সালামের উত্তর জানিয়ে জিন বলল, সিলেটের দরগায় জিকিরে
আছিলাম। কিছুটা নীরব সময় পেরিয়ে গেল। আসলে কেন জানি না আমি তখন কোনও প্রশ্ন বা কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর এক সময় নীরবতা ভাঙল জিনের কণ্ঠ, তুই সাপ নিয়া খেলা করস, এই সাপের হাতেই তর মরণ হইব।
এমন কথার আকস্মিক ধাক্কায় প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, হুজুর, যে সাপ নিয়ে খেলে সে মৃত্যুকে পরোয়া করে না।
তখন মহিলা আচমকা মাথার ঘোমটা সরিয়ে ফেললেন। আমি সোজা তাঁর চোখের দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, এর কি জীবনের মায়া নাই।
খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম, কে এই সুন্দর দুনিয়া ছেড়ে যেতে চায়?
তখন দ্রুত তার ডান হাতটি মাথার পেছন দিক থেকে ঘুরে এল। আমার সামনে মুঠি খুলে ধরতেই নীল পাথর বসানো একটি সোনার আংটি চোখে পড়ল। পরক্ষণেই তিনি আবার সেটাকে অদৃশ্য করে ফেললেন। বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না, তিনি চাইছেন আমি যেন তার কাছে আংটিটা দাবি। করি, বিপদ মুক্তির আশায়। আমার সাহস ফিরে এল। তার কথায় কিংবা চোখের ভাষায় মোটেও প্রকাশ পাচ্ছে না যে তার উপর কোনও কিছু ভর করেছে। একমাত্র হাতের কারসাজিই তার সম্বল। তখন হঠাৎ আমার দৃষ্টি চলে গেল। জানালার বাইরের আকাশে, আহা, কী সুন্দর চাঁদ! অবলীলায় আমার মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এল, হুজুর, আপনারা তো আগুনের তৈরি, নিশ্চয় চাদে যেতে পারেন, আমায় চাঁদের গল্প বলুন।
আর ঠিক তখনই ওই মহিলা পাশে রাখা ঝাড়-ফুক করার ঝাড় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হুজুর, আপনি শান্ত হোন, আমি এখনই চলে যাব। মহিলা বসলেন আর আমি পকেটে হাত রাখলাম। কয়েকদিন আগে গ্রামের পথে হাঁটতে গিয়ে টেনিস বলের আকৃতির একটা লোহার বল কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ওটা ইদানীং প্রায়ই আমার পকেটে থাকে, এখনও আছে। বলটা বের করে মহিলার হাতে দিলাম, ওজন দেখে তিনি মনে হয় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। তারপর ওটা তার কাছ থেকে আমার হাতে ফিরিয়ে এনে খুব ঠাণ্ডা গলায় বললাম, হুজুর, কাল যদি আপনি আসেন তা হলে এটা সোজা আপনার পেছন দিক দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। কথাটা বলেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। পরদিন মাসুমের বাড়িতে গিয়ে কেউ আর মহিলার দেখা পেল না।
জিন নিয়ে ভাবনার যে জিন সদা আমার শরীর কোষে বিরাজমান, তা এসেছিল বাবার কাছ থেকে। কত কিছুই না জানার ছিল তার কাছে। আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা তিনি চলে গেলেন সেই মহাপ্রশ্নের না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যু আমাকে এক বেপরোয়া জীবন এনে দিল। কারণ তিনিই ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় ভালবাসা, সবচেয়ে বড় ভয়। থাক সে কথা। বাবার মৃত্যুর বছর চারেক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে এক স্বাধীন জীবন বেছে নিলাম। এখন মনের সুখে ছবি তুলি, গল্প লিখি, ঘুরে বেড়াই নানান জায়গায়। মাঝে মধ্যে কিঞ্চিৎ মদ্যপান করি, মন্দ লাগে না। আর সাপের ভাবনা, জিনের চিন্তা এসব তো সঙ্গে আছেই।
এক সন্ধ্যার কথা। টেকপাড়ার রিকশা চালক ফালু দেখা করতে এল আমার সঙ্গে। তার মুখে গভীর বিষণ্ণতার ছাপ। সে বলল, ভাইজান, বড় বিপদের মধ্যে আছি, ছোড় মাইয়াড়ার উপর জিন ভর করছে আইজ আট দিন, আপনেরে নিতে আইছি।
ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, আমি গিয়ে কী করব, তুমি বরং কাদির মুন্সির কাছে যাও অথবা শুক্রবারে জেলা সদরে একজন ভাল মনোচিকিৎসক আসে, মেয়েকে নিয়ে তার কাছে যাও।
ফালু নাছোড়বান্দা। সে বার বার বলতে লাগল, আপনারে একবার যাইতেই হইব, আপনে গেলে একটা না একটা কিছু ঘটব।
সাপের চাউট্টা নিতে আসা বৃদ্ধের মত ফালুর মনেও হয়তো ধারণা, গোপনে আমি জিনের সাধনা করে থাকি। আসলে আমি ওখানে গেলে তেমন বিশেষ কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই, নিতান্ত একজন দর্শক ছাড়া আমি যে আর কিছুই নই। তবু ফালু যখন চাইছে আর আমার নিজেরও আগ্রহের কমতি নেই, তাই তাকে বললাম, ঠিক আছে, কাল বিকেলেই আমি তোমার বাড়িতে যাব।
গ্রামের দক্ষিণের টিলার মত উঁচু জায়গায় টেকপাড়ার অবস্থান। বিকেলের সোনারোদ মাথায় নিয়ে লাল মাটির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফালুর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাড়িটার অবস্থান লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে। চারদিকে বিশাল সব গাছপালা, বিশেষ করে বাড়ির দক্ষিণ দিকের প্রাচীন তালগাছের সারি চোখে পড়ার মত। একটা বিস্তৃত বাঁশ ঝাড়ও নজরে পড়ল। জায়গাটার নির্জনতা আমার মনে ধরল, একটা অতিপ্রাকৃত ভাব আছে বটে! এসব ভাবতে ভাবতে পা চালিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়লাম, বিশাল বাগানের মাঝখানে ছোট্ট এক বাড়ি। আসলে এই গোটা সম্পত্তির মালিক রফিক ব্যাপারি, তিনি ফালুকে এখানে বাড়ি করে থাকতে দিয়েছেন জায়গাটা দেখশোনা করার জন্য।
ছোট্ট বাড়িটার ঝকঝকে উঠনে তখন কম করে হলেও পনেরোজন মহিলা অর্ধচন্দ্রাকারে বসে আছেন আর তাঁদের সামনে বারান্দায় বসে আছে বছর আষ্টেকের এক শিশুকন্যা। আমায় দেখে দৌড়ে এল ফালু। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম, কিছুক্ষণ আগে মেয়েটার উপর জিন ভর করেছে। আরও জানলাম, এই জিন মানুষের অতীত ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, চিকিৎসা জানে নানা অসুখের। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে মেয়েটার কার্যক্রম নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। তখন এক মহিলা জিনের উদ্দেশে নিজের সমস্যার কথা বলে চলেছেন, আইজ পাঁচ বছর হয় আমার স্বামী নিরুদ্দেশ, তাইনে কই আছে, দয়া কইরা আমারে কইয়া দেন।