নদীর ধার ঘেঁষে শুকনো রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বামে নদী, ডানে বাঁশ-বাগান অথবা আম্রকানন। এন্তার লাশ পড়ে আছে। বাগানগুলোর ভেতর। কুকুর-শেয়ালে টানাটানি করছে। ওগুলো। ভ্রূক্ষেপও করছে না কেউ। রণাঙ্গনে বাঁচা-মরা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা! নদীর জলে লাশ হয়তো ভাসিয়ে দেয়া যেত। তবে তাতে বিনষ্ট হতে পারে পরিবেশ। এখানকার লোকেদের খাওয়া-রান্না-স্নান সবই ওই নদীর জলে!
আমাদের সাথের এক পরিবার বুড়ো ঠানমাকে ডুলির ভেতর বসিয়ে বাঁশের বাঁকে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পালা করে একজন করে বইছে তাকে। বাঁকের সামনের ডুলিতে বাচ্চা দুটো ছেলেমেয়ে, পেছনেরটায় ঠানমা।
অর্ধেক রাস্তা পার হওয়ার পর বাজার মতন একটা জায়গায় জিরোতে বসলাম সবাই। ঠানমাকে বয়ে আনা লোকগুলোর লুতাভুতা অবস্থা। ঢকঢক করে জল খেয়ে ফোঁসফোঁস করে দম ছাড়তে লাগল তারা। শুনতে পেলাম ফিসফিস করে একজন আরেকজনকে বলছে, ওই বুড়ি মরে না কেন? আর তো পারি না, বাপু! চল, এক কাজ করি, বুড়িকে এখানেই ফেলে সটকে পড়ি আমরা!
এ কী বলছ, দাদা? মাকে রাস্তায় ফেলে যাবে? ভগবানে
সইবে না! বলল অন্যজন। এ প্রথমজন এইবার বলল, তা হলে এক কাজ কর। এখন থেকে তুই ওকে বয়ে নিয়ে যা। আমি আর পারব না, এই বলে দিলাম। তোর বউদিকেও বলেছি গতরাতে। তার মত আছে এ কাজে।
ঠিক আছে। বলছ যখন, দেখ কী করবে? উত্তর দিল দ্বিতীয়জন। এক সেকেণ্ডও লাগল না মত পাল্টাতে। ঠেলার নাম বাবাজি!
এরপর ঠানমার ডুলিটার দিকে এগিয়ে গেল প্রথমজন। গলায় মধু ঢেলে বলল, মা, এইখানে একটু বসো তুমি। দিলু-মিলুর মাকে নিয়ে পাড়ার ভেতর বাথরুম করাতে যেতে হবে। আমরা এই যাব আর আসব। ঠিক আছে? এই রে, দিলু-মিলু, তোরা না বাথরুম করবি বলছিলি? চল, যাই এখন। গাঁয়ের ভেতর থেকে বাহ্যি ফিরে আসি। তোর মাকেও বল। একসঙ্গেই যাব সবাই।
ছেলে যেমন বুনো ওল, মা-ও তেমনি বাঘা তেঁতুল। ঠানমা বলল, ওরে, বিশু। আমারও যে পেছন ফিরতে হবে। অনেকক্ষণ চেপে রেখেছি, এই বেলা না গেলেই নয়। রাস্তায় চলার সময় যখন-তখন তো আর তোদের থামতে বলতে পারি না। জানিস তো, যাত্রাপথে ঘনঘন থামা বিরাট কুলক্ষণ!
ঠানমার বুদ্ধির তারিফ করতেই হবে। এইখানে ফেলে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু হত তার। অথচ এখান থেকে বর্ডারের দূরত্ব মাত্র দুই কি. মি.! গোয়ালন্দের ওপারে মানিকগঞ্জ থেকে প্রথমে নৌকোয় চড়ে তারপর হেঁটে এসেছে পরিবারটা। পাড়ি দিয়েছে সোয়া শ কিলো পথ। অথচ আর মাত্র দুকিলো যখন বাকি, ধৈর্য হারিয়ে ফেলল ঠিক তখনই! মানুষের স্বভাবই তাই। বছর ভরে কষ্ট করে শেষের দিকে হাল ছেড়ে দেয়া। অথচ ওটাই আসল পরীক্ষা!
প্রাগপুর বর্ডার পার হয়ে ইণ্ডিয়ার শিকারপুরে এলাম আমরা। সেখান থেকে বাসে চড়ে কোলকাতা শহরে। জীবনে এই প্রথম দেখলাম ট্রামগাড়ি। গুটুর-গুটুর করে এগিয়ে যাচ্ছে কচ্ছপের মত। হ্যাঁণ্ডেল ধরে অনবরত ওঠা-নামা করছে। যাত্রী। কোলকাতায় তো এলাম, কিন্তু উঠব কোথায়? এখানে সেখানে থিকথিক করছে জয় বাংলা-র লোক, অর্থাৎ বাংলাদেশি শরণার্থী। সারাদিন রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা ছাড়া অন্য কোনও কাজ নেই এদের। বুকে ব্যাজ লাগানো ভলেন্টিয়ার আছে কিছু। ওদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম শরণার্থী ক্যাম্পটা কোথায়।
বিশাল এক খোলা মাঠের ভেতর শরণার্থী ক্যাম্প। তাঁবুর পর তাঁবু, অস্থায়ী ছাউনি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। থিকথিকে জল কাদায় ডুবে যাচ্ছে পায়ের গোড়ালি। শৌচাগার বলে কিছু নেই এখানে। যে যেখানে পারে, সেরে নিচ্ছে কাজ। মল মূত্রের দুর্গন্ধে আকাশ-বাতাস সয়লাব। শিশুদের ঊ্যা-ঊ্যা, মায়েদের খিস্তি-খেউড়, বুড়ো-বুড়ির ভগবান তুলে নিয়ে যায় না কেন! লক্ষ-লক্ষ জনতা-আমাশা, কলেরা, টাইফয়েড। এ এক জীবন্ত নরক! মনে পড়ল বড় মালিথার কথা, ইণ্ডিয়ায় যাবেন, বাবা? কিন্তু, ওখানে তো ভাল থাকতে পারবেন না। আমাদের কোনও জায়গা নেই সেখানে!
মাথা গুঁজবার মত কোনও জায়গাই পেলাম না শিবিরে। তিন বেলা লপসি খেতে লাগলাম। ডাল, মোটা চাল, আর সস্তা সজি দিয়ে এক ধরনের জলো খিচুড়িকে এরা বলে লপসি। সারাদিন রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরি আর তিন বেলা লপসি খাই। রাতে শুই মন্দির চাতালে। ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং। হট্ট মন্দির! বুঝলাম, এভাবে বাঁচতে পারব না। ভাল পরিবেশ চাই আমার। থাকতে হবে স্নান-আহারের সুবন্দোবস্ত আর ভাল শৌচাগার!
তিন দিনের দিন সকালের লপসি খেয়ে শিবির থেকে বেরুতে যাব, ঠিক সেই সময় দেখলাম কীসের যেন জটলা। কী? নাহ্, মুক্তিফৌজের লোক রিক্রুট হচ্ছে। খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলে ট্রেনিং ক্যাম্পে খাওয়া-থাকার সুবন্দোবস্ত আছে। এই তো চাই! মনে-মনে বললাম আমি। আগে জান তো বাঁচাই। যুদ্ধ পরে দেখা যাবে!
দুই
শেয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেনে করে আমাদের নিয়ে আসা হলো বিহারের শাশারাম জেলায়। এরপর আর্মি ট্রাকে তিন ঘন্টা জার্নি করে এলাম এক বাজপড়া এলাকায়। পথে রোহতাস নামে ছোট্ট একটা শহরে ট্রাক থামিয়ে চা-বিস্কুট খেতে দিয়েছিল। আশপাশে বিশ কিলোর ভেতর কোনও জনবসতি নেই। উষর মরুভূমির মত পরিবেশ। বৃষ্টি-বাদলের চিহ্নও নেই কোথাও। তাপমাত্রা বেয়াল্লিশের নিচে কখনও নামেই না। দুই সারি পাহাড়ের মাঝখানে খোলা বাটির মত জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প। মূল রাস্তা থেকে র্যাম্পের মত উঠে গেছে এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে পথ। তারপর ডানে মোড় নিয়ে আবারও ঢালের মত নেমে গেছে বাটির মত বৃত্তাকার উপত্যকায়। ঢালের গোড়াতেই ছোট্ট চেকপোস্ট। পরিষ্কার। বুঝতে পারলাম, আগে থেকে জানা না থাকলে ভীষণ কঠিন এই জায়গা খুঁজে বার করা! পাহাড় ঘেষে লম্বা ব্যারাক। ব্যারাকের একপাশে খাওয়ার মেস, অন্যপাশে হাম্মাম খানা।