আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে দিলাম ওকে। সিগারেটে একটা টান দিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল ওটা। চমকে উঠে দাঁড়াল। বলল, ওহ, মাই গড! ও বলেছিল এই কথা যেন কাউকে না বলি। ওর আসল রূপ যেন কাউকে ফাস না করি। তা হলে আমাকেও সে খুন করবে!
আমি তার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে চারদিকে
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে হাইওয়েতে। হঠাৎ একটা গরম। হাওয়া ঝাঁপটা মারল। একটা চিৎকার শুনলাম। আরমানের চিৎকার। ঝটকা দিয়ে ওর শরীরটা দশ ফুট উপরে উঠে গেল। ঝড়ো গতিতে তার দেহটা শূন্যে ভেসে ধেয়ে গেল হাইওয়ের মাঝখানে। ধপ্ করে আছড়ে পড়ল পিচের রাস্তায়। ততোধিক ঝড়ো গতিতে ধেয়ে আসছিল একটা ট্রাক! একটা মাত্র আর্তচিৎকারই দিতে পেরেছিল আরমান। ট্রাকটা ওকে পিষে চলে গেল দ্রুত গতিতে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। কয়েকজন পথচারী দৌড়ে এল ঘটনাস্থলে। আমিও গেলাম। কেউ একজন পুলিশ স্টেশনে মোবাইল করল।
পিশাচী তার কথা রেখেছে। ততক্ষণে রাত হতে চলেছে। পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। বেচারা আরমান পালিয়েও বাঁচতে পারল না।
আমি বাড়ি ফিরছিলাম। আরমানের গল্পটা তখনও মাথায় আলোড়ন তুলছিল। মহল্লার রাস্তায় পড়তেই গাটা ছম ছম করে উঠল। বাড়ি যেতে হলে একটা মাঠ পেরুতে হয়। ওটার কাছে আসতেই দেখতে পেলাম মাঠের পাশের চালতা গাছটার তলায় একটা মেয়ে, একটা দড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে গাছটার অপেক্ষাকৃত নিচু ডালটা লক্ষ্য করে। নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করবে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখলাম। ছুটে যেতে চাইলাম মেয়েটাকে বাঁচাতে। সহসা মনে পড়ল আরমানের কাহিনী। থমকে দাঁড়ালাম। ভয়ের একটা শীতল স্রোত অনুভব করলাম রক্তে। দ্রুত পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। আমি চাই না আমার অবস্থাও আরমানের মত হোক!
নিশি মিয়া – রাজীব চৌধুরী
নিশি মিয়াকে আমি সেদিনের আগে কখনও দেখিনি। দেখেছি তাও অনেক দিন হলো। হয়তো সময়ের হিসাবে বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে গেছে। ঠিক মনে নেই কতদিন আগে। তবে তখন আমি মনে হয় ক্লাস ফাইভে কিংবা সিক্সে পড়ি। অনেক ছোট ছিলাম। গরমের ছুটিতে গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে কেউ থাকে না। আমরা শহরেই থাকি। সেই জন্য মাঝে মাঝে আমার স্কুল ছুটি হলেই বাবা-মা আমাকে নিয়ে ছুটে যান আমাদের বাড়িতে।
আমাদের বাড়িটা বিশাল। বিশাল বলতে আক্ষরিক অর্থেই বিশাল। কিন্তু মানুষজন নেই বললেই চলে। আমার দাদার একমাত্র ছেলে আমার বাবা আর আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে। বাবা ব্যবসা দেখার জন্য শহরে চলে। এসেছেন। সাথে আমার লেখাপড়ার চিন্তাও মাথায় ছিল। সেই জন্য আমাকে শহরে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়েছেন ভাল স্কুলে। কিন্তু বাবা গ্রামে কেয়ারটেকার রেখে সেখানকার সবকিছু পরিচালনা করেন। মাসে মাসে গ্রাম থেকে আমাদের জন্য চাল-ডাল আসে। আর প্রতি মৌসুমে আসে ফলফলাদি।
তবে কেয়ারটেকার বেচারা অনেক বুড়ো ছিল। আর সেই সুবাদে আমাদের বড় পুকুরের পাড়ে জংলায় আস্তানা গেড়েছিল নিশি মিয়া। খানিকটা পাগল টাইপের ছিল বলে তাকে আর কেউ ঘটায়নি। এমনকী আমার বাবাও নিশি মিয়াকে বেশ ভাল মতই দেখা-শোনা করার কথা বলে দিয়েছিলেন কেয়ারটেকারকে। কেন বলেছিলেন সেটা আমি জানি না।
সেদিন আমি বাড়িতে পৌঁছেই পাড়ার ছেলেদের সাথে মিলে খেলাধুলো করলাম। কিন্তু পরেরদিন বাবা যেই ছিপ নিয়ে পুকুর পাড়ে গেলেন, আমিও পিছু পিছু আরেকটা ছিপ নিয়ে বাবার থেকে দূরে আরেকটা ঘাটে বসে পড়লাম। বাবা শহুরে জীবনে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারেন না। তাই গ্রামে আসলেই বসে পড়েন বড় পুকুরের ধারে। আমিও বাবার কাছেই মাছ ধরা শিখেছি। কিন্তু আমার ছিপে মাছ সহজে আসে না। কী এক নেশা! এই নেশা সেই ক্লাস থ্রি থেকে আমাকে পেয়ে বসেছিল। মাঝে মাঝেই আমাকে নিয়ে বিভিন্ন লেকে মাছ ধরতে যেতেন বাবার। কিন্তু গ্রামে আসলেই আমাকে না বলেই চলে যান মাছ ধরতে। আর আমিও বাবার সাথে পাল্লা দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করি।
সেদিনও আমি বসেছি মাছের আশায়। ছিপে কেঁচো লাগিয়ে বসে আছি তো বসে আছি-কিন্তু মাছ আসে না। ইচ্ছে ছিল বাবার আগেই আমার মাছ আসবে ছিপে। কিন্তু আসে না। আমিও বসে আছি।
বাবা, এভাবে বসলি তো একটাও মাছ পাইবা না, পেছন থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় কে যেন বলে উঠল।
পেছনে তাকিয়েই আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ছোট্ট হৃৎপিণ্ড আমার লাফাতে শুরু করল পাগলের মত। আমি বাবা বলে চিৎকার করতেও ভুলে গেলাম প্রায়। লোকটা লাল রঙের একটা নেংটী পরা। সারা শরীরে আর কিছুই নেই। জায়গায় জায়গায় বড় বড় কিছু তাবিজ ঝোলানো।
জটপাকানো চুল দাড়ির ভিতর দুটো লালচে চোখ। এই দেখে আমার ভয়ে কাঁপাকাপি অবস্থা।
লোকটা বলল, বাবা, ভয় পাইসো? ভয় পাইয়ো না, আমি তোমারে কিছু করুম না, বলেই বিকট চিৎকার করে একটা হাসি দিল সে ভাঙা গলায়।
আমার ততক্ষণে কিছুটা সাহস ফিরে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম আপনার?
আমার পাশে এসে ঘাটে বসতে বসতে বলল, আমারে
সবাই নিশি মিয়া নামে ডাকে।
এটা কেমন নাম?
হা হা হা-এটার কোনও মানে নাই, বলেই আমার দিকে হেসে হেসে তাকাল। আমার ততক্ষণে মজা লাগতে শুরু করেছে। কারণ সে আমার পাশে বসার সাথে সাথে আমি একটা মাছের টোপ গেলা টের পেয়েছি আমার হাতে। ছিপে টান মেরে মাছটাকে ধরে কোনওরকমে আমার পাশে রাখা বেতের ঝুড়িতে রাখলাম। ঝুড়িতে আমার সদ্য ধরা মাছটা লাফালাফি করছে। বঁড়শিতে আপন মনে আবার কেঁচো মেশানো বিস্কিটের দলা লাগিয়ে ছুঁড়ে দিলাম পানিতে