মাঘ মাস, শীতকালীন সবজি দিয়ে ভরা হয়েছে ট্রাক। তিনজন শ্রমিক নিয়ে রওনা হলো মণি। আজ আর রাজু সঙ্গে নেই। জ্বর হয়েছে ওর। সবজির যাতে ক্ষতি না হয়, সেভাবে ব্যবস্থা করে শ্রমিকরা গরম কাপড় মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি হয়ে ট্রাকের খোলা জায়গায় শুলো। মণিও ওদের একপাশে শুয়ে পড়ল। ড্রাইভার বলল, ভাইজান, আপনে বাইরে কষ্ট করবেন ক্যান? ঠাণ্ডা লাগব, ভিতরে আসেন।
মণি রাজি হলো না। ওদের ঠাণ্ডায় কষ্ট হবে, আর আমি আরামে থাকব? তা হয় না। ভাল করে শরীর ঢেকে নিল মণি।
রাস্তায় তেমন যানবাহন নেই, ড্রাইভার গতি বাড়িয়ে গন্তব্যে ছুটে চলল। এসব রাস্তায় বাতির ব্যবস্থা নেই, অন্যান্য গাড়ির হেডলাইটে চারদিক মাঝে-মাঝে আলোকিত হচ্ছে। নিকষ কালো অন্ধকার ভীতিকর করে তুলেছে শীতের রাতকে। আজ ঠাণ্ডাটা খুব বেশি। মণি যতই শরীর ঢেকে শুয়েছে, তারপরও ঠাণ্ডায় জমে যাবার অবস্থা হলো। ঠাণ্ডার চোটে একসময় ভেঙে গেল ঘুমটা ওর। ভাবল, ট্রাকের ক্যাবে চলে যাবে? অন্যদের দিকে তাকিয়ে দেখল, দিব্যি ঘুমাচ্ছে। ওরা। খেটে খাওয়া মানুষ, তাপ কিংবা ঠাণ্ডা ওদেরকে কাবু করতে পারে না।
কম্বলটা ভাল করে গায়ে টেনে নিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করল মণি। প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, সেই অবস্থায় হঠাৎ ওর মনে হলো কী যেন অসঙ্গতি আছে ট্রাকে। পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠল সে, অন্ধকারে অত ভাল দেখা যায় না, তারপরও মণি বুঝল শেষ শ্রমিকটার পাশেই আরও একজন শুয়ে আছে।
কী ব্যাপার?
শ্রমিক ছিল তিনজন, চারজন হলো কেমন করে?
একেবারে ট্রাকের শেষদিকে শুয়ে আছে মানুষটা। চলন্ত ট্রাকে কেউ উঠবে, তা-ও অসম্ভব। রাজুই কি শেষ মুহূর্তে ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে উঠেছিল? তা-ই বা কী করে হয়! ট্রাক ছাড়ার পরও তো তিনজন শ্রমিকই ছিল। তা হলে? শরীরটা কেমন ছমছম করে উঠল মণির। ভয় পেলেও সাহস সঞ্চয় করে বলল, কে রে ওখানে? রাজু নাকি?
ভারী জান্তব এক স্বর শোনা গেল, না, আমি রাজ নই
তারপরই মণির ভয়ার্ত চোখের সামনে ধীরে ধীরে যে উঠে বসল, মানুষ নয় ওটা, ভয়াল এক পিশাচ! রাতের অন্ধকারে, অশুভক্ষণে শিকারের সন্ধানে ঘুরছে সে, আজ সুযোগ পেয়েই ট্রাকে চলে এসেছে।
শয়তানটার কালো কুচকুচে চিকন, রোমশ শরীর। অন্ধকারে দুটুকরো অঙ্গারের মত জ্বলছে চোখ দুটো। কুৎসিত মুখে সাদা চোখাচোখা দাঁত বের করে বীভৎসভাবে হেসে উঠল বিভীষিকাটা, তারপর লিকলিকে কালো হাত দুটো লম্বা হতে হতে পেঁচিয়ে ধরল মণির গলা। বরফ-শীতল সেই হাতের স্পর্শে থরথর করে কেঁপে উঠল মণি। সাপের মত ঘিনঘিনে পিচ্ছিল গা।
চিৎকার করতে পারল না মণি, দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘৃণিত রোমশ হাতের ছোঁয়ায়। পাশে যে শ্রমিক শুয়ে আছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে ওঠাবার শক্তিও পেল না।
পিশাচটা শ্রমিকদের ওপর দিয়ে ভেসে এসে আষ্টেপৃষ্ঠে মণিকে পেঁচিয়ে ধরে গলায় বসিয়ে দিল ধারাল দাঁত। দুচোখ আঁধার হয়ে এল মণির। তারপরই জ্ঞান হারাল। এতবড় ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল টেরও পেল না শ্রমিকরা, জানতে পারল না হেলপার-ড্রাইভারও।
ড্রাইভার তো একমনে গাড়ি চালাচ্ছে, সমস্ত মনোযোগ সামনের রাস্তায়।
এক সময় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থামল ট্রাক।
মাল খালাস করছে শ্রমিকরা, গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মণি, কথায় কথায় একে-ওকে ধমক দিচ্ছে। তুচ্ছ ব্যাপারে বিশ্রী গালাগালি করছে। সবাই খুব অবাক হয়ে গেল, হাসিখুশি মানুষটার আজ হলো কী? অন্যদিন কত কথা বলে, তামাশায় মেতে ওঠে, সবাইকে চা-নাস্তা খাওয়ায়। অথচ এখন? সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, ভয়ে কাছেই যাওয়া যাচ্ছে না। _ ওই রাতের ঘটনার পর খুব দ্রুত বদলে যেতে লাগল মণি। কাজে যায় না, অন্ধকার ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না, ছেড়ে দিয়েছে খাওয়া-দাওয়া। চিন্তিত হয়ে পড়ল বাড়ির সবাই। রতন ডাক্তার দেখাবার কথা বলল, কিন্তু মার ধারণা অন্য: রাত-বিরাতে যাওয়া-আসা করেছে, খারাপ বাতাস লেগেছে। বুঝি! ভাল হয় ইমাম সাহেবকে দিয়ে দোয়া পড়ালে।
ওই কথা শুনে ঘরের মধ্য থেকেই গর্জে উঠল মণি, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না, একলা থাকতে দাও আমাকে।
রাজু, যে অত প্রাণের দোস্ত ছিল, তার সাথেও কথা বলে না মণি। রাতে শুয়ে এখনও রাজু নানারকম কথা তোলে, কিন্তু কোনও জবাব পায় না। অনেক অনুনয় করে বলেছে রাজু, ছোট ভাই, আপনের কী হইছে, আমারে বলেন, আমি কাউরে বলুম না।
ভয়াল স্বরে জবাব দিয়েছে মণি, আমারে বিরক্ত করলে তোর খবর আছে।
আজকাল মণিকে ভয় পায় রাজু।
ছোট ভাই আর আগের মত নেই, কেমন করে তাকায়, চেহারাতেও পরিবর্তন হয়েছে। মোমের মত সাদা, তেলতেলে
অদ্ভুত ভাব মুখে, শরীরটা কেমন কালো হয়ে গেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্য কথা, একেবারে না খেয়ে সে আছে। কীভাবে?
শরীরও দিব্যি সতেজ ও সবল।
এ কী রহস্য?
কেউ ভেবে পায় না মণিকে নিয়ে কী করবে।
কিছুদিন পর, এক রাতে ভেঙে যায় রাজুর ঘুম। বাথরুমে যাবে। মণির বিছানায় চোখ পড়ে। নেই সে, এত রাতে গেল। কোথায়? বাথরুমে? রাজু নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাথরুম দেখল। খালি, কেউ নেই। সদর দরজায় নজর পড়তেই চমকে উঠল রাজু। দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে মণি।