এখলাসের বিস্মিত দৃষ্টির জন্যে জামিল তৈরি ছিল। না থেমে বলে যেতে লাগল, আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, এখলাস সাহেব। কিন্তু পাশাপাশি আমি একজন স্পিরিচুয়াল। মানুষও। আমি মানবাত্মার ব্যাপারে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। আমি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাস না করলেও এটা বিশ্বাস করি যে মানুষের স্থূল দেহের ভিতর এক ধরনের সূক্ষ্ম দেহ আছে, যার সাথে কিছু নিয়ম, কিছু পদক্ষেপ পালনের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ করা সম্ভব।
ছোকরা তা হলে কাফির? তারচেয়েও খারাপ, এ তো মুশরিক বলে মনে হচ্ছে, যে কালো জাদুতে বিশ্বাস করে।
তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। আমার বাবার মৃত্যু খুব একটা স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ওঁর অসুখ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সাধারণ অসুখ নয়।
কী তা হলে?
জলাতঙ্ক।
এখলাস কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
সাধারণ নয় এ কারণে বলছি যে, বাবা কুকুর একদম পছন্দ করতেন না, এবং আমার জানামতে গত দশ বছরে বাবা কোনও কুকুরের কাছেও ঘেঁষেননি। ডাক্তারও বাবার মৃতদেহ পরীক্ষা করে বলেছেন যে তাঁর শরীরে কোনও কামড়ের দাগ নেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে টানা তিন দিন বাবা পানি খাননি, জোর করে খাওয়াতে গেলে বমি করে বের করে দিয়েছেন, ইঞ্জেকশন দিতে গেলে এমন দাপাদাপি করেছেন। যে ডাক্তাররা কাছে আসতে পারেননি।
জামিল আবার একটু থামল। ওকে এখন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। আমি ঢাকায় আসবার পরের দিন রাতেই বাবার সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করি। কিন্তু কোনওরকমের সাড়া পাইনি। ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকার পরেও মোমবাতির আলো পর্যন্ত নড়েনি। আমি ভেবেছিলাম বাবা হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চান না। কিন্তু ঘটনা ঘটা শুরু করে তার পরের রাত থেকে।
এখলাসের মনে হলো ছেলেটার ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে অন্য কীসের যেন ছাপ পড়েছে। ভয়?
সেদিন রাতে খাবার সময় পানি মুখে দেবার সাথে সাথে আমার বমি এসে পড়ে। পানিতে বিশ্রী, সোঁদা গন্ধ। প্রথমে ভেবেছিলাম জগে হয়তো ফাঙ্গাস পড়েছে, বা পানির ফিল্টারে। কিন্তু চেক করে কিছুই পেলাম না। আমি আর মুরাদচাচা মিলে ছাদের ট্যাঙ্কও দেখলাম, কিন্তু সেখানেও কোনও সমস্যা নেই। শেষ পর্যন্ত মুরাদচাচাকে বললাম দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনে আনতে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি, জানেন?
এখলাস বুঝতে পারছিল ছেলেটা কী বলবে, কিন্তু তারপরও জিজ্ঞেস করল, কী?
দোকানের পানিতেও ঠিক একই গন্ধ! আর গন্ধটা এতই তীব্র যে সে পানি ঠোঁটে ছোঁয়ানোই কঠিন, খাওয়া তো দূরের কথা। সেদিন থেকে শুরু। তারপর থেকে প্রত্যেকদিন একই ব্যাপার। যে পানি খেতে যাই তারই একই অবস্থা। ডাক্তার দেখালাম, কোনও অসুখ ধরা পড়ল না। তা ছাড়া মুরাদচাচা তো একই পানি খাচ্ছেন, ওঁর তো কোনও সমস্যা হচ্ছে না। প্লাম্বার ডেকে পানির পাইপ চেক করালাম, বলা বাহুল্য, কিছুই ধরা পড়ল না। আর ব্যাপারটা আরও সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াল তার পরের রাত থেকে। আমার বাসার প্রত্যেকটা কল থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল।
এখলাস এবার একটু থমকাল। এটা ও আশা করেনি।
আবারও বলছি এখলাস সাহেব, দম্ভ করছি না, কিন্তু বাবার এখানে প্রচণ্ড প্রতিপত্তি ছিল। আমি যখন এ বাসার নাম্বার থেকে ওয়াসার অফিসে ফোন দিই তখন ওদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় কে এসে পাইপ ঠিক করবে তা নিয়ে। কিন্তু ওরা এসে কোনও সমস্যাই খুঁজে পেল না। না আমার বাসার পাইপিং-এ, না ওদের নিজেদেরগুলোতে।
এখলাসের দিকে তাকাল জামিল।
কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেটার চোখজুড়ে ক্লান্তি আর ভয়ের ছাপ পড়েছে।
. গত চার দিন ধরে আমি কোক আর জুস খেয়ে বেঁচে আছি। বাড়ির কাজের পানি বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হয়। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে বাবার আত্মা আমার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি আমি অন্য কিছুকে ডেকে এনেছি। অতিষ্ঠ হয়ে আমি কালাম সাহেবকে খবর দিই। উনি বাড়িতে এসেই ঘাবড়ে যান। বারবার বলতে থাকেন যে এখানে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। উনি কোনও অশুভ অস্তিত্ব অনুভব করছেন। উনি আমাকে বলেন যে এসব ব্যাপারে ওঁর তেমন কোনও অভিজ্ঞতা নেই। উনি আপনার কথা বলেন, বলেন যে কারও যদি এই সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা থাকে তা হলে আপনারই থাকবে। এখন বলেন, এখলাস সাহেব, শুনে আপনার কী মনে হয়? সুরাহা করা কি সম্ভব?
এখলাস চিন্তিত মুখে নিৰ্জের দাড়িতে হাত বুলাল।
দেখেন, জামিল সাহেব, এর আগে আমাকে জিনের আসর হওয়া দুটো বাসায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আল্লাহপাকের দয়ায় ওদের সমস্যাগুলো কিছুদিনের মধ্যেই চলে গেছে। কিন্তু আপনার মত কেস ওদের কারওই ছিল না।
এখলাস একটা কুটিল হাসি গোপন করল। এদেরকে যত টেনশনে রাখা যায় টাকার অঙ্ক ততই বাড়ে।
তাই আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে এখানে আমি কতদূর কী করতে পারব।
উত্তর দেবার সময় জামিলের চোখ উদ্বিগ্ন দেখালেও গলা। ঠাণ্ডাই রইল। আপনার যদি টাকা পয়সা নিয়ে কোনও চিন্তা থেকে থাকে তা হলে তা দূর করে দিন। আমার এই সমস্যাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করতে হবে, ঠিক আছে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওর গলা শেষের দিকে কঠিন শোনাল।
এখলাস ভিতরে ভিতরে একটু অবাক হলো। জামিল আসলেই ভয় পেয়েছে। ভীষণ ভয়। ওকে দেখে সহজে ভয় পাবার ছেলে বলে মনে হয় না।
আমি আজ সকাল থেকে জুসও খেতে পারছি না, এখলাস সাহেব, জামিলের গলা ক্লান্ত, ভেঙে পড়া একজন মানুষের গলায় পরিণত হলো। ফলের রস, কোল্ড ড্রিঙ্কস্, যাই খেতে যাই না কেন, ওই অসহ্য গন্ধটা আমার নাকে এসে লাগে। আপনি যদি কিছু না করতে পারেন আমিও বাবার মত পানির পিপাসায় মারা যাব।