আর সাথে সাথে আরও একটা মাছ পেলাম। আমার পাশে মাছটাকে রাখতে রাখতে আমি খেয়াল করলাম, লোকটার শরীর থেকে কেমন যেন কাঁচা মাছের গন্ধ বের হচ্ছে। আমি পাত্তা দিলাম না। খানিকটা সরে এসে বসলাম। আর সাথে সাথে আরেকটা মাছ পেলাম আমি।
আপনি কী করেন? মাছটাকে ছিপ থেকে খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলাম।
আমি? কিছু করি না, আবার অনেক কিছুই করি, বলেই খিক খিক করে হেসে ফেলল সে।
মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মানে আমি নিশি ডাকি মাঝে মইধ্যে।
এটা কী জিনিস? এটা হইল এমন জিনিস…যদি আমি সফল হই তাইলেও মানুষ মরে, সফল না হইলেও মানুষ মরে।
তা মানুষ মরার কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে যাব, এমন সময় পেছন থেকে নিশি মিয়া আমাকে ডেকে বলল, বাবা, আমারে একটা মাছ দিয়া যাও, মুখের হাসি হাসি ভাবটা উধাও। সেখানে হুকুমের সুর।
আমিও ভয়ে একটা মাছ তাকে দিয়েই সেদিনের মত বিদায় নিলাম। বাসায় বাবার আগেই মাছ ধরে আনতে পারার খুশিতে সেদিন ভুলেই গেলাম নিশি মিয়ার কথা। কিন্তু আমার এখন মাঝে মাঝে মনে হয় সেদিন আমি মাছটা দেয়ার সাথে সাথে পেছন ঘুরে কাঁচা মাছটাই খাওয়া শুরু করেছিল নিশি মিয়া। হয়তো আমি ভুল দেখেছিলাম। হয়তো না। কে জানে।
পরের দুই দিন আমি নিশি মিয়াকে বেমালুম ভুলে গেলাম। কারণ টগর আর ওর মা-বাবা, মানে আমার ফুফা ফুফু এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে। আমার থেকে এক বছরের বড় টগর আমার সাথেই স্কুলে পড়ত। আর ওকে পেয়েই আমি ভুলে গেলাম সবকিছু। দুইজনে যত পারলাম দুষ্টামি করলাম। নিজেদের আমবাগান ফেলে আরেকজনের বাগানে হানা দিলাম। ইচ্ছেমত চুরি করা, ইচ্ছেমত ডাব খাওয়া-এভাবেই কেটে গেল তিনটা দিন।
পঞ্চম দিনে হঠাৎ করে সব আনন্দ থেমে গেল। সকাল বেলা ফুফা নাস্তা করে বাজারে গেছিলেন। সেখান থেকে লোকজন ধরাধরি করে আনল বাড়িতে। প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় উনি কাতরাচ্ছেন। আমরা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। ডাক্তার ডাকা হলো। উনি নিয়ে যেতে বললেন সদর হাসপাতালে। বাবা খুব দ্রুত ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। সেখানে ডাক্তার ওঁকে ওষুধ দিলেন। কিন্তু বুকের ব্যথা কমে না। আমরা সবাই হাসপাতালে ছিলাম। বাবা আমাকে আর টগরকে নিয়ে বাড়িতে চলে এলেন।
বাড়িতে এসেই কেয়ারটেকারকে দিয়ে ডাকালেন নিশি মিয়াকে। নিশি মিয়া আসার আগেই আমাকে আর টগরকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিলেন বাবা। কিন্তু আমার কেন যেন সন্দেহ হলো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়ালে থেকে ওঁদের কথা শুনলাম।
বাবা, আমার বোন-জামাইরে তুমি বাঁচাও, নিশি মিয়া।
নিশি মিয়া, বাঁচাইতে পারুম, তয় আমারে কাইল রাইত পর্যন্ত টাইম দেয়া লাগব।
বাবা, তোমাকে বিনিময়ে কী দেব?
নিশি মিয়া, বেশি কিছু না, শুধু আমারে দুইখান কাঁচা মাছ আর মুরগি দেবেন। পেটে বড় খিদা।
বাবা, আর যদি তুমি বাঁচাইতে না পারো?
নিশি মিয়া, না পারলে আমি আমার নিজের শইলের মাংস কাইটা খামু।
ওইটুকু শুনেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম আমার ঘরে। সেখানে ঢুকেই কিছুক্ষণ ভয়ে কথা বলতে পারিনি। পরে টগরকে বলেছিলাম। কিন্তু সে কোনওভাবেই বিশ্বাস করেনি।
পরের দিন আমি দুইবার হাসপাতালে গিয়ে ফুফাঁকে দেখে এসেছি। ওঁর অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেছে। কিছুক্ষণ উনি ঘুমান। আবার কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করেন। এর মাঝে সন্ধ্যার দিকে নিশি মিয়া এসে দেখে গেছে। ওঁকে। আমি মায়ের কাছে শুনেছি নিশি মিয়া নাকি ফুফাঁকে কী একটা পানি খাইয়ে দিয়েই চলে গেছে কাজে। সেদিন সন্ধ্যায় টগর ছিল ওর বাবার সাথে। আমি একা একা কাটিয়েছি বাসায়। পাশের পাড়ার সুমন আর সুমি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। সুমন এসেই আমাকে এক আজগুবি গল্প শোনাল। নিশি মিয়া নাকি ধুপ ধুনো নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে। সে আজকে নিশি ডাকবে। প্রতি বাড়ি বাড়ি গিয়ে একবার ধুনো দেবে আর বাড়ির মানুষের নাম ধরে একবার একবার করে ডাকবে। যদি কেউ সেই ডাকে সাড়া দেয় তবে তার মরণ হবে। আর আমার ফুফা বেঁচে উঠবেন।
শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বাসায় বাবা ছিলেন নিচে। আমি আর মা ছিলাম উপরে। নিশি মিয়ার কাছে বলা ছিল সে যেন আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায়ও না আসে। আমাদের এই কারণে কোনও ভয় ছিল না। সারারাত ধরে আমি দুরুদুরু বুকে কেঁপেছি নিশি মিয়ার ডাক শোনার জন্য। হঠাৎ করে মনেও হয়েছিল কে যেন অনেক দূরে ডেকে ডেকে চলেছে। কিন্তু মনের ভুল মনে করে আমি আবার ঘুমিয়ে গেছি।
এর পরের দিনটা আমাদের জন্য অনেক খারাপ একটা দিন ছিল। ফুফু রাতের বেলাতেই মারা গেছেন। নিশি মিয়ার নিশি ডাক কোনও কাজ করতে পারেনি। লাশ নিয়ে যাওয়া হলো ফুফার বাড়িতে। সেখানে আমরা সবাই গেলাম। সবার মন খারাপ। ফুফু আর টগরের চোখের কান্না দেখে আমিও থাকতে পারিনি। অনেক কেঁদেছি। জলজ্যান্ত মানুষটাকে মরে যেতে দেখলাম আমি। মরে যাওয়া মানুষের শরীরের গন্ধ শুকলাম সেই প্রথম। ফুফাঁকে গোসল করানোর সময় ফুফার শরীরের দিকে তাকিয়ে কেন যেন মনে হচ্ছিল উনি মরেননি। ঘুমিয়ে আছেন মাত্র।
ফুফার দাফন সম্পন্ন করে সেদিন রাতে আমরা থেকে গেলাম ফুফুদের ঘরে। ওঁরা খুব একটা অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন না। একটা কুঁড়ে ঘর ছিল ওদের। ফুফাঁকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে এর থেকে সামান্য দূরে একটা ডোবা আছে। সেখানে ওঁদের ঝুলন্ত পায়খানা ছিল। আর সামনে একটুকু উঠান-এই নিয়ে ছিল ওঁদের বাড়ি।