলল, বেশ। আমাকে ছাড়া আপনার যখন চলছেই না, এক কাজ করুন তা হলে। বাবাকে বলুন আপনার সাথে আমার বিয়ে দিতে। তারপর করুন, যা করতে চান।
চোরা না, শোনে ধর্মের কাহিনী। দণ্ড হলো ধর্ষকামী পাষণ্ড, জোর করে রমণী সম্ভোগ করাতেই তার যত আনন্দ! অব্জাকে টেনেহিঁচড়ে ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে ধর্ষণ করল দণ্ড। আঁচড়ে-কামড়ে বিনাশ সাধন করল তার ননীর মত শুভ্র তুকের। তারপর নিজ কামরায় ফিরে ফলমূল আর সোমরস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্তিতে।
ওদিকে সারাদিন তপস্যা করে বিকেলে ঘরে ফিরল মুনি। অব্জাকে হেঁড়ে গলায় ডেকে বলল খাবার দিতে। মুনি দেখল খাবার দেয়া দূরের কথা, অব্জা তার ঘর থেকে বেরই হচ্ছে না। মেয়ের কামরার দিকে এগিয়ে গেল মুনি। দরজার গোবরাটে দাঁড়িয়ে বাজখাই গলায় বলল, কন্যা, পিতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য, ভুলে গেছ সেকথা!
কী আর করা? আলুথালু অবস্থায় অব্জা এসে দাঁড়াল বাবার সামনে। শুক্র মুনি দেখল অব্জার চোখ ফোলা, সারাগায়ে খামচি আর কামড়ের দাগ। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল মুনির। বলল, আমি ওদিকে তপস্যায় প্রাণপাত করছি, আর এখানে রঙ্গলীলা করছ তুমি! পিতার অবর্তমানে অবৈধভাবে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা! আমি শুক্র মুনি! এত বড় কুলাঙ্গার, আমার কন্যা!
বাবার রাগ খুব ভাল করে চেনা আছে অব্জার। মরার আগে মা বলে গেছে, আর যাই করিস, কখনও বাবাকে রাগাসনি, বাছা। তা হলে কিন্তু মহা সর্বনাশ হবে!
পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যা ঘটেছে, সব খুলে বলল অব্জা।
এইবার দণ্ডকে ডাকল মুনি।
গুরুদেবের হাঁকডাক শুনে বইখাতা বগলে করে সামনে হাজির হলো দণ্ড। যেন কিছুই হয়নি! আগের মতই ঠিকঠাক আছে সবকিছু।
দণ্ডকে মুনি বলল, শোন, দণ্ড, এতদিন এখানে থেকে এই শিক্ষা লাভ করেছ তুমি! এই তোমার চেতনা! দূর হও আমার সামনে থেকে। আমি যদি সত্যিই শুক্র মুনি হয়ে থাকি, তা হলে ভগবান যেন ভস্ম করে দেন তোমাকে, যাতে আর কোনওদিন কোনও অসহায় মেয়ের ক্ষতি করতে না পার।
শুক্র মুনি স্বয়ং অবতার। তার কথা শেষ হতে না হতেই আকাশ ফুড়ে ছুটে এল বজ্র। মুহূর্তের ভেতর পুড়ে ঝামা হয়ে উঠোনে পড়ে থাকল দণ্ড!