‘অন্ধকারের দেবতা।’
‘তোমার সন্তানদের কেন এই পৃথিবীতে রাখতে চাও?’
‘আমার সন্তানরা পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। চোদ্দ দিন পর পৃথিবীটা হবে ফ্যাফ্যাসের।’
আঁতকে উঠল সুজানা। কী বলছে ফ্যাফ্যাস। এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা ধীরে-ধীরে ধ্বংস করে দেবে পৃথিবীকে? এখন কী করবে ও?
চার
সারাটা রাত এই ভয়ঙ্কর প্রাণীটার সাথে থেকে বুকের ভিতরে কেমন যেন হাঁসফাঁস করতে থাকল সুজানার। মনে হলো, মৃত্যু তার খুব কাছে। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা ঘরেই আছে, কিন্তু সেই প্রিয় মানুষটার মাধ্যমে আজ বিপদের মুখে গোটা পৃথিবী। নিজ রুমে শুয়ে আছে সুজানা। মোবাইল নেটওঅর্ক এখনও কাজ করছে না। সুজানার রুমে বসে আছে জাফরও। একা রাখবে না সে সুজানাকে, কারণ সুজানা যে-কোনও সময় চাতুরির আশ্রয় নিতে পারে। জাফর সেটা হতে দেবে না।
সকাল দশটায় বেজে উঠল বাড়ির ডোরবেল। এতক্ষণ ঝিমুনির মধ্যে ছিল জাফর। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুজানাকে বলল, ‘দেখো, কে এসেছে? কিন্তু কোনও ভুল করলে…’
সুজানা ভয়ে-ভয়ে মাথা নাড়ল। সদর দরজা খুলে দেখল দুধওয়ালা ছেলেটা এসেছে।
সুজানা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইয়ে, মানে, করিম, আজ দুই লিটার দুধ দিতে পারবে?’
‘জী, আপা, পারব।’
‘আচ্ছা, দাও তা হলে।’
‘আজ কোনও অনুষ্ঠান নাকি, আপা? বিশেষ কিছু রান্না করবেন?’
কিছু না বলে ঢোক গিলল সুজানা। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে জাফররূপী ফ্যাফ্যাস। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সুজানার দিকে।
সুজানা কোনও চালাকি করলে মেরে ফেলবে।
সুজানার বারবার মনে হচ্ছে, করিমকে কোনও ইঙ্গিত দেবে কি না। একবার যদি কাউকে বিষয়টা বলা যেত, তো ফ্যাফ্যাস এত সহজে পার পেত না। করিমকে ঘরে ঢোকানোও বিপজ্জনক হবে। হয়তো আরও একটা প্রাণ নেবে ফ্যাফ্যাস।
করিম হঠাৎ মুখ বিকৃত করে বলল, ‘আপা, আপনার ঘরের ভিতর থেকে কেমন পচা গন্ধ আসছে।’
রক্তশূন্য হয়ে গেল সুজানার চোখ-মুখ। পচতে শুরু করেছে সুমি আর রিমির দেহের অবশিষ্ট।
করিমকে বিদায় করতে চোখ গরম করে সুজানাকে ইঙ্গিত করল জাফর।
সুজানা বলল, ‘মনে হয় কোথাও ইঁদুর মরে পড়ে আছে।’
‘কী বলেন, আপা, আপনাদের বাসায় ইঁদুর! গন্ধটা কেমন যেন অন্যরকম ইঁদুর মরা গন্ধ নয়। কেমন যেন…’
কথা শেষ না করে মাথা চুলকাতে থাকল করিম
করিমকে ‘তুমি এবার এসো,’ বলে বিদায় করে দিল সুজানা। ফ্রিজে রেখে দিল দুই লিটার দুধ।
করিম চলে যেতেই পুরো ঘর ফিনাইল দিয়ে মোছার চেষ্টা করল সুজানা। তাতে এতটুকু কমল না ঘরের গন্ধ। দুপুরের দিকে অল্প কিছু শুকনো খাবার খেয়ে নিল সুজানা। এই অসীম বিপদেও না খেয়ে থাকতে পারে না মানুষ। মৃত্যু খুব কাছে থাকলেও তাকে খেতে হবে। তার নিজের সন্তানের জন্যও তাকে খেতে হচ্ছে। সুজানাকে খেতে দেখে ফ্যাফ্যাসেরও খিদে লাগল বোধহয়। সে সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খিদে! আবার শিকার চাই!’
‘না, না, আমি এসব পারব না,’ ভাঙা গলায় বলল সুজানা।
প্রচণ্ড জোরে সুজানাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল জাফর।
আছড়ে পড়ে কয়েক মুহূর্ত চোখে-মুখে অন্ধকার দেখল সুজানা। জাফর হিংস্র গলায় আবার বলল, ‘আমার কথা না শুনলে তোকে এবং তোর সন্তানকে মেরে ফেলব আমি। আমার খিদে লেগেছে। শিকার চাই। ফোন কর।’
মোবাইলে নাম্বারগুলো দেখতে থাকল সুজানা। তার মধ্যে ভয়ের এবং বিষাদের অনুভূতি মিলেমিশে একাকার। বারবার চোখের পানি মুছতে হচ্ছে তাকে। দুই-তিনজন বান্ধবীকে ফোন দিল সুজানা। কিন্তু তারা সবাই ব্যস্ত, তাই সুজানার বাসায় আসতে রাজি হলো না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে ফোন দিল জামিল ভাইকে। জামিল ভাইয়ের সব সময়ই সুজানার প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল। কিন্তু সুজানা সেই দুর্বলতা একদম পাত্তা দেয়নি বলে ব্যাপারটা বেশি দূর এগোয়নি। সুজানার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর জামিল কমিয়ে দেয় সুজানার সাথে যোগাযোগ। কারণ সুজানার জীবনে সে উপদ্রব হতে চায়নি।
সুজানার ফোন পেয়ে সত্যিই খুব অবাক হলো জামিল। ‘সুজানা? কেমন আছ?’
‘ভাল আছি, জামিল ভাই। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালই আছি।’
‘আপনার সাথে একটু দরকার ছিল। আমার বাসায় একটু আসতে পারবেন?’
‘এখন? এই দুপুরে?’
‘হ্যাঁ। আপনি তো হাউস বিল্ডিং-এ থাকেন। তিন নম্বর সেক্টর পর্যন্ত আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। নাকি অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত?’
‘না, মানে, ব্যস্ত না। তোমার বাসায় তো আগে কখনও যাইনি।’
‘বাসা চেনেন তো?’
‘হ্যাঁ। বাসা চিনি। খুব ভালভাবেই চিনি। আচ্ছা, তোমাদের গেটে কি দারোয়ান আছে?’
‘না। কোনও দারোয়ান নেই। আপনি দ্রুত চলে আসুন।’
‘আচ্ছা। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।’
সুজানার কোনও অনুরোধ ফেলা জামিলের পক্ষে সম্ভব নয়। সে আসলে জরুরি একটা কাজে বেরোচ্ছিল, কিন্তু এখন তার সবচেয়ে জরুরি কাজ সুজানার সাথে দেখা করা।
.
বেজে উঠল ডোরবেল।
দরজা খুলে দিল সুজানা, জামিলের সঙ্গে দু’চার কথা বলবার পর ড্রয়িং রুমে বসাল মানুষটাকে।
সুজানা অস্বস্তির হাসি হাসছে। ও যে প্রেগন্যান্ট, তা জানত না জামিল। এসব নিয়ে কথা বলবে ভাবছে, এমন সময় হঠাৎ পচা একটা গন্ধ নাকে এল ওর। ঘরের ভিতরটা লাগছে বেশ ধোঁয়া-ধোঁয়া। চাপা গলায় আওয়াজ করছে কেউ যেন। কেন জানি বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল জামিলের। কেউ যেন তাকে বলছে, তুমি চলে যাও। এখান থেকে চলে যাও। নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া খারাপ অনুভূতিটা পাত্তা দিল না সে। সুজানার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী কারণে ডাকলে আমাকে, সুজানা?’