আমার প্রিয় কুকুরটাকে কে বা কীসে যেন বীভৎসভাবে পেট চিরে নাড়ি ভুড়ি বের করে হত্যা করেছে। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওটা, আতঙ্কিত চোখে চেয়ে। কী এমন জন্তুর আবির্ভাব হলো এলাকায় কে জানে? ভাবতে থাকলাম আমি। কোনও কিনারা করতে পারলাম না। কিন্তু ওই আশ্রিতা মেয়ে ঘরের কোণেই রয়ে গেল। দিনের বেলাতেই সে এমন করে। মতি মিয়াকে অন্য রকম মনে হলো। সে চোখ বড় বড় করে পাগলের মত আচরণ করতে থাকল। আর বলতে থাকল, আমি দেখেছি, সব দেখেছি, কিন্তু বলব না, আমি বলব না। মতিকে ডাকলাম, মতি, ঘরে আয়, কী দেখেছিস, আমাকে বল।
সে আরও ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, না, ওঘরে আমি যাব না। আমি দেখেছি, সব দেখেছি। চিৎকার করতে করতে সে বেরিয়ে গেল। রাতে সে জেগে থাকে। হয়তো কিছু দেখেছে। কিংবা কুকুরটাকে খুন করতে দেখেছে। খুনিকে।
মা আমাকে ফিসফিস করে বলল, সব ওই ডাইনীটার কাজ। ওটা যেদিন থেকে বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই শুরু।
আমার জন্য আরও বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল। মা বুঝতে পারলেও আমি বুঝিনি। কিন্তু পরদিন সকালে যখন মতি মিয়ার লাশ পাওয়া গেল তারা পুষ্করিণীর পাড়ে তখন আমি সত্যিকারের ভয় পেলাম। তারও পেটটা ছিল চিরা। দেহের বিভিন্ন জায়গা থেকে কেউ খাবলে খুবলে মাংস খেয়ে গেছে। পুলিশ-ফুলিশ, নানা ঝক্কি ঝামেলা শেষ করতে করতেই দিন শেষ হলো। গ্রামের লোকজন আমাদের বাড়িটাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। ওরা বলে আমাদের বাড়ির চারপাশে নাকি। কিছু একটা ঘুরে বেড়ায় রাতে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মেয়েটির এদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে এখন অনেকটা স্বাভাবিক। কথাটথাও বলে। কিন্তু নিজের পরিচয় বলে না। তবে এখন আর আমাদের বাড়ির আশপাশে কোনও অঘটন ঘটে না। গোরস্থানের কবর খুঁড়ে দুএকটা লাশ কে বা কিছুতে খাবলে খেয়ে গেছে এমন খবর আসে। ওটা শেয়ালের কাজ হতে পারে, ভেবে আমরা গা করি না। এর মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক হয়। যাকে আমি ভালবাসি তার সাথেই বিয়ে। পারভীনের সাথে।
কিন্তু বিয়ে আমার আর পারভীনকে করা হলো না। যেদিন বিয়ে সেদিন সকালে তার লাশ পাওয়া গেল বাশ ঝাড়ের মধ্যে। কেউ যেন তার দেহটা খুবলে খেয়ে গেছে! এদিকে বিয়ের কার্ড বিতরণ হয়ে গেছে। দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গম গম। বাবা আর দাদাজানের ইচ্ছায় আমার বিয়ে হলো ওই মেয়ের সাথে। যাকে আমি বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। মার ইচ্ছে ছিল না। মা তাকে তখনও ডাইনীই ভাবত।
বাসর রাত আমার হলো না। বিছানায় যেতেই আমার বউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মায়ের সাথে দেখা হতেই বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম,! কী হয়েছে, মা?
মা আমাকে বললেন, পুকুর পাড়ে আয়।
আমি গেলাম। মা বললেন, কাল রাতে বৌমাকে মাঝরাতে ঘর থেকে বের হতে দেখলাম! আমিও চুপি চুপি তার পিছু নিলাম, কিছুদূর যেতেই দেখি সে গোরস্থানের দিকে হাঁটা দিয়েছে… হঠাৎ থেমে গেলেন মা। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকলেন একদিকে। তার তাকানো লক্ষ্য করে ও দেখলাম তিনি জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর আমার ঘরের জানালা থেকে আমার বউ তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে এই দিকে! আমাকে দেখেই সরে গেল সে! আমার মা-ও আমার সামনে থেকে দ্রুত সরে গেলেন।
সেদিন রাতেই খুন হলেন মা! চরম আক্রোশে কেউ তার দেহটা ছিন্নভিন্ন করেছে। পুকুর পাড়েই পড়ে ছিল তার লাশ। এবার যেন আমি একটু একটু বুঝতে পারলাম। আসলেই আমি এক পিশাচ নারীকে বিয়ে করেছি। কিন্তু আমি যে তাকে চিনে ফেলেছি, তা তাকে বুঝতে দিলাম না। আমার মা যে মারা গেল তার মধ্যে কোনও অনুশোচনা দেখতে পেলাম না। এখন বুঝতে পারলাম পারভীনকে কে মেরেছে। আমার স্ত্রী হবার জন্যই সে একাজ করেছে।
সেদিন রাতে সে আমার সাথে ভাল ব্যবহার করল। আমরা মিলিত হলাম। আমার ইচ্ছে ছিল না। মা হারানোর বেদনা মনে তখনও ছিল। যা যাবে না কখনও। মনে মনে দৃঢ় সঙ্কল্প করলাম, আজ রাতে আর ঘুমাব না। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকব। তারপর ডাইনীটা ঘর থেকে বের হলে পিছু নেব। কে বলবে এমন সুন্দর মুখের একটা মানুষ পিশাচ। আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না। আমাকে নিজের চোখে দেখতে হবে।
সে যখন নিশ্চিত হলো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, বিছানা থেকে নামল। থমকে দাঁড়াল ঘরের মেঝেতে। নিশ্চিত হতে চাইছে ভালভাবে। তারপর দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। বাইরে থেকে দরজাটা ভেজিয়ে নেমে গেল সে উঠানে। আমি আরও কতক্ষণ মটকা মেরে পড়ে রইলাম। তারপর আস্তে করে নেমে এলাম নিচে। বাইরে বেরিয়ে এলাম। নিঝুম রাত। হালকা বাতাস বইছে। তার গন্তব্য আমি জানি। আজ একজনকে কবর দেয়া হয়েছে। আমি জানি তার গন্তব্য গোরস্থান। বাড়ির সীমানা ছাড়াতেই আমার সামনে দুজনকে দেখতে পেলাম। চমকে উঠলাম আমি। দাদাজান আর বাবা। ওঁরাও তা হলে পিশাচটার পিছু নিয়েছেন। মা মারা যাবার পর বাবা ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তার মনেও যে ডাইনীটাকে হাতে-নাতে ধরার ইচ্ছা ছিল তা জানতাম না। তারা বাপ ছেলে সাবধানে এগিয়ে চললেন। আরও কিছুদূর গেলেই একটা বড় তেঁতুল গাছ পড়বে রাস্তার পাশে। একটা মোটা ডাল রাস্তার উপর ঝুঁকে আছে, মাটি থেকে দশ বারো হাত উপরে।