ফ্যাফ্যাসটি প্রথম পা রেখেছে চিনে, কিন্তু জায়গাটা পছন্দ হয়নি তার। যেতে চেয়েছে এই মহাদেশের দক্ষিণে। ওখানকার আবহাওয়া তার সন্তানদের জন্য সেরা। তবে বেশি দেরি করতে পারবে না। ত্রিশ দিনের মধ্যে জোগাড় করতে হবে ভাল পোষক দেহ। একটা কন্টেইনার ভর্তি জাহাজে চেপে বসল ফ্যাফ্যাস, লুকিয়ে থাকল জাহাজের এক নির্জন কোণে। ক্যামোফ্লেজ বিষয়ে খুব পারদর্শী সে। জানে, জাহাজের কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। বারোতম দিনে জাহাজটি পৌছাল চট্টগ্রাম বন্দরে। খিদের তাড়নায় এই বারো দিনে জাহাজের তিনজন কর্মীকে কৌশলে মেরে ফেলেছে ফ্যাফ্যাস। মানুষের শরীর ভিটামিনের আধার, ভালভাবে বাঁচতে এই ভিটামিন তার খুব প্রয়োজন।
বাইশতম দিনে জাহাজটি থেকে মাল খালাস শুরু হলে বন্দর থেকে বেরিয়ে পড়ল ফ্যাফ্যাস। আবারও আশ্রয় নিল ক্যামোফ্লেজের। বন্দরের বাইরে অনেক গাড়ি দেখতে পেল সে। এর মধ্যে একটা গাড়ির মালামাল রাখার জায়গায় ঢুকে পড়ল ফ্যাফ্যাস। একটু পর গাড়িটি রওনা দিল রাজধানী ঢাকার দিকে।
গাড়িটি ছিল শিল্পপতি ইলিয়াস মোল্লার।
.
মহাখালি, ঢাকা। রাত একটা।
বার থেকে বাড়ি ফিরছিল জাফর। মদ খেয়ে সহজে মাতাল হয় না সে। তবে আজ তার লিমিট থেকে দুই পেগ বেশি খেয়ে ফেলেছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গেলে অসুবিধা হবে বলে সে গাড়ি আনেনি। তার বন্ধু ইলিয়াস তাকে উত্তরা তিন নম্বর সেক্টর পর্যন্ত লিফট দিয়েছে। এবার নির্জন দুটো গলি পার হয়ে তাকে বাড়ি যেতে হবে।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল জাফর, টাল সামলে নিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, ইলিয়াস।’
‘সাবধানে যেয়ো, বন্ধু,’ জবাবে বলল তার বন্ধু।
‘রাজার কোনও ক্ষতি হয় না।’
‘দুই পেগ বেশি খেলে সবাই রাজা হয়ে যায়।’
‘হা-হা-হা! ভালই বলেছ, বন্ধু!’
‘বাই।’
গাড়িটা হুশ্ করে চলে গেল। ইলিয়াসের গাড়ি থেকে কিছু একটা বেরিয়ে জাফরের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। জাফরের গান গাইতে ইচ্ছা হচ্ছে। সুজানাকে সে প্রতি রাতে গান শোনায়। সুজানাও তখন গুনগুন করে গান করে। জাফরের মনে হয় অপূর্ব ওর বউয়ের গলা।
সুজানা জাফরের স্ত্রী। দুই বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে।
সন্তানের মা হতে চলেছে সুজানা। ওদের সন্তানটি মেয়ে।
ওরা মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছে: রোমি।
সপ্তাহে একদিন বার-এ যায় জাফর। সপ্তাহে একদিন ওখানে যাওয়া বোধহয় তেমন দোষের নয়। সুজানারও এ নিয়ে অভিযোগ নেই। আগে প্রায়ই সঙ্গী হত জাফরের। কিন্তু গত দু’মাস ধরে খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে তাকে। ভারী হয়ে গেছে শরীর, সামনের মাসেই ডেলিভারি ডেট।
হেলেদুলে হাঁটছে জাফর। খুব নির্জন গলিটা। এ পথ দিয়ে সে প্রায়ই বাসায় ফেরে। কিছুক্ষণ পর তার মনে হলো, কেউ যেন আসছে পিছে-পিছে। সে পিছনে তাকাল, কেউ নেই। ভয়-ভয় করতে লাগল তার। কয়েক মাস আগে গলির মুখে বড় রাস্তায় একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। মাথা থেঁতলে গিয়েছিল এক বৃদ্ধা মহিলার। কথিত আছে, প্রায় নাকি এখানে দেখা যায় সে মহিলাকে। তিনি নাকি তাঁর থেঁতলানো মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর নাকি স্বরে কাঁদতে থাকেন।
আবার সেই খস খস শব্দ। বিকট এক গন্ধ পেল জাফর। গন্ধটায় গুলিয়ে উঠল তার শরীর। রাস্তার পাশে বসে বমি করতে লাগল সে। উঠে দাঁড়াল কিছু সময় পর। দুর্বল লাগছে শরীর। এমন সময় বুঝতে পারল, পিছে দাঁড়িয়ে কেউ 1 পিঠে লাগছে গরম ভাপ। সাহস সঞ্চয় করে পিছনে তাকাল সে। একটা অদ্ভুত, কুৎসিত, ভয়ঙ্কর প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে। প্রাণীটার তিন শুঁড় নড়াচড়া করছে ক্রমাগত। সরীসৃপের মত নমনীয় মাথা, ঘুরে যায় পিছনেও। একটা মাত্ৰ পা, সব মিলে দুটো হাত। প্রয়োজনে হাত ব্যবহার করে পা হিসাবে, বাড়াতে পারে হাঁটার গতি। হাত-পায়ে ধারাল নখ। সূচালো দাঁত ঢেকে রাখার জন্য ঠোঁট নেই। বিশাল নাক দিয়ে শুঁকে দেখছে সে জাফরকে।
হ্যাঁ, তার পছন্দ হয়েছে জাফরকে। দেরি করল না প্রাণীটা। শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল জাফরকে। সূচালো দাঁত বসিয়ে দিল ওর গলায়। চিৎকার করারও সুযোগ পেল না জাফর।
কাজ শুরু করে দিয়েছে প্রাণীটা। নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল জাফরের বুক থেকে পেট পর্যন্ত। ওখানে হাত ঢুকিয়ে তৈরি করল গর্ত। জাফরের দেহে ঢুকে গেল নিজে। আর তখনই জাফরের শরীরের গর্তটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু শরীরে রয়ে গেল কাটা দাগের চিহ্ন।
এখন থেকে জাফরের শরীর ব্যবহার করবে ফ্যাফ্যাস, নিয়ন্ত্রণ করবে শারীরবৃত্তীয় সব কাজ। অর্ধমৃত জাফর এখন অন্ধকার জগতের ভয়ঙ্কর প্রাণী ছাড়া কিছুই নয়।
তার শরীরে ডিম দেবে ফ্যাফ্যাস। দু’ সপ্তাহে জাফরের শরীরের যেন কোনও ক্ষতি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে। দুই সপ্তাহ এই পোষক দেহে থাকতে হবে তাকে। এ সময়ে জাফরের বড় কোনও ক্ষতি হলে, সে-ও বাঁচবে না।
দু’ সপ্তাহ পর যখন ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোবে, এমনিতেই মারা যাবে জাফর। মরবে ভয়ঙ্কর ফ্যাফ্যাসও। কিন্তু থেকে যাবে তার অসংখ্য বাচ্চা এই পৃথিবীতে।
তাদের থেকে জন্ম নেবে আরও বাচ্চা। এক সময় পৃথিবী হবে ফ্যাফ্যাসদের রাজ্য, শাসন করবে তারা গোটা এই জগৎ।
দুই
কাল রাতের ঘটনায় প্রচণ্ড অবাক হয়েছে সুজানা। রাতে কখন জাফর বাসায় ফিরেছে, সে কিছুই টের পায়নি। জাফর অন্য একটা রুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। এমন তো কখনও করে না!