কণ্ঠস্বরটা স্তিমিত হতে-হতে নিভে যায় একসময়, বর্ষণের প্রচণ্ড আওয়াজের সাথে মিলেমিশে যায় বুঝি। জানালার ধারে দাঁড়ানো রাশেদ একবার ফিরে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করে না, কেননা জানা আছে তার কী ঘটছে। সামনে এখন অনেক কাজ-লোকজন ডাকা, নানির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠাণ্ডা মাথায় সেই সব পরিকল্পনাই করেছে বরং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
একটু ভাল করে ভাবলেই রাশেদ হয়তো বুঝতে পারত যে ছেলেবেলা থেকে শুনে আসা এই গল্পের মাঝে অন্যরকম কী যেন একটা আছে। বুঝতে পারত যে রূপকথার গল্প মনে করে যে গল্প এতকাল জেনে এসেছে, সেটা গল্প না হয়ে সত্যিও হতে পারে!
চার
সেদিন বোঝেনি, বিশ্বাস করেনি।
বিশ্বাস আজও করে না। তবুও আজ এই একলা বাড়িতে কেমন যেন খটকা লেগেই থাকে মনে। বাইরে সূর্য ডুবেছে অনেকক্ষণ, দিনের শেষ চিহ্নগুলোও মিলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। চার দেয়ালের এই ঘেরাটোপে আস্তে আস্তে নেমে আসতে শুরু করেছে অন্ধকার ছায়া।
ভীষণ অস্থির লাগে, ছটফট লাগে মনের মাঝে। নাহ্, আর দেরি করা যাচ্ছে না। বন্ধুরা আসুক বা না আসুক, বেরিয়ে পড়বে এখন। প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে, কিন্তু এই সীমানার মাঝে না। অস্থিরতায় দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে নইলে।
সুটকেস দুটো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে বাইরে। কী মনে করে দরজায় তালা আঁটে, মেইন গেটের তালার চাবিটাও নেয় সাথে। দুনিয়ার লোকজনকে বিশ্বাস নেই, রাতারাতি পরের বাড়ি দখল হয়ে যায় আজকাল। শহরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে…
এ কী! এমন লাগছে কেন?
শ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছে, বুঝি হঠাৎ করে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়েছে সৃষ্টিকর্তার দুনিয়ার বুকে…উফ!
কী কষ্ট!! কী কষ্ট!!
মুখ খুলে প্রাণপণে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে, আর বুঝতে পারে যে কঠিন দুটো হাত পেছন থেকে চেপে ধরেছে গলা। সাঁড়াশির মতন শক্ত দশটি আঙুল চেপে বসেছে গলার ওপরে। শীতল…হিমশীতল দুটো হাত।
মৃত মানুষের মতন শীতল! আর ভেজা!
প্রাণ বাঁচাবার ভীষণ তাগিদে নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে রাশেদ। নিজেকে নিয়োগ করে নিজেকেই বাঁচাবার কাজে। অন্ধকার হয়ে আসছে চোখের সামনে দুনিয়াটা ক্রমশ, একটু বাতাস পাওয়ার আকুতিতে ছটফট করছে বুকের খাঁচায় ফুসফুস। এখনই…আর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র! এর মাঝে যদি নিজেকে মুক্ত করতে না পারে, তো জীবনের এটাই শেষ দৃশ্য।
আহ!
নিজেকে কোনওমতে সাঁড়াশি আঙুলগুলো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রাণপণে অক্সিজেন টানে রাশেদ। শান্তি…শান্তি…
কিন্তু এর পরে যা দেখতে পায়, তাতে জমাট কংক্রিট হয়ে যায় বুকের রক্ত। এই তো…এই তো একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি পরা জবুথুবু এক বুড়ি, সন্ধ্যার অন্ধকারের মাঝেও যার চোখজোড়া ধকধক করছে অপার্থিব হিংস্রতায়। এটা কী করে হয়? মৃত মানুষ জীবিত হয় কী করে?
কী করে হয়?
না-না, বুড়ি জীবিত নয়। হতে পারে না। কিছুতেই না! নিজের অজান্তে পেছাতে শুরু করে রাশেদ একটু একটু করে। আর এক পা এক পা করে এগোয় বুড়ি। ভিজে চপচপ করছে। পুরো শরীরটা তার, একটি একটি পদক্ষেপের সাথে শব্দ তোলে পরনের ভেজা শাড়ি…ছপ-ছপ-ছপ…ছপছপ-ছপ।
হাতদুটো সামনে বাড়ানো, ফোকলা মুখে কুৎসিত হাসি হাসছে প্রেতাত্মা। এবং রাশেদ জানে…জানে যে এই হাতদুটো তাকে ধরেই ফেলবে। চেপে ধরবে তার গলা, আর ধরেই থাকবে যতক্ষণ না প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়।
কী যে হয়ে যায়, শরীর-মনের সমস্ত সাহস একত্রিত করে। ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ, আর খিচে দেয় দৌড়।
কিন্তু…
শরীর সামনে বাড়ে না এতটুকুও। কেননা পেছন থেকে চেপে ধরেছে সেই সাঁড়াশি আঙুলগুলো আবার। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে রাশেদ, দুহাতে সর্বোচ্চ জোর প্রয়োগ করে ছাড়া পেতে চায় সেই মরণ-বাঁধন থেকে।
লাভ হয় না কোনও। জীর্ণ-শীর্ণ সেই হাত মাটিতে ঘষটে-ঘষটে নিয়ে যেতে থাকে ছাব্বিশ বছরের তরতাজা যুবক রাশেদকে। টেনে নিয়ে যেতে থাকে অমোঘ সেই। নিয়তির দিকে..
যে নিয়তি সে নিজ হাতে নিজের জীবনের ললাটে লিখেছে।
পাঁচ
কীভাবে এরপর কী হলো, জানে না রাশেদ। শুধু অনুভব করে…
অনুভব করে যে একরাশ কালো শীতল জল প্রবল শক্তিতে টেনে নিচ্ছে তাকে। টেনে নিচ্ছে অতল গহ্বরে। শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রবেশ করছে অপার্থিব সেই পানি। বুক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে পানি। তারপর প্রবেশ করছে চোখের পাতায়, নাসারন্ধ্রে, কানের গহ্বরে…আর…
শীতল হয়ে আসছে চারপাশ ক্রমশ।
পরিশিষ্ট
দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়বে কি না ঠিক বুঝতে পারে না রতন।
বেশ অনেক মাস যাবৎ দেখছে বাড়িটায় লোকজনের আনাগোনা নেই। রাতে বাতি-টাতিও জ্বলে না। এক বুড়ি আর বুড়ির নাতি থাকত এখানে। বুড়িটা তো মাস তিন-চার আগেই মরেছে, নাতিটাও বোধকরি থাকে না আর। অবশ্য এই ভাঙাচোরা শ্যাওলা ধরা বাড়িতে কেই-বা থাকতে চাইবে।
যাই হোক, যা আছে কপালে, রাত হয়েছে, আশপাশে লোকজন নেই। সুযোগ বুঝে তাই ভেতরে ঢুকেই পড়ে রতন। যা পাওয়া যায়, তাই লাভ। স্টিলের বাসনপত্র পেলেও লাভ আছে। আজকাল চোরা বাজারে সবই বিকোয়। পেশায় সে ছ্যাচড়া চোর, শ পাঁচেক টাকার মাল-সামান পেলেও আজকে রাতের মত খুশি।