আগেই ভেবে রেখেছিলাম, যে রাস্তা ধরে আমরা প্রথম দিন ক্যাম্পে এসেছিলাম, যাব তার উল্টো দিকে। র্যাম্পের ওপর দিয়ে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে আসার পর মোড় নিলাম ডানে। ধূ-ধূ করছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। এখানে-ওখানে মাটির ওপর তৈরি হচ্ছে ধুলোর ঘূর্ণি। যতদূর চোখ যায় জনমানুষের চিহ্নও নেই কোথাও। ট্রেইল ধরে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটছি তো হাঁটছিই। তীব্র গরমে ফেটে যেতে চাইছে তালু। একটা গাছও নেই যে তার নিচে দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নেব কিছুক্ষণ। অবশেষে কিছুটা সরু হয়ে এল তেপান্তরের মাঠ। ডানে-বাঁয়ে পাহাড়, মাঝে চওড়া ফালি জমি। ধীরে-ধীরে আবারও দূরে সরে যেতে লাগল পাহাড়ের সারি। হাঁটতে-হাঁটতে এসে হাজির হলাম প্রায় তিন কিলো ব্যাসার্ধের অতিকায় এক গোল চত্বরের মতন জায়গায়। বিশাল চত্বরটা জুড়ে অসংখ্য পাথরের টুকরো, ঝোঁপ-ঝাড়, আর ধুলোবালি। সামনে তাকিয়ে দেখলাম গোল চত্বর ছাড়িয়ে আবারও চেপে এসেছে পাহাড়সারি। আকাশে হেলে পড়ছে সূর্য। আরও সামনে বাড়লে সন্ধের আগে আর ফিরতে পারব না। আমার বেড়ানো এখানেই শেষ। তবে ফেরা যাবে না এখনই। রুটি-জল খেয়ে তারপর ধরব ফিরতি পথ। কোনও এক জায়গায় বসা দরকার এখন। ডানে তাকিয়ে দেখলাম বেশ কিছুটা দূরে পাহাড়ের গোড়ায় শিরীষ গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। বিরাট লম্বা কাণ্ডের আগায় অল্প কিছু ডাল-পাতা। এগুতে লাগলাম ওদিকেই। কাছে গিয়ে দেখি অনেক পুরনো একটা ট্রেইল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে ওপর দিকে। ট্রেইলের দুদিকে ফণিমনসার গাছ, আধা শুকনো কাটা ঝোঁপ, উলুখাগড়ার মত ঘাসের গোছা, তবে লম্বায় অনেক খাট। খুব কাছ থেকে ভাল করে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না ট্রেইল আছে ওখানে। উঠতে লাগলাম ট্রেইল বেয়ে। এত দূর যখন এলাম, দেখিই না ওপরে কী আছে?
ঘণ্টাখানেক হেঁটে উঠে এলাম পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়চুড়ো একরকম চ্যাপ্টাই বলা চলে। সামনে কতদূর যে গেছে, তার ঠিক নেই। ফুট পঞ্চাশেক দূরে অতএব চিহ্নের মত তিনটে. আকাশ ছোঁয়া মহুয়া গাছ। পাহাড়ের এপাশের ঢালের গোড়া থেকে ত্রিশূলের মত নিরেট কালো পাথরের তিনটে শৈলশিরা বেরিয়ে ধীরে-ধীরে মিশে গেছে বিরাট চওড়া সমভূমিতে, তারপর আবারও পাহাড়। ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম, এই উপত্যকা ছাড়িয়ে ওদিকের পাহাড়সারির কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক তোরণ। দরজা-টরজা খুলে পড়ে গেছে কবেই! এখন হাঁ করে আছে এত্তবড় চৌকোনা ঘন অন্ধকার খোপ। দুপাশে উঁচু পাথরের বেদীর ওপর স্ফিংসের মত পশুর মাথাভাঙা মূর্তি। তোরণের দুদিক থেকে শুরু হয়েছে আদ্যিকালের ভীম মোটা ভাঙা-চোরা পঁচিল। পাচিলের ওপাশে অসংখ্য দালানের ধ্বংসাবশেষ। একসময় দোতলা-তিনতলা উঁচু ছিল দালানগুলো। কোনও কোনও দোতলা আধভাঙা হয়ে টিকে আছে এখনও। হা-হা করছে ওগুলোর জানালা-দরজার খোদল, রেলিং-ভাঙা বারান্দা।
দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে আদ্যিকালের পোড়ো দুর্গ নগরী দেখছি, ঠিক সেই সময় বাঙ্ময় হয়ে উঠল পরিবেশ। ফিরে তাকালাম মহুয়া গাছগুলোর দিকে। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা গাছগুলোর গোড়া। শব্দটা আসছে ওদিক থেকেই। পায়ে পায়ে গেলাম গাছগুলোর দিকে। ঝোঁপের কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ল তিন গাছের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় শুকনো ডাল ভেঙে খড়ির টুকরো বানাচ্ছে চটের লেঙটি পরা বুড়ো মতন এক লোক। পায়ের নিচে ফেলে ডান হাত দিয়ে ভাঙছে ডালপালা। কনুই থেকে বাঁ হাতটা কাটা! বাঁ কানের লতিতে ঝুলছে ছোট্ট লোহার রিং। ইয়া লম্বা দাড়িতে জট পাকিয়ে গেছে, মাথা গড়ের মাঠ। একটাও চুল নেই ওখানে। পুরো কপাল জুড়ে সিঁদুর-চন্দন লেপা, গলায় ঝুলছে তিনপল্ল বরুই সাইজের কুঁচফুলের মালা। কুঁচফল যে এত বড় হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হত না। অস্বাভাবিক শীর্ণ শরীর লোকটার। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বুকের খাবাচি, কনুই, হাঁটু, গোড়ালির জয়েন্ট আর আঙুলের গাঁট! কোটরের ভেতর ঘোলাঘোলা লালচে ছানিপড়া চোখ।
এ কাপালিক সন্ন্যাসী। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা বইয়ে পড়েছি এদের কথা, চোখে দেখিনি কখনও। ভয়ঙ্কর নরপিশাচ এরা, সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্যে পারে না এমন কিছু নেই!
মনে-মনে ভীষণ ঘাবড়ে গেলেও বাইরে প্রকাশ করলাম না সেটা। ভাবলাম, আমার গায়ের সামরিক পোশাক দেখে সমীহ করতে পারে কাপালিকটা। ভাবতে পারে আমার পেছনে আরও নোক আসছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত-জোড় করে নমস্কার করে লোকটার কাছ থেকে শুকনো ডালটা নিয়ে ভাঙতে লাগলাম। একটার পর একটা ডাল ভেঙেই যাচ্ছি। কিছুটা দূরে পাথরের ওপর বসে একদৃষ্টিতে আমার কাজ দেখছে লোকটা। এখন পর্যন্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।
কয়েকটা মাত্র শুকনো ডাল। ভেঙে টুকরো করতে আর কতক্ষণ লাগবে! কাজ শেষ হলে টুকরোগুলো জড় করে চোখ তুলে তাকালাম সন্ন্যাসীর দিকে। ইশারা পেয়ে সন্ন্যাসীর পাশে পাথরটার ওপর বসলাম। নাকে এল শ্যাওলার গন্ধ। সারাদিন জল-কাদায় ডুবে থাকা মোষের গায়েই শুধু এমন বিদঘুঁটে গন্ধ হয়। তবে সোঁদা গন্ধের মত এই গন্ধের ভেতরও এক ধরনের মাদকতা আছে। সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করল, আপ কাঁহা কা রেহনেঅলা হ্যায়?
হিন্দি ভাষা মোটামুটি বুঝলেও ঠিকমত বলতে পারি না আমি। জবাব দিলাম, বাঙ্গাল মুলুক।