রাতে আমরা কোনও রকমে কিছু একটা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। এক ঘরে আমি, টগর আর আম্মা। অন্য ঘরে ফুফু আর ওঁদের বাড়ির আরেকজন। আব্বা বাইরের ঘরে শুলেন। আর ঘরের ভেতর এই সময় প্রস্রাব আসলে একটা পিতলের পাত্রে করতে হবে এই ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু হঠাৎ আমার প্রচণ্ড পায়খানা ধরল। রাতের বেলা আমি আম্মাকে ডেকে তুলতে ভয় পেলাম। সারাদিন অনেক কেঁদে কেঁদে আম্মা মাত্র ঘুমিয়েছেন। আমি টগরকে ডেকে তুললাম। বললাম আমার সাথে যেন একটু বাইরে পায়খানার কাছে যায়। টগর ল্যাম্প জ্বেলে আমার সাথে আসল।
পায়খানা ছিল বাঁশের তৈরি। নিচের দিকে একটা সিমেন্টের পাত বসানো। তাতে একটা ফুটো। উপর দিকে খোলা। গ্রামের খুব সাধারণ পায়খানাটা আমার কাছে কেমন যেন ভয়ানক মনে হলো। টগর বাইরে একা একা দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছিল। আমি বুদ্ধি করে দরজা খোলা রেখে পায়খানাতে বসলাম। কিন্তু বসার পরপরই মনে হচ্ছিল কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে চারপাশ। দূরে কোথাও যেন একটা পাখি ডেকে উঠল। জঙ্গুলে পরিবেশে এর আগে কোনও দিন, আমি এত রাতে ঘর থেকে বের হইনি।
আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিল ভয়ে। মনে হচ্ছিল ভয়ে পায়খানা না করেই দৌড় দিই। তবুও মনে মনে সুরা পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে বসলাম পায়খানাতে। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলো আমি পানি নিয়ে আসিনি। টগর বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে বললাম একটা কিছুতে করে কিছু পানি নিয়ে আসতে। টগর দৌড় দিল শুনেই।
একা একা বসে আছি। মনে হচ্ছে চারপাশে কেমন যেন একটা মরা মরা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোট বেলায় আমার মন ছিল অনেক কুসংস্কারে পূর্ণ। রাক্ষস খোক্কসের গল্প পড়ে পড়ে মনের ভেতর জন্ম হয়েছিল অন্ধকারের প্রতি নিদারুণ ভয়। আজকে সেটা মনে করে আমার হাসি পায়। কিন্তু সেদিন আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম।
খানিক পর টগর পানি আর ল্যাম্প দুই হাতে ধরে নিয়ে এল। আমি এতক্ষণ অন্ধকারে ছিলাম সেটা টগরের হাতে ল্যাম্প দেখে মনে পড়ল। ভালয় ভালয় আমি পায়খানা সেরে যেই বের হতে যাব, এমন সময় আমার পায়ের কাছে কিছু একটা টুপ করে পড়ল। আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলাম। প্রথমে শিশির মনে করলেও পরে টগর আমার পায়ের কাছে। ল্যাম্প ধরে দেখে লালচে কিছু একটা। আমি আর টগর প্রায় একসাথে উপরে তাকালাম। দেখি আমাদের ঠিক উপরেই কেউ একজন বসে আছে। দেখেই আমার শরীরে কাঁপুনি ধরে। গেল। ভয়ের চোটে গলা শুকিয়ে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি টগরের গা শক্ত হয়ে গেছে ভয়ে। ভয়ে ভয়ে টগরের হাত থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে আমি উপর দিকে ধরলাম। যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। লোকটার সারা শরীরে কিছু নেই। মুখ ভর্তি দাড়ি আর গোঁফ। পা ঝুলিয়ে বসে বসে কিছু একটা খাচ্ছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখা যাচ্ছে চোখ দুটো। লালচে সাদা চোখ দেখেই আমি চিনে ফেললাম ওকে। সে আর কেউ নয়-আমাদের নিশি মিয়া।
কিন্তু সে এখানে কী করে? এই সব ভাবার আগেই দেখি নিশি মিয়া পেটের খানিকটা নিচের দিক থেকে এক টুকরো মাংস কেটে নিল। তারপর ঘঁাচঘঁাচ করে কেটে খেতে খেতে বলল, খোকা বাবু, কথা দিসিলাম রোগীরে বাঁচাতি না পারলি নিজের মাংস খামু। হের লাইগা তোমাগোরে দেখাইয়া দেখাইয়া খাইতেসি।
বলেই ধারাল কিছু একটা দিয়ে নিজের রান থেকে। গ্র্যাচর্ঘ্যাচ করে এক টুকরো মাংস কেটে খেতে শুরু করল। টপটপ করে রক্ত পড়ে চলেছে। পড়ছে ঠিক আমার সামনে। ভয়ে টগরের দিকে আমার তাকানোর সময় ছিল না। আমি সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই।
পরের দিন আমাদের দুজনকে অজ্ঞান অবস্থায় আম্মা দেখতে পান। পরে আমাদের দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেক খোঁজ করেও নিশি মিয়ার দেখা পায়নি কেউ। আব্বা অনেক খোঁজ করেছিলেন। কিন্তু পাননি। মাঝে আমিও বড় হয়ে যাই। অনেক দিন কেটে গেছে। আমি হাই স্কুল পাশ করে কলেজে উঠে যাই। দেখতে দেখতে আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হই। অনেকগুলো বছর পার হয়ে যায়। আমিও ভুলে যাই নিশি মিয়ার কথা। এখন আমি পড়াশোনার কাজে থিসিসের জন্য এসেছি আমার গ্রামের পাশের গ্রামে। এখানে থাকতে হবে এক বছর। এই এক বছর গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষদেরকে নিয়ে থিসিস করতে হবে। দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে এইখানে থাকাটা আমার মন্দ লাগছে না। শুধু থাকা-খাওয়াটা একটা সমস্যা। তবে এখানে এখন বেশ কেটে যাচ্ছে সময়।
এই লেখাটা যখন লিখছি তখন অনেক রাত। অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ নেই। নেই কোনও মেঘ। চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আমি রাত জেগে পড়াশোনা করি। কিন্তু আজকে আমার মন কিছুটা বিক্ষিপ্ত। গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবের শরীর অনেক খারাপ। ডাক্তার অনেক ট্রিটমেন্ট করেও তাকে ভাল করতে পারেনি। তার পরিবারের লোকজন বলাবলি করছিল অন্য ব্যবস্থা নেবে। ওঁর হার্টের কোনও একটা প্রবলেম। এই সব ভাবতে ভাবতে রাত জেগে থিসিসের কাজ করছি। এমন সময় অনেক দূর থেকে কারও মৃদু চিৎকার শোনা গেল। আমি পড়া ছেড়ে উঠে বাইরে বের হয়ে এলাম। কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘরে ঢুকে যাব, এমন সময় অনেক দূরে একটা আগুনের শিখা দেখতে পেলাম। আমার ঘর থেকে সোজা দেখা যায় অনেক দূর। গাছ-পালা কম। অন্ধকারের মাঝেই দেখলাম একটা আগুনের শিখা এগিয়ে আসছে কিছুটা, আবার থামছে। প্রতিটি বাড়ির সামনে থেমে থেমে বাড়ির মানুষের নাম ধরে একবার করে ডেকে ডেকে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কিছুটা সামনে আসতেই আমি বেশ ভালভাবেই দেখলাম লোকটাকে। মাথায় সেই বিশাল ঝাঁকড়া চুল। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। আর সেই ভয়ানক দুটো চোখ। একটু ভাল করে লক্ষ করতেই দেখলাম সেই নিশি মিয়া। আমার বাড়ির দিকেই আসছে। নাম ধরে ডেকে চলেছে মানুষকে। যে-ই সাড়া দেবে সে-ই বেঘোরে প্রাণ হারাবে। আরেকটু ভালভাবে দেখতেই দেখি নিশি মিয়ার পেটের ঠিক নিচটায় কেমন যেন খাবলানো। রানের জায়গায় জায়গায় মাংস নেই। কেউ যেন কেটে নিয়ে গেছে সেখানকার মাংসগুলো….