নিতল – রুমানা বৈশাখী
এক
ছেলেবেলায় পানির কাছে যেতে দেখলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসত বুড়ি। নিতল পানি, বাপজান। নামিস না। থাউক, বাপজান, থাউক!
হাজা-মজা পুকুরটার ধারে বসে শ্যাওলা-সবুজ পানির দিকে তাকিয়ে বহুকাল পর বুড়ির জন্যে মনটা কেমন করতে থাকে আজ রাশেদের। দুপুরের রোদ ডানায় মেখে অলস ভঙ্গিতে উড়ে যাচ্ছে কয়েকটা কাক, ছায়ার খোঁজে। আকাশজোড়া রোদরূপী সোনালি আগুন, পুকুরটার চারদিক ঘিরে তপ্ত আলোর আঁকিবুকি করছে। তবুও কিছুতেই বুঝি এতটুকু কাটে না হাজা-মজা পুকুরটার শ্যাওলা-সবুজ পানির অন্ধকার অতলতা। চারপাশের আলোর ছড়াছড়িতে বুঝি আরও বেশি করে আঁধার-কালো মনে হয়।
ছেলেবেলায় বুড়ি কোনওমতেই কখনও নামতে দেয়নি পুকুরের পানিতে। এমনকী বড়বেলায়ও না। ছোট্ট বয়সে অনাথ হওয়া রাশেদের সাত কুলে আপনজন বলতে ওই এক বুড়ি নানিই তো ছিল। বাবা মারা গিয়েছিল জন্মের আগেই, কিছুকাল বাদে নাকি মা-ও। মায়ের চেহারাটা এক বিন্দুও মনে নেই, থাকবার প্রশ্নও ওঠে না। বুদ্ধি হবার পর থেকে এই এক নানিকেই দেখেছে, পরিবার সম্পর্কে যা একটু টুকিটাকি শোনা আছে তার সবটুকুই বুড়ির মুখ থেকে। নানি, রাশেদ আর এই একতলা ঝরঝরে বাড়িটা-এই ছিল এতকাল রাশেদের দুনিয়া।
হ্যাঁ, ছিল। এখন নেই।
গতকাল থেকে বুড়ি নেই জীবনে। আর আগামীকাল থেকে এই অভিশপ্ত বাড়িও থাকবে না। যক্ষ হয়ে আগলে বসেছিল এই বাড়িটাকে বুড়ি। ঢাকা শহরের ওপরে এতখানি জায়গা নিয়ে মাত্র একতলা একটা বাড়ি আর সাথে হাজা-মজা এই পুকুর আগলে বসে থাকার মত বোকামি আর কী হতে পারে? নিজের সামর্থ্য না থাকুক, কোনও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে দিলেই তো লারে লাপ্পা। নগদ টাকার সাথে তৈরি ফ্ল্যাট গোটা কয়েক, আর কী লাগে জীবন হেসে খেলে পার করতে?
কিন্তু নানিকে এসব বোঝাবে কে? নানির বাবার বাড়ি ছিল এটা, জন্মের পর থেকে এখানেই কেটেছে বুড়ির জীবন। প্রথমে ছিল টিনের ঘর, পরে এই একতলা বাড়ি করেছিলেন। রাশেদের নানাজান। ঘর-জামাই ছিলেন তিনি, খুব সম্ভব স্ত্রীর কারণে হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কী বন্ধন যে ছিল এই বাড়ির সাথে নানির, বিয়ের পর স্বামী নিয়েও এই বাড়িতেই থেকে গেছে মৃত্যুর আগের মুহূর্তটা পর্যন্ত। শেষের দিকে তো ঘর থেকেও বেরতে চাইত না, ডাক্তারের কাছে যাবার জন্যেও না। মাঝে মাঝে এসে কেবল বসে থাকত এই হাজা-মজা পুকুরের ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটে। বয়স হয়েছিল নব্বই, ছানি পড়া চোখে দেখতে পেতও না ভাল করে। পুকুর পাড়ে বসে নিকষ কালো পানির শরীরে কী দেখার চেষ্টা করত বুড়ি কে জানে। মাঝে তো মনে হত বুঝি বাপের ভিটা নয়, বুড়ির বন্ধন আসলে এই পুকুরটার সাথে।
দুজনের সংসারে উপার্জনক্ষম কেউ ছিল না, কাজেই অর্থ-কষ্ট তো ছিলই বরাবর। একতলা বাড়িটার একটা অংশ ভাড়া দিয়ে চলত সংসার খরচ, আর বিপদে-আপদে হাত দিতে হত নানাজানের রেখে যাওয়া সামান্য কিছু সঞ্চয়ে। বিক্রি না করুক, পুকুরটা ভরাট করে গোটা দুই টিনের ঘর তুললে কিন্তু অনায়াসে আয় বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারত। কিন্তু না , বুড়িকে রাজি করাতে পারেনি কিছুতেই। কেন যেন মনে হত, পুকুরটার অস্তিত্বকে কেমন একটু ভয়ই করে বুড়ি।
সে যাই হোক, আজ আর সে নেই। এবং কোনও বাধাও নেই জীবনে। সত্যি বলতে কী, বুড়ির মৃত্যুতে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে রাশেদ। মনে-মনে এই একটা কামনাই ছিল যে বুড়ি মরুক, কেননা বুড়ি না মরলে মরতে হত তার নিজেকেই। নানান জায়গায় বিশাল অঙ্কের সব ঋণ জমেছে তার, আর পাওনাদারেরা সব পেশাদার ঋণ ব্যবসায়ী। পাওনা টাকা কী করে উদ্ধার করতে হয় তা ভালই জানা আছে তাদের, সাথে চড়া সুদ আদায়টাও। বুড়ি তো আর বুঝত না যে আজকাল অল্প-বিস্তর নেশাপানি সকলেই করে, না হলে বন্ধু সমাজে ঠিক প্রেস্টিজ থাকে না। আর একটু স্টাইল নিয়ে বাঁচতে, গেলে পকেট গরম না হলে কি চলে নাকি?
ঠিক আছে, ঠিক আছে, রাশেদ না হয় নেশাটা একটু। বেশিই করে। কিন্তু তাতে কী? বন্ধুরাও তো সব করছে, সে-ই বা কেন পিছিয়ে থাকবে? দুই দিনের তারুণ্য, একটু মৌজ মাস্তি করা যেতেই পারে। আজ এ পার্টি, কাল সে পার্টি-সব মিলিয়ে একটা চটকদার জীবনধারার পিছনে খরচ অনেক। আর এই জীবনধারার জন্যেই তো বন্ধুমহলে আজকাল এত জনপ্রিয় সে।
বুড়ি হয়তো বুঝত না তেমন কিছুই, তবে যেটুকুই বুঝত তাতে চোখ রাঙাত বড় বেশি। একদিকে রোজকার ফুর্তির খরচ জোগানো, অন্যদিকে পাওনাদারের ক্রমাগত হুমকি ধমকি, সাথে বুড়ির চোখ রাঙানি-সবমিলিয়ে অসহ্য ঠেকছিল জীবনটা। টাকার অভাবে মেয়েগুলোও একের পর এক হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, অথচ নাকের নিচে পড়ে ছিল অর্থের এত বড় খনি। কতদিন আর সহ্য হয় এসব?
সুতরাং…
রাশেদ তাই করেছে, যা করবার দরকার ছিল নিজের জীবন বাঁচাবার জন্যে। বুড়ির বয়স হয়েছিল, বড় কষ্ট পাচ্ছিল বার্ধক্যের নানান জ্বালায়। রাত হলেই শ্বাসকষ্টে কেঁদে-কেঁদে মত্যকামনা করত সষ্টিকর্তার দরবারে। রাশেদ বেশি কিছু করেনি, সে চাওয়াটাই পূরণ করেছে কেবল। ডাক্তার যে ঘুমের ওষুধ দিতে বলেছিল, সেটার মাত্রাটাকেই কেবল বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যস, পরম শান্তিতে মৃত্যুলোকের ওপারে পাড়ি জমিয়েছে বুড়ি।