একে কি খুন বলা যায়?
মোটেই না, অন্তত রাশেদের তা মোটেই মনে হয় না। তবুও আজকের এই রোদজ্বলা অলস দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে। বুড়ির জন্যে মনটা কেমন-কেমন করছে। আবার কী মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাসও আসে বুক ঠেলে। নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে কতরকমের কাজই না করতে হয় এই জীবনে!
দুই
ঘরে ফিরে নিজের এটা সেটা গোছগাছ করতে শুরু করে রাশেদ একসময়। এতকালের সংসার, তবু নেবার মত বেশি কিছু নেই, নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কেবল। সত্যি বলতে কী, নিতে চাইলে নেয়া যায় বুঝি অনেক কিছুই। এতকালের সংসার ঠাসা কত শত হরেক রকমের জিনিসপত্রে। তবে বুড়ি নানির কাছে এসবের যতটা মূল্য ছিল, রাশেদের কাছে এখন ততটাই মূল্যহীন। কাল থেকে রাশেদের ঠিকানা হবে গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে, বন্ধুদের সাথে স্বপ্নের স্বাধীন জীবনের শুরু। আর নতুন সেই জীবনে এই জরাজীর্ণ পুরানো বাড়ির কিছুই সাথে নিতে চায় না সে। এ দুটো ঢাউস সুটকেসে পরনের জামা-কাপড় আর নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ধরে যায় সব। টেবিলের এক কোণে পড়ে আছে ভার্সিটির বইপত্রগুলো, সাথে নেবে কি নেবে না ভাবে একবার। শেষে না নেবারই সিদ্ধান্ত নেয়। আগামীকাল কোম্পানির সাথে চুক্তি হবার পর মোটা অর্থের অর্ধেকটা জমা হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, আর সেই অর্থের পরিমাণ এতই বিশাল যে এমন বইপত্রের কাড়ি কয়েক লক্ষবার কেনা যাবে অনায়াসে। অযথা টেনে নেয়ার মানে নেই।
বাইরে বেলা পড়ে আসছে ক্রমশ, পুকুরটার চারপাশে আস্তে-আস্তে ঘনাচ্ছে বিকালের ছায়া। জানে না কেন, কাজের ফাঁকেও পোড়ো পুকুরটার অন্ধকারের দিকে নজর যায় বারবার। পুকুরের দিকে, নাকি পুকুর পাড়ে বুড়ির কবরের দিকে? অযথা কবরস্থানের জায়গা কিনে পয়সা নষ্ট করতে চায়নি রাশেদ, বুড়ির এত পছন্দের পুকুর পাড়েই শেষ করেছে। সমাহিত করার কাজ। কিছুদিন পরে এখানে মাথা তুলে দাঁড়াবে বিশাল শপিং মল। না থাকবে এই পুকুর, না থাকবে বুড়ির কবরের চিহ্ন। কিন্তু তাতে কী? রাশেদের মনে হয় না যে সে কোনও অন্যায় করেছে। বুড়ির বাপের ভিটাতেই সমাহিত করেছে দেহ, এবং বুড়ি নানির আত্মা তাতে শান্তি পাবে বলেই মনে হয়।
তবুও বারবার নজর যায় কবর আর পুকুর পাড়ের দিকেই। পোড়ো এই বাড়ির সীমানায় কুকুর-বেড়াল দূরে থাক, এই দিনের বেলাতেও একটা কাক-পক্ষীর সাড়া শব্দ নেই আজ। বুড়ির কটা পুষি বেড়াল ছিল, গতকাল তার। মৃত্যুর পর থেকে সেগুলোও গায়েব। মনে হচ্ছে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বুঝি। থমথমে, দম বন্ধ করা একটা পরিবেশ। কেমন জানি ভৌতিকও।
নাহ্, আজ রাতটা থাকা যাবে না এখানে। এই পোডড়া বাড়িতে কোনও সুস্থ মানুষ একঘণ্টা থাকলেই পাগল হয়ে যাবে। কী করে যে এতগুলো বছর কাটিয়েছে, তাই এখন বুঝে উঠতে পারে না।
ছপ…ছপ…
মনে হয় কী যেন একটা হেঁটে জানালার ধার দিয়ে গেল। বেড়ালগুলো ফিরে এল কি? মনে-মনে একটু স্বস্তিই লাগে রাশেদের, এতবড় বাড়িতে সে একদম একা নয় ভেবে। এগিয়ে দেখে জানালার ধারে পরম আগ্রহে, তবে চোখে পড়ে না কিছুই। বেড়াল তো, এক জায়গায় বসে থাকার প্রাণী নয়। এতক্ষণে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পাঁয়তারা করছে নিশ্চিত।
একটা বাটিতে গরুর দুধ যা আছে, ঢেলে রাখে কেন জানি। আজই তো শেষ, কাল থেকে বেড়ালগুলোরও ঠিকানা বদলে যাবে, আশ্রয় নিতে হবে অলি-গলিতে। শেষমুহূর্তে একটু আহ্লাদ করলে কিছু আসবে যাবে না।
ছপ…ছপ…
এবার শব্দ আসে বসার ঘর থেকে। বেড়ালগুলোই নিশ্চিত। তবে বেড়াল দৌড়ালে ছপছপ আওয়াজ হবে কেন? ভেজা কাপড় পরনে কেউ হাঁটাহাঁটি করলে বরং এমন শব্দ হতে পারে।
একতলা বাড়ি হলেও তেমন অন্ধকার নয়, ভালই আলোর যাওয়া-আসা আছে। তবুও বসার ঘরটা এ মুহূর্তে কেমন অন্ধকারই ঠেকে রাশেদের। আরও অবাক লাগে, যখন দেখতে পায় বসার ঘরের কার্পেটটা ভিজে চুপচুপ করছে। ভিজে আছে সোফা সেটও। বেড়ালগুলোই নিশ্চিত, ভিজে শরীরে জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাইরে তো বৃষ্টি-বাদলের চিহ্ন নেই। বেড়ালগুলো ভিজল কী করে? যাই হোক, ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। নিজের ঘরের দিকে রওনা হয় রাশেদ। যাবার সময় চোখে পড়ে বুড়ির ঘরের ভেজানো দরজার গোড়াতেও একরাশ পানি। বেড়ালগুলো তাদের প্রভুকে খুঁজছে বোধহয়।
দেখার আগ্রহ বোধ করে না আর। কোথায় পানি জমল, কোথায় কী নষ্ট হলো এসব নিয়ে মাথা খারাপ করবার সময় কই? কাল থেকে এই বাড়ি, এই বেড়াল, এই পরিবেশ সব ইতিহাস হয়ে যাবে। টুকটাক শখের জিনিসগুলো গুছিয়ে নিলে সময়টা বাঁচবে বরং। সন্ধ্যার আগেই চলে যাবে ঠিক করেছে, অযথা রাত কাটাবার দরকারটাই বা কী? বন্ধু সিয়ামকে বলেছে গাড়ি নিয়ে আসতে, চলে আসবে যে কোনও সময়। রাতে জোস একটা পার্টির পরিকল্পনা আছে উত্তরার দিকে। এখানে একা পচে মরার চাইতে পার্টি করা ঢের ভাল। হাতে এখনও সময় আছে কিছু, আর কাজও প্রায় শেষ। বিছানায় একটু গড়িয়ে নেয়া যেতে পারে, কেননা বাকি রাত তো আর আরাম করার সুযোগ মিলবে না। তা ছাড়া… ছপ..ছপছপছপ…ছপ…
সে আওয়াজ! মনে হয় বুঝি ঘরের ঠিক সামনে দিয়েই হেঁটে যায় কেউ। তাও ভেজা শরীরে একরাশ পানি নিয়ে। চট করেই ঘুরে দাঁড়ায় রাশেদ। কিন্তু নাহ্, কেউ নেই। কীসের না কীসের শব্দ, কোথাও পানি-টানি পড়ছে বোধহয়। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল, বাড়ির আশপাশে গর্তগুলোতে পানি। জমেছে। সে পানিতে ব্যাঙ লাফাচ্ছে বোধহয়, আর সেই আওয়াজ জানালা দিয়ে আসছে…