আকাশ ছিল পরিষ্কার। রাস্তায় ঝুঁকে থাকা তেঁতুল গাছের ডালটার উপরের আকাশটা ভালভাবেই দেখা যাচ্ছিল। পরিষ্কার আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ। সে আলোতেও ওটাকে দেখতে পেলাম! সামনে থেকে বাবা আর দাদাজান থমকে দাঁড়ালেন। আমি তাদের কাছ থেকে হাত পাঁচেক দূরে একটা কাঁঠাল গাছের আড়াল নিলাম। ওটা বসে ছিল তেঁতুল গাছের ডালটায়। বিশাল দেহ। মাথার চুলগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তীব্র চোখে তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। তার চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলজ্বল করছিল। বাবা আর দাদাজান তার কাছে ধরা পড়ে গেছেন! খিলখিল করে হেসে। উঠল পিশাচ নারী। তার হাসিতে খান খান হয়ে ভেঙে পড়ল রাতের নীরবতা। তারপর যা ঘটল তা এতদিন রূপকথাতেই শুনেছিলাম! হঠাৎ একটা হাত তীব্র গতিতে ছুটে এল বাবা আর দাদাজানের দিকে। এক থাপ্পড়ে দুজন ঢলে পড়লেন মাটিতে। বুঝতে পারলাম ওঁরা আর এই জগতে নেই। আতঙ্কে বোবা হয়ে গেলাম। আমার পা যেন পেরেক দিয়ে কেউ গেঁথে দিয়েছে। ওটা গাছ থেকে নেমে এল। আবার স্বাভাবিক রূপ দেখা গেল তার। বাবা আর দাদাজানের লাশের সামনে এসে বসে গেল। আমি জানি এখন ওটা খেতে শুরু করবে ওঁদের লাশ। আমার চোখ ফেটে জল এল। তারপর ভীত পায়ে ফিরে এলাম ঘরে। দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মুক্তির উপায় ভাবতে লাগলাম। একদিনের ব্যবধানে মা-বাবা আর দাদাজানকে হারিয়েও ঘুম এসে গেল আমার চোখে। কখন। আমার পিশাচী বউ ফিরে এসেছে জানতে পারিনি।
পরদিন আমার বাবা আর দাদাজানের লাশ কোথাও পেলাম না। এমনকী তাদের হাড়গুলোও নয়। রাক্ষুসী ওঁদের সবটাই খেয়ে ফেলেছে নাকি? দিনে দিনে ওর ক্ষুধা বেড়েই চলেছে! আমাকে পালাতে হবে। আমার মনের কথা যেন সে বুঝে ফেলল। আমার কানের কাছে মুখ এনে হিসহিসিয়ে বলল, ওই চেষ্টাও কোরো না। তুমি পালিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। আমি জানি তুমি কাল রাতের ঘটনা সব দেখেছ। কাউকে ওকথা বলতেও যেয়ো না। তোমাকে আমি মারব না। তোমার আশ্রয় আমার দরকার। তোমার স্ত্রী হিসেবে থেকেই আমি আমার চাহিদা মিটিয়ে যাব। আর আমার পিছু নিতে চেষ্টা করবে না, আরমান। আবারও বলছি কাউকে বলবে না। বলেছ তো মরেছ। যাও, স্বাভাবিক মানুষের মত বাজারে যাও। ব্যবসাপাতি দেখ। দুপুরে বাড়িতে আসবে আর আমি লক্ষ্মী বউয়ের মত ভাত বেড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল ডাইনীটা।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার জানামতে। একজন ভাল তান্ত্রিক ছিল। তার নাম ছিল গোখরোনাথ। ভূত প্রেতের উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে ওস্তাদ। তার সাথে দেখা করলাম। সব কিছু বললাম। শুনে বলল, ভয় পাসনে, বেটা। ওটার ব্যবস্থা আমি করব। আজ সন্ধেবেলা যাব তোর বাড়িতে।
আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আমাকে যত্ন করে ভাত বেড়ে দিল আমার বউ। আমি খেলাম না কিছু। সেও কিছু বলল না। মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। এদিকে সন্ধে হয়ে এল। আমি। অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু গোখরোনাথ আসছে না। আমার বউ বলল, কারও জন্য অপেক্ষা করছ মনে হচ্ছে?
আমি কিছু বললাম না। সন্ধে গিয়ে যখন রাত হব হব করছে তখন আমি ভাবলাম, না, দেখে আসা দরকার। হয়তো তান্ত্রিক আমার বাড়ির পথ ভুল করেছে। না-ও চিনতে পারে। আমি উঠন ছেড়ে বের হব তখন আমার পিশাচী বউ হেসে উঠল। বলল, গোখরোনাথকে এগিয়ে আনতে যাচ্ছ? ঠিক আছে যাও। আমি অপেক্ষা করছি। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
তখনই আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম গোখরোনাথ আর নেই। এও সম্ভব!
তবু আমি পথে নামলাম। কিছুদূর এগুতেই অনেক। লোকের ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম টর্চ জেলে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক। তাদের আলো রাস্তার ওপর পড়ে থাকা লোকটার দিকে। তার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। ওই ডাইনী কেমন করে আমার বাড়ির মধ্যে থেকেও গোখরোনাথকে মেরে ফেলল? গোখরোনাথের মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে রাস্তার মাটি কালচে হয়ে আছে। চোখ দুটোতে সীমাহীন আতঙ্ক। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। বিষণ্ণ মনে ফিরে এলাম বাড়ি। আমি জানি রাতের বেলা ওর ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই রাতে পালাতে চাইলেও পারব না। পালাতে হবে দিনের বেলা। বাড়ি ফিরতেই যেন কিছু হয়নি এমনভাবে আমাকে ঘরে ডাকল সে। আমার পাশে বসল। বলল, কেন। এসব করতে যাও? তুমি আমার ক্ষমতা হয়তো জানতে না। এখন জানলে তো। আর ভুলেও এমন চেষ্টা কোরো না।
আমি কিছু বললাম না। রাতে আমার ঘুম এল না। মাঝরাতে সে বেরিয়ে গেল। শেষ রাতের দিকে ফিরে এল। আর আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকল। মুখ থেকে পচা নর মাংসের গন্ধ এল। আমার গা ঘিন ঘিন করতে লাগল, বমি আসার অবস্থা হলো। কিন্তু আমি নিশ্চুপ শুয়ে রইলাম। পরদিন সকালে যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে বেরিয়ে এলাম। যেন আমার গদিতে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি। তারপর পালালাম। হাইওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাছের বাস স্টপেজে এসে বাসে উঠে বসলাম। কোথায় যাচ্ছি, সেটা বড় কথা নয়। জানতেও চাইনি। আমার একটাই উদ্দেশ্য, ওটার কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া। তারপর আপনার সাথে দেখা… থামল আরমান। অনেকক্ষণ কথা বলার জন্য হাঁফাচ্ছে।