আর সাথে সাথে বাড়ির সবগুলো আলো নিভে গেল।
এখলাস দেয়ালে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে এল ঘরটার মাঝখানে, যেখানে জামিল দাঁড়িয়ে ছিল। সারা ঘর একটা অদ্ভুত, গা-শিউরানো শব্দে ভরে গেছে। একটা জান্তব, ফাসফেঁসে গলার গর্জন, ঠিক যেমন এখলাস, গতকাল রাতে শুনেছিল।
ঘরের মাঝখানে আসতে পায়ে কীসের সাথে যেন ধাক্কা খেল। সাথে সাথে ভয়ে স্থির হয়ে গেল এখলাস। নিচে তাকাবারও সাহস পেল না।
অন্য তিনজনও ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে ছুটে এসেছে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা টর্চলাইট। সে আলোটা এখলাসের ওপর ফেলল। একমুহূর্তের জন্যে এখলাসের মনে হলো তীব্র আলোতে ওর চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তারপর ওর চোখ চলে গেল মেঝেতে।
যে মানুষটা মেঝেতে শুয়ে আছে তাকে দেখে আর জামিল বলে চেনা যায় না। ওর শরীর শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেছে, গায়ের চামড়া হয়ে গেছে রুক্ষ, খসখসে। ওর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। কথা বলার চেষ্টা করছে, আর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে অর্থহীন, ফাসফেঁসে শব্দ। ওর চোখে তীব্র, অসহায় আতঙ্ক।
টর্চ হাতে মানুষটা ডুকরে কেঁদে উঠল। মুরাদ। জামিলচাচা! আপনের কী হইল! ইয়া আল্লাহ!
এখলাস কোনওমতে নিজেকে শান্ত করে আয়াতুল কুরসী পড়তে লাগল। কলিম আর রাশেদও কাঁপা কাঁপা গলায় যোগ দিল ওর সাথে।
জামিল শেষ একবার চিৎকার করে উঠল, তারপর স্থির হয়ে পড়ে রইল মাটিতে।
বাসার সবগুলো লাইট আবার জ্বলে উঠল।
.
এক মাস পর।
এখলাস নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমাবার আগে ওর মাথায় আরেকবার ভেসে উঠল সেই কালো দিনের ঘটনাগুলো। প্রায় প্রতি রাতেই ওর মনে পড়ে যায় জামিলের ভয়ঙ্কর, অসহায় চেহারা। ওর, চোখের ভয়। আর মুরাদের স্বীকারোক্তি।
জামিলের মৃত্যুর পর স্বভাবতই পুলিশ আসে। এসে সবাইকে সন্দেহভাজন হিসাবে জেরা করা শুরু করে। মুরাদ এমনিতেই ভেঙে পড়েছিল, পুলিশি জেরার সামনে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি। সব সত্য স্বীকার করে।
ওই বাড়িতে আরেকজন কাজের লোক ছিল, সেলিম, যে পেলে বড় করেছে জামিলকে, তাকে আসলে জামিলের বাবা বের করে দেননি। ছেলে না জানিয়ে বিদেশ চলে যাবার পর জামিলের বাবা রাগে উন্মাদ হয়ে যান। জামিলের সব জিনিসে আগুন ধরিয়ে দেবার পর তার চোখ পড়ে সেলিমের ওপর। উনি সেলিমকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে বাসার নিচের একটা ঘরে আটকে রাখেন। তাকে কোনও খাদ্য-পানীয় কিছু দেয়া। হয়নি। মুরাদও তখন ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। তিন দিনের মাথায় সেলিম পানির পিপাসায় মারা যায়। মুরাদ ওর লাশ গভীর রাতে একটা ডোবায় ফেলে দিয়ে আসে। মারা যাবার আগে সেলিমও নাকি শুকিয়ে অস্থি-চর্মসার হয়ে গিয়েছিল।
এটুকু বলেই মুরাদ কান্নায় ভেঙে পড়ে। ও বিলাপ করতে থাকে যে, সেলিমের আত্মাই প্রতিশোধ নিয়েছে জামিল আর ওর বাবার ওপর। ও হয়তো প্রথমে জামিলের ক্ষতি করতে চায়নি, কিন্তু জামিল নিজের বাবার আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে চাওয়ার পর জামিলের ওপর রেগে যায়।
এখলাসের চোখে আলো পড়াতে পাশ ফিরে শুলো। এখন সারারাত বাথরুমের আলো জ্বেলে রাখে।
সাদা চোখ – সোহানা রহমান
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে এমন হয়। মনটা কেমন জানি তরল থাকে। অজানা দুঃখে মন ভারী হয়ে থাকে। আবার অদ্ভুত ভাল লাগায় হৃদয় অবশ হয়ে আসে। কোথায় দূরে কুহু-কুহু করে একটা কোকিল ডাকছে। ভোরের বেলায় মনটা কেমন করে উঠল। জায়গাটা প্রথমে ভাল লাগেনি একটুও। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিস্তর ফসলের খেত আর সোনালি হয়ে ঝুঁকে পড়া ধান দেখতে-দেখতে খারাপ লাগা খুব বেশিক্ষণ থাকল না। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। একে তো নতুন জায়গা। তার উপর সারারাত ট্রেইন চলে। কুউউউউউউউ করে হুইসেল বাজিয়ে মাঝে-মাঝেই ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া এখানকার টি.এন.ও হয়ে এসেছে। বিশাল সরকারি বাংলো। অনেকগুলো রুম, কিন্তু থাকার মানুষ নেই। আমার পরীক্ষা শেষ বলে আমাকেই আসতে হয়েছে সংসার গুছিয়ে দেয়ার জন্য।
কাল অনেক রাতে ট্রেইনে করে আমরা পৌঁছেছি এখানে। তখন আর গুছানোর সময় ছিল না। তাই আমি একটা বেডরুমে আর ভাইয়া ড্রইংরুমে বিছানা করে শুয়ে পড়েছিলাম। আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কুয়াশায়। ঝাপসা হয়ে যাওয়া ধানখেতগুলোতে সেই ভোরেই কৃষকরা কাজ করছিল। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরাও কাজ করছিল, কেউবা ব্যাগ কাঁধে করে স্কুলের উদ্দেশে রওনা করেছিল। সবকিছু এত ভাল লাগছিল যে আমি উঠে অনেকদূর হেঁটে এসেছিলাম। শিশিরে পা ভিজে উঠছিল, খোলা চুলে হাত দিয়ে মনে হয়েছিল কে যেন ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ঘুরে যখন বাসায় ফিরলাম ভাইয়া তখন উঠে পড়েছে। আজই তার জয়েনিং-এর ডেট। রাস্তার পাশ থেকে গরম-গরম চা আর তেল চুপচুপে পরোটা কিনে এনে তাই দিয়েই নাস্তা হলো। ভাইয়া চলে গেলে আমি গোছগাছ শুরু করলাম। অল্প কটা জিনিস ভাইয়ার। তাই গুছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। তারপর অফুরন্ত সময়। না আছে। টেলিভিশন, না আছে ইন্টারনেট
সময় কাটছিল না একটুও। অদ্ভুত এক জায়গায় বাংলোটা। আশপাশে কোন বাসা নেই। পিছনের দিকে বিস্তৃত ধানখেত, সামনের দিকে ট্রেইন লাইন। সেই ট্রেইন লাইন ছাড়িয়ে অনেকদূর গেলে মূল শহর। এই সৃষ্টিছাড়া জায়গায় কেন এত বড় একটা বাড়ি বানিয়েছিল কে জানে! পরিত্যক্ত সব বাড়ি সরকারি হয়ে যায়, পরবর্তীতে তা রূপান্তরিত হয় বাসভবনে। সেরকমই একটা বাড়ি এটা। কেউ থাকতে চায় না এই জনবিরল জায়গায়। এই বাড়িটা বুঝি ভেঙেই ফেলা হবে। নতুন সরকারি ভবন বানানো হচ্ছে, আর একমাসের ভিতর উঠে যাওয়া যাবে। ততদিন এই বাড়িতে থাকতে হবে। আর আমার ছুটি চলছে বলে এই একমাস আমিও ভাইয়ার সঙ্গে এইখানে থাকব ভেবে রেখেছি। ঠিক পাশের বাড়িটাও বেশ দূর। মাঝখানে একটা খেতের আইল পার হতে হয়।