.
বছর খানেক পর এক সকালে খবর পেলাম টেকপাড়ার রাজ্জাক মিয়ার মেয়ের লাশ ঝুলে আছে বাড়ির অদূরে বাঁশ ঝাড়ের ভিতর। প্রায় দৌড়ে গেলাম ঘটনাস্থলে। দুর্ভেদ্য কাঁটাঝাড়ি বাঁশ ঝাড়ের ঠিক মাঝখানে মাটি থেকে প্রায় দশ ফুট উপরে গলায় শাড়ি পেঁচানো অবস্থায় ঝুলে আছে তরুণীর নিষ্প্রাণ দেহ। যেখানে মেয়েটা ঝুলে আছে তার চারদিক বাঁশ আর কঞ্চিতে ভরা, সেখানে তার পক্ষে তো দূরের কথা কোনও শক্ত-সমর্থ যুবকের পক্ষেও ওঠা সম্ভব নয়। কেউ যে তাকে হত্যা করে এমন জায়গায় নিয়ে ঝুলিয়ে রাখবে, সে চিন্তাও কারও মাথায় এল না। দুপুরের দিকে পুলিশ আসার পর বেশ কয়েকটা বাঁশ কেটে মেয়েটার লাশ নামিয়ে আনা হয়েছিল। সবাই তখন বলাবলি করছিল, এইটা হইতাছে চাড়াল জিনের কাজ, জিনের মধ্যে তারাই হইতাছে সবচাইতে বদ। এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে রহস্যপত্রিকায় ফাল্গুনের আঁধার রাতে নামে একটি গল্পও লিখেছিলাম।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরের কথা। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে মাসুম ভূইয়ার বাড়িতে এক মহিলা বেড়াতে এলেন। দুএক দিনের মধ্যে গ্রামময় রটে গেল মহিলার জিন সাধনার খবর। একের পর এক লোক আসতে লাগল মাসুমের বাড়িতে। একেকজনের একেকরকম সমস্যা। কারও মেয়েকে তাবিজ করে নষ্ট করেছে কেউ, কারও বাচ্চা হয় না, কারও বিয়ে হয় না, কেউ চাকরি পাচ্ছে না আবার কেউ বউ পাচ্ছে না-নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত মানুষের ভিড় বাড়তে লাগল দিনে দিনে।
এক সকালে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে হাজির হলাম মাসুমের বাড়িতে। মাসুম আমার চাইতে বছর পাঁচেকের বড়, ওর বউকে ভাবী বলেই ডাকি। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই পান্না ভাবী আমাকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠলেন। মৃদু হেসে বললাম, আপনাদের মেহমানের সঙ্গে একটু দেখা করতে এসেছি। আর কিছু বলার আগেই ভাবী আমাকে জানালেন, এই মহিলা তার দূরসম্পর্কের খালা, বহু অনুরোধের পর এই প্রথমবারের মত তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর কথা আমার কাছে সত্যি বলে মনে হলো না। তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় আমাকে দক্ষিণের ভিটার ছোট্ট দোচালা ঘরে নিয়ে গেলেন।
চৌকির উপর বসে থাকা মহিলার বয়স নিঃসন্দেহে পঞ্চাশ পেরিয়েছে বছর কয়েক আগে। বয়সের সঙ্গে বেমানান রঙচঙে একটা শাড়ি পরেছেন তিনি, কাঁচা-পাকা চুল ছড়িয়ে আছে কাঁধের উপর। আমি ঘরে ঢুকতেই তিনি হেসে উঠে বললেন, কীয়ের লাইগ্যা আইছচ, ভাই, কী সমস্যা তোর?
কোনও রকম ভণিতা ছাড়া সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি জিন বিশ্বাস করি না, আপনি যদি আমাকে জিন দেখাতে পারেন তবে বিশ্বাস করব।
আমার কথায় প্রথমে তিনি চমকে উঠলেন, পরক্ষণেই রেগে উঠে প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, এই কতা আরও একজন কইছিল, জিনে আইস্যা তারে এমুন মাইর দিল, ছয় মাস হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে থাকতে হইছিল। আমার লগে যেইডা থাকে হেইডা হইল বদরাগী জিন; আমারেও মারে। এরপর তিনি আমার সামনে তার হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালি মেলে ধরলেন, জায়গাগুলো স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা ফোলা। মহিলার বাতজ্বর থাকতে পারে। তাই এসব দেখে আমি মোটেও বিচলিত হলাম না। আর তাতে তিনি আরও খেপে গিয়ে আচমকা বলে উঠলেন, ওই দেখ কী বড় সাপ, চাইয়া দেখ, ভাল কইরা চাইয়া দেখ, বেশি তেরিবেরি করলে এই সাপে তরে খাইব। তাঁর দৃষ্টি ঘরের মেঝেতে। আমার পাশে বসা পান্না ভাবীও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। পান্না ভাবী যে সাপ দেখছেন তাতে কোনও ভুল নেই, ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ভেসে আছে তার মুখে। শুনেছি এই মহিলা অনেককেই এভাবে সাপ দেখিয়েছেন।
কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। সরাসরি সেটা না বলে বললাম, আমি সাপ ভয় পাই না।
বাকিটা পান্না ভাবীই খোলসা করলেন, ওনায় সাপ ধরে, সাপ নিয়া খেলা করে, শুনছি সাপের মাংসও খায়।
কথাগুলো শোনার পর মহিলার, চোখ দুটোতে কেমন এক শীতল আভা নেমে এল। তারপর ঠিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ঠিক আছে, তোর যখন এতই শখ, আইজ রাইত বারোটায় আইবি।
মাসুমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে মনটা কেমন যেন করে উঠল, এই ভেলকিবাজ মহিলার সঙ্গে লাগতে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? আসলে আমার মধ্যে তখন একটা চিন্তাই কাজ করছিল, যে কোনও উপায়ে এই মহিলাকে এলাকা থেকে তাড়াতে হবে। বিপদগ্রস্ত মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে। পানিপড়া, তিলপড়া, তাবিজ-কবচ, এসব দিয়ে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
বিকেল পর্যন্ত বাড়িতে না গিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা। বলে জেনে নিলাম ওই মহিলার উপর জিন ভর করলে তিনি কী ধরনের আচরণ করেন। আরও জেনে নিলাম সেখানে সমবেত লোকজন কীভাবে কথা বলে জিনের সঙ্গে। এসব জানার পর আমার ভিতরটা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। কারণ যাদের সঙ্গে কথা হলো তাদের প্রায় সবারই বিশ্বাস, ওই মহিলা জিন ডেকে আনতে পারে। আরেকটা বিষয় খুবই অবাক লাগল, ওই সব লোকদের কয়েকজন আবার শিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
রাত তখন ঠিক বারোটা। আমার সামনে আনকোরা কাপড় পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তিনি বসে আছেন। নতুন শাড়ি না পরলে নাকি জিন বিরক্ত বোধ করে। আমাদের মাঝখানে পানিতে ভরা অ্যালিউমিনিয়ামের গোল পাত্র। লম্বা একটি বাঁশের কঞ্চি ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে পাত্রের জল থেকে খোলা জানালা পর্যন্ত। মহিলা তখন একদম চুপ। কিছুক্ষণ আগেও তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি শান্তই ছিলেন। রাগারাগী করেননি কিংবা আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টাও করেননি। আসলে আমি নিজেই তখন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। লোকজনের কাছে শুনেছি, তারা সবাই জিনকে হুজুর বলে সম্বোধন করে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর কি আসছেন? আমার ভিতরটা কেঁপে উঠল। জিনের সঙ্গে কথা বলা, এ তো কোনও সাধারণ বিষয় নয়! আমি সালাম জানিয়ে বললাম, হুজুর, আপনার আসতে এত দেরি হলো কেন?