মাছ ধরা ছিল আমার একমাত্র শখ। ভরা বর্ষায়, বৃষ্টিতে ভিজে, গভীর রাতে, যখনই সুযোগ পেতাম মাছ ধরতে যেতাম। মাছের ভাগ্যও ছিল আমার ভাল। কোনওদিনই খালি হাতে ফিরতাম না। বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে তাই মাছকুমার বলেই ডাকে। আমার বাবারও শখ ছিল মাছ ধরার। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখতাম বাবাও রাত নেই দিন নেই, বৃষ্টি বাদল নেই, সুযোগ পেলেই মাছ ধরতেন। সে যাই হোক, বাবার ওই রোগটা আমাকেও পেয়েছে। মা আমাকে মানা করতেন। বলতেন, রাত-বিরাতে যাস না, বাবা। ওদের মাছের প্রতি বেজায় লোভ। শেষে ঘাড়-টাড় না আবার মটকে দেয়। আমি শুনে হাসতাম। আমাদের বাড়ির পাশে একটা বিশাল বাঁশ ঝাড়। তার পাশেই একটা পুকুর। সবাই ওটাকে বলে তারা পুষ্করিণী। কোনও এক রাতে নাকি ওটাতে একটা বড় তারা খসে পড়েছিল আকাশ থেকে। তখন থেকে ওটার ওই নাম।
সেই তারা পুষ্করিণীর পাড়ে কচু ঘেঁচু আর বাঁশের জঙ্গলে নাকি মেন্দির মা বলে এক পেতনী থাকত। বাবা যখন রাতে বৃষ্টির পানিতে পুকুর পাড়ে উজিয়ে ওঠা (পুকুর থেকে লাফিয়ে পাড়ে ওঠা) কৈ মাছ ধরে বাড়ি ফিরতেন, তখন প্রায়ই দেখতেন বাঁশ বাগানের কাছে জবুথুবু হয়ে বসে আছে কেউ। বাবা জিজ্ঞেস করতেন, কে গো, মেন্দির মা নাকি? মেন্দির মা জবাব দিত, ওঁ। বাবা তার থলে থেকে দুটো কই মাছ ছুঁড়ে দিতেন মেন্দির মার দিকে। যেদিন বাবা মাছ দিতেন না সেদিন নাকি স্বরে আওয়াজ হত, কীরে, মাছ দিলি না? ওই সব আমরা ছোট থাকতে শুনতাম। তাই মার ওই ঘাড় ভাঙার কথা খুব একটা আমল দিতাম না। কিন্তু এখন সব কিছু হারিয়ে বুঝতে পারছি মায়ের কথা আমল দেয়া উচিত ছিল। মায়ের কথা শুনলে আজ আর আমাকে সব হারাতে হত না… থামল আরমান। একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ সিগারেট টানল। তারপর ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার শুরু করল।
দুই
বর্ষাকালের একদিন। সেদিন সারা দিন ধরে বৃষ্টি ঝরেছে। সন্ধ্যা হলো, রাত হলো। কিন্তু বৃষ্টির বিরাম নেই। তবে একটু কমে এসেছে। শুনেছি সোনা বিলে নানা রকম মাছ পানিতে নিত্য ঘাই মারছে। ঝাঁকে ঝাকে মাছ। বৃষ্টির পানিতে মাছেদের যেন আনন্দ। আমি আর নিজেকে ঘরে ধরে রাখতে পারলাম না। মা মানা করলেন। কিন্তু আমি শুনলাম না। ছাতা, ছিপ আর একটা চার ব্যাটারির টর্চও নিলাম। বড় একটা অ্যালিউমিনিয়ামের হাঁড়ির গলায় দড়ি বেঁধে : ওটাও নিয়ে নিলাম, মাছ রাখার জন্য। সোনা বিলের পাড়ে একটা ছাতিম গাছ আছে। ওটাই আমার বসার প্রিয় জায়গা। এর আশপাশটা ঝোঁপ-জঙ্গলে ভরা। নানা রকম গাছ। কিন্তু ছাতিম গাছের তলাটা আমি পরিষ্কার করে নিয়েছি।
চারদিক নীরব। ঝিঁঝিরাও ডাকছে না। কালো অন্ধকার। ছাতিম গাছটার তলায় পৌঁছে বিলের পানিতে টর্চের আলো ফেললাম। নিকষ কালো জলেও কয়েকটা মাছ হুটোপুটি করতে দেখে খুশি হলাম। বসে গেলাম ছাতিম গাছতলায়। বঁড়শিতে মাছের টোপ গেঁথে ছুঁড়ে দিলাম পানিতে।
টপাটপ মাছ ধরতে শুরু করে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁড়িটা প্রায় মাছে ভরে গেল। ঠিক তখনই আওয়াজটা শুনতে পেলাম। কেউ একজন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান পাতলাম। কান্নাটা আসছে আমার ডান পাশ থেকে। আমার ডান পাশে গজ পাঁচেক দূরে একটা আম গাছ। পাশে ঝোঁপ-জঙ্গল। আমি টর্চের আলো ফেললাম ওদিকে। সাথে সাথে চমকে গেলাম। একটা মেয়ে মানুষ ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর হাতের দড়িটা ছুঁড়ে দিচ্ছে কিছুটা নিচু হয়ে থাকা আম গাছের একটা ডালে। মুহূর্তে বুঝে গেলাম, গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস নিতে যাচ্ছে কোনও হতভাগী। আমি ছিপ ফেলে দৌড়ে গেলাম তার দিকে। টেনে তাকে নিয়ে এলাম ছাতিম গাছতলায়। তখনও সে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
তার মুখ থেকে একটা কথাও বের করতে পারলাম না। ভাল বিপাকে পড়লাম। কে জানে কার সাথে ঝগড়া করে কিংবা কীসের দুঃখে মরতে এসেছে! এখন ফেলেও যেতে পারব না। তাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে। বাড়িতে মা জেগে ছিলেন। দরজায় টোকা দিতেই খুলে দিলেন। আমি কীভাবে কী বলব ভেবে পেলাম না।
তারপরও সাহসে ভর করে সব কিছু খুলে বললাম। মা কতক্ষণ থ মেরে রইলেন। তারপর কুপিটা ওই মেয়ের মুখের কাছে ধরলেন। সাথে সাথে অস্ফুট একটা শব্দ করে হাত থেকে জ্বলন্ত কুপিটা ফেলে দিলেন। চমকে গেছেন ভীষণভাবে। চমকে গেছি আমিও! এমন রূপও মানুষের হয়! মা আর কিছু বললেন না। রাতটা অস্থিরতার মধ্যে কেটে গেল। মা তাকে শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম মার মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরদিন সকালে মা আমাকে ফিসফিস করে বললেন, পুকুর ঘাটে আয়। আমি ঘাটে গেলে মা আমাকে বললেন, বাবা, এ কাকে নিয়ে এলি তুই! এ তো বাবা মানুষ নয়! মানুষের এত রূপ হয় না। এ অন্য কিছু। খোদা জানে কী গজব নাজিল হবে এবার আমার সংসারে! আমি মাকে বললাম, মা, এ তোমার মনের ভুল। এসব ভেব না তো। আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম
কিন্তু মা আমার ভুল যে বলেননি তার প্রমাণ পেলাম পরদিন। তার আগে বলে নিই, মার সাথে পুকুর ঘাটে কথা বলে আমি গদিতে চলে আসি। বিকেলে বাড়ি ফিরে শুনি সারাদিন ওই মেয়ে অন্ধকার কোনায় বসে থেকেছে। মা এত করে ডাকার পরও বের হয়ে আসেনি। কিছু খায়নি ও। কিন্তু সন্ধে হতে না হতেই তার মধ্যে উতলা ভাব লক্ষ করলাম। কোণ থেকে বেরিয়ে এল সে। স্বাভাবিক নিয়মে চলাফেরা করল। আমার দিকে কটাক্ষে চেয়ে একটু যেন মুচকি হাসতেও দেখলাম। আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কিন্তু কথা বলল না, কিছু একটু খেলও না। সেদিন রাতে ভাল ঘুম হলো আমার। কিন্তু সকালবেলা বাড়ির কাজের লোক মতি মিয়ার চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের বাইরে বেরিয়েই থমকে গেলাম। চোখ বড় বড় হয়ে গেল।