.
সেদিন রাতে এখলাস শোবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। সে জামিলকে কথা দিয়ে এসেছে কালকেই জামিলের বাড়ি দোয়া পড়ে বন্ধ করে দিয়ে আসবে। সাধারণত এটা করতে পাঁচজন লাগে, তাই এখলাস আগামীকাল ওর দুই সাগরেদকে নিয়ে যাবে।
বিছানায় মশারি খাঁটিয়ে শুয়ে পড়ল। মগবাজারের একটা। ছোট বাসায় থাকে। বিয়ে-থা করেনি, এখানে থাকতে ওর তেমন সমস্যা হয় না। পুরনো বাসা, তাই হাজারো সমস্যা। মাঝে মাঝে ওর শোবার ঘরের লাইট নিজে থেকেই কয়েক ঘণ্টার জন্যে বন্ধ হয়ে যায়, আর বাথরুমের কল থেকে নিরন্তর টিপ টিপ পানি পড়তে থাকে, কিন্তু এখলাস কখনোই এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি।
এখলাস বেশি রাত জাগে না। আজকেও বিছানায় শুয়ে রাতের শব্দ শুনতে শুনতে ওর চোখ বুজে এল ঘুমে। জানালার বাইরে থেকে একটা নিশাচর পাখির কর্কশ ডাক ভেসে আসছে। দেয়ালে টিকটিকির টিক টিক ডাক। ফ্যানের ছন্দময়, যান্ত্রিক সঙ্গীত।
হঠাৎ ওর চোখ খুলে গেল। কী ব্যাপার? কী যেন মিলছে না। কোথায় যেন কী নেই। বিছানায় উঠে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল কীসের অভাব অনুভব করছে।
পাঁচ মিনিট কেটে গেল। এখলাসের চোখে কিছুই ধরা পড়ল না। আবার শুতে যাবে তখন বিদ্যুৎচমকের মত বুঝতে পারল কোন্ জিনিসটায় ওর অস্বস্তি হচ্ছে।
বাথরুমের কল থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এখলাস গত দুই বছর ধরে এ বাসায় থাকছে, আর প্রত্যেক রাতে ওর নিদ্রার সঙ্গী ছিল কল থেকে টিপ টিপ পানি পড়ার ওই শব্দটা। কিন্তু আজকে শব্দটা আসছে না।
জামিল না বলেছিল ওর বাসার কলগুলো থেকেও পানি পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে?
এখলাস বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে বাথরুমের লাইটটা জ্বেলে দিল। কিছুই নেই।
সত্যি বলতে কী, আশাও করেনি যে কিছু দেখবে। কিন্তু রাতের পরিবেশটাই এমন। কল্পনা অতি সাধারণ কোন ঘটনাকেও অলৌকিক রূপ দিতে চায়।
বাথরুমে ঢুকে দেখল কোথাও অস্বাভাবিক কিছু আছে। কিনা। ছাদের এক কোনায় একটা বিশাল, গর্ভবতী মাকড়সা ছাড়া চোখে পড়ার মত আর কিছু নেই। কলটা ছাড়তে পানির একটা ক্ষীণ ধারা পড়তে লাগল। সবই ঠিক আছে। লাইটটা নিভিয়ে বিছানায় ফিরতে যাবে এমন সময় জিনিসটা ওর চোখে পড়ল।
ওর মশারির ভিতর কী যেন বসে আছে।
অন্ধকারে একজন মানুষের আবছা আকৃতি দেখা যাচ্ছে। মানুষটা গুটিসুটি হয়ে বসে আছে, দুই হাঁটু বুকের সাথে জড়িয়ে। কপাল হাঁটু দুটোর ওপর রাখা। অসম্ভব শীর্ণ একজন মানুষ।
এখলাস এক কদম এগিয়ে এল।
মানুষটা নড়ল না। কিন্তু এখলাসের গলা থেকে একটা জান্তব গর্জন বেরিয়ে এল। গলাটা অপার্থিব, ভয়ঙ্কর। অনেকক্ষণ চিৎকার করবার পর মানুষের গলা যেমন ভেঙে ফাসফেঁসে হয়ে যায়, অনেকটা সেরকম।
এখলাস বিড়বিড় করে দরুদ পড়তে শুরু করল।
মটমট করে শব্দ হলো। মানুষটা আস্তে আস্তে মাথা তুলছে। ওর হাড়গুলো যেন অনেক পুরনো, ওর শরীরের ভার আর বহন করতে পারছে না।
এখলাস এবার জোরে জোরে দরুদ পড়তে লাগল। ওর কপালে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে। আস্তে আস্তে বেডরুমের লাইটের সুইচটার দিকে এগোচ্ছিল।
মানুষটার মাথা আস্তে আস্তে এখলাসের দিকে ঘুরল।
দড়াম দড়াম করে প্রচণ্ড জোরে শব্দ হলো দরজায়। একটা গলা ভেসে এল বাইরে থেকে, হুজুর? সব ঠিক আছে। তো?
এখলাসও ঠিক সেই মুহূর্তেই লাইটটা জ্বেলে দিল। কিছুই নেই বিছানায়।
উঁচু গলায় প্রতিবেশীকে বলল, জি, কাদের সাহেব, সব ঠিকই আছে।
.
পরদিন এশার আযানের আগে আগে এখলাস ওর সাগরেদ কলিম আর রাশেদকে নিয়ে জামিলের বাড়িতে হাজির হলো। অল্প কথায় জামিল আর মুরাদকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। জামিল বাড়ির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আযান দেবে, সে। সময় এখলাস, কলিম, রাশেদ আর মুরাদ বাড়ির চারকোনায় সুরা পড়ে একটা করে পেরেক ঠুকবে। এতে ঘরের মধ্যে যদি কোনও অশুভ প্রভাব থেকেও থাকে, সেটার আর কারও ক্ষতি করবার ক্ষমতা থাকবে না।
গতকাল রাতে কী হয়েছে সেটা এখলাস জামিলকে বলেনি। যদি ছোকরা মনে করে যে হুজুর নিজেই ভয় পাচ্ছে। তা হলে এখলাসের বদলে অন্য কাউকে নিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলেই এতগুলো টাকা গচ্চা।
এখলাস সবাইকে ওজু করে নিতে বলে নিজেও বাথরুমে ঢুকল। এবং ঢুকেই একবার সাবধানে আশপাশে তাকাল না, কিছু নেই। পানিভরা বালতির পাশে বসে ওজু সেরে নিল।
ড্রয়িংরুমে এসে আরেকবার সবাইকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। তারপর একটা হাতুড়ি আর পেরেক হাতে নিয়ে চলে গেল বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। কলিম, রাশেদ আর মুরাদ বাকি তিন কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর জামিল দাঁড়াল ড্রয়িংরুমের মাঝখানে। এটাই বাসার কেন্দ্রবিন্দু।
জামিল শুরু করল: আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর…
এখলাসও মনে মনে সুরা পড়তে লাগল। পেরেকের মাথাটা দেয়ালের সাথে চুঁইয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল, যাতে জামিলের আযান শেষ হবার সাথে সাথে পেরেকটা ঠুকে দিতে পারে।
আসসাদু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…
হঠাৎ এখলাসের কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। ওর গলা শুকিয়ে গেছে। ভয়ে নয়, বরং মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ পানি খায়নি।
জামিলের আযান থেমে গেল।
এখলাস হাতুড়ি-পেরেক ফেলে দৌড় দিল ড্রয়িংরুমের দিকে। বাড়িটা এত বড় যে দৌড়ে আসতে আসতেও প্রায় ৩০ সেকেণ্ডের মত লেগে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পা দিল ড্রয়িংরুমের দরজায়।