তখন আমরা কুষ্টিয়া শহরেই থাকতাম। সবকিছু থেমে গেল, সহযোদ্ধারা ফিরে গেল নিজ-নিজ এলাকায়, আর সেকেন্দার চাচা এলেন আমাদের ওখানে বেড়াতে। সাথে করে নিয়ে এলেন সমীরের সবুজ রঙের ক্যানভাস কাপড়ের ব্যাগ। এরপর শুরু হলো নকশাল আন্দোলন, সর্বহারা, গণবাহিনী এইসব। এই ডামাডোলে হারিয়ে গেলেন সেকেন্দার চাচাও। ব্যাগটা রয়ে গেল রত্না আপার জিম্মায়। বেশ কয়েক বছর পর এক রাজাকার এমপির ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আগে আলমারি সাফ করল আপা। সেই সময় আবারও আত্মপ্রকাশ করল সমীরের সবুজ ব্যাগ। এবার ওটাকে খুললাম আমি। পেলাম ওখানে যা ছিল, সবকিছু। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে লাগলাম সমীরের ডায়েরি। জানলাম, মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা কাহিনী, যা কোনওদিন লেখা হবে না ইতিহাসে!
আছে ও নেই – অরণ্য সরওয়ার
সেদিন সকালে এক বৃদ্ধ এসে হাজির হলেন আমার কাছে। তিনি প্রায় কাতর স্বরে বললেন, চাচাজী, আমার একটা সাপের চাউট্টা (আঁচিলের আকৃতির এক ধরনের পরজীবী) দরকার। নাতিনডার খুব অসুখ, কবিরাজ কইছে, অসুধ বানাইতে সাপের চাউট্টা লাগব। লোকটার কথা শুনে বুঝলাম, তার ধারণা আমার বাড়িতে সাপের খামার জাতীয় একটা কিছু আছে। অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন। কারণ সাপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই শৈশব কাল থেকে। এক অজানা আকর্ষণের ফলশ্রুতিতে বার বার আমি ওদের কাছে ছুটে যাই। কত কিছুই না করেছি ওদের নিয়ে। সাপ ধরা, সাপের ছবি তোলা, দিনের পর দিন এদের বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়া। বিভিন্ন পত্রিকায় সাপের উপর আর্টিকেল আর গল্প লেখা-আমার এসব পাগলামির কথা তাই অনেকেরই জানা। সেই থেকে এই বৃদ্ধের মত অনেকের মনে। নানা ধরনের ধারণার জন্ম হয়েছে। কোথাও সাপ দেখা গেলে মানুষ আমার কাছে ছুটে আসে, একবার সাপে কাটা রোগী পর্যন্ত আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। এলাকার পল্লী চিকিৎসক আমজাত ডাক্তারের চেম্বারে সাপে কাটা রোগী আসার সাথে সাথে আমার কাছে খবর পাঠানো হয়। অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে আমাকে এসব বিষয় মোকাবেলা করতে হয়। কারণ আমি কোনও সর্প বিশারদ কিংবা পেশাদার ওঝা নই, সাপ আমার নেশা। সেদিন ওই বৃদ্ধ যা চেয়েছিল তা আমার কাছে না থাকলেও, যেখানে থাকতে পারে, আমি তাকে সেই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
সাপের পাশাপাশি আমার আর একটি ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয় হচ্ছে জিন। পৃথিবীর বুকে এদের অস্তিত্বের কথা মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কোরানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। সেই ছোটবেলায় প্রথম জিনে ধরা মানুষ দেখেছিলাম নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। গ্রামের এক মহিলা দুপুর বেলা জঙ্গলে গিয়েছিল লাকড়ির সন্ধানে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাড়ি ফিরে না আসায় লোকজন বনে ঢুকে তাকে প্রায় অচেতন অবস্থায় খুঁজে পায়। তখন তার শরীর জুড়ে প্রচণ্ড খিচুনি আর মুখ দিয়ে গেঁজলা ঝরছিল। নানা বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল মহিলার বাড়ি। তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর সবাই গেল দেখতে, সাথে আমিও। সেখানে যাওয়ার পর ওই মহিলার প্রচণ্ড খিচুনি আর ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি আমার ছোট্ট মনে দারুণ ভয় এনে দিল। এরপর প্রায়ই আমি নানা বাড়ির সামনের বিলের ধারে দাঁড়িয়ে ওপারের বনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওই যে দূরে ঘন বন, ওখানে বাস করে ভয়ঙ্কর জিন, গেলেই ধরবে-কথাগুলো মনে আসতেই আমি এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে যেতাম। সেই আমার জিনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
তারপর কৈশোরে একদিন হেঁটে যাচ্ছিলাম আমাদের গ্রামের কাদির মুন্সির বাড়ির পাশ দিয়ে। কাদির মুন্সি প্রয়াত পীর আলী নেওয়াজ মুন্সির ছেলে। জনশ্রুতি আছে আলী মুন্সির একাধিক অনুগত জিন ছিল। কাদির মুন্সিরও বাবার মত জিনের কারবার। প্রায়ই তার ওখানে জিনে ধরা রোগী নিয়ে আসা হয়। বাড়ির সামনে লোকজনের জটলা দেখে, সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এগিয়ে গিয়ে উৎসুক জনতার কাঁধের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে অবাক না হয়ে পারলাম না। আট ন বছরের একটা মেয়েকে দুজন শক্ত সমর্থ লোক দুদিক থেকে ধরে রেখেছে। মেয়েটার চুল। এলোমেলো, চোখদুটি রক্তের মত লাল। সে ক্রমাগত চেঁচিয়ে চলেছে, যামু না, আমি যামু না, আমার লগে বাড়াবাড়ি করিস না, জানে মারা পড়বি। তখন কাদির মুন্সি এগিয়ে এসে নিজের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মেয়েটার কড়ে আঙুল চেপে ধরল। সাথে সাথে সে কী গগন বিদারী চিত্তার-মুন্সি, তোর ক্ষতি হইব কইতাছি, আমারে ছাইড়া দে।
মুন্সির চেহারা ভাবলেশহীন। তিনি শীতল গলায় বললেন, মাইয়াডারে কোন জায়গা থাইক্যা ধরছছ আগে হেইডা ক।
মেয়েটি কিছু বলল না। মুন্সির নখ গম্ভীর হয়ে চেপে বসল মেয়েটির কড়ে আঙুলের পিঠে। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠল, মাইয়াডা এমবি সাবের পুষ্কনির পার আইছিল দুপুর বেলা। হেইখান থাইক্যা ধরছি। ওটা আসলে আমাদেরই পুকুর। আমার বাবা ডা. ফজলুল করিম পাঠান এলাকার মানুষের কাছে এমবি (এম.বি.বি.এস-এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ) সাহেব নামে পরিচিত। এখন দেখা যাচ্ছে মানুষের জগতের বাইরে জিনের দুনিয়ায়ও তার পরিচিতি রয়েছে! মেয়েটার অবস্থা দেখে আমি তখন হতবিহ্বল, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। এই ছোট্ট বালিকা কীভাবে এসব কথা বলছে?