নাহ, কেউ নেই। পুরো বাড়ি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সাথে টর্চ নেই, থাকলে ভাল হত। অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেলে আয়েসী ভঙ্গিতে এগোয় রতন। এঘর-ওঘর ঘুরেফিরে দেখে। কিছু বাসনপত্র পায়, বস্তায় ভরে। কিছু বিছানার চাদর, ক জোড়া জুতো, দামি কিছু ইংরেজি বইপত্র, আরও টুকটাক নানান জিনিস। যা পায়, বস্তায় ভরার যোগ্য হলে ভরে ফেলে।
একে তো নড়বড়ে শ্যাওলা ধরা পুরানো বাড়ি, তার ওপরে মেঝে থইথই করছে পানিতে। পানির কারণে বহু কিছুই পচে গলে গেছে। অনেকদিন যাবৎ বুঝি জমে আছে পানি, বোটকা একটা পচা গন্ধ আসছে। পানির উৎস কোথায় বুঝতে পারে না রতন। অবশ্য বোঝার চেষ্টাও করে না। নাক চেপে কোনওমতে ঘরগুলোতে সন্ধান করে মূল্যবান কিছুর।
বাকি কেবল একটা ঘর। ওটা দেখা হলেই সোজা বাউণ্ডারির বাইরে। কেমন গা ছমছম করছে এই কালি গোলা অন্ধকারে। বের হয়ে খোলা বাতাসে শ্বাস নিতে না পারলে জানে মারা পড়বে।
করিডরের একদম শেষমাথায় ঘরটা। অন্ধকার বুঝি এখানে আরও বেশি জমাট। আর শীতল। ঘরের দরজাটা ভেজানো।
ধাক্কা দিতেই কাঁচকোচ আওয়াজে খুলে যেতে শুরু করে দরজাটা। আস্তে…খুব আস্তে! দৌড় দেবে কি না বুঝতে পারে রতন। কেননা এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মাঝে পষ্ট দেখতে পায় বিছানায় বসে আছে এক বুড়ি, আর তার পায়ের কাছে একটা পুরুষ কাঠামো। বসে আছে, পিছন ফিরে।
এ কি সেই বুড়ি না? ওই যে বুড়িটা মারা গেল কয়মাস আগে…মানে কী? মানে কী এসবের? এই বুড়ি তো মরেছে, নিজের চোখে লাশ দেখেছে রতন।
বুড়িটা নামে বিছানা থেকে। ধীরে, খুব ধীরে। নিচু কণ্ঠে কী যেন বলে বিড়বিড়িয়ে। অস্পষ্ট, এলোমেলো। ভয় নাই, ব্যাটা…এরপরে আর কুনো ভয় থাকব না…কুনো ভয় নাই… শান্তি…শান্তি…
পরনের প্যান্টটা কখন ভিজে গেছে ভয়ে টেরও পায় না রতন। চিৎকার করে প্রাণপণে, কিন্তু গলা দিয়ে বেরয় না, আওয়াজ। কারণ…
একজোড়া জীর্ণ-শীর্ণ বুড়ো মানুষের হাত কণ্ঠরোধ করে দিয়েছে রতনের।
সাঁড়াশির মত শক্ত একজোড়া হাত!
আগমন – নাজনীন রহমান
গ্রামের মানুষ ভীষণ ভয় পায় ভূত-প্রেতে, ওদের ধারণা অশুভ, খারাপ জিনিস মিশে থাকে বাতাসে, তারপর সুযোগ মত মানুষের ঘাড়ে চাপে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষ মন। থেকে দূর করতে পারে না ভীতি। গ্রামে বেল গাছ, ঘন বাঁশ ঝাড়, শেওড়া গাছ, গাব গাছের অভাব নেই-সবার বদ্ধমূল ধারণা, এসব গাছ ভূত-পেত্নিদের খুবই প্রিয়, তাই নানা খারাপ জিনিস এই গাছগুলোতে থাকে।
এমনই এক গ্রামে বাস করে সচ্ছল কৃষক রমিজ আলী। তার দুই ছেলে রতন ও মণি।
রতন বিয়ে করেছে, দুই বছরের ফুটফুটে সুন্দর একটা ছেলে আছে তার।
রমিজ এখন বৃদ্ধ হয়েছে, শরীরে শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নেই, রতনই বাবার সম্পত্তির দেখভাল করে। বিশ্বস্ত-কর্মঠ কামলা, মজুর আছে-অসুবিধে হয় না।
মণি বৈষয়িক কাজে নেই, তার ভাল লাগে নদীতে ঝাপাঝাপি করে মাছ ধরতে, গাছে উঠে ফল পাড়তে, সঙ্গী সাথী নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় ও গল্প-গুজব করতে। রমিজ রাগ করেছে, হ্যাঁ রে, এইভাবে গায়ে বাতাস দিয়া কদ্দিন চলবি? বড় ভাইটা একলা খাইট্টা শেষ হইল, অরে সাহায্য করা লাগে না? আর কিছু না করিস, শাক-সবজির চালান নিয়া শহরে তো যাইতে পারিস?
আমার ওসব ভাল লাগে না, বলে নির্বিকারভাবে সরে পড়ে মণি।
মণির সর্বক্ষণের সাথী হলো রাজু, একেবারে ছোট থেকে আছে সে এই বাড়িতে। এতিম ছেলেটাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল রমিজ, তারপর বাড়ির ছেলের মতই হয়ে গেছে সে। রতন আর মণি গ্রামের স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, তারপর, পড়াশোনা করতে ইচ্ছে হয়নি বলে স্কুল বাদ দিয়ে রতন বাবার কাজে সাহায্য করেছে।
আর মণি?
মনের সুখে দুষ্টুমি করে বেড়িয়েছে। কোন্ গাছের ডালে পাখির ছানা আছে, কার গাছের ফল পেকেছে, এসবে সে পুরোপুরি হাফেজ। আর রাজু তো মণির অন্ধ চামচা। দুজনে। ঘুমায়ও এক ঘরে, মণি চৌকিতে আর কাছেই মাটিতে বিছানা করে শোয় রাজু। ঘুমাবার আগে কত গল্প হয় দুজনার।
রতনদের ধান-চাল, নানা ফল, সবজির ব্যবসা-বিশাল কারবার। মণি বাউণ্ডুলের মত ঘুরে বেড়ায়, বাবার সেটা একদম সহ্য হয় না। দুই ভাই মিলেমিশে কাজ-কর্ম করবে, এটাই রমিজের মনের ইচ্ছে। বকাবকি, শাসন করেও কোনও লাভ হয় না। মণি তার ইচ্ছেমতই যা খুশি করে বেড়ায়। রতন খুবই ভালবাসে ছোট ভাইকে, বাবাকে বোঝায়, থাক, বাপজান, ওরে কিছু বইলো না, আমি তো আছিই, হেসেখেলে চলুক কিছুদিন, দেইখো সব ঠিক হইয়া যাইব।
রাজু খুব হাসি-খুশি-রসিক ছেলে, সে-ও সেদিন গম্ভীর মুখে মণিকে বলল, ছোট ভাই, আপনে একটা বিয়া কইরা ফালান, তাইলে বাজান বউয়ের সামনে আপনারে বকতে পারব না।
রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল মণি, বলল, ফাজিল ছোকরা, তুই বিয়া কর, খুব শখ-না?
মুখটা করুণ করে রাজু বলল, আমারে মাইয়া দিব কেডা? একদিন সালাম চাচার মাইয়ারে একটা গোলাপ ফুল দিছিলাম। গালি তো যা দিবার দিলই, শ্যাষে স্যাণ্ডেল ছুঁইড়া মারল।
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল মণির।
আস্তে আস্তে কাজ শুরু করল মণি। করতেই হলো। বিরাট কারবার তাদের, অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার। রতন একা সবদিক সামলাতে পারে না, কর্মচারী থাকলেও নিজেদের খেয়াল রাখা দরকার। মণি আর গাফিলতি করল না, ভাইকে সাহায্য করতে লাগল। শহরে চালান নিয়ে যায়, কখনও ধান, চাল, শাক, সবজি, কখনও ফল। রাতের বেলায় ট্রাক নিয়ে রওনা হয়, ভোরে কাজ শেষ করে ফিরে আসে। রাজুকে সঙ্গে নেয়, সেজন্য খারাপ লাগে না, বরং প্রতিটি ট্রিপ বেশ উপভোগ্য হয়।