এ কাহিনি লেখার প্রথম দিকে যে কলাগাছটা ভেঙে পড়েছিল, পরদিন নদীতে নেমে ওটাকে কিনারায় টেনে তুলতেই রহস্যের সমাধান পাওয়া গেল। গাছের মাথায় আলিশান সাইজের ছড়া। গ্যাড়া সুন্দর জাতের কলার ছড়া যেমন বড় হয় গাছও তেমনি বিশাল। ছড়ার ভারেই বিরাট কলাগাছটি নদীতে ভেঙে পড়েছিল। তবে কথা হচ্ছে-গাছ ভাঙার আর সময় ছিল না?
পিপাসার্ত – তানজীম রহমান
শেষ একটা টান দিয়ে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিল এখলাস মুয়াজ্জিন।
যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, এধরনের বিরাট আলিশান বাড়িতে ওর শ্রেণীর লোকজন শুধু একটা কারণেই আসে। তৈলাক্ত হাসি মুখ নিয়ে ধনী মালিকদের কাছে সাহায্য চাইতে। স্যর, আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন, স্যর, আপনারাই মা-বাপ। স্যর, যদি কিছু দিতে পারেন তা হলে বাচ্চাটা পরের ক্লাস পড়তে পারবে, স্যর, নইলে এত ভাল।
একটা ছাত্রের ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ, স্যর।। কিন্তু এখলাস মুয়াজ্জিন এখানে সাহায্য চাইতে আসেনি, বরং বাড়ির মালিক ডেকে এনেছে। একটা ব্যাপারে তার সাহায্য দরকার। এমন একটা ব্যাপারে যেটায় এখলাস ছাড়া। আর কেউ কিছু করতে পারবে না।
নিজের সন্তুষ্ট হাসি গোপন করবার কোনওরকম চেষ্টা না করে এখলাস মুয়াজ্জিন দরজার বেল বাজাল।
একজন বয়স্ক কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিল। আসেন, হুজুর, আমার পিছনে আসেন। বাধ্য ছেলের মত এখলাস তার পিছে পিছে একটা বিশাল বসার ঘরে এসে পৌঁছাল। ও এতক্ষণ ইচ্ছা করেই আশপাশে তাকিয়ে দেখেনি, যাতে চাকরটা মনে না করে যে এরকম বড়লোকের বাসায় ওর আগমন এই প্রথম।
কিন্তু ড্রয়িংরুমটায় এসে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এত সুন্দর রুম ও কখনও দেখেনি।
প্রকাণ্ড ঘরটার সবকিছু সাদা রঙ করা, মেঝে, দেয়াল, ছাদ, সবকিছু। দেয়ালে কয়েকটা ছবি টাঙানো, কিন্তু কোনও ফোটো নেই। গোলাকার মেঝের মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের পাথরের টেবিল রাখা, এটাও সাদা রঙের। আর টেবিলের চারপাশ ঘিরে পুরনো আমলের রাজকীয় চেয়ার রাখা, যেগুলোর মধ্যে একটায় ঢোলা, সাদা শার্ট আর জিন্সের পান্ট পরা শীর্ণ, ফর্সা এক যুবক বসে আছে। ছেলেটার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ আর বেপরোয়া।
এখলাসকে দেখে উঠে দাঁড়াল। এখলাস মনে মনে খুশি হলো। বড়লোক হলেও ছোকরা বেয়াদব নয়।
আসোলামু ওয়ালাইকুম। এখলাস বলল।
ছেলেটা সালামের জবাব না দিয়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। আপনি এখলাস মুয়াজ্জিন, তাই না? আসার জন্যে ধন্যবাদ। আপনাকে কি কালাম সাহেব জানিয়েছেন। আমার সমস্যাটা কী?
কালাম জোয়ারদার হচ্ছে এখানকার মসজিদের ইমাম। সে-ই এখলাসকে বলে এখানে আসতে। এখলাস ছেলেটার সাথে করমর্দন করে জবাব দিল, খুব বেশি কিছু নয়। উনি শুধু বললেন যে আপনার বাড়ির ওপর আসর হয়েছে, আর স্থানীয় হুজুররা কেউই কিছু করতে পারছেন না।
ছেলেটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এভাবে বললে। ব্যাপারটা কত তুচ্ছ মনে হয়, তাই না? হাত দিয়ে এখলাসকে ইঙ্গিত করল বসতে, নিজেও মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
আপনি যদি সবকিছু খুলে বলেন তা হলে আপনাকে সাহায্য করতে আমার সুবিধা হবে। এখলাসের মতামত।
অবশ্যই, অবশ্যই, এজন্যেই তো আপনাকে এখানে আনা…মুরাদচাচা, অতিথি আপ্যায়নের বন্দোবস্ত করেন।
হুকুমটা শোনামাত্র বয়স্ক ভৃত্যটি মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে গায়েব হয়ে গেল।
ছেলেটা নিষ্প্রাণ, ফ্যাকাসে গলায় নিজের গল্প শুরু করল:
এখলাস সাহেব, আমার নাম হচ্ছে জামিল। জামিল সামাদ। এটা আপনি কালাম সাহেবের কাছ থেকে শুনে। থাকবেন। আমার বাবা ছিলেন এহসান সামাদ, ঢাকার প্রখ্যাত ধনীদের মধ্যে একজন। বড়াই করছি না, যাতে আপনি সবকিছু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন তাই বলছি। ছেলেটা একটু থামল। এখলাসের মনে হলো ছেলেটা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না পুরো গল্পটা বলবে কিনা। জামিল দম নিয়ে আবার শুরু করল, বাংলাদেশের অন্যান্য বড় ধনী ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের মত বাবাকেও সম্পত্তির সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় অনেক নোংরা কাজ করতে হয়েছে। তার ফল। হয়েছে এই যে মৃত্যুর সময় ওঁর সাথে কেউ ছিল না। মা আর বাবার অনেক আগেই ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে, আর বছর দুয়েক আগে আমি বাবার অনুমতি না নিয়েই বিদেশে চলে যাই। বাবা এই ব্যাপারটায় প্রচণ্ড রাগ করেন। উনি আমার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। শুধু তাই নয়, উনি এই বাসায় আমার যত চিহ্ন ছিল সব নষ্ট করে দেবার চেষ্টা করেন। আমার ঘরের আসবাবপত্র, আমার ছবি সব পুড়িয়ে ফেলা হয়। এমনকী সেলিমচাচা নামে আমাদের একজন পুরনো, বিশ্বস্ত কাজের লোক ছিল, যে আমাকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করেছে, তাকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেন আমি চলে যাবার পর। তারপরও গত মাসে তার। মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি আবার দেশে ছুটে আসি। আমার জেদ আর রাগের সাথে পরিচিত বলে কোনও আত্মীয়স্বজন আমাকে বাবার অসুস্থতার কথা জানায়নি। আমার ভিসা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিল, আর এসে দেখি বাবার কবর দেয়া হয়ে গেছে।
মুরাদ একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকাতে জামিলের কথায় বাধা পড়ল। সে ট্রে থেকে টেবিলে বিস্কিট আর কেকের প্লেট নামিয়ে রাখল। আর এক কাপ চা।
এখলাস একটা কেক হাতে নেবার পর জামিল আবার শুরু করল, এখলাস সাহেব, যতই রাগ করে থাকি, উনি আমার বাবা। মরার আগে একবার ওর সাথে কথাও বলতে। পারলাম না, আর আমি ওঁর চেহারা দেখতে চাই না এ ধারণা নিয়েই উনি মারা গেলেন-এ ব্যাপারটা আমার সহ্য হয়নি। তাই আমি ওঁর সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নিই।