আমি সাধারণত তেলরঙে আঁকি। অ্যাক্রিলিক ছুঁয়েও দেখি না। তেলরঙে আঁকার নানান ঝক্কি, নানান প্রস্তুতি। রঙের পিগমেন্টের সঙ্গে তাৰ্পিন তেল, লিনসিড অয়েল মেশাও। এক পরত রং চড়ালে সেটা শুকানোর জন্য অপেক্ষা করো। এভাবে অতি ধীরে, একটু একটু করে ক্যানভাসে যা ফুটে ওঠে, সকলে তাকে বলে ছবি। আমি বলি, এটা একটা ধারণা।
আমার ক্যানভাসে আরেকজন কেউ আঁকছে–এটা বুঝতে আমার কয়েক দিন সময় লেগে গেছে। আমি আত্মভোলা, তন্ময় ধরনের শিল্পী না হলে হয়তো আরও আগে টের পাওয়া যেত। প্রথম দিকটায় কেমন একটা ভৌতিক গা ছমছম করা অনুভূতি হয়েছিল। কোথাও একটা কিছু যে ঠিক নেই, এটা সবার আগে। টের পেয়েছিল আমার ঘ্রাণশক্তি। ছবি আঁকার সময় বিশেষ করে তাৰ্পিন তেলের গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে। একটা ঝাঁজালো গন্ধের নেশায় আচ্ছন্ন থাকি সারাক্ষণ। কিন্তু সেবার ছবি আঁকা শুরুর দ্বিতীয় দিন থেকে তাৰ্পিন তেলের সঙ্গে আরেকটা কিছুর গন্ধ পেতে শুরু করি আমি। সেটাও ঝাঁজালো গন্ধই, তবে একেবারে অন্য রকম। কোনো চেনা গন্ধের সঙ্গে সেটার কোনো মিল নেই। একটা বুনো ফুলের গন্ধ যেন। তবে ফুলের গন্ধ যেমন স্নিগ্ধ, নরম হয়, সে রকম নয়। উগ্র গন্ধ। ভেবেছিলাম, বাইরে থেকে হয়তো বাতাসে ভেসে আসছে কোনো শিল্পকারখানার গ্যাসীয় অধঃক্ষেপ। জানালা বন্ধ করার পর গন্ধটা আরও বেড়ে যায়। টের পাই, এর উৎস ঘরের ভেতরেই কোথাও। আরও ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি, ক্যানভাসের ভেতর থেকেই আসছে এই গন্ধটা। ক্যানভাসের রঙের পিগমেন্টের ভেতর থেকে।
দ্বিতীয় যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলাম, তা হলো ক্যানভাসে রঙের বদলে যাওয়া। আমি এক রং ক্যানভাসে চাপিয়ে ঘুমাতে যাই। পরদিন ঘুম থেকে এসে দেখি রং বদলে গেছে। আগের দিন হয়তো সবুজ রং চড়িয়েছি, পরদিন এসে দেখি সেটা বেগুনি বা ভায়োলেট হয়ে আছে। ভার্মিলিয়ন রেড বদলে হয়ে যাচ্ছিল। কোবাল্ট রু। কখনো কখনো আমার চোখের সামনেই রং বদলে যাচ্ছিল। প্রথমটায় ভেবেছিলাম, আমি বোধ হয় বর্ণান্ধতা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু চোখের ডাক্তার। সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল। চোখ ঠিকই আছে।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল ক্যানভাসে অবয়বগুলোর আকার বদলে যাওয়ার ধরন দেখে। ক্যানভাসে আমি কোনো বৃত্ত আঁকতে পারছিলাম না। যখনই কোনো বৃত্ত আঁকছি, সেটা কখনো উপবৃত্তের আকার নিচ্ছে, কখনো হয়ে যাচ্ছে অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্ত। কোনো সরল রেখাও আঁকতে পারছিলাম না আমি। সেগুলো ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল। তখনো এ সবকিছুকে আমার কোনো জটিল স্নায়বিক রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখছিলাম আমি। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। তখনো টের পাইনি, নিরীহ এই ক্যানভাসের অতিনিরীহ উপরিতল আসলে দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকে ধারণ করে আছে। যেকোনো জ্যামিতিক অবয়ব বা যেকোনো রঙের পিগমেন্ট এখানে প্রবেশ করামাত্র স্থানের জটিল কাঠামো তাকে শুষে নিচ্ছে নিজের মধ্যে।
সপ্তম দিন আমি একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যাই, এই ক্যানভাসে অন্য কেউ আঁকছে। একই সঙ্গে। আর সেই শিল্পী আমাদের মহাবিশ্বের বাসিন্দা নয়। স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই, আমার একার পক্ষে এ রকম উন্মাদ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনো দিনই সম্ভব ছিল না। এ কাজে আমাকে প্রভাবিত করেছে আমার এক খ্যাপাটে বন্ধু। বন্ধুটি গণিতের অধ্যাপক। বদমেজাজ ছাড়াও একাডেমিক চক্রে তার আরও নানা রকম কুখ্যাতি আছে। একদিন সে যখন আমার বাসায় বেড়াতে এল, কথাচ্ছলে ক্যানভাসের এই বিদঘুঁটে ভৌতিক আচরণের কথা আমি তাকে বলেছিলাম, আর সে তখন এসে দাঁড়িয়েছিল এই ক্যানভাসের সামনে। ইজেলে হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাসের দিকে সে চোখ কুঁচকে এমন করে তাকিয়ে ছিল, ঠিক যেমন করে লাল একফালি কাপড় হাতে মাতাদোর তাকিয়ে থাকে মাথা নিচু করা ষাড়ের দিকে।
দুটি মহাবিশ্বের পরস্পর মিথস্ক্রিয়ার গাণিতিক অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে, আমার বন্ধু প্রথম দিনই সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতির বিবরণ যে প্রচলিত কোনো গাণিতিক কাঠামো দিয়ে সম্ভব নয়, এর জন্য যে নতুন আর অভিনব এক গাণিতিক কাঠামো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আমি এর কিছুই আসলে ভাবছিলাম না। সম্পর্কহীন দুটি জগতের মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তির বিনিময় কীভাবে সম্ভব–আমি সেই চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলাম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, দুই জগতের মধ্যে অভিজ্ঞতার কোনো অর্থপূর্ণ বিনিময় কোনো দিনও সম্ভব নয়। কেননা, দুটি অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু নেই। বিনিময়ের এই অসম্ভাব্যতার খানিকটা নজির পাওয়া গিয়েছিল আমেরিকার ভূখণ্ডে কলম্বাসের প্রথম পা রাখার সময়।
হতে পারে, ক্যানভাসের এক ক্ষুদ্র অস্থায়ী জানালায় এসে দুটি জগৎ আছড়ে পড়ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতির অদ্ভুত কৌতুককর দিকটি এ-ই ছিল যে, বিনিময়ের কোনো সম্ভাবনা যদি আদৌ থেকে থাকে, তা বাস্তবায়িত হচ্ছিল দুজন শিল্পীর তুলির ভেতর দিয়ে। আমি নিশ্চিত, চিত্রকলার ইতিহাসে এর আগে আর কখনোই একজন শিল্পীর তুলি এতটা সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠেনি, একজন শিল্পীর কাঁধে কখনোই এতটা মহাজাগতিক দায় এসে চাপেনি এর আগে। টের পেলাম, ক্যানভাসের সঙ্গে উল্লম্বভাবে ধরে রাখা আমার তুলির ওপারেই আরেকটি তুলি একই কৌণিক বিন্যাসে ধরে রাখা আছে। দুটি তুলি এক অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।