পরদিন রাতে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে থরথর করে কেঁপে উঠল পৃথিবী। ভেঙে খানখান হয়ে গেল নগরীর দোতলা তিনতলা দালান। এখানে-সেখানে ভেঙে পড়ল পাঁচিল, মাটির ভেতর পুরোপুরি সেঁধিয়ে গেল গোমুখী যক্ষের মন্দির! এর পরদিন ছড়িয়ে পড়ল মহামারী। মাত্র সাত দিনে উজাড় হয়ে গেল সব লোক। হা-হা করতে লাগল শূন্য শহর!
ব্যস, এতটুকু বলেই চুপ করে গেল কাপালিক। আবারও পশ্চিমাকাশে সূর্যের নিচে নগরীর দিকে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন হলো সে। তিরতির করে কাঁপতে লাগল বাঁ কানের ফুটোয় লোহার ছোট্ট রিং। বুঝলাম, প্রশ্ন করে কোনও লাভ হবে না। ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে এখন।
পাঁচ
ক্যাম্পে ফিরে এলাম সন্ধের আগেই। কাপড়-চোপড় গোছগাছ করে পরদিন সকালে আর্মি ট্রাকে চড়ে রওনা হলাম মুক্তিযুদ্ধ হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশে। সেখান থেকে একটা দলের সাথে দিয়ে দেয়া হলো আমাকে। চলে গেলাম মেহেরপুর বর্ডারে। পর-পর দুটো অপারেশন করলাম আমরা। একবার স্যাবোটাজ করলাম মিলিটারি কনভয়। আরেকবার আক্রমণ করলাম এক শত্রু ছাউনিতে। এক প্লাটুন খান সেনা থাকার কথা ওখানে। তবে আমরা পেলাম মাত্র বারোজনকে। এরপর আমাদের দলকে পাঠানো হলো কাজীপুর বর্ডারে। দুটো দল একসাথে হয়ে ওপারের একটা ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো মাঝরাতে হামলা করা হবে। ওপারে এক মহাজনের বাড়িতে গিয়ে জমায়েত হওয়ার কথা সবার। বিকেল থেকেই একজন, দুজন করে ফসলের মাঠের ভেতর দিয়ে ঘাস কিংবা বিচালির আঁটি মাথায় করে যেতে শুরু করল মুক্তিযোদ্ধারা। আঁটির ভেতর লুকানো হাতিয়ার, গন্তব্য মহাজনের বাড়ি।
আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি। মাথার ওপর খড়ের আঁটির ভেতর ত্রি-ইঞ্চ মর্টার গান। হঠাৎ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দূরে বাবলা গাছের নিচে দেখলাম অতি ক্ষীণ দেহের কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আরে, এ তো সেই চট পরা কাপালিক! শরীরে কাঁপুনি উঠে গেল আমার। তাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। মচকে গেল পা। হাঁটতেই পারি না আর। দুজন ধরে নিয়ে এল এপারের ক্যাম্পে। আমাকে রেখে ফিরে গেল আবার। রাত নটার দিকে বিরাট কাঁচারি ঘরে গোস্ত-পরোটা খাওয়ার আয়োজন করল মহাজন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে ভাল-মন্দ খাওয়াই নাকি রীতি! কে জানে, কে মরে কে বাঁচে? মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো দলকে একসাথে বসিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে, ঠিক সেই সময় দরজা আটকে সরে পড়ল মহাজন। পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলল খান সেনারা। ঘরে আগুন ধরিয়ে স্রেফ পুড়িয়ে মারল একত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধাকে! শুধু বেঁচে থাকলাম আমি-বত্রিশ নম্বর!
ছয়
অন্য দলে যোগ দিলাম আমি। এখানে-সেখানে অপারেশন চালাতে-চালাতে একদিন গেলাম মালিথা গ্রামে। ভাবলাম, বড় মালিথার সাথে একবার দেখা করে আসি। মালিথাদের কাঁচারি ঘরে যখন পৌঁছলাম, তখন যোহর নামাজের সময়। কাঁচারি ঘরের দাওয়ায় জলচৌকির ওপর বসে ওজু করছে বড় মালিথা। মাথা-ঘাড় ঢাকা সেই চেকচেক উড়নি এখন আর নেই। দেখলাম চকচকে টাক মাথা বড় মালিথার, একটাও চুল নেই ওখানে। বাঁ কানের লতিতে ঝুলছে ছোট্ট লোহার রিং। তিরতির করে কাঁপছে ওটা!
পরিশিষ্ট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমার এক চাচা কমাণ্ডার ছিলেন। আমরা বলতাম সেকেন্দার চাচা। সেকেন্দার চাচার দলে সমীরণ সাহা নামে এক সহযোদ্ধা ছিল। এই সমীর ছিল সেকেন্দার চাচার ডান হাত। যেমন সাহসী তেমনি তার বুদ্ধি! রণাঙ্গনে বাঙ্কারের ভেতর বসেও ডায়েরি লিখত সমীর। ১৫ ডিসেম্বর বিকেলবেলা তাঁর দল নিয়ে কুষ্টিয়া শহরে ঢুকলেন চাচা। ক্যাম্প করলেন মীর মশাররফ হোসেন গার্লস হাইস্কুলে। সন্ধের সময় যখন রাতের রাধা-বাড়া চলছে, চুলোর পাশে বসে রেডিয়োতে আকাশবাণীর খবর শুনছেন চাচা, ঠিক সেই সময় পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল সমীর। চাচাকে বলল, কমাণ্ডার, কলেজের ওদিকটা থেকে একটু ঘুরে আসতে চাই। যদি অনুমতি দেন, তো যাই এখন?
চাচা বললেন, আরেকটু বসো। খেয়ে-দেয়ে তারপর না হয় যেয়ো। আর এখন যাওয়াটাও ঠিক হবে না। কাল সকালের পর গেলেই ভাল করবে। আগে সারেণ্ডার করে নিক পাকিস্তান আর্মি, কী বল?
সমীর ওদিকে মাথা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েই আছে। চাচা দেখলেন, এই ছেলে যা চায়, তা করেই ছাড়বে। অনুমতি না দিলে পালিয়ে গিয়ে ঘুরে আসবে। অন্য সহযোদ্ধারা তখন বলবে, সমীর অনুমতি ছাড়াই বাইরে ঘোরা-ফেরা করে। হয়। তাকে শাস্তি দেন, না হয় আমাদেরকেও দেন সেই স্বাধীনতা! সমীরকে শাস্তি দেয়া সেকেন্দার চাচার পক্ষে সম্ভব নয়। চাচা বললেন, এখনই যেতে চাও? খেয়ে গেলে ভাল হত না?
জী, কমাণ্ডার, এখনই যেতে চাই। হাতিয়ার রেখে গেলাম। এই যাব আর আসব।
ঠিক আছে, বাবুর্চিকে বলব তোমার খাবার আলাদা করে যেন তুলে রাখে। এসে দেখা কোরো আমার সাথে, কেমন?
সেই যে গেল সমীর, ফিরল না আর! সারারাত প্রচুর। গোলাগুলি আর মর্টার শেলিং হলো।
পরদিন বারোটায় সারেণ্ডার করল খান সেনারা। প্রচুর খোঁজাখুঁজি করলেন সেকেন্দার চাচা। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না সমীরকে। তার হাতিয়ার মালখানায় জমা দেয়া হলো। কাপড়ের ব্যাগটা রয়ে গেল সেকেন্দার চাচার কাছে। ওটার ভেতর সমীরের ডায়েরি, দাঁতের মেসওয়াক, গায়ে মাখা সাবান, কাপড়-চোপড়, ধুন্দলের ছোবড়া আর কিছু টুকটাক হাবিজাবি।