ঝিম ধরা একাকী দুপুরে বুঝি চোখ লেগে এসেছিল। শুয়ে ছিলাম বড় বেডরুমটায়, হঠাৎ মনে হলো ভাইয়া রুমে এসে ঢুকেছে। আমার দিকে ভাইয়া তাকাতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। ভাইয়ার চোখে কোন মণি নেই। অদ্ভুত সাদা। আমি চিৎকার দিয়ে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। শীতকালেও আমি ঘেমে জবজবে হয়ে গিয়েছি। এত বাস্তব! এত বীভৎস স্বপ্ন! ঘুমটাও গেল, মনটাও দমে গেল। জায়গাটা আর ভাল লাগছিল না কিছুতেই। হাত-পা বিবশ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল পিছন থেকে কেউ এসে ঠাণ্ডা হাত রাখবে কাঁধে অথবা বিছানার নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে আমার পা টেনে ধরবে কেউ! সে এক অসম্ভব আতঙ্ক। ভাইয়া না আসা পর্যন্ত আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। ভাইয়া আসতেই ভয় কমে গেল। তাকে আর কিছু বললাম না।
আমি ওটাকে নিছক স্বপ্নই ভেবেছিলাম। তাই গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আমি রোজ একই স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। কখনও ভাইয়া, কখনও মা, কখনও বাবা এসে মণিহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! সে এক তীব্র আতঙ্ক! কিন্তু কী যেন হত আমার। ভাইয়া আসলেই আমি আর স্বপ্নের কথা বলতে পারতাম না। কী যেন বাধা দিত। পরদিন ভাইয়া আবার অফিসে যাওয়ার পর থেকে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। ঘুমাতে চাইতাম না। কিন্তু ঠিক ওই সময়েই জাদুবলে কে যেন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে ভয়ের জগতে নিয়ে যেত। অসম্ভব এক ভয়, আর ভয় পাওয়ার ভয়ঙ্কর এক নেশা! বুয়া সবসময় থাকত, কিন্তু তাও আমি স্বপ্ন থেকে রেহাই পেতাম না।
একমাসের ভিতরেই নতুন বাসা ঠিক হলো, কিন্তু ততদিনে আমি শুকিয়ে কাঠি-কাঠি হয়ে গেলাম। রোজ ভয় পেতাম। আমি যেন সম্মোহিত ছিলাম। স্বপ্নের কথা বলতে গেলেই আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। কাউকে বলতে পারতাম না। তাই বাসা পরিবর্তনের কথায় আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হয়নি।
চলে যাওয়ার আগের সন্ধ্যায় ভাইয়া আর আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। তখন ভাইয়ার এক কলিগ আর তার স্ত্রী এসে উপস্থিত হলেন। চা খেয়ে বিদায় নেয়ার সময় ওই ভাবী বললেন, তোমরা বেশ অনেকদিন থেকে গেলে এখানে। কিন্তু জানো, এই বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না। পিশাচের দল নাকি আপনজন সেজে এসে ভয় দেখায়! তোমরা কীভাবে থাকলে বলো তো? বলতেই-বলতেই ভাবীর চোখ পুরো সাদা হয়ে গেল!
তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। বোধহয় হার্টফেলই করেছিলাম। সে থেকেই আছি, বেশ আছি। শুধু জানি যে মরে গিয়েছি। একদিন আয়না দেখেছিলাম, দিব্যি ছায়া পড়ে।
আমার চোখও এখন একদম সাদা!
অন্য কিছু – রতন চক্রবর্তী
এক
লোকটা জবুথুবু হয়ে বাস থেকে নামল। ও আগে আর আমি পিছনে। নেমেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল। আমি লোকটাকে ধরে উঠালাম। লোকটার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে, আতঙ্কে। আমার দুবাহুর মধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। বয়সে প্রায় আমার মতই ইয়াং। গায়ের রং চাপা ফুলের মত ফর্সা। অত্যন্ত সুপুরুষ। মেয়েরা এমন ধরনের পুরুষকে পছন্দ করে। গায়ে সস্তা দরের জামা আর লুঙ্গি, যা তার রূপের সাথে মানাচ্ছে না। রাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকান, সামনে। একটা লম্বা বেঞ্চ পাতা। তাতে লোকজন বসে। এখন অবশ্য কোনও খদ্দের নেই। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে খদ্দের না থাকারই কথা। আমি লোকটাকে ওখানে বসালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু খেয়েছেন? চেহারা দেখেই মনে হচ্ছিল সে কিছু খায়নি। অন্তত দুদিন যে পেটে কিছু পড়েনি আমি নিশ্চিত।
– মাথা নেড়ে না করল সে। এই দুপুরে চা খাওয়ার চেয়ে ভাত খাওয়া ভাল। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে। আশপাশে কোনও হোটেল আছে কিনা। দোকানি বলল, দশ মিনিট মত হাঁটলে একটা বাজার মত পাওয়া যাবে। ওখানে হোটেল আছে। ভাত রুটি সবই পাওয়া যাবে। অনেকের মনে হতে পারে, রাস্তায় কত লোকই তো কত রকম ঝামেলায় পড়ে। হঠাৎ করে এই লোকটার জন্য আমার দরদ উথলে উঠল কেন? আসলে ওর চেহারাটা এমনই বনেদি টাইপ যে মনে হচ্ছিল এমন পরিস্থিতিতে সে কখনও পড়েনি। তার প্রতি কেন যেন একটা টান অনুভব করছিলাম। আর তার আতঙ্কিত চোখের ভাষায় অজানা এক রহস্য খেলা করছিল, যা আমাকে ভীষণ টানছিল।
হোটেলে বসে গোগ্রাসে লোকটা ভাত খেল। পানি খেল। তারপর তাকে বেশ সুস্থ মনে হলো। এতক্ষণে কথা বলল সে, থ্যাঙ্কস।
লোকটা শিক্ষিত, বুঝতে পারলাম। শিক্ষিত লোকের কথার ধরন অন্য রকম। আমি ভণিতায় না গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী, বলেন।
লোকটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, একটা সিগারেট খাওয়াবেন?
আমি বললাম, স্যরি, আমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। এক্ষুণি আনিয়ে দিচ্ছি।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা হাইওয়ের পাশে একটা গাছতলায় এসে দাঁড়ালাম। তারপর লোকটা ওই গাছতলাতেই বসে পড়ল। আমিও বসলাম। রাস্তা ধরে সাঁই সাঁই বাস-ট্রাক বেরিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামনে দিয়ে। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে লোকটা তার গল্প শুরু করল। কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর গল্প তার কাছে শুনব সেটা আমি আশা করিনি। তার ভাষাতেই গল্পটা তুলে দিলাম:
আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। দাদাজান নাম রেখেছেন আরমান। গ্রামে আমাদের বিশাল অবস্থা। আমার বাবাকে এক নামে সবাই চেনে। এলাকায় তাঁর প্রতিপত্তি আছে। অনেকেই তাকে ইলেকশান করতে বলেছে, কিন্তু তিনি ওসর পছন্দ করতেন না। আমাকে শহরে রেখে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বি.কম. পাশ করার পর বাবা বললেন, তাঁর ব্যবসা যেন দেখাশুনা করি। গঞ্জের বাজারে আমাদের চালের আড়ৎ। আমি আর আপত্তি করলাম না। বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করতে লাগলাম। দাদাজান বাড়িতেই থাকতেন। ফলফলাদির বাগান আছে। ফুলের বাগান আছে। তাই। দেখাশুনা করতেন। আমি ব্যবসাটা ধরে ফেলার পর বাবাও দাদাজানকে সঙ্গ দিতেন। এভাবেই দিন কাটছিল আমার। এদিকে মা এবার সুযোগ পেয়ে বসলেন। আমাকে বিয়ে করতে হবে। দক্ষিণ পাড়ার পারভীনের সঙ্গে আমার প্রেম ছিল। মাকে জানালাম সে কথা। কেউ কোনও আপত্তি তুলল না। উভয় পক্ষের কথা মত বিয়ের দিনও ঠিক হলো। কিন্তু সেই বিয়ে আর হলো না। তার আগেই আমার ভাগ্যে নেমে এল ভয়ানক বিপর্যয়।