হ্যাঁ, তাই হবে। বুঝতে পেরে একটু স্বস্তি লাগে রাশেদের। আসলে হয়েছে কী, বুড়ির মৃত্যুর পর থেকে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। গতকালের সকাল-দুপুর তো পার হয়ে গেছে বুড়ির দাফন-কাফন ইত্যাদি করে। আশপাশের প্রতিবেশীরা কেউ কেউ এসেছিল, তারাই সব গুছিয়ে করেছে। রাতেও দূর-সম্পর্কের কয়েকজন আত্মীয় ছিল, বাড়িতে, একা হবার সুযোগ ঘটেনি আর।
কিন্তু সকালের পর থেকে…।
অস্বস্তি অবশ্য হতেই পারে। আর সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে বুড়ির বয়স হয়েছিল, হতে পারে যে বার্ধক্যজনিত কারণে বড় বেশি ভুগছিল, কিন্তু আরও কিছুকাল হয়তো বাঁচত। তারপর আপনা থেকেই আশ্রয় নিত মৃত্যুর কোলে। কিন্তু এটাও ঠিক যে সেই মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে রাশেদ নিজেই। নিজ হাতে দুধের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়েছে নানিকে। সরল বিশ্বাসে একমাত্র নাতির হাত থেকে গ্লাসের দুধ পান করেছিল বুড়ি।
বড় বৃষ্টি হচ্ছিল সে রাতে এই শহরের বুকে…
তিন
বৃষ্টি মানে রীতিমতন ঝুম বৃষ্টি। রান্নাঘরে যখন কুসুম গরম দুধের গ্লাসে ঘুমের ওষুধগুলো খুঁড়ো করে মেশাচ্ছিল, জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বারবার।
চোখে ছানি পড়েছিল শেষকালে, ঠিকমতন দেখতে পেত না নানি। নিজের হাতেই গ্লাসখানা বুড়ির হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল রাশেদ।
এটা খেয়ে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে।
মনে কয় না, বাপ। আইজকে খাইয়াম না।
খাবে না মানে কী? রাতে তো কিছু খাও নাই। কলা দিব সাথে?
ফোকলা দাঁতে হাসে বুড়ি পরম মমতায়। ওরে, আমার বাপ রে, মনে কয় না রে দুধ খাইতে।
ডাক্তার বলেছে খেতে। খাও, আরাম হবে। খাও।
ছোট একটা চুমুক দেয় গ্লাসে নানি, আর চিলের মতন প্রখর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রাশেদ। এই এক গ্লাস দুধ শেষ হবার ওপর নির্ভর করছে তার আগামীকাল। এবং সত্যি বলতে কী, তার জীবনের নিরাপত্তাও। অনেক বুঝিয়েছে বুড়িকে সে, কিন্তু কিছুতেই বাড়ি বিক্রি করে অর্থের সংস্থান করতে রাজি হয়নি বুড়ি। বুড়িকে পরপারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা ছাড়া আসলেই কোনও পথ ছিল না সামনে।
ও, নানি, তুমি না একবার এই পুকুরে ডুবে গেছিলে… বহুকালের পুরানো প্রসঙ্গ আবার টেনে তোলে নাতি। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, কথার ছলে দুধটুকু খাইয়ে দেয়া কেবল। বলো না ওই গল্পটা। পানির নিচে কী জানি ছিল?
আলোক আছিল রে। হ্যাঁজাকের বাত্তির মতন আলোক। …তখুন তো এইখানে এত্তবড় দালান আছিল না, আছিল টিনের ঘর। দালান তো অনেক পরে তুর নানাজানে করছে। …আমার বাপজানে বড় শখ কইরে এই পুষুনি কাটায়েছিল একমাত্র কইন্যার জন্যে। আমার বড় হাউশ আছিল পুষুনিতে গোসুল করুম, সাঁতার কাটুম।
তোমার আব্বা তোমাকে অনেক ভালবাসতেন, তাই না?
ওরে, পোলায় কয় কী? আমার বাপজানের জান আছিলাম আমি, বুঝছোস? বাপজান আমার জনমের পর থেইকে নাকি কইত, এই মাইয়া আমি বিয়া দিমু না। ঘরের খুঁটি বানায় রাখুম প্রয়োজনে, তাও বিয়া দিমু না।
এই জন্যে নানাজানকে ঘরজামাই রেখেছিল? টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না নাতি।
ধুরো, হারামজাদা। তুর নানাজানে তো ঘরজামাই আছিল আমার কারণে। পীর সাহেবে কইছিল এই ভিটার থেইকে আমারে পৃথক না করতে, পুস্কুনি থেইকে পৃথক না করতে। হেই কারণে তো নানাজানে এই ভিটায় আছিল। তুর নানাজানে কি আর শখ কইরে থাকত নাকি…
নানাজানের গল্প বাদ। তুমি পুকুরে ডোবার গল্পটা বলো তো। আর দুধটা খাচ্ছ না কেন? খেতে খেতে গল্প বলো… তাড়া দেয় রাশেদ।
অগত্যা দুধের গ্লাসে আবার চুমুক।
আমার বয়স তখন বারো, বুঝছোস? ডাঙর হইছি, এইদিক-ওইদিক থেইকে বিয়ার প্রস্তাব আসে। মাথায় অনেক লম্বা চুল আছিল, ওই চুলের জইন্যেই আসত বিয়ার প্রস্তাব। একদিন হইছে কী জানোস, পুষুনির ঘাটে বইসে চুলে তেল দিতেছি…হঠাৎ দেখি সামনে ইয়া বড় এক সাপ। মাগো মা, কী সেই সাপ! ফণা তুইলে বইসে আছে সামনে। বাড়ির দুয়ার থেইকে আম্মাও দেখছে সেই সাপ, আর সাথে সাথে তো দিছে চিক্কুর। বাপজান আছিল না বাড়িত, আমি আর আম্মায় শুধু…হইল কী, চিকুরের সাথে-সাথেই সাপে দিল ছোবল। আমার আর তারপরে কিছু মনে নাই।
তুমি তো পুকুরে পড়ে গেছিলে, নাকি?
সেইটাও আমার মনে নাই রে, বাপ। আম্মার কাছে শুনছি যা শুনার। আম্মায় বলছে সাপে কাটার সাথে-সাথে নাকি আমি তো অজ্ঞান। ছিলাম পুষুনির ঘাটে, অজ্ঞান হইয়ে। সোজা গিয়া পড়লাম পানিতে। আর তলায় গেলাম। আম্মা একলা মেয়েমানুষ কী করবে? খালি চিক্কর দিতেছিল। লোকজন জড় হইয়ে খুঁজাখুঁজি কইরে শেষমেশ দুইঘণ্টা পরে পাওয়া গেছিল নাকি আমারে।
মনে মনে হাসে রাশেদ। আদ্যিকালের মানুষের এই হলো এক ব্যাপার, সবকিছু বাড়িয়ে বলবে। পাঁচ-দশ মিনিটকে বাড়িয়ে বলছে দুই ঘণ্টা। দুই ঘণ্টা পানির নিচে থাকলে কি মানুষ বাঁচে নাকি? তাও যে মানুষকে সাপে কেটেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে তো সাপের বিষেই মরে যাবার কথা।
…পানির থেইকে তোলার পরে তো আরেক কাহিনি, বুঝছোস? সকলে তো ভাবছে আমি বাইচে নাই, এত সময় পানির তলে থাইকে তো আর মানুষ বাঁচে না। পানি থেইকে তোলার পরে তো দেখা গেল আমি নিঃশ্বাস নেই না। আমি পষ্ট দেখছি যে আমারে সাপে কাটছে। আমি একা না, আম্মাও দেখছে। পানির থেকে তোলার পরে দেখা গেল কোথাও সাপে কাটার চিহ্নও নাই। ওঝা ডাকছিল বাপজান। বিষ ঝাড়নের জইন্যে। ওঝায় কইছিল, শরীলে বিষের কুনো বালাই নাই। আমারে নাকি সাপেই কাটে নাই কুনোদিন..