প্রতি এক শজন মুক্তিযোদ্ধার জন্যে আটজন ট্রেনার। আগে থেকেই পঁচাত্তরজন ছিল ওখানে। আমাদের দলে পঁচিশজন-সব মিলে এক শ। বারোজনের এক-একটা গ্রুপ। তৈরি করে শুরু হলো ট্রেনিং। আমাদের গ্রুপের জি. আই. বা ট্রেনারের নাম সতীশ লাল রায়, সংক্ষেপে এস, এল. আর.। ঝটা গোঁফ, কদমফুল চুল। গায়ে হাতাঅলা মুগায় কাটা গেঞ্জি আর ঢোলা হাফ প্যান্ট। পায়ে পেছন-কাটা পামশু। এই এস, এল, আর, আমাদের শেখাল কীভাবে গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়, চালাতে হয় এস, এল, আর. (সেমি অটোমেটিক লংরেঞ্জ রাইফেল)। ট্রেনিং দিতে গিয়ে এস, এল, আর. বললেন, এস. এল. আর.-এ ফায়ার ওপেন করলে প্রথম ম্যাগাজিন কোনওরকম ঝামেলা ছাড়াই শেষ হয়। তবে দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয়টার বেলায় লাল টকটকে হয়ে ওঠে ব্যারেল, আগুনের মত গরম হয়ে যায় এস, এল, আর.। তখন ওটাকে হাতে ধরাই যায় না। এইম করে দুশমনকে গুলি করা তো অনেক পরের ব্যাপার! এই সমস্যার সমাধান হলো জল দিয়ে ব্যারেল ভেজানো। রণাঙ্গনে জল আর পাওয়া যাবে কোথায়! অ্যামবুশ ফেলে জল আনতে গেলে নিজের জীবন তো যাবেই, সেই সাথে যাবে সঙ্গীরও। চাই তাৎক্ষণিক সরল সমাধান, আর সেইটে হলো লুঙ্গির কাছা খুলে ব্যারেলের ওপর পেশাব করা! বন্ধুরা, অপারেশনে যাওয়ার আগে যত বেশি পারেন জল খেয়ে নেবেন!
.
সন্ধের পর-পরই সেরে ফেলা হত খাওয়া-দাওয়া। রাত দশটার ভেতর হ্যারিকেন নিভিয়ে শুয়ে পড়া বাধ্যতামূলক। খাওয়ার পর এই রাত দশটা পর্যন্ত কোনও কাজই নেই। সব থেকে কষ্টের ছিল রোববারের দিনটা। রোববার সাপ্তাহিক ছুটি, ট্রেনিং-ফ্রেনিং সব বন্ধ। সকালবেলা কাপড়-চোপড় কেচে শুকোতে দিয়ে সারাদিন বিছানায় বসে থাকা! রুমমেটরা চাষাভুষো ধরনের, এদের সাথে কথা বলে কোনও আরামই পাই না। ম্যাট্রিক পাশ চ্যাংড়া মতন একটা ছেলে আছে। বাবার ওপর অভিমান করে নাম লিখিয়েছে মুক্তিফৌজে। এখন বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্যে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। রাতদিন তার মুখে শুধু বাড়ির কথা। মুখে গুটিবসন্তের দাগঅলা তালপাতার সেপাইয়ের মতন ডিগডিগে আরেকজন আছে। বছর ত্রিশেক বয়স। এ নাকি ডাকাতি করত। কাকে কোথায় জবাই করে পুঁতে রেখেছে, মুখে শুধু সেই কাহিনী। যতজনকে এ খুন করেছে, সেই হিসেব করলে অর্ধেক গাঁ, বিহারের আঞ্চলিক ভাষায়, উজড়া হয়ে যাওয়ার কথা! চূড়ান্ত মিথ্যুক এই গুটিবসন্ত। আমার ধারণা, এ ব্যাটা আসলে ছিঁচকে চোর। কাউকে খুন করার মুরোদ এর কোনওকালেই ছিল না। গাঁয়ের লোকের মারের হাত থেকে বাঁচার জন্যে নাম লিখিয়েছে মুক্তিবাহিনীতে! তিন নম্বর রুমমেট এক ফুলবাবু। দেশ যাচ্ছে রসাতলে, মরব কি বাঁচব তার নেই ঠিক। ওদিকে এর ব্যাগের ভেতর স্নো আর পাউডার! সন্ধের পর ক্লিন শেভ করে স্নো-পাউডার মাখে। তারপর হাতলঅলা ছোট আয়নায় কিছুক্ষণ পর-পর মুখ দেখে। গুনগুন করে গানও গায়: আমার গলার হার খুলে দে এ-এ-এ, ও, ললিতে…
জেনেছি এ যাত্রাদলে বেহুলা সেজে মেয়েদের পার্ট করত। রাজাকারেরা তাকে নাকি ধর্ষণ করতে চেয়েছিল! মুক্তিযুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ নিতে চায়!
তিন
বিশ দিনের মাথায় হাঁফিয়ে উঠলাম আমি। কোথাও না কোথাও একটু বেড়িয়ে না এলে আর চলছে না। কিন্তু যাব কোথায়? এই এলাকার কিছু চিনি না। চিনলেও বা কী? ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার কোনও হুকুম নেই। তারপরেও অনুরোধ করেছিলাম এস, এল, আর.-কে। কিন্তু লাভ হয়নি কিছু। এরই ভেতর একদিন এক ঘটনা ঘটল। রামেশ্বর কাউর নামে এক ব্রিগেডিয়ার এল ক্যাম্প দেখতে। খুব বিখ্যাত লোক, সেনাবাহিনীতে নাকি বিরাট নাম-ডাক। অনেক পরে জেনেছি, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর প্রধান ছিল কাউর! কয়েকজনকে ডেকে এটা ওটা জানতে চাইল ব্রিগেডিয়ার সাহেব। এই কয়েকজনের ভেতর পড়ে গেলাম আমিও। সম্ভবত লেখাপড়া জানা থাকার কারণেই ডাকা হলো আমাকে। দোভাষীর মাধ্যমে হিন্দিতে কথা বলছিলেন কাউর সাহেব। আমি তার সাথে সরাসরি ইংরেজিতে কথা বললাম। জানালাম, খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা মোটামুটি ভাল হলেও আমাদের কোনও প্যান্ট দেয়া হয়নি। বুটের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে থাকি, ট্রেনিং করতে হয় মালকোঁচা মেরে! লুঙ্গি-গেঞ্জি-কে ইংরেজিতে লুঙ্গি-গেঞ্জি বলায় হাসতে লাগল কাউর। বলল, উই উইল সি টু ইট। ইউ ক্যান গো নাও।
ততক্ষণে হালকা হয়েছে পরিবেশ। সাহস বেড়ে গেছে আমার। বললাম, স্যর, এক জায়গায় থাকতে-থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। একদিনের জন্যে ছুটি চাই। ক্যাম্পের বাইরে ঘুরতে যাব।
পরের রোববারে ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার পেলাম! তবে একাই যেতে হবে আমাকে। আর ফিরে আসতে হবে সাঁঝ ঘনাবার আগেই।
.
রোববার দিন সকালে ডাক পড়ল কোয়ার্টার মাস্টারের কামরায়। একজোড়া পুরনো বুট, চটের মোজা আর ঢোলা হাফপ্যান্ট পেলাম। এরপর কোয়ার্টার মাস্টার জানাল, বাইরে
ঘুরতে যেতে পারি আমি। তবে বেশি দূর যেন না যাই। রাস্তা হারিয়ে ফেললে ফিরতে পারব না সময়মত। রুমে ফিরে পোশাক-আশাক পরার পর দেখাতে লাগল গ্রাম্য দফাদারের মত! যা হোক, সামরিক পোশাক পরেই ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম আমি। লুঙ্গি পরে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল পায়ে যে বেরুতে হয়নি, তাতেই যথেষ্ট খুশি। প্যান্টের পকেটে দুটো শুকনো রুটি আর জলের বোতলও নিলাম!