০. নিজের কবর

০১.

প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয়–নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতন লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতেই জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি।

অবশ্য মহাকাল কারো কারো প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন, মানিক বন্দ্যো, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।

আর, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ। কালের স্থূল হস্তাবলেপ তাঁর গায়ে লাগেনি। প্রতিভার নবনবোম্মেষে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি প্রতিভাত, উদ্ভাসিত। নিত্য নব ভাষাভঙ্গি, নব নব ভাবের উদ্ভাবনায় বিভিন্ন শৈলীর শৈলশিখরে স্বচ্ছন্দ বিচরণে বাঁকে বাঁকে অবাক করা, নিতুই নব তিনি। হিমালয়ের মতই চিরন্তনরূপে সর্বকালীন বলে যেন মনে হয় তাঁকে। চিরদিনের অপরূপের।

কিন্তু ওই মনে হওয়াটাই। যথার্থ বললে হিমালয়ও কিছু চিরকালের নয়। কালস্রোতে সেও ক্ষয় পায়। ভেসে যায়।

তাহলেও এই মনে হওয়াটাই অনেক। ক্ষণস্থায়ীদের ঝরতি পড়তির ভিড়ে এই দীর্ঘক্ষণ স্থায়িত্বটুকু বিস্তর। অমরত্বের ভ্রম জন্মায়। তাই কি কম?

তবে সত্যিকার সর্বকালীন লেখা কি নেই? আছে। সেটা বিধাতার নিজের রচনার। যদিও তা মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে বদলে যায়, তবু তাঁর হাতের স্বাক্ষরে এক চিরকালের আদল বজায় থাকে।

আর আছে তাঁর উচ্চারণায়–যা চারিধারে তিনি চারিয়ে দেন তাঁর প্রতিভূদের প্রতিধ্বনিতে। বেদ উপনিষদ গীতা চণ্ডী বাইবেল কোরআন্ কথামৃত–সেই জাতীয়। তা-ই কেবলমাত্র কালজয়ী। সর্বদাই আনকোরা, সর্বকালের মানুষ তার মধ্যে চিরদিনের জিনিষ খুঁজে পায়–চিরকালের প্রেরণা।

তা বাদে আর সব লেখাই কালক্ষয়ী, কালক্ষয় করার জন্য লেখা এবং পড়া। কালের সাথে সাথে ক্ষয় পাবার।

সত্যিকারের হচ্ছে এই কালস্রোত। নদীর জলধারার মতই চিরন্তন, নিত্য নূতন।

বহতা নদীর ধারে আমার কালজয়ী তাজমহল গড়ে তুললাম, অভ্রংলিহ সেই কীর্তিস্তম্ভ দাঁড়ালো বটে সগৌরবে, কিন্তু নদীর পথ পালটালো, নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেও অন্য ধারা ধরলো সে, সঙ্গে সঙ্গে সেই জলপথে যাতায়াতকারী যাত্রীদলেরও মতিগতি পালটে গেল, ভাব-ভাবনা হয়ে গেল আরেক ধারায়। বহতা নদীর তীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সুদূরপরাহত বহুকীর্তিত সেই কীর্তিমন্দির কারো কারো কাছে তখনো হয়ত পরিক্রমণীয় তীর্থ হলেও, নিজের দুর্বহতার বোঝা নিয়ে আর সবার কাছেই তখন তা যত্নসাপেক্ষ প্রত্ন গবেষণার; একদার মিউজমহল কৌতূহলী সকলের কাছে তখন মিউজিয়ম হল্ ছাড়া কিছু নয়।

আমার ধারণায়, আমাদের কারো কোনো লেখাই কখনই কালজয়ী হয় না। হতে পারে না। সব লেখকই ক্ষণকালজয়ী–যদি বা হয়। রূপের মতন সেই মুহূর্তের চোখ আর মন ভোলাতে পারলেই ঢের। তাহলেই সে সার্থক। পরমুহূর্তেই আবার নতুন রুপোদ্দামে নব বসন্তের নতুন মধুপদের আসর জমজমাট। পুরানো রূপসীর দিকে তাকাবার কারো ফুরসৎ কোথায়?

আমার নিজের কথা বলতে পারি, আমি কখনই কালজয়ী হতে চাইনি, এমনকি বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠাতেও নয়। সেই বৃথা চেষ্টার অক্লান্ত সাধনায় কালক্ষয় না করে সকলের জীবনের সকালটা, না, জয় করতে নয়, তার সঙ্গী হতেই চেয়েছিলাম আমি। ছেলেমেয়েরা ছোটবেলায় আমার লেখা পড়বে, একটু বেলা হলে, বড় হলেই অক্লেশে ভুলে যাবে আমায়। সেই একটুক্ষণ তাদের একটুখানি হাসি-হাসি করতে পারলেই আমার খুশি।

কিন্তু গোড়াতেই যেকথা বলেছি, ক্ষণজীবীই হোন আর দীর্ঘজীবীই হোন, খোদা কাউকে কখনো পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেন না, স্বেচ্ছায় না সরলে সরিয়ে নেন–শেষ খোদকারি সেই তাঁরই।

পথচারীদের জন্যে সর্বদাই পথ সাফ রাখতে হয়, ট্রাফিক যেন জামতলায় না জমে।

এক জায়গায় এসে দাঁড়ি টানতেই হয়। আর সবার পক্ষে দেহরক্ষার পর হলেও লেখকের বেলায় তার ঢের আগেই। বলবার কথা ফুরিয়ে গেলেই তাঁর কথা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না আর। আমার নিজের কথা যদি বলি, আমার কী বলার কথা ছিল আমি নিজেই জানি না। এতদিন ধরে কত কথাই বলেছি, বেশির ভাগই তার আজেবাজে আর হাসির কথাই, নিতান্তই টাকার জন্য, বাঁচার তাগাদায় লেখা–কিন্তু আর না। কিছু বলতে পেরে থাকি বা না থাকি, কিছু বলতে পারি আর নাই পারি–এই লেখাটার পরেই আমার দাড়ি। এইটাই আমার শেষ লেখা আমি আশা করি।

এর পরেও যদি প্রাণে প্রাণে থাকি, প্রাণের দায়ে যদি ফের আমায় কলম ধরতে বাধ্য করে, এই দাঁড়ির পরেও কথা বাড়িয়ে আবার আমায় Comma-য় আসতে হয়, তবে সেই সব বাক্য অবশ্যই আমার মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করবে, আমি জানি, সে হবে আমার আপন স্বাক্ষরে নিজের ডেথ সেনটেনস।

.

রূপোর ঝিনুক মুখে নিয়ে জন্মাইনি ঠিকই; আর, যদি জন্মাতুমও, তাহলেও ঝিনুকের থেকে মুক্ত হতে আমার দেরি হত না। অল্প বয়সেই আমি বুঝেছিলুম মুখ মোটেই ঝিনুকের জন্যে নয়; আর রূপো না, মুখের সম্মুখে যদি কিছু রাখতেই হয় তো সে হচ্ছে রূপ। ঝিনুকের থেকে মুক্তি পাবার পরেই সে মুক্ত!

সেই নব নব রূপে অপরূপ মুক্তি।

আর এই রূপই হল আমার অভিশাপ। এই রূপের জন্যেই জীবনে আমার কিছু হল না এবং যা কিছু হল তা হয়ত ওর জন্যেই হল। এই অনির্বচনীয়ের স্বাদ বাল্যকালেই আমি পেয়েছিলাম আর তার টানে সেই অতি কৈশোরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির থেকে স্বাধীনতার সাথে শুধু কেবল বহুবিচিত্র রূপের আস্বাদে।

মুক্তির রূপ আর রূপের মুক্তি এক হয়ে মিশে গেছে আমার জীবনে।

এই কারণেই আয়াসসাধ্য কোনো সাধনা আমার দ্বারা হল না, সাধনালব্ধ কোনো সিদ্ধিও নয়। এমন কি, লিখে লিখে জীবনটা কাটলেও লেখকের মত লেখক আমি হতে পারলাম না কোনোদিনই। লেখক হতে হলে যে উদয়াস্ত পরিশ্রম বা নিদারুণ পড়াশোনা বা যে দুর্নিবার দুঃখ ভোগ করতে হয় তা আমার কুন্ঠিতে কই?

লেখক হতে চাইওনি বোধ হয় আমি। লিখতে ভাল লাগে না আমার। প্রেরণার বশে নয়, প্রাণের দায়েই, আর কিছু না হতে পেরেই অগত্যা আমার এই লেখক হওয়া–সাংবাদিক হতে গিয়েই লেখক। ঘরকুনো হয়ে ঘাড় গুঁজে কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে লেখক হবার কোনোদিনই আমার সাধ ছিল না, পাঠক হতেই চেয়েছিলাম বরং। বিধাতা সে বর্ণপরিচয়ের কেতাব আমাদের চোখের সামনে চারিধারে মেলে রেখেছেন সর্বদাই, যার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে মুক্তোর ছাঁদে সোনার আখরে আপন স্বাক্ষরে তাঁর অপরূপ কাহিনী লেখা, নতুন নতুন হরফে নব নব মুদ্রণে মুহূর্তে মুহূর্তেই যে–বইয়ের নিত্য নবীন সংস্করণ, সেই-বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের পড়াই আমার শেষ হয়ে উঠল না জীবনে। লিখিয়ে হব কি, পড়ুয়া হয়েই থাকতে হল আমায় চিরটা কাল। কি সেই ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারলুম কি?

.

যে তিনটি কথা মাথায় করে আমার এই আত্মকাহিনীর শুরু, সে-তিনটির সঙ্গেই, যাকে বলে কমফ্রন্টেশন, সেই বাল্যকালেই আমার হয়েছিল।

সত্যি বলতে, সে সময়টা ছিল কেমন ঈশ্বরপীড়িত। আমাদের বাড়িতে বাবা ছিলেন পরম বৈষ্ণব, বিষ্ণুভক্ত; মা ছিলেন শাক্ত, শক্তির উপাসিকা; আর আমার মামা ছিলেন নাম-সাধক, হরিগুণ গানে বিভোর।

বাবাকে আমার মনে হত মহাদেবের মতন। শিবের মতই ছিল তার চেহারা আর ধরনধারণ। রক্তাভ গৌরকর্ণ চেহারা, সদাপ্রসন্ন, প্রশান্ত, আত্মনিমগ্ন। সংসার-উদাসীন আত্মভোলা। ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম ভাঙত তাঁর। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি গোটা গীতাটা আওড়াতেন। তাঁর মুখে শুনে শুনেই গীতা আর উপনিষদের আদ্ধেক শ্লোক আমার মনে গাঁথা হয়ে গেছল– মানে তার বুঝি আর নাই বুঝি। সেই পুঁজিই আমার সারা জীবন ভাঙিয়ে খাওয়া।

মার কাছে প্রায়ই আসত লাল চেলীপরা ত্রিশূলধরা ভৈরবীরা–তিব্বতের কোন মঠ না কামিখ্যে থেকে কে জানে! মার সঙ্গে নিভৃতে আলাপ হত তাঁদের। দিনকতক থেকে ফের কোথায় তাঁরা চলে যেতে যেন।

এক ভৈরবী আমায় ভালোবাসতেন ভারী। পেড়া-টেড়া খেতে দিতেন তার বোলার থেকে। দেবী কামাখ্যার মহাপ্রসাদ। তিনি একবার আমায় বলেছিলেন-তোমার মাকে সামান্য মনে কোরো না বাবা। জগন্মাতার অংশ আছে তার মধ্যে। মাকে কখনো অমান্য কোরো না।

মাকে আমি ভালোবাসি তে।

মা সাক্ষাৎ ভগবতী। মা-ও যা–মা দুর্গাও তাই। তিনি বলতেন।

জানি আমি। জবাবে আমি বলতাম–সবার মা-ই তো তাই। মা দুর্গাই। তাই না?

শুনে শুনেই এসব কথা জানা। আমিও শুনিয়ে দিতে ছাড়তাম না।

তাই বটে। তবে তোমার মা আরও বিশেষ।

কিন্তু কী যে সেই বিশেষ তা তিনিও কোনো দিন খুলে বলেননি, আমিও তা জানতে চাইনি কখনো। মার সেই বিশেষত্ব সারা জীবন ধরে আমায় জানতে হয়েছে। জীবন ভরে জেনেছি। আর, পৃথিবীর সঙ্গে আমার মুখোমুখি হয়েছিল সেই বয়সেই। মাথার মধ্যে কী পোকা ছিল কে জানে, সুখে থাকতে ভূতে কিলোতো, আর মাঝে মাঝেই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম বিবাগী হয়ে। পকেটে একটিও পয়সা না নিয়ে পাব কোথায় পয়সা?) বিনাটিকিটে রেল গাড়ির লম্বা লম্বা পাড়ি জমাতাম-চলে যেতাম বৈদ্যনাথধাম। দেওঘরের দেবতা কি প্যাড়া কিসের টানে তা আমি বলতে পারি না।

চলে এসেছি কলকাতায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, খবরকাগজ ফিরি করেছি, জেল খেটেছি মাঝে মধ্যে, ফুটপাথে পার্কে শুয়ে রাত কেটেছে। কষ্টের মধ্যেও কতো সুখ। স্বাধীনতার স্বাদ।

আর, ভালবাসা? তার পরিচয় কাউকে বোধ হয় চেষ্টা করে পেতে হয় না, সে নিজেই আগ বাড়িয়ে জানান দিয়ে থাকে। ই একটি বস্তু, যা কারোর দ্বারা কিছুতেই লভ্য নয়, (পাওয়াও যায় না বোধ হয়) নিজগুণে আপনার থেকে অযাচিত এসে ধরা দেয়।

চলার পথের মোড়ে মোড়েই তার দেখা মেলে। দেখতে না দেখতেই বেঁচে উঠি, বেঁচে বেঁচে যাই। নতুন করে বাঁচি, নতুনতরো আঁচ পাই জীবনের। কি করে যে একজনকে আরেকজনের এমন ভালো লেগে যায়, আর কী আশ্চর্য, তাকেও ভালো লাগানো যায় তেমনি আবার–কত সহজেই না! আমার কাছে সে এক পরম বিস্ময়-পরামাশ্চর্য রহস্য:

ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা–প্রত্যেকের জীবনেই ওতপ্রোত। কেউ বঞ্চিত নয়। প্রত্যেককেই টের পেতে হয় কখনো না কখনো, না টে: পেয়ে উপায় নেই, যিনি এই নাটের গুরু তিনিই টের পাওয়ান।

আর, বাল্যকালেই এসবের টের পেয়ে যাওয়া এক রকমের ভালোই বোধ করি। কেননা, ব্যাধি হিসেবে এই তিনটিই মারাত্মক–এই ঈশ্বর, পৃথিবী আর ভালোবাসা। তেমন করে ধরতে পারলে এ বস্তু কাউকে ছাড়ে না, রেহাই দেয় না সহজে, আজীবন ভোগায়, আপাদমস্তক গ্রাস করে বসে। সংসার, সারাৎসার আর…আর ভালোবাসার কী আখ্যা দেব? অন্তঃসার? নেহাৎ অন্তঃস্রাব ছাড়া কী আর ও? এর একটিই যদি কাউকে ধরে তো তার হয়ে গেল। জীবনের মতন ছাড়ান নেই। ঘোর সংসারী, যোরালো প্রেমিক কিংবা ঘোরতর ঈশ্বরসাধক হয়ে গেল সে। হতেই হবে। পরিত্রাণ নেই আর।

তাই কৈশোরেই কারো যদি এসবের টিকা নেয়া হয়ে যায়-খানিক খানিক স্বাদ পায় সেতো জন্মের মতই বেঁচে গেল বেচারা!

সটীক হয়ে থাকলে সঠিকভাবে বাঁচা যায় জীবনভোর। বাল্যে বসন্তের টিকা নিয়ে রাখলে তা যেমন কখনো প্রাণান্তকর হয়ে দেখা দিতে পারে না, দিলেও হামের মতই হামেশার সামান্য ব্যাপার হয় মাত্র, তেমনি প্রাথমিক এই ত্রিবিধ টিকায়–এই ট্রি অ্যানটিজে নেয়া থাকলে সারা জীবন ধরে পৃথিবী, ঈশ্বর আর ভালোবাসার পার্থিব আর অপার্থিব সেই বসন্তকালকে অল্পে অল্পে একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে চেখে চেখে যাওয়া যায়-খাওয়া যায়।

তাকেই খাই, তাঁর খাদ্য হতে হয় না।

পরাৎপর হলেও সেই মহাকাল যেন পরাস্ত হয়ে থাকে।

বিবেকানন্দের ভাষায় অমৃত ভাণ্ডের কিনারে বসে তার কিনারা করা। তার ভেতরে ডুব দিয়ে মজে ভূত হয়ে যাওয়া নয়, তাকে কিনারায় রেখে বহালতবিয়তে থেকে দেখেশুনে চেখে যাওয়া।

ভবানীর ভাঁড়ে হারিয়ে না গিয়ে, মিলেমিশে তাঁর সাথে একাকারে নিজেও ভাঁড়ে ভবানী না হয়ে, নিজের ভাঁড়কেও ভবানী না বানিয়ে ভবানীর ভাড়ার লুঠ করা আর কি!

একদিন বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি মা আমার বিরাট দরদালানে কেমন যেন অভিভূতের মতন দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখে বললেন, জানিস কে এসেছিল আজ?

কে?

মা এসেছিলেন।

দিদিমা? তাই নাকি? কই কই? কোথায় দিদিমা? আমি লাফিয়ে উঠেছি।

না, তোর দিদিমা নয়। তোরও মা। তোর মা, আমার মা, সবার মা। তিনিই একটু আগে এসেছিলেন।

শুনে আমি হতবাক হই। বুঝতে পারি না ঠিক।

মা কালী আমায় দর্শন দিয়ে গেলেন একটু আগে। এই সামনে, ওইখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন–যেখানে তুই দাঁড়িয়েছিস। ওই জবাফুলটা দিয়ে গেলেন আমায়। আমার হাতে তুলে দিতে এসেছিলেন। ভয়ে আমি হাতবাড়িয়ে নিতে পারিনি। হতচ্ছাড়ী আমি!

সামনেই একটা জবাফুল পড়েছিল আমি দেখলাম। দেখেশুনে আমি শিউরে উঠেছি কেমন।

কাছেই একটা গোরু বসে জাবর কাটছিল, কিন্তু জাবর কাটা সে ভুলে গেছে কখন  রোমাঞ্চিত হচ্ছে তখনো। মনে হয় সেও বুঝি মা কালীকে দেখেছে।

আর, সত্যি বলতে, দিব্যদর্শনের গোরুত্ব তখনই আমার মালুম হয়েছিল। সেই দণ্ডেই।

.

০২.

আত্মস্মৃতির পরিক্রমায় এগুবার আগে নিজের কুল পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন আছে বেঙ্গ করি! কিন্তু ছোটবেলাতেই যে নিরুদ্দেশের অকূলে ভেসেছিল আজ এত ঘাট পেরিয়ে, অবশেষের বালুবেলায় এসে জীবনের শেষ তীর্থ আত্মবিস্মৃতির উপকূলে পৌঁছে নিজের কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানো সম্ভব নয় বোধ হয়।

মহাকালের মোহনায় দাঁড়িয়ে গত কালের মোহ না রাখাই ভো ভালো। যখন সামনে চোখ রেখে কিছুই দেখা যায় না তখন পিছনে তাকিয়ে থেকে লাভ? মহাসাগরের অতলে ডুবে যাবার আগে নিজের মনে র দেওয়াই তো বেশ। কিন্তু…

দিন কতক আগে এক ভদ্রলোক এসে এমন বেকায়দায় ফেললেন আমায়! অমুক পত্রের পক্ষ থেকে আমি আসছি। তিনি জানালেন, আমাদের পত্রিকায় আমরা আপনার জীবনকথা ছাপতে চাই…।

শুনেই না আমি চমকে গেছি। আমার প্রতি কোনো পত্রিকার এহেন পক্ষপাতের হেতু খুঁজে পাই না আমার জীবনের কথা আসছে কোথা থেকে? আমি জন্মালাম কবে যে আমার… বাধা দিয়ে বলতে যাই।

আমরা অমুক অমুক অমুক সাহিত্যিকের আত্মপরিচয় ছেপেচি, সেই পর্যায়ে আপনারটাও প্রকাশ করতে চাই আমরা।

তাদের পর্যায়ে আমি পড়ি না। সবিনয়ে জানাই তারা যথারীতি জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন, বাড়ছেন, আরো বাড়বেন–তাঁরা জীবন্ত। তাঁদের পূর্বসূরী উত্তরসুরী দুই-ই আছে। তাঁদের জীবনী অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু আমার কথা আলাদা।

আলাদা কেন?

কারণ এই যে, আমি নিজেকে সাহিত্যিক বলেই মনে করি না। সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমি সৃষ্টি করতে পারিনি। গাইতে না পারলেও অনেকের গান বোঝার ক্ষমতা থাকে,আমারও অনেকটা সেইরকম। স্বয়ং সাহিত্যিক না হয়েও আমি সাহিত্য বোঝার সামান্য একটু ক্ষমতা রাখি।

সাহিত্য বলতে আপনি কি বোঝেন? জানতে পারি কি?

যা সর্বকালের সর্বজনের সহিত যায়, যেতে পারে। সহযাত্রার শক্তি রাখে। সর্বজনের সর্বক্ষণের সম্পূর্ণ মনের সঙ্গমক্ষেত্র, আমার মতে, তাই সাহিত্য। সে রকম লিখতে পারে কজনা? আমি তো পারি না। আমি তা পারি না। তাই আমি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর থেকে আলাদা।

সাহিত্যিক নন কী আপনি?

সাহিত্যিকরা সবাই মহৎ স্রষ্টা, স্বভাবতই প্রেরণার বশেই তাঁরা লেখেন। সামান্য লেখকমাত্র, কলমচালক কেবল, আমি লিখি নিতান্তই টাকার জন্যে। লিখে খাই আর নিজের খাই মেটাবার জন্যেই লিখি। প্রেরণার আদায়ে নয়, প্রাণের দায়ে আমার লেখা।

প্রাণের দায়ে লেখা?– হ্য। লিখতে আমার একটুও ভালে লাগে না। যা কষ্ট হয় কী বলব! না লিখতে হলে বেঁচে যাই। লিখতে মেহৎ,বহুৎ পরিশ্রমের ফল সেই লেখার গা থেকে ঘাম মুছতে মেহনৎ আবার। আদৌ সাহিত্যিক নই। আমি মেহনতি জনতার একজন। মজদুরের সগোত্র।

সব লেখকই লিখে টাকা পান, তা বলে টাকার জন্য লেখেন এমন কথা বলা যায় কি?  তিনি বলেন।

গায়ে জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না তার বদলে এই কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার এইটুকুই। আমি জানাই।–সাহিত্যের সঙ্গে আমার সংযোগ ততখানিই।

তাহলেও আপনি লেখক তো নিশ্চয়ই। অনেক লিখেছেন, শখের খাতিরে না লিখলেও নেহাৎ মজুরির জন্যেই আপনার এত লেখা এ কথা ঠিক মানা যায় না।

লেখা আমার পেশা হলেও পিষ্ট হয়েই আমার লেখা। বেশ, মজদুর বলতে না চান মুটে বলতে পারেন আমায়। মোট ফেলেই আমার খাওয়া; মোটামুটি লিখে মোটের উপর কিছু পেয়ে যাওয়া।

যাই বলুন, এদেশের মাপকাঠিতে আপনাকে সাহিত্যিকের মধ্যেই গণ্য করা যায়…

আমি গণ্য করি না। সাংবাদিক বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। আসলে আমি হচ্ছি ছোটদের লেখক–ছোট লেখক।

বড়দের লেখা দিয়েই আপনি শুরু করেছেন বলে শোনা যায় …

সেসব লেখা দেখা যায় না আর। কোথায় তলিয়ে গেছে কে জানে! আমারও সেই দশা হত, কোথায় চলে যেতাম অ্যাদ্দিন, ভাগ্যিস সেই ছেলেবেলাকার ছড়াটা মনে পড়ে গেল বড়ো যদি হতে চাও ছোট হও তবে-তাই আমি ছোট-র হয়ে গেলুম ছোট লেখক,– ছোটদের লেখক হয়ে গেলুম-রয়ে গেলুম শেষ পর্যন্ত।

বড় হলেন তো শেষ পর্যন্ত।

আমি হইনি ঠিক। আমার পাঠকরা হয়েছে। বেড়ে উঠে তারা দিল হয়েছে একেকটা। তারা আমায় টেনে তুলতে চেয়েছে বলে আজ আমার এই বাড়বাড়ন্ত।

এরকম তো হয় না বড় একটা। বড় হয়ে ছোটবেলার লেখকদের ভুলেই যায় ছেলেরা।

কারণ আছে তার। আমার লেখায় ছোটদের কখনই আমি ছোট বলে ধরিনি, অবোধ শিশু বলে গণ্য করিনি কখনো। আমার সমকক্ষ বলেই ধরেছি তাদের। বয়স্ক বন্ধুর মতন বিবেচনা করেছি। বড় হবার উপদেশ নয়, বড়ত্বের স্বাদ পেয়েছে তারা আমার লেখায়।

সেই আস্বাদ তাদের মনে লেগে রয়েছে এখনো। সেই কারণেই হয়ত এটা হবে।

আপনি ছোটদের একজন প্রিয় লেখক আমি জানি। আপনার শিশুসাহিত্য ছোটরা খুব ভালবাসে।

সে আমি শিশু সাহিত্য করি না বলেই। করি নানা বলে পারি না বলাটাই ঠিক। সত্যিকার শিশুসাহিত্য করেছেন দক্ষিণারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, কুলদাচরণ, সুখলতা রাও, সুকুমার রায় প্রভৃতিরাই-শিশুদের জন্যই লিখেছেন–শিশুদের মত করেই লেখা। সে কলম আমি পাব কোথায়! এ যুগে সে লেখনী আর সেই লেখা হারিয়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়। কারো কারো হাতে সে ধরনের লেখা এখনও খেলা করে বটে, কিন্তু সে অতি বিরল।

একালের সেই বিরল দৃষ্টান্ত কারা? তিনি জানতে চান।

মোহনলাল, সুকুমার দে সরকার, সতীকান্ত গুহর নাম করা যায়। এর পরের ধাপে মানে কিশোর সাহিত্যের পর্যায়ে পড়েন, হেমেনদা, প্রেমেন, নারাণ গাঙ্গুলী। লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, ধীরেন ধরকেও ধরা যায়…

আর আপনি? আমি এঁদের ধারেকাছেও নিজেকে ধরাতে পারি না। আমার ছোটদের লেখায় কিছু পোলা থাকে আর কিছু পান্ থাকে–এছাড়া কী আছে আর? পোলাপানদের জন্যে লেখা আমার শিশুসাহিত্য পড়ে তাই কি আপনার ধারণা হয়নি? আমার লেখায় বেশ ভেজাল আছে, সেই অ্যাডালটারেটেড লেখা ছেলেমেয়েদের অ্যাডাল্ট বানিয়ে ছাড়ে। আর সেই জন্যেই হয়ত তারা তা ভালোবাসে…। কোনো হিতোপদেশ নেই আমার লেখায়, আদর্শ স্থাপনের বালাই নেই কোনো, কোনো বাণী দিইনে আমি সেই জন্যেই হয়ত শোনার যোগ্য মনে করে তারা। বলুন, বাণী দেবার আমার কী আছে, সোনাই আসলে নেই যেখানে। খাঁটি সোনার নয়, পরিপাটি গিটির–সেই কারণেই আমার রচনায় এত ঝুটো অলঙ্কার, এমন পানঝাল, বুঝেছেন? পারা বাদ দিলে আমার লেখায় কী থাকে, আর এই কারণেই একটা গিটি বোধ সর্বদাই আমার মনে।

ভদ্রলোক চুপ। আমার নিজের প্রতি নিজেরই দাক্ষিণ্যের অভাব দেখে বুঝি তিনি নিরুত্তর হয়ে গেছেন।

আমার নিজের কী মনে হয় জানেন? শিশুসাহিত্যের সেই স্বর্ণযুগ আর নেই। শিশুই নেই তো শিশুসাহিত্য। শিশু কোথায় এখন? শিশুরা আর জন্মায় না, জন্মালেও বেঁচে থাকে না বেশিদিন, মানে, ঐ শৈশব অবস্থাটা অতি ক্ষণস্থায়ী এখন। সময় গতিকে শিশুরা সব বয়স্ক হয়েই জন্ম নিচ্ছে, দেখতে না দেখতে বুড়িয়ে যাচ্ছে–দেহের দিকে নয়, মনের দিক থেকে। এখনকার ছেলেমেয়েদের ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প দিয়ে ভোলানো যায় না, পক্ষিরাজ ঘোড়া আর তালপত্রের খাড়াঁয় তারা ভোলে না, চন্দ্রাভিযানের এই যুগে চাঁদের রকা কাটার বুড়ির সুতোর মায়ায় জড়ানো যায় না তাদের। কল্পলোকের গল্পকথা এখন অচল। শিশুসাহিত্যের সেই সত্যযুগ গেছে, এখন তার এই ঘোর কলিতে তাই আমার এই গাঁজার কল্কি।

না, কী বলছেন। আমার তরফে তাঁর ওকালতি–গাঁজা নয়।

গাঁজা কি না আমি জানি না। গাঁজানোই। তবে কী জানেন? লেখা মাত্রই নেশা ধরায়-গাঁজা হোক বা না হোক। নেশা না ধরলে–না ধরাতে পারলে, পেশা চলে না। এটা সব শিল্পেরই কুলকথা, মূলকাহিনী। তবে আসল কথাটা এই, ছেলেমেয়েদের আমি ভোলাতে চাইনি, ঠকাতে চাইনি, সজাগ করে দিতে চেয়েছি তাদের চোখ কান মন ফুটিয়ে দিয়ে…আজকের পৃথিবীর, এখনকার জীবনের একেবারে মুখোমুখি করে দিতে চেয়েছি।

সেই কথা বলুন।

এখনকার ছেলেমেয়েরা যেন তেল সলতে নিয়ে তৈরি হয়েই জন্মেছে, প্রদীপের মতই উন্মুখ। দেশলাই কাঠি ঘষে দিলেই প্রদীপ্ত। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ। শৈশবের থেকে এক লাফেই, এক ধাপেই যৌবনে। সত্যি বলতে, সব শিশুর মধ্যেই সম্পূর্ণ মানুষটি রয়েছে। পরিণত হবার প্রত্যাশায়–পুরোপুরি জেগে উঠতে চায় সে। সোনার কাঠি ছোঁয়ালেই হলো। তাহলেই চোখে কানে মনে সে সজাগ। বালক-বালিকার ছদ্মবেশে বিশ্বজয়ীর দল। সাহিত্যের কাজ হলো তাদের এই জাগিয়ে দেওয়া। এবং শিশুসাহিত্যই বলুন আর কিশোর সাহিত্যই বলুন, সর্বাগ্রে তাকে সাহিত্যই হতে হবে।

নিশ্চয় নিশ্চয়। তিনি মেনে নেন আমার কথাটা।

দুধের বদলে পিটুলি গোলায় ভোলালে তাদের চলবে না। সেকালে যেমন সদ্যকিশোরকে ব্রহ্মবোধের দীক্ষা দিয়ে ঈশ্বর সাক্ষাতে নিয়ে যাওয়া হত, একালে তেমনি জীবনবোধের শিক্ষা দিয়ে তাকে বিশ্বের সাক্ষাতে নিয়ে যাওয়া–সে যুগের উপনয়নের মতই এই উপনয়ন দুনিয়ার দরবারে তাকে পৌঁছে দেওয়া। এই জন্মের মধ্যেই আরেক জন্ম লাভ, শুধু দ্বিজত্ব মাত্র নয়, আরো আরো অনেক জন্ম লাভের বোধ সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা লাভ করি। সাহিত্যই আমাদের তৃতীয় নয়ন তার সাহায্যেই আমরা নিজেকে অপরকে জগতকে যথার্থরূপে দেখতে পাই। সাহিত্যই সেই দৃষ্টি-প্রদীপ। সাহিত্যিকের দায়িত্বও তাই এই মনের চোখ খুলে দেওয়া। হৃদয়কে জাগানো।

সে কথা মানি।

আমিও সেই দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছি–আমার সাধ্যমত। কতটা পেরেছি জানিনে, কিন্তু ছোটবেলাতেই যাতে তারা নিজেদের পরিবেশ-সমাজ সংসার মানুষের ধরণধারণ সম্বন্ধে সচেতন হয়, জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে, প্রয়াস পেয়েছি তার। জীবন আর জগতের সব কিছুই তাদের জানাতে চেয়েছি–যদিও একটু তির্যকভাবে আড় চোখে দেখলে দেখা যায় আরো। সোজাসুজি না বলেও বোঝাবুঝির কোনো অসুবিধা হয় না-বুঝলেন? এমনিতেই ছোটরা আমাদের চেয়ে বেশি বোঝে, বেশি বুঝদার।

এটা কী বললেন?

ঠিকই বলেছি। ছোটবেলায় বোধশক্তি স্বভাবতই তীব্র থাকে। অনুভবের দ্বারা তারা বোধ করে–কেমন করে যেন বুঝতে পারে সব। ছেলেবেলায় সকলেই খুব চালাক চতুর চৌকস থাকে, তারপরে যতই বড় হয়, হতে থাকে, চারধারের ধাক্কা খেয়েই হয়ত বা, ততই আরো ভোঁতা হয়ে বোদা মেরে যায় কেমন! নিতান্ত বোকা কিংবা অতিবুদ্ধি হয়ে, বুদ্ধিজীবী বনে বন্ধু হয়ে যায় বোধ হয়।

হ্যাঁ, ছোটরা যে বড়দের চেয়ে চালাক, চৌকস সেটা লক্ষ্য করেছি–

আর আমার গল্প পড়ে হয়ত তারা আরো একটু চোখা হয়। আমার লেখার পয়েন্ট সেইখানেই… যা এ কথা, আপনি কী বলছিলেন?

আমি এসব কথা আলোচনার জন্য আসিনি। আপনার জীবনকথা জানার জন্যই এসেছিলাম, কিন্তু আপনি ধান ভানতে…

কথাটা যেন তিনি উলটো বললেন মনে হলো। ধান ভানতে শিবের গীত নয়, শিবের গাজন শুনতে এসে টেকির বাদ্যি শুনতে বাধ্য হয়েছেন! টেকির ঢক্কা নয়, শিবের গীত শুনতেই তিনি উগ্রীব।

আমার জীবনকথা আবার কী! সবার জীবনও যা আমারও তাই, আমি জানাই।–এমন কিছু ভিন্নতর নয়, সবার মতই। কোথাও হয়ত বা একটু ইতরবিশেষ, কোথাও একটু বিশেষভাবে ইতর। এই যা।

তা কি কখনও হয় নাকি?

যেখানে আর সবার থেকে আমি আলাদা তা আমার আর্টে। এই আটই লেখক শিল্পীর শিল্পসত্তা। তার বেঁচে থাকা, পেশায় এবং নেশায়। এ ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই। শিল্পীর এবং তার শিল্পের কোনো অতীত কথা নেই, ভবিষ্যৎ বার্তাও নেই কোনো। সমস্তটাই তার বর্তমান।

বর্তমান?

সব সময়ই বর্তমান। সবার চোখের ওপর–সর্বদাই। মহাত্মা গান্ধীর জীবনই যেমন হ্যাঁ বাণী, শিল্পায়া লেখকেরও তেমনি সে যা বানিয়েছে তাই তার জীবন। তার বাইরে কি নেই। সেই জীবনকাহিনীই তো জানালাম এতক্ষণ আপনাকে।

.

০৩.

বিলক্ষণ! নিশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক : আপনার আর্ট তো খালি কথার খেলায়।

বহির্লক্ষণ তাই বটে। কিন্তু এহ বাহ্য। বাহ্যদশার মতন অন্তর্দশাও থাকে, এমনকি ও শব্দদেরও। আমি বললাম : কথার খেলাকে নিতান্ত খেলার কথা ভাববেন না। শব্দকে ব্র বলা হয়েছে। ব্রহ্মের রহস্য কী, আমি জানিনে, কিন্তু শব্দদের চিরদিনই আমার রহস্যম মনে হয়। একেকটি word যেন একেকটি world! তার মন নিয়ে, মনন নিয়ে স্বত এক একটি শব্দ, প্রায় মন্ত্রের মতই, কেবল যে তার অর্থের সহিতই জড়িত তাই নয়, তা মধ্যে একাধিক অর্থ, বিচিত্র রস, আশ্চর্য দ্যোতনা, সব উহ্ন থাকে। আমি গুহ্য কথাট প্রকাশ করতে যাই।

এ আবার কোন শব্দতত্ত্ব আনছেন?

নিজেই জানি না। এক স্বরে একাধিক ব্যঞ্জনা এক ব্যঞ্জনায়, একাধিক স্বর, ভাবলে অবাৰ হতে হয়। এক কথার পাঞ্জনায় অর্থবহ একাধিক বাক্যের ব্যঞ্জনা। অবাক হয়ে ভাববার শব্দরূপ, শব্দরস, আর শব্দতত্ত্ব–সব মিলিয়ে পরম রহস্য–আমি হয়ত চেয়েছিলাম তা দিয়ে জগন্নাথের ভোগ বানাতে, জগন্নাথ মানেই জগজন। কিন্তু আমার অক্ষমতায় তা হয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নেহাৎ জগাখিচুড়ি।

আপনার ক্ষোভের কারণ নেই। জগজন না হোক, জগতের বালকজন আপনার সে খিচুড়ি খেয়ে বেশ খুশি। জগত বলতে অবশ্যি আমাদের এই বাংলা দেশ।

সুবোধ বালক তারা–যা পায় তাই খায়, তাতেই খুশি। তাদের কথা ছেড়ে দিন।

আপনিও ও কথা ছাড়ুন। কথার কথা থাক্‌, কাজের কথায় আসা যাক। যে জন্যে এসেছিলাম–ভুলে গেলেন নাকি? আপনার জীবনকাহিনী …

আমার জীবন আমার যত কাহিনীর মধ্যেই বিধৃত, বিবৃত। তার মধ্যেই তারা ধরা পড়েছে, ধরা রয়েছে। খুঁজে পেতে সমঝে নিতে হবে। আমার কাহিনীই আমার জীবন, আর জীবনই আমার যত কাহিনী।

তার মানে?

নিজের জীবন নিয়েই আমার যত গল্প লেখা, বুঝলেন কিনা, আমার জীবনটা অনেকটা গল্পের মতই। জীবন দেখে, জীবন থেকেই তো সাহিত্য ছেকে নিতে হয়। আমার জীবনে আমার নিজের জীবনটাই ঘুরে ফিরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছি কেবল, সীমিত ক্ষমতা নিয়ে তার বাইরে আর যেতে পারিনি, তাই ঘুরে ফিরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই জীবনটাকেই দেখিয়েছি আমার রচনায়।

আপনি লিখেছেনও তো নেহাৎ কম না মশাই!

জীবনও তো বিপুল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, দিগ্বিদিকে বিস্তৃত। ইতো নষ্ট স্ততো ভ্রষ্ট। বেশির ভাগই ট্রাজেডি। তবে কিনা, একজনের দুঃখের কারণ অপরের উপভোগের বস্তু হতে পারে। আমার জীবনের বিয়োগ-যোগগুলি আমি তাই অপরের উপভোগ্য করে তুলেছি। নিজের দুঃখেই কাঁদছি, কতক্ষণেরই বা সে কান্না! তাই দিয়ে আবার অন্যকে কাঁদিয়ে কী লাভ?

তা বটে।

তবে কিনা, সর্বজনীন সাহিত্য সৃষ্টি করতে সবার জীবন দেখে, সকলের জীবন থেকেই নিতে হবে। কিন্তু বলেছি তো, আমার ক্ষমতা অতি সীমিত, উৎসাহও পরিমিত। কুলী কামিনের কাহিনী লিখতে হলে কয়লা-কুঠিতে কাটাও, বস্তির চরিত্র বানাতে পাঁকের মধ্যে মজো, গঙ্গার গল্প লিখতে গিয়ে জেলে হও, জেলেদের সঙ্গে মেশো গিয়ে, আর কয়েদখানার কাণ্ড জানতে হলে কষ্ট করে জেলে যাও। এবং জেলে গিয়ে কষ্ট করো। পাহাড়ে পরিবেশের পরিচয় দিতে বিস্তর চড়াই উতরাই পেরোও। কিন্তু পায়ের হাড় শক্ত নয় যে পাহাড় পার হই, তাই কোনো মহাপ্রস্থানের পথে না গিয়ে ঘরে বসে নিজেকে দেখে নিজের থেকেই আমার এই প্রবোধলাভ।

নিজেকে জানলে সবাইকে জানা যায় বলে যে। তিনি বলেন- তাই বা মন্দ কি?

হ্যাঁ, মন্দ কি! পহেলা, আত্মানং বিদ্ধি। প্রথমে নিজেকে বিদ্ধ করে তারপর আর সবাইকে বিদ্ধ করা। লক্ষ্যভেদ করা নিয়ে কথা। আমিও সেই কথাই বলি। সেই সঙ্গে এই কথাও বলি, আমার সাহিত্য সর্বজনীন, সর্বকালীন এমনকি সর্বাঙ্গীনও হয়নি। সত্যি বলতে, তা সাহিত্যই নয় হয়ত।

সাহিত্যই নয়। তাহলে কী হবে?

বলেছি তো জগাখিচুড়ি। তবে কিনা খিচুড়িও একেক সময়ে ভালো লাগে। বাদলার দিনে তাতেই মজে যায় সবাই। তাই যদি বা কখনো মানুষের পাতে পড়ে, ভোগে লাগে। তার জীবন যন্ত্রণার একটুখানি ভোলানোর জন্যেই আমার এই হাসির পরোয়ানা। দুঃখের পরোয়া না করার। তবে তাতেও কতটা সিদ্ধকাম হয়েছি তা জানিনে।

আপনার গল্পকথা থাক, সে তত আপনার বই পড়লেই জানা যায়। আমি এসেছি আপনার কথা জানতে, আপনার নিজের মুখ থেকে। আপনার ঠিকুজি কুলজি নিতে।

আমার কোনো কুলের খবর আমি রাখিনে। ছোটবেলায় বাড়ির মায়া কাটিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন, পিতৃকুলে, বাবার নামটুকু জানি খালি, ঠাকুর্দার নাম জানিনে। মাতৃকুলে দাদামশায়ের নাম জানতাম, ভুলে গেছি এখন। বেণীমাধব চৌধুরী না কে। কোন না কোথাকার জমিদার ছিলেন, নেহাত জমিদার না হলেও কোনা বলে কোনো জায়গার ভারী জোতদার জাতীয় ছিলেন বোধ হয়, তাঁদের বংশের কে বেঁচে বর্তে আছেন জানা নেই। তিনকুলের পিতৃকুল মাতৃকুল মামাতৃকুল গেল, তারপর জামাতৃকুল। তাও আমার নাস্তি।

জামাতৃকুল?

হ্যাঁ। তাও নেই। মেয়ে থাকলে তো জামাই। মেয়েই নেই, বিয়ে হয়নি বলে।

বিয়ে হয়নি কেন?

পৈতে হয়নি বলে বোধহয়। সেকালে অসবর্ণ বিবাহ ছিল না। পৈতে নেই, অচেনা বামুনকে কে মেয়ে দেবে? আর, বিয়ে যখন হয়নি আমার শ্রাদ্ধও হবে না আশা করি। ছেলে নেই, পিণ্ডি চটকাবে আর ছেরাদ্দ করবে কে?

আপনি খালি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। কোথায় গেলে আপনার কুলের খবর পেতে পারি তাই বাতলান।

কোথায় পাবেন। নিজের কুলকিনারা পাই এমন আমার ক্ষমতা নেই। কোথায় যাবেন?

আপনার বন্ধুকুলের কারো কাছে?

বন্ধুকুল। পৃথিবীতে বন্ধু বলে কেউ আছে আমি জানিনে। ধু আমার নয়, কারো আছে কি না সন্দেহ। বন্ধু পাওয়া যায় সেই ছেলেবেলায় স্কুল-কলেজেই। প্রাণের বন্ধু। তারপর আর না। আর না? সারা জীবনে আর না?

জীবন জুড়ে যারা থাকে তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। তারা দুরকমের। এনিমি আর নন এনিমি। নন্‌-এনিমিদেরই বন্ধু বলে ধরতে হয়।

আপনার বেলায়?

আমার কেউ এনিমি নয়। এ পর্যন্ত পায়নি একটাও। কিন্তু তারা কেউ আমার কোনো খবর জানে না।

কেন, ভবানীবাবু তো অনেক খবর রাখেন আপনার। তাঁর লেখা অমৃতের কাছে বসে শোনা সিরিজে আপনার কথা বেরিয়েছিল…

তাঁর মহিমা। আগাগোড়া মনগড়া। আমি তাকে কাছে বসে কখনো কিছু শোনাইনি। তাকে শোনাবার আমার কিছু নেই এই কথা তাঁকে জানাতে যেদিন তাঁর বাড়ি গেলাম, শুনলাম তিনি আগের দিনই তার লেখাটা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন কাগজে। যথাসময়ে আমি যেতে পারিনি তাই।

পড়েননি লেখাটা?

পড়েছি। পড়ে আমি তাজ্জব। বাল্মীকির যেমন রাম না হতেই রামায়ণ রচনা, তারও তেমনি এই ব্রিামায়ণ কাণ্ড! আপন মনের মাধুরি মিশায়ে সেই আশ্চর্য সৃষ্টি। তিনি যে অসাধারণ কথাশিল্পী তার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর ছাড়া কিছু নয়।

বলেন কি!

আমার ভাঁড়ে ভবানী তা জানি, কিন্তু–ভবানীর ভাঁড়ে যে এতও আছে তা আমার জানা ছিল না। গল্প লেখায়, মহৎ জীবনী রচনায়, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমীক্ষা, সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর জুড়ি নেই, আর ভাঁড়ারও অফুরন্ত তা জানতাম, কিন্তু একটা নগণ্য ভাঁড়কে এমন কাণ্ড করা–সত্যিই অদ্ভুত! অবাক করা কাণ্ডই! সামান্য ভাণ্ডে ব্ৰহ্মাণ্ড দেখানোর মত বাহাদুরি আর হয় না!

প্রেমেনবাবুও তো আমার বন্ধু শিব্রাম বলে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন কোন কাগজে, পড়েননি? সেটাও কি বানানো?

পড়েছি। কে একজন এনে পড়িয়েছিলেন লেখাটা। না, সেটা বানানো নয়। সত্যি ঘটনাই। প্রেমেনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনাই। এক সিনেমা হাউসেই সেটা হয়েছিল। অবশ্যি, তার আগে কল্লোল কার্যালয়ে তাকে দেখেছিলাম, কিন্তু সেখানে কোনো কথা হয়নি–আলাপ হয়নি–আলাপ জমেছিল সেই সিনেমাতেই।

কোন্ সিনেমাতে?

আমার ঠিক মনে নেই। এখনকার এলিট-এই হবে বোধকরি। স্মরণীয় হলেও কোনো কিছু আমার মনে থাকে না, ধরে রাখতে পারে না আমার মন। এমনিই আমার স্মরণশক্তি। কিন্তু আশ্চর্য স্মরণশক্তি ওর, সিনেমা হলের সামান্য খুঁটিনাটিটা পর্যন্ত সে মনে করে রেখেছে। তার সেই লেখাটাতেই দেখা গেল। না মশাই, তাতে আমার বিষয়ে কোনো অত্যুক্তি নেই। প্রায় সব ঠিক কথাই।

প্রায়?

একেবারে ঠিক ঠিক এ দুনিয়ায় কিছুই হয় না, হতে পারে না। সবই যেন প্রায় প্রায় হয়ে যায়।

আবার অচিন্ত্যবাবুও আপনার কথা লিখেছেন তাঁর কল্লোলযুগে।

শুনেছি, কিন্তু পড়া হয়নি। সেটাও নিশ্চয় অচিন্তনীয় কিছু হবে। ওর মন তো কারো কোনো খুঁত দ্যাখে না, সবার ভালো দিকটাই দ্যাখে কেবল, ওর কলমও ঠিক ওর মই, নিতান্ত সাধারণকে অসাধারণ করে দেখায়।

পড়ে দেখেননি? আপনার কথা আপনি পড়ে দেখেননি। তিনি একটু অবাক হন।–আশ্চর্য তো।

কী করে পড়ব! পাইনি তো। কেনাও হয়নিকো, বেজায় দাম বইটার, কিনতে পারিনি তাই। পয়সা কই আমার।

অচিন্ত্যবাবু দেননি আপনাকে?

দিয়েছিল, মানে, দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, ডি এম লাইব্রেরী থেকে নিয়ো। চাইতে গেলে গোপালবাবু বললেন, কী করবেন বই নিয়ে? ফুটপাতে বেচে দেবেন তো! নাম খারাপ হবে আমাদের। তার চেয়ে তার দামটাই না হয় দিয়ে দিই। এই নিন পাঁচ টাকা। ধরুন।

কী করলেন?

ধরলাম। তক্ষণাৎ। সমঝদার লোক তো। এ বিষয়ে আমিও বুঝদার বেশ। ওই পাঁচ টাকায় ওঁরই দোকানের সামনে ফুটপাথ পেরিয়ে চাচার হোটেলে গিয়ে নিজেকে বাঁচালাম। কল্লোলযুগে শুনেছি আমার সম্বন্ধে বিস্তর ভালোমন্দ কথা ছিল, পড়া হল না। কিন্তু ভালোমন্দ খাওয়া গেল খুব। ডি এম অচিন্ত্যর দৌলতে কাটলেট খাওয়া গেল মজা করে।…নিজের প্রশস্তি পাঠের চেয়ে সেটা আরও প্রশস্ত ব্যাপার নিশ্চয়।

কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়তে পারতেন তো বইটা?

কৌতূহল হয়নি আদৌ। সত্যি বললে, কৌতূহল বস্তুটা আমার কম। কোনো বিষয়েই তেমনটা নেই, নিজের বিষয়ে তো আরো কম। কেননা, আমার কাছে আমার কিছুই বোধহয় অজানা নেই। নিজের বিষয়ে নিশ্চয় আমি অপরের চেয়ে একটু বেশি জানি।

তাহলেও এটা আমার কাছে কেমন যেন ঠেকছে। তিনি বললেন : বইটা হাতে পেলে কি আর আপনি পড়ে দেখতেন না?

ভদ্রলোক ধরেছিলেন ঠিকই। দামী বইটা নিয়ে বেচেই দিতাম আমি, ফুটপাথে ঠিক না হলেও। তবে বইটা আগাগোড়া পড়ার পরেই বেচতাম যদিও। কী করব বই নিয়ে? আমার বাসায় বই রাখবার জায়গা কই? একটাও আলমারি কি বুক-শেলফ আছে? কোনো বই-ই

আমার কাছে নেইকো, এমনকি নিজেরও একখানা নয়। চেয়ে দেখুন, চারধারে।

তাই তো দেখছি। লেখকের ঘরে একখানা কারো বই নেই? আশ্চর্য!

যেমন লেখক, তেমনি আমি পাঠক। যেমন লেখায় তেমনি পড়ায় আমার অনীহা। লেখাপড়ায় আমি সমান চৌখস।

কিন্তু আপনি যে বইটা নিয়ে বেচে দেবেন, গোপালবাবুর এটা ধারণা করা অন্যায়। উনি সেটা টের পেলেন কি করে?

বারে! উনি টের পাবেন না? ওঁর কাছেই তো বেচেছি কত বই! আমার কোনো ৭২ বেরুলে তার কমপ্লিমেন্টারির পঁচিশ কপি তো ওঁর দোকানে গিয়েই বেচে আসতুম, একটু বেশি কমিশন দিয়ে নগদ মূল্যে। উনি কিনতেন আর উনি জানবেন না!

তাই নাকি! নিজের নতুন বইও বাড়ি এনে দেখবার সাধ হতো না আপনার?

সাধ্য হত না। পাড়ার ছেলেমেয়েরা কেড়েকুড়ে নিত রাস্তাতেই। ভাব ছিল তাদের সঙ্গে। তাছাড়া, বাসার লোকরাও পাবার আশা করত। দিলে আর তা ফিরে পাবার প্রত্যাশা ছিল না। কৃথা বাজে বরবাদ না করে তার চেয়ে নিজের আশ মেটানোটা কি ভাল না মশাই?

নিজের আশ মেটানো?

ভালো একটা প্রাতরাশ। টোস্ট মাখন ডিমের পোচ দিয়ে কোনো রোস্তোরাঁয় গিয়ে। তারপর ধরুন, তেমনি পরিপাটি একখানা মধ্যাহ্ন আশকোনো পাইস হোটেলে নানারকমের মাছ মাংসে, সন্ধ্যায় আবার তেমন ধারার একটা সান্ধ্য আশ-দেলখোস কেবিনে চর্বিওলা মাটন চপ সহ। তারপর? না, তারপর আর কোনো আশ নেই। তারপর একটানা সারা রাত্তির লাশের মতন লম্বা ঘুম একখানা।

এরকম করতেন কেন? না, আপনার ঐ খাওয়া কি ঘুমের কথা বলছি না। এই বই। বেচাটা…

ঠিক লেখকসুলভ নয়, এই তো? কিন্তু আমিও তো সুলভ লেখক নই। খবর কাগজ বেচেই জীবিকার্জনের শুরু হয়েছিল বলেই হয়ত অভ্যেসটা এসে থাকবে। তারপর সেই সব কাগজে লেখা শুরু করেই আমার লেখক-জীবনের সূত্রপাত হল। আর সব লেখকের কেমন আয় হত জানি না, আমার প্রায় যায় দশাই ছিল। ভারী টানাটানির সময় গেছে সেটা। যেমন ছিল লেখার দর, তেমনি তার আদর। তিনশ লাইন লিখে তিন টাকা পেতাম তখন।

বলেন কি।

এমন ছিল সেকালটা। এখন অবশ্য তিন লাইন লিখে তিনশ টাকা পাই। তবে তার কতটা আমার আর কতখানি খোদার কুদরং তা জানি না। একটা কথা বলব আপনাকে? কাউকে বলবেন না। প্রেমেন জানলে মনে ব্যথা পাবে, অবশ্যি এখনও যদি তার ব্যথা পাবার মতন মন থেকে থাকে।

বলুন।

প্রেমেনের প্রথম বই পুতুল ও প্রতিমা, বেরিয়েছিল গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় থেকে। গল্পের বই। অতুলনীয় গল্প সব। অনেকদিনের পর তার দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল সিগনেটের থেকে। তার একখানা কপি হাতে পেতে পাতা উল্টে দেখি, বইটা আমার নামেই উৎসর্গ করা। এ কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম দেখে। তোমার প্রথম বইটা আমাকেই দিয়েছ দেখছি। গদগদ কষ্টে তাকে বললাম।

সে কি! তুমি জানতে না? সে সুধালো।

না এই দ্বিতীয় সংস্করণ বের হবার পর টের পেলাম। আমি বলি–দ্বিতীয় সংস্করণটাই দিয়েছ বুঝি আমায়? প্রথম সংস্করণটা কাকে দিয়েছিলে?

কেন তোমাকেই তো! তুমি জানতে না? সে তো হতবাক। বইয়ের প্রথম সংস্করণ একজনকে, দ্বিতীয় সংস্করণ আরেকজনকে–এরকম দেওয়া যায় নাকি।… আশ্চর্য! বইটা বেরুবার দিনই তো দিয়েছিলাম তোমায়, তোমার বাসায় গিয়ে, মনে নেই।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন। আমি বাসার থেকে বেরুচ্ছি আর তুমি এলে-পথেই তো দেখা হল, মনে আছে বেশ।

বইয়ের মলাটও উলটে দ্যাখনি নাকি?

উলটে দেখার কী ছিল? তোমার সব লেখাই তো মাসিকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই পড়া। একবার নয়, বারবার। সেই সব জানা গল্প আবার নতুন করে জানতে যাবার কী আছে–তাই কোন কৌতূহল হয়নি আমার।

মনে পড়ল তখন। হাতে পেয়ে বইটার মলাট দেখেই খুশি হয়েছিলাম। মলাটের পাতা উলটে আরো বেশি খুশি হবার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি যে, সেটা আমার ললাট। প্রেমেনের বই তখন লোকের হাতে হাতে লত, তাই মনে হয়েছিল এই দুর্যোগের দিনে এটাকেও হাতে হাতেই চালিয়ে দিই এই সুযোগে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এম সি সরকারে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছিলাম বইটা।

.

০৪.

জীবনজিজ্ঞাসু সেই চমকপ্রদ ভদ্রলোকটি কিছুদিন বাদে আবার এসেহজির একদিন আচমকাই।

যতই সচকিত হই না, যথোচিত স্বাগত জানাতেই হয়-আইয়ে জনাব। আসুন।

আপনার কুলকিনারা করে ফিরেছি এবার। ঠিকুজি কুলজী সব নিয়ে। তিনি জানালেন–এর জন্যে মশাই, খোঁজখবর করে আপনার দেশে পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলাম শেষটায়।

আমার দেশ! কোথায় আমার দেশ? চমকাতে হল আমাকে।

কেন, আপনার দেশ কোথায় আপনি জানেন না?

একটা মহাদেশ তো জানি, এই ভূভারত। তাছাড়া একটা খণ্ড দেশের বাসিন্দা আমি বটে–এই চোরবাগানের। আমি জানাই, তবে এটাকে কলাবাগানও বলা যায় আবার। সত্যি বলতে, উভয় দেশের মধ্যপ্রদেশে-চোর আর কলা-এই চাতুর্যকলার মাঝামাবিই আমি রয়েছি। কলাচাতুর্যের নোম্যান-ল্যাণ্ডের সীমান্তে আমার আস্তানা।

আপনি উত্তরবঙ্গের নন? জন্মেছিলেন কোথায় শুনি?

উত্তরবঙ্গে নয়, কলকাতারই কোনো অলিগলিতে হবে বোধ হয়। আমি বলি-মার মুখে শুনেছিলাম দর্জিপাড়ায় জন্ম আমার–দাদামশায়ের বাড়িতেই। নয়ানচাঁদ দত্তের লেন—না কোথায় যেন ছিল সেটা।

কত নম্বর বাড়িতে?

ভুলে গেছি অ্যাদ্দিনে। কানে শোনা মাত্র, কোনোদিন নয়নে দেখিনি সেই গলিটাকে। দেখতে যাইনি, কৌতূহল হয়নি। আমি নিশ্বাস ফেলি-তা ছাড়া সে গলি কি আর রাস্তায় পড়ে আছে অ্যাদ্দিন! কলকাতা এর ভেতর কতবার ভোল পালটালো। পথঘাটের নামঠিকানাও পালটে যাচ্ছে।

হতে পারে জন্ম আপনার দর্জিপাড়ায়, কিন্তু আসলে আপনি উত্তরবঙ্গের কোনো রাজবংশের সঙ্গে জড়িত-সম্ভ্রান্ত পরিবারের থেকে এসেছেন জেনে এসেছি আমি।

কী সর্বনাশ! শুনে এবার চমকে গেছি সত্যিই! রক্ষে করুন, প্ৰলিতারিয়েত, পাতিবুর্জোয়া যা খুশি বলুন, কিন্তু এভাবে আমাকে বংশ দেবেন, এমন কি, কোনো রাজবংশও নয়। ভ্রান্তভাবেও না দোহাই আপনার! আমি রাজবংশীদের কেউ নই।

বললে কী হয়! আপনার মাতামহকুলও প্রায় রাজবংশই; ঠিক রাজগোত্রের না হলেও জমিদারগোষ্ঠীর তো বটে। তখনকার কালে ওই জমিদারদেরই রাজা বলত সবাই। কোনার না কোথাকার জমিদার ছিলেন নাকি তাঁরা।

পৃথিবীর কোন কোনায় কে জানে! আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। বিশ্বাস করুন, আমার পিতৃকুলে মাতৃকুলে কোনো কুলেই রাজাগজা কেউ নেই কো। তবে হ্যাঁ, মাসতুতো কুলে, তাও আমার আপন মাসির নয়, দূর সম্পর্কের মাসতুতোই, আমার বাবার মাসির, মানে বাবার এক মাসতুতো ভাই একটা রাজাই ছিলেন বটে। খেতাবী রাজা। তবে তাঁর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক! এক রোদে ধান শুকোবার সম্বন্ধেও না।

তাহলেও আপনাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন বলতে হবে।

কি করে ভদ্রলোকের এই সভ্রান্তি দূর করি, ভারি মুশকিলে পড়ি আমি। বংশের খোঁজে– জীবনে জীবনে ঘুরে ঘুরে বাঁশবনে ডোমকানা হওয়ার মতই তাঁর এই দশা বুঝতে পারি। কার স্বকপোলকল্পিত কে জানে, একটা কানা বাঁশ নিয়ে এসে ধরে বেঁধে কষে লাগাতে শুরু করেছেন আমায়।

দেখুন, আমার নিজের ধারণা ছিল আমি কলকাতার কোনো বস্তির থেকে আমদানি কিংবা ফুটপাথের কোনে কুড়িয়ে পাওয়া। কেন যে আমায় এভাবে অযাচিত অবাঞ্ছিত এই বংশ ধারণ করতে বলছেন তা জানিনে। আমি তো জানি, কলকাতার ফুটপাথে ঘুরে ঘুরেই আমি মানুষ। কেয়ার অব ফুটপাথই আমার ঠিকানা ছিল অনেক কাল। সেখান থেকেই উঠে এসেছি এই মেসের বাসায়। কিন্তু ফুটপাথ আমায় ছাড়েনি, চেয়ে দেখুন, আমার ঘরে যত রাজ্যের জঞ্জাল। কলকাতার রাস্তার মতনই পুঞ্জীভূত। ফুটপাতের প্রতি আমার এই স্বাভাবিক আসক্তি, এটা কি আমার রক্তের টান নয়?

হতে পারে। সে খবরও একেবারে মিথ্যে নয় হয়ত। সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু তাহলেও সামাজিক সম্পর্কটাকে তো আর অস্বীকার করা যায়না মাশাই। আপনার বংশধারার বিবরণ শুনুন আমার কাছে–উত্তরবঙ্গে চাঁচোর নামে একটি সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রাম আছে, এখন উদ্বাস্তুদের সমাগমে সে গ্রাম প্রায় উপনগরের মতই, যাই হোক, সেই গ্রামে একদা রাজা ঈশ্বরচন্দ্র নামে এক নৃপতি বাস করতেন। তিনি সিদ্ধেশ্বরী এবং ভূতেশ্বরী এই দুই পত্নী রাখিয়া অপুত্রক অবস্থায় দেহরক্ষা করেন…

বটে বটে? আপনি দেখছি বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প এনে ফাঁদলেন–বত্রিশ সিংহাসনের একখানা নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। বেতালের মত বললাম।

উক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর দুই পত্নীকেই পরের পর দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার দিয়ে যান। রাণী সিদ্ধেশ্বরী প্রথমে সেই অধিকার খাটাবেন, তিনি ব্যর্থকাম হলে তারপর দ্বিতীয় রাণী। তাঁর সেই ইচ্ছে মতন রাণী সিদ্ধেশ্বরী দেশের থেকে নিজের বোনের ছেলেকে নিয়ে এসে দত্তকরূপে গ্রহন করেন বা করতে চান…বোনের নামটা কী ছিল কেউ বলতে পারল না।

ধরুন না, প্রেতেশ্বরী। সিদ্ধেশ্বরী ভূতেশ্বরী প্রেতেশ্বরী–এক সুরে না হলেও এক স্বরে মিলে যায় বেশ।

বিন্ধ্যেশ্বরী হবে যেন শুনেছিলাম। যাই হোক, এই বিন্ধ্যেশ্বরীর সন্তান স্বর্গীয় শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী হলেন…

আমার বাবা। এ তো আমি জানতাম। বাবার নাম আমি জানতাম না? এই জানতে আপনি অদূর কষ্ট করে এত নাস্তানাবুদ হতে গেছলেন! 1,

উক্ত ঈশ্বরচন্দ্রেরও মনোগত অভিপ্রায় ছিল যে…তার স্বর্গত হবার পর…

স্বর্গে তত গেছেন। এখন ঈশ্বর ঈশ্বরচন্দ্র বলুন তাহলে। কিংবা চন্দ্রবিন্দু ঈশ্বরচন্দ্রও বলতে পারেন। আমি বাধা দিলাম।

হ্যাঁ। ঈশ্বরচন্দ্রের মনের ইচ্ছা ছিল প্রথমা পত্নীর বোনের ছেলেকেই উত্তরাধিকারী করার…রাণী সিদ্ধেশ্বরী হয়ত তাঁকে দত্তক নিয়েও থাকতে পারেন…

না মশাই, না। নেননি। আমি জোর গলায় বলি- আমার বাবা কারো পোয্যপুত্র হবার পাত্র ছিলেন না, তাঁর স্বভাব-চরিত্রের যর আমার জানা আছে। শালীর প্রতি টান থাকা স্বাভাবিক, আমি মানি। এমন কি অপত্যস্নেহবশে তার ছেলেকে রাজতক্তে বসিয়ে যাওয়ার বাসনা থাকাও শক্ত নয়, কিন্তু সেই ছেলেটির ধনশালী হওয়ার বাসনা ছিল না কোনদিনই। যতটা জানি তিনি রাজাগজা কিছু হননি, হতেও চাননি কখনো। কখনো না।

কেন হননি বা কেন হতে চাননি তার মূলে একটা রহস্য আছে। সে কথা পরে। এখন বলুন তো আপনার বাবা যে সন্ন্যাসী হয়ে গেছলেন এ খবর কি আপনার জানা?

জানি বই কি। এমন কি তাঁর সন্ন্যাসী বেশে ধ্যানমগ্ন চেহারার একখানা ফটোও ছিল আমার কাছে। অনেকদিন অযত্ন করে রেখেছিলাম-কি করে হারিয়ে গেছে কে জানে। নইলে দেখাতে পারতাম আপনাকে। জটাজুট সমন্বিত সেই হোরা।

হরিয়ে গেছে, কি করে হারালো?

কবে কেন কোথায়–কিছুই আমার মনে নেই। কেমন করে জানি না, সব কিছুই আমায় হারিয়ে যায়। কিছুই কখনো ধরে রাখতে পারি না আমি।

তার সন্ন্যাসী হয়ে হঠাৎ এভাবে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে বেরিয়ে যাবার গরুটা আপনি বলতে পারেন?

জায়গাটার দোষ বোধ হয়।

জায়গার দোষ?

হ্যাঁ, ঐ যে চাঁচোর বললেন না? ওটার ইংরেজি নাম হল গে চঞ্চল–সেখানকার ডাকঘরের ছাপেও তাই পাবেন। CHANCHALI। তাই মনে হয়, সেই চাঞ্চলের ডাকে আমাকে যেমন এক সময় বাড়ি ছাড়া করেছিল সেইরকম বাবাকেও বোধ হয়…

মশাই, না। কোনো চঞ্চলতার জন্য নয়। চাঁচোরের খুব প্রাচীন এক ব্যক্তির কাছে জেনে এলাম, অন্য কারণ। তাঁরও কথাটা আবার আরও প্রাচীন আরেক ব্যক্তির মুখ থেকেই শোনা। আপনি শোনেননি হয়ত। যাই হোক, আপনার বাবার হঠাৎ এই সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে পড়ার কারণটা কী হতে পারে আপনার ধারণা?

চাঞ্চল্য তো হঠাৎই হয়ে থাকে–তার আবার কারণ কী। আমার কী মনে হয় জানেন? জায়গার যদি না হয় তবে এটা সেই সময়টারই দোষ। সন্ন্যাসব্যাধি তখন কেবল ব্যক্তিগত বা বংশগতই ছিল না। সামাজিক মহামারির মতনই ছিল অনেকটা। তখন তো খাওয়া-পরার ধান্দা ছিল না কোনো, জীবনসগ্রামই ছিল না বলতে গেলে। এখনকার মতন নয়, কারো কোনো ভাবনা চিন্তাই ছিল না সেকালে। আর নেই কাজ তো খই ভাজ। কোনো ভাষা না থাকলেই যত ভাব এসে মাথায় এসে চাপে। বৈরাগ্যভাবটাও সেইরকম। ঈশ্বরটি মানুষ পাগল হয়। ভগবানের খোঁজ খবর নিতে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়ে অকস্মাৎ। আর বাবাও সেইরকম…

না মশাই, না। এর মধ্যে অন্য রহস্য আছে…

হ্যাঁ, রহস্য তো আছেই। জীবনটাই এক রহস্য। আমি তো আজীবনই সেই রহস্য দেখছি–বিন্দুমাত্রও তার ভেদ করতে পারিনি যদিও। চাঁচোর থেকে এই চোরবাগান অব্দি সেই রহস্যে ওতপ্রোত হয়ে আছি। দেখছেন না আপনি?

কী রহস্যের কথা বলছেন?

সেই রহস্য। দেখছেন না আপনি, চাঁচোর আর চোরবাগান দুয়ের মধ্যেই একটা রহস্য রয়ে গেছে? লক্ষ্য করেননি?

না তো। কী রহস্য?

দুটি জায়গাতেই একই বিশেষণে একই বিশেষ্য-অভিন্ন রূপে এক বিশেষ ব্যক্তি বর্তমান? দেখছেন না?

উহুঁ।

এত বড়ো চোর আপনার নজরে পড়ছে না? আশ্চর্য!

চোর? সারা মুখটাই একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ওঠে ওঁর–কোথায় চোর?

চোরই বলুন আর গোলামই বলুন–আপনার সামনেই। এই নরাধম। হাতের তাস ফেলি।

কী বলছেন মশাই? তাঁর মুখের রেখায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসার ওপরে বিস্ময় চিহ্ন দেখা যায়।

হ্যাঁ। চাঁচোরেও যে চোর, এই চোরবাগানেও সেই চোরই–সেই আমিই এই আমি। আমার চোরামি ঠাওর হচ্ছে না আপনার?

আপনার অকারণ এহেন কবুলতির কারণ?

কারণ আবার কি! সত্যি কথা স্বীকার করাই কি ভালো নয়? আর সত্যি বলতে, আমার এই দেশ, এই আর্যাবর্ত ব্রহ্মচর্মর পীঠস্থান। এটা তো মানে? ব্রহ্মসূত্র আর কর্মসূত্র এক চৌর্যবৃত্তির দ্বারা এখানে বিধৃত। এর তুঙ্গ স্থানে সেই ব্ৰহ্ম, আর কর্মস্থলে কেবল চৌর্য-দুহাতে এই উভয়কে আঁকড়ে ধরে আমাদের জীবন। ব্ৰহ্মচৌর্য ছাড়া বাঁচা যায় না। বাঁচতে পারি না আমরা।

ব্ৰহ্মচৌর্য কী বলছেন? ব্রহ্মচর্য বলুন।

একই কথা। বাগর্থ এক হলেও তার বাচ্যার্থ ভাবার্থ গূঢ়ার্থ অনেক থাকে–নানা অর্থে তার, নানান অনর্থ। ব্রহ্মকে চর্যাপদে আনলে পদে পদে ঐ চৌর্যকমই। তাছাড়া পথ কই? বাঁচতে হলে, বাঁচার মত বাঁচতে হলে ব্ৰহ্মবৃত্তি আর চৌর্যবৃত্তি দুই-ই আমাদের চাই যে। পরম ব্রহ্মের সাক্ষাৎ অবতার স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নিজের জীবনে সেই দৃষ্টাত দেখিয়ে গেছেন। বাঁচার তাগিদে ননী চুরি থেকে গোপিনীর বস্ত্রহরণ কিছুই বাদ দেননি তিনি।

টাকা পয়সা চুরি করাটাকেই আমরা চুরি বলে ধরি, শ্রীকৃষ্ণ তা করেননি।

খাবার অভাবেই লোকে টাকা পয়সা চুরি করে–অভাব মেটাবার স্বাভাবিক তাগাদায়। ছেলেবেলায় চুরি করে থাকে সবাই-অভাববশত নয়, স্বভাবতই। তারা ওটা চুরি বলে মনে করে না। শ্রীকৃষ্ণও বাল্যকালে সেই need ছিল, ননী খাওয়ার লোভ; তার অভাব মেটাতেই ননী চুরি করে তাঁর ওই no-need হতে যাওয়া। কিন্তু খাবার কি তার বিকল্প টাকা পয়সা চুরি করাটাকে চুরি বলেই আমি মনে করি না। শুধু অর্থই নয়, পরমার্থও আমাদের চুরি করে পেতে হয়। সহজে মেলে না।

কিছুই সহজে মেলবার নয় তা জানি। সে কথা ঠিক। তিনি মেনে নেন।

পরকে একপ্লয়েট না করে বাঁচা যায় না। পরকে আত্মসাৎ করে, পরের আত্মসাৎ করেই আমরা বাঁচি, আমরা বাড়ি, আমরা হই। এই চুরি বিদ্যাই হচ্ছে বড় বিদ্যাসুন্দর বিদ্যা। তার সমন্বয়েই এই জীবন বিদ্যাসুন্দর। সেই চৌর পঞ্চাশৎ যেমন কালীপক্ষে তেমনি বিদ্যাপক্ষেও…আমার কথা যদি বলেন, আমি এতাবৎ বেঁচে রয়েছি পরের খেয়ে-পরেই। পরের এবং পরীর।

পরীর?

হ্যাঁ, পরীর তো অবশ্যই। পরের থেকে অর্থ, আর পরীর থেকে পরমার্থ-পেলেই না সর্বার্থসিদ্ধি? একপ্লয়েট এবং সেপ্লয়েট? দুয়ে দুয়ে যেমন চার, তেমনি দু হাতে দুধারের দুয়েই না আমাদের বাঁচার?

কী বলছেন মশাই?

সেই কথাই বলছি…কামিনী আর কাঞ্চন এই দুটিই আমাদের জীবনের সার বস্তু। জীবনের আর পৃথিবীর। এই দুই নিয়েই তো বাঁচা। বাঁচার মত বাঁচার জন্য দুইটাই চাই আমাদের যে করেই হোক। আর ভাবান? হ্যাঁ, ভগবানও বটে। তিনি এই উভয়ের মধ্যে উত্ত। দুই মেরুর মধ্যে দণ্ডের মতই গুহ্য তিনি, তাঁর ওপর ভর করে তাঁর ভরসাতেই পৃথিবীর মতন আমাদের সূর্য প্রদক্ষিণ। শিরদাঁড়া না থাকলে কি বাঁচা যায় মশাই? খাড়াই হওয়া যায় না। ঠিক মতন। তাই ভগবানও আমাদের চাই বই কি। দুই মেরুর মধ্যে একই প্রাণদণ্ডে আমাদের সঙ্গে তিনি সমান সজীব। সেই অক্ষর বস্তু আপন স্বরে আর আমার ব্যঞ্জনায়-সম্মিলিত হয়ে যুক্তাক্ষর-কামিনী আর কাঞ্চন নিয়ে সশরীরে আমাদের মধ্যেই। আপন মহিমার নব নব ভূমিকায়। অবতার রূপ না ধরেও আমরা প্রত্যেকেই তাঁর অবতারণা।

কিসের থেকে কিসের অবতারণা!

আজ্ঞে, সেই কথাই।…এই কামিনী আর কাঞ্চন…পরের থেকেই পেতে হয় আমাদের, পরস্বাপহরণ না করে মেলে না কখনোই। একআধটু চুরি-চামারি না করলে কেউ বাঁচতেই পারে না। এই দুনিয়ায় বোধ হয় বাঁচাই যায় না একদম। অন্তত আমি তো পারিনি মশাই। আমার কথা যদি কই, মার্কটোয়েনের থেকে চুরি করেই আমার হাসির লেখার হাতেখড়ি-আমি লেখক হই। শুধু তিনিই নন, আরো অনেকে কাছে আমি ধারি। মুক্তহস্তের সেই ধার মুক্তকণ্ঠে আমার স্বীকার। চার ধারের মতো আখের রস পেষণ করে আমার এই আখের। এই লেখক পেশা। চোরামির কৌশল মজ্জাগত ছিল বলেই ছ্যারাতে ছ্যাঁচরাতে আসতে পেরেছি অ্যাদ্দিন–জীবদ্দশায় টিকে থেকে কোনো গতিকে। সত্যি বললে, আমি যেমন চোর তেমনি এক ছ্যাঁচোর। সে কথা প্রকাশ করতে আমার কুণ্ঠা নেই।

অসম্ভব না। খুনের ছেলের পক্ষে চোর হওয়া বিচিত্র নয় কিছু।

কী বললেন?

আপনার বাবা যে রাজ্যলোভ সংবরণ করে বিবাগী হয়ে সন্ন্যাসী হতে গেছলেন, সে কোনো ঈশ্বরের খোঁজে নয় মশাই। আপনার মাকে খুন করে তিনি ফেরার হয়েছিলেন।…

.

০৫.

ওমা, সে কী কথা গো। শুনেই না আমি আৎকে উঠেছি : তা কি কখনো হয় নাকি!

হবার কী আছে? তিনি বললেন : সেকালের পতিদেবতারা সাধারণ মানুষ ছিলেন।, তাঁদের পক্ষে এ তো অতি সহজ কাজ। সেযুগে বৌ ঠেঙানো লোকে বিলাসিতা বলেই মনে করত, আর, বৌকে খুন করে ফেলা তো চরম বাহাদুরি। আপনার বাবা কিছু আর তখনকার সমাজবহির্ভূত লোক নন? তবে হ্যাঁ, এই ফেরার হওয়াটা একটু সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার বটে। স্বভাবতই সে সময়ে এসব আপনার থেকেই চাপা পড়ে যেত, থানার দারোগাকে কিছু ধরে দিলেই মিটে যেত হাঙ্গামা। তবে এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সদরের পুলিস সাহেবের কানে গিয়ে গড়িয়েছিল কিনা। তিনি স্বয়ং সরজমিনে তদন্তের জন্যে মহানন্দাপথে তাঁর বজরায় এসে পড়লেন একদিন…গেরেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে…

আর, বাবাও অমনি রাজ্যপাটের পরোয়া না করে আমাদের নদীতটে সায়েবের বজরাঘাতের আগেই কেটে পড়লেন সেখান থেকে। আমি অনুযোগ করি : এই তত বলতে চাইছেন আপনি?

অবিকল।

কিন্তু তা কি করে হয় মশাই? আমার মাকে আমি নিজের চোখে দেখেছি যে…জলজ্যান্ত দেখেছি…বাবা মারা যাবার পরেও অনেকদিন তিনি বেঁচে বর্তে বহাল তবিয়তে ছিলেন।

তাই নাকি? কিন্তু আপনার মা হেমাঙ্গিনী দেবীর নিহত হবার খবর সেখানকার সুপ্রাচীন অনেকের কাছেই জেনে এলাম যে!

হেমাঙ্গিনী–কী বলছেন? আমার মার নাম যে শিবরাণী।…আমি প্রকাশ করি : বাবার নাম শিবপ্রসাদ। আমার ভাইয়ের নাম শিবসত্য, ঘাটশিলার স্কুল কাম কলেজের হেডমাষ্টার বনাম প্রিন্সিপাল। শিব দিয়ে মিলিয়ে নাম সব আমাদের।

শুনে তিনি অবাক হন–এরকম নামের যোগাযোগের মানে?

কে জানে, কেন! আমাদের দুভায়ের নাম বাবার রাখা–তিনিই মিলিয়ে রেখেছেন আর, মার নামটা নাকি হয়েই ছিল আগের থেকে। আর, ঐ নামের মিলের কারণেই বিয়েটা হল নাকি শুনেছি।

মনের মিল হয়ে বিয়ে হয় তা জানি, কিন্তু এই নামের মিল দেখে-আশ্চর্য তো!

আশ্চর্য তো বটেই। বাবা যখন সাধুবেশে মুক্তিলাভের আশায় হিমালয়ের পথে বিপথে ঘুছিলেন তখন এক ঋষিকল্প সন্ন্যাসী নাকি তাকে সংসারে ফিরে গিয়ে বংশরক্ষণ করে নিজের প্রাক্তনখণ্ডনের উপদেশ দেন, আর তিনিই বলেছিলেন যে, তাঁর উপযুক্ত সহধর্মিণী অপেক্ষা করছে–যার নাম লেই তিনি টের পাবেন। আর একটা রাজপ্রাসাদও নাকি তৈরি হয়ে রয়েছে তাঁর জন্যে। ভদ্রলোকের এই দুটো ভবিষ্যবাণীই কিছু কিছু ফলেছিল বাতে হয়।

সেই রাজপ্রাসাদটা আমি দেখে এসেছি এবার ওই চাঁচোরে গিয়ে, যেখানে আপনারা এককালে বাস করতেন। ওল্ড রাজ প্যালেস বলে থাকে লোকে এখনো। তবে তার রাজোচিত চেহারার কিছু আর অবশিষ্ট নেই…তিন বার পড়ে গেছে তার। অনেক- কাল হল তো।

আমার বাবা যখন সন্ন্যাস ছেড়ে সংসারে ফিরে এলেন তখন স্বভাবতই তাঁর বিয়ের কথা উঠল–নানা জায়গার থেকে সম্বন্ধ নিয়ে আসতে লাগল ঘটক। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম শিবরাণী দেখেই না, বাবা ঠিক করে ফেললেন, বললেন যে, ওই মেয়েই আমার সহধর্মিণী।

অবাক কাণ্ড তো?

সেই পরমহংসদেবের মতই না? তিনি ছোটবেলাতেই এক দঙ্গল বালিকার মধ্যে একটিকে দেখিয়ে বলেছিলেন–ই আমার বৌ। পরে তার সঙ্গেই তাঁর বিয়ের ঠিক হয়। তিনিই মা সারদামণি। তাই না?

তা না হয় হোলো কিন্তু বিলকুল গড়বড় হয়ে যাচছে যে! বিশ্বস্তসুত্রে পাওয়া খবর সব… জেনে এলাম আপনার মাকে খুন করে বাবা ফেরার হয়েছিলেন, এদিকে আপনি বলছেন বাবা মারা যাবার পরেও আপনি মাকে দেখেছেন। মনে হচ্ছে, যাকে দেখেছেন তিনি আপনার মা নন, সৎ মা। উক্ত হেমাঙ্গিনী দেবীই মা ছিলেন আপনার…আপনার বাবা দুই বিবাহ করেছিলেন, আপনি তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলে।

আবার আমার প্রতি আপনার এই অযথা পক্ষপাত…

অসম্ভব কিছু নয়ত। সেকালে একাধিক বিয়ের রেওয়াজ ছিল যে। প্রায় লোকেই তা করতেন।

জানি। তবে সেটা কুলীনদের বেলাতেই হতো মশাই! এক কুড়ি দুকুড়ি বিয়ে করা তাঁদের পক্ষে কিছুই ছিল না–এমনকি কুড়িয়ে বাড়িয়ে একশও ছাড়িয়ে যেত কারো কারো শুনেছি। কিন্তু চকরবরতিরা কুলীন নয়, যদ্দুর আমি জানি।

চকরবরতিরা কঞ্জুস হয় একথাটা যেমন আপনার জানা তেমনি তো? তিনি হাসতে থাকেন।

চকরবরতিরা যে কঞ্জুস হয় সেটা কেবল জানা নে, আমার দেখাও যে। আমি জানাই : এই চর্মচক্ষেই দেখা-আয়নার মধ্যে জাজ্বল্যমান।

তাহলেও, কুলীন না হলেও দুতিনটে বিয়ে এমন কিছু কঠিন ছিল না কারো পক্ষেই তখন এমন অন্নসংকট তো দেখা দেয়নি সে সময়। আমার ধারণা আপনার বাবা ফেরার দশার পর ফিরে এসে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছিলেন এই শিবরাণী দেবীকে।

তাহলে তো সেই দুর্লভ সৌভাগ্যলাভ হত আমার, যা খুব কম ছেলের বরাতেই ঘটে থাকে… আমি বলি : বাবার বিয়ে দেখতে পেতাম আমি। মানে এই দ্বিতীয় বিয়েটাই। আমার চোখের ওপরই ঘটত তো! আর কিছু না হোক, বৌভাতের দিন অন্তত পানের খিলি বিলি করার পাটটাও আমি পেতাম।

তার জন্যে আপসোস করবেন না। আপনার লেখায় তো তাই বিলিয়েছেন সারা-জীবন। বলে তিনি খিলখিলিয়ে হাসেন।

সে কথা সত্যি, মানতে হয় আমায়। পাঠক-পাঠিকার পাতে আর সব লেখকের নানান উপাদেয় ভুরিভোজ্য পরিবেশনের পর জীবনভোর আমার ঐ পানের খিলি বিলোনোই তো। পুষ্টিকর কিছু নয়, মুখ বদলাবার জন্য তুষ্টিকর হয়ত যৎকিঞ্চিৎ। আমার ফসলে ধান গমের কিছু নেই, তার আবাদেও পারঙ্গম নই আমি, ধার করা ধারালো আমার বরোজে খালি ওই পানই ফলে। চুটকি লেখার চটক! কারো মনের আকাশে খানিকক্ষণ উড়লেও খানিকবাদে ফুরুৎ করে মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।

যাক। ওসব কথা থাক, আপনার কুলপঞ্জীতে আসি। আপনার কাছে খবরগুলো যাচিয়ে নেওয়া যাক। আপনার ঠাকুর্দার নামটা কী বলুন তো?

কি করে বলব! আমার বাবাই জানেন।

আপনি জানেন না? শোনেননি কখনো বাবার কাছে?

শুনব না কেন, কত বারই তো শুনেছি। কিন্তু বছরে একবার করে শুনলে কি মনে থাকে নাকি কারো, না মুখস্থ হয়?

বছরে একবার করে?

হ্যাঁ, সেই মহালয়ার দিন পার্বণশ্রাদ্ধর সময়। তখনই বাবা ঊর্ধ্বতন চোদ্দ পুরুষের নাম আউড়ে তর্পণ করতেন…সেই দেবশর্মণদের নাম তখন তখন হলে না-হয় বলতে পারতাম; কিন্তু এখন অ্যাদ্দিন বাদে

কিন্তু অন্তত তিন-চার পুরুষের নাম তো মনে থাকে, মনে রাখে সবাই।

রেখে লাভ মশাই? যখন সেই অতীত কুলকোটিনাম্ সপ্ত দ্বীপনিবাসিনীম কারো নামই আমাদের স্মরণে নেই, তখন হরানো মহাসমুদ্রের এক গণ্ডুষ মাত্র-গণ্ডাকয়েকের নাম মনে রেখে কী হবে? তবে… আমার আরো অনুযোগ–এটুকু আপনাকে বলতে পারি ঠাকুর্দার সম্পর্কে যে, শিব দিয়ে তাঁর নাম নয়। কেননা, আমার বাবা তো তাঁর নামকরণের সুযোগ পাননি আদৌ।

তবে শুনুন সেটা আমার কাছে। আপনার ঠাকুর্দার নাম হচ্ছে নবকুমার। ঈশ্বর নবকুমার চক্রবর্তী। সেই নবকুমারের পৌত্র আপনি, বুঝেছেন?

য্যাঁ? তাই নাকি? আমি যেন চোট সামলাই, তাহলে ইনিই কি সেই নবকুমার যিনি নৌকা থেকে কাঠ কুড়োতে নেমে বালিয়াড়িতে গিয়ে পথ হারিয়েছিলেন?

পথ হারিয়েছিলেন? তার মানে?

মানে, পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ-র নবকুমার? আপনি কি বলতে চান যে কপালকুণ্ডলা আমার ঠাকুমা? আমার বঙ্কিমকটাক্ষ।–বঙ্কিমবাবুর সেই মানস কন্যা যাকে দামোদরের বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে, কপালকুণ্ডলা ডুবিয়া গেল আর উঠিল না, বলে এক কথায় তিনি খতম করে দিয়েছিলেন, যে নাকি আবার সাঁতরে দামোদর পেরিয়ে মৃন্ময়ীরূপে লোকসমাজে ফিরে দেখা দিয়েছিল আবার?

আপনার ঠাকুমার নাম আমি পাইনি। চেষ্টাও করিনি জানবার। তবে আপনার জন্মবৃত্তান্ত জেনে এসেছি, তাও কিছু কম রোমাঞ্চকর নয়।

হাতী ঘোড়া কিছু নয় নিশ্চয়? আর সবাই, সাধারণ মানুষেরা যেমন করে জন্মায়…

হাতী ঘোড়ার কথা আসছে কেন এখানে?

মানে, আমার জন্ম ব্যাপারে হাতীমার্কা কিছু ঘটেনি, সেই কথাই আমি বলতে চাইছিলাম। গোপা দেবী গৌতম বুদ্ধের জন্মের আগে হাতীর স্বপ্ন দেখেছিলেন না?

না, তেমন অলৌকিক কিছু না হলেও একেবারে লৌকিকও বলা যায় না ঠিক। মার মুখে আপনি শোনেননি কিছু?

শুনেছিলাম একটুখানি এক সময়। কিছুতেই নাকি আমি হচ্ছিলাম না, তাই বাবা-মা বিন্ধ্যাচলে গিয়ে মানত করেছিলেন ছেলের জন্যে–আর তারপরেই নাকি আমি হলাম। মা বিন্ধ্যবাসিনীর দয়াতেই হওয়া, জগন্মাতার দোয়াতেই আমার পাওয়া। তাই মা আমার নাম রেখেছিলেন পার্বতীচরণ। পরে বাবা আমার সেই প্রথম নামটা পালটে শিবরাম বানিয়ে দেন।

কেমন করে পাওয়া আপনি, জানেন তো? তাঁরা দেবীর পূজো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখতে পান এক নবজাতক শুয়ে রয়েছে মন্দিরচত্বরে, অনেক খোঁজখবর করেও তার বাপ-মার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন সেই বেওয়ারিশ শিশুটিকেই মার দেওয়া মনে করে তুলে নিয়ে এসে তাঁরা মানুষ করেন। সেই শিশুই হলেন আপনি।

আশ্চর্য নয়। আমারও সেইরকম মনে হয়। বলেছিলাম না আপনাকে যে আমি কোনো বস্তির আমদানি, নয়ত রাস্তার কোণ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া–মিলে গেল তো?

মেলালেই মেলে। তিনি নিশ্বাস ফেলেন।

তিনিই মেলান। মেলাবার মালিক তিনিই। মেলাবেন তিনি মেলাবেন-অমিয় চক্কোত্তির সেই কবিতাটা স্মরণ করুন। বস্তির সঙ্গে শ্রাবস্তির, কুঁড়ে ঘরের সঙ্গে কুঁড়ের বাদশাকে তিনিই মিলিয়ে দেন–মিলিয়ে থাকেন। সবই তাঁর অবদান।

এবার আপনার বাবার চরিত্রকথা শুনুন তবে– যা জেনে এসেছি। আপনার মনঃপূত হবে কিনা জানি না। আপনি তো বললেন–আমার বাবা পূত চরিত্রের দেবতুল্য আত্মভোলা মানুষ ছিলেন–কিন্তু সুন্দরী ললনাদের প্রতি দারুণ তাঁর ঝোঁক ছিল জানেন সেটা?

নিজের থেকেই জানা যায়-আমার মধ্যেও সেই ঝোঁক যে। আমার দেহে বাবার রক্ত প্রবাহিত কি না জানি না, যদি আমি বিন্ধ্যাচলের সেই বেওয়ারিশ ছেলেই হই, তবে আমার স্নেহে সেটা প্রকট। বাবার দৃষ্টান্তেই মানুষ তো! নামান্তরে সেই বাবাই। সুন্দর মেয়েদের সামনে আমিও আপনাকে সামলাতে পারি না। কেউ পারে কি না কে জানে!

সুন্দরী বধূদের তিনি হীরে চুণী পান্নার আংটি উপহার দিতেন জানেন তা? সে তল্লাটের অনেক গিন্নীই হাতের সেই আংটি দেখালেন আমায়–প্রৌঢ় হলেও প্রথম যৌবনে যে তাঁরা রূপসী ছিলেন দেখলেই সেটা টের পাওয়া যায়। এটা আপনি জানতেন?

জানব না কেন। স্বচক্ষে দেখছি। যখনই তিনি কলকাতায় যেতেন একগাদা সোনার আংটি গড়িয়ে আনতে পাথর বসানো, আর যাঁকে তাঁর ভালো লাগত স্বহস্তে তার আঙ্গুলে। পরিয়ে দিতেন দেখেছি। …আর এটা…এটা অনেকটা তার পাণিগ্রহণের মতই যেন, আমার মনে হত সেই সময়।

আর আপনি এদিকে বলছেন আপনার বাবা ছিলেন নিরাসক্ত দেবতুল্য মানুষ–

তাতে কী হয়েছে! মহাদেবের কি মোহিনীর প্রতি ঝোঁক ছিল না? বাবার হয়ে সাফাই গাই : আর সত্যি বলতে, বাবার ওই আদর্শ থেকেই আমি প্রেরণা পাই। এটাকে মনের দুর্বলতা বলতে পারেন, কিন্তু আমার মনের জোর ওই থেকেই। নিজের মনের দুর্বলতা অনায়াসে কাটিয়ে ওঠার অতি সহজ এই উপায় বাবার দৃষ্টান্ত থেকেই আমি শিখেছি। বাবার ওই আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়–তাঁর ওই আচরণের ছেলেবেলাকার সেই-শিক্ষায় এই অধম জীব বহুৎ বাধা অবলীলায় উৎরে এসেছে।

পরস্ত্রীর প্রতি ওই আসক্তি কি ভালো?

তা আমি জানিনে। তবে বলতে পারি আমার মধ্যে একটুও পরস্ত্রীকাতরতা নেই। পরস্ত্রী ছাড়া কি আর মেয়ে নেই দুনিয়ায়? পরকুমারীরা সব গেল কোথায়? পরীর মত মেয়েরা?

তারা থাকতে-পরধনে হস্তক্ষেপ করবার দরকার! তবে হ্যাঁ, ওই আংটি দেওয়াটা একটু ব্যয়সাপেক্ষ বটে। কিন্তু ও ছাড়াও বিয়ে না করেও পরকন্যার করলাভের অন্য পথ আছে আরো, একেবারে নিখর্চায়। কাজী আমায় শিখিয়েছিল পামিস্ট্রি। মিষ্টি হাতকে হস্তগত করার সহজ উপায় হচ্ছে ঐ হাত দেখা। ঐ করে প্রথম হাতিয়ে না, তারপর শনৈঃ শনৈঃ! আর কী! শনৈঃ পন্থা শনৈঃ কস্থা-শনৈঃ পর্বত লঙ্নম ইত্যাদি! কাজী নাকি ঐভাবেই বাগাতে মেয়েদের। আর সেই কারণেই আমি বলতাম, আমাদের মধ্যে কাজী…কাজীই একমাত্র…

কাজী কি?

Kazi knows rule!

কাজীর কথা থাক, আপনার বাবার কথা কই…তিনিও কিছু কম কাজের কাজী ছিলেন না।

বাবার কুলকুষ্ঠী আর আপনার কাছে কী শুনব? তাঁর কুলকাহিনীর আমিও কিছু কিছু জানি। তাঁর মুখেই শোনা। বলব আপনাকে?

বলুন বলুন।

আমাদের আদি নিবাস ছিল নাকি চোঁয়ায়…মুর্শিদাবাদের কোনখানে যেন সেই জায়গাটা। সেখান থেকে চুঁইয়েই আমরা ওই চাঁচোরে গিয়ে পড়েছিলাম–তারপর সেখান থেকে বিদূরিত হয়ে কোথায় না। যাক, ওই চোঁয়া যে কেমন জায়গা চোখে দেখিনি যাইনি কখনো সেখানে, তবে বাবা একটা ছড়া কাটতেন–ছড়াটা তাঁরই কিনা কে জানে-শীত নেই গ্রিন্থি নেই সব সময়েই ধোঁয়া। সকাল নেই সন্ধ্যে নেই শেয়াল ডাকে হোয়া। গ্রামের নামটি চোঁয়া। এই চোঁয়ায় একবার এক যাত্রা পালার আসর বসেছিল। চাঁচোরেও আমি যাত্রাদল আসতে দেখেছি। মুকুন্দ দাসও এসেছিলেন একবার মনে আছে আমার। এখন চোঁয়ার কথাটাই বলি। যেদিন রাত্রে যাত্রা হবার কথা, সেদিন সকালে বাবা সামনের বাগানে প্রাতঃকৃত্য করতে গেছেন, দেশগাঁয় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে প্রকৃত রসিকের ন্যায় নিঃসর্গ দৃশ্য দেখতে দেখতে মুক্ত বাতাসে নিজেকে বিমুক্ত করাই যে রেওয়াজ তা আপনি অবহিত আছেন আশা করি। এখন, সেই যাত্রাদলের একটি ছোকরাও বসেছিল প্রাক্তকৃত করতে কাছাকাছি–তিনি লক্ষ্য করেননি। এহেন কালে একটা কুল এসে পড়ল তাঁর সম্মুখে। টোপাকুল। দেখে তিনি লোভ সামলাতে না পেরে মুখে পুরে দিয়েছেন, আমাই বাবা তো! কিন্তু সেই ছেলেটা সেটা দেখেছিল।…

তারপর?

তারপর, সন্ধ্যেয় যাত্রার আসর বসতে রাধাকৃষ্ণের পালা শুরু হোলো। সেই প্রাতঃকৃত্যের ছোঁড়াটা জটিলা-কুটিলার একজন সেজেছিল। নাচতে নাচতে আসরে এসে গাইতে লাগল, তোমার কুলের কথা কয়ে দেব, রাধার কাছেই হাত মুখ নেড়ে গাইছিল সে, তারপর গোটা আসরেই ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগল তাই। বাবার কাছে এসে যখন সে হাত নাড়তে লেগেছে–তোমার কুলের কথা কয়ে দেব–বাবা তাকে একটা টাকা প্যালা দিয়েছেন। চলে গেছে। এক চকর ঘুরে ফের সে ফিরে এসে শুরু করেছে, তোমার কুলের কথা কয়ে দেব। অমনি বাবা হাটে হাঁড়ি ভাঙবার ভয়ে পাঁচ টাকা প্যালা দিয়েছেন। ফের আবার। বকশিশ পেয়ে পেয়ে ছোঁড়াটার উৎসাহ বেড়েছে, ঘুরে ঘুরেই আসছিল সে আর গাইছিল ওই কুলের কথার কলিটা-বাবার মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে। আর বাবাও অমনি তেড়ে তেড়ে প্যালা দিচ্ছিলেন ছেলেটাকে তার মুখ চাপা দেবার জন্য। তিনি যত চাপতে চাচ্ছিলেন ততই তার চাপল্য বাড়ছিল যেন। সে ভেবেছিল তার গানটা বুঝি বেমায় মনে ধরেছে বাবুর–তাই সে গানও ছাড়ছিল না,, বাবাকেও না। মাছির মতই ভোঁ ভোঁ করছিল বাবার কাছে এসে। আর বাবাও পাগলের মত প্যালা দিয়ে যাচ্ছিলেন–ঐ করে বাবার আংটি গেল, সোনার ঘড়ি চেন গেল, গায়ের শাল দোশালা আংরাখা, লক্ষ্মেী টুপির কিছুই রইল না, সব চলে গেল বাবার ই গানের ঠ্যালা সামলাতে, কিন্তু প্যালারামকে থামানো গেল না কিছুতেই। শেষটায় কুলের কাঁটার যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে বাবা উঠে পড়লেন আসর থেকে–সর্বশেষে বাবা নিজের পরিধেয় বস্ত্রটি খুলে দিয়ে বললেন, যা ব্যাটা, কগে যা আমার কুলের কথা। হাগতে বসে একটা কুল খেয়েছি এই তো? কয়ে দিয়ে, বয়েই গেল আমর। বলে বিলকুল দিগম্বর হয়ে বেরিয়ে এলেন আসর থেকে।

তাই নাকি?

বাবার এই কুলকাহিনী তো আপনি শুনতে পাননি? সত্যি বলতে, সবার কুলকথা কুলকেচ্ছাই প্রায় এইরকম। আমিও নিজের কুলের কথা কাউকে কইতে চাইনে তো এইজন্যেই। পাছে দিগর সাজে লোকসম জে বেরিয়ে পড়তে হয় সেই ভয়।

.

০৬.

একেবারে পোড় বাড়ি ঠিক না হলেও প্রায় পড়ো পড়োই ছিল বটে বাড়িটা। আড়াই ধার তার পড়েই গেছল, দেড়টা দিক খাড়া ছিল কোনো গতিকে।

তাহলেও নামড়াকে রাজবাড়ি। পুরাতন রাজবাটী। চাঁচোরের রাজা ঈশ্বরচন্দ্র একদা মহাসমারোহে বাস করলে সেই প্রাসাদে।

বিরাট চার মহলা লম্বা চওড়া ছিল যে বাড়িটা তা তার চারধারের ধ্বংসাবশেষ দেখলেই বোঝা যায়। অন্দর মহল, রাণীরা থাকতেন যে ধারটায়, পশ্চিমদিকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখন ভগ্নদশায় দাঁড়িয়ে। দক্ষিণ ধারটাও ভাঙাচোরা চেহারা, তার একটা দিকের খানকয় পরিত্যক্ত ঘর তো আমার চোখের ওপরই ভেঙে পড়ল একদিন।

একশ বছরের ওপর নাকি বাড়িটার বয়স, তখন সেই পড়ন্ত অবস্থায় মনে হতো পড়তে পড়তে পুরোপুরি যেতে আরও একশ বছর লেগে যাবে বাড়িটার। সেকেলে শক্ত গাঁথুনির পোক্ত বাড়ি তো রীতিমতন বনেদী।

দোতলা বাড়ি। আমরা থাকতাম রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের সাবেক তোষাখানায়। পূর্বদিকের এলাকায়। তার বাঁ দিক ঘেষে স্নান করার গোসলঘর। এখন সংক্ষিপ্ত হয়ে গোর, সেটা পেরিয়ে গেলে শীসমহল ইত্যাদি-হলগুলো থাকলেও সে-সবের রঙ-চঙের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট ছিল না আর।

দস্তুর মতন প্রশস্ত তোষাখানার ঘরটায় পর পর আটখানা খাট আটত। সেটাই ছিল আমাদের শোবার ঘর। বাবার নিজের ছিল তিনখানা খাট, যখন যেটাতে খুশি তাঁর দেহভার রাখতেন, তার ভেতরে একটা ছিল আবার পেল্লায়। আমার নিজের দখলে ছিল একখানা, বায়না করে বাগানো, আর আমার ভাই আর মার খাট দুখানা জুড়ে এক-করা, একটা বড় মশারির বিছানা ছিল সেই খাটে। আমি নিজের খাটে তো শুতামই, আবার ইচ্ছে হলে, ইচ্ছেটা প্রায়ই হত আমার, পাশের সেই জোড়া খাটে গিয়ে মধ্যিখানে সেঁধিয়ে পড়তাম এক এক সময়। বাবার পাশেও গিয়ে শুতাম কখনো-সখনো।

আর অষ্টম, বাড়তি খাটখানা ছিল মামা-টামা বা সম্পর্কিত দিদি-টিদি কেউ কখনো সখনো এলে-টেলে তার জন্যে।

রঙমহল শীসমহল ইত্যাদির মানে কী, আমার জানা নেই। মুঘল যুগের ইতিহাসে যাঁদের দখল আছে তারা বলতে পারেন। আমার মোগলাই অভিজ্ঞতার দৌড় ঐ পরোটা পর্যন্ত। আমার মনে হয় ওখানে বসে রাণী আর বেগমরা হয়ত মুখে হাতে নখে মেহেদির রঙ লাগানে আর রাজা কি রাজকুমাররা শীস দিয়ে ইশারা করতেন তাঁদের কিংবা সাড়া দিতেন তাঁদের ইশারায়। আর, তোষাখানাটা আমার ধারণায় ছিল খোসামোদের আখড়া। মোসাহেবদের তোষামোদে রাজাবাহাদুর এখানে আমোদিত হতেন, আমোদ পেত সভাসজ্জন সবাই।

গোলঘরটার উত্তর দিকে আরো অনেক ঘর ছিল, সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ খাড়া ছিল তখন। তারই ভেতর যে দু-একখানা তখনো পড়ে যায়নি তারই একটাতে ছিল আমাদের ভাঁড়ার ঘর আর তার পাশেই রান্নাঘর।

ঐ পর্যন্তই আমাদের এলাকা। তার ওধারটায় সাবেক মহাফেজখানা ছিল যেটা সেখানে থাকতেন এক ডাক্তার, সপরিবারে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। রাজ এস্টেটের দাঁতব্য চিকিৎসার ভার ছিল তার ওপর।

কলকাতা থেকে এসেছিলেন তাঁরা। আমার মাও শহুরে মেয়ে। তাই দুই বাড়ির গিন্নীর ভেতর ভাব জমাতে বেশি দেরি হয়নি। আমার বাবা প্রথম পরিচয়েই ডাক্তারবাবুর বৌকে একটা হীরের আংটি উপহার দিয়েছিলেন আমার মনে আছে। কিন্তু সেহেতু মার কোনো রাগ হতে আমি দেখিনি।

ডাক্তারবাবুর ছিল চার মেয়ে আর এক ছেলে। কী যেন তাদের নাম। শুধু একজনের নাম এখনো আমার মনে আছে, সব্বার ছোট, সেই রিনি। প্রায় আমার বয়সী, দশ-বাবোর মধ্যে সবাই, তবে ছেলেটা আমার চেয়ে একটু বড়ই হবে বোধ করি।

আমার বেশ মনে আছে, আমরা দুই ভাই রাম লক্ষ্মণ সাজতাম আর সেই ছেলেটা-কী যেন ছিল তার নাম, সে হতো রাবণ। মোড়ার কাঠি ভেঙে তীর ধনুক বানিয়ে ঘোরতর যুদ্ধ হত আমাদের–যেটাকে ন্যায়যুদ্ধ বলা যায় না কিছুতেই। কেন না রাবণ হারতে চাইত কোনমতেই, সব শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে গায়ের জোরে হারিয়ে দিতে আমাদের। তীর ধনুক সব ফেলে দিয়ে পিটাতে এমন শুরু করত আমাকে-স্বভাবত রাবণের রামের প্রতি আক্রোশ বেশি হবার কথা–অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু আমারই পাশ-বালিশ বাগিয়ে দুমদাম লাগানোটা কি ঠিক? যতই বলি যে গদাযুদ্ধ রাবণোচিত নয়, দুর্যোধনের শোভা পায়, সেকথায় কান না দিয়ে সে বালিশ আর আমাকে একসঙ্গে ফাঁসিয়ে দিত। চোখে নাকে মুখে তুলো ঢুকে হাঁচতে হাঁচতে পালাবার পথ পেতাম না আমি। সে তখন লক্ষ্মণের সঙ্গে সন্ধি করে মার্বেল খেলতে বসে যেত বারান্দায়।

নীচের ডাক্তারখানা থেকে আমি একবার একটা কাঁচের পিচকিরি চুরি করে এনেছিলাম, বিশেষ কোনো কারণে না, এমনিই। ভালো লেগেছিল তাই। তাই না দেখে ভারী রাগ করেছিলেন বাবা, কাঁদতে কাঁদতে সেই পিচকিরিটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হয়েছিল আমায়। কম্পাউন্ডারবাবু পিচকিরিটা নিয়ে সিরাপ খাইয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন আমাকে, মনে পড়ে এখনও।

তোষাখানা আর মহাফেজখানা মাথা উঁচু করে থাকলেও পশ্চিম আর দক্ষিণের মালখানা আর বালাখানার সবটাই প্রায় পড়ে গেছল। এই চারখানার মাঝখানে অনেকখানি শান বাঁধানো ফাঁকা জায়গা ছিল–সেই বিরাট চত্বরে ম্যাজিক বা যাত্রার আসর জমত, পাঁচখানা পাড়ার লোক জড়ো হতো দেখতে। আর সেই চৌহদ্দিতেই ওরা পাঁচ ভাইবোন আর আমরা দুই ভাই মিলে বাতাবি নেবুর বল পিটিয়ে খুব ফুটবল খেলতুম।

আমাকে সঙ্গী করে বড়ো মেয়েটা, নানু বুঝি ছিল তার নাম, মাঝে মাঝে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরুতো। মেয়েটা ছিল দারুণ ডানপিটে। গায়ে জোরও ছিল বেশ। তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পারতুম না আমি কখনোই।– রত্নহারের সন্ধানে বেরুতাম আমরা একেকদিন। মহারাণীর রত্নহার। চারধারেই তো প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সে বলত এরই আনাচে কানাচে কোথাও না কোথাও মোহরের ঘড়ার সন্ধান পাওয়া যাবে। সেকালে তো ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক ছিল না। ধনরত্ন সব মাটির তলাতেই লুকিয়ে রাখত সবাই।

আমাদের বাড়িটার পশ্চিম দিকে রাণী ভূতেশ্বরীর অন্দর মহলের ভগ্নাবশেষে হানা দিতাম, যদি মহারাণীর হীরে মাণিক্যের খোঁজ মিলে যায় দৈবাৎ।

একদিন এঘরে সেঘরে ঘুরতে হঠাৎ একটা সুড়ঙ্গের মতন দেখা গেল। নানু বলল, আয় নেমে যাই, এর ভেতরটায় কী আছে দেখে আসি।

বাবা। আমি ঘাড় নাড়লাম। সাপখোপ থাকতে পারে। কামড়ে দেবে। বাবার কাছে সাপের ওষুধ আছে। সে বলল। ডাক্তারের মেয়ে, সাপের ভয় রাখে না সে।

তেমন তেমন সাপে কামড়ালে টের পাবি তখন। তোর বাবা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবি না। ঢুলে পড়বি এখানেই।

বয়ে নিয়ে যাবি তুই।

আমি? আমি তোকে তুলতে পারি? এখুনি পরীক্ষা করে দেখা যায়না বাবা। তুই যা ভারী। সুড়ঙ্গে সেঁধিয়ে কাজ নেই। এমন সময় সাজগোজ করা একটা মেয়ে থামের আড়াল থেকে ইশারা করল আমাদের।

থমকে দাঁড়ালাম আমরা। এখানে মেয়ে এলো কোথা থেকে রে? আমি নানুর কানে ফিসফিস করি।

রাণী ভূতেশ্বরী হবে বোধহয়। তোকে ডাকছে। হ্যাঁ তোকেই। যা না।

বাবা। গুপ্তধনের সন্ধান পেতে পারিস। বা মোহরের ঘড়ার খবর। যা না রে। ভয় কীসের! আমি তো রয়েছি এখানে?

না বাবা।

গলার হারখানা দেখেছিস? হীরে মুক্তো ঝকমক করছে। রত্নহারটা তোকে দিতে পারে–চাস যদি। চা না গিয়ে।

রত্নহার আমার মাথায় থাক। ও নিয়ে আমি কী করব? আমায় দিবি। পরব আমি আমার গলায়। আমায় দিবি রে!

না বাবা।

সেখান থেকে ফিরে সেদিনকার রাণী ভূতেশ্বরীর সঙ্গে মোলাকাতের কথা মাকে বললাম। মা শুনে ভারী রাগ করলেন। কড়ে আঙুলটা কামড়ে দিলেন আমার। মনে মনে কী যেন আউড়ে সারা গায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

জানো মা, রাণী আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছিলেন। জানো মা, নানু বলছিল, ওর গলার হারটা দেবার জন্যই ডাকছিল আমাকে। আমরা নাকি ওর নিকটাত্মীয় হই?

খবরদার, ওই সব পোড়া বাড়ির দিকে পা বাড়াবিনে কোনদিন। পুনঃ পুনঃ মা সাবধান করে দিলেন আমায়।

সেদিন রাত্তিরে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটেছিল নাকি! মার মুখে শুনেছি।

রাত নটার মধ্যেই খাওদাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়তাম আমরা। মার রান্নার কোনো ঘনঘটা ছিল না। লুচি, আলুর তরকারি, আর ক্ষীর–এই ছিল রাত্রের খাবার। বাবা খেতেন অনেক রাত্তিরে–তাঁর জপধ্যান সব সেরে। তাঁর খাবার ঢাকা দেওয়া থাকত গোলঘরটায়।

শুতে না শুতেই সেদিন হাড় কাঁপিয়ে আমার জ্বর এসেছিল নাকি।

দেখতে না দেখতে সে জ্বর চড়ে গিয়েছিল বেজায়। রাত দুপুরে ঘোর বিকারে দাঁড়িয়ে গেল। সান্নিপাতিক সব লক্ষণ প্রকাশ পেতে লাগল তখন।

আর, সেই সময়েই শুরু হয়েছিল দারুণ ভুতুড়ে উপদ্রব। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে যে রকম বর্ণনা রয়েছে–হুম হাম দুম দাম্ অট্ট অট্ট হাসিছে। অবিকল সেই ধরনের সব।

আর, মা আমার পাশটিতে শুয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে মা কালীকে ডাকছেন।

ওকে ছেড়ে দে, ওকে ছেড়ে দে। ওকে আমি নিয়ে যাব। খোনা গলায় বলেছিল কে যেন।

না মা, তোমায় গড় করি। ওকে তুমি নিয়ো না। ওকে ছেড়ে দিয়ে যাও, তোমার দোহাই! মিনতি করছিলেন মা।

না। তা হয় না। ও আমাকে ভেংচি কেটেছে কেন? ছাড়ব না, ওকে নিয়ে যাবই। নিয়ে যেতেই আমি এসেছি। তুই ছেড়ে দে।

মা, তোমার পায়ে পড়ি। তোমাদের বাড়ির বউ আমি। ওর হয়ে আমি মাপ চাইছি–তবধ বালক, ওকে মাপ করো। এবারটির মত ছেড়ে দাও। ওর ঘাট হয়েছে মা।

ওকে না নিয়ে আমি যাব না। আজ রাত না পোয়াতেই নেব।

তখন মা কী করেন, আর কোনো উপায় না দেখে কালীঘাটের মা কালীর কাছে তাঁর ডান হাত বাঁধা রাখলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভূতুড়ে উৎপাত শান্ত হল, আমার জ্বর ছেড়ে গেল, সকাল বেলা যেন দুঃস্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম। সম্পূর্ণ বহালতবিয়তে।

রাতে যে আমাকে নিয়ে অত টানাপোড়েন চলেছিল তার বিন্দুমাত্রও আমি টের পাইনি। টের পেলাম সেদিন দুপুরে খেতে বসে।

আমি, মা আর আমার ভাই সত্য একসঙ্গে খেতে বসতাম সকাল সকাল। স্নান আহ্নিক সেরে বাবার খেতে বসতে দুপুর গড়িয়ে যেত।

মা বসেছেন আমার সামনেই। একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি অবাক হয়ে শুধিয়েছি মা, তুমি ডান হাতে না খেয়ে বাঁ হাতে ভাত খাচ্ছ কেন আজ?

যেই না বলা, অমনি মা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।

সেদিন আর মার খাওয়াই হল না। সারাদিনটা উপোস গেল। খেলেন সেই রাত্তিরে। ভাত আর মার পেটে পড়ল না সেদিন।

তখন জানলাম রাত্তিরের ব্যাপারটা। মার ডান হাত বাঁধা রাখার কথা। মা এখন থেকে বরাবর বাঁ হাতেই খাবেন-যদ্দিন না সেই কালীঘাটে গিয়ে মার মানতের পুজো দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। মার খাওয়া পণ্ড প্রথম আমার থেকেই হয়েছিল। অনেকদিন তিনি অমনি উপোস করে কাটিয়েছেন।

প্রথম পাণ্ডা আমি হলেও তার পরে আরো অনেকের হাতেই তাঁর খাওয়া পণ্ড হয়েছিল। শেষটায় পাড়াপড়শীরা কেউ এলে খেতেই বসতেন না মা। বাঁ হাতে খাওয়া দেখলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগত তাদের মনে, আর তার জবাবে সেদিনকার সে বেলার মতন খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত মার।

তারপর থেকে সাবধান হয়ে গেছেন মা। বাড়ির অতিথি-অভ্যাগতরা নিজ গুণে বিদায় না নেওয়া পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন তিনি। খেতেই বসতেন না। অনেকদিন পরে কলকাতায় এসে কালীঘাটে পুজো দিয়ে তারপর হাত খালাস করতে পেরেছিলেন মা।

মা ডান হাতে খাচ্ছেন, তখন সে আবার আমাদের কাছে আরেক অবাক করা দৃশ্য।…

একটা রহস্যের আজও আমি ঠিক থই পাইনি। মার সেই দিব্যদর্শন আর আমার ওই অত দেখাটার।

মনের ইচ্ছাপূরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়ত বা তার কিছু হদিশ মেলে। যেরকমটা স্বপ্নে দেখে থাকি, সেইরূপ চোখ মেলেও স্বপ্ন দেখা যায়-অবচেতনের প্রার্থিত বস্তু হাতে হাতে পেয়ে যাই তখন।

মনই তো বাঞ্ছা কল্পতরু-বাঞ্ছিত বস্তু মিলিয়ে দেয় আমাদের। সব কিছুর তত্ত্ব মনের গুহাতেই নিহিত। মনের গুণেই ধন মেলে, কখনো বা কল্পনার কল্পলোকে। কখনো অকল্পনীয় ভাবে জীবনের এই বাস্তবে।

মা রাতদিন মা কালীর কথাই ভাবতেন তো! তারপর দরদালানে জবা ফুলটা দেখে তার অনুষঙ্গে তাঁর ভাবনা ঐ ভাবমূর্তি ধারণ করেছিল। এক রকমের আত্ম-সম্মোহন আর কি!

আর আমার ব্যাপারটাও প্রায় তাই। ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতে ভূতপেত্নীর দর্শন মিলেই থাকে, লোকমুখে শুনে শুনে গল্পগাথায় পড়ে জানা। তাই সালঙ্কারা ভূতেশ্বরীকে দেখেছিলাম। কিন্তু রাত্তিরে সেই হঠাৎ জ্বর বিকার হওয়া আর মার মানত করার সাথে সাথেই তার বেপাত্তা হয়ে যাওয়া–এর মানে? এই জিজ্ঞাসার জবাব পাইনে।

অবশ্যি, শেষ পর্যন্ত মহামতি শেপীরের মত তাবৎ প্রশ্ন ভূয়োদশী উক্ত হোরেশিয়োর ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় বইকি!

যদিও মাঝে মাঝে আমার মনে হয় জীবনের যত ভূয়োদর্শনের সবটাই হয়ত ভুয়ে নয়।

.

০৭.

রিনিকে নিয়ে আমি প্রায় দিনই বেরিয়ে পড়তাম বিকেলে বেড়াতে। ইস্কুলের থেকে ফিরে দুপকেটে চিড়ে আর খেজুর গুড়ের পাটালি ভরে নিয়ে কুকুরডিঘির পাশ দিয়ে পাহাড়পুরের পথ ধরে চলে যেতাম একেকদিন। দুজনে মিলে চিড়ে গুড খেতে খেতে মজা করে। কোনোদিন বা আবার চষা ক্ষেতের আল পথ দিয়ে আলগোছে হাঁটতাম আবার আমরা। কোনোদিন নয়া দিঘির পাড়ে বসে থাকতাম, বসে বসে গল্প করতাম দুজনায়।

মাঠের মাঝখানে সেই যুঁই গাছটার তলায় গিয়ে বসতাম একেকদিন। যুঁই ফুল ছড়ানো কেমন গন্ধ জড়ানো জায়গাটা। সেখানে গেলে রিনির সব গল্প ফুরিয়ে যেত হঠাৎ। আমার কোলের ওপর মাথা রেখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভাবত সে, কে জানে! তার মুখের ওপর চোখ নামিয়ে কী দেখতাম আমি কী জানি!

সারা আকাশ রঙে ভাসিয়ে দুর দিয়ে সূর্য অস্ত যেত, আর যে সূর্যমুখী ফুল আ। চিনিনে, দেখিনি কখনো, কি রকম দেখতে কে জানে, আমার মনে হত তাই যেন ফুটে রয়েছে আমার কোলের উপরে।

কোনোদিন বিকেলে আমি ডাকতে যেতাম রিনিকে ওদের দিকটায়। কোনোদিন বা সে, আসত আমাদের এধারে। দুজনে খেতে খেতে হাঁটতাম, আর হাঁটতে হাঁটতে খেতাম। আসবার সময় হাত ধরাধরি করে ফিরতাম আমরা।

সেদিন রিনি ফেরার কালে আমার হাত না ধরে আমার কাঁধের ওপর হাত রেখে এল– ঠিক ছেলেদের মতই। ছেলেবন্ধুরা যেমন পাশাপাশি গলা জড়িয়ে যায় সেইরকই প্রায়। সত্যি বলতে এই জর্জর অবস্থাটা একটু কেমন কেমন ঠেকলেও তেমন আমার খুব মন্দ লাগছিল না।

রিনির মধ্যে ছেলেমানুষি তো ছিলই, ছেলেদের মতও খানিকটা যেন ছিল কীরকম। একাধারে ছেলে আর মেয়ে–এই কারণেই তাকে আমার ভালো লাগত আরো।

ওর চেহারাটাও ছিল যেমন ছেলে-ছেলে, ওর অনেক আচরণেও তেমনি ছেলেমি প্রকাশ পেত। ছেলেদের মেয়েলিপনা অসহনীয় বোধ হলেও মেয়েদের মধ্যে এই ছেলে ছেলে ভাবটা আনকোরা এক আকর্যণ মনে হয়।

ছেলেদের সঙ্গে ছেলেরা যেমন সহজে মেশে, রিনির সঙ্গে তেমনি অবলীলায় আমি মিশতে পারতাম। কোন কুণ্ঠা সঙ্কোচ ছিল না কোথাও।

সেদিন সারাটা পথ তার অকুণ্ঠ এই গলা জড়িয়ে আসাটা আকণ্ঠ আমার যেন অমৃতে ভরে দিল… মধু ঝরতে ঝরতে এল সারাক্ষণ। এমন কি, বাড়ি ফিরেও অনেকক্ষণ খালি কাঁধটাই আমার কাছে কালাকাদের মতন মিঠে ঠেকতে লাগলো।

বেড়িয়ে ফিরতে প্রায়ই সন্ধ্যে হয়ে যেত, তাই সোজা সে তার বাড়িতে চলে যেত আর আমি উপরে উঠে আসতাম।

সেদিন সে নিজের এলাকায় না গিয়ে আমার সঙ্গে উপরে এল।

তোমার পড়ার ঘরটা দেখব।

পড়ার ঘর বলে আলাদা কিছু নেই আমার। কয়েকটা বড় বড় হল তো। ঘর কোথায় আমাদের? ঘর আছে তোমাদের দিকটায়। ছোটখাট বেশ কয়েকখানা ঘর।

তাহলে তুমি পড়ো কোথায়?

শোবার ঘরেই পড়ি, আবার কোথায়? বাবার টেবিলে প্রকাণ্ড আয়নাটার সামনে গোল একটা কেদারা আছে, বেশ বড়ো কিন্তু বেজায় সেকেলে, সেইটেয় বসে টেবিলে বইপত্তর রেখে পড়াশুনা করি। দেখবে ল।

টেবিলের সামনে একটিমাত্র বড় কেদারায় আমরা ঘেষাঘেষি বসলাম। সে আমার বইখাতা হটকাতে লাগল।

ওমা! একী! কী লিখে রেখেছ সব?

কী লিখেছি! ওর সবিস্ময় শব্দে আমি সচকিত হই।

খাতা ভর্তি যা-তা কী লিখেছ সব? এ কী!

কী জানি। উদাসীনের মত বলি : হাতে কোনো কাজ থাকে না তখন কী করি, যা মনে আসে তাই লিখি।

তাই বলে পাতার পর পাতা জুড়ে খালি রিনি রিনি রিনি রিনি! এ কী! আমার নাম কেন? সে অবাক হয়। এত এত আমার নাম। কেন গো?

কে জানে কেন!

বারে! আর কী কোনো নাম ছিল না পৃথিবীতে? ঠাকুর দেবতার নাম লিখতে হয়। বাবা রোজ সকালে একপাতা করে দুর্গা নাম লেখেন। মা দুর্গার নাম। শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়, শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়। তার মানে বোঝা যায়। তোমার এ কী?

আমি তার কী জবাব দেবো? চুপ করে থাকি।

এ রকম লিখো না আর। কারো চোখে পড়লে কী ভাববে বল তো?

কী ভাববে আবার? ভাববার কী আছে!

ক্ষ্যাপা ভাববে তোমাকে।

এক মাঘে যেমন শীত যায় না, তেমনি এক ক্ষেপেও মানুষ পাগল হয় না কিন্তু তার কথার ঠিক জবাবটি আমি জানতুম কি তখন! খানিক চুপ থেকে বলি-ভাবুক গে। আমার বয়ে গেল।

সে আর কিছু বলে না।

কেন, তুই কি রাগ করলি আমার ওপর? আমি শুধাই : কালী দুর্গা না লিখে তোর নাম লিখে রেখেছি বলে?

সে কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে।

একটা অদ্ভুত নীরবতা যেন দেখা দেয় অকস্মাৎ।

অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে আমি স্তব্ধতাটা ভাঙি-দেখি তত তোমার ইংরেজী হাতের লেখা কেমন? লেখোত।

আমার খাতায় আমারই কপিং পেনসিলটা দিয়ে সে লেখে-ইউ আর এ ভেরী গুড বয়।

বাংলা লেখা দেখি এবার।

আমি তোমাকে ভালবাসি।

গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দেয়।

লিখে সে তার বড় বড় চোখ মেলে তাকায় আমার দিকে। আমিও তাকিয়ে থাকি।

চুপ করে তাকিয়ে থাকি পরস্পর অনেকক্ষণ।

আমার কপিং পেনসিলটা তার মুঠোর মধ্যে তখনো।

আমার পেনসিলটা তোকে প্রেজেন্ট দিলাম। ফর এভার।

সে কিছু না বলে পেনসিলটা মুঠোয় করে চলে গেল তারপরে।

একদিন বিকেলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও তার দেখা না পেয়ে তার বাড়িতে তাকে ডাকতে গেছি। দেখি তার মা তখন প্রকাণ্ড একখানা ভোয়ালেয় দেহ জড়িয়ে কুয়ো তলায় বিকেলের গা ঘোয়ায় লেগেছেন।

রিনি নেই মাসিমা?

কোথায় যেন বেড়াতে গেল তার দাদার সঙ্গে। নানু-টানু সবাই গেছে। তোমাদের ইস্কুলে কী ফাংশন হচ্ছে না আজ? ম্যাজিক না কী হচ্ছে যে বলল। তুমি যাওনি যে? যাওনি কেন?

রিনিকে নিয়ে একসঙ্গে মাঠঘাট চষে বেড়ানোর যে ম্যাজিক আমি রোজ দেখি তার কাছে কোনো ভেকিই কিছু নয়। কিন্তু সে কথা কি বলা যায়!

এমনি যাইনি। ওকে নিয়ে যাব ভাবছিলাম। নানুদের সঙ্গে চলে গেল? আমার গলায় দুঃখের সুর বেজে উঠল বুঝি।

ও বোধ হয় ভেবেছে ওখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে।…

আমি তাহলে যাই মাসিমা।

যাবে কেন? বোসো না। উনিও বাড়ি নেই, কোথায় রুগী দেখতে বেরিয়েছেন গাঁয়ে। বোসো ঐখেনে। নাইতে নাইতে গল্প করা যাবে তোমার সঙ্গে।

শিশি থেকে নিজের মাথায় তেলের মতন কী একটা জিনিস তিনি ঢাললেন ভিজে চুলের ওপর–এখানে বসে বসেই একটা ম্যাজিক দ্যাখো। কেমন? এই দ্যাখো না–এই তেলটা মাথায় দিলাম তো। দেখছো তো তেল? দেখতে না দেখতে এক্ষুনি সাবান বানিয়ে দিচ্ছি এটাকে–মন্ত্রের চোটে–চেয়ে দ্যাখো তুমি?

ওমা! সত্যিই তো! মাথায় একটুখানি ঘষতে না ঘষতেই সেটা সাবানের ফেনায় ফেনায় বদলে গেল–অবাক কাণ্ড! বিস্ময়ে থই পাই না।

একে বলে শাম্পু। শুনেছ এর নাম? না তো!

মাথায় সাবান দিলে–তার ভেতরে ক্ষার আছে তো? তার জন্যে চুল উঠে যায়। শাম্পু দিতে হয়। তুমি মাখবে?

না। ঘাড় নাড়ি আমি।–কি হবে মেখে?

মাথা হালকা হবে। চুল পরিষ্কার থাকবে। খুসকি-টুসকি হবে না মাথায়।

আমার নেই ওসব।

হতে কতক্ষণ! যা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া একমাথা চুল তোমার! ছাঁটো না কেন? ছাঁটবে।

আচ্ছা। ঘাড় নাড়লাম আবার।

মাথার শাপুর পর তিনি মুখে সাবান মাখলেন, তারপরে বললেন আমায়-পিঠের দিকটায় মাখিয়ে দাও তো আমার।

সাবানটা নিয়ে আমি তাঁর পিঠে মাখাতে লাগলাম।

ভালো করে মাখাও।

আমি জোরে জোরে ঘষতে লাগলাম।

এবার এদিকটায়।

আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি বুকের দিকে তোয়ালেটা সরিয়ে দিলেন এবার।

তবু আমি হাত বাড়াই না দেখে তিনি একটু হেসে বললেন–তোমার মনে পাপ ঢুকেছে দেখছি।

পাপের কথায় রাগ হয়ে গেল আমার। আমি চোখ কান বুজে জোরে জোরে সাবান ঘষতে লাগলাম।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর। পায়ে মাখাও এবার।

মাখাতে লাগলাম। কী সুন্দর সুগঠিত পা! অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতই। বাবা বলতেন, দেবীর স্তরে পা থেকে বন্দনা শুরু করতে হয়। সরস্বতীর বেলায় কে যেন তা করেনি, তাই তাঁর কোপে সে নাকি গাধা বনে গেছল। আমি তার মর্মটা তখন বুঝতে পারি।

এ কী! থামছ কেন? ওপর পর্যন্ত মাখাও। থেমে যাচ্ছ যে?

আমি তখন ওঁর কোমর অব্দি সাবান মাখাতে লাগি। হাঁটুর ওপরে আরো কী সুষমার রহস্য রয়েছে দেখার কৌতূহল যে না জেগেছিল তা নয়। তবুও কেমন একটা বাধ বাধ, ঠেকছিল বইকি।

আরো ওপরে। আরো।

আরো উপরে মাখাতে গিয়ে তাঁর পরনের তোয়ালে খসে পড়ে। তিনি মোটেই সামলাতে বান না।

আমি ঘাড় হেঁট করে থাকি।

থামলে কেন? মাখাবে তো।

ঘাড় গুঁজে ঘষতে থাকি সাবান।

সব জায়গায় লাগছে না যে। বাদ দিয়ে যাচ্ছ তুমি।

তারপর আমি আর কোন বাদবিসংবাদ রাখি না। ঘাড় হেঁট করে চালিয়ে যাই।

মাথা নীচু করে কেন? কোথায় মাখাচ্ছ দেখছ না? তাকাও ওপরে।

নিজেই তিনি দু হাত দিয়ে মাথাটা আমার তুলে ধরেন। প্রাণপণে আমি সাবান মাখাই। সামনে পিছনে সব জায়গাতেই।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন তারপর পা থেকে গলা অবধি বেশ করে রগড়ে দাও তো দেখি। ময়লা কেটে যাক।

রগড়াই বেশ করে। তলার থেকে গলা পর্যন্ত। দেবীর বন্দনায় কোনো অংশই বাদ যায় না।

ক্রমশই ভালো লাগতে থাকে।

এবার কুয়োর থেকে বালতি বালতি জল তুলে ঢালতে পারবে? কুয়োর ভেতরে পড়ে যাবে না তো তুলতে গিয়ে।

পড়ব কেন? এসব কাজ আমি খুব পারি। হাতে হাতে প্রমাণ দিয়ে দি।

কয়েক বালতি ঢালার পর তিনি শুকনো তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে বলেন-এসো এবার সাবান মাখিয়ে তোমার গা ধুইয়ে দি বেশ ভাল করে। কেমন? জামা কাপড় খুলে রাখো ঐখানটায়।

না।

না কেন? গা ধোও না বিকেলে?

না।

বিকেলেই তো নাইবার আরাম গো। নাও, জামা-টামা খোলো। খুলে রাখো ঐখেনে। একী, লজ্জা করছে নাকি খালি গা হতে?

না।

আমি এত বড় মেয়ে খালি গা হয়ে নাইতে পারলাম আর তুমি এইটুকু ছেলে-তোমার লজ্জা! এসো, লজ্জা কিসের? বেশ ভালো লাগবে তোমার।

না।

তখন তিনি গাটা মুছে শুকনো কাপড় পরতে লেগেছেন।

আমি এবার যাই মাসিমা।…দেখি গে, কী হচ্ছে ইস্কুলে।

আচ্ছা এসো। তারপর কী ভেবে বললেন ফেরকাল বিকেলে এসো আবার। কেমন?

তারপর রিনিদের বাড়ি যাইনি আমি। কোনো বিকেলেই যাইনি আর। ওর মার নাইবার সময় কখনই না।

বাধ-বাধ ঠেকত বলে যে, তা না। তাঁর দেহসুষমায় অভিভূত হলেও আমি তেমন কোনো আকর্ষণ বোধ করতাম না। কেমন যেন লাগত আমার।

সেই বয়সেই নগ্ন নারীদেহের মাধুরী দেখেছিলাম অনেক। আমাদের বাড়িতে বিনতি আর্টিস্টের আঁকা রঙীন ছবির অ্যালবাম ছিল বাবার–আমি দেখতাম। লুকিয়ে নয়, খোলাখুলিই। কোনো বাধা ছিল না। মা বাবা কিছু বলতেন না সেজন্যে। ভালোই লাগত দেখতে।

আমাদের বাড়ি ভারতী, সাহিত্য, প্রবাসী, ভারতবর্ষ আর মাসিক বসুমতি আসত। তার কোন কোনটায় বাঙালী মেয়ের নগ্ন দেহ দেখা যেত মাঝে মাঝে। শিল্পী টমাস, হেমেন মজুমদার আর ভবানী লাহার আঁকা সিক্তবসনা রূপসীদের দিকে আমি অপলক চোখে তাকিয়ে থেকেছি।

তবে পূর্ণযৌবনা সুন্দরীর রূপলাবণ্য হাতে হাতে পরখ করে দেখা আমার সেই প্রথম। সেই অল্প বয়সেই সৌন্দর্যবোধের শিক্ষাও আমার হয়ে গেছল।

তারপর রিনিদের বাড়ি আর না গেলেও সে-ই আসত আমার কাছে। বিকেলে বেড়ানোর বেলায় তো বটেই, অন্য সময়েও কোনো দরকার পড়লে চলে আসত সে।

তবে যেতে হলো আমায় তাদের বাড়ি সাত-সকালেই একদিন হঠাৎ।

বাবা কদিনের জন্যে কলকাতায় গেছলেন কী কাজে, ফিরেছিলেন আগের দিন রাত্তিরে। অনেক রাত তখন, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা।

কলকাতা থেকে নতুন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে এসেছিলেন বাবা আমাদের জন্যে। মা খুব ভালোবাসতেন নলেন গুড়ের সন্দেশ খেতে। কলকাতার মেয়েতো।

সকালে উঠে হাতমুখ ধুতেই না, মা দুটো বড়ো বড়ো তালশাস সন্দেশ খেতে দিলেন আমার। অমনি আমি সেই সন্দেশ হাতে করে ছুটেছি ওদের বাড়ি। রিনিকে ভাগ না দিয়ে খাওয়া যায়?

ওরা ভাইবোন মিলে তখন গুলতানি করছিল ওদের পড়ার ঘরে, আমি গিয়ে হাতের মুঠো খুলে রিনিকে দেখালাম-দ্যাখ, কি এনেছি তোর জন্যে।

তখুনি সে আমার হাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছে। দুটো সন্দেশই এক সঙ্গে।

ও মা! আমি যে একদম খাইনি রে এখনো।

বলতেই না, সে মুখ থেকে বার করে আমার হাতে নয়, পাখি-মা তার ছানাকে যেমন করে খাওয়ায়, তেমনি করে তার মুখের গ্রাসের খানিকটা আমার মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে। মুখের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে।

সেই প্রথম চুমো পাওয়া আমার জীবনে। সন্দেশের সঙ্গে মিশিয়ে চুমু খাওয়া সেই! প্রথম অমৃত আস্বাদের জন্যে রিনির কাছে আমি চিরঋনী।

প্রথম চুমু অমন করে সন্দেশের সঙ্গে মিশিয়ে পেয়েছিলাম বলেই কি ওই চুমু জিনিসটা এমন মিষ্টি থেকে গেল আমার কাছে চিরদিনই?

নাকি, চুমোর সঙ্গে মাখানো ছিল বলেই কি যতো মেঠাই এমন মিঠে লাগে আমার কাছে?

তাই কি আমি এমন সৃষ্টিছাড়া মিষ্টিশোর হয়ে গেলাম জন্মের মতই? কে জানে!

.

০৮.

সেদিন আমি ছাদেই ছিলাম বিকেলে। একটু বাদে রিনি এল।

কী! বেড়াতে বেরুবে না আজ?

না। ছাদে বসে বসে আজ কাঞ্চনজংঘা দেখব।

এখানে বসে কাঞ্চনজংঘা দেখা যায়? বসল সে।

হ্যাঁ, উত্তরের আকাশ পরিষ্কার থাকলে। আজ তাই আছে। সূর্যের আলো একটু কমে এলেই কাঞ্চনজংঘার ছটা দেখা দেবে। পাহাড়ের শৃঙ্গগুলো সারি সারি এমন সুন্দর দেখায় সারা উত্তর দিকটা জুড়ে কি বিরাট সমারোহ। বোস না আমার পাশে;খতে পাবি। দেখাব তোকে।

সে বসল বেশ কৌতূহল নিয়ে।

চিড়ে গুড নিয়ে আসি গে? খাওয়া যাবে। .

ও জিনিস কি ঘরে বসে বসে খাবার? বেড়াতে বেড়াতে খায়।

বেশ তো, বেড়িয়ে বেড়িয়েই খাওয়া যাক।

বেড়াবে কোথায়?

কেন, এই ছাদেই। কত বড় ছাদটা দেখেছিস। আমি রোজ সকালে উঠে এইখানেই বেড়াই তো। আমাদের এধার থেকে তোদের ওধার অব্দি বার আষ্টেক পাক খেলেই আধ মাইলটাক মনিং ওয়াক হয়ে যায়। এই ছাদেই। তুইও আসিস না তখন! বেড়িয়ে বেড়িয়ে পড়াও যাবে-পড়াও তৈরি হয় বেশ।

কি করে আসব বলো? আমাদের দিক থেকে ছাদে ওঠার কোন সিঁড়ি নেই যে!

একটা বাঁশের মই বানিয়ে দিতে পারি তোদের দিকে–মই বেয়ে তুই উঠতে পারবি?

সে কথার জবাব না দিয়ে সে বললে-কোথায় তোমার কাঞ্চনজংঘা? দেখাবে বললে যে!

দাঁড়া না, দেখবি। বোস না।

বসেই তো আছি। না, কাঞ্চনজংঘা আর দেখা দেবে না আজ। কেমন ধোঁয়াটে কুয়াশার মতন দেখছি যেন উত্তর দিকটা।

না দেখা দিক। তুই তো দেখা দিয়েছিস! তোকেই না হয় দেখব আজ। ভালো করে দেখব আরো।

দেখছই তো। আবার কী দেখবে আমায়!

এ দেখা নয়, ভালো করে দেখব তোকে। আমার সামনে খালি গা হবি?

দূর! তা আবার কেউ হয় নাকি?

সুন্দর মেয়েরা হয়। আর্টিস্টের সামনে হয়ে থাকে। দেখে দেখে তাদের ছবি আঁকে যে তারা। এমন সব খালি গায়ে মেয়েদের ছবি তোকে আমি দেখাতে পারি। বিলিতি অ্যালবামে আছে।

ও! সেই বিলেতেই হয়, এদেশে নয়। সে বলে।

এদেশেও হয়েছে। এদেশের আর্টিস্টরা ছবি এঁকে চিরদিনের মত ধরে রেখেছে তাদের। দেখতে চাস্?

না। দেখে কী হবে? দেখবার কী আছে ওতে?

দেখতে সুন্দর! দেখতে চমৎকার! দেখলে আনন্দ হয়। এই! আবার কী! আমি বলি-তোকেও সেই রকমটি আমি দেখতে চাই।

দেখে কী করবে? তুমি তো আর আঁকতে পারবে না।

মনের মধ্যে একে নেব–চিরকালের মতই।

দেখছ তো! অনেকখানিই দেখছ! মুখ দেখতে পাচ্ছ–কতটা পা দেখতে পাচ্ছ দ্যাখো। এই তো! এতখানি ফ্রকটা তুললাম…দ্যাখো না!

না আমি সবটা দেখতে চাই।

সবটাই তো দেখছ। আবার কী আছে দেখবার?

আরো সব। আমি বললাম-তুই দেখতে সুন্দর না? দেখতে ইচ্ছে করে না আমার?

আর কোনো মেয়েকে তুমি দেখেছ এমন খালি গায়ে?

আবার কে আছে দেখবার? আমি বলি, আবার কে সুন্দর আছে এখানে?

কেন, আমার দিদি! সে তো আমার চেয়ে অনেক সুন্দর।

মোটেই না। আমার কাছে নয়, আমার কাছে তুই-ই কেবল সুন্দর, তোকেই দেখতে চাই।

আমি যদি খালি গা হই তুমি দিদিকে বলে দেবে না তো?

পাগল! তা কি কেউ কাউকে বলে নাকি?

সে চুপ করে থাকে, কী যেন ভাবে।

ছাদে কেউ এসে পড়বে না তো হঠাৎ?

কে আসবে?

মাসিমা, কি তোমার ভাই?

মা তো জলখাবারের লুচি ভাজছেন এখন। আর সত্য? সে এখন নানুর সঙ্গে মার্বেল খেলছে উঠোনে।

তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না তো? ছোঁবে না তো আমায়?

কক্ষনো না। তুই সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকিস। খালি এক মিনিটের জন্যে কেবল। খুলবি আর পরবি।

সে ফ্রকটা খোলে। খুলে একটুখানি হাসে-হলো তো এবার?

বারে! কোথায় হলো?

তখন সে ইজেরটাও খুলল আস্তে আস্তে।

কয়েক মুহূর্ত না হতেই লাজুক চোখে তাকিয়ে বলল–পরি এবার?

পর। সত্যি, তুই ভারী সুন্দর। তোর মতন সুন্দর মেয়ে আর হয় না। আমি তো কখনো দেখিনি।

কটা মেয়ে তুমি দেখেছ! সে হেসে বলে-জীবনে কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখতে পাবে। আমার চেয়েও ঢের ঢের।…তখন তো ভুলে যাবে আমাকে।

কক্ষনো না। আর কোনো সুন্দর মেয়েকে আমি দেখব না। দেখতেই চাইনে আমি। তুই-ই আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর। তুই একমাত্র।

ফ্রক-টক পরে সে এক দৌড়ে চলে গেল। একটু পরেই ফিরে এল আবার।

কোথায় গেছেলিস?

দোতলায়। বাথরুমে।

তারপর সে আপনার থেকেই ফ্রক খুলল, ইজেরটা খুলে ফেলল আবার, না সাধতেই। আপনমনেই নাচতে শুরু করে দিল তারপর।

ছাদময় ঘুরে ঘুরে নাচল।

তুই এমন নাচতে শিখলি কোত্থেকে রে?

শান্তিনিকেতন থেকে। মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। থেকেছিলাম দিন কয়েক। দেখে দেখে শিখেছি। শান্তিনিকেতনের মেয়েরা নাচে সবাই।

তাই নাকি? আমি বললাম, বাঃ বেশ তো!

আর মেমরা কেমনতর নাচে জানো? ঠ্যাং তুলে তুলে এমনিধারা। কলকাতার সিনেমায় দেখেছি। কেন যে তার অমন ফুর্তি জাগল হঠাৎ কে জানে, ছাদময় খানিক ছুটোছুটি করে কার্নিশের ধার ঘেঁষে এমন করে সে দৌড়ে এল এক পাক যে, আমার বুকটা ধড়াস্ করে উঠল হঠাৎ-আটপকা নীচে পড়ে যেত যদি?

দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে কোলের ওপর বসে পড়ল সে। আমার মুখের মধ্যে তার মুখ গুঁজে রাখল।

তোর এত ফুর্তি যে হঠাৎ! আমি শুধাই-কেন রে?

এমনিই। তারপর একটুখানি চুপ করে থেকে–ভালো লাগল নাচতে তাই।

গান গাইতে পারিস নাকি?

হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ল সে–গাইব? বলে গুন গুন সুরে শুরু করল সে–দাঁড়িয়ে আছে তুমি আমার গানের ওপারে একটুখানি গেয়েই চুপ। বসে রইল চুপটি করে।

একদিন তোর পা থেকে মাথা অব্দি আমি চুমু খাব–বুঝলি?

খেয়ো।

হাজার হাজার।

আচ্ছা। কিন্তু পা থেকে কেন? পা কি চুমু খাবার জায়গা নাকি?

দেবতাদের পাবন্দনা করে আরম্ভ করতে হয় কিনা?

আমি দেবতা নাকি?

আমার কাছে তো।

আমিও তোমার পায়ে খাব তাহলে।

না। তা আমি খেতে দেবো না। একটুখানি থেমে বলি, ছেলেরা কেউ দেবতার মতন হলেও তাদের পাদবন্দনা করে শুরু করার নিয়ম নেই। তাদের মুখে খেলেই হয়।

খাবে পায়ে? সে তার ডান পা-খানা তুলল একটুখানি। পাখির ডানার মত।

আমি আলতো হাতে ধরে তার পায়ের পাতার ওপরে আমার চুমু রাখলাম।

তারপর কী হল যে, সে কান্নায় ভেঙে পড়ল কেন কে জানে! কোলের উপর বসে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে।

কী হল রে তোর? কাঁদছিস কেন?

কিছুতেই সে ঠাণ্ডা হয় না। কত আদর করলাম, ঠোঁট দিয়ে চোখ মুখ মুছিয়ে দিলাম ওর-বুও না।

একটু বাদে কান্না থামলে সে চোখ তুলে তাকালো উত্তর আকাশে দেখা গেল কাঞ্চনজংঘা? দেখেছিলে?

হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম।

আমি দেখতে পেলাম না। দুঃখের সুর বাজল তার স্বরে-দেখলে তো বললে না যে আমায়?

আকাশে দেখিনি। এই ছাদেই দেখেছি কাঞ্চনজংঘা।… আমি বলি–এখনো দেখছি।

অবাক চোখে তাকায় সে আমার দিকে–এখনো দেখছ

আমি বলি : কাঞ্চনজংঘার ছটা এখানে বসেই দেখছি এখন। এই তো!

দুষ্ট! লাজুক মুখে একটুখানি আদর করে উঠে পড়ল সে কোলের থেকে। ফ্রক-টক পরে মধুর হেসে চলে গেল তারপরে।

তারপরেও আমি বসে রইলাম অনেকক্ষণ সেই ছাদেই। অন্ধকার নামল, তারা উঠল। সারা আকাশ যেন তারায় তারায় রিনি রিনি করতে লাগল।

বিকেলে কিছু খাইনি তো, খিদে পেয়েছিল বেশ। লুচি আর বেগুন ভাজার গন্ধ আসছিল রান্নাঘর থেকে। ভাবলাম মার রান্নার একটুখানি বউনি করা যাক গিয়ে।

বউ নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল মা আর মাসিমার মধ্যে। দোর গোড়াতেই থমকে দাঁড়াতে

আসছে মাসেই দিদি আমরা চলে যাচ্ছি এখেন থেকে। বলছিলেন রিনির মা।

কেন দিদি, এখানকার জলহাওয়া কি সইছে না তোমাদের? মা বললেন।

তা নয়। মেয়েদের পড়াশোনা কিছু হচ্ছে না। কোনো মেয়ে-ইস্কুল নেই এখেনে। এখনকার কালে মুখ মেয়ে কি বিয়ের বাজারে চলে দিদি?

ইস্কুলের কোনো মাস্টারকে প্রাইভেট টিউটর রেখে দাও না কেন! বাড়িতে এসে পড়িয়ে যাবে মেয়েদের, ফাইনালের জন্যে তৈরি হোক বাড়ি বসে। তারপর কলকাতায় গিয়ে প্রাইভেট পরীক্ষা দেবেখন। তারপর মা অনুযোগ করলেন আবার : আর তাছাড়া, তোমার মেয়েরা তো দেখতে ভালোই। তেমন কিছু লেখাপড়া না জানলেও বেশ ভালো ঘরে বিয়ে হবে দেখো।

সেই বিয়ের কথাটাই ভাবছি দিদি। মেয়েরা সব ডাগর হয়েছে। নানু তত বলতে গেলে বিয়ের যুগ্যিই, ষোলো পেরুলল। তার ছোটটাও পনেরয় পড়েছে, রিনিও চোদ্দয় পা দিল। কলকাতায় আমাদের বাড়িঘর ইষ্টিকুটুম সবাই-এখানে বসে কি বিয়ের সম্বন্ধ করা যাবে।

এটা ভাবনার বিষয় ছিল বোধহয়, কেননা মাকেও একটু ভাবিত দেখা গেল।–তা বটে। নানুর বিয়েটা দিতেই হবে এবার। কিন্তু তোমার এই মেজো মেয়েটিকে আমার পছন্দ, ভারী ঠাণ্ডা মেয়েটি। বেশ লক্ষ্মীশ্রী।…

মেজো মেয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই, মায়ের পাশটিতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কথাটায় মাথা নীচু করল দেখলাম।

মা তার চিবুকে হাত দিয়ে আদর করলেন–বেশ মেয়েটি। রামের সঙ্গে বেশ মানাবে। এটিকে তুমি দেবে আমায়?

তা নিয়ো না হয়। কিন্তু রামের প্রায় সমবয়সী হবে না? অবশ্যি আজকাল কেউ বয়স নিয়ে মাথা ঘামায় না আর। জাত কুল নিয়েই বাছ-বিচার করে না শুনছি।

তা তোমরা কি আসছে মাসেই যাচ্ছ তাহলে? সব ঠিক? প্রায় ঠিক। কর্তা এক মাসের নোটিশ দিয়েছেন–এখান থেকে এখন ছাড়ান পেলেই হয়। কর্তা এর পরে বাড়ি বসে প্র্যাকটিস করবেন ঠিক করেছেন। তোমরা কলকাতায় কখনো এলে আমাদের বাড়ি এসো কিন্তু দিদি?

হ্যাঁ, একবার তো যেতেই হবে কলকাতায়–এই হাতের মানতটা ছাড়াতে হবে আমাকে।

আচ্ছা আসি দিদি, হ্যাঁ, যেজন্যে এসেছিলাম-কাল সকালে দশটার মধ্যে রাম ও সত্যকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে মনে করে, কেমন?

কেন দিদি?

কাল ভাইফোঁটার দিন না? আহা, ওদের কোনো বোন নেই কী দুঃখু! নিজের দাদার সঙ্গে ওদেরকেও ফোঁটা দেবে মেয়েরা। ভাই-ই তো ওরা।

আচ্ছা, দেবো পাঠিয়ে। হাসিমুখে মা বললেন।

আমাদের রান্নাঘর আর ভাড়ার ঘরটাই ছিল দুতরফের সীমান্ত প্রদেশ।

মাঝখানের একটা দরজার খিল খুলে যাতায়াত করা যেত। দু বাড়ির গিন্নিরাই ঐ পথে যেতেন আসতেন-আমরা ও-পথ কোনোদিন ব্যবহার করতাম না।

রান্নাঘর দিয়ে রিনির মা সেই পথেই চলে গেলেন।

শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আকাশ-পাতাল।

মেজোটার সঙ্গে বিয়ে কেন? রিনির সঙ্গে হলে কী হয়? কেন, রিনির সঙ্গে কি হতে পারে না আমার বিয়ে? সে তো বয়সে ছোটই আমার চেয়ে…ওর মেজদির চেয়ে কি খুব খারাপ মানাবে তাহলে?

না, মেজোকে কোনোদিন আমার চোখে লাগেনি। মনেও লাগেনি কোনোদিন। ওর সঙ্গে বিয়ে কী! ধ্যুৎ!

করলে আমি রিনিকেই বিয়ে করব। সুবিধে মত মাকে বলতে হবে একদিন… ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি।

ঘুম থেকে তুলে খাওয়াতে হয়েছে আমায়।–কিরে, তোর পড়াশুনা কিছু নেই আজ? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটালি সন্ধ্যে বেলাটা। দেখি গা-টা…গা তো গরম হয়নি, ভালোই আছিস তো, ঘুমুচ্ছিলি কেন তবে?

এমনি। ভালো লাগছিল না।

নে, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড় তাহলে। নটা বাজে প্রায়…

খেয়েদেয়ে নটায় শুয়ে উঠলাম পরদিন সকাল নটায়। শুনলাম সত্য কখন গিয়ে ফোঁটা নিয়ে ফিরে এসেছে। ঘুমুচ্ছিলুম বলে আমাকে ভোলা হয়নি। মুখ ধুয়েই চলে গেলাম সটান।

দেখলাম, আসন পাতা। আসনের সামনে পায়েস পিঠে সন্দেশ সব সাজানো। ধান দূর্বা, চন্দন সব তৈরি।

তার আগে জীবনে কোনো বোনের ফোঁটা পাইনি। বেশ লাগছিল কিন্তু, সত্য-টত্য সবার, ফোঁটা হয়ে গেছে আগেভাগেই। আমার বাকী কেবল।

প্রথমে নানু আমায় ফোঁটা দিল কোনরকমে মন্তর আউড়ে। ওর মা বললেন, রামকে একটু আদর কর। রাম তোর ছোেট না? ছোট ভাইয়ের মতই।

আদর আবার কী! বলে সে আলতো হাতের এক চাপড় বসিয়ে দিল আমার ঘাড়ে এই তো আদর।

তারপর মেজোর পালা। না, সে ফোঁটা দেবে না কিছুতেই কাল আমার মা কী বলেছেন না? সেইজন্যেই।

রিনি, তোর রামদাকে ফোঁটা দে এবার। বললেন মাসিমা।

রিনি, ফোঁটা দিল তার পর। বেশ স্পষ্ট করে মরটা পড়ল-যমের দুয়োরে কাঁটা দেওয়া পর্যন্ত বাদ দিল না কিছুই। ফোঁটা দিয়ে আমার পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল তার পর।

জীবনে সেই প্রথম আমি প্রণাম পেলাম একজনের। বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সত্যিই যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম পরে আরেকবার যেবার আমার উত্তর কৈশোরে একজন প্রায়-যুবকের কাছ থেকে আপনি বলে সোধিত হতে শুনেছিলাম। কিন্তু ওটা যেন আর চেয়েও আরো বেশি মিষ্টি-আপনির চেয়েও আরও যেন আপনার।

ভাবছিলাম, মাসিমা ওকেও হয়ত একটু আদর করতে বলবেন আমাকে।কেন জানি না, তা বললেন না কিন্তু। পাছে সে আমার অন্য ঘাড়ে আরেক থাপ্পড় ঝাড়ে সেই ভয়েই হয়ত

কিন্তু আমি জানি, বললে পরে সেদিনকার সেই সন্দেশ খাওয়ানোর মই সে করে বসত আবার–সবার সামনেই।

যা, আদর না পাই, দাদার প্রাপ্য প্রণাম পেয়েছি তো!

.

০৯.

আমার জীবনে তুই একমাত্র মেয়ে। তুই প্রথম আর তুই-ই শেষ। তোকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে আমি জানি না, জানতে চাই না।

সেদিন ছাদের বুকে বসে কিশোরী রিনিকে বুকের কাছাকাছি পেয়ে কিশোর আমার একথা বলতে এতটুকু বাধেনি। উপন্যাসের নায়কের মতই উপস্থিত কথায় তুখোড় হয়ে উঠেছিলাম আমি সেই ঐচোড় বয়সেই–অল্প বয়েস থেকে উপন্যাস পড়ে পড়েই হয়ত আমার এই উপযুক্ত হওয়া। কিংবা হয়ত ভালোবাসায় পড়লে সহজেই এমন সব উপলব্ধি ঘটে, যাতে মজবুত কথার যুতসই জবাব যতো মুখের ওপর আপনার থেকেই এসে যায়।

খুব ছোটর থেকে নভেল পড়ে পড়ে পেকে উঠেছিলাম। প্রায় কায়মনোবাক্যে পরিপক্ক। কায়ের দিক থেকে ততটা হয়ত না হলেও মনোবাক্যে তো বটেই। পাকা পাকা কথা কইতে পারতাম বেশ।

আর মেয়েদের তো এমনিতেই কথার বাঁধুনি। স্বভাবতই তারা নভেলটি–সর্বদাই।কোনো রোমান্স কাহিনী না পড়েও তারা বোরামান্টিক। আজন্ম নায়িকা। মুহুর্মুহু রোমাঞ্চকর।

তাই সহজেই সে বলতে পেরেছিল, এই তো তোমার জীবনের শুরু গো! আমার পরেও আরও কত মেয়ে পাবে, কতজনাই তোমার জীবনে আসবে–তখন তুমি অনায়াসেই ভুলে যাবে আমায়। দেখে নিয়ে। এই সামান্য বয়সেই নারীসুলভ অসামান্যতার দুঃস্বাভাবিক নৈপুণ্যে জীবনের এত বড় তত্ত্ব দুকথায় ব্যক্ত করতে একটুও তার বাধেনি।

সটান আমার উপন্যাসপাঠের ভূমিকায় আসতে হয় এবার…

সেকালের সব ছেলের মতন আমারও গ্রাম্য পাঠশালায় বাল্যপাঠ শুরু। এখনকার মতন অলিগলিতে কে জি ইস্কুলের পত্তন হয়নি তখন, গগ্রামে তো নয়ই; গেয়ো পণ্ডিতের আটচালায় গিয়ে লেখাপড়া শিখতে হত সবাইকে।

অবশ্যি, তখনো হাইস্কুল হয়েছিল দেশ পাড়াগাঁয়। চাঁচোরের রানী সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউশন ছিল কাছেপিঠেই। এবং ইনফ্যান্ট ক্লাসও নিশ্চয়ই ছিল সেখানে, কিন্তু রামনাথ পণ্ডিতের কাছে নামতার পাঠ না নিয়ে এক পা-ও সেখানে এগুনো যেত না। যুগপৎ গলায় আর চোখে ধারাপাত ঘটিয়ে, সমবেত কণ্ঠে শোরগোল করে গড় আউড়ে গড়াতে গড়াতে তবেই ছিল সেই ধারাবাহিক শিক্ষায়তনের পথে পা বাড়ানো।

প্রথম ভাগের হাতেখড়ি মার কাছে হলেও শিক্ষালাভের প্রথম ভাগ্য আমার রামনাথ পণ্ডিতের কাছেই। গ্রামের সেই পাঠশালার পড়ুয়া হয়েই সেকালের প্রায় সবার মতই আমারও পাঠ্যাবস্থার শুরু।

আর, পাঠশালায় যেতে এমন খারাপ লাগত আমার যে…

একটা যাওয়াই ছিল বটে সেটা। রাজোচিত সমারোহে যাওয়া। পালকি চেপে নয়, পালকি সেজে। পালকির মত দুলকি চালে হেলে দুলে হেইয়ো হেইয়ো করে হট্টগোলের মধ্যে পণ্ডিতমশায়ের আটচালায় আমার প্রবেশলাভ। বলতে গেলে প্রায় প্রত্যহই।

পাঠশালার সময়টা প্রায় প্রতিদিনই খুঁজে পাওয়া দায় ছিল আমাকে। এ ঘরে ও ঘরে, ছাদের ওপরে চিলেকোঠায় কি পায়খানায়, কোথাও আমায় খুঁজে পাওয়া যেত না। শেষটায় পাঠশালার সর্দার পোড়োরা এসে আশ্চর্য অনুসন্ধিৎসায় খাটের তলার থেকে ঠিক খুঁজে বার করতে আমাকে–তারপর সগৌরবে, আমি পায় পায় এগুতে চাইলেও নাছোড়বান্দা তারা আমায় পদস্থ হতে দিত না, অপদস্থ করে সবাই মিলে আমার চার হাত পা পাকড়ে চ্যাং দোলায় দুলিয়ে নিয়ে যেত। অসহায়ভাবে আমতা আমতা করতে করতে ঝুলে ঝুলে যেতে হতো আমায় নামতার ইস্কুলে।

সেই পঠদ্দশার কথা স্মরণে এলে পাঁঠার দশার কথাই মনে পড়ে আমার। মাঠের থেকে বাড়ি ফিরতে অনিচ্ছুক পাঠাকে গায়ের চ্যাংড়ারা যেমন করে চার পা ধরে দখিন হাওয়ার মতই দোদুল দোলায় দুলিয়ে নিয়ে যেত, ব্যা-ব্যা- করা সেই পাঠার মতই তেমনি হত পা ছুঁড়ে প্রাত্যহিক দোলযাত্রার মহোৎসবের মধ্য দিয়ে পাঠশালার পৈঠা পেরিয়ে একদা ইস্কুলের আলাদা ব্যাকরণে গিয়ে পড়লাম।

তবে ঐ সিদ্ধেশ্বরী ইস্কুলে সিদ্ধিলাভের পথে এগিয়ে যেতে কেবল পা ছোঁড়াই নয়, আমার হাত সাফাইও একটু ছিল। তারই সাফল্য আমার হাতে হাতে ফললো।

নামতা ওগড়াতে একদিন একটু গড়বড় করায় পণ্ডিতমশাই কষে কান মলে দিয়েছিলেন। আমিও দ্বিরুক্তি না করে, হাত বাড়িয়ে তক্ষুনি তাঁর কান মলে দিয়েছি। কানের ব্যথার চেয়েও অপমানে আমার বেশি লেগেছিল।

ছিপ্‌টিখানা নিয়ে আয় তো! হুকুম দিলেন তিনি একটি ছেলেকে।

ছিটিহস্তে পণ্ডিতমশায়ের সেই রুদ্রমূর্তি কদাচ আমি ভুলব না। এখন আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কখনো কখনো সেই চেহারা ভেসে ওঠে। ছিপটি দিয়ে অকাতরে ছেলেদের পিঠের ছাল ছাড়াতে কোনোদিন আমি তাঁর কোনো কসুর দেখিনি, কিন্তু কেন জানি না, আমার পিঠকে তাঁর সামনে অনাবৃত পেয়েও পিটতে গিয়ে তিনি হাত গুটিয়ে নিলেন হঠাৎ।

না, মারব না আমি তোমায়। তোমার বাবাকে বলে মার খাওয়াবো। রাজবাড়ির ছেলে বলেই তুমি বেঁচে গেলে আজকে। নইলে তোমার পিঠের ছাল আমি ছাড়িয়ে নিতুম। তোমার বাবাও সেইরকম করতে বলে দিয়েছিলেন আমায়।

হ্যাঁ, বলেছিলেন বটে বাবা। পাঠশালায় ভর্তি করার সময় বলে দিয়েছিলেন, পণ্ডিতমশায়, আমার ছেলের মাংস আপনার, হাড় আমার। আর সব ছেলের মতই বিধিমত আপনি একে পড়াবেন। কোনো কার্পণ্য করবেন না।

না, কার্পণ্য তিনি করতেন না। ছেলেদের পিঠে ছিপটি প্রয়োগে তাঁর কিপটেপনা কখনো আমি দেখিনি, আগাপাশতলা পিটিয়ে রক্ত বার করে ছাড়তেন। পণ্ডিত হলে রামনাথ মাত্রই বুনো হয় কি না কে জানে, কিন্তু পণ্ডিতের মধ্যে বন্যতায় তিনি ছিলেন অনন্য।

তবুও আমার বেলায় তাঁর এই অন্যথার মূলে বোধ হয় আমাদের সেই পুরনো পোড় বাড়িটা। সেই ভাঙ্গা রাজবাড়িটাই বদাচরণের বদলে তাঁর এই বদান্যতার কারণ হয়েছিল, নইলে বাবার কথাই ছিল তাই, পণ্ডিতমশাই যা বলেছেন, আমার মাংস তাঁর আর হাড় আমার বাবার। মানে, বিদ্যালাভের খাতিরে মারের চোটে আমার দেহের চামড়া খানিকটা ছিঁড়ে গেলেও ক্ষতি নেই, মাংস যায় যাক্, নামমাত্র হাড় কখানা বজায় রেখে প্রাণে প্রাণে নিজের ছেলেকে ফিরে পেলেই তিনি খুশী।

শেলেট বই সেখানেই ফেলে দিয়ে হাড়ে হাড়ে শিক্ষা নিয়ে, কিংবা না নিয়েই, আমি ফিরলাম।

আর কখনো আমায় যেতে হয়নি সেই পাঠশালায়।

আমার ভাইকেও আর পা বাড়াতে হয়নি সে পথে।

সেদিনকার কুরুক্ষেত্রে আমার কর্ণবধের পর্ব পণ্ডিতমশায়ের কাছে শুনেও বা কিছু বলেননি আমায়। বাড়িতেও তুলকালাম কিছু হয়নি। মা বলেছিলেন, পাঠশালায় গিয়ে আর কাজ নেই ওদের। আমার কাছেই পড়বে ওরা। ভারী তো পড়ানো।

বাবাও সায় দিয়েছিলেন তাঁর কথায়-বেশ, তোর মার কাছেই পড়বি তোরা দু ভাই এবার থেকে বাড়িতেই তোদের ইস্কুল।

ভালোই হলো আমার। এতদিনের যেন অকূল জ্ঞানসমুদ্রের কিনারা পেলাম। পড়াশোনার ইস্কুল পেলাম বাড়িতেই।

জীবদ্দশার প্রথম ভাগটাই পঠদ্দশা। অবশ্য, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি, কখনো হাতী কখনো মশা হয়ে মানুষের দশ দশার মধ্যে শিক্ষণীয় দিকটা তো থাকেই। যেমন প্রথম ভাগেরই হাতে খড়ি হয়েছিল মার কাছেই–দ্বিতীয় ভাগ্যও খুলল আমার মার হাতে। অ আ ক খ-র অক্ষর পরিচয়ের মতন ফাস্ট বুকের বর্ণজ্ঞানও পেলাম মার কাছে। বি এ ডি ব্যাড, সি এ ডি ক্যাড, ডি এ ডি ড্যাড পেরিয়ে শনৈঃ শনৈঃ ওয়ান মরু আই মেট এ লেম ম্যান ইন এ লেন পর্যন্ত অবলীলায় উতরে গেলাম।

আরো নানান দিকে লেনদেন হতে লাগল। বাড়তে লাগল এলেম। পিতৃদেবের বিপুল পাঠাগারের দিকেও আমার হাত বাড়ালাম ক্রমশ।

সেখানে থরে থরে যত গ্রন্থাবলী সাজানো ছিল–বসুমতী আর হিতবাদী সংস্করণের। আর মরক্কো বাঁধাই হয়ে কত না মাসিকপত্র। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, সাধনা ইত্যাদি থেকে শারীরতত্ত্বের স্বাস্থ্য সমাচার, এমনকি শিশুদের পত্রিকা সন্দেশ পর্যন্ত। তাছাড়াও কতো রকমের বই যে! ম্যাটসিনি গ্যারিবডির জীবন-চরিত থেকে রেনল্ডসের লন্ডন রহস্যের বঙ্গানুবাদ অব্দি কিছুই বাদ ছিল না।

ছিলো মাসিক সাহিত্য, ভারতী, নব্যভারত। মানসী ও মর্মবাণী, আরো কতো যে পুঁথিপত্তর কী জানি! তন্ত্রমন্ত্রের বই-ই কত না।

সব কিছুই আমার হাতের নাগালে এসে গেল। আর, নাগালে আসইে না গালে। সন্দেশের মতই গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম-নির্বিচারে, কোনো বাদবিচার না করে। এদিকে বাবা-মার কাছ থেকে কোনো বাধা ছিল না।

আরব্য উপন্যাস পারস্য উপন্যাস ছাড়াও আরো কত কী উপ-অনুপ-অপ-কথা ছিল আমাদের বাড়িতে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারতও ছিল, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দরের সঙ্গে পদাবলী সাহিত্যও। কালীপ্রসন্ন সিংহের বিরাটকায় মহাভারত, ড্রপ পেল্লায় আকারের সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম-কালক্রমে সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর দম্ভফুট করেছিলাম–দাঁত বসাতে পারি আর নাই পারি।

সেই সঙ্গে বটতলা বাজারের যত রাজ্যের অপকথার বই। খুনীকে খুন থেকে শুরু করে হরিদাস আর হরিদাসীর গুপ্তকথা। আর কী চমৎকার সব পাঁচকড়ি দে-র গোয়েন্দা কাহিনী আর প্রিয়নাথ দারোগার দপ্তর।

বাবা কালী সিংহীর মহাভারত পড়তে বলতেন বার বার কিন্তু বারংবার প্রয়াসেও সেই বাড়াবাড়ির মধ্যে নাক গলাতে পারিনি। পড়লে বোধ হয় মানুষ হতাম। অথচ মার মুখে আরব্য রজনীর কুজ দর্জির গল্পটা শুনেই না, না বলতেই আরব্য উপন্যাসের আগাগোড়া পড়ে শেষ করেছি। আরব্য রজনীর থেকে বঙ্কিমের রাজসিংহ, রজনীতে ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে গিয়েছি একাদিক্রমে।

প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়েই পড়েছিলাম-বর্ণপরিচয় হতেই না–দেবী চৌধুরানী শুরু করে দিলাম। বঙ্কিমের ওই বইটির প্রথম, আমার মনে আছে বেশ।

তার কারণ আর কিছুই নয়। ঐ সন্দেশ।

বইটার প্রথম লাইনেই, পি-পি-প্রফুল্ল মুখপুড়ি বলে ডেকে নয়ান বউ না কে, তার সতীনের পোড়ারমুখে যখন মিষ্টি খুঁজে দিল, এমন মিঠে লাগল যে গল্পটা! বউয়ের পা টেপার ব্রজ-র সেই পদব্রজের অংশটাও মন্দ লাগেনি। বারবার ঐ পরিচ্ছেদ দুটো পড়া আমার সারা শৈশবেই। তারপর রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, বিষবৃক্ষ পার হয়ে গেল, ন্দ্রশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইল পাঠ করলাম, কমলাকান্তের দপ্তরও বাদ গেল না। বাবার নির্দেশে কৃষ্ণচ্চরিত্রও পড়ে ফেললাম, মন্দ লাগেনি। আনন্দমঠ পড়ে দস্তুর মতন আনন্দ পেয়েছি। তবে আমার সবচেয়ে মধুর লেগেছে কমলাকান্তের দপ্তর বাদে লোকরহস্য আর মুচিরাম গুড়। এমন মিঠে আর হয় না। প্রায় পাটালি গুড়ের মতই-হ্যাঁ।

আমি তো প্রথম ভাগ খতম করে দ্বিতীয় ভাগের শেষে বঙ্কিমবাবুর গ্রন্থাবলী নিয়ে পড়েছিলাম, আমার ভাই সত্য আবার আমার চাইতেও সরেস। সে অক্ষর পরিচয় সেরেই রমেশচন্দ্রের গ্রন্থাবলী নিয়ে পড়ল, মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত থেকে রাজপুত জীবনসন্ধ্যা পর্যন্ত কেটে গেল তার দেখতে না দেখতেই। তারপরে আমরা দু ভাই পাল্লা দিয়ে বাবার পাঠাগার ফাঁক করতে লাগলাম।

লোকরহস্য থেকে লন্ডনরহস্য হয়ে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্যলহরী অব্দি কোনো কিছুরই রহস্যভেদের বাকী রইল না আমার।

যখন আমাদের অক্ষরপরিচয় হয়নি, মা আমাদের সন্দেশের গল্প আর ছড়া পড়ে শোনাতেন। পুরানো সন্দেশের একটি ছড়ায় তিনি হেসে গড়ানে কতত বার যে।–ওগো রাঁধুনি, শোনো গো শোনন, তোমায় রান্না বলে দি শোনো। সুখলতা রাওয়ের লেখাই হবে বোধ করি ছড়াটা-আস্ত মুড়োটা ভাতে-তে ছেড়েছি, মন্দ হয় নি জেনো-রাঁধুনীর এই মজাদার জবাবটি পর্যন্ত তিনি হাসতে হাসতে গড়িয়ে যেতেন। ওটা আউড়ে তিনি যেমন মজা পেনে, শুনে তেমনি আমোদ লাগত আমাদেরও।

আর মজা পেতাম অঙ্গদরায়রারে। মা যখন সুর করে কৃত্তিবাসী রামায়ণের সাতকাণ্ডের সবচেয়ে চমৎকার ঐ ল্যাজের কাণ্ডটি পড়তেন কী ফুতিই যে হতো না।

রাবণের রাজ্যে গিয়ে বালীনন্দন অঙ্গদ, রাজসভায় রাজপুত্রের উপযুক্ত অভ্যর্থনা আসন না পেয়ে নিজের লেজের কুণ্ডলী করে পাকিয়ে তার ওপরে বসেছে, তার পরে সেই উচ্চাসনে বসে রাজ্যির রাবণের মুখোমুখি হয়ে কোটি যে সত্যিকার রাবণ তার ঠাওর পাচ্ছে না, আর রাবণের ছেলে ইন্দ্রজিতকে তার আসল বাপটকে চিনিয়ে দেবার জন্য সাধছে–

শোন্ রে ইন্দ্রজিতা,
এত বাপের মধ্যে রে তোর কোনটি আসল পিতা?…
বলতে পারিস কে যে?
মোর বাপ তোর কোন বাপেরে বেঁধেছিল লেজে?

তখন অঙ্গদের তেজস্বিতা আর বালির লেজস্বিতায় আমরা দু ভাই চমৎকৃত হয়ে যেতাম যুগপৎ।

রামায়ণ সন্দেশের ওই ছড়াছড়িতে আকৃষ্ট হয়েই আমরা অক্ষর পরিচয়ের প্রথম পাঠে প্রলুব্ধ হয়েছিলাম, আর প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ কষ্টেসৃষ্টে পার হয়েই একেবারে বাংলা সাহিত্যের উপাখ্যান ভাগে এগিয়ে গেলাম-বটতলার থেকে শুরু করে বসুমতীর তাবৎ বইয়ের হরিহরছত্রে ভিড়ে বিদ্যাসাগরের বর্ণবোধ ক্রমে নানান বোধের আস্বাদ নিয়ে একদিন বিদ্যাসুন্দরের গভীরে গিয়ে পড়ল। সাগরযাত্রা শেষ হলো মহবোধির-সুন্দর বিদ্যার সাগরসঙ্গমে।

কিন্তু এ-যাত্রা কি কোনোদিন শেষ হবার?…পালাবদলে পা চালানো বইতো নয়।

.

১০.

বাবাকে একদিন আমি শুধিয়েছিলাম–এত এত বই যে বাবা! কেন তুমি এনেছিলে? এনে এমন করে সাজিয়ে রেখেছিলে কেন?

তুই আসবি বলে–এসে পড়বি বলেই! তোদের জন্যেই তো! বলেছিলেন তিনি।

কেমন করে তুমি টের পেলে বাবা যে, আমরা আসব? তখনও তো কেউ আসিনি আমরা? জানলে তুমি কি করে?

জানা যায়।

নির্লিপ্তের ন্যায় এক কথায় সেরে দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু এখন আমি জানি তাঁর কথাটা সত্যি কতখানি। সত্যিই জানা যায়–আর কারো না তাঁরই খেলা এসব। অমিয়-চরিত কথায়, যেমন, যিনি মেলাবার তিনিই মেলান, যথাসময়ে যথাযথ মিলিয়ে থাকেন। যা মিলবার আপনার থেকেই অঙ্ক আর কবিতার মতই কেমন করে, কি করে যেন মিলে যায়-অসম্ভব মিলন কাণ্ডের পাণ্ডা সেই তিনিই তো!

একদা আমার মতন অর্বাচীন এক বালকের সঙ্গে মেলার জন্যেই এই বইয়ের মেলা! এত মেলাই বই!

তিনি জানতেন, সারা জীবন নিজের লেখার মোট ফেলতে আর মজুরি কুড়োতেই আমার দিনরাত কাটবে, পড়ার ফুরসৎ আর হবে না কোনদিন, লেখাপড়া অদৃষ্টে নেই আমার–তাই কৈশোরকালের এই ফাঁকতালে তাক মাফিক এক-আধটু আমার পড়াশোনার এহেন ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।

মোটামুটি যা কিছু জানবার শেখবার তখনই আমি শিখেছি ও জেনেছি। বাবার ঐসব বই পড়েই।

পণ্ডিত হবার পক্ষে এমন কিছু না হলেও একজন মেহনতি মজদুরের পক্ষে, আমার ধারণায়, এই যথেষ্ট। এর বেশি পড়াশোনার দরকার করে না।

মা অবশ্যি বলতেন, বই পড়ে কিছুই জানা যায় না, মন দিয়ে জানতে হয়। চোখে দেখে, পরখ করে তবেই আমরা টের পাই। এর ভেতর ওই মনটাই আসল। মন না দিলে কিছুই ঠিক দেখা যায় না বোঝা যায় না। এমন কি ওই বইও যদি মন দিয়ে না পড়ি তো ওর মর্ম মেলে না আদপেই।

তবে ছেলেরা যে এত পড়ে-পড়ে পড়ে মুখস্থ করে মনে রাখে, তার মানে কী মা? আমি শুধিয়েছি। কত বড় বড় লোককেও তো বই মুখে পড়ে থাকতে দেখেছি আমি দিনরাত। পড়ে যায়, খালি পড়ে যায়।

না বুঝে পড়ার সবটাই বোঝা হয়ে থাকে তাদের মাথায়, বলেছেন মা : কখনই মনের সঙ্গে মিলিয়ে যায় না। জীবনের সঙ্গে মেশে না। জীবনের সঙ্গে মেলে না। সে পড়া শুধু ভার হয়ে থাকে ঘাড়ের ওপর, কাজে লাগানো যায় না কখনো, খাটানো যায় না নিজের জীবনে। যে বিদ্যা জীবন হয়ে ওঠে না, জীবন্ত হয় না, সে আবার কী বিদ্যা রে?

মার কথার মানে সেদিন আমি বুঝিনি, এখনো যে তার অর্থ ঠিক ঠাওর হয় তা আমি বলতে পারি না। এখন আমার মাঝে মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে, কেন আমি বিধিমত লেখাপড়া শিখিনি। আমার বন্ধুদের কত কত পড়াশোনা, বিশ্বসাহিত্যের কত অলিগলিতে যাতায়াত, কী না তাঁরা জানেন? কী না পড়েছেন–কোনো কিছুই তাঁদের অজানা নেই। আর এক কণাও তার পড়া হয়নি আমার। পৃথিবীর কত মহৎ সৃষ্টি আমার অগোচর অপঠিত থেকে গেল, আমার স্বদেশেরই কি সব জানতে পারলাম! মহাকাব্যের কখানা পড়েছি, পুরাতত্ত্বেরই বা কী! বাবার অত অত বলাতেও বাল্মীকি বেদব্যাসের রামায়ণ মহাভারত দুটো আমার পড়া হল না। বিদেশী মহৎ স্রষ্টাদের প্রায় সবাই তো অমনি অচেনা রয়ে গেলেন! বিশ্বের নিত্য নবীন সাহিত্য সৃষ্টির সাথেই বা যোগ রাখলাম কোথায়! সর্বাধুনিক রচনাই বা কী পরিচয় পেলাম। অভয়ঙ্করের বিদেশী সাহিত্যের সমালোচনা পড়েই আমার যা এই ভয়ঙ্কর বিদ্যে।

অবশ্যি উপেনদা (অগ্নিযুগের উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিজলীর সম্পাদন-প্রকাশনায় বিজড়িত ) একদিন সান্ত্বনাছলেই বুঝি আমায় বলেছিলেন, বাঁধাধরা লেখাপড়া তেমনটা তুই শিখিসনি যে তা এক পক্ষে ভালোই হয়েছে, শাপে বর হয়ে গেছে তোর। তোর ওপর অপর কারো প্রভাব পড়েনি, পড়তেই পায়নি একদম। তুই যা হবি আপনার থেকেই হবি, যা লিখবি নিজের মনের থেকেই লিখবি। কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের মতন হওয়াই তো ভালো রে! তোর লেখায় আর কারো প্রভাব পড়বে না। অবশ্যি তোর রচনায় কোনো ঐতিহ্যসূত্র থাকবে না তা বটে, তাতে কি? তা না থাকলেও তুই-ই নিজেই একটা ইতিহাস হতে পারিস হয়ত বা!

বাবার পাঠাগারে নানা ধরনের গাদা গাদা বই থাকলেও রবীন্দ্রনাথের রচনা ছিল না একখানাও। রবীন্দ্রনাথের পরিচয় পেয়েছিলাম ইস্কুলে ভর্তি হবার পর। বছর কয়েক মার কাছে ঘরে বসে পড়ে বাংলা ইংরাজির কিছুটা রপ্ত করে সাহিত্য ব্যাকরণ গ্রামার ট্রানশ্লেশন একটুখানি দুরস্ত হয়ে পরীক্ষা দিয়ে ইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম সটান ক্লাস সেভেন-এ। আর আমার ভাই এক ক্লাস নীচেয়। সেইকালে ইস্কুলের লাইব্রেরীতে রবীন্দ্রনাথের খবর মিলল। আর পেলাম বাংলার সার-এর কাছে। তখন আমার এমন বিস্ময় জাগল, বঙ্গদর্শন থেকে নব্য ভারত, তত্ত্ববোধনী পত্রিকা থেকে সমাজপতির সাহিত্য, ভারতবর্ষ, প্রবাসী, তা ছাড়া আরো কত পত্রপত্রিকা, এমন কি গৃহস্থ গম্ভীরা মানসী মর্মবাণী, স্বাস্থ্য সমাচার এত ছিল, কিন্তু বাবার ভাঁড়ারে কবিগুরুর বই ছিল না একখানাও!

রবি ঠাকুরের ওপর কেন জানি না, হাড়ে হাড়ে চটা ছিলেন বাবা।

কবি বলতে তার কাছে মাইকেল মধুসূদন, হেমচন্দ্র আর মবীন সেন! তাঁদের কবিতা তাঁর মুখস্থ–আওড়াতেন মুখে মুখে। সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণির থেকে শুরু করে হুররে হুররে হুররে করি গর্জিল ইংরাজ! নবাবের সৈন্যগণ ভয়ে ভঙ্গ দিল রণ, পলাতে লাগিল সবে নাহি সহে ব্যাজ। আর, বাজ রে শিঙা বাজ ঘোর রবেসবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে/সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে/ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়! আর সেই সাথে, হেমচন্দ্রের হায় হায়! ঐ যায় বাঙালীর মেয়ে!

কবিতা তো এই সব! এঁরাই তো কবি। তা নয় তো কী, তোর ঐ রবিঠাকুর। আর বকিস না পায়রা কবি, খোপের ভিতর থাক ঢাকা/তোর বক বক আর রকম সকম সব কবিত্বের ভাব মাখা। তাও ছাপালি পদ্য হোলো, নগদ মূল্য এক টাকা!!

কবিকে ঠাট্টা করা কাব্যবিশারদের গালভরা গাঁট্টামারা এই ছড়াটা বেশ ফুর্তি করে তিনি আওড়াতেন।

বাবার উপরোধে মাইকেল, নবীন সেন, হেমচন্দ্রে এক-আধটু হাবুডুবু খেয়েছিলাম। মাইকেলে হাঁপিয়ে উঠেছি, হেমচন্দ্রে উঠে হাঁপছাড়া গেছে, নবীন সেন মন্দ লাগেনি নেহাত তবে স্বচ্ছন্দ নিশ্বাস ফেলতে পেরেছি ভারতচন্দ্র পেয়ে। তাঁর কাব্যলোকে পোঁছে-তর অন্নদামঙ্গল আর বিদ্যাসুন্দরে এসে রস পেয়েছি সেই বয়েসেই। আহা, কী ছন্দ! কী বাক্যের ছটা! কী রূপরাগের ঘটা! একেবারে যেন মাতিয়ে দিয়েছিল।

পুরানো সাধনা, আর স্বর্ণকুমারী দেবীর সম্পাদনায় ভারতীতে রবীন্দ্রনাথের রচনার কিছু কিছু স্বাদ পেয়েছিলাম, আর তদানীং কালের প্রবাসীতেও কিছু কিছু-কিন্তু ভূরিভোজ শুরু হোলো সেই ইস্কুলের লাইব্রেরীর নাগাল পেয়ে। রবীন্দ্রনাথের গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের বইয়ে ঠাসা ছিল গোটা একটা আলমারিই।

পাঠশালার সেই ঝুলনযাত্রার পর যেন শারদীয়া মহাপূজার মহামহোৎসবের মধ্যে এসে পড়লাম।

প্রথম দিনই আমি চারু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা নিয়ে এসেছিলাম। তার প্রথম কবিতাটা ছিল, মনে আছে এখনো, ধূপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে…। ধূপের মতই যেন আমি রবীন্দ্রনাথের কাব্যছন্দে আর ভাবসৌরভে একেবারে মিলিয়ে গেলাম–বিলিয়ে দিলাম আপনাকে।

বইখানা হাতে নিয়ে বাবার সেই নাক সিটকাননা…এখনো যেন আমার চোখে ভাসে। আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন বাবা-আমাদের ছেলে-চারু দেখছি বার করেছে বইটা। পৈতে ফেলে দিয়ে ব্রহ্ম হয়ে গেছে চারু।

ঐ পর্যন্ত, আর কিছু নয়।

লেখক হিসেবে চারুদা আমাদের অচেনা ছিলেন না। প্রবাসীতে তার গল্প আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। তাঁর ভাতের জন্মকথা বইটা তিনি আমার ক্লাস ফ্রেন্ড বিঃ সুকুলকে উৎসর্গ করেছিলেন-বিষ্ণুর কাছ থেকে নিয়ে পড়েছিলাম বইটা। এমন ভালো লেগেছিল যে! সে বইটা বোধহয় পাওয়া যায় না এখন আর।

চাঁচোরের রাজার সম্পর্কে কে যেন হতেন চারুদা আমাদের। রাজাকাকার জামাই চারু বলে আরেকজন ছিলেন, তাই বাবা-মা চারুদের কথা উঠলেই ছেলে-চার বলে বোবাতেন। চাঁচোরের পারিবারিক কাহিনী নিয়ে কয়েকখানা উপন্যাসও লিখেছিলেন চারুদা-পরগাছা, আরও যেন কী কী! প্রবাসীতেই বেরিয়েছিল, পড়েছিলাম।

তাছাড়াও ভাতের জন্মকথা বলে চারুদার হোটদের জন্যে লেখা বইখানা বন্ধু বিঃ সুকুলের কাছ থেকে নিয়ে পড়েছিলাম।

বিষ্ঠু সুকুলকে আমি রীতিমত ঈর্ষা করতাম এক কারণে, ঐ বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্টায় তার নাম ছাপানো ছিল বলে। বিষ্ণুর ভাতের সময় বইটা তিনি তাকে উপহার দিয়েছিলেন। বিষ্ণুর বাবা গৌরীপ্রসাদ সুকুল চারুদার বাল্যবন্ধু ছিলেন। মার মুখে শুনেছিলাম, গৌরীকে একবেলা না দেখতে পেলে তিনি নাকি ছটফট করতেন।

বিষ্টুর জন্যও আমার সেইরকমটাই হতোবোধ করি মাঝে মাঝে। একদিন কেলাসে গিয়ে নিজের পাশেই তাকে না পেলে সেই ছটফটানিই হতো বুঝি। যেদিন সে অপর কোন ছেলের পাশটিতে বসত এমন খারাপ লাগত আমার যে কী বলব! পাঠ্য পুস্তকের আড়ালে গল্পের বই পড়তেও মন লাগত না তখন আমার।

বিষ্টুকে আমি বলতাম, তুই একজন বড় রাইটারের একখানা বই পেয়েছিস তো! আরেকখানাও পাবি তুই এক সময়। আমিই দেব তোকে। আমার একখানা বই উৎসর্গ করব তোর নামে। বড় হয়ে আমিও বই লিখব তো?

আরেকজন বড় রাইটার? চোখ বড় বড় করে সে তাকাত।

তা ঠিক বলতে পারি না, তবে রাইটার হব আমি ঠিকই। বড় হয়ে বই লিখব আমি। তুই দেখে নিস।

আমাকে নিয়েও একটা গল্প লিখিস তাহলে। কেমন, লিখবি তো? নিশ্চয়।

লিখব বইকি।

বই তো তারপর লিখেছি বিস্তর, কিন্তু একখানাও ওর নজরে পড়েছে কিনা কে জানে!

অনেকদিন আগে শুনেছিলাম, বিহার মুলুকের কোথায় যেন সে মাস্টারি করছে, তারপর আর কোনো খবর পাইনি তার, কোথায় যে সে থাকে। আমারও কোনো খবর রাখেনি সে তারপর। আমারও ঠিকঠিকানা তার জানা নেই বোধহয়।

আমার নিখরচায় জলযোগ বইটা আমার বাল্যকালের প্রাণের বন্ধু সেই বিষ্ণু প্ৰসাদ সুকুলের নামে উৎসগীত। আর অদ্বিতীয় পুরস্কার বইয়ের নাম-গল্পটাই তার কীর্তিকাহিনী নিয়ে। কিন্তু দুখানার একখানিও তার কাছে আমি পৌঁছাতে পারিনি। কোনো সুত্রে সে পেয়েছে বা পড়েছে কিনা জানি না।

ছেলেবেলার বন্ধুরা মেয়েদের ভালোবাসার মতই কোথায় যে হারিয়ে যায়! ভাবতে অবাক লাগে একেক সময়। মনে হয় যে, বুঝি একরকম ভালোই। তাদের নির্মেদ দেহ আর নির্মেঘ মন নিয়ে কৈশোরের নিবিড় মাধুর্যে মিশিয়ে নিটোল মুক্তোর মতই চিরদিনের স্মৃতির মধ্যে অক্ষয় থেকে যায় তারা–পরে যে কখনো আর ফিরে দেখা দেয় না তাতে জীবনের মতই সুমধুর থাকে, পলে পলে দন্ডে দন্ডে অবক্ষয়ে টাল খায় না, ক্ষয় পায় না।

নইলে পরে যদি তারা ভূরি ভূরি কামিয়ে আর বিপুল ভূঁড়িভার নিয়ে ফিরে এসে দেখা দিত আবার, তাহলে সংসারের ত্রিতাপদগ্ধ পোড়াকাঠের মত তাদের দেহমন আর পেনসনপ্রাপ্ত অখন্ড অবকাশ আমাদের জীবনে কী দুর্বিষহই না হতো যে!

বন্ধুত্বের সেই পরাকাষ্ঠায় বৃযোৎসর্গের মই আত্মাহুতি দিতে হতো আমাদের।

জীবন মন্থনের প্রথম ভাগেই তাই যত না অমৃত, তার পরে যা ভাগ্যে ওঠে তা নিতান্তই হলাহল। তখন কার ভেলকিতে কেমন করে কে জানে, আগের সব অমিয়ই গরল আর ভেল হয়ে গেছে!

জীবনভোর জীবন-যন্ত্রণাই বাকী আছে কেবল।

চাঁচোরের কাছাকাছি নামডাকওয়ালা এক গ্রাম ছিল–বেশ বধিষ্ণু-কলিগ্রাম। চাঁচোর থেকে পাকা সড়কে পুল পেরিয়ে যাওয়া যেত কলিগাঁয়, আবার আমাদের ইস্কুলের পাশের চাষের খেতের মধ্যে দিয়েও সোজাসুজি যেতে পারতাম সেখানে। কলিগাঁর ছেলেরা চাঁচোরের ইস্কুলে পড়তে আসত। তাদের অনেকের সঙ্গে ভাব হয়েছিল আমার।

কলিগ্রাম যেমন মালদা জেলার এক নামকরা গ্রাম, তেমনি কলিগ্রামের বিখ্যাত নাম কৃষ্ণচরণ সরকার। একজন জমিদার বা মহাজন সেখানকার; একদা স্বদেশী যুগের পাড়া। ছিলেন, পরে অসহযোগ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। স্বনামধন্য বিনয় সরকারের সহযোগে মালদহের বিখ্যাত সংস্কৃতিপত্র গম্ভীরা-র তিনি ছিলেন প্রকাশক সম্পাদক। তাঁর এক বিরাট গ্রন্থাগার রয়েছে খবর পেলাম কলিগাঁর ছেলেদের কাছে। পত্রপাঠ গেলাম তার বাড়ি।

তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর বই কাউকে বড় একটা তিনি নিতে দিতেন না, এইরকম শুনেছিলাম। এই কারণেই বোধহয় বইগুলো টিকে ছিল।

বাবার নাম করতেই সমাদরে তার বইয়ের ঘরে তিনি নিয়ে গেলেন আমাকে। আলমারিতে আলমারিতে সাজানো থরে থরে সব বই। তদানীন্তন লেখকদের বই যত। কত বই যে! ইতিহাস প্রবন্ধ গবেষণামূলক বইও কত! রাখালদাসবন্দ্যোপাধ্যায় যদুনাথ সরকারের বই। শরৎচন্দ্রের বইয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল আমার সেইখানেই। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক আর কবিতার বইও পেয়েছিলাম। আরো কতোরকমের বই–মনে নেই এখন।

গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশিত তাবৎ বই ছিল তাঁর। তার থেকে ইচ্ছেমত কয়েকখানা তিনি বেছে নিতে বললেন। আর বললেন যে, পড়ে-উড়ে ফিরিয়ে এনে দিলে আবার পাব। এমনি করে সেকালের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটল।

সকালে উঠে একখানা বই পড়ে শেষ করি। একখানা দুপুরে পড়ার জন্যে ইস্কুলে নিয়ে যাই। আবার রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আরেকটা পার করতে লাগি। দুদিন বাদ বাদ নিয়ে আসি গিয়ে।

বাবা বলতেন, গ্রন্থঃ ভবতি পতিত। যারা গ্রন্থ নিয়ে পড়ে থাকে তারাই পতিত হয়।

মানে, তুমি বলছ যে লাইব্রেরীয়ানরাই? যারা কিনা বই নিয়েই ব্যস্ত থাকে সব সময়?

না, সেভাবে পড়ে থাকা নয়, গ্রন্থ নিয়ে পড়া-সেই কথাই বলছি রে। বই পড়েই বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়।

মা, বাবা কী বলছে জানো? মাকে গিয়ে বললাম, গ্রন্থঃ ভবতি পন্ডিতঃ। কথাটা সত্যি নাকি? মানে কী ওর?

ঠিকই বলেছে তোর বাবা। যারা বই মুখে করে পড়ে থাকে সব সময়, তারা পন্ডিত না। হয়ে আর যায় না। বই ছাড়া চোখের সুমুখে কিছুই তাদের পড়ে না তো আর তাই সবটাই পন্ড হয় তাদের। তার মানেই হোলো গিয়ে পন্ডিত।

তুমি কী বলছ মা? পন্ডিত মানে কি তাই? একেবারে পণ্ড হয়ে যাওয়া?

গ্রন্থি কথাটার আরেকটা মানেও আছে আবার। তার মানে গেরো। কপালে গেরো না থাকলে কি কারো পন্ড হয়? কেউ পতিত হয় নাকি? এ হোলো গে ওই বইয়ের গেরো।

গেরোও বলা যায় আবার গেরোনও বলা যায়, তাই না মা?

বলতে পারিস। বই থেকে কী জানা যায় কিছু? মন থেকেই তো জানা যায় সব। সেই জানাটাই আসল। মনের জানাটা বই দেখে মিলিয়ে নেয়া যেতে পারে কেবল, সত্যিকার জানা তোর ঐ মনেই। মনের মধ্যেই তোর সব রে।

বাবা যে ব্রহ্মগ্রহি দেয় পৈতেয়? সেটা তাহলে? সেটাও কি–?

ঐ গেরোই। ধরতে গেলে, সেই গেরোই একরকমের। ব্রহ্মও একটা গেরো ছাড়া কী? গেরোনও বলতে পারিস। যার কপালে ঐ গেরো আছে, যার বরাতে ঐ গ্রহণ লাগে, মানে যাকে তিনি গ্রহণ করেন, তার কি আর নিস্তার আছে নাকি? ইহকাল পরকাল সব ঝরঝরে।

ভগবানের খর্পরে পড়া তাহলে ভালোই নয় বলছ তুমি?

না, আমি কিছু বলছি না। কারো খর্পরে পড়াটাই বুঝি ভালো নয়। তুই পৈতের ব্রহ্মগ্রন্থির কথা বলছিলিস না? সেটা হচ্ছে গিয়ে উপনয়ন সংস্থার। ভগবানের সঙ্গে জোট পাকিয়ে নতুন করে জন্মানো-ভগবান আর তুই দুজনে মিলে একজোটে দ্বিজত্ব লাভ, বুঝলি?

একদম না।

উপনয়ন মানে উপনীত হওয়া, ব্রহ্মের মুখোমুখি গিয়ে পৌঁছনো। ব্রক্ষ সাক্ষাৎ। উপনয়ন মানে তৃতীয় নেত্রও বোঝায় আবার। তার মানে, যা আমি বলছিলাম, তোর ঐ মনের চোখ। মনের চোখ খুলে যাওয়া। যার মনের চোখ খুলে যায় সে পৃথিবীর সব কিছুই যথার্থরূপে দেখতে পায়। আর তাই হল গিয়ে সর্বত্র ব্রহ্মসাক্ষাৎ।

মনের সেই চোখ কি করে খোলে মা?

মার ইচ্ছে হলেই খোলে। এই জন্মেই খোলে, কারো-কারো আবার সাত জন্ম লেগে যায় খুলতে। আবার এই দভেই খুলে যায় কারো কারো। সবই মার ইচ্ছে।

মানে, তোমার ইচ্ছে!

আমার ইচ্ছে? আমি কে? বলছি না মার ইচ্ছে? আমার মা, তোর মা, সবার মাসেই বিশ্বজননী।

তুমিই তো সেই মা। সেই বিশ্বজননী। তুমিই তো! ভৈরবী বলেছিল আমায়।

দূর পাগলা। মা হাসতে লাগলেন আমার কথায়।–মাথা খারাপ করে দিসনে! আমি শুধু ভাবছি তুই খাবি কি করে রে? পড়ার বই ঠুনে একদম-রাতদিন নভেল নিয়ে পড়ে থাকিস। পাসটাস করতে পারবিনে–চাকরি-টাকরিও জুটবে না তোর কপালে। লেখাপড়া শিখলিনে, মুখ হয়ে থাকলি। কী হবে রে তোর? খাবি কি করে?

তুমি তো আছে। মা থাকতে ছেলের ভয় কি!

আমি কি চিরদিন আছি নাকি? বেঁচে থাকব চিরকাল?

থাকলেও তখনো তুমি থাকবে, আমি জানি। আমার ভাবনা নেই।

তা কি হয় নাকি রে? তুই কি আমায় বেঁধে রাখতে চাস? আমি বাঁধা পড়তে চাই না। কিছুতে না, কারাতে না।

তারপর খানিক কী ভাবলেন তিনি-দাঁড়া, তোর সঙ্গে আসল মা-র পরিচয় করিয়ে দিই। তাহলে আর তোর কিছু ভাবনা থাকবে না। খাওয়া পরার তো নয়ই–কোনো দুখকও পাবিনে জীবনে। দাঁড়া।

দাঁড়িয়েই তো রয়েছি। তোমার সামনেই তো দাঁড়িয়ে।

আমার দুই ভুরুর মধ্যবিন্দুতে আলতো করে তার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটি চুঁইয়ে তিনি বললেন-এইখেনে মন আনতে পারিস? আন দেখি? এই দুই ভুরুর মাঝখানে?

মন?

হ্যাঁ। মন আনতে হবে, এনে স্থির করতে হবে এখানটিতে। সারা দেহময়ই তো তোর মন ছড়িয়ে-তাই না? সেই সবগুলো মনকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এইখেনে নিয়ে এসে জড়ো করতে হবে–মনের মধ্যে মন। সেই মনের মধ্যেই মা দুর্গা থাকেন। সবার মা যিনি, বিশ্বজননী…। এনেছিস মন?

চেষ্টা করছি।

কী মনে হচ্ছে এখন?

কতো কী! কতো কী যে মনে পড়ছে।

মা দুর্গার কথা?

না তো। যত সব আজেবাজে মেয়েদের কথা মনে আসছে কেবল।

তোর মনে আবার মেয়ে কী রে! মা তো শুনে হতবাক।

রিনিটিনিদের কথাই মনে পড়ছে আমার।

তাই বল! শুনে হাসলেন মা-দাঁড়া, আমি তোর মন এনে দিচ্ছি এখেনে। এ বলে তিনি ভ্রুর মধ্যে তাঁর মুখ ছোঁয়ালেন-যতক্ষণ আমি তোকে চুমু খাব ততক্ষণ তোর মন এখেনে থাকবে। তুই মনে মনে মা দুর্গা মা দুর্গা কর–আমিও মাকে ডাকছি মনে মনে। মা আবার আমাদের দুজনকে ডাকছেন। এইখেনে বসে। মিনিট খানেক বাদে মা শুধালেন–এলো মন?

হ্যাঁ।

কি রকমটা বোধ হলো তোর?

শিরশির করছিল গা।

মা দুর্গার আবির্ভাব হলো কিনা, সেই জন্যেই। তারপরে তিনি আমার ব্রহ্মরন্ধ্রে হাত ছুঁইয়ে বললেন-এখানে থাকেন বাবা মহাদেব। পরম শিব। আর, তাঁর পায়ের তলায়, এইখখনে দুই ভুরুর মাঝখানটিতে পার্বতী রয়েছেন। দশভুজা দুর্গা। আর এইখানে, এই কঠদেশে আছেন বাদেবী-মা সরস্বতী। বুকে নারায়ণ, নাভিপরে মা লক্ষী–এমনি সব নানা দেবতা নানান অঙ্গে ছড়িয়ে, বড় হয়ে যখন বই পড়বি, তন্ত্রের বইই পড়বি, তখন টের পাবি। দেহের নানা স্থানে নানান চক্র রয়েছে ভুরুর মাঝখানটিতে আছে আজ্ঞাচক্র। মা দুর্গা এখানে বসে আজ্ঞা করছেন, বলছেন তথাস্তু। তথাস্তু। তাই হোক। তাই হোক। এখানে মন নিয়ে এসে তোর মন দিয়ে যা চাইবি তাই পাবি। পেয়ে যাবি-দেখিস।

তাই পাব? বলছ কি মা?

নিশ্চয়। চেয়ে দ্যাখ না তুই।

চাইব বইকি। আজই চাইব। আমার কিন্তু মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না মা।

বিশ্বাস না হলেও হবে। অবিশ্বাস করে চাইলেও পাবি-শুধু মার কাছে এসে চাইতে হবে…এইখেনে মন নিয়ে এসে…

বিশ্বাস না হলেও?

অবিশ্বাসে কী আসে যায়? মা কি আর মা থাকে না তাহলে? অবিশ্বাস করে আগুনে হাত দিলে কি হাত পুড়বে না তোর? মা তো আগুন রে।

তবে যে মামা বলেন, বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর…!

সে কথা কৃষ্ণের বেলা খাটতে পারে, মার বেলা নয়। মা তো তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সব সময় মিলে রয়েছেন। যাই গে, আমার কাজ পড়ে রয়েছে।

চলে গেলেন মা। আমিও চলে এলাম আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকের খোলা ছাদের নিমগাছের ছায়ায়। আমার মোয়ার, শুয়ে শুয়ে বই পড়ার প্রিয় জায়গা ছিল সেইটা। খোলা হাওয়ায় খোলা ছাদে গা গড়িয়ে ভুরুর মাঝখানে মা দুর্গাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম শুয়ে শুয়ে।

বিকেল গড়িয়ে এসেছিল, খিদে পেয়েছিল বেশ। সেই কখন সন্ধ্যে হবে, লুচি ভাজবে, খেতে বসব আমরা। এর মধ্যে যদি কিছু খেতে পাওয়া যায়, কী ভালই না হয় তাহলে। মনে মনে মা দুর্গার কাছে খাওয়ার দাবি জানাতে লাগলাম।

মা দুর্গাকে ছেড়ে কখন ফের রিনিদের কথা ভাবতে লেগেছি টের পাইনি। এদিকে বড় বারকোস নিয়ে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল কজনা। সামনের ছাদে আমায় শুয়ে থাকতে দেখে ইশারায় অরা ডাকলো আমাকে।

কী ব্যাপার? না, মা সিংহবাহিনী আর রামসীতার শীতল ভোগের মহাপ্রসাদ-বৈশাখ মাসের বৈকালী। সারা বোশেখ মাসটা ধরেই প্রতিদিন বিকেলে এমনি ধারা বৈকালিক ভোগ দেয়া হবে তাঁদের, আর সেই প্রসাদ পালা করে বিলোনো হবে একেক জনকে একেক দিন।

আজ প্রথম দিনটিতেই রাজাবাহাদুরের হুকুমে আমাদের পালা পড়েছিল।

প্রকান্ড রূপোর আর শ্বেত পাথরের দু থালায় সাজানো মাখন ছানা ক্ষীর সর বাদাম কিসমিস আখরোট আঙুর খেজুর ভিজে ছোলা শসা কলা ইত্যাদি যাবতীয় ফলটল আর সেই সঙ্গে সন্দেশ-টশে আরো কত কী!

সীতারাম সিংহবাহিনীর শীতল ভোগের মহাপ্রসাদ।

নয়া রাজবাড়ির দক্ষিণ দিকে রামসীতার প্রকান্ড মন্দির। দেখেছিলাম আমি। তার পাশেই সিপাহিদের বকেয়া ব্যারাকে আমাদের হাইস্কুল বসতো।

রোজ সন্ধ্যায় রামসীতার পূজারতি হয় খুব ঘটা করে তাও শুনেছি। কোনো দিন তা দেখা হয়নি। কী করে দেখব? ইচ্ছে থাকলেও অত দূরে সন্ধ্যেবেলায় একলাটি কি আমায় যেতে দেয়? আমাদের এই পুরনো রাজবাড়ি থেকে নয়া রাজবাড়ি তো কমখানি পথ না।

রামসীতার দিনের বেলার পূজার্চনাও দেখিনি কখনো। দুপুরে যে রাজভোগ হয় শত শতলোক তার প্রসাদ পায় নাকি। আর রাত্রির গোয় সন্ধ্যারতি–তা নাকি একটা দেখবার মই। দেখতে হবে একদিন। রিনিকে নিয়ে দেখে আসব না হয়।

রামসীতা রাজবাড়ির ঠাকুর। আর সিংহবাহিনী তাদের কুলদেবতা। সোনার প্রতিমা-ছোট্ট একটুখানি। দূর থেকে দেখা যায় না। খুব কাছে গেলে তবেই দেখা যায়, দেখিনি কখনো। পুজোর সময় পাহাড়পুরে রাজবাড়ির মহাপুজায় বিরাট দুর্গা প্রতিমার পাশেই নাকি সোনার সিংহাসনে সিংহবাহিনীকে রাখা হয়–মা দুর্গার সঙ্গে তাঁরও পূজা হয়ে থাকে তখন। মা দেখেছেন সে ঠাকুর, আমার চোখে কিন্তু পড়েনি।

দুথালা প্রসাদ, একটা শ্বেত পাথরের থালায়, আরেকটা থালা রূপোর।

দুথালা কেন গো? দুরকমের দুটো থালা যে।

রূপোর থালায় মা সিংহবাহিনীর প্রসাদ, আর শ্বেতপাথরে সীতারামের।

প্রসাদ রেখে দিয়ে থালা নিয়ে যাবে তত তোমরা? লোকগুলোকে শুধোলাম।

না। না। থালা এখানেই থাকবে। থালাসমেত রেখে যেতে বলেছেন রাজাবাহাদুর।

রাজবাড়ির ব্যাপার। রাজরাজড়ার চালচলন। তাদের কান্ডকারখানাই আলাদা।

এর আগে আর কখনো আমাদের বাড়ি বৈকালীর পালা পড়েনি। আসেনি কখনো আর। সেই প্রথম এল।

আর, সেই প্রথম আমার ঈশ্বরের প্রসাদলাভ…মার আশীর্বাদে।

১. নিমগাছের ছায়া

১১.

সেদিন সারা বিকেলটা নিমগাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে প্রাণপণে মা দুর্গাকে ডাকাডাকি করলাম কিন্তু কোথায় কী! সেই বৈকালী আর এলো না। কপালগুণটা বাজিয়ে দেখতে রোজ রোজ আসতের বাবা বস্তুর ঘন ঘর সবার খুলবে এইরকম। কালী একটু গিয়ে মাঝখান থেকে খিদে বেড়ে গেল আরো।

বৈকালীর বদলে রিনি এল-বেরুবে না আজকে? বেড়াতে যাবে না?

যাব বইকি। মাঠের পারে কি পুকুর ধারে নয়, নতুন জায়গায় বেড়াতে যাব আজ, দাঁড়া, আগে কিছু খাবার ব্যবস্থা করি। রিনিকে নিয়ে মার কাছে গেলাম। মা, কিছু খেতে দাও না আমাদের। ভারী খিদে পেয়েছে।

সেই কখন খেয়েচিস। খিদে পাবে তার আশ্চর্য কী। কি ছিলি এতক্ষণ?

নিমগাছের ছায়ায় ছাদে শুয়ে তোমার মা দুর্গাকে ফাঁদে ফেলবার তালে ছিলাম। কিন্তু এত করে চাইলাম, বৈকালী তো বই এল না আজ?

রোজ রোজ আসবে না কি? একেকদিন একেকজনের পালা যে? পালা মরে সবার বাড়িতেই যাবে তো। তোর বাবা বয়সে আর মানে সবার চাইতে বড়ো বলে প্রথমদিনের পালাটা তারই পড়েছিল। বামুন পাড়ার ঘ. ঘর সবার বাড়ি যাবে, তারপর বড় বড় আমলাদারদের বাড়িতেও। সারা বোশেখ মাস ভোরই তো চলবে এইরকম।

তা যাই বলল না মা, চাইলেই পাওয়া যায় না সব সময়। তোমার মা কালী একটু খামখেয়ালী আছে।

তা আছে। তবে চাইলেই পাবি-পাবি যে, সেটা নিশ্চয়। কখনো তক্ষুনি, কখনো বা কিছু পরে। পেতেই হবে, না পেয়ে যাবিনে কক্ষনো। কখনো চেয়ে পাবি, কখনো বা গেয়ে চাইবি-কখনো বা না চাইতেই পেয়ে যাবি-এমন ধরা চলতে থাকবে সারা জীবন, পরখ করে দেখিস।

পরখ করে দেখলাম তো এতক্ষণ। আমার দু র শোনা গেল।

আবার চাইবার আগেই পেয়ে যাবি একেক সময়–বললুম না? দেখবি যে না চাইতেই কখন দিয়ে বসে আছেন মা। মা বলেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, জীবনের কোন জিনিসই তো এখনো তোর টেস্ট করা হয়নি। তাই আগে মা একটুখানি করে তাদের বাদ দেবেন। স্বাদ দিয়ে তোর সাধ জাগাবেন। আর, তোর সাধ মেটাকেন চাইলে পরেই তারপর। মেটাতে মেটাতে যাবেন তিনি জীবনভোর বরাবর।

একেই বুঝি সাধনা বলে থাকে? তাই না মা?

তাও বলতে পারিস। তবে সাধনা দুতরফেই-মার পুত্রসাধনা আর ছেলের মাতৃসাধনা। দুজনের দুজনকে নিয়ে সাধ আহ্রদ।

বাঃ বেশ তো! শুনে আমার বেজায় ফুর্তি হয়। হাতে যেন স্বর্গ পেয়ে যাই তক্ষুনি।

যেমন চাইবার আগেই পেয়ে গেছিস আজকে। পরে তুই চাইতে পারিস বলে তার আঁচ পেয়ে আগের থেকেই যুগিয়ে রেখেছেন মা।

কোথায় পেলাম। মার কথায় আমার অবাক লাগে।

আজ সকালেই পৌঁছে গেছে তোদর বিকেলের জলখাবার।

বলোনি তো তুমি? কখন এল? কী এসেছে?

তোরা তো তখন ইলেছিলি–বলব কখন? আজ সকালে তোর বাবা পাহাড়পুরে তোর জ্যাঠাইমাদের বাড়ি গেছলেন না? বড়মা তোদর জন্যে ক্ষীরের ছাঁচ সরের নাড়ু চন্দ্রপুলি তিলকোটা চিড়েমুড়ির মোয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন সব।

দাও দাও। বলেনি কেন এতক্ষণ। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি।

বস। বসে খা। রিনি আর আমাকে আসনপিড়ি হয়ে বসতে বলেন মা।

বসে বসে খায় নাকি মানুষ? রাস্তায় খাব আমরা। বেড়াতে যাচ্ছি না এখন? রিনিকে আমি রাম-সীতার মন্দির দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি আজ। আরতি দেখে ফিরব। যেতে যেতে খাব আর খেতে খেতে যাব। বড়মার অবদানে আমার দুপকেট বোঝাই করে বেরুলাম।

বেশি রাত করিসনে যেন। পই পই করে বলে দিলেন মা।–সামনে ক্লাস পরীক্ষা রয়েছে তোর। এসেই পড়তে বসবি, বুঝেছিস? বেশি রাত জেগে, কি মাঝ রাত্তিরে উঠে আমি পড়তে দেব না।

ঘাড় নেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

তোমার মা আবার কোন মায়ের কথা বলছিলেন গো! যিনি সব জুগিয়ে থাকেন? তোমার পাহাড়পুরের বড়মা?

না না, অন্য মা। আরেক মা। তোর মা, আমার মা, মার মা, বড়আরও মা-সবার মা, যিনি বিশ্বজননী, মা দুর্গা। তার কথাই বলছিলেন মা।

মা দুর্গা?

হ্যাঁ, তিনিই খাবার পাঠিয়েছেন আমাদের–খেতে চাইবার আগেই। রিনির বড় বধু চোখ আরো বড় হয়ে উঠল যেন।–তাই নাকি?

হ্যাঁ, চল না। যেতে যেতে বলছি তোকে সব। আগে কিছু খেয়ে নেয়া যাক। খিদে পেটে তত্ত্বকথায় মন যায় না।

পুলির তত্ত্ব নেবার পর রিনির চাঁদ মুখের তত্ত্ব নিলাম।- তোর মুখে নারকেল নাড়ু

ভয়াশ লেগে রয়েছে। দা, মুখ মুছিয়ে দি তোর।

এ আবার কী ধরনের মুখ মোছানো? পকেটে রুমাল ছিল না? হত ছিল না তোমার? মাঝ রাস্তার মধ্যিখানে …এই সব। আপত্তি করল সে।

হাত ছিল তো কী? আমি বলি-ঝগড়াঝাটির বেলায় অবশ্যি হাত থাকতে মুখ কে?

তখন কষে তোমার দু হাত চালাও। কিন্তু তেমন কারো মুখ মোছাতে হলে অন্য কথা। তখন মুখ থাকতে হাত কেন? তাই মুখ দিয়েই মুছে দিলাম।

বেশ করেছে। এবার শুনি তোমার সেই কথাটা। মা দুর্গার কথা।

তোমার মা দুর্গা আবার কিরে! তোরও মা দুর্গা তো, মা দুর্গা তো সবাইকার। বল, আমাদের মা দুর্গা।

ওই হোলো। এখন শুনি তো কথাটা।

মা দুর্গা আছে না? শিব আছেন, দুর্গা আছেন লক্ষ্মী সরস্বতী দেবতারা সবাই রয়েছে।

আছেন তা তো জানি। একবাকে তার সায়।–ত কে না জানে?

কিন্তু আছেন কোথায়? সেই আকাশের মগডালে নয়, আমাদের এই শরীরে–আমাদের মনের মধ্যেই। যেমন তোর শিব আছেন মাথার এইখানটায়, আর মা দুর্গা রয়েছেন তাঁর পায়ের তলায় বসে–এইখানে কপালের মধ্যিখানে। এখানে মন নিয়ে এসে এমনি করে মা দুর্গাকে ডাকতে হয়। আনতে পারিস এখানে তোর মন?

কি করে আনব?

দাঁড়া, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তোকে। আগে আমার এখেনে ডেকে আনি মা দুর্গাকে…বলাটা হয়তো ভুল হলো…আগে আমাকে ডেকে নিয়ে যাই এখানে মা দুর্গার কাছে, তারপর…

তারপর মার আখ্যানের পুরোটাই তার দেহে মনে মঞ্জরিত করতে লাগিযথাবিহিত পুরঃসর আমার অখ্যানমঞ্জরী নিবেদনের পর ওধাই : কি রকম লাগছিল ব তো, আমি যখন…

তুমি যখন ঠোঁট ঠেকিয়ে রেখেছিলে না, সারা গা কেমন শিরশির করছিল আমার।

করবেই তো! কপালটা শিরোভাগ না? তাই করবেই তো শিরশির!

কপাল নয় গো, গাটা শিউরে উঠছিলো যেন।

আহা, ওই শীর্ষদেশ থেকেই তো যতো শিরা উপশিরা আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। মাথার ডাকে সাড়া দিচ্ছিল তারা। নিজের বুদ্ধিমত্ত আমার ব্যাখ্যা করা।

এবার বুঝলাম। বেশ তো, ডাকা গেল না হয় মা দুর্গাকে। কিন্তু কারণে অকারণে নাহক তাঁকে ডাকতে যাব কেন? তাঁকে বিরক্ত করা হবে না?

মা আবার বিরক্ত হয় নাকি ছেলেমেয়ের ওপর? আর অকারণে কেন? কোনো কিছুর দরকার পড়লেই ডাকবি তো। চাইবার জন্যেই ডাকবি, পাবার জন্যেই ডাকবি রে। দেখবি তোর প্রার্থনা পূর্ণ হয় কিনা।

আচ্ছা, আমি কিছু না চাইবার জন্যে ডাকি যদি? সে জানতে চায়।

না চাইবার জন্যে ডাকা? না পাবার জন্যেই সে আবার কী রে? তার কথাটায় আমার ধাঁধা লাগে, বুঝতে পারি না ঠিক।

ধরো, মা তো আমাদের আছে মাসে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছে। আমি এখান থেকে যেতে চাইনে। আমি যদি এখন দুর্গার কাছে না যাবার জন্যে চাই তাহলে আমাদের যাওয়া হবে তো?

না চাওয়ার জন্য চাওয়া যায় কিনা তা আমি জানি না। ওর কথায় আমি ভাবনায় পড়ি–জিগ্যেস করতে হবে মাকে। তারপরে তোকে বলব।

না পাওয়ার জন্য চাওয়াটা কী আবার? ওর কথাটা আমার অদ্ভুত লাগে–সত্যি, তোরা মেয়েরা যেন কেমনধারা। আমরা ছেলেরা চাইবার জন্যেই চাই, পাবার জন্যেই চেয়ে থাকি-পাই আর না পাই। কিন্তু এই তোরা-মেয়েরা! তোরা না চাইবার জন্যেও চাস আবার না পাবার জন্যও চেষ্টা করিস। আশ্চর্য!

চাইলে যদি পাওয়া যায়, না চাইলে তবে না পাওয়া যাবে কেন? তার জিজ্ঞাসা।

কে জানে। তোরা মেয়েরাই তা জানিস। আমরা ছেলেরা যা চাই তাই শুধু চাই, তেরা মেয়েরা তার ওপর আবার না চাইতেও,চাইতে পারিস দেখছি। মামা যে বলেন কথাটা মিথ্যে নয় তাহলে, মামা বলতেন বটে, কিন্তু আমি তার মানে বুঝতাম না তখন।

কী বললে তোমার মামা?

মেয়েরা ভারী নাচাইতে পারে।

তুমি ভারী বোকা! সেটা ঐ না চাওয়া নয় মশাই, তা হচ্ছে গিয়ে তোমায় বাঁদর নাচানো।

তোরাই জানিস। তোরাই নাচাস তো।

বেড়াতে বেড়াতে আমরা মহানন্দার তীরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

আমরা যাচ্ছি কোথায় বল তো? সে শুধায়।

রামসীতার আরতি দেখতে যাচ্ছি না। নদীটা পেরিয়ে যেতে হবে।

জল আছে যে নদীতে।

ও হাঁটুখানেক জল। অক্লেশে হেঁটে পেয়োনো যায়। বর্ষাকালে বান ডাকে। তখন ফেলে ওঠে এখানকার মহানন্দা। অন্য সময় বেচারী মহাবিষণ্ণ হয়ে পড়ে থাকে ওর একটুখানি জল নিয়ে।

ঐ তো দূরে পুল দেখা যাচ্ছে, সাঁকোর ওপর দিয়ে গেলে হয় না?

তাহলে এই ফুটবলের মাঠ ক্রস করে এলাম কেন? সাঁকো দিয়ে পেরিয়ে পাকা সড়ক ধরে গেলে অনেক দূর পড়বে, দেরি হবে বাড়ি ফিরতে। সোজাসুজি নদী পার হয়ে সিঙিয়ার আমবাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করব আমরা।

হাঁটুর বেশি জল হয় যদি? আমার ফ্রক ভিজে যাবে কিন্তু।

কোলে তুলে নিয়ে যাব তোকে? কি, পিঠে করে?

পারবে? জলে ফেলে দেবে না তো?।

তোর কী মনে হয়?…জলেই তোকে বিসর্জন দেব?

রামসীতা ছাড়া আরো কী যেন ঠাকুর আছে বলছিলে-যা দেখতে যাচ্ছি আমরা। আর কী ঠাকুর?

সিংহবাহিনী। এইটুকুন ঠাকুর কিন্তু আগাগোড়া সোনা দিয়ে গড়া।

তাই নাকি?

কিংবা সোনা দিয়ে মোড়াও হতে পারে। জানি না ঠিক।

দেখেছ তুমি?

দেখিনিও বলা যায় আবার দেখেছিও বলা যায় আবার। চোখের সামনেই দেখছি তো এখন। তোর সোনার প্রতিমা দেখছি না?

হয়েছে। খুব হয়েছে।

তুই আমার কাছে সিংহবাহিনী। আর আমি যদি তোকে বয়ে নিয়ে যাই তবে আমি তোর বাহ্ন হব তো? আমি হব গিয়ে তাহলে তোর সিংহ। বুঝেছিস?

তুমি সিহ? সিংহ তত তোমার কেশর কই গো? সে হাসে: তবে তোমার চুলগুলো প্রায় কেশরের মতই বানিয়েছ বটে! এমন ঝাঁকড়া চুল-ছাঁটো না কেন? ছাঁটবার সময় পাও না নাকি?

নাপিতের কাঁচির সামনে উবু হয়ে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকতে আমার এমন বিচ্ছিরি লাগে। কারো খচখচানি আমার সয় না। এমনকি, ওই কাঁচিরও নয়।

ততক্ষণে আমি তাকে কোলে তুলে ফেলেছি।–ই তেমন ভারী মোস তো! হালকা পলকা আছিস। তবে বিয়ের পর শুনছি মেয়েরা নাকি খুব মুটিয়ে যায়। তুইও বেশ মোটা হবি তখন।

বয়স হলে ছেলেরাও মোটা হয়। ভুড়ি হয় তাদের। তুমিও মোটাবে।

সে নেহাৎ মন্দ হবে না–যদি দুজনেই একসঙ্গে মোটাই। ভালোই হবে মোটের ওপর।

মোটামুটি মানিয়ে যাবে বলছ?

হ্যাঁ, দুজনেই যদি মোটামুটি হই-এইতো এসে গেলাম পারে। কই, পড়লি তুই জলে? পর পারে নিয়ে ওকে নামালাম।

কিন্তু নামাবার আগে শরৎচন্দ্রের কথা আমার স্মরণে এল। তাঁর স্বামী বইটা আমার পড়া হয়ে গেছল তার মধ্যেই-কৃজ্ঞরণ সরকারের পাঠাগারের থেকে নিয়ে। দামিনীকে কোলে করে নরেনের সেই নালা পেরুনোর ঘটনাটা আমার অবচেতনের মধ্যে যেন বিদ্যুতের মতই চমকে উঠল অকস্মাৎ। আমাকে নালায়িত করল।

বিশিষ্টরূপে বহন করার মানেই যে বিবাহ, তদ্ধিত প্রত্যয়ের সেই তথ্য বাংলার সারের সৌজন্যে আমার অজানা ছিল না তদ্দিনে। নরেনের মতই তাকে মাটিতে নামাবার আগে আমার স্বামীত্বের স্বাক্ষর তার মুখপত্রে রেখে দিয়েছি।

এটা কী হোলো আবার? ওর দু চোখে দুই সৌদামিনী খেলে যায়।

আমার লায়ন্স শেয়ার। আমি বললাম, মজুরি নিলাম…আমার এতক্ষণ তোকে বয়ে আনতে কষ্ট হল না বুঝি? একটুখানি মিষ্টিমুখ করে সেই কষ্ট লাঘব করা গেল।

হটতে হাঁটতে আমরা সিঙিয়ার আমবাগানের সামনে এসে পড়েছি।

ও বাবা! এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাব নাকি এখন আমরা? ভেতরটা কী দারুণ অন্ধকার।

জঙ্গল বলছিস? সিঙিয়ার বিখ্যাত আমবাগান-এর নাম। হাজার খানেক আম গাছ আছে বাগানটায়। ভালো ভালো আম যতো। ল্যাংড়া বোষই ফজলি গোপালভোগ হিমসাগর ক্ষীরসাপাতি-কত কী! আমের সময় আমরা ছুরি নিয়ে চলে আসি। গাছতলায় কত পাকা আম পড়ে থাকে যে। কাটি আর খাই। আমি জানাই : অনেক ছেলে আবার গাছে উঠেও খায় বসে বসে।

আমিও খাব, এবার যদি আমের সময় আমাদের থাকা হয় এখানে। রিনি বলে আমি কিন্তু গাছে উঠতে পারব না।

আমিও পারিনা। গাঁয়ের অনেক মেয়ে পারে কিন্তু। গেছো মেয়ে কিনা তারা।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এই অন্ধকারে বাগান দিয়ে যেতে ভয় করছে আমার। সাপখোপে কামড়ায় যদি?…কতখানি পথ গো?

তা, আধ মাইলটাক হবে। ইস্কুল যাবার সময় এই বাগান দিয়েই তো আমরা শর্টকাট করি। রাজবাড়ির ডান দিকে রামসীতার মন্দির, আর তার পাশেই আমাদের ইস্কুলটা। সাপের ছোবলের ভয় কছিস? তাহলে, কোলে করে নিয়ে যাই তোকে?

আর ই বলে… আর কিছু সে বলে না। তার চোখের কানিতেই কথাটা বলা হয়ে যায়।–বুঝেছি।

খেতে খেতে যাব আর যেতে যেতে খাব এই কথাই বলছিস তো? বাবা বলেন, মুখের অন্ন সম্মুখের অন্ন ছাড়তে নেই। তা যখন অন্নপূর্ণাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি…

অত অন্ন খাওয়া ভালো নয় মশাই। গরহজম হয়।

তা যা বলিস। আমার জবাব : কিন্তু যতই খাই না কেন, তোর মাথা খেতে পারব না। তোর মাথা অলরেডি খাওনা। মামা বলে, কলকাতায় মাথা না খাওয়া মেয়ে নাকি একটাও নেই–তারাও নাকি আবার জোর মাথাখোর। আমার মামার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করি-আর, তুইও তো কলকাতার মেয়ে। তার ওপর এমন সুন্দর। তোর মাথা কি না-খাওয়া আছে এখনও?

কে খেল শুনি?

কে খেয়েছে কে জানে। কেউ না কেউ খেয়েছেই।

না বাপু, তুমি সড়ক ধরেই চলল। পথ দেখে দেখে যাব আমরা। পথের দুপাশে দেখবার কিছু নেই কি।

অগত্যা তিলকুট আর চিড়ের নাড়ু চিবুতে চিবুতে সড়ক ধরেই চললাম আমরা।

এতখানি পথ! ইস্কুলে যাবার সময় কতটাই না মনে হয়। কিন্তু এখন যেন দেখতে না দেখতে ফুরিয়ে গেল। পকেটের রসদ ফুরোতে না ফুরোতেই পথ খতম।

ও বাবা! কত বড়ো একখানা বাড়ি গো। এই বুঝি তোমাদের সেই রাজবাড়ি? চাঁচোরের রাজার?

হ্যাঁ, নতুন রাজবাড়ি। ওর ডান দিকে রামসীতার মন্দির ই। আর তাঁর পাশেই আমাদের হাই স্কুল।

কলকাতায় এত বড় বাড়ি দেখিনি। রিনি অবাক হয়ে দ্যাখে। তবে কলকাতার কতটুকুই বা দেখেছি।

ভেতরে আবার আরও কত বড়ো। যতখানি চওড়া দেখছিস সামনেটা, ততটাই ডান দিকে, বাঁ দিকেও ততখানি, পেছনেও আবার তাই। কতো কতো ঘর যে কতো বড়ো

একখানা হাদ। ফুটবল খেলা যায়। ছাদে আবার কল আছে–খুললেই জল পড়ে।

কলকাতার মই নাকি? বলল কি গো?

তা হবে। কলকাতার কল দেখিনি তো আমি। …কাসর ঘন্টা বাজছে শোন! আরতি এরু হয়ে গেছে এখন।

আমরা মন্দিরের চত্বরে গিয়ে দাঁড়াই। আরতি দেখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

বাঃ, বেশ ঠাকুর তো। রাম সীতা লক্ষন হনুমান… রিনি গড় হয়ে প্রণাম করে। আমিও। তোমার সিংহবাহিনী কই গো? দেখছি না তো।

এরই মধ্যে আছে কোনোখানে। এতদূর থেকে ভালো দেখা যায় না। এইটুকুন ঠাকুর তো। আমি বলি : সিংহবাহিনী তো দুর্গাই। মা দুর্গারই একটা নাম সিংহবাহিনী। আমি এখানে মন নিয়ে এসে মার কাছে কি প্রার্থনা করলাম এখন জানিস।

কী?

আমি যেন রামের মতন রাজা হই।

রাজা হবে? রাজা হবে তুমি? রাজা হয়ে কী করবে?

সিংহাসনে বসব ঐরকম। তুই সীতা হয়ে আমার পাশে বসবি, আর আমার ভাই সত্য লক্ষণ হয়ে ছাতা ধরে থাকবে আমার মাথায়। আর হরিটা হনুমান হবে।

হরি আবার কে?

আমাদের ছোট ভাই। মামার বাড়ি থাকে কলকাতায়। দিদিমার ন্যাওটা কিনা। দিদিমা ভারী ভাললাবাসেন তাকে। তাঁর কাছেই থাকে। আমি জানাই–সে হনুমানের মত হাত জোড় করে থাকবে আমাদের সামনে।

হনুমানের মতন ল্যাজ আছে ওর?

নেই, তবে ল্যাজ হবে-হয়ে যাবে ল্যাজ।–তুই দেখে নিস।

যা, তারও ল্যাজ হয়েছে আর আমিও সীতা হয়েছি! রিনি হাসতে থাকে।

.

১২.

আরতি দেখে ফিরতে একটু রাতু হল। মা বললেন, কি রে, এত দেরি করলি যে। খাবার সময় হয়ে গেল, পড়তে বসবি কখন? সামনে তোর পরীক্ষা না?

পরীক্ষা কিসের মা। প্রমোশন তো সামনে।

পাশ করেছিস?

কবে! পরীক্ষার ফল জানা হয়েছে, এক অঙ্ক ছাড়া আর সব বিষয়েই ভালো মতন পাশ। জানালাম : বাংলায় তো ফার্স্ট হলাম।

বলিস কি রে! পড়লি না টড়লি না, বাজে বই পড়ে সময় কাটালি, পড়ার বই ছুঁলি না পর্যন্ত। পাশ করে গেলি! মা হতবাক।

তোমার আশীর্বাদে। আমি জানাই : তুমি যে প্যাঁচ শিখিয়ে দিয়েছ না, তাই কষেই তো তরে গেলুম এ যাত্রা। বরাবর এই করেই তরব আশা করছি…কোশ্চেন সব আউট করলাম যে।

সে কি রে! কোশ্চেন আউট করলি কি? অ্যাঁ? মা হতবুদ্ধি-আমি আবার কী প্যাঁচ শেখালুম তোকে।

ঐ যে! ভুরুর মধ্যেখানে মন এনে মা দুর্গাকে ডাকতে–পরীক্ষাতেও সেই ভুরকুটি দেখিয়েছি। ঐ করে কোশ্চেন সব বার করেছি। তাই আমাকে আর কষ্ট করে পড়তে হয়নি, পরীক্ষা পাশ করতে হয়নি, এমনি করেই পরীক্ষার পাশ কাটালাম। পরীক্ষাই আমায় পাশ করে গেল এবার।

শুনি তত ব্যাপারটা। মার আগ্রহ দেখা যায়।

এইরকম আর কি, আমি বিশদ ব্যাখ্যা করে দিই, চোখ বুজে ঐ সন্ধিস্থলে, নাকি সন্ধিক্ষণে- মন নিয়ে আসি আর মা দুর্গার নাম করে একটা বইয়ের একটা করে জায়গা বার করি–এমনি করে পাঁচবার করার পর সেই সব জায়গার দুদিকের পাতার, মোট দশ পৃষ্টার সবখানি দুরস্ত করে রাখি, তার পরে দেখা গেল ঐ দশ পৃষ্টার ভেতর থেকেই বেশির ভাগ প্রশ্ন এসে গেছে। পাশ করার মতন নম্বর পেয়ে গেছি তাইতেই।

এই করে পাশ করেছিস তুই? মার মুখে রা সরে না।

হ্যাঁ। এই করে ইংরেজি বাংলা ভূগোল ইতিহাস সব, শুধু অঙ্কটাতেই সুবিধে হল না মা। পইত্রিশ পেয়ে টায়েটুয়ে কোনোরকমে পাশ।

মোটে পঁইত্রিশ?

হ্যাঁ, সব অঙ্ক জানা ছিল না তো। একটা বড় যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের অঙ্ক, একটা ডেসিমেলের, ফ্র্যাকশনের আক একটা,আর ঐ সিঁড়ি ভাঙা একখানা কষতে পেরেছি কেবল। জিয়োমট্রির একটা থিয়োরেমও করেছিলাম কিন্তু তার জন্য মাত্র আদ্ধেক দিয়েছে।

আদ্ধেক কেন?

আমি এখানে মন নিয়ে এসে মনগড়াভাবে সেটাকে মিলিয়ে দিয়েছিলাম কি না। অঙ্কের স্যর বললেন যে আমি যেভাবে প্রুভ করেছি তাও হতে পারে বটে, তবে বইয়ের মতনটাই ফলো করতে হবে আমাদের। সেই কারণে তার জন্যে পুরো নম্বর দেননি।

বাকী অঙ্কগুলো তোর জানা ছিল না কেন? ঐখেনে মন নিয়ে এসে চেষ্টা করিসনি কেন জাবার?

করেছিলাম। বের করেছিলাম দশটা পাতা, তার ভেতরের আঁকও এসেছে হয়ত বা, এসেছে কি না তাও জানি না, আসতে পারে হয়ত–কিন্তু ঐ অঙ্কগুলো তো আমার জানা ছিল না, কষিনি তো আগে।

কেন, কষিসনি কেন? আর জেনে তখন-তখনি বা কষে নিলি না কেন–ঐ অঙ্কগুলো?

কী করে করব? আগের অঙ্ক না জানা থাকলে, কষে না রাখলে পরের অঙ্ক কি করা যায় নাকি? এ তো আর তোমার মুখস্থ করা নয় যে মুখস্থ করে রাখলেই হবে-স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাবার ব্যাপার। আগের অঙ্কগুলোই করিনি যে।

অঙ্কের মাস্টার ক্লাসে হোম টাস্ক দেন না তোদের? দেখাতে হয় না প্রত্যেক দিন?

হয় বইকি। সে আমি ম্যানেজ করি। আমি বলি, কাবিল হোসেন আমাদের ক্লাসের ফাস্ট বয়, আমার খুব বন্ধু। হোমটাসূকের অকগুলো আমার খাতায় কষে দেয় সে রোজ রোজ-তাই আমি সেকেন্ড মাস্টারকে দেখিয়ে দিই। প্রতিদানে কাবিলকে আমি মাঝে মাঝে রসগোল্লা খাওয়াই বাণিজ্যার দোকানে।

তাই নাকি রে?

হ্যাঁ। তবে সেও খাওয়ায় মা আমায়। তাদের হোটেলে মুর্গি-টুর্গি হলে ডেকে নিয়ে খাওয়ায়।. মুগি খাওয়া কি খারাপ মা? মুসলমানের খেলে কি জাত যায় আমাদের?

পাগল। হিন্দু মুসলমান আবার কী? জাত বলে কিছু নেই রে! তবে গোরু টোরগুলো প্রাসনে যেন কখনো।

না, তারাও খায় না। আমরা মনে কষ্ট পাব বলে কাটেও না তারা। মাকে আমি ভরসা দিই–আমি তাকে তোমার ওই মা দুর্গার প্যাঁচটা শেখাতে গেছলাম, সে বললে যে, তাদের ওটা করতে নেই। আল্লা ছাড়া আর কোনো দেবতাকে ডাকলে তাদের গুণা হয়। সে বললে বিসমিল্লার কাছে প্রার্থনা করলেও সেই ফলই পাওয়া যাবে–বিসমিল্লা হের রহমানে রহিম-এই মন্তর বলে চাইতে হয় নাকি। তা কি হতে পারে মা?

কেন হবে না? এই তো সব। সব তো একই। সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে সেই ভগবান-সেই কেন্দ্রস্থলে মন নিয়ে যেতে হয় কেবল, তাহলেই হলো। এখন, যে মন্তরে, যা বলে ডেকে সেখানে তুমি যাও না কেন! আসলে সেই একই জিনিস–এক ভগবান। বিসমিল্লা আর দুর্গা এক–সেই এক বিন্দুবাসিনী।

বিসমিল্লা হের রহমানে রহিম আর মা দুর্গা এক? কথার হেরফের কেবল? আচ্ছা, যেমন করে এখানে মন এনে কোশ্চেন জেনে পাশ করলাম তেমনি করেই তো ফাস্টও হতে পারি আমি?

তা কি করে হবে? পড়াশুনা না করে-পাঠ্যবইদের বিলকুল ফাঁকি দিয়ে? তা কি হয় নাকি রে? মা বলেন, যে ছেলেরা রীতিমতন খেটেখুটে পড়ছে তাদের ভেতর থেকেই ফার্স্ট হবে, তুই শুধু কোনোরকমে পাশ করে যাবি কেবল।

তা কেন মা?

সাধনা না করলে কি সিদ্ধি হয় রে? যে ছেলেটা খেটে পড়ছে সে যদি মা দুর্গাকে নাও ডাকে তবুও সেই ফাস্ট হবে–তার ঐ খাটুনিটাই তো আসলে ভগবানকে ডাকা। আর যদি খাটেও আবার সেই সঙ্গে সঙ্গে ডাকেও–তাহলে সে কোথায় গিয়ে উঠবে বলাই যায় না। উন্নতির চূড়ান্ত হবে তার আর এইভাবে ফাঁকি দিয়ে তরতে গিয়ে তোর তলিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু যেহেতু ঐ মাকে ডেকেছিস, তাই তুই ডুবে যাবিনে একেবারে, শুধু ভেসে থাকবি কোনোগতিকে। সারাজীবন এইভাবে ভেসে ভেসেই কাটবে তোর।

ভাসা ভাসা জীবন হবে? তুমি বলছ?

আমি কিছু বলছি না। সেটা মার ইচ্ছে। তবে জেনে রাখিস্ সাধনা না করলে কোনই সিদ্ধি হয় না। যেমন তোর ওই অঙ্কের মতন। কী অঞ্চগুলো আসবে জানতে পারলেও কষতে পারলিনি–স্টেপ বরাবর এগুসনি বলে। ওই স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে সাধনা। ফাঁকতালে কিছুই মেলে না রে, অমনি করে এগিয়ে গিয়েই পেতে হয় সব।

অঙ্ক যে আমার একদম ভালো লাগে না মা।

তাহলে কি করে হবে রে। তবে কি করে এখান থেকে উৎরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকোঠ ডিঙোবি? আর তা না হলে…তের বাবা যে তোকে বিলেত পাঠাতে চায় রে। সেখান থেকে আই-সি-এস পাশ করে আসবি তুই। জজ ম্যাজিস্ট্রেট হবি। তোকে সিভিলিয়ান দেখার স্বপ্ন যে তাঁর অনেক কালের। খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাচ্ছেন সেই জন্যে।

আমি চাই না জজ ম্যাজিষ্ট্রেট হতে। ওসব হতে ভাল লাগে না আমার। কী হয় ওসব হয়ে? ওই তোমাদের এক বিচ্ছিরি শখ মা। ছেলেদের সব সিভিলিয়ান করার মতলব। বামুনপাড়ার আদ্ধেক ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বসেছে-বসে বসে পড়তে লেগেছে সবাই। তাদের বাবাদের শখ সিভিলিয়ান করার। হকিম মুনসেফ উকীল ব্যারিস্টার ডাক্তার সাবরেজিস্টার হবে। বাবার শখ মেটাতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা।

সেটা কি খারাপ? মা বলেন : ভালোই তো। তাদের নিজেদের পক্ষেই তো ভালো।

ভালো না ছাই! ওসব হতে চাই না আমি। আমি চাই আমি হতে। তা কী করে হওয়া যায় যে…!

ভেবে কোন কূল পাচ্ছিসনে তার?

পেয়েছিলাম তোত একটা কূল-তোমার কথায়। এখেনে মন এনে মা-দুর্গার কাছে চেয়ে চেয়ে আমার কাজ বাগাতে। তুমি তো বলছ যে কেবল তাতে হবে না। শর্টকাট করলে চলবে না, সারা পথটা হাঁটতে হবে–হেঁটে হেঁটে সারা হতে হবে আমায়। কিন্তু তা কি করে হয়? অমনতর হটবার আমার ক্ষমতা নেই। ইচ্ছেও করে না আমার।

তাহলে আর কি করে হবে। মা সান্ত্বনা দেন-তবে খুব বড় হলেও কিছু একটা হবি। কিছু কিছু হবে তোর। ভিকে-শিকে করে যা হয়। ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ-বলেছে না? ভগবানের কাছে ভিক্ষে চাইলেও প্রায় সেই কথাই। তবে এরই মধ্যে একটুখানি ইর বিশেষ–এই যা।

কেবল প্রার্থনা করে মেলে না কি মা?

চাইতেও হবে, চেষ্টাও করতে হবে–তবেই হবে ষোল আনা। চাই কি, তার চেয়েও বেশি হতে পারে। চেয়ে চেয়ে এগুতে হবে–এগিয়ে গিয়ে আগাবার পর চাইতে হবে–তবেই হবে পথ চলা। পথ চলাটাই তে আসল রে। গন্তব্যস্থল কোথাও নেই।

কী মুশকিল। কী মুশকিল।

মুশকিলটা আবার কোনখানে?

আমি ভেবেছিলাম তোমার সিদ্ধি আমার কাজে লাগাব। তোমার ঐ প্যাঁচটা কষে যা হবার হতে পারব–যা যা চাইবার, যা পাবার পেয়ে যাব সব-এখন দেখছি…

আমার আবার সিদ্ধি কি রে? মা একটু বিস্মিতই।

তুমি তো সিদ্ধিলাভ করে বসে আছ, ভৈরবী বলছিল আমায়।

ভৈরবী তো সব জানে! হাসতে থাকেন মা : ওই সব আজেবাজে কথায় কান দিস তুই! বিশ্বাস করিস?

বা রে। ফল পেয়েছি যে! না পড়ে পাশ করে গেলাম কি করে তাহলে?

ও কিছু নয়। এক-আধবার ওরকম হয়ে যায়। কখনো আবার হয়ও না। কেন যে হয়, কেন যে আবার হয় না তা আমি জানি না। মনে হয়, তুই যে একবার বলেছিলি না? মা কালী একটুখানি খামখেয়ালী, তাই হয়ত এর কারণ হবে।পরমহংসদেবের কথামৃত পড়তে দিয়েছিলাম যে তোকে? পড়েছিলিস?

পাঁচ খন্ডই। কবে শেষ করেছি।

কী বলেছেন তাতে ঠাকুর? এরকমটা হলেও এটা হওয়াতে নেই। এটা একটা ছোটখাট সিদ্ধাই-বুঝেছিস? ঠাকু সিদ্ধাইয়ের বিরুদ্ধে, সেটা টের পাসনি?

পেয়েছি। কিন্তু তিনিই তো আবার বলেছেন যে গুরুকেও বাজিয়ে নিতে হবে? বলেননি? বাজিয়ে না দেখলে সিদ্ধাই কিনা বুঝব কি করে?

তাই কি তুই ই সিদ্ধাইটা বাজিয়ে দেখছিস নাকি?

যদি বলি তোমাকেই। তোমাকেই বাজিয়ে দেখছি আমি। মার চেয়ে বড়ো গুরু তো নেই আর, ভৈরবীর কথা। তুমি তো আমার পরম গুরু।–তাই তোমাকেই তার মানে, তোমার কথাটাকেই বাজাতে লাগলাম। তোমার ওই সিদ্ধাইটাকেই

আমার আবার সিদ্ধাই কিসের।

সিদ্ধাই না বলে যোগ যদি বলি? তোমার যোগবল?

আমি আবার যোগ করলুম কবে রে?

যোগ না করলে তুমি এই কৌশলটা জানলে কি করে তবে? বাবা যে বলেন, যোগ কর্মসু কৌশলম, মানে যে, যোগ হচ্ছে গিয়ে কাজ করার কৌশল, সেটা কি মিথ্যে?

না না, মিথ্যে কেন হবে? শাস্ত্রবাক্যই।

আমি কেবল সেই কৌশলটাই কাজে লাগাচ্ছি তো। ছলে বলে কৌশলে কার্যোদ্ধার করতে হয় না? তাই এই কৌশলেই কাজ হাসিল করছি আমার।

শুনে মা গুম হয়ে যান-কিসের ভাবনায় যেন তাকে কাতর করে : মনে হচ্ছে আমিই তোর সর্বনাশ করলুম বুঝি। তোকে এই প্যাঁচটা শিখিয়ে দিয়ে…যা মা-ই তোকে বাঁচকেন শেষ পর্যন্ত। তাঁর পায়েই তো ফেলে দিয়েছি তোকে।

তুমি কি ব্রহ্মকে জেনেছ মা? আমার আচমকা জিজ্ঞাসা। শুনে মা যেন মকে যান–ব্ৰক্ষ? ব্রহ্মকে কি জানা যায় নাকি? জানতে পারে কেউ?

তুমি জেনেছ।

পাগল! জানলেও কি কেউ কাউকে তা জানাতে পারে? ব্ৰক্ষকে কেউ মুখের থেকে বের করতে পেরেছে কখনো? ব্রঙ্ক অনুচ্ছিষ্ট বলেননি ঠাকুর? কী পড়লি তবে সেই কথামৃতে? ব্রহ্মকে মুখের থেকে বার করা যায় না, নিজে তার স্বাদ পেলেও অমৃততুল্য সে সোয়াদ ভার কাউকে দিতে পারে না কেউ কখনো…

হ্যাঁ পারে। ব্রহ্ম কী তা জানিনে, তবে তার সোয়াদ অপরকে দেওয়া যায় জানি। রিনি একদিন দিয়েছিল আমাকে।

রিনি? তাই নাকি? কী রকমের ব্রহ্ম শুনি তত একবার? কেমন তার সোয়াদ?

সন্দেশ। আমি জানাই। রিনির মুখের থেকে বের করা অমৃত অংশটুকু উহ্য রেখে, ব্রহ্মস্বাদের পনের আনাই বাদ দিয়ে মুখ্য খববের, না, খাবাবের এক আনাটাক ব্যক্ত করি।

সন্দেশ! সন্দেশই বুঝি তোর কাছে ব্ৰহ্ম রে? ব্রহ্মস্বাদ সহোদর ঐ সন্দেশ? বটে বটে? হাসতে থাকেন মা–তবে সেই সন্দেশ নিজে না খেয়ে পিঁপড়েদের খাওয়াতে যাস কেন? তাদের গর্তে-গর্তে রেখে আসিস যে?

সব ভালো জিনিসই সবাইকে দিয়ে খেতে হয়, তুমিই তো বলেছ মা! বিলিয়ে না দিলে ভগবান মিলিয়ে দেন না। এমন কি, তোমার এই প্যাঁচটাকেও আমি অনেক ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছি। সবাই মিলে মা দুর্গাকে জব্দ করুক না। আমি একাই কেন মজা লুটি! তারাও ভগবানের সাহায্যে উৎরে যাক–কার্যোদ্ধার করুক। তোমার ঠাকুর বলেছেন না?…

কী বলেছেন ঠাকুর?

বলেছেন গুরুর মত হাঁড়ি কলসিকেও বাজাতে হবে, নাকি, আঁড়ি কলসির মত গুরুকেও বাজিয়ে নিতে হবে? ভগবানের চেয়ে তো গুরুতর আর কিছু নেই। তাই হাঁড়ি কলসির মতই ভগবানকেও আমি বাজাতে লেগেছি। চাই কি, ভগবানের এই হাঁড়ি হাটেও একদিন

আমি ভাঙতে পারি হয়ত।

সে কি রে।

তাই। ভগবানকে আমি কাজে লাগাতে চাই না। যে ভগবান আমাদের নিত্যকার কাজে লাগবে না, সে-ভগবানে আমাদের কী কাজ মা?

.

১৩.

ভগবানকে কাজে লাগাবি কি রে! ভগবানের কাজে লাগবি তো। আমার কথায় মা হতভম্ব হন। ভগবানের কাজের জন্যেই আমরা এসেছি তো…তার সেবার জন্যেই।

ভগবানের সেবার জন্যেই সবাই? আমি শুধাই: তাঁর সেবা করা ছাড়া আর আমাদের নিজেদের কোনো কাজ নেই?

আবার কী কাজ? তাঁর সেবা তাঁর উপাসনা করাটাই তো মস্ত কাজ। তা ছাড়া আর সমস্ত কাজ? সেবা করাটা আবার কি রকম? উপাসনা কাকে বলে?

উপাসনা মানে তাঁর কাছে বসে থাকা, তাঁর কাছে বসে তাঁর কথা শোনা, তাঁর নামগান। করে তাকে শোনানো।

আর সেবা মানে তো গিয়ে ভোগ দেওয়া? তাই না মা? আমাদের নিজেদেরকেই কি ভোগ দেব তাকে? নাকি, নিজেদের যত ভোগ…? যত না কর্মভোগ…?

সেবা বল পূজা বল ভালোবাসা বল–তাঁকে ভালোবাসার জন্যই আমাদের জন্মানো। তিনি যে ভালোবাসার ধন।

ভগবানকে ভালোবাসব কী মা? তাঁর কথায় আমিও কম অবাক হইনে : ভগবানকে কি ভালোবাসা যায়? যার ধারণাই করতে পারিনে তাকে আমরা ভালোবাসব কি করে?

ভালবাসা যায় না ভগবানকে?

একটা পিঁপড়ে কি একটা হাতিকে ভালোবাসতে পারে? হাতী যে কী, তা তো সে টের পায় না কোনদিন। তার গায়ে হেঁটে চলে বেড়ালেও, তার পায়ের তলায় চাপা পড়লেও নয়। হাতি ও পিঁপড়ের ঠাওর পায় কি না কে জানে!

পায় না? তুই বলছিস?

হাতীর পক্ষেও একটা পিঁপড়েকে ভালোবাসা অসম্ভব। আর পিপত্রে ভালোবাসা পেতে হলে, কি পিঁপড়েকে ভালোবাসতে হলে তোমার হাতাঁকে ওই পিঁপড়ে হয়েই জন্মাতে হবে আমার মনে হয়।

তাই তো জন্মায় রে। ভগবান মানুষ হয়ে জন্মান তো সেই জন্যেই। তাঁর অবতার হওয়া তো সেই হেতুই।

তাই কল মা। তিনি মানুষ হয়ে জন্মেছেন…জন্মাচ্ছেন…আমাদের ভালোবাসা পাবার লালসায়। আমি তো সেই কথাই কইছি মা। …ভগবানকে ভালোবাসাই যায় না। মানুষকেই কেবল ভালোবাসা যায়, কারণ মানুষকে আমরা বুঝতে পারি, তার ভালোবাসাও টের পাই আমরা।

একই কথা। মানুষকে ভালোবাসাও সেই ভগবানকেই ভালোবাসা।

আর, মানুষের ভালোবাসাও সেই ভগবানেরই ভালোবাসা–তাই বলছ তো? আমি হাঁফ ছাড়ি : আর রিনির ভালোবাসা আমার কাছে তাই ভগবানের ভালোবাসাই।

কী বললি? মা চকিত হন।–কার ভালোবাসা বললি?

বলছিলাম যে এই জন্যেই আমরা ভগবানের ভালোবাসার কাছে ঋণী। মানুষের এই ভালোবাসার জন্যেই। এবং তাঁরও এত কষ্ট করে মানুষ হয়ে জন্মে মানুষের মারফতে অন্য মানুষকে ভলোবাসার জন্যে এমন দুঃখ পোহানো–এই ত্যাগস্বীকার–তার জন্য আমরা ঋণী নই কি?

ঋণী বই কি। আর তিনিও তো আমাদের ভলোবাসার স্বাদ পাবার জন্যেই মানুষ হয়ে জন্মান। এই কারণেই তো তাঁর অবতার হওয়া।

অবতার না হয়েও তো তিনি তার মানুষ হয়ে জন্মেছেন–জন্মাচ্ছেন এখনো, যত খুশি তোমরা ভালোবাসো না! যাকে খুশি তাকে। তাই না মা? আমি বলি-কিন্তু আমরা মানুষকে না ভালোবেসে তাঁকে ভালোবাসতে গিয়ে তাঁর সেই স্বাদে বাদ সাধছি কেবল। তাই নয় কি মা?

মানুষকে ভালোবাসলেও সেই তাঁকেই ভালোবাসা হয় রে। মা বলেন, আর ভগবানকে ভালোবাসাও … .ঠাকুর বলেছেন …

অত ঘুরে আমার নাক দেখতে যাব কেন মা? নাকের সামনেই তো মানুষ। সোজাসুজি মানুষকেই ভালোবাসব …মানে রিনিকেই মানে কিনা, যার ভালোবাসায় আমি ঋণী…যার কাছে ভালোবাসার স্বাদ পেলাম প্রথম, সেই মানুষকেই।

ঠাকুরের কথাটা হোলো…

তোমার ঠাকুর যাই বলুন না মা, তাঁর কথায় আমি বাধা দিই-ঠাকুরের বিবেকানন্দ কিন্তু কোনোখানেও ভগবানকে ভালোবাসার কথা বলেননি, মানুষকেই ভালোবাসতে বলেছেন। পড়লাম তো কতো বই-ই তাঁর, কিন্তু কোথাও না। ভগবানকে ভালোবাসবার কথাই নেই।

বলেননি তিনি কোথাও?

কোথায়! তিনি তো বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেই জন, বলে আমি তকনি বিবেকানন্দ আওড়াতে যাই।

কোথায় পেলি বিবেকানন্দের বই? পড়লি কবে?

আমার জীব বার করার আগেই মার বাধা পাই। নিজীবের ন্যায় বলি-কলিগায়। কোনা-দার ভারতীভবন লাইব্রেরীর থেকে নিয়ে। তাঁর পাঠাগারে কতো রকমের বই আছে যে! বিবেকানন্দের বই, অশ্বিনী দত্তের ভক্তিযোগ, এমনি সব ভালো ভালো বই। যতো কর্মবীরদের জীবনী। মানে সেই সব বই যা পড়লে নাকি মানুষ হওয়া যায়…গল্পের বই নয়, প্রবন্ধের বই যতো। সেখান থেকেই নিয়ে পড়েছি আমি।

বিবেকানন্দের কথাটা তুই বুঝিসনি ঠিক। ভগবানকে না ভালোবাসলে মানুষকে ঠিক ভালোবাসা যায় না।

ভগবানকে তো ভালোই বাসা যায় না মা!…..ভগবানকে ভালোবেসে কোনো সুখ নেই।

সুখ নেই? বলিস কি রে তুই? ভগবানকে ভালোবাসলে তোর মানুষের ভালোবাসার চাইতে সহস্রগুণে সুখ, তা জানিস? ঠাকুর বলেছেন …

তোমার ঠাকুর যাই বলুন না মা, তাঁর কথায় আর কাজে কোন মিল নেই–আমি বলব। ভগবানকে ভালোবেসেই যদি এত সুখ তবে তিনি শুধু তাই নিয়ে না থেকে মানুষকে ভালোবাসতে গেলেন কেন আবার? তিনি তো মা কালীকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেনও হমুদ্দ, তবে তিনি তাঁর ভালোবাসাতেই তৃপ্ত না হয়ে বিবেকানন্দকে নিয়ে মত্ত হতে গেলেন কেন? মা কালীতেই না মশগুল থেকে তাঁর কাছে নরেনকে এনে দাও, নরেনকে এনে দাও বলে কান্নাকাটি লাগিয়েছিলেন কেন? নরেনতো একটা বাচ্চা ছেলেই তখন। প্রায় আমার মতই হবে। আমি জানাই : মা কালীতেও তাঁর আশ মিটলো না। তাই তাকে পাবার পরেও একটা ছেলের জন্যে তিনি পাগল হলেন শেষটায়।

মা কালীর জন্যেও কি তিনি বালিতে মুখ ঘষেননি একদিন?

তা ঘষেছিলেন। কিন্তু বালিবধের পর হনুমানকে নিয়েই মজে গেলেন তো সেই। সুরেশ সমাজপতির মতন তাঁর সমালোচনা আমার। তার আগের জন্মে যেমনটা ঘটেছিল প্রায় তেমনটাই।

আগের জন্মের…হনুমানকে নিয়ে মজলেন। মা ঠাওর পান না ঠিক।

মজলেন না? যিনি রাম যিনি কৃষ্ণ তিনিই তো সেই রামকৃষ্ণ? তাহলে যিনিই বিবেকানন্দ তিনিই সেই হনুমান। আমার অনুমান ব্যক্ত করি, অবশ্যি আমার মতন হনুমান না, আমাকে তুমি যে হনুমান বলল সে হনুমান নয়, আমার ন্যায় দুর্বল নয়, হনুমানের মহাবীর সংস্করণ। মানে, বলছিলাম কি, আমার ব্যাখ্যা প্রকাশ করি-হনুমান যেমন সমুদ্রমন করেছিলেন, বিবেকানন্দও তেমনি কি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে একালের স্বর্ণলঙ্কা আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার রাক্ষসদের তাক লাগিয়ে দেননি? হনুমান যেমন শ্রীরামের বাহ্ন, বিবেকানন্দও তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের বাহন তো? তাঁর ভাবধারা বহন করে নিয়ে গেছলেন সেখানে। আসলে এটাকে–এই ক্রিশ্চান মুলুকে গিয়ে তোলপাড় করাটাকে আমি তাঁর লঙ্কাকান্ড বানোই বলব মা। তোমার ঠাকুর যেমন কুরুক্ষেত্র কান্ড বাধিয়েছিলেন তাঁর আগের জন্মে কৃষ্ণষ্ঠাকুর হয়ে…যিনি রাম যিনি কৃষ্ণ তিনিই শ্রী…

তোর কথা শুনলে আমার মাথা ধরে। গোঁজামিলের কথা রাখ তো। এলোমেলো কথা যত তোর। এসব কথা থাক, তোর বইখাতা নিয়ে আয় দেখি। পড়াশোনাটা কেমন হচ্ছে দেখা যাক একবার।

খাতাপত্তর নিয়ে আসি সব। উলটে-পালটে দেখে মা বলেন-অঙ্কের খাতাটা কই? দেখছি না তো এর ভেতরে।

বলেছি না তোমায়? মাতৃ অঙ্ক ছাড়া আর অন্য কিছু আমি জানি না। অঙ্কট একদম আসে না আমার।

তাহলেও খাতা একটা থাকবে তো? গেল কোথায়?

কাবিলের কাছে আছে। বলেছি না, আমার বন্ধু মহম্মদ কাবিল হোসেন আমার খাতায় প্রতিদিনের আঁকগুলো সব উতরে দেয়, তাই সে খাতাটা ইস্কুল থেকে নিয়ে যায়, পরদিন আবার নিয়ে আসে ইস্কুলে ঠিকঠাক করে। আমার আকে খাতার মোকাবিলা সে-ই করে।

দেখি তোর কম্পোজিশনের খাতা তবে। ট্রান্সলেশনের খাতাটা দেখি।

ওই তো আছে। তোমার সামনেই তো।

এসব কী লিখে রেখেছিস খায়?

দ্যাখো না।

গদ্যপদ্যের ছড়াছড়ি দেখছি। এসব কী আবার? কিসের মহাভারত?

মহাভারত নয়, রামায়ণ।

রামায়ণ! মা যেন আকাশ থেকে আছাড় খান।

পড়ে দ্যাখো না, কেমন আমি রামায়ণ লিখলাম।

রামপেসাদী কাভ বাধিয়েছিস যে? তিনি যেমন হিসেবের খাতায় মায়ের গান ফেদে ছিলেন, দে মা আমায় তবিলদারি-র গান বেঁধে রেখেছিলেন, তুইও তাই করেছিস দেখছি।

শিবপ্রসাদের ছেলে হয়ে সেটা কি খুব বেহিসেবী হয়েছে মা? বাবা তো পদ্যটদ্য লেখেন, বইও ছাপিয়েছেন সেই সব নিয়ে, আমিও প কৃত্তিবাসের তহবিল তছরূপ করেছি মা। কৃত্তিবাসের মতন আমিও রামায়ণ লিখছি একখানা।

দেখি তোর কান্ডটা। পাতাগুলোর ভেতর দিয়ে ওপর ওপর চোখ বুলিয়ে যান মা।

একটা কান্ড হয়নি এখনো। আমি জানাই : সাতকার সবটাই বাকী। মাঝে মাঝে লিখে গেছি খানিক খানিক। যখন যেখানটা আমার মনে ধরেছে লিখে রেখেছি। আরো আমি বিশদ করি- তবে সপ্ত কাভের শেষ কথাটি আমি লিখে রেখেছি আগেভাগেই।…এই যে! এই পাতাটায় দ্যাখো না!

মা দেখলেন, তার পরে শুরু করলেন সুর করে :

সুপণ্ডিত শিবরাম বিচক্ষণ কবি।
সপ্তকান্ডে গাহিলেন রামায়ণ সবি।।

আওড়াবার পর মার সে কী হাসি। মার এরকম হাসি, এমন উচ্চস্য এর আগে আমি কখনো শুনিনি।

হাসির চোটে আমি রীতিমতন চোট খাই। ঘাবড়েও যাই বেশ। অপ্রতিভের মতন কই-ভালো লাগল না বুঝি তোমার?

কিসসু হয়নি তোর। কৃত্তিবাসের কথাগুলোই উলটে পালটে বসিয়ে দিয়েছিস–তার লেখাই আরেক রকম করে সাজিয়েছিস। তাঁর পয়ারের ভেতর থেকেই মিল টেনে এনে মিলিয়ে দেওয়া কেবল। এই যেমন তোর শেষ ছত্রটাই ধর না– কৃত্তিবাসের রয়েছে-কৃত্তিবাস পন্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ-সপ্তকান্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ। তুমি বাপু, সেই কথাগুলোই ফের ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছ। ফের ফের তাই দেখছি আগাগোড়া।

আমার ফেরেববাজির কথায় আমার প্রাণে লাগে–কিচ্ছু হয়নি তুমি বলছ?

মার কথায় কান্না পায় আমার, বলতে কি! দেখাবো তোমায়?

কি করে হবে? সাধক না হলে কি এসব লেখা যায় রে? কৃত্তিবাস কাশীরাম–এঁরা মহাপুরুষ, মহাসাধক ছিলেন। মহাভক্ত তাঁরা, ভগবানের কৃপাতেই লিখেছেন, লিখতে পেরেছেন। নইলে কি লেখা যায় নাকি? তুই তা লিখবি কি করে?

তাহলে আমি বৈষ্ণব পদাবলীই লিখব না হয়! ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলি-তাও আমার বেশ আসে। আরেকটা খাতায় লিখেছি…দেখাবো তোমায়?

এইরকম তো হবে, তার দরকার নেই, দেখলে আমার হাসি পাবে আরো। না দেখেই হাসতে থাকেন মা : বৈষ্ণব পদাবলী তুই লিখলি কি করে? তোর বাবার পদাবলী সংগ্রহ পড়ে পড়ে?

না পড়লে কি লেখা যায় নাকি? নিজের সাফাই গাই : লেখাপড়া শিখতে হলে যেমন আগে লেখা তার পরে পড়া, আগে হাতেখড়ি অ-আ-ক-খ যতো লিখে লিখে মরি, তার পরে তো বইটই পড়ি? তেমনি লেখক হতে গেলে আগে পড়া তার পরে লেখা। তাই নয় কি? আমার তো তাই মনে হয় মা। আগে পরের লেখা না পড়লে কেমন করে লিখব? কী লিখব, কিরকম করে লিখব টের পাব কি করে?

কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী কি তাই? পড়লেই কি লেখা যায় নাকি?…তুই কি বৈষ্ণব? কৃষ্ণে ভক্ত কি তুই? সাধন ভজন করেছিস কিচ্ছু কখনো? তা না হলে ওসব লেখার অধিকারী তুই নোস। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, ঐরা গুণী লোক, যেমন সাধক তেমনি ভক্ত, তাই ওই পদাবলী তাঁরা লিখতে পেরেছিলেন। তাঁদের ভক্তির বাধনে বাঁধা পড়েছিলেন ভগবান… যেমন সাধক তাঁরা তেমনি আবার মরমিয়া কবিও।

মরমিয়ার মর্ম তখন আমার মগজে না ঢুকলেও কথাটা আমার মর্মে লাগল বেশ।-তবে আর লিখে কী হবে! আমি যখন পিরবোই না তুমি বলছ। আমি কিন্তু মা, জয়দেবের মতন সমস্কৃত কবিতাও লিখব এঁচে রেখেছিলাম। মর্মান্তিক কথাটা না বলে পারলাম না।

জয়দেব! অ্যাঁ? বলিস কি রে? জয়দেব পড়েছিস নাকি তুই?

পড়ব না, কী মিষ্টি যে! বাবার আলমারিতেই তো রয়েছে-কুমারসম্ভব, শকুন্তলার সঙ্গে। পড়েছিও, বুঝেছিও। সমস্কৃত হলেও বোঝা যায় বেশ, বাংলার মতন সোজাই তো।

তাহলেই বোঝ। বুঝে দ্যাখ তাহলে। কত বড় ভক্ত হলে তবেই না অত বড় কবি হওয়া যায়। তাঁর ভক্তির টানে ভগবান নিজে এসে তাঁর কবিতায় অসমাপ্ত পদ স্বয়ং লিখে সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেছলেন, জানিস তো?

জানি বই কি। স্বরগরলখণ্ডনম মম শিরসি মণ্ডনম দেহি পদপল্লব মুদারম্‌!

আহা! আহা! মার আহাকার-ধ্বনি শোনা যায়।

রাধার মতন অমন আহামরি মেয়ে হলে তেমন পদপল্লবমুদারম করতে সকলেই পারে মা। এমন কি আমিও পারি। সত্যি কথা বলতে কি…

বলতে গিয়ে আমি চেপে যাই। রিনির পদপল্লব নিয়ে নিজের মাথায় না ধরলেও প্রায় তার কাছাকাছি এনে সেই উদারতা আমিও যে দেখেয়েছি সে কথা আর কই না। সে কথা ফাঁস করে নিজের ফাঁসির দড়ি কি কেউ গলায় পরে সাধ করে?

বড্ড পেকে গেছিস তুই! এই বয়সেই। তোর বাবাই তোর মাথাটা খেল-একটুও শাসন করে না তোকে। এমন অনাসক্ত সন্ন্যাসী মানুষকে নিয়ে কি সংসার করা পোয়!

তাহলে আর কী হবে? আমি তো কবি কি লেখক কিছুই হতে পারব না আর। আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে।

পারবি না কেন? তবে কিনা, পরের নকল করে তা হতে পারবিনে। পরের মত করে লিখলে কি হবে? তাহলে চলবে না, নিজের মত করে লিখতে হবে যে। পরের থেকে নিয়ে নয়, নিজের থেকেই হতে হবে তোকে। এই যেমন… মা আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে এক দৃষ্টান্ত নিয়ে আসেন-এই কবি রাজকৃষ্ণ রায়। রাজকৃষ্ণ রায়ের গ্রন্থাবলী পড়েছিস তুই? আছে তো আমাদের। তোর বাবার ঐ আলমারিতেই রয়েছে।

না, পড়িনি তো। এখনো পড়িনি। পড়ে দ্যাখ তো। বাল্মিকীর অনুসরণে তিনিও রামায়ণ লিখেছেন, নানা ছন্দের কবিতায় কিন্তু একেবারে নিজের মতন করে। সাত কাণ্ডের কোনোখানেও কবি কৃত্তিবাসের কোন

অনুকরণ করেননি। যদিও কৃত্তিবাস তাঁর ঢের আগেকার।

করেননি তিনি?

না। করলে তাঁর লেখা কিছুই হত না একেবারে। কিন্তু লিখেও যে কিছু হয়েছে তা নয়! হয়নি কেন জানিস? রামায়ণ বলে কথা! রামের ভজনা না করে শুধু বিদ্যাবুদ্ধির জোরে কি তা লেখা যায়? ভগবানের সাধক না হলে ভগবানের চরিত গাথা গাইবার ক্ষমতা হয় না, রচনাও করা যায় না। তুলসীদাস, কৃত্তিবাস শ্রীরামের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন-তাঁর কৃপাতেই ওই মহাকাব্য লিখতে পেরেছেন। কিন্তু রাজকৃষ্ণ রায় ভক্ত সাধক ছিলেন না তো; লিখলেন বটে রামায়ণ, ভালোই লিখলেন বটে, কিন্তু লিখেও কিছু হল না। তাঁর বই লোকসমাজে চালুই হল না মোটে। অথচ ভারতের ঘরে ঘরে রামচরিতমানস, কৃত্তিবাসী রামায়ণ। এতেই বুঝবি।

মার কথায় রাজকৃষ্ণ রায় নিয়ে বুঝতে বসলাম।

পড়ে দেখলাম চমৎকার লেখা। বিচিত্র ছন্দে রচিত, আশ্চর্য কবিতা সব। নতুন ধরনের মিল দিয়ে, আনকোরা লেখাই। কৃত্তিবাসের ধার-কাছ দিয়েও যায় না, আলাদা রকমের

লেখা, তাঁর চেয়ে আরো ভালো বলেই মনে হেলো, কিন্তু এমন করে লিখেও কিনা…এই। দশাএ-বই কেউ পড়ে না আজকাল? চলে না বাজারে?

কৃত্তিবাসী রামায়ণের পরে এসে লিখতে বসে রাজকৃষ্ণের অমন কীর্তি যদি বাসী হয়ে গিয়ে থাকে তো আমার এই অনাসৃষ্টির দশা কেমনটা দাঁড়াবে তাহলে?

ঘাবড়ে গেলাম বেশ। রাম জন্মাবার ষাট বছর আগে যেমন বাল্মীকির রামচরিত রচিত হয়েছিল, আমার বেলায় সব দিক খতিয়ে দেখে জন্মাবার আগেই আমার রামায়ণ খতম!

.

১৪.

সেই সাংবাদিক ভদ্রলোককে অনেকদিন পরে ফের দেখা গেল আমার ঘরের দোরগোড়ায়।

আইয়ে জনাব! আইয়ে! আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক। বহুদিনের বাদ এলেন। তারপর তো আর দেখা পাইনি আপনার…

তাঁকে দেখে একটু সচকিতই হয়েছিলাম বলতে কি!

তাঁকেও যেন একটু চমকিতই দেখলাম-ওমা? একি! খেতে বসেছেন এই সাত সকালে?

সাত-সকাল কোথায়? এখন তো সাড়ে আট সকাল! একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছি। প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে সবে এসে বসেছি এই বিছানায়–ভাত দিয়ে গেল এক্ষুনি।

এক্ষুনি ভাত? এখন তো আপিসের বাবুরা ভাত খায়, খেয়ে আপিস যায় সব। আপনার তো আর আপিস-টাপিস নেই মশাই।

তা নেই, কিন্তু খিদে আছে। রাতভোর মোটেই কিছু খাইনি তো! সেই রাত নটায় যা খেয়েটেয়ে শুয়েছি…তার পরে এতক্ষণ ধরে তো একটানা উপোস। খিদে পাবে তার দোষ কি!…তাছাড়া…।

তাছাড়া?

তাছাড়া, এই মেসবাড়ির রান্না গরম গরম থাকতেই খেয়ে নেওয়া ভালো। নইলে সে আর মুখে উঠতে চায় না। সেই শুকনো ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত খেতে হলেই হয়েছে।

তা বটে। কিন্তু এই শোবার বিছানার ওপরেই খেতে বসেছেন?

ক্ষতি কী? কাজ তো আমার দুই, খাই আর শুই। এক জায়গাতেই হওয়াটা ভালো নয় কি? এইখানেই খেলাম, খেয়েটেয়ে শুয়ে পড়লাম এইখানেই… নিশ্চিন্তি।

খেয়েই শুয়ে পড়বেন নাকি? এইখেনেই? এখনই?

তাই তো করি মশাই! সারা রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ি যে কহতব্য নয়। ঘুম থেকে উঠে শরীরে বলাধানের হেতু একটুখানি খেতে হয়–কী আর খাব? তাই এই ভাত খাই। কিন্তু এই খাবার ব্যাপারটা! এও এমন পরিশ্রমসাধ্য কাজ যে আবার ক্লান্ত হয়ে পড়তে হয় তাইতেই। সেই ক্লান্তি দূর করতেই আবার ঘুম। ঘুমোতে হয় আমায়। শুয়ে পড়ি ফের তার পরেই।

খেয়েই শোয়া? তার চেয়ে শুয়ে শুয়ে খাওয়াটা সারলেই পারেন!

না ঘুমোলে ক্লান্তি যায় না। আর, খেয়েই এমন ঘুম পায় যে… আমি জানাই–এই খেয়ে নিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে সেই দুপুরবেলায় উঠব…

সেই ক্লান্ত হয়ে উঠবেন তো আবার? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে?

সেই সময় আমার ভাগ্নে রুটি, মাছ, তরকারি ইত্যাদি নিয়ে আসবে তাদের বাড়ি থেকে খেয়েই শুয়ে পড়ব আবার।

আবার ঘুমোবেন?

না, আর ঘুমোব না। তখন একটু কাজটাজ-এই কাগজটাগজ পড়ব। অল্পবিস্তর কাজ করতে হয় সময় সময়। এই সময়টাই তাই করি।

তারপরে কী করেন?

বিকেলে আবার খাবার ব্যবস্থা। কী খাওয়া যায় তার ধান্দা দেখি। কাজু-টাজু বিস্কুট বিস্কুট, ভালোমন্দ যা নাগালে পাই, এই গালে দিই–

দিন-রাত যদি এমনি খালি খান আর ঘুমোন তাহলে লেখেন কখন? লেখেন-লেখেন কখন?

কেন, পরের দিন? আমার সপ্রশ্ন জবাব : পরের দিন তো পড়েই আছে। নেই কি, বলুন?

সে তো চিরদিনই পড়ে থাকে। কোনোদিনই তো আর সে আসে না।

আমার সবই পরের ভরসা মশাই। পরদিনের, পর জনের মানে, ঐ পরি জনের… পরাৎপরের।

পরকাল আপনার ঝরঝরে। হাসতে থাকেন ভদ্রলোক।

ধরেছেন ঠিক। একি, দাঁড়িয়ে রইলেন যে! বসুন। এই বিছানাতেই বসুন-ওপাশটায়। দেখছেন তো অতিথি অভ্যাগতর জন্যে আমার ঘরে কোনো টেবিল চেয়ার কিছু নেই।

সেবারেই দেখে গেছি। এর মধ্যে কোনো শ্রীবৃদ্ধি হয়নি দেখছি ঘরখানার।

বরং কিছু বিশ্রী বৃদ্ধি হয়েছে। জঞ্জাল-টঞ্জাল বেড়েছে আরো একটুখানি। যা গে-এখন বলুন তো কী খবর আপনার। নতুন খবরটবর কিছু আছে?

খবর তো আজকের কাগজে। সে তত আপনি বিছানায় পেতে ভাতের থালা রেখেছেন তার ওপর। দেখেননি কাগজ?

কই দেখলাম। দেখব দুপুরে। তবে এক কাজ করলে হোতো, খাবারটা থালায় না নিয়ে কাগজের ওপর খেলে হোতো-খাওয়াও চলত কাগজও পড়া চলত এক সঙ্গে। খবর আর খাবার একাধারে।

মন্দ হতো না। খেয়েদেয়ে আবার শুয়ে পড়তেন তার ওপরেই।

শুয়ে শুয়ে পড়াও চলত তার ওপর। …বলুন, এখন কী বার্তা নিয়ে এসেছেন এবার?

বলছি দাঁড়ান। কিন্তু তার আগে জানতে চাই আপনি সেবার আমায় ধোঁকা দিয়েছিলেন কেন মশাই?

ধোঁকা?

ধোঁকাই তো। আপনি বলেছিলেন যে ইস্কুল-কলেজের চৌকাঠ আপনি মাড়াননি। অথচ, আপনার এক প্রকাশকের কাছে আপনার খবর নিতে গিয়ে জানলাম আপনি নাকি দস্তুর মতন এম-এ পাশ!

এম-এ পাশ! কী সর্বনাশ! আকাশ থেকে পড়তে হয় আমায়-এমন তথ্য কে প্রকাশ করলেন? কিনি সেই প্রকাশক?

অভ্যুদয় প্রকাশ মন্দিরের অমিয় চক্কোত্তি। এম-এ পাশ, তাও আবার ইংরেজিতে। লীলা মজুমদার আর আপনি এক বছরেই পাশ করেছেন, গেজেটে একসঙ্গে ছাপা রয়েছে আপনার নাম। অমিয়বাবু স্বচক্ষে দেখেছেন।

বটে?…কার লীলা কে জানে! আমি তো জানি ও-খেলা আমি কোনোদিন খেলিনি। ওই পরীক্ষা পরীক্ষা খেলা। ওদের মায়াপাশে না জড়িয়ে পাশ কাটিয়ে এসেছি চিরটা কাল। বলে একটু থেমে যোগ করি : সত্যি বলতে, আপনাকে বেশ ভয় করছে আমার। আপনি যখন আমার এম-এ আবিষ্কার করেছেন, কোনদিন হয়ত আবার আমার মেয়েও বার করে বসবেন।

করেইছি তো, কিন্তু সে কথা পরে। তবে একথা না বলে পারছি না যে, আপনি ভয়ঙ্কর মিথ্যেবাদী।

যা বলেছেন। একটা সত্যি কথা বললেন এতক্ষণে। গল্প লেখার সময় মিথ্যে লিখতে পারি আর কইতে গেলেই যত দোষ?…তবে হ্যাঁ, আমার ছোট ভাই শিবসত্য ইংরেজিতে ডিস্টিংকশন নিয়ে বি-এ পাশ করেছিল বটে। সে-ই পরে হয়ত এম-এ-টাও দিয়ে থাকতে পারে, আমার জানা নেই। তার নামের সঙ্গে আমার নামটা গুলিয়ে ফেলেননি তো অমিয় বাবু? গোড়ায় শিব আর শেষে চকরবরতি দেখেই আত্মহারা হয়েছেন, ভেতরের সত্যটা তলিয়ে দেখতে যাননি কো আর?

তা কি হতে পারে নাকি? এতদূর দৃষ্টিভ্রম?

অসম্ভব কী? তা না হলে ধরুন না…এই সহজ কথাটাই ধরুন। আমার ভাই যেকালে বি-এ পাশ করে ঘাটশিলা হাই স্কুলের হেডমাস্টার হতে পেরেছে সেকালে আমি এম-এ পাশ করলে, তা সে যে বিভাগেই করে থাকি না কেন, যে কোনো একটা মাস্টারি কি জুটিয়ে নিতে পারতুম না? নিদেন একটা সেকেন্ড মাস্টার হয়ে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারতুম না কি? এই থার্ড ক্লাস লেখক হতে যেতাম কোন্ দুঃখে? লেখক হতে কি ভালো লাগে কারো? অন্তত আমার তো লাগে না মশাই!

লেখত হতে চান না আপনি?

একদম না। এই দন্ডে যদি আমি হাজার দশেক টাকা পাই, তো আমার ছোটদের বইগুলোর একটা ট্রা বানিয়ে দিয়ে…ওগুলো তো আর আমার নয়, বাংলার ছেলেমেয়েদের সম্পত্তি…তার প্রকাশ ব্যবস্থাটা করে গঙ্গাস্নান করি গিয়ে আমি। তার পরে একেবারে তোবা তালাক দিয়ে এই লেখাটেখা সব ছেড়ে দিই বেবাক।

বলেন কি?

তাই বলি। কী যন্ত্রনার জীবন যে এই লেখক হওয়া-কী বলব। সাধ করে কি কেউ হতে চায়? নেহাৎ প্রাণের দায়-ও ছাড়া কিছু পারি না তাই। যাক্ গে, সে কথা থাক। এখন বলুন আপনার বার্তাটি কী? সেবার তো আমার কুলের কেচ্ছা নিয়ে এসেছিলেন।

এবার এসেছি আপনার উপকূলকাহিনী নিয়ে।

উপকূল! আবার আমায় হতচকিত হতে হয়।–সে আবার কী মশাই? উপকূল আবার কী?

উপকূল কাকে কয় জানেন না নাকি?

জানব না কেন? নদীর দুই উপকূল থাকে, সেই দুকূলের গভী বজায় রেখেই তাকে বইতে হয়… আমি বলি। আর সাধারণ লোকেরও দুটি কুল থাকে জানি। পিতৃকুল আর মাতৃকুল।

কিন্তু লেখক শিল্পীরা কি সাধারণ লোক? তাঁদের কি কেবল দুকুল হলেই পোয় মশাই?

তা বটে। দুকুলে শুধু সীতা শকুন্তলাকেই শোভা পেয়েছিল, লেখক-টেখকদের একাধিক কুল থাকতে পারে বটে। এতদ্বারা আপনি কি কোনো পরস্বৈপদী পরকীয়া ইঙ্গিত-টিঙ্গিত করছেন?

যা বলেছেন, তাই বটে। কলকাতার চারদিকে আপনার চারটে উপকুলের খবর পেয়েছি আমি… জানি না, তাঁরা আপনার বিবাহিত স্ত্রীও হতে পারেন…

কী সর্বনাশ! এতগুলি নারীর উপনায়ক হয়ত আমি হতে পারি কিন্তু তাদের ভর্তা হওয়া তো আমার পক্ষে অসম্ভব। নিজের ভরণপোষন করতেই আমার প্রাণ যায় তার ওপর এই কান্ড। এমনটা আমি করেছি আমার বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস হয় না?

না মশাই! এতগুলি মেয়েকে বিয়ে করব কি, কোনো মেয়েরই উপযুক্ত আমি নিজেকে জ্ঞান করিনি কখনো। ভেবে দেখলে এদেশের বেশির ভাগ মেয়েরই বেশ দুঃখের জীবন। এদের একটিকে অন্তত আমি সুখী করতে চেয়েছিলাম আমার জীবনে…

কাকে?

যে মেয়েটিকে আমি বিয়ে করিনি। আমার হাতে পড়ে বেচারী অহরহ যে কষ্ট পেত। তার থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি।

বিয়েও করেননি, উপটুপও নেই বলছেন। মেয়ের অভাব কখনো বোধ করেননি আপনি?

বরং উলটো। মেয়ের প্রভাবেই একেক সময় ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়তে হয়েছে আমায়। আমার বাবা ততটা বউ পছন্দ করে নয়, যতটা নাকি সাত শালী দেখে বিয়ে করেছিলেন শোনা যায়–রসিক ব্যক্তি ছিলেন নিশ্চয়। আমি স্বয়ং শালীবাহ হলেও তাইতেই পুষিয়ে গেছল আমার, বাবার উত্তরাধিকার-সূত্রে আমার সাত মাসির সৌজন্যে সাতাত্তরটি কাজিন– রত্ন লাভ করেছিলাম…

সাতাত্তর জন? বলেন কি মশাই?

গুণে গেঁথে দেখিনি অবশ্যি, তবে আমার আন্দাজ। তাছাড়া, আমার নিজের স্বোপার্জিত কাজিনও কিছু ছিল বইকি তার ভেতর…

স্বোপার্জিত কাজিন কী রকমটা?

মনে করুন বন্ধুর মাসে তো ঠিক মার মতই। নাকি তাকে আপনি অন্য কোনো উপমা দিতে চান? তাঁর মেয়েরা, মানে আমার বন্ধুর বোনদের তো. বোনই ধরতে হবে? নাকি

আপনি তাদের উপবোন বলবেন, শুনি?

আমি আর কী বলব।

উপবনই বলুন। কারণ সেখানে সেকালে ফলের কোনো আশা নেই, আকাঙ্ক্ষাও নেই কোনো-উপবনই বলা উচিত। তথায় ফুল ছেঁড়ারও অধিকার নেই আপনার, শুধু ওপর ওপর ঘ্রাণ নেওয়াই কেবল। একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকুগান শুনি গোছের আর কি।

কিন্তু তাতে কি আশ মেটে? কাউকে ষোলো আনা পাবার সাধ জাগেনি কখনো আপনার? কেবল ফুল শুঁকে কে কি দুঃখ যায়? ফল কী তাতে?

মা ফলেষু কদাচন। ষোলো আনার সাধ মেটাতে গেলে ষোলো আনাই যে বরবাদ হয়। যদি কোনো মেয়ের মোল আনা আপনি পেতে চান তো বিনিময়ে তাকে ষোলো আনাই দিতে হবে আপনার-তার চেয়ে এক আনা পেয়েই খুশি থাকা কি ভালো নয়? শত শত একানি পেলে মোটমাট কতখানি দাঁড়ায় ভেবে দেখুন একবার।

ভাবতে গিয়ে তিনি গুম হয়ে থাকেন। উপকূলের খবর নিয়ে এসে এখন বুঝি হিসেবের কূল পান না। এ কানার পাল্লায় পড়ে যোবা মেরে যান বোধ হয়। কিন্তু একটু পরেই তিনি গুমরে ওঠেন আবার

কিন্তু যাই বলুন না মশাই, কলকাতার চারদিকে আপনার যে চারজন রয়েছেন তাঁরা কখনই উপবন নন, তাঁরা আপনার…

উপস্ত্রী? তাই বলছেন তো! তাহলে বলি। বলে আমার পঞ্চ ম-কারের পঞ্চমটিকে ধরে টানি, তাহলেও আপনার হাওড়ার সেই মেয়েটির খবর জানা নেই যাকে নিয়ে আমি হাওয়া হয়েছিলাম একদিন…

তাই নাকি? জানি না তো।

জানবেন কি করে? আমি নিজেই জানতাম নাকি! খবরটা ধরা পড়ল হঠাৎ। আমার এক কিশোর বন্ধু একদিন বিবাহ রেজেস্ট্রি আপিসে গিয়ে খবরটা জেনে এসেছিল। তার এক দূর সম্পর্কের মাসির সঙ্গে আমার এক সুদূর সম্পর্কিত খুড়োর অসবর্ণ বিয়ের নোটিশ দিতে গিয়ে রেজেস্ট্রি আপিসে গিয়ে দেখে এসেছিল যে, সেখানকার নোটিশ বোর্ডে হাওড়ার কোন মেয়ের সঙ্গে এক শিবরাম চক্রবর্তীর বিয়ের নোটিশ রয়েছে। জানলাম তার কাছে-তারপর আমি তার সঙ্গে গিয়ে নিজের চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে এলাম।

দেখলেন আপনাদের বিয়ের নোটিশ?

দেখলাম বইকি! তারপর কিছুদিন বাদ একটু সময় সুযোগ পেতেই হাওড়ার ঠিকানাটায় গিয়ে সেই মেয়েটিকেইও দেখে এসেছি।

কী দেখলেন?

দেখতে নেহাৎ মন্দ নয়। তবে ভারী বিষণ্ণ চেহারা। তাহলেও তেমন মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হওয়া যায় মনে হোলো। কিন্তু বিয়ের সুখ তার কপালে সইলো না…তার বিষণ্ণতার কারণ জানা গেল…

বিধবা হয়ে গেল না কি? বিয়ের পর মারা গেল সেই লোকটা? মানে সেই শিবরাম–

তার চেয়েও খারাপ। পড়শীদের কাছে জানতে পেলাম বিয়ের পর লোকটা মেয়েটির গয়নাগাটি সব নিয়ে উধাও হয়েছে। তার কোনো পাত্তাই নেইকো আর।

তাই নাকি?

তাই তো বললেন, প্রতিবেশী সেই ভদ্রলোক। কে লোকটা, শুধাতে জানালেন কোথাকার কে এক লেখক মশাই এই শিবরাম চক্কোত্তি! গল্পটল্প লেখে-টেখে। বইটই আছে নাকি তার। তার লেখা পড়েই নাকি পটে গেছল মেয়েটা, পস্তাচ্ছে এখন। ফুসলে বিয়ে করে এখন তার যথাসর্বস্ব নিয়ে সে হাওয়া!

আপনারই কান্ড নাকি মশাই?

কে জানে! কোনো লেখকের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। তবে এতদিন আমি মেয়েদেরই অঘটন ঘটনপটিয়সী বলে জানতাম। তাদের ওপরেও যে পটীয়ান লোক থাকতে পারে সে ধারণা আমার ছিল না।

.

১৫.

আমি চারুদার মতন গল্প লিখিয়েই হব না হয়। মাকে আমি বলেছিলাম– কৃত্তিবাসের মত কবি নাই বা হলাম। সেও কিছু কম কীর্তি হবে না মা।

ছেলে-চারুর মত গল্প লিখবি তুই? বলিস কী রে?

পারব না লিখতে? চারুদার ভাতের জন্মকথা বইটা বিস্টুর কাছ থেকে নিয়ে পড়েছি চমৎকার! অমনতর লিখতে পারলেও তো মন্দ হয় না।

তুই কী লিখবি? ডালের জন্মকথা? হাসলো মা : চারুকে তো প্রবাসীর পাতায় পাতায় খি। তোকে তা হলে এরপর ডালে ডালে ঘুরতে দেখা যবে!

ঠাট্টা করছো মা? কেন, ডাল নিয়েও লেখা যায় না কি? ডালও তো কত রকমের হয়। ছোলার ডাল, কলাইয়ের ডাল, খেসারির ডাল, অড়হর ডাল, মুসুরির ডাল, মুগের ডাল…। ছোলা কলার থেকে শুরু করে মুগের ইস্তক ভাঁজতে লাগি।

জানি। ডালের আবার কত পালা, শাখা-প্রশাখা, কত কী! কিন্তু তার খোঁজখবর নিতেও ঢের পড়াশোনা করতে লাগে। চারুর মত বিদ্যা হয়েছে তোর? সে বি-এ পাশ। ডালপালার অতো শতো ফ্যাকরায় না গিয়ে বরং তোর বাপের মতন পদ্য লেখ না কেন!

হ্যাঁ, পদ্য লেখেন বটে বাবা। পয়ার, ত্রিপদী, চতুস্পদী-নানা আকারে, নানান ছন্দে বানানো ছোটখাট অনেক রকম পদ্য লিখেছেন বটে, নিজ ব্যয়ে বই করে ছাপিয়েছেনও সেসব আবার, কলকাতার থেকে ছাপিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন-তা, হাজারখানেক কপি তো হবেই। যে চায়, যে না চায় তাকেও, না চাইতেই বিনামূল্যে বিলিয়ে দিয়ে থাকেন। চাঁচোর আর আশপাশের গাঁয়ে তাঁর বই পেতে বাকি নেই কারও। কবি খ্যাতিও রটেছে নিশ্চয়ই।

নিজের নামেই নামকরণ করেছেন বইটার-শিবপ্রসাদ। নিজে তেমনটা না হলেও তাঁর বইটিকে তিনি স্বনামধন্য করে ছেড়েচেন।

বাবা বললে, সে কবিতাই বা কী আর সেই বনিতাই বা কীসের, পা ফেলার সাথে সাথেই যে হাতে হাতে তোমার মন না কেড়ে নেয়। বেড়ে কথা বলেছিলেন বাবা। পদ্যবিন্যাস মানে মন না মতে যয়া। কথাটার মর্ম বুঝতে আমার একটুকুও বিলম্ব হয়নি। কবিতার পদবিন্যাস কী তখন আমি তা ভালো করে জানি না, কিন্তু বনিতারটা জেনেছিলাম। রিনির পদক্যিাসের সঙ্গে কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দেখেছিলাম সত্যি বটে! বনিতা কাকে বলে কে জানে, কিন্তু অমন মেয়ে না হলে, যে তার পা দিয়েই সহজে যে কারো মন হাতিয়ে নিতে পারে-তার সঙ্গে ছাড়া আর বুঝি বনিয়ে চলা যায় না। আর কেউ তেমন বনবার নয়।

আমার সেই বাল্যকালে বাবার বইটা আমি কয়েক বারই তো পড়েছিলাম, কিন্তু এমনিই আমার বিস্মৃতি শক্তি, এতদিন পরে তার অতগুলো পদ্যর একটাও যদি আমার মনে থাকে।

কেবল তার একটা পদবিন্যাস আমার মনে আছে-যে পদ্যটা সত্যিই আমার মন ভুলিয়েছিল সেদিন। ভারী উপাদেয় পদ!

বাংলার নানান জায়গার কোথাকার কী খাদ্য, কোনখানের কোন খানা খাসা, তার সবিস্তার ফিরিস্তি তাঁর একটি পদ্যের কয়েকটি ছত্রে তিনি ধরে দিয়েছিলেন, তার মধ্যেকার সারাৎসার সেই লাইনটি

চাঁচোরের মানকি কলা সংসারের সার। এখনো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়ে রয়েছে। মনের লালায়িত রসে সজিভ হয়ে এখন।

স্বর্গীয় চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের উদ্ভ্রান্ত প্রেমের (সেই কালেই আমার পড়া) আহা, কী করিয়া বলিব কেমন সেই মুখখানি-র বর্ণনার সঙ্গেই বর্ণে বর্ণে মিলিয়ে বুঝি সেই কলার তুলনা কর চলে। তেমন হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ কলা, মের্তমান জাতীয়ই হবে বোধ হয়, কিন্তু বর্তমানে বিরল) চাঁচোরের বাইরে আর কোথাও আমি পাইনি, খাইনিকো অন্য কোথাও। ফজলি যেমন মালদা জেলার বিশিষ্ট আম (গোপালভোগ, বৃন্দাবনা, ক্ষীরসাপাতি ইত্যাদি আরো সব থাকলেও) তেমনি ঐ মানিক কলা চাঁচোরেরই বিশেষ আমদানি। খানদানি পরিবাররাই খানদান- খান এবং দান করে থাকেন।

বাবার বইটির আরো ছত্র, আমার জন্ম কাহিনীর সঙ্গে জড়ানো বলেই বোধ করি, আমার স্মরণে রয়ে গেছে এখনো–

বঙ্গাব্দ তেরশ দশ প্রাতে রবিবার
সাতাশে অগ্রহায়ণ শিবের কুমার
শিবরাম জনমিল লীলাশ বাজাইল
শিবহৃদে উপজিল আনন্দ-অপার।

লীলাশঙ্খটা কী মা? শুধিয়েছিলাম আমি মাকে : রবিবাবুর কবিতায় লীলা কমলের মতই কোনো জিনিস-টিনিস নাকি? লীলাখেলা করবার?

না রে, তুই যখন জন্মালি না, জন্মানোর সময় শাঁখ বাজাতে হয় তো, তখন যে মেয়েটা তোর জন্মাবার সময় শাঁখ বাজিয়েছিল তার নাম ছিল লীলা। মা জানালেন আর জানিস, তুই যখন হলি না, সূয্যিঠাকুর উঠল ঠিক সেই সময়টায়-একসঙ্গেই এলি তোরা দুজনায়।

সূয্যিঠাকুরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এসেছিলাম বলছ না নিশ্চয়?

কে জানে! আর তুই জন্মেছিলি তোর দুহাত খুলে-সেটা একটা ভারি আশ্চয্যি ব্যাপার। আশ্চয্যি কিসের?

সব ছেলেই জন্মায় দু হাত মুঠো করে-তাই নিয়ম। তুই এসেছিলি একেবারে খোলা হাতে। নানা জনে নানান ব্যাখ্যা করেছিল তার।

কি রকম?

কেউ বলল, এ ছেলে এক নম্বরের উড়চন্ডী হবে, কিছু এর হাতে থাকবে না, কোনো জিনিস ধরে রাখতে পারবে না। কতজন কত কী বলল। তোর বাবা বলল যে, এ ছেলে কাউকে বাঁধবে না, কারো কাছে কোথাও বাঁধা পড়বে না। আমার ছেলে তো! আমার মতই হবে। জন্মসন্ন্যাসী। মুক্ত হাতে এসেছে, মুক্ত হতে যাবে-সর্বদা মুক্ত হও। মুক্ত পুরুষ। এই কথা বলতো তোর বাবা।

মুক্ত পুরষ! মুক্ত পুরুষ কী মা? আমি জানতে চাই; অগাধ সমুন্দরের ডুবুরি যারা, মুক্তো খোঁজে, শুক্তি খুঁজে বেড়ায়, তারাই কি? নাকি, যারা মুক্তি খোঁজে তারা?

যারা মুক্তো খোঁজে তারাও-যারা মুক্তি খোঁজে তারাও।

মুক্তো তো খুঁজতে হয় সমুদ্রের তলায় গিয়ে। আর মুক্তি তো খোঁজে মানুষ ভগবানের কাছেই-তাই না মা? ভগবানই তো মুক্তি দিতে পারে-তাই না? বইয়ে তো সেই কথাই বলে থাকে। আমি শুধাই : আমি যদি মুক্তি চাই তো ভগবানের কাছেই চাইতে হবে আমায়। তাই তো?

চাইতে পারিস। কিন্তু মুক্তিটা দিতে হবে তোকেই। ভগবানের তোকে মুক্তি দেওয়ার মানে হোলো, মানে তার অপর মানেটা, তোরই ভগবানকে মুক্তি দেওয়া অন্য কথায়।

তার মানে? মানে, ভগবান তোকে কী মুক্তি দেবে রে? তোর কাছ থেকেই তাঁকে নিজের মুক্তি নিতে হবে। তুই-ই মুক্তি দিবি ভগবানকে। তুই মুক্তি দিলে তবেই তিনি নিজের মুক্তি পাবেন। সেটা তোর মুক্তি বল বা উন্মুক্তি বল–যা খুশি।

খুলে বলল না মা! খোলসা করে কও?

মা তখন কথাটার খোলস ছাড়াতে লাগেন-যেমন ধর এই সূর্য। সূর্যর ভেতর দিয়ে ভগবান আলো হয়ে মুক্তি পাচ্ছেন, আলো বানিয়ে সূর্যই ভগবানকে মুক্তি দিচ্ছে একথাও তো বলা যায়। সূর্য তাঁর বাহন। বলা যায় যে, ভগবানই আলো হয়েছেন, কিন্তু সূর্যটি না হলে হতে পারতেন কী? সূর্যের যেমন ভগবানের দরকার নিজের আলোর জন্যে, তেমনি ভগবানেরও ঐ সূর্যটিকে চাই আবার। দুজনের না হলে দু-জনার চলে না।

এই জন্যেই কি দেবতাদের সব বাহন থাকে মা? মা দুর্গার যেমন সিংহ, সরস্বতীর যেমন কিনা হাঁস…। আমি ফাঁস করতে যাই।

বলতে পারিস। তা হলে দ্যাখ ভগবান যেমন তোকে মুক্তি দেবেন, তুইও তেমনি তাঁকে মুক্তি দিবি। কেবল নিজেকে নিয়ে কারো চলে কি রে? একক চেষ্টায় মুক্তি মেলে না, আরেক জনকে চাই। নইলে, ভগবান তো গোড়ায় একলাই ছিলেন আপনি, হাজারটা হতে গেলেন নে তবে? ওই জন্যেই তো। হাজার জনের ভেতর দিয়ে হাজার রকমের মুক্তির স্বাদ পাবেন–সেই জন্যেই না! হাজারটার মজাই আলাদা।

হাজা মজা যে বলে থাকে মা, তা বুঝি এই? আমি কই-ভগবান আমাদের হেজে মজে গেছেন?

তোর যতো সব উল্টোপাল্টা কথা! কোনোই তার মাথামুন্ডু নেই! কথার মাঝখানে বাধা পেয়ে মার ব্যাজার ভাব।–বড় হলে বুঝবি এসব।

না না, এখনই বুঝছি। এখনই বুঝব। তুমি বলে যাও। শুনছি তো আমি এই যে! কান খাড়া করে দেখাই।

তা হলে দাঁড়ালো কী? ভগবান যেমন তোর মুক্তিদাতা, তুইও তেমনি তাঁর মুক্তিদাতা– কিংবা উন্মুক্তিদাতাও বলতে পারিস। তোরা দুজনেই, যাকে বলে পরস্পরের পরিপূরক। গতিমুক্তি–আশা-ভরসা।

তাহলে আমি…আমিই তো…না, আমি ঠিক নই…মানুষই তো তাহলে বিধাতার চেয়ে বড়ো হয়ে গেল মা? অত বড় বিধাতাকে, ধারণাই করা যায় না যার, এই একটুকুন মানুষ মুক্তি দিচ্ছে?

হলই তো এক পক্ষে। তার সসীম দেহের ভেতর দিয়ে, তার আয়ুর গভকালের মধ্যে সেই অসীমকে, অখন্ডকে সবার কাছে নিয়ে…গভীর মাঝখানে ধরে বেঁধে ছেড়ে দিচ্ছে এনে…..একপক্ষে হলই তো সে। মুহুর্মুহু মৃত্যুর শিকার হয়েও সর্বদা ভগবানের অঙ্গীকার লাভে সে মহৎ।

আর সব মানুষের কথা থাক, বড় বড় মানুষের কথায় আমার কাজ নেই, আমায় বলল তুমি কী করে আমি মুক্তি পেতে পারি? কিংবা, তোমার কথামতন আমার ভগবানকে মুক্ত করতে পারি আমি? সেই কথাটাই বলো তুমি আমায়।

ভগবান প্রকাশ পান রূপে আর অপরূপে-মানুষের দেহ–সুষমা আর তার শিল্পকলার সৃষ্টি-মহিমায় তিনি ধরা দিয়েছেন। তুই যদি কবি হোস, তা হলে তোর কবিতাই হবে তাঁর মুক্তি, যদি দেখতে সুন্দর হোস, তবে তোর সেই, সৌন্দর্যেই তিনি উম্মুক্তি পাবেন। রকমটা এই আর কি! ভগবানের বাহন হতে হবে তোকে। কাউকে তিনি আপনার থেকেই নিজের বাহুন বেছে নিয়েছেন, কারু আবার তাঁকে যেচে তাঁর বাহন হতে হয়েছে। ঠাকুরকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন, বাণীরূপে তিনি মুক্তি পেয়েছেন সেখানে। আর রবিঠাকুরকে যেচে নিতে হয়েছে…নিজের কাব্যসাধনায় তাঁর সে অন্তরদেবতাইে তিনি উন্মুক্ত করেছেন।

বলে একটু থামেন মা–আর, তুই যদি নিজের চেষ্টায় কখনো খুব বড়লোক হোস, তাহলে তোর নিজের অর্থ অপরকে দিয়েই সেই ভগবানকেই তুই বিলিয়ে দিবি। তোর সেই দানই ভগবান তখন। সেই ভগবানের দান, ভগবানকেই দেওয়া–বুঝেছিস। মানে, যা পাবি…..রূপই হোক, শিল্পই হোক, অর্থই হোক, তা পেয়েই তোকে দিতে হবে-দিলেই তুই পাবি আবার। পেলেই দিবি, দিলেই পাবি–এমনি ধারা একটি মজার খেলা চলছে দুনিয়ায়।

দিলেও তেমনি কিছু পাওয়া যায় না রে! দিলেও তেমনি কিছুই পাওয়া যায় না–এটা একটা রহস্যই।

বুঝেছি মা। আমি যদি বড়লোক হই, তবে আমাকে পেয়ে পেয়ে দিতে হবে, যদি গাইয়ে ই তো গেয়ে গেয়ে দিতে হবে। নইলে সত্যিকারের পেয়েছি কি না, তা আমি টের পাব কি করে? তাই তুমি বলছ তো?

হ্যাঁ, তাই। নইলে, তোর লাখ টাকা মাটির তলায় পোতা থাকলে কার কী! তোরই বা কীসের! অন্য কেউ ভাগ পেল না বলে টাকাটা তোর ভাগ্যেও এল না।

আর যদি আমি কাউকে ভালোবাসি মা, তাহলে কিন্তু খালি দিয়ে গেলেই চলবে না, সেখানে আমায় দিয়ে দিয়ে পেতে হবে–যেমনটা কিনা পেয়ে পেয়ে দিতে হবে। তা নইলে ভলোবাসা হল কোথায়? তা তো কখনো একতরফা হয় না মা। সেখানে আমায় চেয়ে চেয়ে দিতে হবে, দিয়ে দিয়ে চাইতে হবে–তাই তো?

এই বয়েসে তোর এত ভালোবাসার ধান্দা কিসের রে? আমি যে তোকে এত ভালোবাসি আমি কি তোর ভালোবাসা চেয়েছি কখনো চাই কখনো?

তোমার ভালোবাসাই আলাদা। আমি জানাইঃ মার ভালোবাসার কি তুলনা হয় কারো সঙ্গে?

দুটো হাতই মুক্ত রাখতে হয়–পাবার আর দেবার। দেওয়ার আর নেওয়ার। মুক্ত হস্তে দিবি, মুক্ত হস্তে নিবি। আদান-প্রদান একই খেলার এদিক ওদিক। যেমন নিতে হয়, তেমনি দিতে হয়–নইলে, ভগবানের দান মেলে না। মনে কর না, বাইরে ভগবানের ঝড় বয়ে যাচছে, কিন্তু তোর ঘরের একদিকের একটি মাত্র জানালা খোলা রাখলে তার একটু হাওয়াও কি তুই পাবি?

একেবারে পাব না? বাইরে ঝড় বইলেও তার ঝাঁপটা লাগবে না আমার ঘরে? একটুখানিও না? আমি জানতে চাই।

একদিকের একটা জানালা খোলা থাকলে-মা বলেন, সেই হাওয়ার ছিটেফোঁটা হয়ত আসতে পারে তোর ঘরে–কিন্তু ঘরের দুধারের জানালা যদি খুলে রাখিস তো সেই ঝড় তোর ঘরের ভেতর দিয়ে হু হু করে বয়ে যাবে। তাঁর কৃপার জন্য দুটো দরজাই খোলা রাখতে হয়–আসার এবং যাবার।

তা হলেই তাঁর কৃপার পার পাওয়া যায় না-মার কথার ওপর আমার টিপ্পনি কাটি মার লকের ওপর আমার এক কাঠি।

বেশ বলেছিস। কেবল ভগবানের দিকে ওপনিং থাকলেই হবে না, মানুষের দিকটাও ওপন রাখতে হবে, নইলে ভগবান তোর বাতায়নে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে যা আমরা পাই তা আবার কড়ায় গন্ডায় আমাদের কিরিয়ে দিতে হয় তাঁকে–কিন্তু সরাসরি তাঁকে দেবো কি করে? তাই পৃথিবীকে দিয়েই তাঁকে দিতে হয়। মানুষকে দিলেই তিনি পান। নইলে পান না-পেতে পারেন না।

মানে, তাঁর দেওয়াটা একেবারে দান না? ধার দেওয়া কেবল? তার মধ্যে ফিরিয়ে দেবার কড়ার রয়েছে আবার? সুদ দেবার-শুধে দেবার কড়াকড়ি?

আছেই তো। কেবল যোগ করলেই হয় না তো, বিয়োগ করতেও হয়–তবেই কিনা অঙ্ক মেলে। যোগবলে কী পেলি বিয়োগ ফলেই তো তা টের পাবি রে। যোগবলের চেয়ে ঐ বিয়োগবল বড়ো-বুঝেছিস?

আর ই বিয়োগ ফলটাই শেষ ফল মা–তাই না? এত যোগবল আর যোগফলের পরেও শেষের তোমার ওই প্রাণ বিয়োগ। আমার দীর্ঘ নিশ্বাস।

মা থাকতে মৃত্যু কোথায়? আবার তিনি এমনি জন্ম দেবেন–ভয় কিসের?…তোকেও। দেবেন আমাকেও দেবেন।

তুমি তো বললে মা যে, ভগবানের কাছ থেকে যা আমরা পাই, তা আমাদের মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হয় আবার। বললে না তুমি? কিন্তু একটা জিনিস আছে মা, যা নাকি কাউকে চেষ্টা করে পেতে হয় না, কষ্ট করে দিতে হয় না। টাকাকড়ি পরকে দিতে গেলে সব দিক দেখতে হয়, এমন কি, তোমার ঐ ভালোবাসাও-কাউকে দিতে যাওয়া তেমন সোজা নয়কো মা। অনেক চেয়ে চেয়ে পেতে হয়–দিতে হয়।

জিনিসটা কী তোর–শুনি?

রূপ। ও তো যে পায়, এমনিতেই পায়, অমনিই পেয়ে থাকে। অপরকে দিতেও তাকে কোনো বেগ পেতে হয় না। যেমনি পাওয়া অমনি তার দেওয়া। না দিয়ে উপায় নেই তার-ঝরনা যেমন আপনার থেকেই সর্বক্ষণ ঝরছে।

রূপ তো ভগবানেরই বিভূতি রে। তাঁরই ঐশ্বর্য-যে পায় তার মতন ভাগ্যবান কে আর? সবাই কি তা পায়?

যেমন কিনা রিনি–মানে যে ঐ জিনিস পেয়েছে, সে তার কাছে ঋণী হয়েও সেই ঋণী নয়–তাকে আর কষ্ট করে পরকে দান করে তা শুধতে হয় না। সে দেখা দিলেই তার দেওয়া হয়ে যায়, তাকে দেখতে পেলেই পাওয়া হয়ে গেল আমার-দর্শন দান আর দর্শন লাভ যুগপৎ! আশ্চর্য নয় মা?

আশ্চর্য বই কি! পরমাশ্চর্যই। পরম ঐশ্বর্যও আবার। মা বলেন-রূপ তো ভগবানেরই প্রকাশ-সেখানে তিনি প্রত্যক্ষ হয়েছেন।

অমনি আরেকটা জিনিসও আছে মা, যা নাকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া হয়ে যায়-খাওয়ার সাথে সাথেই খাওয়ানো। সেও কিছু কম আশ্চর্য নয় মা! মি বলি-তর চেয়ে বড় অবদান বিধাতার কিছু নেই অর

কিসের কথা বলছিস তুই? কিসের কথাই বলছি তো মা! বলতে গিয়ে আমি ঢোক গিলি-ওর বেশি আর বলি। সব কথা কি সবাইকে বলবার? গুহ্য কথা গুরুজনদের কাছে ব্যক্ত না করাই শ্রেয়ঃ। পূজ্যদের কাছে উহ্য রাখাই বিধেয়।

.

১৬.

তাহলে এই পটানো কাজটি আপনার নয় আপনি বলতে চান? জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক।

কী করে বলি? আপনার সম্বন্ধে কি সঠিক কখনো জানা যায়? নিজের রহস্য কি টের পায় কেউ? আপনার অন্ত মিলেছে কারো? সেই গুরু গোবিন্দর পর বলুন, পেয়েছি আমার শেষ–এমন গুরুতর কথা কটা লোক আর আওড়াতে পেরেছে? হাজার আত্মবিদ্ধ করেও আত্মবিদ্ধ হয় না মশাই! এই কথাই আমি কইতে চাই।

সোজাসুজি বলুন না গো! অত ঘোর প্যাঁচে যাচ্ছেন কেন!

কিন্তু সহজ কথা যায় কি বলা সহজে। আমাদের কর্মকান্ডর বিবরণ বিশদ করা কি সোজা? কটা কাজ আমরা প্রকাশ্যে করি–কতটাই বা আমাদের জ্ঞাতসারে হয়? প্রদীপ জ্বালার আগে যেমনটা সলতে পাকানো, অনেকটা তো আমাদের অন্তর্লোকের অবচেতনায় ঘটে থাকে। ক্রিয়াকলাপের বেশির ভাগই আমাদের অন্তরগত, লোকলোচনের অন্তর্গত হবার নয়।

এমন কাজ আপনি করতে পারেন বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস হয় না যথার্থ। আমারও। আবার অবিশ্বাস করতেও প্রাণ চায় না। এমনতর নিজের নৈপুণ্য মনে মনে আমি কল্পনা করেছি অনেক। পটনকর্ম তো একটা শিল্পকর্মই, মশিল্পও বলা যায়। পটনশিল্পী-পটশিল্পীর চেয়ে কিছু কম নন। আর, আমি কি এককালে (এই লিখিয়ে না হয়ে) পটুয়া হতেই চাইনি? চায় না কি লেখকরা? বিস্তর লেখালেখির পর রেখার হরিহরছত্রেও কি পটুতা দেখা যায়নি কারো কারো?

সুন্দরদের শুধু চিত্তপটে ধরে না রেখে (ক দিনই বা রাখা যায় অমন করে?) চিরদিনের

তরে চিত্রপটে বেঁধে রাখতে চাইনি কি?

দেখুন, এ বিষয়ে আমি সন্দেহবাদী, জনাবাহাদুরের প্রতি আমার জবাব : সব ব্যাপারের মত এখানেও আমার একটুখানি সংশয় আছে। আমার কী মনে হয় জানেন-হয়ত আমিই করেছিলাম এই কর্ম, কিংবা হয়ত…হয়ত বা আমার মন অন্য কোনো ব্যক্তি এই দুঙ্কা করে থাকতে পারেন। পটিয়সীদের ওপর পটিয়স হবার দক্ষতা আমার আছে জানলে স্বভাবতই আমার গর্ব হয়, কিন্তু কে জানে, আমার ওপরেও টেক্কা মারার মন আরও কোনো টেকচাঁদ ঠাকুর থাকতে পারেন। আমার চাইতেও বাহাদুর কেউ নেই কি আর?

তাহলে আপনার কোনো বল? আপনি বলতে চান অবিকল।

ঠিক ধরেছেন আপনি। আমার প্রবল সন্দেহ তাই। ফুরার হিটলারে যেমনটি ছিল বলে শোনা যায়-তারা বোধ হয় কখনো ফুরাবার নন। সুভাষচন্দ্রের নিরুদ্দেশের পর আমি একবার ওয়েলিংটন-ধর্মতলার মোড়ে কল্পতরু আয়ুর্বেদ ভবনে সুভাষচন্দ্রের মতন বজনি একজনকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেছলাম, পরে জানা গেল, উনি সেই গণনায়ক নন, কবিরাজ গণনাথ সেনেরই কে যেন হন। দেখেছিলেন নেতাজীর অন্তর্ধানের পরে? সত্যি?

তা বই কি। সেই রকম কেউ হয়ত আমার অনুরূপ ধারণ করে আমার ওপরে এই হটি করে যাচ্ছেন বারংবার–যদিও তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি ডেড হীট হয়নি এখনো অব্দি। তিনিই হয়ত আমার বিয়ের সাধটা মিটিয়ে গেছেন। আমার বংশরক্ষার শখও মিটিয়েছেন কি না কে জানে।…তাহলে তো আমার…..আমাদের উভয়েরই মৃত্যুর পর জলপিণ্ডির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

পুত্রপিণ্ডের প্রয়োজনেই ভার্যাবরণ করা হয়, শাস্ত্রে বলে। জানি।

যাঁ। আর পুত্রপিণ্ডের ভরণপোষণ, মানুষ করার দায় থেকে বেঁচে গিয়ে নিখরচায় যদি ঐ পুত্রপিন্ড, পুত্র আর পিণ্ড, আলাদা আলাদা, রঙ্গমঞ্চের নেপথ্যে কারো সৌজন্যে পাওয়া যায় মন্দ কি?

আপনি ভাগ্যবান। খেটে মরলো হাঁস, ডিম খেলো দাবোগাসাহেব।

তাই তো হয় মশাই, এক-একজনের বরাত অমনিধারা। বর না হয়েও কনে পায় তারা–ঘরের কোণেই মিলে যায় অবলীলায়। আমার কী মনে হয় জানেন? ঐ মহাপ্রভু। উনিই। আমায় কোনো মেয়ে দিয়েছেন কি না এখনো জানিনে, তবে আমায় ঐ এম-এ ডিগ্রীটা–আমার ধারণা, ওঁরই অবদান।

সেই লোকটার কাণ্ডই বলছেন?

সে ছাড়া কে আর? তিনিই অঙ্ক মিলিয়ে অতগুলো পরীক্ষা পাস করেছেন, আবার অঙ্কশায়িনী মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি–তাঁর দয়ায় কোনো দুঃখ অভাব নেই আর আমার।

দুঃখ ছিল নাকি কখনো?

ছিল না? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ দেখিনি, সেজন্য কেমন যেন একটা নিঃস্ব বোধ করতাম নিজেকে–বৌ নেই বলেই কি কম ক্ষোভ ছিল এককালে? তাঁর কৃপায় নাক গেল না, কিন্তু নরুন মিলল-কষ্ট করে পড়াশুনা করতে হল না, অবহেলায় ডিগ্রী জুটে গেল। সেকালে, জানেন, নামের পেছনে বি-এ, এম-এর লেজুড় লাগানোর রেওয়াজ ছিল বেজায়। একালে কেউ তেমন পোঁছে না, কিন্তু তখন এর যেমন বাজারদর তেমনি নাকি কদর। যাই হোক, এহেন দৌলত তাঁর দৌলতেই তো!

গাছে না উঠেই এক কাঁদি-কোনো কাদাকাঁদি না করেই। আমার কথায় তার সায় দেওয়া-আপনার ভাষায় প্রকাশ করলাম মশাই; মাপ করবেন। ব্যারামটা ছোঁয়াচে কি না।

হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীটা তাঁর সৌজন্যে হলেও, চুয়াল্লিশ ডিগ্রীটা পাওয়া স্রেফ আমার নিজের জন্যেই। সম্পূর্ণ আমার কুতে। বিলকুল স্বোপার্জিত। আমি জানাই।

চুয়াল্লিশ ডিগ্রীটা কী আবার? কোথাকার কলেজের?

আলিপুর জেলের। পাঁচ হাত লম্বা, হাত চারেক চওড়া ছোট ঘোট খুপরি-বাইশটা করে সারি সারি দু লাইনে সাজানো-খুনের আসামীদের ফাঁসি দেয়ার আগে আটক রাখা হয় সেখানে।

শুনেই তিনি চমকে উঠেছেন-ও বাবা! আপনি খুনও করেছিলেন আবার?

না। আমার তরুণ বয়সে কলকাতায় এসে এক যুগান্তকারী পত্রিকা প্রকাশের জন্য খুন। হয়েছিলাম। দেশবন্ধু দাশের অর্থ সাহায্যে আগেকার যুগের যুগান্তর পত্রিকাটার নবপর্যায়ে পুনরুজ্জীবন করেছিলাম। ফলে যা হবার। জেল হয়ে গেল। তখনকার কালে যাতে না পালাতে পারে, সে কারণে ওই রাজবন্দীদেরও রাখা হোতত সেই সব খাঁচায়। উপেন বাঁড়ুজ্যে বারীন ঘোষ উল্লাসকরের আত্মজীবনীতে নিশ্চয় ওর সবিশেষ বর্ণনা পেয়েছেন।

তাই বলুন। তিনি হাঁফ ছাড়লেন–আমি ভেবেছিলুম…

ভেবেছিলেন আমি সর্বগুণান্বিত, এমন কি ঐ খুনান্বিতও? না, মশাই না, হয়ত বা ইচ্ছে থাকলেও অদূর আমি এগুতে পারিনি। সাধ ছিল বটে, সাধ্য ছিল না–কবির ভাষায় বলা যায়। আমার দৌড় ওই মসজিদ অবদিছিঁচকে ব্যাপার-প্রাণ বাঁচানোর দায়ে-করা ছিঁচকেমি যত। ছিচকাঁদুনি আর গাইতে চাইনে। বাঁচতে হলে মানুষকে এক আধটু ক্রাইম করতেই হয়–অবশ্যি সবদিক বাঁচিয়ে আইনের দিকটাও-না হলে চলে না। আর বাঁচার মন বাঁচতে হলে সময় সময় কিছু কিছু সিন না করলেই নয়। এই আমার ধারণা। তবে বাঁচোয়া এই যে, তার অনেকখানিই আমরা মনে মনে সারি–বাহ্যত এবং কার্যত পারি না। বেশির ভাগই আন্তরিক উপভোগ। আমি যোগ করি : আর আসলে সুখ দুঃখ তো আমাদের মনেই মশাই! জন্মভূমির মতন আমাদের মনোভূমিও তো স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এবং স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। স্বপ্নসাধ আর স্মৃতিসুখ–এই নিয়েই তো আমাদের আধখানা বাঁচা। আদ্ধেক জীবন।

সমাজে বাস করে অপরাধপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। তাঁর সুচিন্তিত অভিমত।–অপরের চেয়েও নিজের মনেই তার প্রতিক্রিয়া বেশি হয়।

তা তো বটেই। জানি, অপরাধ করলে একটা অপরাধবোধ সর্বদাই মনের মধ্যে খোঁচায়, তেমনি আবার কোনো কোনো অপরাধ না করলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হয়। পস্তাতে হয় জীবনভোর।

জানি না ঠিক। এবার শুনি আপনার কারাবাসের কাহিনী। সময়টা খুব কষ্টের ছিল নিশ্চয়?

কষ্ট কিসের! অমন সুখের সময় আর আসেনি আমার জীবনে। আমার বিশ্বাস সহজে লোকে জেলে যেতে পারে না বলেই সাধ করে বিয়ে করে-ওই জেলে না যাওয়ার দুঃখ ঘোচাতেই। ওই জাতীয় একটা সুখের লোভে নিজের বাড়িতে জেলখানা এনে বানায়। হাতে পা শেকল বাঁধে।

তবে জেলখানাকে নরক ভোগ বলে কেন মশাই? আমার কথায় তিনি বেশ একটু অবাক হন।

ভিন্ন রুচির লোক হয়ে থাকে না? তাই হবে বোধহয়। জেলখানার বিচার তো জেলের খানা দিয়েই। প্রেসিডেন্সি কি আলিপুরের জেলে থাকতে-কানটায় ছিলাম জানিনে, তবে এটা বলতে পারি, যেখানেই এই চুয়াল্লিশ ডিগ্রী বিরাজিত সেইখানেই–খাওয়াটা ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই। একটা জগাখিচুরির মতন খেতে হতো আমাদের নাম ছিল তার লপসি। সহজে গলা দিয়ে গলতে চাইত না। কিন্তু সেখানকার সেল থেকে বেরিয়ে বহরমপুরের জেলে গিয়ে যেন হাতে হাতে স্বর্গ পেলাম। সেখানকার খানাই ছিল আলাদা। মাথাপিছু তিন টাকা করে বাধা ছিল সবার–সেই টাকায় কী ইলাহী খাওয়া হোত যে। তা কহতব্য নয়।

বটে বটে?

সেখানে গিয়ে জে এল বাঁড়ুয্যে, নজরুল ইসলামের দেখা পেলাম। আলাপ হোলে কবি বিজয় চাটুজ্যে, বিপ্লবী বীর পূর্ণ দাসের সাথে। আরো কে কে যেন ছিলেন, মনে পড়ে না এখন-তাঁদের প্রত্যেকেই দিপাল। কাজী বলত, হোটবেলায়, সে নাকি কোথায় বাবুর্চির কাজ করেছে–সব রকমের রান্না জানে! প্রমাণ দেবার জন্যে সবার রান্নাটা সে-ই করত। আর কী খানাই যে বানাত কী বলব! বিরিয়ানি পোলাও থেকে শুরু করে চপ কাটলেট কোপ্তা কোর্মা কাবাব কারি–কাবাব আবার দুকিসিমের-শিক্ এবং নন-শিক্-কারিকুরি কত না!

রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছু করত না কাজী?

আর গানে কবিতায় আবৃত্তিতে গল্পগুজবে আড্ডায় মাতিয়ে রাখত। এমন মজার মজার কথা কইত সে! অমন প্রাণোচ্ছল প্রদীপ্ত যুবক জীবনে আমি আর দেখিনি। খানাকুলের থেকে আমি কৃষ্ণাগরের দিকে এগোই–তার প্রেমের গান সেইখানেই শুনেছিলাম। তার বিদ্রোহের কবিতার পাশাপাশি দোলনচাঁপার কাহিনী! প্রেমের স্মৃতিচারণ তার অবিস্মরণীয় যতো গজল। সোজা গজালের মতন গিয়ে গেঁথে যায় মগজে।

বিদ্রোহের গানটান গাইতো না? গাইত না আবার! তার বিদ্রোহী কবিতাটার আবৃত্তি তার মুখে মুখে বার বার শুনলাম। আর বিপ্লবের যততা গান।কারার ঐ লৌহকপাট/ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট রক্তজমাট। শিকল পূজার পাষাণবেদী/ওরে ও পাগলা ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/রক্তনিশান/উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি। মনে হয় এ-গানটা তার ঐ জেলেই বাঁধা। কী উল্লাসে গাইত যে।

আর কী করত কাজী?

তাছাড়া কবিগুরুর গানও গাইত একেক সময়। তার মুখে কবির ঋতু পর্যায়ের গানগুলো এমন ব্যঞ্জনা পেত যে বলা যায় না। তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে/ তুমি ধন্য ধন্য হে কবির এ গানটার এমন চমৎকার এক প্যারডি বেঁধেছিল সে। গেয়ে গেয়ে সেটা শুনিয়েছেও আমাদের।

গানটা কী শুনি।

আমি তো গাইতে পারব না, শোনাতে পারি–তোমারি জেলে/পালিছ ঠেলে/তুমি ধন্য ধন্য হে! / তোমারি অশন/তোমারি বসন/তুমি ধন্য ধন্য হে!

আপনারা বেশ আরামেই ছিলেন দেখা যাচ্ছে সেখানে। তবে জেলখানাকে এত মন্দ। জায়গা বলত কেন লোকে?

মন্দের ভালোটা তারা দেখতে পেত না তাই। ভালোর ভালো বলে এই দুনিয়ায় কিছু তো নাই। মন্দের ভালোই সত্যিকার ভালো। তাই নিয়েই খুশি থাকতে হয়। আমাদের কবিও কি সেই কথাই বলে যাননি? অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। সেই তো তোমার আলো/ সকল দ্বন্দ্ববিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভাললা/ সেই তত তোমার ভালো! বলেননি কি তিনি?

জেলখানাটা আপনার বরাতে দেখছি এক রাজঘোটক হয়ে গেছে।

নিশ্চয়। আমার স্বনামধন্য সেই ভদ্রলোক আমার হয়ে কষ্ট করে পাশ-টাশ করেছেন, বে-থাও করেছন, সেজন্যে আমার কোনোই ব্যথা নেই, কিন্তু কী ভাগ্যি, তিনি আমার হয়ে এই জেলটাও খাটেননি–তাহলে, সত্যিই! কী সর্বনাশ যে হতো আমার! এইসব অন্তরঙ্গদের সঙ্গসুখ পেতাম না। যথার্থই সর্বহারা হতাম। রাজযোটক তো বটেই। যত রাজাগজার সঙ্গে যোগাযোগ সেই সুযোগেই আমার ঘটল তো! আর সেই খানা! জেলখানার সেই খানা। আহামরি! কার সঙ্গে তার তুলনা করি। মনে পড়লে এখনো জিভে জল সরে। আমি নিজেকে যেন সজিভ বোধ করি আবার। আহা, তেমনটি আর জীবনে কখনো খাইনি।

কী বলেন যে!

আরে মশাই! এই চেহারা আমি ফিরিয়ে আনলাম সেই জেলের থেকেই। বলব না। আগে তো আমি এই কড়ে আঙুলটির মই টিঙটিঙে ছিলাম। কোনো ব্যায়াম ট্যায়াম সেরে নয়, টনিক-ফনিক মেরে না, জলবায়ুর হেরফেরেও নয়কো, সেই কড়ে আঙুলের ন্যায় চেহারা নিয়ে গিয়ে তেহারা হয়ে ফিরলাম। এই বুড়ো আঙুলের মত হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বেরিয়ে এলাম বহরমপুরের সেই গারদ থেকেই। দেখছেন তো বেঁটেখাটো আমার এই প্রতীকচিহ্ন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ সরকারকে আমার এই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলে এলাম। আর, তারপর থেকে…।

তারপর থেকে?

তারপর থেকে জেলখানায় আর জেলের খানায় গড়া এই মোগলাই চেহারা একটুখানি টসকায়নি আমার। সেইরকমটিই রয়ে গেছে প্রায়। অ্যাদ্দিন বাদেও এখনো আমার সেই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠই দেখিয়ে বেড়াচ্ছি সবাইকে।

জবাবে কাজীর প্যারডির একটি পংক্তিই তিনি পুনরুচ্চারণ করলেন- তুমিই ধন্য ধন্য হে!

সত্যি বলতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মুদ্রাযন্ত্র তার দুঃশাসনী কারাগারের নিষ্পেষণী খর্পর থেকে আমার এই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করার অদ্বিতীয় কৃতিত্বের জন্য নিজেকেই কি আমার ধন্যবাদ দেবার ইচ্ছে করে না একেক সময়?

.

১৭.

না বিইয়ে কানাইয়ের মা বলে না? বললেন ভদ্রলোক, আপনি দেখছি সেই রকম বিয়ে না করেই বলাইয়ের বাবা। বলাই বা বালাই যাই বলুন।

এ কথা বলছেন কেন? আমি শুধাই।

মানে, আপনার সেই হাওড়ার পরকীয়া গৃহিণীকে স্মরণ করেই কথাটা মনে পড়ল আমার। এতদিন তাঁর দৌলতে হয়ত আপনি অনেক ছাপোনার বাবা হয়ে বসেছেন …।

কিন্তু বালাই বলছেন কেন তাদের?

মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী হলেও ছেলেরা তো আপদ বালাই-ই। মায়ের কাছে তা না হলেও বাপের কাছে তো তাই বটে। ছেলেদের মানুষ করা যায় না যে। বেশির ভাগই তারা বাঁদর হয়ে যায়। সেই কারণেই।

বংশধররা বংশের ধারা রাখে কি না!

আদমপুর্বিক সেই ডারুইনের সূত্র ধরে তাদের হয়ে আমার সাফাই গাইতে হয়, মেয়েদের মনের মত করে গড়া গেলেও (এমনিতেই মেয়েরা মনের মত স্বভাবতই) ছেলেদের বেলায় সেটা একেবারেই খাটে না। তারা নিজের মতই হয়ে ওঠে। বাপের ধার ধারে না, ধারাও বজায় রাখে না। এই জন্যই কি বালাই? কিন্তু কোনো পুরুষেই তো বাপের ধার ধারেনি-পিতৃঋণ শোধ করতে চায়নি। পারেনি কেউ। আর মাতৃঋণ? মার ঋণ তো শোধ করাই যায় না। এবং……এবং মা তার বড় একটা প্রত্যাশাও রাখেন না। মা মা-ই। তার সঙ্গে কারো কি তুলনা হয়? আমি নিশ্বাস ফেলি-মার ঋণ কখনই আমরা শুধতে পারিনে। তাঁর কাছে আমরা চিরঋণী, আর তাই আমরা থাকতে চাই।

সে কথা তুলছি না। বলছিলাম হাওড়ার সেই আপনার পরকীয়া পত্নীটির খবর নিয়েছিলেন আর? ভদ্রলোক, মানে সেই ওরফে-টি নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন এর ভেতর, সুখে ঘরকন্না করছেন এতদিন।

অসম্ভব না। নানান অশ্বমেধের পর অনেক হৰ খেয়ে নিজের নিশ্চিত নীড়ে ফিরে এসে, রাজসুয়ের যোগ্য হয়ে রাজার মতই শুয়ে পড়েছেন এতদিনে আশা করি।

এবং আপনার আশাও পূর্ণ করেছেন আরো। আপনাকে পুত্র কন্যা খনে ধনী বা ঋনী যাহোক একটা করে আপনার সন্তান দুঃখও মোচন করে বসে আছেন আপনার সেই ওরফে বা বিকল্প–যাই বলুন।

অসম্ভব নয়। একালে আর সেই কল্পতরু তো নেই–এখন সবই বিকল্প–সব কিছুরই বিকল্প নিয়েই সুখী হতে হয় আমাদের। আমিও আমার সেই বিকল্পতরুর থেকে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ চতুর্বর্গ লাভ করলাম। এমনকি, পুত্রকন্যাও পেয়েছি নিশ্চয়। যাকে বলে মোক্ষম লাভ।

তাহলে আপনার সব দুঃখ দুর হয়েছে বলুন।

সুখ আরো যে, নিজে না হতে পারলেও আরেকজনকে আমি স্বনামধন্য করতে পেরেছি। সাহিত্য জগতে দ্বিত্ব লাভ না কালে দ্বিজত্বলাভ করা যায় না; তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, সুনীল গাঙ্গুলির দু নম্বর বেরিয়েছেন। যে কারণে তারাশঙ্করকে শ্ৰী-হীন হতে হল মশাই! বাকী দুজন কী করেছেন জানিনে। আমারও যে অমনি একজন আছেন জানলেও আনন্দ।

কিন্তু তিনি তো লেখেন না আর! লেখক তো নন?

হতে কতক্ষণ? লেখা এমন কি শক্ত কাজ? আর, আমার লেখা এমন উঁচু দরের অননুকরণীয় কিছু নয় যে কারো পক্ষে এ ধরনের লেখা কঠিন হবে। ইস্কুলের থার্ড ক্লাসের ছেলেরাও আমার স্টাইলে আমার চাইতে ঢের ভালো লেখে, আমি দেখেছি–অবলীলায় এমনটা লেখা যায়। কেবল আমার পক্ষে লিখতেই যা দারুণ পরিশ্রম হয় মশাই!

কই, আপনার নাম নিয়ে কাউকে ক্লিখতে তোদেখা যায়নি এ পর্যন্ত। তিনি শুধানঃ আপনার স্বনামধন্য সেই ভদ্রলোকের কোনো লেখা কি চোখে পড়েছে আপনার?

এখন অব্দি না! আমার মতন থার্ড ক্লাস লিখিয়ে হতে চান না বোধ হয়। কিংবা আমার মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছেন। আমি মরলেই তিনি কলম ধরবেন। আমি বিল হবার পরই তাঁর অবিরল হবে।

ভালোই আপনার। এও তো এক রকমের অমরত্বই।

নিশ্চয়ই। তাছাড়া, দেখছেন তো একালে অমর হওয়া শক্ত কত। নামজাদা লেখকরাও মারা যাবার পরই ডুবে যাচ্ছেন। পাঠকরা তাদের ভুলে যাচ্ছে একেবারে। সেকালে এক একটি প্রতিভা বহুদিন বাদ বাদ প্রদীপ্ত হতেন-তিনকাল ধরে প্রতিভূরূপে আলো বিলোনে অন্তত। এখন তো ঘন্টায় ঘন্টায় নতুন নতুন প্রদীপ জ্বলছে,-নিভেও যাচ্ছে তেমনি–এবং আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে দেশ। ভালোই তো বলতে গেলে।

তা বটে। তাহলেও মরবার পরে অমর হতে না পারলেও আপনি অন্তত ধারাবাহিক হতে পারবেন।

পারতাম, কিন্তু আর বোধ হয়এ আশা করা যায় না। আমার কী মনে হয় জানেন? উক্ত ভদ্রলোক বোধ হয় আর বেঁচে নেই।

কেন এমন আশঙ্কা আপনার?

আমি যদি তাঁকে মেরে ফেলে থাকি?…

অ্যাঁ? তাই নাকি? খুন করেছেন তাঁকে? তিনি, শিহরিত হন : আপনি বার বার পিলে চমকে দিচ্ছেন আমার। ঈর্ষাবশতই মেরেছেন বোধ হয়? কী করে মারলেন?

ট্রেন দিয়ে।

ট্রেন দিয়ে? চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন নীচেয়? অ্যাঁ?

না, না–তা নয় ঠিক।

তবে কী? ট্রেন দিয়ে কি কাউকে মারা যায় নাকি? তিনি একটু সন্দিগ্ধই : তবে হ্যাঁ, একজনকে খতম করার দায়ে ট্রেন উড়িয়ে দিয়ে অনেককে ঘায়েল করা যেতে পারে বটে।

মারা যায় না ট্রেন দিয়ে? কী যে বলেন! পাকিস্তান যদি লরী দিয়ে সাতজন বিদেশ ডিপ্লোমাটকে কাত করতে পারে তাহলে কি আমি ট্রেন দিয়ে একজনের মোলাকাত করতে পারব না–যদিও আমি তাদের মতন তেমনটা লড়িয়ে নই।

খুলে বলুন তো, শুনি আপনার কান্ডটা। কী করে খতম করলেন তাকে?

ক বছর আগেকার কথা। সেবার মহাষ্টমীতে বাড়ি থেকে বেরিয়েই দুর্ঘটনা ঘটল মহাষ্টমীতে যাত্রা নাস্তি বলে থাকে পাঁজিতে জানেন তো? আজকাল আমরা তা মানিনে, নিজের সুবিধেটাই দেখি। মহাষ্টমীতে পুজোর ভিড়টা কমে যায় বেশ-ট্রেন যাত্রা ঢের সহজ। তাই ওই দিনই আমি আমার মুল্লুকে যাই। সেবার হাওড়া স্টেশন থেকেই দুর্ঘটনার শুরু-প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেই ট্রেনটা পেয়ে গেলাম। ধরতে পারলাম, চড়তে পারলাম কামরায়। আশ্চর্য ব্যাপার।

আশ্চয্য কিসের? দুর্ঘটনাই বা কোথায়?

বরাবর আমায় পরের ট্রেনে যেতে হয়–সিটি বুকিং-এ আগের থেকে টিকিট কেনা থাকলেও। যে ট্রেনের জন্যে মনে করে বেরুই, যে কারণেই হোক, সে ট্রেনটা নির্ঘাত ফেল করে বসি, তাকে আর ধরতেই পারি না। সেই কারণেই পরের গাড়িতে যেতে হয় আমায়……..তবে সবই তো পরের ট্রেন। সেদিক দিয়ে ধরলে, কোন্ ট্রেনটাই বা আমার নিজের বলতে পারি বলুন?

তা বটে! তিনি ঘাড় নাড়েন ট্রেন আর কবে কার! তারপর?

তারপর আর কি! সেই ট্রেনটাতে না যাবার জন্যেই দুর্ঘটনা ঘটল। ঘটল আবার সেই ট্রেনেই।

কোন্ ট্রেনে?

পরের ট্রেনে, যেটাতে আমার যাবার কথা অথচ আমি যেতে পারিনি। আগের ট্রেনটা পেয়ে তাতেই চেপে চলে গেছি। যথাসময়ে ঘাটশিলায় পৌঁছে খেয়েদেয়ে বিছানায় গড়াচ্ছি, এমন সময়ে সেই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা ঘটল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই বিদঘুঁটে এক আওয়াজ এল–ঘাটশিলার অদূর থেকেই। সোরগোল উঠল ঘাটশিলার কাছেই নাকি এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে–বে-লাইন হয়ে উলটে গিয়েছে গাড়ি। পরের দিনের কাগজে বিস্তৃত খবর বেরুল-হতাহতের তালিকায় এক শিবরামের নাম।

অ্যাঁ? সে কী মশাই?

হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি। এই দুর্ঘটনার জন্যে আমিই সম্পূর্ণ দায়ী। না না, ঐ ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য না–আমি দায়ী মানে, আমার দোষেই ঐ ভদ্রলোক হতাহত হলেন কি না। আমি যদি পরের ট্রেনে আসতাম তো আমিই মারা যেতাম নির্ঘাৎ। এক বাড়িতে দুবার বজ্রাঘাত হয় না, এক লোককে দুবার কামড়ায় না সাপে-তেমনি এক সাথে দুজন শিব্রাম মারা পড়তে পারে না কখনো।

আপনার পক্ষে ভালোই তো সেটা। তিনি ঠিক ঠাহর পান না-এর ভেতর খারাপটা হলো কোনখানে?

সেই ভদ্রলোকের মারা যাওয়াটা খারাপ হলো না? একজন বিধবা হলো না সেজন্য? কয়েকজন পিতৃহারা হলো না কি? কিন্তু আমি মরলে কার কী যেত? কী ক্ষতি হতো কার? খতিয়ে আমি বলি–চিত্রগুপ্তের খাতায় এক শিব্রামের ট্রেন চক্রে মরবার কথা ছিল সেদিন, সেই খাতে আমায় মিলল না বলেই ওকে মেরে তাঁর খতিয়ানের হিসেব ঠিক রাখতে হলো। কাপুরুষের মতন আত্মরক্ষা করে তাঁর মৃত্যুর জন্য আমিই কি দায়ী নই? বলুন আপনি?

শুনে তিনি গুম হয়ে যান, কিছুক্ষণ তাঁর কথা সরে না। তার পরে তিনি গুমরে ওঠেন অত।

অদ্ভুত তা বটেই। আমাদের বেচে যাওয়াটাও অদ্ভুত, মারা পড়াটাও অদ্ভুত! সবচেয়ে অদ্ভুত আমাদের এই বেচে থাকাটা। মুহুর্মুহু মিরাকে। তাঁর কথায় আমার অক্ষরে অক্ষরে সায়।

খেয়েদেয়ে থালাতেই হাত ধুয়ে মুখ মুছে সকড়ি থালাবাটি গেলাস সব চৌকির নীচে নামিয়ে রেখেছিলাম- এবার আমি শুয়ে পড়ি, কী বলেন? শুয়ে শুয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করা যাক, কেমন?… আপনি পা তুলে ভালো করে বসুন। বাবু হয়ে বসুন বিছানার ওপর।

তা কি হয়! পায়ে ধুলো যে! ধুলো কিসের! আপনি জুতো পরে আসেননি কি? তাঁর পায়ের দিকে নজর দিই, এ কি? আপনার জুতো গেল কোথায়?

ঘরের বাইরে রেখে এসেছি। দরজার ও ধারে।

করছেন কী! খালি পায়ে এসেছেন এই নোরা ঘরে, অ্যাঁ? কেন? ঘরে কি আরো জুতো নেই নাকি? আমারই তোক জোড়া রয়েছে-ঘরময় ছড়ানো। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত-নিক্ষিপ্ত দেখছেন না? এটা তো ঠাকুরঘর নয় আর। জুতো পায়ে ঢুকতে কী হয়েছিল আপনার? জুতোর কি আবার জাতিভেদ শ্রেণীভেদ আছে নাকি?

না, তা নয়। তবে কারো ঘরে কি জুতো পরে ঢুকতে আছে?

অন্য ঘরের খবর রাখিনে, আমার ঘরে কিন্তু তাই নিয়ম। দেখছেন আমার ঘরে কতো ধুলো বালি আবর্জনা জমে রয়েছে। তিন যুগ আগে সেই কবে যে এই ঘরে ঢুকেছি তার পর আর এখানে ঝটপাট পড়েনি। ঝড়পোছ হয়নি কখনো। কে করবে ওসব বলুন? ও সব তত গৃহিণীর কাজ–গৃহিণী গৃহমুচ্যতে, বলে না? মুচ্যতে কিংবা মুচ্ছ্যতে যাই বলুন না।

কেন, বাসার চাকর-টাকর? বললে, বসিস দিলে, তারা কী ঝটপাট দিয়ে ধুলো ময়লা সব সাফ করে দেয় না।

কী হবে দিয়ে? তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে ঘরের ভেতরে পুঞ্জীভূত এই জঞ্জালের মধ্যে কত না জীবাণু জন্মেছে–কত না বোগজীবাণু! কী হবে ঝেটিয়ে তাদের উত্যক্ত করে? ঝাড়লেই তো তারা হাওয়ায় উড়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমাদের নাকমুখের পথে সোজা গিয়ে শরীরে সেঁধুবে? কী দরকার তার? তার চেয়ে লেট দি স্লিপিং ডগস্লাই। আমার এই কথাই।

বেশ কথা। কিন্তু তাহলেও, দোরগোড়ায় একটা পাপোশ তো রাখতে পারেন? লোকে পা-টা মুছে ঢুকতে পারে ঘরে তাহলে।

আমিও সেটা ভেবেছি–রাখব একটা পাপোশ এবার। তবে দরজার বাইরে নয়, আমার ঘরের ভেতরেই রাখতে হবে পাপোশটা।

ঘরের ভেতরে কেন?

বাইরে রেখে কী হবে? বাইরেটা তো বেশ পরিষ্কার, দেখছেন না? রোজ সকালে জমাদারের ঝাড়ু পড়ে। ঘরের ভেতরেই তো যত ধুলোবালি আর জঞ্জাল। ঘরের মধ্যেই রাখতে হবে পাপোশটা–যখন কেউ এ ঘর থেকে বেরুবেন, বেশ করে নিজের পা-টা মুছে-টুছে বেরিয়ে যাবেন সেই পাপোশে।

.

১৮.  

পা তুলে গুটিয়ে বিছানার ওপরে ভালো করে বসুন না মশাই। বললাম আমি জনাব সাহেবকে ঘরের ধুলো বালি আপনার পায়ে লেগেছে বলেছেন? এক কাজ করুন না! আমার এই বিছানাতেই পা-টা মুছে নিন না হয়।

বিছানাতে পা মুছব? তিনি যেন অবাক হন।–বলছেন কী।

কোথায় মুছবেন আর? পাপোশ তো নেই আমার ঘরে? কী হয়েছে? আমিও তো তাই করি সর্বদাই।

বিছানাতে পা মোছেন নাকি?

বিছানাতেই কি আর? তা কি কেউ মোছে নাকি? চাদরের তলাতেই মুছি। চাদর তুলে কম্বলের গায়ে মুছে দিই। চাদর আমার ফিটফাট ধোপদুরস্ত। চাদরের তলায় কী আছে কে দেখতে যাচ্ছে বলুন? ওপরটা চাকচিকন হলেই হল। চাদরের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক। বিছানার কী! নিন, মুছুন।

চাদর তুলে আমার কম্বল শয্যা উন্মুক্ত করি।

আমার কোনো বিষয়াসক্তি নেই। বিছানাকে যে চাদর দিয়েছি সেই ঢের-তার বেশি আদর করা ঠিক হবে না। মাঝে মাঝে পা মুছি তাই–এই, জুতো-টুতো পরার আগে কিংবা বাইরে থেকে ফিরে এসে। মাঝে মাঝে পদাঘাত করতে হয় বিছানাকে–তবেই ব্যাটা দুরস্ত থাকে।

তিনি পা নিয়ে ইতস্তত করেন।

নইলে নাই পেলে বিছানা মাথায় উঠবে যে! অনেকে অবশ্যি বিছানাকে মাথায় করে রাখেন। ঝালর দেওয়া সুজনি টুজনি বিছিয়ে তার ওপর। আমার মতে, বিছানা হচ্ছে ঘুমোবার জন্যে, ঘুমটি হলেই হোলো। শান্তিতে ঘুম-নির্বিবাদ শান্তি। তার জন্যেই বিছানা। বিছানায় বিছা না থাকলেই হোলো। নেই আমার। কামড় বসাবার কেউ নেই। বিয়ে করিনি তো।

সারারাত বিছের কামড় সইতে পারবেন না বলেই নাকি?

আঁক-ফাঁকের দেমাক সয় না আমার। তার ভেতর মাথা গলাই না আমি। অঙ্ক মেলাতে পারতুম না বলে অঙ্কশায়িনীও মিলল না বোধহয়। ভালোই হোলো একরকম। বিছানাকে নাই দিতে হোলো না, বিছানাময়ীকেও নয়।

জীবনমন্থনের বিষভাগকে বাদ দিতে গিয়ে অমৃতের ভাগেও বঞ্চিত হলেন শেষটায়। জীবনটাই বিস্বাদ করলেন। আমার ভাষাতেই যেন তাঁর বিসংবাদ শুনি-ফাঁকি দিয়েছেন নিজেকেই। ফাঁকি পড়েছেন একেবারে।

সাধ্য কী! আমি বলি-ননচার অ্যাভর ভ্যাকুয়াম, বলে না? কোথায় ফাঁক রাখার যো আছে কি? প্রকৃতিই থাকতে দেয় না। ভগবান একেবারে ফাঁকি পড়তে দেন না কাউকেই। সব ফাঁক সবার ফাঁকই ভরাট করে দেন একেক সময়-ভগবানের প্রকৃতিই তাই।

বটে? তিনি জানতে চান তাহলে শয্যাসঙ্গিনীও ঘটে যায় একেক সময় বলছেন? ই বিয়ে না করলেও?

আমি কী বলব? আপনিই বলুন। এসব কথা কি কাউকে কখনো মুখে বলার? নিজের মনে নিজ গুণেই সমঝে নিতে হয়ে। তাবৎ ভাবের কথাই তো ভাববাচ্য মশাই!

তিনি যেন ভাবে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। কথা সরে না তাঁর। তারপর বলেন-আশ্চর্য কিছু নয়!

আশ্চর্য কী! কার কোথায় কখনো বা পুরুষকারের ফাঁকিতে পড়ে না নাকি?

আশ্চর্য কী! কার কোথায় কখন কীভাবে কোন অভাব মোন হয়ে যায় কেউ বলতে পারে? কখনো দৈবাৎ মেলে, কখনো বা পুরুষকারের দ্বারা লভ্য পুরস্কার। মোটের ওপর ভগবতীর রাজ্যে কেউ কদাপি ফাঁক যায় না–একেবারে ফাঁকিতে পড়ে না কেউ। কালী কল্পতরু, কালও আবার তাই। কালক্রমে মেলে সব, মিলে যায় তাবৎ, জানেন নাকি?

কী জানি?

কী জানবেন আর! জানবার কী আছে! ভগবানের অপার রহস্য, কিছু কি তার জানা যায়? নিন, পা তুলে ভালো হয়ে বসুন তো! নইলে আমি স্বস্তি পাচ্ছি না।…শুতে পারছি না বলে শান্তি পাচ্ছিনে।

পড়ুন না শুয়ে। কে আটকাচ্ছে?

আপনাকে ওই প্রায়োপবেশনে রেখে কি শোয়া যায় মশাই? ভদ্রতায় বাধে যে? সঙ্গে সঙ্গে আমার অনুযোগ : লেখকা যদিও ঠিক ভদ্র নন কখনো-তাহলেও চক্ষুলজ্জা বলে একটা আছে তো।

ভদ্রলোক আমার উপরোধে ঢেকি গেলার মতন সসঙ্কোচে চাদরের এক ধারটা তোলেন এ তো কম্বল দেখছি কেবল। দুখানা কম্বল। এই আপনার বিছানা! তোষক–টোষক নেই?

পাবো কোথায়? কে দেবে? জেলখানার দৌলতে পাওয়া ওই কম্বল দুটোই দুনিয়ার সম্বল আমার।

অ্যাঁ? কী বললেন? জেলখানার কম্বল?

হ্যাঁ। চুয়াল্লিশ ডিগ্রীর অবদান। সেখানে হাজত বাসের সময় ও দুখানা দিয়েছিল–একটা পাতার জন্যে আর একটা গায়ে দেবার। তারপর আদালতে কারাদণ্ড হবার পর সেখান থেকে বহরমপুরের জেলে চালান যাবার কাছে ওদুটো নিতে হহলো-শীতকাল ছিল কিনা তখন! প্রহরী আর কম্বল–পরিবেষ্টিত পৌঁছলাম বহরমপুরে গিয়ে। কম্বল নিয়েই ঢুকলাম সেখানকার গারদে।

তারপর?

সেখান থেকে খালাসের সময় আমায় বললে যে, তোমার যা জিনিসপত্র আছে, যা যা সঙ্গে এনেছিলে নিয়ে যেতে পারো। নিজের বলতে ওই কম্বল দুখানাই ছিল। নিয়ে এলাম সমভিব্যাহারে। বাধা দিলে না কেউ। ব্যবহারে লাগিয়েছি এখন।

পলিটিক্যাল আসামী বলে হৃক্ষেপ করেনি কেউ। সেইজন্যেই আনতে পেরেছেন।

আনন্দবাবুও সেই কথাই বললেন…

আনন্দবাবুটি কে?

এই বাড়ির মালিক। আনন্দমোহন সাহা। তাঁর এই বাসায় তিনিই তো ঠাই দিয়েছিলেন আমায়। দুঃখের বিষয়, এখন আর বেঁচে নেই। সস্ত্রীক স্বত। আহা, তাঁরা বেঁচে থাকতে কতো ভালোমন্দ খেয়েছি যে! পায়েস পিষ্টক ভুনিখিচুড়ি-ভূরি ভূরি খেয়েছি। খিচুড়িটা ঠিক পোলাওয়ের মতই খেতে-প্রায়ই আসত তাঁদের বাড়ি থেকে। আর পায়েস। আহা, সে কী পায়েস! আয়েস করে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার মতন। খাসা চাল, দুধে নয়, ক্ষীরের মধ্যে সেদ্ধ করা আগাগোড়া। তেমনটি আর হয় না। আজকাল কোথাও খেতে পাই না আর। আনন্দ বিয়োগে ততটা নয়, ওই পায়েসের শোকেই আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল–আমার জীবনের আনন্দ তিনি নিয়ে গেছেন। সেই আনন্দবাবুই এই কম্বল দেখে বললেন, আরে ভাই! করেছো কী! জেলখানার মাল নিয়ে এসেছে! কেউ দেখতে পেলে আর রকে থাকবে না–চুরির দায়ে ধরা পড়বে যে! হাতকড়া পড়বে। আর এবারকার জেলটা ঠিক বিরিয়ানি খাবার হবে না, হবে দস্তুর মতন ঘানি টানার।…সরিয়ে ফেল সরিয়ে ফেল এক্ষুনি।

বললেন তিনি। এই কথা বললেন?

হ্যাঁ। শুনেই না আমি সরিয়ে ফেলেছি তক্ষুনি। চাদরের তলায় চাপা দিয়েছি তাদের।

আর ঐ বালিশটা পেলেন কোথায়? নক্সাকাটা ওয়াড় দেয়া খাসা বালিশ তো? ওটাও কি জেলখানার নাকি?

না। ওটা আমার বোন পুতুল দিয়েছিল আমাকে। একদা সে এসে দেখল কি, আমার মাথাটা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে…

মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল? আপনার মাথা?

আহা, ওই হোলো। এই বিছানতেই গেল না হয়। গড়াগড়ি যাচ্ছিল তো ঠিকই। আর টাকা মাটি মাটি টাকা যদি হতে পারে তো বিছানার মাটি হতে বাধা কিসের? তাই না দেখে সে তক্ষুনি বেরিয়ে কোত্থেকে একটা বালিশ কিনে এনে উপহার দিল আমাকে। ওই বালিশটাই। সঙ্গে আবার ওয়াড় দিল খান দুয়েক। দুখানা কেন? শুধিয়েছিলাম তাকে। যাতে আমায় কাঁচাকাচির কাজে না যেতে হয় সেইজন্যেই দুখানা–একটা যোবা বাড়ি কাঁচতে যাবে, আরেকটা পরানো থাকবে। কাঁচাকাচির কাজ করলেও মেয়েরা কখনো কাঁচা কাজ করে না।

তাই বলুন! কিন্তু এই কম্বল শয্যার সঙ্গে ঐ উপাদেয় উপাধানের খাপ খাচ্ছে না ঠিক। কেমন বেখাপ্লাই ঠেকছে।

জেলের কি তার জিনিসের কোনো নিন্দে করবেন না আপনি আমার কাছে। আমি বলে দিই। তার দৌলতেই আমার এমন দেহলাভ আর এই দেহরক্ষার জন্যে এহেন শয্যা–তা জানেন?

জানলাম। কিন্তু এইটে আমি বুঝতে পারছিনে আপনার এমন সব বোন থাকতে তাঁরা কি এই ঘরটার ওপর একটু নজর দেন না? সাফসুফ করতে চাননি কখনো কেউ?

চাননি কি আর? বিনি ইতু পুতুল–যে এসেছে, ঘরের এই চেহারা দেখেছে, সে-ই এর হাবভাব বদলাতে চেয়েছে, কিন্তু দিচ্ছে কে হাত লাগাতে? বিনিকে নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক গল্প লিখেছি এককালে মানি, সে-সবের বিনিময়ে টাকাও পেয়েছি দাদার তা জানি, কিন্তু–তাই বলে দাদার লেখা বিকিয়েছে বলে তার মাথা কিনে নেয়নি, আমার কি আমার ঘরের ওপরে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাকে দিইনি আমি। আর ইতু কি পুতুল এ-ঘরের জঞ্জালে হাত লাগাতেই না আমার সঙ্গে হাতাহাতি বাঁধার যোগাড়। যতই ইতুদেবীর পূজারী কি পৌত্তলিক আমি হই না কেন, আমার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় কারো হস্তক্ষেপ আমি সইতে পারি না। ব্যক্তিত্বহানিতে আমি নারাজ। ব্যক্তিত্বই তো একজনের চরিত্র। চরিত্রহীন হতে চায় কে?

ঘর পরিষ্কারের সাথে ব্যক্তিত্বের, ব্যক্তি-স্বাধীনতার কী সম্পর্ক মশাই? তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না।

ঘর কি আমার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় মশাই? আমার ঘরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বও কি জড়িত নয়? কী বলেন! আমার মনের রূপের বহিঃপ্রকাশ তো এই ঘর। খানিকটা অদ্ভুত নিশ্চয়ই। আমার অন্তঃকরণের পুঞ্জীভূত জঞ্জালের অভিব্যক্তি ছাড়া কী আর? সত্যি বলতে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সোফা সেট সাজানো পোশকী ঘরে লোফার আমি যেন ঠিক স্বস্তি পাইনে।

বুঝতে পেরেছি। এই হেতুই কোথায় আপনি হবেন এক বিরাট জমিদারি আর সাত মহলা বাড়ির সুসজ্জিত সাতষট্টিখানা ঘরের মালিক, খাটপালঙ্ক গদি সাজানো ঘর সব, তা না হয়ে. গদির কথায় তাঁকে গদ হয়ে উঠতে দেখি।

আর কোথায় এহেন এক ঘরের এই চৌকিদারি আমার। তাঁর বাক্যটা আমিই সম্পূর্ণ করি : অবশ্যি, সেই সাথে কয়েকটি চটিরও মালিক বটি।

চটি না বলে স্লিপার বলুন বরং।

স্লিপার তো আমিও কিছু কম নই। ওরা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, আর আমি সর্বদা এই শয্যায় নিক্ষিপ্ত। তফাৎ এই, ওরা সব জোড়ায় জোড়ায়, আর আমার আদৌ কোনো জোড়া নেই। এ ঘরে নেই অন্তত।

সারা বাংলা মুলুকেই আপনার জোড়া নেই। কথাটা যেন তার ব্যাজস্তুতিচ্ছলেও বলা নয়।–তা জানি।

জুড়ি একজনা ছিল বটে–কিন্তু সে জুড়ি তো আমি হাঁকিয়ে দিয়েছি কোকালে। ঘাটশিলার রেলগাড়িতেই। বললাম না আপনাকে?

অন্য জুড়ি জুটলে এমনটা হতো না। বিয়ে করলে এভাবে থাকতে পারতেন না কিছুতেই। বোন না হয়ে বৌ হলে কি আর এসব আবর্জনা বরদাস্ত করত? দরকার হলে হাতাহাতি করেও সব জঞ্জাল সাফ করে ছাড়ত এক লহমায়।

তা হয়ত হতো, কিন্তু সেই জঞ্জাল সাফ হতো কি করে? আমার প্রশ্ন রাখি।

কোন জঞ্জাল?

সেই জঞ্জাল হটানো জঞ্জাল? তিনি আবার যে পুন্নাম নরক আমদানি করতেন-সেই সব?

স্ত্রীপুত্ররা সব জঞ্জাল নাকি আপনার কাছে? তাদের অবশ্যি মায়াজাল বলেছে বটে শাস্ত্রে, কিন্তু…তাহলে আপনার বোনরাও তো আপনার কাছে জঞ্জাল একরকম?

মোটেই না। আমার কাছে তারা সব নন্দন কানন। নন্দন অংশ বাদ দিলেও–সেই পারিজাত সৌন্দর্য-সুরভির সীমা নেই, তুলনা হয় না। বন উপবন যাই বলুন, সেসব ব্যক্তি-স্বাধীনতার হকারক নয়। স্বচ্ছন্দ বিচরণের স্থান। আস্তে আস্তে তারা সব ছেড়ে যায়, বেঁধে রাখে না, বাঁধা থাকে না। বন ক্রমেই গভীরত্র হয়ে নিছক রোদনের অরণ্যরূপে, কালক্রমে নিজে সংসারসমুদ্রে গিয়ে হারিয়ে যায়। তারা তো ছাড়ান দেয়, ছেড়ে যায় যথাসময়ে, কিন্তু বৌকে তো আর ছাড়ানো যায় না কিছুতেই। কখনই না।

দরকার কি তার?

সিন্ধুবাদের সেই গলগ্রহের ন্যায় সূতহিবুকযোগে লব্ধ গোধূলি লগ্নের উদ্বাহিত সেই ভার্যাকে ঘাড় থেকে আর নামানো যায় না যে! তারপরে শেষকালেতে মাথার রতন লেপটে রইলেন আঠার মতন! কবি ডি এল রায় একথা কেন বলে গেছেন কে জানে! যে জন্যেই বলুন, মোদ্দা কথা এই, তারপর সেই নাছোড়বান্দার নেহাৎ বান্দা হয়ে বন্দীদশায় যাবজ্জীবন কাটানো!

তাই বলছেন আপনি? বৌয়ের বিরুদ্ধে এই আপনার অভিযোগ!

আমি কেন বলব? বৌয়ের বিরূদ্ধে আমার কোনই অভিযোগ নেই। আমি জানাই : আমার আবার অভিযোগ কিসের! বিয়েই করিনি আমি। মাথা নেই তো মাথাব্যথা কিসের? কিন্তু যাঁরা করেছেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যাঁদের, তাঁদের সেই ফাস্টহ্যাণ্ড নলেজের ফল গল্প-কাহিনীর ছলনায় তাঁদের আত্মচরিতেই ব্যক্ত হয়েছে। আমার বন্ধুরাই মুখে না বলে লিখে জানিয়ে গেছেন।

লিখে জানিয়েছেন? বলেন কি?

কেন, পড়েননি নাকি? কে যেন তার বৌকে কুয়াসার আড়ালে হারাতে চেয়েছিল অবশ্যি মেয়েটি হারায়নি শেষ পর্যন্ত। হারাবার কি হারবার পাত্র নয় মেয়েরা হারিয়ে না গিয়ে উলটে তারাই হারিয়ে দেয় আমাদের।…সেই কার যেন স্ত্রীকে শৃঙ্খলের মত বোধ হয়েছে, কে যেন আবার দেদার পাম্প করে দিয়ে স্টোভ ফেটে বৌয়ের অপঘাতের অপেক্ষায় বসেছিল–বিস্ফোরণের এক যাত্রায় সহধর্মিণীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়াও তার বাঞ্ছনীয় ছিল নাকি–পড়া নেই আপনার?

পড়ব না কেন? বিখ্যাত গল্প সব। কিন্তু আপনার লেখক বন্ধুদের একজনেরই তো গল্প এগুলো–আর কোনো বন্ধুর কেউ কি এরকম দুর্লক্ষণ দেখিয়েছেন? তার উল্লেখ করুন।

দরকার করে না, উনি একাই একশ। আমাদের সবার মুখপাত্র। গৌরবে বহুবচন-তাঁকে। নিয়েই আমাদের গৌরব। হাঁড়ির একটা চাল টিপলেই আর সবার হালচাল জানা যায়। তাঁর লেখাতেই আর সকলের টিপসই রয়ে গেছে। তবে একথা ঠিক, গল্পকথা হলেও এগুলি অল্প কথা নয়। এর মধ্যে শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু।

কিন্তু শুনেছি তো, তাঁর মতন পত্নী-বৎসল নাকি হয় না…

ঠিকই শুনেছেন।…স্ত্রী না হলে একদণ্ডও চলে না ওঁর। বউকে ছেড়ে এমন কি আমেরিকায় গিয়েও উনি স্বস্তি পাননি–একদিনও তিষ্ঠোতে পারেননি সেখানে। সম্ভাবিত নোবেল প্রাইজ পাবার লোভ সংবরণ করে দুদিন বাদেই ন্যাড়া মাথায় নিজের সেই বেলতলাতেই ফিরে এসেছিলেন আবার।

কেন এলেন বলুন! তাহলেই বুঝবেন–স্ত্রী কী চীজ।

আসতেই হবে যে। আর সেই কারণেই তো আমার বলা–দাম্পত্য জীবনের পরিণতিতে দাসমলোভাব দাঁড়ায়, অন্য গতি থাকে না আর। হয়ত একটু আত্মতুষ্টির আবহ সৃষ্টি করলেও আত্মস্ফুর্তির পক্ষে ভয়াবহ। বউ কোনো বাড়াবাড়িতে যেতে দেয় না, স্বচ্ছন্দবিহার চলে না, বাড়িতেই বন্দী হয়ে থাকতে হয় সবসময়-অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায়-কেচ্ছার ভয় আছে না? সেসব বালাই নেই ব্যাচিলারের। বউ অন্তরের আয়ের সব পথ বন্ধ করে দেয়–নিজের কাছে অন্তরীণ রাখে। এইজন্যেই সে ব্যক্তি-স্বাধীনতার অন্তরায়।

কিন্তু অসুখবিসুখে দেখাশোনা করবার…

যেমন সে, নানান আধিব্যাধি আমদানি করতেও তেমনি। বিবাহিত ব্যক্তির নানা অসুখবিসুখ তো লেগেই থাকে, কেন বলুন দেখি?

আপনিই বলুন না।

ঐ বউয়ের জন্যেই মশাই! বোগেই তো বোগ টানে। গোড়াকার বোগ ওই দারাই। দারারোগ দুরারোগ্যই। আবার ই বউয়ের হাতের সেবাসুখ পাবার লোভেই যতো না অসুখ! বউ এসে গায় মাথায় হাত বুলোবে, যত্নআত্তি করবে, তার মুখের আহা উঁহু শোনা যাবে সেইজন্যেই না! যার ঘরে বউ নেই তার কোনো ব্যায়োও নেই, অন্তত তেমনটা নেই এইজন্যেই।

আপনার অসুখবিসুখের সময় আপনি কি চান না আপনার প্রিয়জনরা কেউ এসে গায় মাথায় হাত বুলাক?

মাথায় থাক। অপর কেউ আমার গায় মাথায় হাত বুলোলে আমার গা জ্বালা করে– আমার মা ছাড়া আমার কপালে আর কারো করাঘাত আমি সইতে পারিনে-পাছে কেউ আমায় অসহায় অবস্থায় পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যায় সেই ভয়ে আমার কোনো অসুখই করে না কখনো। এই বছর পঞ্চাশ তো এই বাসায় কাটালাম, জিগ্যেস করুন না বাসার ঠাকুরকে, জানবেন একদিনের জন্যেও আমার কোনো মীল বাদ যায়নি। কোনো অসুখ করেনি কখনো। এমন কি একবার… কথাটা বলব কিনা আমি ভাবি একবার।

একবার? তিনি উসকে দেন আমায়।

একবার এ বাসায় ফুড পয়জন হয়েছিল অনেকদিন আগে। নৈশাহারের পরেই। পরদিন শুনি আগের রাত থেকেই বাথরুমে যাতায়াত শুরু হয়েছিল কারো কারো। পরের দিন সকালে উঠে বেরিয়ে গেছি, কিছু জানিনে, রাত্রিবেলায় ফিরে দেখি রান্নাঘর অন্ধকার। উনুনে আচটাচ পড়েনি, কী ব্যাপার? না, সারাদিন ধরে বাসাড়েরা কেউ বিশ পঁচিশ কেউ বা বাহান্নবার বিগলিত হয়েছেন–কেউ কেউ আবার হাসপাতালেও গেছেন নাকি। আমাদের। বাসার ওড়িয়া ঠাকুর-পরশুরাম পাঢ়ী–সে নাকি সন্ধ্যে পর্যন্ত সঠিক ছিল, কিন্তু তারপরে তাকেও এখন মুক্তকচ্ছ হতে হয়েছে। বাসার সবাই আজ ধারাবাহিক, তাই আজ রান্নাঘরে আঁচ পড়েনি, হাঁড়ি চাপেনি তাই।

বটে?

অথচ সেদিন সকালে যেখানে গেছলাম সেই বন্ধুর বাড়িতে বেদম খেয়েছি–খাবার লোভেই আমার যাবার গরজ তো-তারপরে বাসার ঐ নিরাহার চেহারা দেখে বেরিয়ে পড়তে হলো আবার। দেলখোস কবিনে গিয়ে গিলতে বসে গেলাম।

আপনার জীবনে কখনো কোনো অসুখবিসুখ করেনি তাহলে? এই কথাই বলতে চাইছেন আপনি?

করেছিল বইকি। একবার করেছিল। মোক্ষম অসুখ। প্রায় মোক্ষ প্রাপ্তির কাছাকাছি নিয়ে গেছল বলতে কি! এখানে সেখানে ভালোমন্দ খেয়ে না খেয়ে-বহুকালের ব্লডপ্রেসার তো আমার। দারুণ প্রেসার। তার দরুন একটু স্ট্রোক হয়েছিল হঠাৎ। ব্লাডপ্রেসার মানতাম না, ডাক্তারের মানাটানা না শুনে তার ওপরেও খেতাম–একটানা গিলে যেতাম-মাংস ডিম মাখন ক্রীম–তার ফলেই ওই দুর্ঘটনা! কিন্তু তারপরেই আমি সাবধান হয়ে গেছি খুব। কোথাও যাই না, গেলেও তেমনটা খাই না। কোনো কোনো সাহিত্যিক বন্ধুর জন্মদিনে বেজায় ঘটা করে যোড়শোপচারে খাওয়ানো হয়, সেখানে গেলে পাছে লোভ সামলাতে না পারি–তাই যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি, তাঁরাও বেঁচে গেছেন মনে হয়, কেননা কারো জীবনের শুভদিন অপর কারো শোকাবহ মৃত্যুদিন হয়ে জন্মোৎসবটা নষ্ট হোক, তারাও তা চান না নিশ্চয়। নিজ গুণে ক্ষমা করেছেন আমাকে।…

মুক্তারামের তক্তারামে শুয়ে-অচিন্ত্যবাবুর ভাষায়-শুক্তারাম খেয়ে সুখে রয়েছেন?

সর্বদা মার্কাস স্কোয়ারের দূর্বা-মথিত দুর্বার মুক্ত বায়ু সেবন করে-আমি জানাই-এই, সকালে খাই চারটি ভাত, কত কটি, চোখেই তো দেখলেন? দুপুরে বোনের বাড়ির থেকে আমার ভাগনের নিয়ে আসা একখানি রুটি, কয়েক টুকরো মাছ, একটু তরকারি আর রাত্রে খালি হরলিক। তার সঙ্গে হয়ত এক-আধটা বিস্কুট। তবু আমার রক্তের চাপল্য যায় না মশাই।

কখনো আপনার কোনো অসুখ হয়নি একথা আমার বিশ্বাস হয় না।

হয়নি কি? হয়েছে। ছেলেবেলাতেই হয়ে গেছে। কী অসুখটাই না ভুগেছি তখন–কত রকমের যে অসুখ! যত রকমের সুখ আর অসুখ আছে তার উপভোগ সেই অতি কৈশোরেই হয়ে গেছে আমার। সে সবের লিস্টি দিয়ে কী হবে? যেমন রোগা ছিলাম তখন, তেমনি রোগও ছিল কত না। কিন্তু সেও সেই মা এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। বিছানার পাশটিতে বসে থাকবে দিনরাত, সেই লোভেই তো! আর, ইস্কুলে যেতে হবে না, শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়া যাবে মজা করে–কী আনন্দ! সুখের জন্যই আমাদের যতো অসুখ, বুঝেছেন? আমার বক্তব্যের উপসংহার-তারপর সেই যে বাড়ির থেকে পালিয়ে তীরবেগে বেরিয়ে পড়লাম উদার পৃথিবীতে, তারপর থেকে আমার একটিও অসুখ করেনি কখনো। কার জন্যে করবে?

তা না হয় হলো, কিন্তু এখন আপনার এই বয়সে যদি হঠাৎ কোনো অসুখ বিসুখ করে, কোনো শক্ত অসুখই হয়, এখন তো যে কোনো সাধারণ অসুখই সহসা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। এখানে বাসার সবাই নিজের কাজ নিয়ে আপন ধান্দায় ব্যস্ত এই অবস্থায় একলাটি কী ব্যবস্থা হবে আপনার? বলুন দেখি?

কী হবে আর? মারা যাবো? এই না? তা বলে দৈনন্দিন মার খেয়ে মরতে হবে না তো? মারা যাবার সময় কারো ওই আহা-উঁহু শুনতে পেলাম আর নাই পেলাম। কী ক্ষতিবৃদ্ধি? তখন কি কারো ফোঁসফোঁসানি কানে যায়, না ভালো লাগে মশাই?, বিশেষ করে শুধু আমিই যখন মারা যাচ্ছি–আর কেউ মরছে না আমার সঙ্গে অন্তত, এই মুহূর্তে নয়–তখন আমার অন্তরের সেই হাহাকার তাদের ঐ আহাকারে কি থামবার? সেই কালে তাদের ওই সহানুভূতি আমার মরার ওপর খাঁড়ার ঘার মতই মনে হবে না কি?

কিন্তু আপনার যদি বৌ থাকত এ সময়–

রক্ষে করুন! সারা জীবন ধরে বৌয়ের অসুখ সামলাতে কে? তারা কিছু কি কম অসুখে ভোগে নাকি! তাদের অসুখের হামলা পোহাতে হোতত না দিনরাত? নিজের অসুখের দায় বরং সওয়া যায়, কিন্তু সেই বোঝার উপর বৌয়ের বিসুখের ঐ শাকের আঁটিটি-তার ঠ্যালা কি কম নাকি?

আরে মশাই, দিনরাত অসুখে ভুগবে কেন সে? দেখেশুনে স্বাস্থ্যবতী এক যুবতাঁকে বিয়ে করতে পারবেন না? পরীর মতন একটি বৌ হলে আপনার ঘর আলো করে থাকত নাকি? আপনার দেখাশোনাও করত সে?

সত্যি কথা বলব? পরীর মত মেয়ের কথা বলছেন? আমার জীবনে কোনো পরীর দ্বারাও আমি দৃষ্ট হতে চাইনি, অন্ততঃ এভাবে নয়, শুধু একটি মেয়ের দ্বারাই পরিদৃষ্ট হতে চেয়েছি।

কে সে মেয়েটি, জানতে পারি?

আমার মা।

তিনি তো কবে মারা গেছেন।

মা-রা কি কখনো মারা যাবার? তাঁরা চিরকাল বেঁচে থাকেন, থাকতে হয় তাঁদের। ছেলেকে দেখাশোনার জন্যেই, বুঝলেন? ছেলের মরণের পরও তাঁকে বাঁচতে হয় ছেলেকে কষ্ট করে পুনর্জন্ম দিতেই আবার। ছেলেকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে হবে না? জন্মজন্মান্তরের মায়ের সেই ঋণ কি শোধ হবার কখনো? এ জন্মে না–কোনো জন্মেই নয়।

.

১৯.

মাকে একদিন আমি শুধিয়েছিলাম, মা, তুমি কি কখনো ঈশ্বরকে দেখেচ?

দূর খ্যাপা! ঈশ্বরকে দেখবি কি! ঈশ্বরকে কি দেখা যায়?

যায় না? বাঃ! তবে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেখতেন কি করে? আমি বলি–তিনি কি তাহলে মিথ্যে কথা বলেছেন?

না, মিথ্যে বলবেন কেন? তিনি নিজেকেই দেখতেন–নিজের মধ্যে নিজেকে। মা বললেন-ভগবানের কথা ভাবতে ভাবতে উনি নিজেই ভগবত্তা লাভ করেছিলেন। সেই যে, কাঁচপোকার কথা ভাবতে ভাবতে আরশোলা একদিন কাঁচপোকা হয়ে যায়–বলতেন না উনি?

ঈশ্বরপ্রাপ্তি, ঐশ্বর্যপ্রাপ্তি সব। যদি তিনি ধরা দিতেন না, তাঁর ঐশ্বর্য-বিভূতি ব্যবহার করতেন না কখনো।

নিজেকেই নিজে দেখতেন, তুমি বলছ মা, সেটা আবার কী রকম?

তুই যেমন আয়নায় নিজেকে দেখতে পাস না? সেই রকম আর কি! আত্মসমোহিত অবস্থায় চিত্তের আয়নায় আত্মসাক্ষাৎকার হতো তাঁর।.বুঝেছিস এবার?

না তো। কিছু বুঝলাম না।

আমার যদি সন্মোহনবিদ্যা জানা থাকত তাহলে তোক বুঝিয়ে দিতে পারতাম এখুনি–স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নিলোকে ঘুরিয়ে সব দেখিয়ে আনতাম তোকে…মা দুর্গাকে দেখতে পেতিস স্বচক্ষেই।

হিপটাইজম করে দেখাতে?

হ্যাঁ রে হ্যাঁ, সেদিন হিন্দু হোস্টেলের ম্যাজিক খেলায় সেই যাদুকরটা যেমন আকাশ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি টাকা নোট সব বার করে আনছিল দেখিসনি? তোদের সবাইকে হিটাইজ করেই তো! সেই রকম, ধ্যানের সাহায্যে নিজেকে সম্মোহিত করার এক কায়দা আছে–একদিকে মন রেখে একটানা ধ্যান করে যেতে হয়, তার ফলে যা হয় তাকেই বলে সমাধি। উনি সমাধিস্থ অবস্থায় আত্মদর্শন করতেন।

তা হলেই আমার ভগবানকে দেখা হয়েছে। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম একটানা ধ্যানে বসব কি, একটুক্ষণের জন্যেও মনকে কোথাও আমি বসাতে পারিনে। ভগবানের কথা ভাবতে গেলেই যত রাজ্যের জিনিস আমার মগজে ভিড় করে আসে। কী করি আমি বল তো? ও ছাড়া কি ভগবানকে দেখবার কোনো শর্টকাট নেই? ইংরেজী মেইজির মই?

থাকবে না কেন? সব কিছুরই শর্টকাট আছে। বোম্ ভোলানাথ বলে গজায় কষে দম দিলে মুহূর্তের মধ্যে কৈলাসে শিবদুর্গার সান্নিধ্যে গিয়ে পৌঁছোনো যায়; সাধু-সন্নিসিরা তাই করে থাকেন শুনেছি, অমনি করে ইন্দ্রলোকে অপ্সরাদের নৃত্যগীত দেখেন–শোনন নাকি! তোর বাবা তো সন্ন্যাসী ছিলেন এক সময়, গাঁজাও খেতেন নাকি, তাঁকেই শুধাগে না!

শুধাবার দরকার কি? এখনো তো মাঝে মাঝে খান, আমায় লুকিয়ে। তাঁর খেয়ে রাখবার পর সেই ছিলিমটা নিয়ে একদিন না হয় টেনে দেখব লুকিয়ে-এক টান মাত্তর! দেখি না কী হয়!

এই মরেছে। তাহলে তোর সঙ্গে সঙ্গে কৈলাস প্রাপ্তি ঘটে যাবে। সেইখানেই থেকে যাবি-আমার কাছে ফিরে আসতে পারবি না আর। মহেশ্বরের কাছেই থাকতে হবে তারপরে-নন্দীভৃঙ্গির সাকরেদ হয়ে।

চাইনে আমার ভগবানকে তাহলে। আমার সাফ জবাব–তোমাকে ছেড়ে ভগবানকে চাচ্ছে কে? নন্দীভৃঙ্গির সাকরেদ হবার দায় পড়েছে আমার।

বাঁচালি বাপু! হাসলেন মা-তোর বাবা সন্ন্যাসী হয়ে সংসার ছেড়ে গেছলেন, তুইও যদি আবার তাই করিস তা হলেই হয়েছে।

কী দুঃখে সন্ন্যাসী হব মা! ভগবানের খোঁজে? ভগবানের ওপর অতখানি টান নেই আমার। কলিগায় গৌরদা রামপদদাদের একটা আড্ডা আছে জানো মা? ভারী তর্কাতর্কি হয় সেখানে সব সময়। ভগবান আছে কি নেই–এই নিয়ে তর্ক যততা। আমি সেখানে বসি গিয়ে এক এক সময়। শুনি সব।

তাই নাকি?

কলিগাঁয় ফকির সরকারের বাড়ি থেকে বই আনতে যাই না? রামপদদাদের আড্ডাতেও– যাই তখন। কলিগাঁয় অতুল গোঁসাই আমাদের ক্লাসফ্রেন্ড-তাদের বাড়িতেই সেই আড্ডাটা! …গৌরদা কে হয় যেন তাদের। তাদের বাড়িতেই থাকে। আর, রামপদদা হচ্ছেন গৌর গোঁসাইয়ের বন্ধু!

তার চেয়ে বয়সে বড়ো বুঝি?

অনেক বড়ো। তিরিশ বত্রিশ বছর বয়েস হবে বোধ হয়। তারা বলে যে, তারা নাস্তিক, ঈশ্বর ধর্ম কিছু মানে না। ওসব কিছু নেই নাকি। মানা তো ভারী খারাপ, না মা?

কেন, খারাপ কিসের! মা একেবারে নির্বিকার না মানলে কী হয়? ভগবান রাগ করেন? না,না-হয়ে যান?

বয়সে তারা বড় হলেও আমি তাদের সঙ্গে তর্ক করতে যাই, কিন্তু পারি না কিছুতেই। তারা বলে, ঈশ্বর আছে যে তার প্রমাণ কোথায়? প্রমাণ দাও আগে। আমি কি করে প্রমাণ দেব? কিছুই তো জানি না আমি। তুমি বলে দাও না আমায়-ঈশ্বরকে কি প্রমাণ করা যায়? প্রমাণ আছে কোনো তার অস্তিত্বের?

আছে বই কি। প্রমাণও করা যায় নিশ্চয়।

কী প্রমাণ? আমি জানতে চাই–কী করে প্রমাণ করা যায়–বলে দাও না তুমি আমায়! ঈশ্বরের প্রমাণ বিন্দুমাত্র। মা জানান-বিন্দুমাত্রই প্রমাণ।

বিন্দুমাত্র প্রমাণ?

হ্যাঁ, বিন্দুর যেমন অস্তিত্বই শুধু সার, সেই রকম আর কি! তোর ঐ জ্যামিতি দিয়েই প্রমাণ করে দেওয়া যায় ভগবানকে। মা বিশদ হন–পয়েন্ট থেকে ইচ্ছে মতন রেডিয়া নিয়ে সার্কেল টানা যায় না? রেডিয়াস্ মাফিক কোনোটা বড়ো সার্কেল হয়, কোনটা বা ছোট সার্কেল? হয় না? সেই সার্কেলটাই হচ্ছে পয়েন্টের অস্তিত্বের প্রমাণ তখন। তাই না? পয়েন্ট একটা ছিল বলেই তো তার থেকে রেডিয়াসের সাহায্যে সার্কেল টানা গেল? তেমনি আমরাই হচ্ছি ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ। আমরাই তাঁর সার্কেল, নিজগুণে তিনি টেনেছেন আমাদের-তাঁর সেই টান থেকে বেরুনো।

ভগবানের সার্কেল আমরা?

হ্যাঁ। কারো বা বড় সার্কেল কারো বা ছোট সার্কেল। কেউ বা সূর্য হয়েছে, কেউ বা শুধুই যুঁই। কেউ রবিঠাকুর, কেউ বা…কেউ বা তোর ওই রিনি! যার যেমন ব্যাস তার তেমনি বৃত্ত। সেই বিন্দুমাত্র ঈশ্বর আছে বলেই জগদ্ব্যাপী আমাদের অস্তিত্ব। ঈশ্বর আছে বলেই আমরা আছি। আমরা হয়েছি, আমরা হচ্ছি। আমরা স্ব।

তা না হয় হলাম, কিন্তু তাই বলে ঈশ্বরকে তোমার তো জানা যাচ্ছে না মা!

জানা যায় না, তবে বোঝা যায়। ঠাকুর যাকে বলতে বোধে বোধ। সেই ঈশ্বর বোধের থেকে যে জ্ঞানের উদয় তাই হলো গিয়ে তোর বেদ। আর, বেদের সেই বোধোদয় থেকে ব্যাস নিয়ে আমাদের এই জীবনের বৃত্ত রচনাই হচ্ছে গিয়ে মহাভারত। যার মানে কিনা, মহাপ্রকাশ। ঈশ্বরপ্রকাশ। আমাদের জীবনে ঈশ্বরের বৃত্তলাভ। আর আমাদের ঈশ্বরবৃত্তিলাভ।

বেদব্যাসের মহাভারত-জানি মা আমি। সায় দিই মার কথায়। সেই মহাভারত কী? ঈশ্বরের কথাই তো। তাঁর লীলাকাহিনী। ভগবান ভূতলে নরদেহ নিয়ে নেমেছেন-বিচিত্র দেহরূপে স্নেহরূপে তাঁর সেই রসায়ন। যেমন তাঁর কথা তেমনি আমাদের জীবনকথাও আবার। ঐ মহাভারতই আমাদের জীবনে কোনো না কোনো রূপে কখনো না কখনো ঘটছেই। ঘটবেই।

আমাদের জীবনবৃত্তান্তই লিখে গেছেন সেই মহাকবি? কবি বেদব্যাস?

আবার একালের তোর ওই রবিঠাকুরও সেই বেদব্যাসেরই আরেক রূপ। আরেক দেহরূপ স্নেহরূপ সেই তাঁরই। তাঁর রচনাও অন্য এক মহাভারত। গীতাঞ্জলি পড়েছিস তো? কী সেটা? ভগবানের কথাই না?

হ্যাঁ মা। আবার তোমার রিনিও তাই। তাই না মা? রিনি অবশ্যি ভগবানের কথা কয় না, কিন্তু তাহলেও সেও ঐ ভগবানের কথাই। ভগবানের শেষ কথাই সে, আমার বোধ হয়।

যা বলিস! এই জীবনবৃত্তেই মরলোকে নরদেহী ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তা ছাড়া ঈশ্বরদর্শনের আর কোনো উপায় নেই। বুঝেছিস?

মার মোদ্দা কথাটা যা আমার মগজে ঢুকেছিল তা হচ্ছে এই যে, আমাদের জীবনের সব কিছুর কেন্দ্রেই তিনিই মূল। সেই কেন্দ্রমূল থেকে বোধের ব্যাস নিয়ে বৃত্তে এসে তিনি কাত হয়েছেন–তাঁর মুলাকাত পেতে হলে সেই বৃত্ত পথে–আমাদের প্রবৃত্তি পথেই যেতে হবে–নানা বৃত্তের নানান বৃত্তান্তে পদে পদে তাঁর সাক্ষাৎ পাব। নইলে তিনি মূলে হাবাৎ। কেবল মূলে তাঁর খোঁজ পেতে গেলে তিনিও নেই। আমরাও নাস্তি!

বহুরূপে সম্মুখে তোমার…এই জন্যেই বিবেকানন্দ বলে গেছেন, তাই না মা?

হ্যাঁ, তাই। ফলেন পরিচীয়তে-বলে না? সবকিছুর প্রমাণ হচ্ছে তার ফলে-ফলোভে। ঈশ্বর কল্পতরু আর কল্পতরুর প্রমাণ তার ফলেই তো মিলবার? তাই না?

হাতে হাতেই পাবার তো মা? আম লিচু যেমনটা আমি পাই?

নিশ্চয়! নইলে পরিচয়টা হবে কি করে? তাঁকে ডেকে তুই তোর কল্পিত ফল, এমনকি তোর অকল্পিতও যা–যদি তুই কল্পনাতীত ভাবে পেয়ে যাস, তাহলে সেটাই, ঈশ্বর যে আছে তার প্রমাণ হবে–নয় কি? ডেকে দ্যাখ, চেয়ে দ্যাখ তুই পাস কি না তবেই তো বিশ্বাস হবে।

অবিশ্বাস করে ডাকলেও তো ফল পাবো? তুমি বলেছিলে না মা আমায়?

ঈশ্বরকে মনে রেখে তোর কর্মবৃত্তির পথে তোকে এগুতে হবে–এগিয়ে যাবি–দেখবি ঈশ্বর হাত ধরে পদে পদে এগুচ্ছেন তোর সঙ্গে–তোর সহযোগিতা করছেন, পদে পদে তার সাহায্য পাবি, হাতে হাতে নগদ, দেখিস। দেখে নিস।

ঈশ্বরের সাহায্য পাব সব সময়?

বলছি তো, তবে ঈশ্বরের সহযোগিতা পেতে হলে আমাদের তাঁর বোধের সাহায্য নিয়ে নিজের মনের মত কর্মে প্রবৃত্ত হতে হবে–তবে তিনিও সেই সুযোগে আমাদের সঙ্গে সহকর্মে প্রবৃত্ত হবেন তাহলে নানান কর্মে প্রবৃত্ত তিনিই তো করছেন আমাদের। আমাদের কর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে তিনিই সারথি।।

তিনি তো তাহলে শ্রীকৃষ্ণ?–সারথি যখন তুমি বলছ? আর আমরা তাহলে?

আমরা পার্থ। পৃথিবীর সন্তান সব।

তাহলে তো আমরা কেউ কম নই মা। তাঁর সাহায্যে কুরুক্ষেত্ৰকাভ করতে পারি আমরা?

পারিই তো। মনের ঠিক প্রবৃত্তিটা ধরতে পারি যদি সেই বোধও তিনিই দিয়ে দেন। তাঁর কাছে চাইতে হয়। তাঁর কাছে চেয়ে পেতে হয় সেই বোধ। সেই বোধকে কর্মে রূপায়িত করতে তিনিই আবার সহায়তা করেন। আমাদের যথার্থ প্রবৃত্তির পথেই তাঁর দেখা পাওয়া যায়–পদে পদে সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে।

প্রবৃত্তির পথে? এটা তুমি কী বললে মা? প্রবৃত্তি তো ভালো নয়, নিবৃত্তিই ভালো– আমাদের যতো ধর্মশাস্ত্রে এই কথাই তো বলে মা? বলে না?

ধর্মশাস্ত্র পড়েছিস তুই?

তা পড়িনি বটে, আমার সব সেকেন্ডহ্যান্ড নলেজ। এখানে-সেখানে এর ওর তার লেখাটেখা পড়ে এই জ্ঞান হয়েছে–তাই থেকেই বলছিলাম–এমন কি তোমার ঠাকুরও তো ওই কথাই…।

ঠাকুর কক্ষনো অমন কথা বলেননি, বলতে পারেন না। তিনি ঈশ্বরে মন রেখে নিজের নিজের কাজ করে যেতে বলেছেন–যার যেটা কাজ। সবাইকে তিনি তার নিজের মতন হতেই বলেছেন–নিবৃত্ত হতে বলেননি কাউকেই। গিরিশ ঘোষকে তিনি অভিনয় করে যেতেই বলেছিলেন–যেটা তাঁর কাজ। এবং তাঁর প্রবৃত্তি বুঝে মদ্যপানেও কোনো দিন বাধা দেননি তাঁরা।

তাই বটে মা। মেনে নিতে হয় আমায়।

কবীরের কথা শুনেছিস? মুচির কাজ করত কবীর। কিন্তু কবিত্বে আমাদের রবির কাছাকাছি। রবিঠাকুরের যেমন গীতাঞ্জলি, তেমনি কবীরের ই দোঁহা। প্রবাসীর পাতায় ক্ষিতিমোহন সেনের লেখায় তার পরিচয় পাবি তুই, পড়ে দেখিস। তাঁকে একবার কে যেন বলেছিল, গঙ্গাসাগর তীর্থে চল না? কবীর বলল, কী হবে গিয়ে। আমার মন যদি ঠিক থাকে তো এখানেই মা গঙ্গা আমার। মন যদি চাঙ্গা তো কাঠুরিয়ামে গঙ্গা…আমি আমার কাজে লেগে থাকব। গঙ্গা মাঈর যদি খুশি হয় তিনি আমা এই জলের কটোরাইে এসে দেখা দেবেন। দিয়েছিলেন তিনি।…নিজের কর্মবৃত্তির পথেই কবীর পেয়েছিলেন মার দেখা।

তবে নিবৃত্তির কথাও কোন্ কোন্ মহাপুরুষ যেন বলেছিলেন মা, তাঁদের নাম এখন মনে পড়ছে না।

নিবৃত্তির পথে যাওয়া মানে ভগবানের বিরুদ্ধে যাওয়া। তা কি হয় নাকি রে? না, কেউ পারে তা কখনো। এটাই বোঝ না, ভগবান তো গোড়ায় নিজের মূলকেন্দ্রে চিৎরূপে নিবৃত্ত হয়েই ছিলেন, তাতে কোন সুখ নেই দেখে, কোন আরাম না পেয়েই না এই আনন্দের পথে, রূপের পথে অবারিত হলেন-প্রবৃত্তির পথে গা ভাসিয়ে দিলেন নিজের। তাঁর সেই স্রোতের উলটো দিকে কি যাওয়া যায়? কেউ পারে তা? চেষ্টা করলেও তিনি তার ঘাড় ধরে ঘুরিয়ে দেন যে! প্রবৃত্তির পথে আসতে হয় ফিরে আবার।

এখন মনে পড়ছে মা? আমি উসকে উঠি-নিবৃত্তির কথাটা বাবার মুখেই আমি শুনেছিলাম যেন।

যা, তবে তোর বাবার কাছ থেকেই ভালো করে জেনে আয়গে।

শুনেই আমি তক্ষুনি এক ছুটে চলে যাই বাবার কাছে, আর পরমুহূর্তে টেনিস বলের মতন বেয়ারিং পোস্টে ফেরত চলে আসি মার কোর্টে। বাবা বলছেন–সংস্কৃত শ্লোক-টোক

কী সব আউড়ে যেন বললেন, যার মানেটা হচ্ছে যে প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাম, অর্থাৎ কিনা, ভূতদের এইরকমই প্রবৃত্তি বটে, কিন্তু নিবৃত্তিইে নাকি রয়েছে মহাফল। ভূত কী মা?

ভূত কী, তা তুই জানিসনে?

আমিই তো, তাই না? তুমি তো আমায় ভূত বলে ডাকো একেক সময়, হনুমান কথাটা খুঁজে পাও না যখন। আমরাই তো:ভূত মা, তাই না? মারা যাবার পর প্রেত হয়ে যাব সবাই।

তোকে বলেছে! হাসলেন মা-মরবার পর তোকে প্রেত হতে হবে না কখনো–মা তা হতে দেবেন না। মায়ের পেটে জন্ম নিবি তক্ষুনি আবার।

অবশ্যি মার যদি, মানে তোমার যদি তাই অভিপ্রেত হয়। সে তো আর আমার ইচ্ছের ওপর নয়।…কিন্তু মহাফলটা কী জিনিস, যা নাকি নিবৃত্ত হলে মেলে?

কাঁচকলা!

বেলও তো হতে পারে? আমি বলি-বাবা যখন বেল খান রোজ রোজ?।

হ্যাঁ, তা হতে পারে? তবে সন্ন্যাসী হয়ে ন্যাড়া না হতে পারলে তো আর বেলতলায় যাওয়া যায় না রে! তুই কি তাহলে সন্নিসী হতে চাস?

কক্ষনো না। জটাজুট রেখে ছাইভস্ম মেখে কী লাভ? আমি তোমার ওই প্রবৃত্তির পথেই রয়েছি সব সময়।…কিন্তু মা, তোমার ওই প্রবৃত্তির কথাটা বাবাকে যখন বললাম না, শুনেটুনে বাবা কী বললেন জানো মা? বললেন যে, তোর মার কথাটা বিলকুল দর্শনবিরুদ্ধ। আমাদের কোনো দর্শনশাস্ত্রে এমন কথা বলে না।

দর্শন-টর্শন জানিনে, ষড়দর্শন পড়িনি কখনো। এটা হচ্ছে আমারনিজস্ব দর্শন–আমি নিজে যা দেখেছি, যা দেখছি–তাই। মা জানান-এখন বল তো তোর আসল প্রবৃত্তিটা

কোন্ দিকে? কোনদিকে তোর মনের ঝোঁক, বল দেখি আমায়?

বলব? বলব মা?… বলতে গিয়ে আমি আমতা আমতা করি, রিনির নামতা আওড়াতে পারি না কিছুতেই

বলল মা? আমার ঝোঁক খালি তোমার দিকে, তোমাকেই আমি দেখি তো। তোমাকেই দেখেছি, দেখছি সব সময়। বলে দৃষ্টান্তস্বরূপ আমার কথাটায় আরো একটুখানি জোর লাগাই : এটা হচ্ছে আমার নিজস্ব দর্শন।

.

২০.

ভগবদ্দর্শনের প্রশ্নটা বাবার কাছেও পেড়েছিলাম আমি।

বাবা বলনে, ধ্যানের দ্বারা ধরা যায়। ধ্যাননেত্রেই তিনি প্রত্যক্ষ হন। আর ধ্যানে বসতে হলে? এমনি করে পদ্মাসনে নাসিকাগ্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ ক বসতে হবে–একটানা, যতক্ষণ পারো। বলে তিনি দৃষ্টান্তস্বরূপ হতেন।

এদিকে পদ্মাসনে বসাটা তেমন সোজা নয়, বসতে গেলে উটে পড়তে হয়। আর উলটে যদি নাও পড়ি নেহাত, অমন আড়স্টভাবে বসে থাকাটাও কস্টকর। ওর চাইতে কুশাসনে বসাটাও ঢের সুখের। তাছাড়া ঐভাবে বসে ভগবানের ধ্যান করতে গেলে নাস্ত্রে ডগায় আনব কি, আমার সবটা মনগিয়ে যন্ত্রণাকাতর পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সেইখানেই ওতপ্রোত হয়ে। মৈনাকের শিখরদেশ থেকে মনের এই পদস্খলনের গতিরোধ করা যায় না।

মাকে কথাটা বলায় তিনি বললেন-তোর বাবার যেমন! নাকের ওপর নজর রেখে জড়ভরতের মত ল্যাজেগোবরে হয়ে বসে থেকে কী লাভ? ভগবান কি ঐ নাকের মাথায় রয়েছেন যে দেখা দেবেন? কুশাসন কেন, তুমি আরাম করে কুশানে কি ইজিচেয়ারে বসে ডাকো না, কি বিছানায় শুয়ে ঠ্যাং-এর ওপর ঠ্যাং তুলে। মন দেওয়া নিয়ে কথা, নাক দেখানো নয়।

বেশিক্ষণ ডাকাই যায় না ভগবানকে, ভালও লাগে না ডাকতে। আমি জানাই। তাছাড়া, ঐ নাক নিয়ে মানে, নিজের নাক নিয়ে মাথা ঘামানো আমার একদম ভালো লাগে না। ফিলানথ্রপিস্ট-কথাটাও ততদিনে জানা হয়ে গেছে ঐ কাগজের কল্যাণেই। হেডস্যারের জবাবে ঐ প্যাট্রিয়টই জিভের গোড়ায় এসে গেল। হেডস্যারের জবাবে ঐ গালভরা কথাটাও আমি আওড়াতে পারতাম, কিন্তু কেন জানি না, ঐ প্যাট্রিয়টই জিভের গোড়ায় এসে গেল। ফিলানথ্রপিস্ট হতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে লাগে, তার আগে বহু কষ্ট করে বড়লোক হতে হয়, তারপরেই না বিশ্বের উপকার করতে বেরুনো? কিন্তু ঐ প্যাট্রিয়ট হওয়াটা তার চেয়ে ঢের সোজাই যেন! সারা জীবন দিলে তো কথাই নাই, সোজাসুভি প্রাণটা দিলেও হওয়া যায়।

কিংবা দেশের ভাবনায় ভাবিত ঐ অর্ধ সাপ্তাহিকের গরম গরম সম্পাদকীয় বা সংবাদের পৃষ্ঠা পাঠেই বুঝি আমি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকব। অথবা বাবার বইয়ের ভাড়ার থেকে বাগানে যোগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ম্যাজিনি-গ্যারিলডির জীবনকাহিনীর থেকেও হয়ত প্রেরণ পেয়ে থাকতে পারি।

কান্তিবাবু আর কোনো ছেলের উচ্চাশা সম্পর্কে বিশেষ উচ্চবাচ্য করে আমার বিষয়ে কিংবা ওই প্যাট্রিয়টের বিষয়েই বেশ কিছু বলেছিলেন মনে আছে। প্যাট্রিয়ট কাকে বলে প্যাট্রিয়টিজম কী, কী বা তার দায় ধাক্কা তার যেন একটুখানি আঁচ পেয়েছিলাম তার কথায়

সেদিন ইস্কুলের ছুটির পর আমাদের ক্লাসের ছেলে সতীশ আমায় পাকড়ালো।

আয়, এখানে বসি একটু। কথা আছে তোর সঙ্গে।

ড্রিলের মাঠটায় আমরা বসলাম।

প্যাট্রিয়ট হতে চাস বলছিলিস না তুই? তাই ভাবলাম, তোকে তো আমাদের দলে নেওয়া যায় তাহলে। চাপা গলায় বলল ও।

তোদের দল! ক্রিকেট ফুটবলের টীম যদি হয়… আমার সাফ কথা-না ভাই, তার মধ্যে আমি নেই। ঐ সব খেলাধুলায় হাত পা ভাঙতে পারব না আমি। ওসব আসেও না আমার, ভালোও লাগে না। তবে হ্যাঁ, যদি টেনিস কি ব্যাডমিনটন হয়…

আরে না না, সেসব কিছু নয়। তার ভেতরে প্যাট্রয়টিজমের কী আছে? একেবারে অন্য জিনিস। আনকোরা আরেক ব্যাপার।

ব্যাপারটা কী শুনি?

তুই আমাদের বিপ্লবীদের দলে আসবি?

বিপ্লবীদের দল? সে আবার কী রে?

কেন, জানিসনে? ক্ষুদিরাম কানাইলালের কথা শুনিসনি নাকি? ফাঁসি হয়ে গেছে যাদের?

দেশোদ্ধারের দল? জানি বইকি। আছে একটা দল ওরকম। খবরের কাগজ পড়লে জানা যায়। খবর বেরয় বটে মাঝে মাঝে।

আসবি তুই সেই দলে? খুব গোপন কিন্তু। বলবিনে যেন কাউকে।

কী করতে হবে আমায়?

তোর কথা আমাদের লীডার বলছিল একদিন। দলে তোকে পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখতে, …তোর মন একটা ছেলেকে আমাদের দরকার খুব!

লীডারটা কে শুনি?

তা বলব না। তা ই জানতে চাসনে। জানতে পাবি না কোনোদিন। আমাদের দলে অতটা উন্নাসিক হওয়া কি ভালো? কিন্তু তা না হলে তো আমার আধ্যাত্মিক উন্নতির একেবারেই কোনো আশা নেই দেখছি।

ভগবান যেমন বিন্দুমাত্র, ভগবানকে ডাকার প্রয়োজনও তেমনি মুহূর্ত মাত্রই। গোশৃঙ্গে সর্ষপ, মানে গোরুর শিঙের ওপর সর্ষে রাখলে যতক্ষণ থাকে ততটুকুর জন্যই ভগবানে মন দিলে, মন দিয়ে তাঁর মন পেলেই ঢের। তার ফলে যে গতিলাভ হয়, যেদিকে যাবার প্রবৃত্তি হয়, তিনি যেদিকে নিয়ে যান সেইটেই হোলো তোর ভগবতি। খুব সহজ ব্যাপার। এত সহজে আর কিছু হয় না। প্রায় নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই।

মার মতে, আমার মনে হোলো যে, ঐ নাকই দেখতে হবে বটে, তবে কিনা একটু ঘোরালো পথে। প্রায় ঘুরিয়ে নাক দেখার মতই। বৃত্তির পথে, প্রবৃত্তির পথেই যেতে হবে আমায় ভগবানকে পেতে পেতে। এক সেকেন্ড মাত্র ভগবানকে দিয়ে তার পর থেকে খালি সেকেন্ডহ্যান্ড ভগবানকে পাওয়া। সবার সঙ্গে তার সাথে সাথে চলা। যেতে যেতে আদানে-প্রদানে তাঁকেই দিতে দিতে পেতে পেতে যাওয়া।

বাবা যে বলেছে মা, ভগবানকে পাওয়া নাকি সোজা না। অনেক সাধনার দরকার। বাবার কথার পুনরাবৃত্তি আমার।

ভগবান যদি মা হন তাহলে কি তাঁকে সাধ্যসাধনা করতে লাগে? মাকে তো এমনিতেই পাই-ছেলে হয়ে জন্মানোর সাথে সাথেই। আমরা তো সবাই স্বয়ংসিদ্ধ তো। আজন্ম সিদ্ধি আমাদের। সাধনা যদি করতে হয় তো প্রবৃত্তির সাধনাই করতে হবে-বুঝেছিস? আমৃত্যু সেই সাধনা, জন্মজন্মান্তরের। তোর প্রবৃত্তি কী, মনের ঝোঁকটা কোনদিকে তোর, সেইটে তুই বার কর আগে।

মাথা ঘামাতে লাগলাম আমি তারপর। কোনদিকে মনের ঝুঁকি, মনের মধ্যে মাথা ঠুকি। ঠুকে ঠুকে মরি।

মনের ভেতর দিয়েই যদি ভগবানের প্রেরণা মেলে, তাহলে তাঁকে ডাকতে গেলে যেসব দিকে মন খেলে ( ভগবান নিজেই খেলিয়ে দেন কিনা কে জানে?) সেই দিকেই কি মনের ঝোঁক আমার? বুঝতে হবে তাই?

কী হতে চাই? কী করতে চাই আমি? মাথা খেলাই।

সেদিন ক্লাসে হেড স্যার শুধিয়েছিলেন সবাইকে– কে কী হতে চাই আমরা?

হেড স্যার কান্তিভূষণ ভট্টাচার্য ইংরেজি পড়াতেন আমাদের। এমন জলের মতন বোঝাতেন, এমন চমৎকার পড়াতেন যে, দৌলতপুর কলেজের প্রিন্সিপাল কামাখ্যাচরণ নাগ মশাই আমাদের ইস্কুলে রেকটর হয়ে যোগ দেবার সময় তার সেরা ছাত্র কান্তিবাবুকে হেডমাস্টার করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে।

একমনে পড়িয়ে যেতেন তিনি, আজেবাজে কথা কইতেন না একদম।সৌম্যদর্শন ছিপছিপে চেহারার গুরুগম্ভীর মানুষ। হঠাৎ সেদিন তিনি পড়ার বাইরে ঐ প্রশ্নটা করে বসলেন কেন যে! কেউ বললে সে ডাক্তার হবে, কেউ বললে যে বিজনেস করবে, কেউ হবে অ্যাডভোকেট–এমন কতোজন কতো কী।

আই ওয়ান্ট টু বি এ প্যাট্রিয়ট। আমায় শুধাতে জবাব দিয়েছিলাম।

আমাদের বাড়িতে অর্ধসাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা আসত দেশপ্রেমের বান ডাকত সেই কাগজে। প্যাট্রিয়ট-ঐ শক্ত কথাটা সেখান থেকেই শেখা আমার। অবশ্যি, ফিলনথ্রপিস্ট–কথাটাও ততদিনে জানা হয়ে গেছে ঐ কাগজের কল্যাণেই। হারের জবাবে ঐ প্যাট্রিয়টই জিভের গােড়ায় এসে গেল। হেডস্যারের জবাবে ঐ গালভরা কথাটাও আমি আওড়াতে পারতাম, কিন্তু কেন জানি না, ঐ প্যাট্রিয়টই জিরে গােড়ায় এসে গেল। ফিলানথ্রপিস্ট হতে গেলে অনেক কাঠখড় পােড়াতে লাগে, অর আগে বহু কষ্ট করে বড়লােক হতে হয়, তারপরেই না বিশেষ উপকার করতে বেরুনাে ? কিন্তু ঐ প্যাট্রিয়ট হওয়াটা তার চেয়ে ঢের সােজাই যেন! সারা জীবন দিলে তাে কথাই নাই, সােজাসুজি প্রাণটা দিলেও হওয়া যায়।

কিংবা দেশের ভাবনায় ভাবিত ঐ অর্থ সাপ্তাহিকের গরম গরম সম্পাদকীয় বা সংবাদের পৃষ্ঠা পাঠেই বুঝি আমি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকব। অথবা বাবার বইয়ের ভাঁড়ার থেকে বাগান যােগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ম্যাজিনি-গ্যারিলডির জীবনকাহিনীর থেকেও হয়ত প্রেরণা পেয়ে থাকতে পারি।

কান্তিবাবু আর কোনাে ছেলের উচ্চাশা সম্পর্কে বিশেষ উচ্চবাচ্য না করে আমার বিষয়ে কিবা এই প্যাট্রয়টের বিষয়েই বেশ কিছু বলেছিলেন মনে আছে। প্যাট্রিয়ট কাকে বলে, প্যাট্রিয়টিজম কী, কী বা তার দায় ধাক্কা আর যেন একটুখানি আঁচ পেয়েছিলাম তাঁর কথায়। সেদিন ইস্কুলের ছুটির পর আমাদের ক্লাসের ছেলে সতীশ আমায় পাকড়ালাে।

আয়, এখানে বসি একটা কথা আছে তাের সঙ্গে।

ড্রিলের মাঠটায় আমরা বসলাম।

প্যাট্রয়ট হতে চাস বলছিলিস না তুই ? তাই ভাবলাম, তােকে তাে আমাদের দলে নেওয়া যায় তাহলে। চাপা গলায় বলল ও।

তােদের দল! ক্রিকেট ফুটবলের টীম যদি হয়… আমার সাফ কথা–না ভাই, তার মধ্যে আমি নেই। ঐ সব খেলাধুলায় হাত পা ভাঙতে পারব না আমি। ওসব আসেও না আমার, ভালােও লাগে না। তবে তা, যদি টেনিস কি ব্যাডমিনটন হয়…

আরে না না, সেসব কিছু নয়। তার ভেতরে প্যাট্রিয়টিজমের কী আছে? একেবারে অন্য জিনিস। আনকোরা আরেক ব্যাপার।

ব্যাপারটা কী শুনি?’

তুই আমাদের বিপ্লবীদের দলে আসবি?

বিপ্লবীদের দল? সে আবার কী রে?

কেন, জানিসনে? ক্ষুদিরাম কানাইলালের কথা শুনিসনি নাকি? ফাঁসি হয়ে গেছে যাদের?

দেশােদ্ধারের দল? জানি বইকি। আছে একটা দল ওরকম। খবরের কাগজ পড়লেই জানা যায়। খবর বেরয় বটে মাঝে মাঝে।

আসবি তুই সেই দলে? খুব গােপন কিন্তু। বলবিনে যেন কাউকে।

কী করতে হবে আমায়?

তাের কথা আমাদের লীডার বলছিল একদিন। দলে তােকে পাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করে দেখতে, তাের মতন একটা ছেলেকে আমাদের দরকার খুব!

লীডারটা কে শুনি?

তা বলব না। অ ই জানতে চামনে। জানতে পারি না কোনােদিন। আমাদের দলে

কে কে আছে তাও না। তুই শুধু আমাকেই জানবি, আমি তোকে রিক্রুট করলাম তো? লীডারের অর্ডার আমার মারফতেই পাবি তুই। সেই মতন তোকে কাজ করে যেতে হবে।

আমি ভেবে দেখি ওর কথাটা। অভিরামের দ্বীপান্তর মা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি। বিদায় দে মা ঘুরে আসি। মনে পড়ে মুকুন্দদাসের যাত্রার পালা গানও। জাগো জাগো জননি, আসিছে নামিয়া ন্যায়ের দণ্ড রুদ্র দীপ্ত মূর্তিমান–সাবধান সাবধান! মনে পড়ল কত কথাই।

কাজটা কী করতে হবে শুনি আমায়?

সেন্টার থেকে চিঠি আসবে লীডারের-আসবে তোর নামে–দলের আরো বড় লীডারের চিঠি। সেসব চিঠি খুব দরকারী, কিন্তু তার ভারী রিকস। আমাদের হোস্টেলের ছেলেদের চিঠিপত্র সব পুলিসে খুলে দ্যাখে কি না! ডাকঘরেই দেখে নেয় টিকটিকিরা। তোর নামে, তোর একটা দলীয় নাম দেব আমরা, সেই নামে যেসব চিঠিপত্র, পার্শেল-টার্শেল আসবে, একদম তুই না খুলে সেসব তুলে দিবি আমার হাতে। আমি গিয়ে লীডারকে দেব। আপাতত এই কাজ।

তারপর?

তারপর, পরে তোকে যা করতে বলা হবে, করতে হবে। ইতস্ততঃ করা চলবে না। কিন্তু সে পরের কথা পরে, এখন…

আমার চিঠিপত্র খুলবে না পুলিস?

তোর বাবার কেয়ার অফ-এ আসবে তো? সন্দেহ করবে না পুলিস। তোর বাবা বয়স্ক লোক, গণ্যমান্য মানুষ–তিনি কি আর এইসব বিপ্লবী দলে থাকতে পাবেন–ভাববে তারা। বুঝেছিস এখন? কেমন, রাজী তো! কথাটায় কি রকম বরামাঞ্চ বোধ করি। সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যাই। প্যাট্রিয়ট হবার বাসনা প্রকাশের সাথে সাথেই প্যাট্রিয়টের মত কাজ করার এই সুযোগ! সৌভাগ্য বলেই মনে হয় আমার।

দুদিন বাদে সতীশ এসে বলল, তোর নাম দেওয়া হয়েছে সুরেন। দলীয় নাম।

আরে! সুরেন যে আমার মামার নাম রে! সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী।

ভালোই হলো আরো। ঐ নামই রইলো তোর তাহলে। বলে চলে গেল সতীশ।

আমিও ভাবলাম, মন্দ কি! নরাণাং মাতুলক্রম বলে নাকি, আমার যদি নামের দিক দিয়েই সেই উপক্রম হয় তোত ধারাবাহিকতাই বজায় থাকে তার।

দিনকতক বাদে একটা চিঠি এল মামার নামে-খামের চিঠি-বাবার কেয়ার অফে, ইস্কুল থেকে ফিরে জানলাম মার কাছে।

মা বললেন, এ কী চিঠি এসেছে রে সুরেনের নামে, দ্যাখ দেখি। এক বর্ণও বোঝা গেল না তার।

খুললে কেন চিঠিটা? খুলতে গেলে কেন? মামার চিঠি, দেখছ না?

সুরেন তো রাজাপুরেই এখন, তার বাড়িতেই। কোনার ঠিকানায় না লিখে এখানে আবার তাকে লিখলো কে, কলকাতার থেকে খুদিদি, তোর বড় মাসীই হয়তো লিখে থাকবে, মনে। করেছে সে এখেনেই আছে এখো-তাই ভেবেই, খবরটা কী, আর খুলে দেখতে গেছি। কিন্তু দেখছি, এ তো একটা আঁক। কী আঁক কে জানে?

ইকোয়েশনের আঁক বলে ঠাওর হচ্ছে। তার সঙ্গে ফ্রাকশন ট্রাকশন ডেসিমেল সিঁড়ি ভাঙা সব মিশিয়ে বিদঘুঁটে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!

এ আঁক তুই জানিসনে?

কোনো জন্মে না। কাবিল হোসেন জানে। কিন্তু তাকে তো এই চিঠি দেখানো যাবে না যার চিঠি তার হাতে দিতে হবে।

কার চিঠি শুনি?

সে একজনের। শুনলে তুমি কিচ্ছু বুঝতে পারবে না। বলে চিঠিখানা হাতিয়েই আমি সরে পড়ি।

সতীশকে চিঠিখানা দিই গিয়ে। খাম খোলা দেখেই সে খাপখোলা তরোয়ালের মতই ঝলকে উঠেছে : খুলেছিস কেন?

আমি খুলেছি নাকি? মামার চিঠি মনে করে–মামাকে লেখা মাসির চিঠি তাই ভেবে না  খুলে দেখেছে মা। দেখেও বুঝতে পারেনি কিছু। যা বিচ্ছিরি আঁক একখানা–তার ভেতর নাক গলায় সাধ্য কার। এক সাথে আমি মার আমার সাফাই গাই-মনে হচ্ছে মা আমার মতই অঙ্কে দিগগজ। আমারই মা তো!

মোটেই তোমার আঁক নয়, সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা। লীডার বুঝবে। এই না বলে সে দ্বিরুক্তি না করে চিঠিখানা নিয়ে চলে যায়। কোথায় যায় কে জানে!

রাত্রে তাদের হোস্টেলে গেলে সে জানায়–লীডার ভারী রাগ করেছে। এরপর থেকে ইস্কুলে যাবার পথে রোজ তুই পোস্ট আপিস হয়ে যাবি। জানবি তোর মামার নামে চিঠিপত্তর পার্শেল-টার্শেল টাকাকড়ি মনিঅর্ডার-টর্ডার এসেছে কিনা। এলে ফর দিয়ে সই করে নিয়ে সোজা চলে আসবি ইস্কুলে।

মনিঅর্ডার টাকাকড়িও আসবে নাকি আবার? শুনে আমার উৎসাহ হয়।

এলেই বা! তাতে তোর আমার উৎসাহিত হবার কিছু নেই। বেল পাকলে কাকের কী পার্টির টাকা–দলনেতাকে গিয়ে দিয়ে দিতে হবে তক্ষুনি।

সতীশের কণ্ঠস্বর পৃথিবীর মতই উত্তর-দক্ষিণে চাপা হয়ে আসে তারপর–এমন কি পিস্তল-টিস্তলও আসতে পারে ঐ পার্শেলে। সেই খবর দিয়েছে ওই চিঠিতে।

পিস্তল! শুনেই আমি চমকে উঠেছি।–পিস্তল-টিস্তল কেন রে!

আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিশের জন্যই, আবার কী রে? স্বদেশী ডাকাতি করতে হবে না। টাকার যোগাড় হবে কোত্থেকে? কলিগাঁয় ফকির সরকারের বাড়ি করব ডাকাতি। ওর ভারী মহাজন, অনেক টাকা ওদের।

না না। ওর বাড়ি না। কিছুতেই নয়, ওই ভদ্রলোক দারুণ ভালো। বইটই পড়তে দেয় আমায়–ওর বাড়ি ডাকাতি-টাকাতি নয়।

ঘাবড়াচ্ছিস? হয়তো তোদের বাড়িও করতে হতে পারে আমাদের। তখন তোকেও লাগতে হবে–থাকতে হবে আমাদের সঙ্গে। কালি-ঝুল মেখে মুখোশ পরে থাকবি, বাড়ির কেউ চিনতে পারবে না তোকে।…তোদেরও অনেক টাকা আছে, তাই না?

কাঁচকলা পাবি আমাদের বাড়ি। বাবার যা কিছু আছে সব কোম্পানীর কাগজে জমা রাখা। কাগজ কখানা পাবি কেবল। তবে হ্যাঁ, মার গয়নাগুলো নিতে পারিস। চাইলে মা হয়ত নিজের থেকেই দিয়ে দিতে পারে দেশের কাজে। কেড়ে নিতে হবে না।

টাকা নেই তো চলে কি করে তোদের? শুনি? তোর বাবা তো কোনো চাকরি-বাকরি করেন না।

রাজ এস্টেট থেকে মাসোহারা আসে না বাবার? মাস মাস আসে টাকা। তাতেই আমাদের চলে যায়। তার থেকেও বাবা জমায় আবার। কোথায় রাখে আমার জানা আছে। মাঝে মাঝে বাবার অজান্তে সেখান থেকেও হাত সাফাই করি–ধরতে পারে না বাবা। খেয়ালই করে না বোধ হয়।

যাক গে, ই যখন পাটির, তোদের বাড়ি ডাকাতি হবে না নিশ্চয়। তার আগে তো টার্গেট প্র্যাকটিশ করে হাত-টাত পাকাতে হবে আমাদের।

হাত পাকাবি কোথায়?

কেন, সিঙ্গিয়ার আমবাগানে। হাজার হাজার গাছের আওতায় নিশ্চিন্তে প্র্যাকটিশ করা যাবে। নির্জন জায়গা, কেউ বড় একটা সেখোয় না ওর ভেতর-গুলিটুলির আওয়াজ কারো কানে যাবে না।

যেখানে আম পাকে সেখানেই হাত পাকাবি? তাহলে ভাই আমের সময়টাতেই পাকানো যাবে না-হয়। পাকা আমের দিকে তাক করে লাগালে দু-একটা আম গালে এসে পড়তেও পারে, চাই কি?

সেই সুখেই থাক! আমার কথাটা সে এক কথায় উড়িয়ে দেয়।

কিন্তু এক কথায় পাকা আমের অত বড়ো বাগান ওড়ানো যায় না–আমি আবার তাকে বাগাতে লাগি : ইসব ফলন্ত আম গাছের সামনে দাঁড়িয়ে লোভ সামলাতে পারবি তুই? তোর হাতের তাক তো আমি জানি। শুধু ঢিলিয়েই তুই ফজলি আম নামিয়ে আনিস। পিস্তলের নিশানা না জানি তোর আরো কতো জোর হবে। আর সিঙ্গিয়ার বাগানে কী সব আম রে ভাই! আমের তার আর তার হাতের আরিফ একবাক্যে করে আমি ওর আমড়াগাছি করি।

সে কিন্তু টলে না একদম। বলে যে, হ্যাঁ, সেইজন্যেই আনা হচ্ছে কিনা পিস্তল! আম পাড়বার জন্যে আনছি কিনা আমরা! সে বলে বিলেতে যে একটা জোর লড়াই বেধেছে খবর রাখিস তার? ইংরেজ জার্মানীর যুদ্ধ হচ্ছে জানিসনে?

জানব না কেন? আসে তো খবর কাগজ আমাদের বাড়ি। হিতবাদী, অমৃতবাজার দু-ই আসে। সব খবর পাই আমরা। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের কী! কোথায় বিলেত আর কোথায় আমরা। কার সঙ্গে কার লড়াই আর আমরা কোনখানে।

কী বোকা রে! তার চোখে কৃপাকটাক্ষ। আরে, আমাদের স্বাধীনতা লাভের এই তো মোকা রে! ইংরেজ জার্মানীর সঙ্গে লড়ায়ে বিব্রত–এই সুযোগে আমরাও তৈরি হবো এদিকে।

রণক্ষেত্রের সৈনিক না আমরা? আমাদের অ্যানার্কিস্ট পার্টি ভারতজোড়া, জানিসনে? শুনেছি এক-আধটু। পড়েওছি খবর কাগজে।

এ সব কথা থাক এখন। কদিন বাদে পিস্তলের পার্শেলটা আসবে। কটা পিস্তল আসে কে জানে! ইস্কুলে আসার পথে রোজ খবর নিবি পোস্টাপিসে–এলেই ডেলিভারি নিবি। আর নিয়েই না, সোজা চলে আসবি ইস্কুলে। ইস্কুল পালিয়ে তারপর প্রতিদিন দুপুরে আমাদের পিস্তলের মহড়া শুরু হবে ওই বাগানে-সেদিন থেকেই। বুঝেছিস?

পিস্তল নিয়ে লড়তে হবে বলছিস? কিন্তু লড়বি কার সঙ্গে শুনি? তাহলে তো সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই যেতে হয় আমাদের, ওই বিলেতেই।

কেন, ইংরেজের সঙ্গে লড়ব আমরা। এখানেই লড়াই করব। সারা ভারতই আমাদের রণক্ষেত্র। সর্বদাই আমাদের সংগ্রাম।

এখানে ইংরেজ কোথায় রে, এই গাঁয়? আমি শুধাই–এই অজ পাড়াগাঁয় কই তোর ইংরেজ?

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নেই? পুলিস সাহেব নেই জেলার? সেখানে গিয়ে মেরে আসতে হবে তাদের। লীডারের হুকুম হলেই যেতে হবে আমাদের।

না ভাই, ওসব খুনোখুনি কাণ্ড আমার ভালো লাগে না। আমার আপত্তি : পুলিস সুপারকে প্রাণে মারলে মেম-সুপারির প্রাণে লাগবে না? কাঁদবে না তাঁর ছেলে-সুপাররা? মেয়ে-সুপারিরা? না… মানুষ মারবে কেন মানুষকে? মারবার জন্যে তো মানুষরা হয়নি। ভালোবাসাবাসির জন্যেই হয়েছে।

সব মানুষকে কি ভালোবাসা যায়? ওরা আমাদের ছেলেদের ধরে ধরে গুলি করে মারছে না! লটকে দিচ্ছে না ফাঁসিতে? তুই বল?

হ্যাঁ, সব মানুষকে ভালোবাসা যায় না, তা ঠিক। মানতে হয় আমায়-তবে মানুষের মধ্যে যারা রূপসী মানুষ তাদের ভালো না বেসে পারা যায় না। সেইসব মানুষের ভালোবাসার জন্যে আমরা সব সময় উপোসী। তাদের রূপের উপাসনা করি আমরা।

তোর ওই সব রূপসী মানুষ উপোসী মানুষের ফাতরা কথা যত রাখ তো। দেশের স্বাধীনতা তুই চাস কি চাস না?

নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু ওইসব খুনখারাপি না করে…না ভাই, কাউকে খুন করতে আমি পারব না। ওতে আমার একদম প্রবৃত্তি হয় না।

কিসে তোমার প্রবৃত্তি শুনি?

প্রবৃত্তির প্রশ্নটা খট করে আমার মগজে এসে লাগে। মার কথাটা মনে পড়ে যায়…প্রবৃত্তির পথেই ভগবদ্গতি…আমাদের গতি ভগবানের দিকে, ভগবানের গতি আমাদের দিকে। উভয়ের গতিমুক্তি এক পথে–একসঙ্গে। একাধারে–এক ধারায়। ধারাবাহিক।

কিসে আমার প্রবৃত্তি বলব? আয়, আমরা হাতে-লেখা একখানা পত্রিকা বার করি। মাসিক কি ত্রৈমাসিক। আমার মতে সেই ভালো হবে তার চেয়ে। মাস মাস কি তিন মাস অন্তর বেরুবে কাগজটা। তাতে গল্প উপন্যাস কবিতা সব থাকবে। তুই লিখবি, আমি লিখব, হোস্টেলের আরো সব ছেলেরা লিখবে–বিষ্টু-টিষ্টু সব্বাই। ইস্কুলের লিথো মেশিনটা নিয়ে লিথো করেও বার করতে পারা যায়। কাগজটার নাম রাখা হবে অঞ্জলি। দেবী ভারতীর পায়ে অঞ্জলি আমাদের।

তোর মাথা! দেশের স্বাধীনতা আগে, না, ওইসব তোর ছাতমাথা? দেশ স্বাধীন হোক। সাহিত্যচর্চার ঢের সময় পাওয়া যাবে, কিন্তু ইংরেজ এখন জীবন-সঙ্কট লড়ায়ে বিব্রত, তাকে খতম করার এমন সুযোগ আর মিলবে না। জার্মানরা ওদিকে হারাবে তাদের, আমরা এদিক থেকে তাড়াব।

তার কথাটাও নেহাত ফেলনা নয়, ভেবে দেখি। ভেবে দেখতে হয়।

ভাবছিস কী? আমরা সবাই রণক্ষেত্রের সৈনিক এখন। লড়তে হবে এ সময়-লড়তে হবে, মরতে হবে, মারতে হবে। প্রাণ দিতে হবে, প্রাণ নিতে হবে-বুঝেছিস!

হ্যাঁ, প্রাণ দিতে হবে প্রাণ নিতে হবে-প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার কথাই বটে। ভেবে দেখি, কথাটা রিনির ক্ষেত্রেও যেমন, রণক্ষেত্রেও তাই।

 ২. পার্শেলটা এল

২১.

অবশেষে একদিন পার্শেলটা এল।

স্কুলের পথে পোস্টাপিসে খবর পেয়েই মামার নামের ফর দিয়ে ফরফরিয়ে আমার সই করে সেটার ডেলিভারি নিয়েছি।

সটান চলে গেছি ইস্কুলে-সিঙ্গিয়ার আমবাগানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করে।

বাংলার সার সীতানাথবাবু ততক্ষণে এসে গেছেন ক্লাসে।

পার্শেলটা দেখেই না লাফিয়ে উঠেছে সতীশ। অবশ্যি, বসে বসেই যতটা লাফানো যায়সারের নজর বাঁচিয়ে।

কী আছে রে ওতে? জানতে চেয়ে ফিসফিসিয়েছে পাশের ছেলেটি।

ডিকসনারি। ফাঁস করেছি আমি। দেখবি নাকি? দেখতে চাস? খুলব?

শুনেই সে আর দ্বিরুক্তি করেনি, দ্বিতীয় বার তাকায়নি সেদিকে–নাড়ানাড়ি করা দূরে থাক।

খানিক বাদে বলেছে, বিয়ের আগে কোনো নারীঘটিত ব্যাপারে থাকতে নেই ভাই! বি এ পাশ করার আগে কি কেউ ডিকসনারি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে?

নারী আর ডিকসনারির মধ্যে মিলটা কোনখানে? আমি জানতে চেয়েছিলাম।

নাড়ির সম্বন্ধ নেই? তার পাল্টা জিজ্ঞাসা।

আমাদের ভেতরে সে একটু পরিপক্ক বলতে হয়, কেননা তার পুরুষ্টু গোঁফ বেরিয়েছিল, বিয়ে হয়েছিল দিন কতক আগে। (তখনকার দিনে পাড়াগাঁয়ে বাল্যবিবাহ চালু ছিল বেশ) হয়ত সেই কারণেই ডিকসনারি নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা সে পছন্দ করেনি।

আমি আর সতীশ আর কথা না বাড়িয়ে পিরিয়ড শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

তারপরে পিরিয়ড কাবার হতেই স্কুল পালিয়ে সতীশ আর আমি চলে গেছি আমবাগানে পিস্তলের তাক বাগাতে।

ছায়াচ্ছন্ন নিরালা এলাকায় খোলা হল পার্শেল।

তিনটে পিস্তল এবং আরো কতকগুলো কী যে দেখা গেল তার ভেতরে!

তিনটে কেন রে? শুধালাম আমি সতীশকে।

এর একটা তোর, একটা আমার। তৃতীয়টা কার জন্যে কে জানে?

কেন, তুই জানিসনে?

লীডার জানে। বলেনি সে আমায়। আমিও জানতে চাইনি। সেরকম চেষ্টা করাও অন্যায়। শুধু জানিয়েছিল যে তিনটে আসবে মোটমাট।

আর এগুলো সব কি রে?

কার্তুজ। আমাদের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্যে।

এত কার্তুজ?

লাগবে না? সহজে কি কারো নিশানা দূরস্ত হয় নাকি? অবশ্যি প্র্যাকটিসের পরেও বেঁচে যাবে এর অনেক। পরে সেগুলো কাজে লাগাব আমাদের। আমাদের কিংবা আমাদের দলের।

সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি প্র্যাকটিস করতে আসবে না?

তার হাত দূরস্ত আছে–আগের থেকেই। তাছাড়া সে যে কে তাও আমি জানিনা। লীডার আমায় জানাননি। টের পাবো সেই অ্যাকশনের দিন। কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পেলেও হয়ত তাকে দেখতে পাব না। মনে হোল বলতে গিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস যেন সে চাপল।

তিন তিনটে ঝকঝকে পিস্তল! বেশ দেখতে কিন্তু। আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি।

তাকিয়ে দেখার পর তাক করে দেখতে লাগি তারপর।

হাত তৈরি হবার পর সতীশ একদিন এসে জানাল-এই শোন! আমাদের কষ্ট করে সদরেও যেতে হবে না আর। ম্যাজিস্ট্রেট কি পুলিস সাহেবকে জেলায় গিয়ে মারতে হবে না। এখানেই আসছেন তাঁরা কদিন বাদে আর।

তাই নাকি? আমি জানতে চাই–কেন আসছে রে?

দুজন না হলেও ওদের একজন তো আসবেই নির্ঘাত। খবর পেয়েছে আমাদের লীডার।

ইস্কুল ভিজিট করতে বুঝি?

তা নয়। মীটিং করতে এখানে। বিলেতে যুদ্ধ বেধেছে না? বাংলাদেশে বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি হচ্ছে সেইজন্যে। তার সোলজার রিক্রুট করতেই তাঁরা আসছেন। ইস্কুলের ছেলেদের কি এখানকার যুবকদের কেউ সেই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে চায় যদি।

বেঙ্গল রেজিমেন্ট? হ্যাঁ, দেখেছি বটে কাগজে। স্কুল-কলেজের অনেক ছেলে সৈন্যদলে নাম দিয়েছে তাও জানি।

এখন, আমাদের প্ল্যানটা কিরকম হবে শোন্। সভাটা হবে স্কুলের মাঝখানে ড্রিল মাঠে সামিয়ানা খাটিয়ে–যেমনটা হয়ে থাকে ফি বছর প্রাইজ বিতরণ উৎসবের সময়। তবে এবার জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিস সাহেব আসছেন না? তাই এবার আরো জমকালো হবে সভাটা।

তা তো হবেই। সে আর বলতে হয় না।

যেমন হয়ে থাকে, সভার একধারে হবে ডায়াস–সেখানে চেয়ার সাজিয়ে বসবেন ঐ সাহেবরা, গাঁয়ের গণ্যমান্য যতো লোক, রেকটার, হেডস্যার আর মাস্টার মশায়রা, এমনি আমার আন্দাজ। আর তার সামনে সারি সারি পাতা বেঞ্চে বসব শুধু আমরা যত ছাত্ররা।

ফি বছর বসে যেমন। তার আন্দাজে আমার ঢিল ছোঁড়া।

তুই বসবি গিয়ে একেবারে সামনের সারিতে, বুঝেছিস। পকেটে গুলিভরা পিস্তল নিয়ে। আর আমি বসব ঠিক তোর পেছনে–কয়েক সারি পিছনে–আমার পকেটেও থাকবে পিস্তল।

তোর পিস্তল কিসের জন্যে রে! তুই কাকে মারবি আবার? আমি ভেবে পাই না, ও বুঝেছি। পাছে আমার হাত কাঁপে, তাক ফসকে যায় যদি–তাকে শেষ করার জন্যেই বুঝি তুই…? মানে, আমার লক্ষ্য তেমন ঠিক হয়নি এখনও তোর ধারণা?

না, না, সেজন্যে নয়। সে বলে : তাক কেন ফসকাবে তোর? তোর নিশানা অব্যর্থ। আমি দেখেছি। না, সেজন্যে নয়…

তবে কিসের জন্যে? তোর পিস্তল আবার কেন তাহলে?

তোর জন্যেই রে। বলে সে একটুখানি হাসে।

তার হাসিটা আমার তেমন ভালো লাগে না। হেঁয়ালীর মতই লাগে কেমন! আমার জন্যে তার মানে? আমার পিস্তল তো রয়েছেই, তার ওপরে আবার কেন? আমারটা যদি কোন কারণে জ্যাম হয়ে যায়, যথা সময়ে গুলি না বেরয় যদি?

তোর পিস্তলটা যেমন তোর জন্যে, আবার ওই সাহেবটার জন্যেও যেমন, আমার পিস্তলটাও সেই রকম আমার জন্যেও-ফের আবার তোর জন্যেও তেমনি।

আমার জন্যও তেমনি? তার মানে?

তা আমি বলব না। মানা আছে বলবার। বলে সে একটুখানি ঢোঁক গেলে-সব কথা কি সবাইকে সব সময় বলা যায়?

আমি কি সবাইকার মধ্যে হলুম? আমি তোর বন্ধু না? ফোঁস করে উঠি : এক পার্টির ছেলে না আমরা?

বলতে পারি। গোপনে। কাউকে বলবি না বল?

বলব নে? এসব কথা কি বলাবলির?

যক্ষুনি তুই পুলিস সাহেবকে গুলি কবি, আর সে পড়ে যাবে-সেই মুহূর্তেই তোকে গুলি করতে হবে আমায়। বুঝেছিস? লীডারের এই হুকুম।

আমাকে মেরে ফেলবি! তুই! তার পিস্তলের তাক হবার আগেই যেন আমার তাক লেগে যায়।

আমি না মারলেও তোকে তো মরতেই হবে–তা কি তুই জানিসনে? গুলি করার পরই তো ধরা পড়ে যাবি। পুলিসের হাতে ধরা পড়বি তুই। চেনা ছেলে, সবাই তোকে চেনে, পালাবি কোথায়? আর ধরা পড়লেই তোর ফাঁসি হবে। হবে না?

তা হবে। তা হবে বটে। আমতা আমতা করে মানতেই হয় আমায়। কিন্তু তাই বলে ফাঁসি যাবার আগেই…এই ভাবে মারাটা…মারা যাওয়াটা… আমার কথা আটকে যায়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে কি একটা যেন ঠেলে উঠতে থাকে। কান্নাই নাকি?

সেই তোকে মরতেই হবে। সেই মরবি কিন্তু পুলিসের হাতে অনেক মারধোর খেয়ে, অনেককে মেরে তার পরে মরবি-তার চেয়ে আগেই খতম হয়ে যাওয়াটা কি ভালো নয়? তোর পক্ষেও ভালো, দলের পক্ষেও।

দলের কাকে আমি মারতে যাচ্ছিলাম! কাউকেই তো চিনি না আমার দলের।

ধরা পড়ার পর থানায় নিয়ে পুলিস যা বেধড়ক মার লাগাত না, পুলিসের সেই পিটুনির বহর তো জানিসনে…জানলে তুই ঢের আগেই মরতে চাইতিস–নিজেকেই নিজে গুলি করে মরতিস। কিন্তু তখন আর সে উপায় নেই তোর। লেট হয়ে গেছে।

খুব মারে বুঝি পুলিস? থানায় নিয়ে গিয়ে খুব কষে ঠ্যাঙায়?

মারে না? নখের মধ্যে পিন ফুটিয়ে দেয়, কম্বলে মুড়ে রামধোলাই লাগায়, ঠ্যাং বেঁধে কড়িকাঠে লটকে ঝুলিয়ে রাখে…।

এই উলটো ফাঁসিটা কেন? আগের থেকে আসল ফাঁসির মহড়া দিয়ে রাখতেই নাকি?

কষে চাবকাবার জন্য, আবার কেন? তারও পরে আরো আছে…ন্যাংটো করে বরফের চাপড়ার ওপরে শুইয়ে রাখে…

ন্যাংটো করে? না না, ন্যাংটো হতে আমার ভালো লাগে না একদম।

প্রবল আপত্তি আমার খালি গা হতে লজ্জা করে ভারী।

তোর আপত্তি তারা শুনছে কি না। কারো লজ্জাফজ্জার ধার ধারে কি না তারা!

সতীশ বেআবরু করে। কেন, খালি গা হতে লজ্জাটা কিসের তোর? আমরা তো হেসটেলের ছেলেরা কেউ কেউ ফুটবল খেলার শেষে সন্ধ্যেবেলায় এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ি গিয়ে-পাড়ের ওপর প্যান্ট-শার্ট সব খুলে রেখে-খালি গায়ে সাঁতার কাটি কেমন আমাদের কই লজ্জা করে না তো।

আহা, তোর মতন শরীর হত যদি–দেখাবার মত অমন-আমারও খালি গা হতে লজ্জা করত না তাহলে, ইচ্ছেই করত বরং। কিন্তু দেখছিস তো এই প্যাঁকাটির মতন চেহারা, হাড় বার করা জিরজিরে এই শরীর নিয়ে কেউ কি কারো সামনে খালি গা হতে চায়?

সে আমি জানি না ভাই, তবে শোয়বেই ওরা বরফের চাঙাড়ে। এবং একেবারে দিগম্বর করে- কিছুতেই ছাড়বে না। যার যা দস্তুর। বরফের ওপর শুতে কেমন লাগে জানিস?

খেতে তো ভালোই জিনিসটা, শুতে কেমন কে জানে! কখনো তো শুয়ে দেখিনি।

দেখতে পাবি বেঁচে থাকলে। টের পাবি হাতে হাতে তখন। দেখতে চাস নাকি?

না, কিন্তু শোয়াতে যাবে কেন তারা? তাতে লাভ তাদের? তারা তো সোজাসুজি নিয়ে আমায় ফাঁসিতে লটকে দিলেই পারে। শেষমেস তাই যখন লটকাবে, লটকাবেই ছাড়বে না, তখন তার আগে মড়ার ওপর এত খাঁড়ার ঘা মারাটা কিসের তবে?

কনফেসন আদায় করতে তোর। তোর দলে আর কে কে আছে তাই জানবার জন্যেই…

দলের কাউকেও তো আমি জানি না ভাই! কী জানাব? কার নাম করবো?

আমাকে তো জানিস। যন্ত্রণার চোটে আমার নামটা বলে দিবি নিশ্চয়। না বলে পারবি না। পার পাবি না। তখন তারা আমাকে পাকড়ে নিয়ে গিয়ে ওই সব কাভই করবে আবার। মারের চোটে আমিও বলতে বাধ্য হব তখন-যার নাম জানি তার। এই করে করে শেষ পর্যন্ত গোটা দলটাই ধরা পড়ে যাবে আমাদের। সেই কারণেই তোকে এই অঙ্কুরেই বিনাশ করা।

শুনে আমি গুম হয়ে যাই। অঙ্কুরিত কিনাশের সম্মুখে প্রস্ফুটিত হবার কোনো উৎসাহ পাই না।

সে কিন্তু গুমরে ওঠে তার পরেই–পার্শেলের মধ্যে মোট নিটে পিস্তল ছিল, মনে নেই তোর?

হ্যাঁ, ছিল তো। বেশ মনে আছে।

তার মানেটা কী জানিস? বলে সে একটুখানি থামে-অকালে মরার জন্যে মন খারাপ করছে তোর? মনে কোনো দুঃখ রাখিসনে। কিচ্ছু ভাবিসনে। আমিও তোর সহযাত্রী ধরে নে না! তোর পরে আমিও হয়ত এই পৃথিবীতে আর থাকব না। ওই তৃতীয় পিস্তলটি, মনে হচ্ছে আমার জন্যেই হয়ত।

তোর জন্যে? তার মানে? অন্য আরেক ধাঁধার সামনে আমি বাধা পাই আবার।

মানে, সেদিন হয়ত কে জানে, সেখানেই আর কেউ অমনি বসে থাকবে আমার পেছনে আমাকে মারবার জন্যে তা করে! সঙ্গে সঙ্গে সাফ করে দিতে আমায়। কেউ বলতে পারে?

তোদের লীডার না কি? না অন্য কেউ?

কী জানি কে? আমি কী জানি?

নিজের মধ্যে এই খুনোখুনি? না ভাই, ব্যাপারটা আমার একেবারেই ভালো লাগছে না। যাই বল তুই।

ভালো লাগালাগির কথা নয় তে, দলের কানুন। যে বিয়ের যা মন্তর বলে না? তাই।

.

২২.

অমন দুর্ধর্ষ জার্মান ফৌজ য়ুরোপ জুড়ে অতো লড়াই করেও যে ইংরেজদের মেরে ফৌত, করতে পারছে না, আমরা মুষ্টিমেয় বালক এখানে সেখানে তাদের এক আধটাকে কখনো সখনো খতম করে কি করে যে শেষ পর্যন্ত তাদের নিকেশ করব তা আমার হিসেবে আসেনা। আর সেই হেতু অকারণে অকালে এভাবে আমাদের নিজেদের হতাহত হওয়াটা একেবারের ভালো লাগে না আমার।

তাছাড়া এই খুনোখুনি কাণ্ডে একটুও প্রবৃত্তি হয় না, সত্যি বলতে।

কিন্তু কী করা যায়…

কোনদিকে যাই, কী করি, কোন পথ ধরি তাই আমি ঠাওর পাই না। আমার প্রবৃত্তি যে কোনদিকে, কে আমায় তা বলে দেবে?

শেষটায় বাবাকে গিয়ে পাকড়াই–প্রবৃত্তির পথটা আমায় বাতলে দিতে পারো বাবা!

প্রবৃত্তির কোনো কথাই নয়। নিবৃত্তিনিবৃত্তি! আবৃত্তি করেন বাবা-বললাম না তোক বোকা? হাত-পা-মন সব গুটিয়ে এনে পদ্মাসনে বসে একাগ্র হয়ে ধ্যান করতে হবে? এইভাবে নিবৃত্তিটা রপ্ত করতে পারলে, মানে, নিবৃত্তিই হচ্ছে আসল কথা। সত্যিকার পথ। যে পথে নাকি মোক্ষ।

বাবার মোক্ষম কথাটা মার কাছে গিয়ে ফাঁস করে উঠেছন মাতোকে বলেছে! তুই না। হয় হমুদ চেষ্টায় কোনোমতে নিবৃত্তিটা আয়ত্ত করলি, কিন্তু ভগবানকে নিবৃত্ত করে কে? কার সাধ্যি? তিনি তো কার কথা শুনবেন না-হতেই থাকবেন, যেমন কি হচ্ছেন। তেমনিধারা হয়ে যাবেন। নিজেকে গুটিয়ে নেবেন না কখনই। কিছুতেই। তাঁর বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে? স্রোতের উল্টো মুখে কি যাওয়া যায়? গিয়ে লাভ? মারও সেই আগের কথারই পুনরাবৃত্তি আবার।

মার বক্তব্য আমার ভাষায় ব্যক্ত করি গিয়ে বাবার কাছে-আমি না হয় নিবৃত্ত হলাম বাবা! কিন্তু বাবা, ভগবানকে নিবৃত্ত করা যায় কি করে, করতে পারে কেউ? মা এই কথা বলছিল।

বিপন্নের মত মুখ করে তার জবাবে বাবা মাইকেলের গীতিকবিতা আওড়ান- সখি রে, বন অতি রমিত হইল ফুলফুটনে/পিককুল কলকল/অলিকুল চঞ্চল/চললো নিকুঞ্জে সখি, ভজি ব্রজরমণে। বিপদে পড়লেই, দেখেছি, তিনি মধুসূদনকে স্মরণ করেন।

তারপরে, বোধ করি, বিপদের কিনারা করার পর, তিনি নিবৃত্তির তত্ত্ব ব্যাখ্যায় বসেন ভগবান কি কারো পরামর্শ নিয়ে কাজ করেন? ভগবতীর পরামর্শেই বোধ হয়–আমার এই গায়ে পড়া কথাটা গায়ে না মেখেই তিনি বলে যান-ভগবানের কথায় আমাদের কাজ কী বাবা? মহাজনরা যা বলে গেছেন তাই না শুনতে হবে আমাদের? মেনে চলতে হবে তাই না? তাঁরা বলে গেছেন, নিবৃত্তিই হচ্ছে পথ। আর সে পথে যেতে হলে… তিনি নাগাড়ে বলে যান : প্রবৃত্তির কোনো কথাই নেই। বলেই চলেন বাবা–নিবৃত্তিই হচ্ছে আসল কথা। নেতি নেতি করে এগিয়ে যেতে হয় কেবল… বলে বাবা তাঁর নেতিবাদের বিস্তৃত বিশদ বিবরণ দেন।

বাবার নেতৃত্বে আমার পথের কোনো হদিশ না পেলেও শোনার মতন বাণী শোনা যায় বিস্তর।

শোনার জন্য যেমন, তেমনি শোনানোর জন্যও বাণীর দরকার জানি, আর, অলঙ্কার গড়তে গেলে সেই সোনাটাই ঝালিয়েও নিতে হয় আবার। যদিও ঝালমরা বাদ দিয়েই খাঁটি জিনিস পাই আমরা, তেমনি বাবার কাছে শোনাটা মার কাছে ঝালিয়ে নিতে যেতে হয়।

শুনেটুনে মা বলেন, তাই করগে যা তবে-যা বলেছেন তোর বাবা। নেতি নেতি করতে করতে নিবৃত্তির পথে এগিয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড় গিয়ে। তাহলে হাতে হাতে মোক্ষ লাভ হবে।

বাবা তো সেই কথাই বলছেন মা? মোক্ষের কথা, নির্বাণের কথাই।

সব জ্বলা আর জ্বালা চুকিয়ে দিয়ে নিবে যাবার কথা। মুলে গিয়ে হাবাৎ হওয়া? এই কথাই বলেছেন তো তোর বাবা?

তোমার কথাটা শুনে বাবা কি বললেন জানো মা?…কোনো কথাই বললেন না, কেবল মাইকেল, না না, মাইকেলের মেঘনাদ নয়। আরেক আর্তনাদ ছাড়লেন। বলে মহাকবির ফুলকেলির কথাটা আমি প্রকাশ করে দিই তাঁর কাছে।

ওর মধ্যেই তাঁর অজান্তে ঈশ্বরের কথাই দৈববাণীর মত উক্ত হয়েছে…উহ্য রয়েছে… মা জানান : ফুল বরং বৃত্তচ্যুত হয় কিন্তু ভগবানের বৃত্তচ্যুত হবার কোনো কথাই নেই। বৃত্তকে ধরেই তিনি কেন্দ্রমূল। সর্বদাই তিনি তাঁর প্রবৃত্তির পথে ধাবিত। ফুল তিনি ফোঁটাতেই থাকবেন, অফুরন্তই, বনও রমিত হবে বারংবার সে-প্রবৃত্তি তাঁর কোনো কালে ঘুচবে না। অলিকুলের মধ্য দিয়ে তাঁর মাধুশ্রী বৃত্তিও কোনোদিন যাবার নয়। তাহলে?

তাহলে কী হবে তার জবাব আমি কী দেব? আমি বলি তাহলে আমার প্রবৃত্তির পথটা তুমি আমায় বাতলে দাও না! কী যে আমার পথ, কোনদিকে যে আমার প্রবৃত্তি তার। কিছুই তো আমি ঠাওর পাচ্ছিনে। দেখোদ্ধার করব, না, সাহিত্যিক হব, না…না…নাকি…।

নাকি, মাকে কেন্দ্র করে আমার রিনির বৃত্তপথেই ঘুরতে থাকব আমরণ, যেমন ঘুরছি এখন? কিন্তু নানান কথার সেই কথাটায় আর মুখ ফোঁটাতে পারি না, চুপ করে থাকি। মার কাছে আমার নাকি-কান্না কাঁদা যায় না।

কোনদিকে তোর মনের ঝোঁক টের পাচ্ছিসনে তুই? তাহলে তোর মার কাছে গিয়ে চাইগে যা, তিনিই তোর পথ ধরিয়ে দেবেন ঠিক…

আমার মার কাছে?

হ্যাঁ, তোর মা আমার মা সবার মা। আমাদের সবার মনের মধ্যে তিনি আছেন। তাঁর কাছে চাইগে যা। তোর সত্যিকার প্রবৃত্তি কিসে যে, তা তিনিই জানেন কেবল।

তুমি যে সেই ঠাকুরের মতই কথাটা বললে মা। তিনি যেমন মার কাছে পাঠিয়ে ছিলেন নরেনকে–তার যা দরকার তা চেয়ে নেবার জন্য। নরেন কী চাইতে গেল আর কী চেয়ে বসল শেষটায়। মানে, তিনিই চাইয়ে দিলেন বোধহয়। সে চাইতে গেল টাকাকড়ি, আর তাকে চাইতে হল ত্যাগ বিবেক তিতিক্ষা। কী ঝঞ্ঝাট দ্যাখো দিকিন। না, মার কাছে চাইতে আমার ভারী ভয় করে মা। না, তিতিক্ষা-ফিতিক্ষা আমার চাইনে। ওসবে আমার কী হবে? তিতিক্ষা মানে কী?

নরেন তার নিজের নয়, তার বাড়ির চাহিদাটা চাইতে গেছল, তিনি তাকে তার মনের চাওয়াটা ধরিয়ে দিলেন কেবল। নরেন থেকে বিবেকানন্দ বানালেন তাকে। ত্যাগ বিবেক তিতিক্ষার দিকেই অন্তরের ঝোঁক ছিল তার, সংসারের দাবীর কাছে নিজেরটা তিনি দাবিয়ে রেখেছিলেন…মা তাঁর সেই সত্যিকার প্রবৃত্তির পথটা মুক্ত করে দিলেন কেবল। মার কাছে গিয়ে চা তুই। তিনিই আমাদের ঠিক পথে নিয়ে যান হাত ধরে। মা ছাড়া কে আর আছে আমাদের বল?

তুমি আমার হয়ে চেয়ে দিতে পারো না মা? কি করে চাইতে হয় তাই যে আমি জানি না।

যেমন করে আমার কাছে চাস তেমনি করে–আবার কী? তফাৎ এই, আমার কাছে মুখ ফুটে বলতে হয়, তাঁর কাছে মনে মনে। মনে মনেই শুনতে পান, জেনে নেন তিনি।

কিন্তু নিজের মতিগতির হদিশ মার কাছে গিয়ে চাইব কী, মাঝপথে আমার গাইড সতীশ। যে মাঝখানে এসে হানা দেয়–তৈরি আছিস তো শিবু? আসছে হপ্তাতেই সেই সভাটা। পুলিস-সাহেব আসবেন আমি খবর পেয়েছি। খতম করতে হবে তাকে। মনে আছে!

সেই মুহূর্তে আমাদেরকেও তো সেই সঙ্গে–? পরের খতমের সঙ্গে নিজের ক্ষতিটা না খতিয়ে আমি পারি না-কিন্তু যাই বল্ ভাই, কিছুতেই আমার মন টানছে না ওদিকে।

না টানলেও তোর রক্ষে নেই। আমাদের কারোই রক্ষে নেই। করতেই হবে তোক। নইলে আমাদের পাটিই তোকে খতম করে দেবে। রেহাই পাবিনে, মনে রাখিস।

সে কথা কি ভুলবার? আমি বলি-অহরহই মনে রয়েছে আমার।

যেমন ঢিলে শার্ট পরে ইস্কুলে যাস তেমন যাসনে যেন সেদিনটায়। ভারী কোট পরে যাবি, তাহলে তোর পকেটের পিস্তলটা কারো নজরে পড়বে না। তৈরি থাকিস, আমি এসে ঠিক সময়ে নিয়ে যাব তোকে। আমার সঙ্গে প্যান্ডেলে যাবি, ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেব, বুঝেছিস? এই শনিবার, মনে রাখিস।

তার গলায় যেন অশনির আওয়াজ পাই। মনে মনে ভয় খাই।

এদিকে শনিবার শনৈ শনৈ এগুতে থাকে।

এর মধ্যে রিনি এসে বলে গেছে আমাকে জানো শিবরামদা, সামনের শনিবার আমরা চলে যাচ্ছি। এখন থেকে–সেই কলকাতায় আমাদের বাড়িতে। সন্ধের গাড়িতে–মা বাবা সবাই আমারা–চিরদিনের জন্য। আমি গিয়ে চিঠি লিখব তোমায়। উত্তর দিয়ে কিন্তু। বলে তাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানাটা আমায় জানাল।

আমি নিরুত্তর হয়ে যাই। এই প্রথম রিনি দাদা বলে ডাকল আমায়–চিরকালের মতন তার চলে যাবার আগে।

আমার হৃদয়ের দুর্বলতম স্থানে অকস্মাৎ এই দা বসিয়ে একেবারে দু টুকরো করে দিল আমায়।

আমার তো মনে হয়, শুধু আমার কেন, কোনো মেয়ে দা বসালে, আমার ধারণা, রক্ষে নেই কারোই।

উত্তর দিতে পারব কি না জানি না। মুখ ফোটে আমার–আমিও সেদিন যাচ্ছি ভাই! আমিও চলে যাচ্ছি সেদিন।

হ্যাঁ, আমিও তো চিরকালের মতই চলে যাবার পথে। এখেন থেকে–ইহলোক থেকে? শনিবারের বারবেলাতেই!

কোথায় যাচ্ছ শিবরামদা? কলকাতায়? আমাদের সঙ্গেই চল না কেন তাহলে। সারাটা পথ গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে, কেমন? কোথায় উঠবে কলকাতায় গিয়ে? মামার বাড়ি? কোনো মাসির বাড়িতে? আমাদের বাড়িতেই ওঠো না কেন? বলব আমি মাকে? নাকি, তোমার মাকেও বলতে হবে আবার?

কলকাতায় কি কোথায় যাচ্ছি আমি জানিনে। তবে যেতে হবে। আমি জানাই তোর মাকে বলার দরকার নেই। আমার মাকেও নয়। যদি যেতেই পারি তাহলে তোদের বাড়িও যাব নিশ্চয়। তোর সঙ্গে দেখা না করে পারি আমি? তুই বল?

যেয়ো তাহলে। এই বলে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে সে চলে যায়।

মাকে কেন্দ্র করে রিনির বৃত্তও যেন আমার চোখের ওপর মুছে যাচ্ছে দেখতে পাই….রিনির বৃত্তান্তের সঙ্গে ইহকালের আমার ইতিবৃত্তেরও ইতি।… কোথায় যাচ্ছি আমি?

অবশেষে শনিবারের সেই মারাত্মক দিনক্ষণ এল। ভারী কোট পরে, তার ওপরে পিস্তলের ভারে জর্জর, ভারিক্কী হয়ে বসে অপেক্ষা করছি–অকুস্থলে অকুক্ষণে নিয়ে যাবার জন্যে যথা সময়ে সতীশ এসে হাজির।-তৈরি?

— হ্যাঁ, ভাই।

দেখি কেমন তৈরি! বলে সে আমার পকেট হাতড়ে পিস্তলটা বার করে পরীক্ষা করল-গুলি ভরে নিয়েছিস দেখছি। বেশ। তার পিস্তলটাও বের করে দেখালো আমায় আমারটাও ভর্তি। দেখেছিস!

আমি আর দেখতে যাই না, নীরবে এগুতে থাকি ওর সঙ্গে।

এই হপ্তাতেই কলকাতায় তোর জীবনী বেরিয়ে যাবে-জানিস? আমাদের অমর শহীদ সিরিজে। যেতে যেতে সে জানায়।

আমার লাভ? আমি তো আর দেখতে পাচ্ছি না।

তা পাবি না বটে, সে কথা ঠিকই, তবে জেনে যা-ক্ষুদিরাম, কানাইলালের সঙ্গে একাসনে স্থান পাবি–এক সাথে নাম উচ্চারিত হবে তোর।

আমার জীবনী? লিখতে গেল কে? আমি যে নিজেই কিছু জানি না আমার জীবনের। বলে আমি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ি আমার জীবন তো শুরুই হয়নি, এখনো।…পরলোকে পাড়ি দিতে চলেছি? আমার জীবন কাহিনী তোরা জানলি কি করে?

জানিনে আমরা? এতদিন একসঙ্গে আছি, দেখছি তোকে, জানিনে? তারপর তোর বাবার পদ্যের বই থেকেও কিছু নেওয়া, কিছুটা বানিয়ে দেওয়া। কে লিখেছে বলছিস? স্বয়ং আমাদের লীডার। লেখার বেশ হাত আছে তার।

আমার জীবনী লেখা হয়েছে এতদিন জানাসনি তো আমায়?

কবে লেখা হয়ে গেছে! ছাপাও শেষ, এখন শুধু বেরুনোর অপেক্ষায়। তোর ঐ কাটার পরেই ছাড়া হবে বাজারে। জানাইনি আগে বটে, তবে এখন, যাবার আগে কথাটা জেনে আনন্দ হচ্ছে না?

আনন্দ? জেনে আমার কিসের সুখ ভাই! অমর শহীদ হবার কোনোই সান্ত্বনা আমি পাই না।–লাভটাই বা কী আমার, বল?

তোর লাভ নয়, আমাদের লাভ। আমাদের পার্টির লাভ। কী লাভ, কেমন করে লাভ, বলছি শোন। বইটা বাজারে পড়তে না পড়তেই তো সরকার থেকে বাজেয়াপ্ত হবে, তল্লাসী করে তার কিছু কিছু বই এখানে সেখানে পেয়ে নিয়ে যাবে পুলিস। কিন্তু বেশির ভাগ বইয়েরই কোনো হদিশ মিলবে না। তখন সেইসব বই লুকিয়ে ছাপা হতে থাকবে আরো।

এডিশনের পর এডিশন। আরো আরো লাভ।

তোর জীবনীও কি আমার সঙ্গে বেরুবে নাকি আবার? আমি জিগ্যেস করি।

বের হতেও পারে, টের পাইনি এখনো। লীডার কিছু বলেনি আমাকে।

যথা সময়ে যথাস্থানে গিয়ে যথাযথ বসলাম আমরা। ডায়াসের সামনের সারিতে আমি, আর আমার ঠিক দু সারি পিছনে আমার উপর নজর রেখে সতীশ। কোটের পকেটে হাত পুরে রেখে বসেছে সে দেখে নিলাম।

আমিও তার মতই পকেটের ভেতরে পিস্তল পাকড়ে বসেছি।

সদর থেকে পুলিস সাহেব এসেছেন, সঙ্গে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক পদস্থ সৈনিক। হাবিলদার-টাবিলদার হবে কেউ, কাবিল হোসেন বলল। আমার ঠিক পাশেই বসেছিল সে।

বিপদে পড়লে মাথা খেলে নাকি মানুষের, কথায় বলে। আমিও ডায়াসের সম্মুখে বিপদের মুখে–বসে বসে নিজের মাথা খেলাই।

আচ্ছা, সাপও মরে আর লাঠিও না ভাঙ্গে-তেমনটা রা যায় না কি? আমাদের অভিশাপ ওই সাহেবটাও মোলো অথচ আমার দেহষ্টি অক্ষত রইল-এমনটা হয় না?

অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের পরেই আমি যদি ধুপ করে বসে পড়ি-বসেই না বেঞ্চির সঙ্গে মিশিয়ে যাই, তাহলে, সতীশের তাক না ফস্কালেও, আমার গায়ে তার গুলির আঁচড়টিও লাগবে না। ধরাও পড়তে হবে না, পুলিসের থোলাই থেকেও বেঁচে যাব হয়ত।

যেহেতু, সাহেবের পতন ও মৃত্যুর সাথে সাথেই দারুণ হইচই পড়ে যাবে। হট্টগোলের মধ্যে ভেঙ্গে যাবে সভা। সবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিস, কে কোথায় পালাবে তার ঠিক নেই। আমিও ঘাড় গুঁজে সেই ভিড়ের ভেতরে ভিড়ে গিয়ে হারিয়ে যাব গভীরে। সেখান থেকে সটান চলে যাব সামসিতে। এক দৌড়ে মাইল দশেক দূরের আমাদের রেল স্টেশনে। খানিকক্ষণ কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকে তারপরে কলকাতার ট্রেন ছাড়বার মুখটাতেই চট করে উঠে পড়ব সেই গাড়িতে। সরাসরি চম্পট কলকাতায় তারপরই।

জমজমাট সমাবেশ। এক একজন কিছু বলতে উঠছেন, চটাচট পড়ছে হাততালি। পাঁচশো ছেলের হাজার হাতের হাতুড়িতে গমগম করছে সভা।

প্রথমে বলতে উঠলেন আমাদের রেটর মশাই কামাখ্যাবাবু, তিনি পরিচিতি দিলেন মাননীয় অতিথিদের। বাংলার এককালের শৌর্যবীর্যের উল্লেখ করে বললেন-যে-সামরিক বৃত্তির পথ এতদিন বাঙ্গালীর কাছে অবরুদ্ধ ছিল, ভগবানের কৃপায় আজ তা আবার উন্মুক্ত হয়েছে, আবার কৃপাণ ধরবার সুযোগ পেয়েছি আমরা। বাঙ্গালী যুবকরা–যারা শক্ত সমর্থ–এহেন সুযোগের সদ্ব্যবহারে যেন দলে দলে এই সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের মুখোজ্জ্বল করে-সেই আশাই উচ্চারিত হলো তার ভাষণে।

সব শেষে বলতে উঠলেন হাবিলদার সাহেব। বীরোচিত চেহারার সেই বাঙ্গালী সৈনিকটি। রণক্ষেত্রে নিজের বরামাঞ্চকর নানান অভিজ্ঞতার কথা এমন ভাষায় তিনি বর্ণনা করলেন যে, সত্যিই রোমাঞ্চ হল আমাদের। যুদ্ধে না গিয়েই গায়ে কাঁটা-দেওয়া সেদিনের আমার সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

তারপরেই তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হবার জন্য ওজস্বিনী ভাষায় আহ্বান জানালেন সবাইকে।

সেই মুহূর্তেই আমি দাঁড়িয়েছি, পকেটের মধ্যে হাত মুঠো করে। সঙ্গে সঙ্গে সতীশও উঠেছে আমার পিছনেই, আড় চোখে দেখছি তাকিয়ে। আমি উঠতেই না, চারধার থেকে এমন জোর হাততালি পড়ল যে এক লহমায় সব প্ল্যান ভেস্তে গেল আমার।

হালিদার সাহেব আমায় ডাকলেন তার কাছে।

ডায়াসে যেতেই তিনি আমায় বুকে জাপটে ধরলেন; ঘোষণা করলেন এই তরুণই এখানকার প্রথম বীর, আমাদের সৈন্যবাহিনীর। তারপর দুহাতে আমাকে উঁচুতে তুলে সবার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রদর্শনী করলেন আমার।

তিনি নামাবার পর কামাখ্যাবাবু আমার মাথায় হাত রেখে তাঁর আশীর্বাদ জানালেন। গদ কণ্ঠে বললেন–ধন্য! তুমি আমাদের মুখ রেখেছ। সিদ্ধেশ্বরী ইনস্টিটিউশনের মুখ উজ্জ্বল করেছ তুমি। যাও, বীরের মত যুদ্ধে যাও, বীরের মতই ফিরে এসে আবার। বীরের উপযুক্ত তোমার সংবর্ধনার জন্য সেদিনটির অপেক্ষায় থাকব আমরা।

আবার চটপট হাততালি চারধার থেকে। ছেলেদের সে কী উল্লাস! পুলিস সাহেব আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন সহাস্যে।

আমার পিছু পিছু সতীশও উঠে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেখাদেখি আরো জনাকতক।

সবাইকে ডাকা হলো সেই ডায়াসের ওপর। রিকুটের দলে নাম লেখা হলো সবাইকার। শুনলাম, সাহেবের সঙ্গে পরদিনই সদরে চলে যেতে হবে সবাইকে।

আমার অপটু দেহের জন্য, বিস্তর বাহবা দিয়েও, শেষ পর্যন্ত আমায় বাতিল করে দেওয়া হল। ওদের সবাইকে কিন্তু ভর্তি করে নেওয়া হলো সৈন্যদলে। সতীশও গেল সেই সঙ্গে।… আমাকে আর কষ্ট করে নিজের মাথা খেলাতে হল না। কার লীলা কে জানে, অবলীলায় বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়।

কী করতে যে কী হয়ে যায়। আমাদের মাথার ওপরে আড়ালে থেকে কে যে নিজের মাথা খেলায়!

.

২৩. 

সেদিনের সংগ্রামসভা থেকে ফিরেই সোজা যাচ্ছিলাম রিনিদের কোয়ার্টারে–তার সঙ্গে শেষ দেখা সারতে। সেদিনের সন্ধ্যাতেই তাদের স্টেশনে যাওয়ার কথা-সামসি রওনা হবার আগেই যদি ধরতে পারি তাদের। রাত্রের গাড়িতেই কলকাতায় পাড়ি জমাবে তারা।

বাড়ির সামনেই বাধা পড়ল। আমার ভাই সত্য এসে খবর দিল-বাবা তোকে ডাকছে রে দাদা।

যেতে হোল বাবার কাছে।

বাবা সেই সভায় যাননি, কিন্তু সেদিনকার সব খবরই পেয়েছিলেন আমার ভাইয়ের কাছে।

যেতেই তিনি বললেন, রাম, তোমার শৌর্যে আমি সুখি, একটু গর্বিতও বইকি। কিন্তু এখনও তোমার যুদ্ধবিগ্রহে যাওয়ার বয়স হয়নি। বয়স হলে যেয়ো। যাবে বই কি। লড়াইয়ের কায়দা-কানুন রপ্ত করে রাখাটা ভালো–এখনই তার বেশ সুযোগ ছিল। কিন্তু লড়তে হবে নিজের দেশের জন্যেই, ইংরেজের জন্যে নয়।…।

হ্যাঁ বাবা, তা আমি জানি। দেশের স্বাধীনতার জন্যই আমি প্রাণ দিতে চাই, ইংরেজের স্বার্থে নয়–সেইজন্যেই যাচ্ছিলাম। ইংরেজের কাছ থেকেই তো শিখে নিতে হবে এই যুদ্ধবিদ্যাটা?

এখন যারা তার উপযুক্ত, তারা তা শিখবে বইকি। এবং তারা কি শিখছে না? দলে দলে যুদ্ধে ঢুকছে তারাই এখন। পরে সুযোগ মতন সব বেঁকে দাঁড়াবে। কামানের মুখ, বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেবে ওই ইংরেজের দিকেই। কিন্তু এখন তোমার সে বয়স আসেনি, তোমার শরীর যুদ্ধে যাবার মতন তৈরি হয়নি–মজবুত হয়নি এখনো…

সেইজন্যই তো নিল না আমায়। আমি সখেদে জানাই-তারাও সেই কথাই বলল বাবা।

এখন তোমার যে কাজ সেইটাই ভালো করে করো। খেলাধূলায়, ব্যায়াম চর্চায় শরীর তৈরি করো। আর পড়াশুনায় মন দাও। যখনকার যা কাজ তাই কমতে হয়; তাহলে পরবর্তী কাজটার জন্য উপযুক্ত হওয়া যায়। বিদ্যার্জন কিছু কম কাজ নয় বাবা। যুদ্ধে গিয়ে প্রাণ দিলে অমরলোকে যাওয়া যায় জানি, জয়তে লভতে লক্ষ্মী–মৃতেলাপি সুরাঙ্গনা-শাস্ত্রে বলেছে, কিন্তু বিদ্যার দ্বারাও অমরত্ব লাভ করা যায়–মরবার পরে নয়, এই জীবনেই। সেটাও কিছু কম শ্রেয় নয়। বিদ্যয়ামৃতমনুতে-বলে থাকে, জানো?

জানি বাবা। আমার ঘাড় নাড়ি : বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ে ওই ছাপ মারা থাকে আমি দেখেছি, কিন্তু ওর মানে ঠিক জানি না।

বিদ্যয়ামৃতমতে, কিনা, বিদ্যুয়া অমৃতম্ অণুতে– অর্থাৎ বিদ্যার দ্বারা অমৃত অর্জন করা যায়। বুঝলি?

হ্যাঁ বাবা। এখন খেলতে যাই তাহলে?  বলে বাবার কাছে বিদ্যার্জন না সেরেই রিনিদের বাড়ির দিকে দৌড়াই।

গিয়ে দেখি তাদের ঘরগুলোর জানালা খড়খড়ি সব বন্ধ–তবু আশায় ভর করে–এখনও হয়ত ওরা রওনা দেয়নি–সেই ভরসায় কাঠের সিঁড়িটা ধরে উপরে উঠলাম। কুয়াতলার পাশ দিয়ে এগিয়ে দেখি, দরজায় মোটা তালা ঝুলছে। আর দরজার গায়ে রিনির হাতের গোটা গোটা আঁচড়ে টাটকা চকের লেখা–রামদা, চলে গেলাম, রিনি।

র-য়ের বদলে ঋ-কার দিয়ে নিজের নাম লিখেছিল সে। বানান ভুলটা চকচক করছিল চোখের উপর। ইচ্ছে করে ঐ রকম বানানো-আমি বুঝলাম।

কিন্তু সে ঋণীটা কিসের? ঋণী তো আমি। আমিই তো। সে তো খালি দিয়েই গেছে, দু হাতে, অন্নপূর্ণার মতন যত পরমান্ন, আর আমি কেবল নিয়েই গেছি–পেয়েছি যত না। বিনিময়ে কিছুই তাকে দিইনি–দিতে পারিনি।

আমার আছেটা কী? চিড়ে গুড় ছাড়া আর দেবার কী ছিল আমার? সে-ই তো মহাজন। আমি ঋণী, চিরঋণী–শিবের মত চিরভিখারী রয়ে গেলাম তার কাছে।

ফিরে এলাম রান্নাঘরে, মার কাছেই। মা লুচি ভাজছিল তখন।

আয় বোস, কোথায় ছিলি রে এতক্ষণ? কিছু খাসনি তো বিকেলে। মুখটুখ শুকিয়ে গেছে।

খানকয় ফুলকো লুচি আর পটল ভাজা দিলেন একটা রেকাবিতে। খেতে খেতে বলি–মা,  তুমি কলকাতায় যাবে বলছিলে না?

কলকাতায়! কেন রে? এত জায়গা থাকতে কলকাতায় যাব কেন হঠাৎ?

বাঃ, বলছিলে না সেদিন? কালীঘাটে তোমার হাত খালাস করতে যাবে। বলছিলে না সেদিন রিনির মাকে?

রিনির মা কী রে? মাসিমা বল। হ্যাঁ, যাব তো কলকাতায়। যেতে হবে বটে, কিন্তু কবে হয়ে ওঠে দেখি।

এর আর দেখাদেখি কি মা? হয়ে ওঠাওঠিটা কিসের? গাড়িতে উঠে বসলেই হয়। আমি মাকে উৎসাহ দিই-বল তো আমি সাইকেলে করে সামসিতে গিয়ে আগে থেকে টিকিট কেটে নিয়ে আসতে পারি। যাব কাল সকালে?

টিকিটের জন্যেই আটকাচ্ছে কিনা! তোর বাবার সময় সুবিধা হলে তবেই তো যাওয়া হবে। দেখা যাক আগে…

বলব গিয়ে বাবাকে? জিগ্যেস করব মা?

না, তাকে জিগ্যেস করতে হবে না। আমিই বলবখন।

সত্যি, হাতটা খালাস করে নেওয়াই ভালো। বাঁ হাতে খেতে তোমার কতো কষ্ট হয়…হয় না মা?

কষ্ট কিসের! অভ্যেস হয়ে গেছে তো। এখন হয়ত ডান হাতে খেতে গেলেই আমার আবার বাধ-বাধ ঠেকবে।

বাঁ হাতে খাওয়াটা কেমন দৃষ্টিকটু নয়? যারা দেখে তাদের তো কষ্ট হয়। হয় না মা?

তা কী জানি! কী করে বলব! আমি তো কাউকে দেখতে দিই না আমার খাওয়া।

কী দরকার অমন করে লুকিয়ে চুরিয়ে খাওয়ার? নিজের পয়সায় খাচ্চি তো? পরের পয়সায় কি চুরি করে খাচ্ছি না যখন?…আচ্ছা মা, কলকাতায় গেলে রিনিদের বাড়িতেই তো উঠব আমরা? মাসিমা এত করে বলে গেছেন তোমায়?

আমার আপন দিদি থাকতে, তোর খুদি মাসির বাড়িতে না উঠে, ওদের বাড়ি যাব কেন রে? সেটা কি ভালো দেখাবে? তবে হ্যাঁ, একদিন ওদের বাড়ি যেতে পারি, যাব বেড়াতে একদিন, বলেছি যখন।

আমি একটা থার্ড ক্লাস ছ্যাকরা গাড়ি ভাড়া করে আনব মা-যেদিন যাব ওদের বাড়ি। আমি খড়খড়ি বন্ধ করা গাড়ির খুপরির ভেতর তোমার সঙ্গে বসব না কিন্তু, বলে রাখছি এখন থেকেই। আমি কোচম্যানের পাশে বসে যাব, নয় তো গাড়ির পেছনে সইসের জায়গায় দাঁড়িয়ে। কেমন তো?

বেশ বেশ, তাই হবে। তাই যাস না হয়। হাসতে থাকেন মা-এখন খেয়ে নিয়ে পড়তে বসগে।

খোলা ফিটন গাড়ি চেপে গেলেও তো হয় মা? হয় না? তাহলে তো আমি তোমার পাশে বসেই দেখতে দেখতে যেতে পারি।

তাও হয়। কিন্তু খোলা ফিটন তো সাহেবপাড়া ছাড়া পাওয়া যায় না রে!

আমি ট্রামে চেপে চলে যাব সাহেবপাড়ায়, সেখেন থেকে ফিটন ভাড়া করে নিয়ে আসব হয়-চেপে বসে আসব তাইতে। আনব তো? কী বল মা?

তাই আনিস না হয়।

তারপরে রিনিদের বাড়ি পৌঁছবার পরে ঐ গাড়ি করেই যদি আমরা–আমি আর রিনি যদি একটুখানি হাওয়া খেয়ে বেরিয়ে আসি মা?

বেশ তো, আসিস না-কে মানা করছে। যা, এখন পড়তে যা তো।

বাবাও তো পড়তে বলছেন মা। বলছেন, বিদ্যায়ামৃতমতে। কিন্তু তার মানেটা কী মা? মুখস্থ করে পাশ করে কী যে আমার চারটে হাত বেরুবে তা তো আমি ভেবে ঠাওর পাইনে। মুখস্থ বিদ্যায় কী অমরত্ব যে পাব তা জানি না। কী তত্ত্ব তার কে জানে!

বলতে না বলতে উসকে ওঠেন মা। তত্ত্বকথায় মাকে একবার পেলে হয়, তক্ষুনি তিনি উন্মত্ত। বাবার তত্ত্ব পেতে গিয়ে মার ব্যাখ্যা শুনি-শুনতে বেশ লাগে আমার। যা কিছু শিক্ষা আমার-সে তো সেই ছোটবেলাতেই–নিজের মার কাছেই। বই পড়ে আর কতটা শিখেছি।

তাই বলছেন নাকি তোর বাবা?

বলছেন তো তাই। বলছেন যে, আবৃত্তি সর্ব শাস্ত্রানা বোধাদপি গরিয়সী। শাস্ত্রটার মানে কী যে, যদি কিছু বুঝতে নাও পারো, শুধু কেবল তুমি আউড়ে-শাস্ত্রবোধের চেয়েও তার ঐ আবৃত্তিটা বড়ো।

সে আবৃত্তি কি তোর মুখস্থ বিদ্যে? তোকে বলেছে!

আমিও তো তাই বলছি মা। মুখস্থ করে কোন্ অমৃতটা আমি পাব যে…

বলতে গিয়ে আমি থমকে যাই। মনের মেঘে বিজলির মতন চমকে ওঠে, হ্যাঁ, একটা অমৃত আছে বটে, যা শুধু মুখস্থ করলেই মেলে, মুখেই যার উদয় আর মুখেতেই অস্ত-মুখের ওপরেই সমস্ত–কিন্তু সর্বক্ষণ অন্তরে যায় নিরন্তর অনুরণন–উদয়াস্তব্যাপী সেই দিলবাহার, আসলে তা কোনো বিদ্যা কিনা জানি না, তবে তার তত্ত্ব যে সেই অল্প বয়সেই আমার আয়ত্ত হয়েছে, মার কাছে তা আমি আর ব্যক্ত করতে যাই না। যেমন ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলীর ওই বইটাও যে আমি পড়েছি, ফাঁস করতে পারিনি কোনোদিন। বিদ্যাসুন্দরের থেকে শেখা সেই সুন্দর বিদ্যার কথাটা জানাইনি কখনো মাকে, বইটা পড়ার পুনঃ পুনঃ মানা ছিল মার–সেইজন্যেই! মনে হয়, মনে আমার পাপ ঢুকেছিল তখনই।

বিদ্যার মানে আলাদা, একেবারেই আলাদা-সবাই তা জানে না। গঙ্গাড় করে তোর ওই আউড়ে যাওয়াটা বিদ্যে নয়। বিদ্যে কখনও পুঁথিগত হয় না, সেটা অভ্যাসগত। সেই অভ্যাসের মানেও আবার স্বতন্ত্র। প্রত্যেক শব্দের একটা আভিধানিক মানে আছে, কিন্তু তার আড়ালে আরেক অর্থ থাকে, প্রত্যেক বাক্যের অন্তনিহিত আরেক তত্ত্ব। শোন বলি। বিদ্যার মানে হচ্ছে…

কিন্তু মার বিদ্যা জাহিরের আগেই সত্য ভগ্নদূতের মতন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে-জানো মা, কী হয়েছে? সতীশদাকে পাকড়েছে পুলিশে, তার পকেটে রিভলবার পাওয়া গেছে। নাকি। সে কবুল করেছে যে, আরেকটা জিনিস আছে নাকি দাদার কাছে। থানার দারোগা অ্যারেস্ট করতে আসছে দাদাকে। জানায় সে।

ঐ জিনিস-কী জিনিস? জানতে চান মা।

ঐ রিভলবার। আরেকটা আছে নাকি দাদার কাছে।

কোথায় রিভলবার? দেখি তো?

এই যে মা। কোটের পকেট থেকে বার করে দিই।

কোথায় পেলি তুই?

মামার নামে একটা পার্শেল এসেছিল। সেই যে মামার একটা অঙ্কের চিঠি এসেছিল না? তার পরেই তো এল এই রিভলবার দুটো। একটা পার্শেলে।

সুরেন তলে তলে বিপ্লবীদের দলে ভিড়েছে জানতুম না তো। ঘুণাক্ষরেও না…

দারোগাবাবু ততক্ষণে বাবার বৈঠকখানায় এসে পৌঁছেছেন–বাতচিত করছেন বাবার সঙ্গে। দারোগার মুখে আমাদের কীর্তিকাহিনী শুনেও বাবার মুখে কোনো ভাবান্তর আমি দেখলাম না।

মা গিয়ে দারোগাবাবুকে বললেন-রিভলবারগুলো এসেছিল আমার ভাই সুরেনের নামে পার্শেলে…।

জানি। পোস্টমাস্টারবাবু পার্শেলের কথা বলেছেন। পার্শেল যে এসেছিল তা আমি জানি। সেদিনও গিয়েছিলাম পোস্ট-আপিসে, রোজই একবার করে যেতে হয় আমাদের…এইসব ব্যাপারের খোঁজখবর নিতে। পার্শেলটার ওপরে লেখা ছিল মেডিসিন উইথ কেয়ার আমি দেখেছিলাম। শিবপ্রসাদবাবুর কেয়ার অফে এসেছিল বলে আমরা আর ওটা খুলে পরীক্ষা করে দেখিনি…সন্দেহই করিনি কোন।

রামও করেনি আমার। মামার জিনিষ মনে করে নিয়েছিল, খুলে দেখেছে পিস্তল। খেলার জিনিস মনে করে রেখে দিয়েছে কাছে।

রিভলভার তো খেলার জিনিষ নয় ম্যাডাম। তক্ষুনি গিয়ে জমা দিলে হতো থানায়। তা না করে নিজের কাছে রাখাটা… দারোগার মুখ দারুণ গম্ভীর হয়।

খুবই অন্যায়, খুবই অন্যায়। মা সায় দেন তার কথায়। আমি জানলে সেই ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু টের পেলাম তো আজ। এইমাত্র। তা ছাড়া আমার ভাই সুরেন যে তলে তলে বিপ্লবীর দলে গেছে ঘুণাক্ষরেও তা আমরা জানিনে। টের পাইনি কখনও। তা ছাড়া, সুরেন তো বহুদিন এখানে থাকে না…

কোথায় থাকেন সুরেনবাবু এখন?

ভাঙরের কাছে কোন এক আশ্ৰম আছে নাকি, গোঁসাই গুরুর আশ্রমেই থাকে সে। ধর্মকর্ম নিয়েই আছে এখন–সর্বদা হরিনাম কীর্তন করে এই তো জানি। কোনোদিন যদি বিপ্লবী দলে ভিড়েও থাকে, এখন সে বদলে গেছে একেবারে। হলফ করে বলতে পারি আমি।

তা হলে খোঁজখবর নিতে হবে আমাদের একবার।

নিয়ে দেখুন, তাকে দেখলে, তার সঙ্গে কথা কইলেই টের পাবেন–আলাপ হলেই জানতে পারবেন সে এখন আলাদা মানুষ…একেবারে অন্যরকম…

এই সব কাজের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই পালটে যায়, ধর্মে মতি হয় শেষটায়, দেখেছি আমরা অনেক…

আপনারা কি মামাকে গিয়ে অ্যারেস্ট করবেন নাকি? আমার অন্তরগত বিবেক আমায় কামড় বসায়, আর্তনাদ করে উঠি।

যদি দেখি যে বিলকুল বদলে গেছেন, এনাকির্স্ট দলে তিনি নেই এখন আর, তাহলে কেন তাঁকে হ্যারাস করতে যাব আমরা?

দাদাকে বুঝি ধরে নিয়ে যাবেন থানায়? সত্য জানতে চায়।

শিবপ্রসাদবাবু যদি ওর জামীন হন-অতঃপর ওর গুড বিহেভিয়ারের দায়িত্ব নেন-ওকে নিজের চোখে চোখে রাখেন, বিপথে যেতে না দেন, তা হলে ওকেও আমরা কিছু বলব না। তবে বাবার নজরে ছেলেরা আর কতক্ষণ থাকে বলো! উনি যদি নিজের হেফাজতে রাখেন… মার প্রতি তিনি কটাক্ষ করেন। ছেলেরা মার নজর এড়াতে পারে না কখনই…উনি যদি নিজের হাতে ভার নেন ওর-তাহলে তোমার দাদাকেও আমরা কিছু বলব না।

দারোগার আবেদনে নীরব থাকলেও সর্বদাই যে তাঁর নজরানা আমার প্রতি প্রদত্ত, মার মৌনতাতেই সেই কথাটি সবার সম্মুখে মুখর হয়। আমি বেঁচে যাই।

কিন্তু তার পরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। শেষের সেই প্রশ্নটি আমার আর আমাদের সতীশের কি হবে তাহলে?

যদি সে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেয় তো কিছুই হবে না। ভালই হবে তার। যুদ্ধ থেকে বেঁবের্তে যদি ফিরে আসে, আসতে পারে, সরাসরি আমার জায়গাতেই এসে বসতে পারে হয়ত-চাই কি, কোনো থানার দারোগা হয়েই বসবে হয়তো কোনোদিন।

দারোগা? কী হতে গিয়ে কী যে হতে হলো সতীশকে, আমি নিজের মনে খতিয়ে দেখি একবার। লাভ কি ক্ষতি জানিনে, দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে সেই রাজভক্ত হতে হলো তাকে-পেট্রিয়ট না হয়ে পুলিস সেজে পেটের ধান্দায় ঐ পথের আর সব বিপথিকদের ধরে পেটাবার কাজে লাগতে হলো শেষটায়…হায় রে!

কী চাইতে গিয়ে কী যে পায় মানুষ, কী পাবার পরে কী আবার চেয়ে বসে যে–হিসাবের খাতায় তার অঙ্ক কোনোদিনই মেলে না বুঝি!

.

২৪.

সবটা কাল শোনা হোলো না মা আমার, মার কাছে গিয়ে বসলাম আবার : দারোগাবাবু মাঝখানে এসে আমার বিদ্যালাভের পথে বাগড়া দিলেন না কালকে?

কিসের বিদ্যালাভ?

সেই যে…যে বিদ্যায় অমৃতলাভ হয়…বিদ্যয়ামৃতমতে?

অমৃত মানে কী, বল্ দেখি আগে।

কে না জানে? সেই জিনিস, যা নাকি একদিন দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনে উঠেছিল…সুধা আর বিষ।

সুধা আর বিষ?

হ্যাঁ, সুধাটা স্বর্গেই শুধু পাওয়া যায়, কিন্তু বিষ কি কোথায় মেলে আর এখন? সবটুকু তো তোমার নীলকণ্ঠই গিলে বসে রয়েছেন।

গিলেছিলেন ভাগ্যিস!

আমার অনুযোগ : কিন্তু ঐ সুধাও কি তোমার এই বসুধায় মেলে নাকি আবার? বাবা বলছেন যে, বিদ্যার্জনেই কেবল তা পাওয়া যায়।

হ্যাঁ, সুধাই বটে। অমৃতর তাই একটা মানে বটে ঠিকই, কিন্তু বলেছি না, প্রত্যেক শব্দের ভেতরে আরেকটা অর্থ থাকে ফের? অমৃত কি না, অ-এর সঙ্গে যা ঋত, কিনা জড়িত। অ হল গে আদিস্বর, ব্রহ্ম আর ম্ হল তোর অনুস্বর–তার সঙ্গে যুক্ত ব্যঞ্জন,-যার মানে অদ্ভুত ব্যঞ্জনা, অফুরন্ত প্রকাশ। ব্ৰহ্ম আর তাঁর মায়া-স্বয়ং ব্রহ্মময়ী-মা বিন্দুবাসিনী। বিন্দু আর ব্যাস মিলিয়ে ঐ অম্।

অনুস্বরের চেহারাটাও প্রায় সেই রকম-তাই না মা? যেন পয়েন্ট আর তার রেডিয়াস। আমার পয়েন্টেড প্রশ্ন : বিন্দু আর ব্যাস নিয়ে তোমার ঐ বিন্দুবাসিনী। তাই না মা? ভারী আশ্চর্য তো!

আশ্চর্য কি! শব্দ তো ব্রহ্মই। প্রত্যেক শব্দের আড়ালেই তিনি রয়েছেন, বাক্যমাত্রেই তাঁর আভাস মেলে। যেমন সব জলেই ছায়া পড়ে আকাশের। মা জানানঃ শুধু দেখতে জানলে হয়।

যাদের দিব্যদৃষ্টি খুলে যায় তারাই দেখতে পায়, তাই না? যেমন বিবেকানন্দের খুলে গেছল একবার, তোমার ওই ঠাকুর খুলে দিয়েছিলেন, তখন তিনি পৃথিবীর সব জিনিসেই ব্ৰক্ষ দেখছিলেন। গোলদীঘির ধারে দাঁড়িয়ে, হারিয়ে ফেলেছিলেন গোলদীঘিকে। অতবড় গোলদীঘিটা, এমনকি তার রেলিং-টেলিং সব নিয়ে ব্রহ্মের সঙ্গে, গুলিয়ে একাকার হয়ে গেছল তাঁর চোখের সামনে।

হয়েছিলই তো।

কিন্তু ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিয়ে ঐ গোলদীঘির কিংবা গোলদীঘির সঙ্গে মিলিয়ে তোমার ঐ ব্রহ্মের এই তালগোল পাকানোটা কি ভালো মা? তাতে তো কোনোটাইে ঠিক ঠিক দেখা যায় না–সঠিকরূপে পাওয়া যায় না একদম।

সেও একরকমের দেখা রে! ব্রহ্মকে অখণ্ডরূপে দেখা, আবার খণ্ডরূপে দেখা-দুটো দেখাই সমান দেখাই সমান সত্যি।

খণ্ডরূপে দেখাটাই ভালো আমার কাছে। অখণ্ডরূপে দেখতে গেলে তো অদেখা হয়ে যায়, মনে হয় কিছুই দেখা হল না। সন্দেশকে খণ্ড খণ্ড করে ভেঙে ভেঙে খেলে তবেই না তার স্বাদ মেলে?

এখন যে কথা হচ্ছিল আমাদের, মা তাঁর আদিস্বরে ফিরে যান-অম-এর সঙ্গে ঋত, মানে, জড়িত কী? তার ব্যাস এবং বৃত্ত।সেই বিন্দু-ব্যাস-বৃত্ত-অখণ্ড মণ্ডলাকার-চরাচর ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন।

তোমার বিন্দুবাসিনী গিয়ে বিন্দুবাসিনী হয়েছেন শেষটায়! মার কথার ওপর আমার ফোড়ন কাটা–এটা তার বিলাসব্যসন কিংবা ব্যাসনবিলাসো বলা যায় মা।

বিন্দু, ব্যাস, বৃত্ত-অ উ ম তিন মিলিয়ে হল গে ওম। ওঁ-প্রণবমন্ত্র। অনাহত ধ্বনি। বিশ্বসৃষ্টির-বীজ নব নব সৃজনের। বুঝেছিস?

জানি। বাবা হরদম হরি ওম হরি ওম করেন, জানিনে? কিন্তু মন্ত্রবিদ্যা জানতে চাইনি তো তোমার কাছে-আমার বিদ্যালাভের মতরটাই জানতে চেয়েছিলাম!

বিদ্যা হচ্ছে বিদ্যমানতা, আমাদের অস্তিত্ববোধ। বোধের মধ্যে আমাদের বেঁচে থাকা। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগেই আমাদের অস্তিত্ব। অ-এর সঙ্গে ঋত হয়েই আমরা অমৃত আমাদের মৃত্যু নেই তখন। আবার আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, জড়িত হয়েই অস্তিত্ব ঈশ্বরেরও–তিনিও অমৃত তখনই। পরস্পরের এক সঙ্গে একাধারে যুগপৎ এই বিদ্যমানতার বোধই হচ্ছে মহাবিদ্যা। আর এই বিদ্যাতেই অমৃতমনুতে।

ওবাবা! আমার বাকস্ফূর্তি রহিত।–এত কাণ্ড!

বিদ্যা আবার দুরকমের-পবিদ্যা আর অপরাবিদ্যা। মার ব্যাখ্যান পরাবিদ্যা হোলো ঈশ্বরের সঙ্গে বিদ্যমানতা। পর কে? না, ঈশ্বর। পর বলতে তাঁকেই বোঝায় কেবল!

কথাটা ঠিক বলেছো মা। তৎক্ষণাৎ আমার সায় : ভগবানের মতন পর আর হয় না। কখনই তিনি কারো আপনার নন। দ্যাখো না মা, তিনি আপনার হলে পৃথিবীর মানুষের এত দুঃখকষ্ট কেন?

দুঃখকষ্টের কারণ ভগবান নন। আমরা নিজেরাই। সে কথা তোকে বোঝাব আরেকদিন। মা বলেন-এ পর সে পর নয় রে! এখানে পরের মানে আলাদা। পর কিনা, পরাৎপর, পরম। যাঁর ওপরে আর কেউ নেই, কিছু নেই। সেই পরমের সঙ্গে অহরহ আমাদের যে যুক্তবোধ-সেই হলো তোর পরাবিদ্যা। আর অপরের সঙ্গে বিদ্যমানতা হোলো অপরাবিদ্যা।

সেটা আবার কীরকম মা?

দুরকমের অস্তিত্ব না আমাদের! এক, ভগবানের সঙ্গে মনোযোগে আর অপর সকলের সঙ্গে কর্মযোগে? ঈশ্বরের সঙ্গে যোগ মনোবৃত্তে এবং সবার সঙ্গে যোগ জীবনবৃত্তে। মনে মনে তাঁকে আমরা টের পাই, তাঁর অস্তিত্ববোধ জাগে, ঠাকুর যাকে বলেছেন বোধে বোধ। আর বুদ্ধদেব বলেছেন, বোধি।

বুদ্ধদেবের বেলায় বোধি? আর পরমহংসদেবের বেলায় বোষোদয়? আমার প্রশ্ন হয়।

বুদ্ধদেব তো ঈশ্বর মানতেন না, নিজেকে স্বীকার করতেন কেবল। তাঁর বোধি হোলো আত্মবোধ-নিজের অস্তিত্ববোধ। আর শেষ পর্যন্ত তাতেই নির্বাণ লাভ করা।

কিন্তু সেই বোধি তো বুদ্ধ হওয়া–বুন্ধু মেরে যাওয়া! ফুরিয়ে যাওয়া একেবারে–যা নাকি নির্বাণ। সে তো সর্বনাশ। সে তত ভালো নয় মা। আমার বোধশক্তি জাহির করি-অনির্বাণ না জ্বলে একেবারে নিবে যেতে কে চায় মা?

আমার সে কথার জবাব না দিয়ে মা নিজের কথার আবেগে এগিয়ে যান : মনে মনেই সেই পরমকে পাই; আর অপরকে পেতে হলে যেতে হয় জীবনে জীবনে। আমাদের পেশায়। কার্যসূত্রে আমাদের নিত্যকার বৃত্তিতে যোগাযোগ হয় সবার সঙ্গে। সেই হেলো আমাদের অপর এক অস্তিত্ব।

ভগবানের যোগে আমরা মনস্বী, আর অপরের যোগে ধনস্বী-পরমার্থের সঙ্গে টাকাকড়ি দুই মিলে জীবন্ত। মার খোদাইয়ের ওপর আমার কিঞ্চিত খোদকারি।

হ্যাঁ, তাই। তাহলে দেখা যাচ্ছে আমাদের জীবনে বৃত্তটাই হল গিয়ে আসল। বৃত্ত নইলে অস্তিত্বই নেই। আবার সেই বৃত্তকে যদি মূল-এর সঙ্গে বিন্দুর সহিত যুক্ত করতে পারি, তাহলেই আমাদের অস্তিত্বের পূর্ণতা। বিন্দুবাসিনী আমাদের বৃত্তে এসেই নিত্য; নিত্যকালীন নৃত্যকালী; তাঁর সঙ্গে সংযোগেই আমাদের অস্তিত্ব। আমরা অ-মৃত।

হ্যাঁ, মা। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না, মার কথায় সায় দিয়ে যাই।

একেই বলে আবৃত্তি। এই আবৃত্তিই হোলো গে…

কী করে হোলো, বুঝিয়ে দাও।

অ হোলো গে ঈশ্বর, অ-র সঙ্গে আরেক অ-কার যোগ হলে হয় আ। স্বরসন্ধিতে পড়েছিস। এই দ্বিতীয় অ-কার হোলো তাঁর অনুরূপ। তুই, আমি, আমরা সবাই-পরস্পরের যোগাযোগে আমাদের আকারলাভ। তারপর বৃত্তপথে এসে, নিজ নিজ বৃত্তির পথে আবৃত্তি হচ্ছে আমাদের। তাঁরও, আমাদেরও। তাঁকে নিয়ে আমরা পুনরাবৃত্ত, এবং আমাদের নিয়ে তাঁর পুনরাবৃত্তি। পুনঃ পুনঃ পুনরাবৃত্তি-অনন্তকাল ধরে চলেছে এই খেলা!

মা অনায়াসে কত সহজে সেদিন বুঝিয়েছিলেন যে! এতদিন বাদে আজ আমার ভাষায় তার আভাসেও পৌঁছতে পারব কি! মোটামুটি যা বুঝেছিলাম, এইভাবে বিন্দুমাত্র তিনি বৃত্তপথে এসে ব্যক্ত হচ্ছেন–আমাদের মনবৃত্তে প্রাণবৃত্তে, আমাদের ব্যক্তিত্বে। দেহবৃত্তে স্নেহবৃত্তে আদান-প্রদানের রূপ ধরে জীবনের নানান বৃত্তিতে। এই আমাদের জীবনবৃত্তান্ত। মূলে তিনিই ফুলে ফুলে ফুটছেন, ফল হয়ে ফলছেন–তাঁকে পাট্টায় বসিয়েই পাটোয়ার আমাদের ফলাও কারবার। মৌলিক তিনিই নিজের অনুকরণ করছেন আমাদের মধ্যে নব রূপে-নিত্য নব হয়ে। নিতুই নব চিরকালের রূপকথাই এই।

তাকে কেন্দ্র করেই বৃত্তাকারে ঘুরছি আমরা, ঘুরব আমরা-এই আবৃত্তিই হচ্ছে শাস্ত্রটাস্ত্র পড়ার চেয়ে বেশি–মা পাড়েন : এই আবৃত্তিই তোর সর্বশাস্ত্রানা বোধদপি গরিয়সী বুঝেছিস এইবার?

হ্যাঁ মা। মার বোঝানো কেমন অবলীলায় মনের মধ্যে মিলিয়ে যায়। পান্ডিত্যের বোঝার মতন মাথার ওপর বোঝাই হয়ে চেপে বসে। ভারালো হয়ে ভারিক্কী করে তোলে না।

আর আমাদের ঠাকুর হচ্ছেন তার প্রমাণ। মা কালীর নিরক্ষর পুরুৎ ছিলেন তো তিনি। পূজা আরতি করতেন মার। আর আরতি মানেও আবৃত্তি। তাঁর সঙ্গে যুক্ত থাকা, শুধু তাকেই প্রদক্ষিণ করা ঘুরে ঘুরে। সমস্ত শাস্ত্রের পার পেয়েছিলেন তিনি ঐ করেই। মার কাছেই–নিজের মনের মধ্যে। পরে অবশ্যি তিনি পন্ডিতদের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনায় জেনেছিলেন, মা তাকে যা যা জানিয়েছেন শাস্ত্রবাণীর সঙ্গে তা সব মিলে যায় ঠিক ঠিক। তাই না?

হ্যাঁ মা।

মা-ই নিজে জানিয়ে দেন, তা নইলে কি আমরা জানতে পারি? তিনিই প্রথমে চিনিয়ে দেন নিজেকে-তারপরে সারা জীবন ধরে চিনতে হয়, জানতে হয় আবার আমাদের বাজিয়ে নিতে হয় বার বার যা নাকি তিনি জানিয়েছেন। পদে পদে হাতে হাতে পাই যখন-তখন তখনই টের পাই, ফের বুঝতে পারি আমরা। এমন কি দেবতাদেরও তাঁকে জানাতে হয়েছিল এই করে–চেনাতে হয়েছিল নিজের থেকে। কথাটা বেদে আছে।

বেদে আছে? দেবতাদেরও চেনাতে হয়েছিল?

দেবতারাও কি তাঁর দেখা পায়? চিনতে পারে তাকে? তিনি নিজে না দেখালে না চিনিয়ে দিলে? এইজন্যেই দেবতাদের কাছে তাঁকে দেখা দিতে হয়েছিল। দেবতাদের সামনে দিব্য জ্যোতিরূপে একদিন আকাশে তিনি আবির্ভূত হলেন। দেবতারা তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল, ঐ জ্যোতিস্বরূপা কে উনি? উমা হৈমবতী আকাশবাণীতে তিনি বলে দিলেন তখন তাদের। আর তাদের পথের সামনে যে তৃণখন্ড পড়েছিল, বললেন, ওটাকে দুখানা করে দেখি। ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ সবাই মিলে হমুদ্দ চেষ্টা করেও সেই একটা কুটোকে দুটো করতে পারলেন না। এমন কি, নাড়াতে পারলেন না একটুও। অমন প্রবলপ্ৰতাপ যে বায়ু–যার দাপটে কিনা বিশ্বব্রহ্মান্ড কাঁপে-সেও সেটাকে একটুখানিও সরাতে পারল না। মা তখন জানালেন, আমিই সেই শক্তি, যার জোরে তোমরা নড়াচড়া করো, নাড়াচাড়া করছ, নড়ছ চড়ছ।… চন্ডীতেও ঐ কথা আছে, প্রথমে উনি ওদের দেখা দিলেন, দিয়ে বললেন, ডাকো আমায়। আমার কাছে চাও। আমিই দেবো তোমাদের, আমিই দিতে পারি। বাঁচাতে পারি তোমাদের। যখন যখনই আমায় ডাকবে আমি দেখা দেবো, আপদে বিপদে সব সময় রক্ষা করব তোমাদের। করেছিলেনও রক্ষা-চন্ডীতে আছে পড়ে দেখিস। আমার শিয়রের কাছেই তো থাকে বইটা, মাথার বালিসের পাশেই। দেখিসনি? সংস্কৃতে লেখা, কিন্তু মানে করে দেওয়া রয়েছে বাংলায়। পড়লেই বুঝবি। পড়বি, বুঝলি।

বাবার গীতার মতন দেখতে, ওই চটি বইটা তো? দেখেছি। পড়বো মা।

দেবতা কি ছাড়, স্বয়ং শিবের কাছেও নিজের স্বরূপ প্রকাশ করতে হয়েছিল তাঁর। তবেই শিব চিনতে পারলেন তাকে ঠিক ঠিক। দশ মহাবিদ্যারূপে দেখা দিয়েছিলেন না তিনি একবার?

হ্যাঁ, পড়েছি অন্নদামঙ্গলে।

কী পড়েছিস? শিব নিঃস্ব হয়ে ভিখারীর ন্যায় অন্নভিক্ষায় বিশ্বময় ঘুরেছিলেন, কোথাও খুদকুঁড়োটাও জোটেনি, এমন কি মা লক্ষীর কাছেও না–শেষটায় অন্নপূর্ণার কাছে গিয়েই তিনি তাঁকেও চিনলেন, আর অন্নও পেলেন নিজের। পরমান্ন, যা নাকি অমৃতই।

হ্যাঁ মা।

মা তাঁকে নিজেকেও চেনালেন, পরমান্ন কী, কোথায় মেলে তাও বুঝিয়ে দিলেন তিনিই। মা বলেন-প্রথমে মা-ই মিলিয়ে দেন, তারপর সেই সত্য টের পাবার পরে তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়-চেয়ে চেয়ে নিতে হয় বারবার–বরাবর-জীবনভোর।

মিলিয়ে দেখি মনের মধ্যে, হ্যাঁ, মার কথাটা ঠিকই। অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পরমান্ন যে কী, আমার অন্নপূর্ণাও নিজের থেকে চিনিয়ে দিয়েছিল আমায়। তার সম্মুখেই পেলাম প্রথম। তারপর আমাকে চেয়ে চেয়ে নিতে হয়েছে। খেয়ে খেয়ে পেতে হয়েছে। পেয়ে পেয়ে খেতে হয়েছে। বারবার। সত্যি! সত্যিই সত্যি!

সত্য কথাটার তত্ত্বালোচনায় মজে মনে মনে মশগুল হচ্ছি, মাঝখান থেকে সত্য এসে অন্য কথা পাড়ে। কালকের মতই জানান দিয়ে তার হানাদারি।

কী রে দাদা! যাবিনে তুই?

কোথায় যাব রে?

বাঃ, সতীশদারা আজ চলে যাচ্ছে না? ইস্কুল থেকে সভা করে বিদায় অভিনন্দন দেওয়া হচ্ছে সবাইকে। সব ছেলে যাচ্ছে, তুই যাবিনে?

যাব না কী রে! বুঝি বা জন্মের মতন চলে যাচ্ছে তারা। আবার ফিরে আসবে কিনা কে জানে! দাঁড়া।… শার্টটা আমার গায়ে চড়াই।

যাবার মুখে সাড়া পাওয়া যায় বাবার। সেদিনকার সভায় তো পড়িসনি। বলে দিলাম তোকে অতো করে আমি। আজকের সভাটায় মনে করে পড়িস যেন। হেমচন্দ্রের সেই অমর কাব্য এরকম ক্ষেত্রেই পড়বার বস্তু-বুঝলি? আবৃত্তি করিস আজ, কেমন? করবি তো? বলে বাবা নিজেই আওড়াতে শুরু করেন–

বাজ ওরে শিঙ্গা বাজ ঘোর রবে
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়;
চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপান।
তারাও স্বাধীন তারাও প্রধান…
দাসত্ব করিতে করে হেয় জ্ঞান, ভারত শুধুই…

জানি বাবা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। ফাঁক পেলেই শিঙ্গাটা আমি বাজিয়ে দেবো আজকে। আমি ভরসা দিই।

সেদিন বাজাতে কী হয়েছিল তোর? ফাঁক খুঁজে নিতে হয়। সুযোগ কি আর আপনার থেকে আসে রে? সেটা সৃষ্টি করবার।

সেদিন আর শিঙ্গা ফুঁকবার সময় পেলাম কোথায় বাবা। তার আগেই না সমস্ত কিছু গড়বড় হয়ে প্ল্যান ভেস্তে গেল আমাদের?

.

২৫.

স্কাউটের পোশাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছিল যে সতীশকে। সুগঠিত সুঠাম শরীরে মিলিটারি ড্রেসে সে যেন এক লহমায় যৌবনে গিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। তাদের সবাইকেই চমৎকার মানিয়েছিল, কী বলব!

তোকে সেই মেজর জেনারেলের মতই মনে হচ্ছে মাইরি! বললাম আমি সতীশকে। গদগদ গলায়।

সতীশ গর্বিত হাসি হাসল একটুখানি।

কী করব ভাই! নিলই না যে আমায়। আমার মতন কাউকেই নিল না তো। জেনাব্যালি মাইনরদের নেয় না যে। মেজর জেনারেল হতে পারলাম না তাই।

সতীশ আর আমায়–দুজনকেই বুঝি আমি সান্ত্বনা দিতে চাই।

শরীরটা তৈরি করে নে এর ভেতরে, তাহলেই হবি। যুদ্ধ কিছু এর মধ্যেই ফুরোচ্ছে না। যুদ্ধ আছে আরো। চিরকাল ধরে যুদ্ধ। ঢের চানস আসবে।

তোদের লীডার ভারী রাগ করছে, নয় রে? কী করতে কী হয়ে গেল যে। সত্যি। কিন্তু ভাই, আমার কোনো দোষ নেই, আমি তো মারবার জন্যে তৈরি হয়েছিলাম, এমন কি মারা যাবার জন্যেও, কিন্তু কপাল মন্দ, করব কী! রাগ করছে খুব আমাদের ওপর, তাই না?

না না, রাগ করবে কেন? খুশিই হয়েছে বরং। আমি যুদ্ধে যাবার এই সুযোগটা পেলাম। বলেই। এতে আমাদের কাজের সুবিধেই হবে আরো। সেখানে গিয়ে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে আমি রিক্রুট করতে পারব–এনতার আসবে আমাদের এই বিপ্লবী দলে। আমাদের কাজের আরো সুসার হবে তাতে। সেই ভারই দিয়েছেন তিনি আমাদের ওপর।

ভালোই হয়ে গেছে তাহলে, কী বলিস? এই জন্যেই বুঝি বলে থাকে–ভগবান যা করেন সব ভালোর জন্যেই-না রে?

হ্যাঁ রে। এখন যদি সত্যিই আমি মেজর জেনারেল হয়ে ফিরতে পারি তবেই না! ফিরে এসে ফোট জ্বলিয়মের ভেতরে থাকব তখন, আমার দলবল নিয়ে। ভেতর থেকে, ভেতরে থেকে একদিন দখল করে নেব ফোর্ট। তারপর কেল্লার যত ফৌজ স্বদলে পেলে, আর কামান বন্দুক তামাম হাতে এলে ইংরেজ তাড়াতে কতক্ষণ লাগে রে!

পারবি পারবি। নিশ্চয় পারবি। সেইজন্যেই তোর জন্ম হয়েছে, বুঝতে পারছি আমি। নইলে এমন যোগাযোগ হয় কখনো? বল তুই?

গলার মালা দুলিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে মার্চ করে চলে গেল সব্বাই। আমি ফিরে এসে মার কাছটিতে বসলাম আবার।

আচ্ছা মা, যুদ্ধবৃত্তিটা কি খুব খারাপ?

না, খারাপ কিসের! যার ওদিকে ঝোঁক আছে তার পক্ষে ভালোই তো। ন্যায়যুদ্ধ তো ভালোই রে! কেন, তোর বুঝি ভারী খারাপ লাগছে যুদ্ধে যেতে পারলিনে বলে?

না, না। তা নয়। যুদ্ধ-টুদ্ধ আমার মোটেই ভালো লাগে না। মানুষরা কি মারবার? মানুষ তো ভালোবাসার জিনিস মা!

তাই নাকি রে! তুই বুঝি মানুষকে খুব ভালোবাসিস?

ঠিক তা নয়। সব মানুষকে না, তবে তার ভেতরে বেছে বেছে দুচারজনকে তো ভালোই লাগে বেশ। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না তাদের?

মহাপুরুষদের বুঝি? যেমন অশ্বিনী দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বোস, এঁদের মত? নাকি ওই রবিঠাকুর, পরমহংসদেব…।

না না, ওদের কাউকেই। অত বড়োকে কি ভালোবাসা যায় কখনো? এই ছোট ছোট মানুষদের-মাথায় যারা আমার বড় নয়, আমার মতই…আমার মনের মতন যারা।… আচ্ছা মা, ভালোবাসাবাসিটা কি কারো বৃত্তি হতে পারে না?

বৃত্তিই তো। মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই রে। তবে বৃত্তি বলতে যা বোঝায় তা নয় ঠিক। ওটা তো হৃদয়গত ব্যাপার। বৃত্তি হচ্ছে কর্মগত। তুই যা কাজ কবি-যে কাজটা বেছে নিবি তোর জীবনে, সেইটাই হবে গিয়ে তোর বৃত্তি। বুঝেছিস এবার?

তা তো বুঝেছি। কিন্তু কোন্ কাজটা যে আমি বেছে নেব তাই তো আমি ভেবে পাচ্ছি। কী যে আমার বাঞ্ছনীয়।

যেদিকে তোর মন যায়, যে কাজটা তোর মনের মতন কাজ। সেই কাজই হচ্ছে তোর আসল কাজ। তাই কবি তুই। তাই হবে গিয়ে তোর আসল বৃত্তি।

সেটা আমি টের পাব কি করে মা? সেই কাজটা?

মা-ই বুঝিয়ে দেবে, জানিয়ে দেবে–সে কাজে তোর মন সাড়া দেবে, মার সাড়াও পাবি। নিয়তিই পাইয়ে দেবে তোকে। যথাসময়ে পেয়ে যাবি-ভাবিসনে। মার কাছে চাইলেই পাবি, বলেছি তো তোকে, মাকে ধরতে পারছিসনে? মাকে পেলেই সব পাওয়া যায়। মিলে যায় সব কিছুই।

মাকে আমায় পেতে হবে না মা। কষ্ট করে পাকড়াতে হবে না তাকে, তুমিই বলেছ তো। মা-ই তো ধরে রয়েছে আমাদের সবাইকে? তাই না? মূলধন তো আমার হাতের মুঠোয়, কিংবা সেই কেন্দ্রমূলের মুঠোর মধ্যেই আমরা। সেজন্যে আমি ভাবিনে। আমি মাথা ঘামাচ্ছি আমার বৃত্তিটা কী হতে পারে তাই নিয়ে। আমার বৃত্তিটা কী হবে, বলো না তুমি আমায়!

প্রবৃত্ত হলেই দেখতে পাবি। বুঝতে পারবি তখন।

কিসে প্রবৃত্ত হবে তাই যে আমি জানিনে ছাই।

কাজেই প্রবৃত্ত হবি, আবার কীসে? মা বলেন, যে কোনো কাজে। মনের মত কাজ হলে তো কথাই নেই, যদি কাজের মত মন হয় তাহলেও হবে। মা তো সব কিছুর কেন্দ্রেই রয়েছেন, মনের মূলেও সেই তিনিই–তুই মন দিয়ে তোর কাজ করলেই তাঁর সঙ্গে তোর যোগাযোগ হয়ে যাবে, সহজেই হবে স্বভাবতই-সেটা তোর জাতেই হোক, অজান্তেই হোক। তখন দেখতে পাবি তোর ভেতর থেকে আরেকজন কে যেন তোর কাজে এসে হাত লাগিয়েছে, সব কাজ করে দিচ্ছে তোর, কাজটা হয়ে যাচ্ছে অবলীলায়, তখনই তুই বুঝবি। এ আর কারো কর্ম নয়, মারই কাজ।

যে কোনো কাজ?

হ্যাঁ, যে কোনো কাজ। কাজটা বড় কথা নয়, কাজের ভেতর ভগবানের দেখা পাওয়াটাই আসল। তিনিও যে তোর কাজে তোর সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন, হাতে হাতে ছোঁয়াছুঁয়ি হচ্ছে, হাতে হাতে তার প্রমাণ পাবি, তুই চলেছিস আর তোর সঙ্গে তিনিও চলেছেন সাথে সাথে, পদে পদে টের পাচ্ছিস সেটা–মুহূর্তে মুহূর্তে তার পরিচয় পাবার জন্যই তো আমাদের জন্মানো, এই বেঁচে থাকা, আমার আমি হয়ে ওঠা–সম্পূর্ণ হয়ে ওঠা। এই পুনঃ পুনরাবৃত্তি। জন্মে জন্মে এই অমৃতমতে। এই অমরত্ব।

আমি কাজে লাগলেই আরেকজন অলক্ষ্যে আমার কাজে এসে হাত লাগাবে, বলছ তুমি? আমি কই, সমক্ষে সেই প্রমাণ পাবো?

পাবি বইকি। ভেতর থেকে তিনি তো আসবেনই, বাহির থেকেও আসবে কতজনা তোর সাহায্যে এগিয়ে–তাদের মধ্যেও সেই তিনিই। বিরাট কর্মীদের বড় বড় কাজ সব এই করেই তো হয়েছে রে!

আমি বাইরের লোকদের কথা ভাবছি না মা, আসুক না আসুক, বয়েই গেল আমার। আমি ভাবছি ভেতরের…

নিশ্চয়। ঠাকুর কি তবে মিছে কথা কয়েছেন নাকি? বলেননি যে, একজন ধান মাপতে বসলে আরেকজন তার পাশে বসে ধানের রাশ ঠেলে দিতে থাকে–বলেননি তিনি?

হ্যাঁ, বলেছেন তো। তুমি বলছ এই রাশলীলা সেই ভগবানের?

বলছি কি তবে? রামপ্রসাদ যখন নিজের ঘরের বেড়া বাঁধতে লাগলেন তখন ভেতর থেকে তাঁর হাতের কাছে দড়ি যুগিয়ে দিচ্ছিল কে? তিনি কাজটায় লাগলেন বলেই না ভেতরের যোগান পেলেন? এই বাগানদারিটা কার? আবার তিনি যখন নিজের গান বাঁধতে বসলেন তখন সেই গানের ধুনিও কে তাঁকে যোগালো বল্ দেখি?… ঠাকুর কি কখনো মিছে কথা কন?

আবার রবিঠাকুরের বেলাতেও এরকমটা ঘটেছিল মা। রিনি সেদিন একটা গান গাইছিল, শান্তিনিকেতনে শেখা…শুনবে? তার মতন অমন মিষ্টি সুর বার করতে পারব না আমি, তবে কথাগুলো কোনোরকমে ছন্দ করে বলতে পারি

আমার এ গানের তরী ভাসিয়েছিলাম/চোখের জলে
সহসা কে/এলে গোকে এলে গো/সে তরী বাইবে বলে…

রিনি গাইছিল তাই আমার মিষ্টি লাগছিল, কিন্তু গানটার মানে আমি একদম বুঝতে পারিনি, তোমার কথায় বুঝতে পারছি এখন।

সেই একই মানে। কবি যখনই না সুরধুনীর স্রোতে নিজের নৌকো ভাসিয়েছেন, দেখেছেন যে, আরেকজন এসে তাঁর পাশে বসে দাঁড় বেয়ে চলেছে তাঁর সঙ্গে। গীত রচনাই ছিল তাঁর বৃত্তিতে, নিজের বৃত্তিতে তিনি প্রবৃত্ত হলেন বলেই না … গানের পথে পা বাড়াতেই সঙ্গীতের সঙ্গী এসে হাত মেলালেন তাঁর সঙ্গে …এত সুর, এই অফুরন্ত গান কি একজনের কাজ! বলে মা গুনগুন করে সুর ধরলেন তারপর…পথিক, তুমি পান্থজনের সখা হে,/পথে চলা, সেই তো তোমার পাওয়া/যাত্রাপথের আনন্দ গান যে গাহে/তারই কণ্ঠে তোমারই গান গাওয়া…

তাঁর গানে সেই একই কথা মা এখানেও। আমি সায় দিলাম মার কথায়। সত্যি মা, এত গান, এত রকমের গান কখনই একজনের সৃষ্টি নয় সত্যি। এত কাজ একজনের পক্ষে সম্ভব হয় না।

একজনৈর জন্যে কি হয় কিছু কখনো? গাহিতে হবে দুইজনে। পরাবিদ্যায় গায়ক গাইছেন পরমাত্মার সঙ্গে। আর অপর বিদ্যমানতায় এক শ্রোতার জন্য–তার সঙ্গেই। তাকেই বলে গানের সঙ্গত।

নইলে গান গাওয়াটাই অসঙ্গত। তাই না মা? বলে আমি মার উল্লেখিত কবিতাংশটা আজড়ে নিজের স্মৃতিশক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাই-কেবল গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুইজনে/একজন গাবে ছাড়িয়া গলা আরেকজন গাবে মনে।

— হ্যাঁ। তেমনি তুই যদি কখনো কবি হোস…কবি হতে চাস নাকি তুই? তাহলে তোর বেলাও এমনটা ঘটবে দেখবি। রবিবাবুর মতন অত বড় অঘটন হয়ত ঘটবে না, শতদল পদ্ম যেমন তার একশ দলে বিকশিত হয়ে ওঠে তা হয়তো হবে না তোর বেলায় আমার মনে হয় এটা। যার যেমন আধার। না হোক, দুচার দলের ফুলের মতন ফুটতে পারবি তো তুই-তাতেই তুই সম্পূর্ণ হবি, সার্থক হবি।

হলে তো মা! মার কথার পিঠে আমি দীর্ঘনিশ্বাস পাড়ি হওয়াই যাচ্ছে না যে।

হবেই। না হয়ে যায়? ঠিক প্রবৃত্তিটির বৃত্তে তুই এক-পা এগুলেই দেখবি, মা দুপা এগিয়ে এসেছেন, সাথী হয়েছেন তোর পথযাত্রায়, তুই দুহাত বাড়ালেই মা দশ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছেন তোকে। দেখবি তুই।

কবিতা লেখা, গল্প লেখা কি কারো বৃত্তি হতে পারে মা? আমি শুধাই।

কেন হবে না? যেখানে পরাবিদ্যায় আর অপরাবিদ্যায় মিলেছে, মাকে ডাক দিয়ে পাচ্ছিস, মার কাছ থেকে আসছে, আর অপরের যোগে প্রকাশিত হচ্ছিস-ডাকিনী আর যোগিনী, মার দুই সখি এসে মিলেছেন যেখানে, সেখানেই আমাদের বৃত্তি, সেই আমাদের বৃত্তপথ-সেইখানেই আমরা প্রবৃত্ত। যেখানে যেখানে এমনটা হয় মার সেখানে এই ছিন্নমস্তারূপ–নিজের কণ্ঠের রুধির ধারা নিজে পান করছেন, পান করাচ্ছেন তাঁর ডাকিনী যোগিনীদের।.সেই ত্রিবৃত্ত এসে মিলেছে যে পথে–সেইখানেই। কোথায় কোথায় এমনটা হয় রে?

কোথায় হয় কে জানে! তুমিই জানো আর মা-ই জানেন।

সঙ্গীতে হয়, সেখানে মা নিজের সুর নিজে শোনেন, যে সেই সুরঙ্গমাকে ডাকে, ডেকে আপন গলায় আনে-সেও শুনতে পায়, আর পায় বিশ্বজন সবাই-তার শ্রোতারা-সেই সুরধুনীতে স্নান করে ধন্য হয় যারা। ডাকিনী আর যোগিনী হল না? মা একটুখানি থামেন : লেখাটেখার বেলাতেও তো তাই হয়ে থাকে, তাই না?

আবার ভালোবাসার বেলাতেও বোধ হয় তাই মা। ভাবলে, প্রায় সঙ্গীতের মতই সন্তুরাগ সমন্বিত সেটাও। কিন্তু সঙ্গদোষে দুষ্ট সেই পঞ্চম ম-কার মার সম্মুখে উচ্চারণ করতে বাবে আমার। একটু ঘুরিয়েই বলি-তাতেও মা একজন ডাক দেয়, আরেকজনা যোগ দেয়, আর মা তাদের মাঝখানে থেকে মিলিয়ে দেন দুজনাকে। প্রায় তাই হল না মা? আমার পুনশ্চ যোগ হয়–মা-ও তো সেই ভালোবাসার ভাগ পান, পান নাকি?

মাকে ভাগ দিয়ে পেলেই, মাতৃভাগ্যে এলেই তো সার্থক হয়, সম্পূর্ণ হয় সেই ভালোবাসা। মা কন, মার প্রসাদ পেলেই তো স্বাদ মেলে, সাধ মেটে।

তবে তুমি যে বলছ মা, ভালোবাসা কোনো বৃত্তি হতে পারে না–বৃত্ত হতে পারলেও। ওটা আমাদের স্বাভাবিক বৃত্তিই নাকি–নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতই। তাই তুমি বলছ তো? তোমার মতে কর্ম না হলে কোনো বৃত্তি হবে না, কিন্তু ভালোবাসা তো কর্ম হতে পারে না কর্মই নয়…। বলে আমার স্বগতোক্তি শুনি এবং কর্ম হলেও তো ঈষৎ কর্ম। সৎ কর্ম কিনা। কে জানে! আর তা যদি কোনো বিদ্যাই হয়, সুন্দর বিদ্যাই। (ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর আমার মনে পড়ে যায়। আর বৃত্তি হলে তো আনন্দবৃত্তি। কিন্তু কর্ম ও কর্ম বলতে যা বোঝায়, এক সঙ্গে হাত পা মাথা খাটিয়ে ডাকিনী-যোগিনীর সহায়তায় রুধির উপায়-রুধির বুলতে টাকাকড়িও বোঝায় নাকি আরার-মাই একবার বলেছিলেন আমায়-একাধারে নেশা আর পেশা সেই ভালোবাসা তা নয় তো! কাউকে ভালোবেসে কি টাকা উপায় করা যায় কখনো? গেলেও সেটা সদুপায় বলে গণ্য হয় না নিশ্চয়, নিতান্তই তা গণিকাবৃত্তি বটে। মনে মনে মাথা ঘামিয়ে এই সব আলোচনার পর নিজের মুখপটে প্রকট হই–কিন্তু তোমার ওই লেখা-টেখাটা বৃত্তি হবে কি করে বলো? সে কর্মে তো টাকা উপায় করা যায় না মোটেই?

কে বললে যায় না? তবে তেমনটা হয় না হয়। কিন্তু জীবনের সব দুঃখ দূর হয় না বোধ হয়–কিন্তু জীবনে তো দুঃখ রয়েছেই, বড়লোকেরও আছে, গরীবদেরও আছে তবে যারা শিল্পকলা নিয়ে থাকে, আপন ছন্দে চলে, একরকমের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য তারা পায় বইকি–সেটা কি কিছু কম?

না, সেটা ছন্দ নয়। আমি ঘাড় নাড়ি– আর চারুদা তো লিখেটিখেই সংসার চালায়। চালায় না মা?

চালায় বই কি! লেখাটাই যদি তোর পেশা করিস তত মাকে স্মরণ করে লিখতে বসলেই…

মনটা গোড়ায় মাকে দিয়ে তারপর তো লেখায় দিতে হবে মা? গোড়ার থেকেই তো আগাতে হয় আমাদের।

হ্যাঁ, তাহলেই দেখবি তোর লেখাটেখা কেমন আপনার থেকেই হয়ে যাচ্ছে যেন। নিজের বেগে বয়ে চলেছে। কোত্থেকে সব কথা আসছে যে! লাইনকে লাইন কে যেন লিখে দিচ্ছে তোর হয়ে…..কত আইডিয়াই যে আসছে তোর মাথার থেকে, ভেবেই পাবিনে। তর তর করে লিখে যাবি তুই।

তাই নাকি মা?

তবে ওই যে বললি, গোড়ার থেকে আগাতে হয়– উল্টোপাল্টা কথা কইলেও কথাগুলো তোর আলতুফালতু না–একেক সময় তার একটা মানে হয় বেশ। কিন্তু আমার ভয়ও হয় সেই সঙ্গে আবার।

কিসের ভয় মা?

তুই যেরকম শব্দের মোহে পড়েছিস না? তার থেকে, ভয় করে এর পরে হয়তো তুই অর্থের মোহে পড়বি নির্ঘাত টাকাকড়ির লালসায় ছুটবি। শব্দ থেকে আর এক পা এগুলেই তো অর্থ। অর্থের জন্য আরেক ধাপ এগুলেই অনর্থ। অনর্থে না পড়ে যাস তুই শেষটায়–সেই ভয়। তবে ভরসা এই, মা-ই তোকে সব অনর্থ থেকে সব সময় সামলে রাখবেন-বাঁচাবেন তোকে সব সময়।

নিশ্চয় নিশ্চয়। আমিও মাকে ভরসা দিই : এখন তুমি গোড়াতেই যে কথাটা বলছিলে … বলে অন্য কথায় গড়িয়ে যাই। শুধুই যে শব্দের মোহে পড়িনি, শব্দের মতন রূপ রস গন্ধ স্পর্শ সব কিছুর মহিমাতেই আমি কাতর, তার দৃষ্টান্ত মার কাছে তুলে ধরিনে আর।

গোড়ার কথা হচ্ছে মা-ই। সবের গোড়ায়–সব কিছুর গোড়াতেই। মার গুঁড়ি ধরেই উঠতে হবে আমাদের।

গোড়াগুড়িই মা? আগাতেও সেই মা-ই আবার? আমার বাগাড়ম্বর-মা আমার ফলেও আছেন ফুলেও রয়েছেন।

হ্যাঁ, মার বোধন করেই আমাদের সব কাজের উদ্বোধন। মাকে ডাকার সাথে সাথেই মার সাড়া পাওয়া যায়-মাতৃসম্বোধনের সঙ্গে সঙ্গেই তোর বোধোদয়-বুঝেছিস? সম্বোধতে কী হয়? প্রথমা। প্রথমা-ই তো? পড়িসনি তোর উপক্রমণিকায়? সব কাজের উপক্রমেই তাই। মা-ই। তিনিই তো এই বিশ্বের আদ্যাশক্তি–প্রথমতমা–তাই প্রথমা। তাই উপক্রমণিকার সম্বোধনেও স্বয়ং তিনিই। আর, সম্বোধনের সাথে সাথেই তাঁর সঙ্গে তোর সম্বন্ধ স্থাপিত। সম্বন্ধে ষষ্ঠী। আর তার পরেই কিনা পরস্পরের প্রতি অধিকারবোধ জাগ্রত-মার তোকে আর তোর মাকে অধিকরণ। অধিকরণে সপ্তমী। আর তার পরেকার ব্যাপার হল গিয়ে তাদের দুজনের সন্ধি-তুই তাঁর বাহন সিংহ হলেও–কি, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অসুর হলেও– সেই অষ্টমীতে।

তারপর? আমার প্রশ্ন। সন্ধিপূজার পর?

তারপরই নবমী। তোর নবীকরণ-নবরূপান্তর। আর সবশেষে তোদের নিরঞ্জন-মার মধ্যে তোর আর তোর মধ্যে মার। আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তের মাতৃপূজার এই-ই নির্ঘন্ট।

ওব্বাবা কটমট ওই ব্যাকরণের মধ্যেও আবার সেই ভগবান? আমি হাঁ হয়ে যাই। সেটাও তোমার গিয়ে দর্শন শাস্ত্র?

আমাদের সব কিছুই দর্শনভিত্তিক। আমাদের সঙ্গীত, আয়ুর্বেদ, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ –সব। আর দর্শন মাত্রেই ভগবদ্দর্শন। ভগবানকে দেখা–তাঁর মূলে এবং তাঁর মায়ায়–তস্মিন দৃষ্টে পরাগরে–সেই পরে তাঁতেই–আর এই অপরে–আর সবকিছুতে। কথাটা পরাবরেও হয় মতান্তরে–এখানে পর হলো তিনি আর আবর হচ্ছে তাঁর মায়া–এই বিশ্বসৃষ্টির আবরুল। এই উভয়ের মধ্যেই, সর্বত্র, সব ক্ষেত্রে তাঁকে দেখাটাই হচ্ছে সত্যিকারের দেখা। এবং সেই কথাটাই আমাদের সব শাস্ত্রে, সব মহাকাব্যে। এবার যা বলছিলাম… মা আবার তাঁর গোড়ার কথায় আগান; তত্ত্বব্যাখ্যার পর মার দৃষ্টাতের আখ্যান : মহাকবি কালিদাসও তাঁর কাব্য রচনার আদিতে পার্বতী পরমেশ্বরের বন্দনা করেছিলেন…।

জানি। বাবাকে আওড়াতে শুনেছি তো। মার উদাহরণে আমার উদ্ধৃতিযোগ : বাগর্থ যত্র সম্পৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপওয়ে/জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী পরমেশ্বরৌ। বাবার মুখে বার বার শোনা কালিদাসের পদটা আওড়াই–বুঝেছি মা। কালিদাসের-পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলতে হবে আমাকে। কোনোকালে কালিদাস হতে পারি আর নাই পারি।

হ্যাঁ, আর তাহলেই দেখবি কৃত্তিবাসের উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে না তোকে আর। কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ/সপ্ত কাণ্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ। ভাঙিয়ে তোর ওই–শিবরাম পণ্ডিত এক বিচক্ষণ কবি/সাত কাণ্ডে গাহিলেন রামায়ণ সবি। এইসব ভ্যাজাল আমদানি করতে হবে না আর। তুই নিজেই এক কাণ্ড করে বসবি তখন, যদি সেই কল্পতরুর তলায় গিয়ে হাত পাতিস কেবল। ফল পড়বে টুপটাপ, দেখবি। বলেছেন না ঠাকুর-কালী কল্পতরুমূলে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি। বলেননি তিনি?

বলেছেন তো! আচ্ছা ওই চারি ফলটা কী মা? কোনো খাবার জিনিস?

চারি ফল হচ্ছে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ–এই চতুর্বর্গ। জানিসনে?

এর মধ্যে তোমার প্রথম আর শেষটা আমার চাইনে। ধর্মের আমি ধার ধারিনে, আর মোক্ষ? মোক্ষে আমার দারুণ অনীহা।

অনীহা-মানে? মা সচকিতই।

জানি না আমি ঠিক। ভারী ভারী প্রবন্ধে থাকে, দেখা যায়। কী মানে কে জানে, কথাটা বেশ কিন্তু। আমার রচনার খাতায় ফাঁক পেলেই লাগিয়ে দিই যেখানে সেখানে–তোমার সেই পিতাঠাকুরের মতই। বাংলার মাস্টারও বুঝতে পারেন না, হকচকিয়ে যান, তাজ্জব হয়ে থাকেন। আমি জানাই : তবে আমার ধারণা, ওর মানে হয়ত হবে, অনীহ্যাঁ, কিনা, না ইহা–এটা নয়। বাবার ঐ নেতিবাদের মতই কিছু একটা হবে বোধ হয়।

ধর্মই তো আসল জিনিস রে! ধর্ম কি ফ্যানা নাকি? ধর্ম ছাড়া কি একদণ্ডও কেউ বাঁচতে পারে?

ধর্ম-টর্ম আমার ভাল লাগে না। আমি বলি, ধর্মটা কী মা?

কর্মই হচ্ছে ধর্ম। ধর্ম কর্ম বলে না রে? যে-কর্ম তুই ধরে থাকিস আর যে-কর্ম তোকে ধরে রাখে। স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ধর্ম সবার-সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। ভগবানের সঙ্গে আর জীবৎকর্মে যে একান্ত ব্যক্তিগত যোগাযোগ তাই হচ্ছে তোর ধর্ম। তোর যেটা কর্ম তা যদি তুই সবটা মন দিয়ে সুচারুরূপে করতে পারিস তবে সেই করাটাই ধর্ম। ধর, তুই যদি লেখক হোস তো লেখাটাই হবে গিয়ে ধর্ম তোর। কর্মও আবার।

তাই বলে মা! আমি হাঁফ ছাড়ি : বাঁচালে তুমি আমায়।

আর, মোক্ষ হলে গিয়ে, মন দিয়ে লিখতে বসলে যা তোর মনের ভেতর থেকে মুক্তি পাবে… লিখতেই বস বা কি কাউকে ভালোই বাস…তখন তোর অন্তর থেকে যা ক্ষরিত হবে–বিমুক্ত হয়ে আসবে, তাই হচ্ছে গিয়ে তোর মোক্ষ। মোক্ষ কিছু লাভ করার বস্তু নয়–মুহুর্মুহু সেটা ঘটবার। সেই আত্মমোক্ষণে তোর সঙ্গে ভগবানেরও মুক্তিলাভ। ধর্ম হচ্ছে তোর–মাকে ধরে থাকা। আর মোক্ষ হচ্ছে ভগবানের। মা-র। অহরহই সেটা হচ্ছে।

আচ্ছা, আমি যদি চাই তো তোমার ওই কল্পতরু কি গল্পতরু হয়ে ধরা দেবে আমার কাছে? আমি শুধাই, এনতার গল্প পাবো তার কাছ থেকে–চারুদার মতই। কৃত্তিবাসের গাছতলায় গিয়ে কবিতার মিল কুড়োতে হবে না আমায়। মিলটিল সব সেখান থেকেই মিলবে। আমার কীর্তি ফলছে তোমার ওই গাছেই, বলছ তো তুমি?

চেয়েই দ্যাখ না। গাছ মাত্রই তো ফলেন পরিচীয়তে–এমনকি ঐ কল্পতরুও। বেয়ে চেয়ে দ্যাখগে… বাগর্থের মতই পরাবিদ্যা আর অপরাবিদ্যা যেখানে হরিহরাত্ম হয়ে মিলেছে, সেই কালী কল্পতরুর মূলেই পাবি তুই সব।

শিবও তো কল্পতরু মা? বাবা যে আওড়ান-প্রণমামি শিম শিবকল্পতরু…শিবও তো হতে পারে মা…?

শিব দুর্গা কি আলাদা রে? এক দেহেই তো অর্ধনারীশ্বর হরগৌরী হয়েছেন।…দুর্গা স্বয়ং শিবের কাছেও কল্পতরু আবার, তা জানিস? একবার অন্নপূর্ণা হয়ে-

জানি জানি। কিন্তু পরমান্ন আমার চাইনে এখন মা! আমি এখন গল্প পেতে চাই, কবিতা পেতে চাই ঝুড়ি ঝুড়ি।

সব পাবি। কবি তোর নিজেই বলে যাননি কি?–নূতন ছন্দে অন্ধের প্রায় ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়/নূতন বেদনা বেজে ওঠে তায়নুতন রাগিণী ভরে/যে কথা ভাবিনি বলি সেই কথা/যে ব্যথা বুঝিনে জাগে সেই ব্যথা/জানি না এনেছি কাহার বারতা/কারেশোনাবার তরে। ওগো রহস্যময়ি! আমি যে-কথাটি/কইতে চাইছিকিহিতে দিতেছ কই?/পড়িসনি ছেলে-চারুর চয়নিকায়?

— পড়েছি তো। মানে বুঝেছিলাম, কিন্তু মর্ম বুঝিনি তখন।

এই রহস্যময়ীটি কে বল দেখি?

জানিনে বুঝি? মা-ই তো, আবার কে? তোমার মা আমার মা সবার মা।

আমার কথায় হাসতে থাকেন মা-সেই হাসির আড়ালে সর্বময়ীকেই…সবার মার হাসিটি দেখা যায় না কি!

.

২৬.

আমাদের গতিবিধির বৃত্তান্ত শুনবেন তাহলে নিতান্তই? জনাব সাহেবের প্রতি কৃপাকটাক্ষ করে শুরু হয় আমার : কিন্তু শুনলে আপনি হতাশ হবেন, আমি বলছি। কেননা, মানুষের আশা কখনই পুরোপুরি মেটে না–যে গতিবিধি করে তারও যেমন নয়, যে তার ইতিবৃত্ত চায় তারও তেমনটা। তাছাড়া মানুষ স্বভাবতই দ্বিধাগ্রস্ত, জানেন তো? আর এই লেখক-শিল্পী গোত্রের কেবল দ্বিধা নয়, শতধাই বলা যায়। দেহ মন নিয়ে শতদিকে সতত তাঁরা ধাবমানকে তার সন্ধান রাখে, কেই বা কাকে তা দিতে পারে! তাহলেও শুনুন, গোড়াতেই বলে রাখছি কিন্তু…গতিবিধি বলতে যা বোঝায় তা ঠিক হয়ত হবে না। বিধিমত গতি তাকে বোধহয় বলা যায় না কিছুতেই।

উৎকর্ণ ভদ্রলোক বৃথা বাক্যব্যয়ে অযথা বাধা না দিয়ে নিজের মৌন সম্মতিতে উন্মুখর হয়ে আমায় উৎসাহিত করেন।

হেমেনদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ একেবারেই আকস্মিক,আমি আরম্ভ করি: অঘটনের মতই প্রায়। সেকালের নব সংস্কৃতির নানামুখী ভাগীরথী ধারার যাঁরা ভগীরথ-ধারক বাহক ছিলেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আমাদের এই হেমেন্দ্রকুমার রায়। অবশ্য ভাগীরথীর ন্যায় সংস্কৃতির ধারা সব সময়ই বহতা, সেকাল একাল বলে তার কিছু নেই–কখনো তার মোড় ফেরা, কখনো বা তার মুখ ফেরানো।

সে যুগের এক চমকদার লেখক ছিলেন হেমেন রায়। যেমন তাঁর গল্প, তেমনি তাঁর কবিতা, তেমনি আবার ব্যঙ্গ কবিতাও–সেই সঙ্গে কিশোর সাহিত্যও আবার। কিশোর সাহিত্যে তো তাঁর জোড়া মেলে না–তাঁর বন্ধু মণিলাল গাঙ্গুলীকে বাদ দিলে। যথার্থ বলতে দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথার রাজ্যে কিশোর কাহিনীর আমদানি তাঁরই একান্ত কীর্তি। সে-পথে আমরা অনুগামী তাঁরই।

আর মানুষ হিসেবে তুলনাই হয় না তাঁর। লেখকদের মধ্যে এমন সহৃদয় আমি খুব কমই দেখেছি, অবশ্যি কটা লেখকই বা দেখেছি আমি আর?

ফুটবল ম্যাচ দেখে মাঠের ফেরতা কল্লোল-এর কয়েকজন আমরা প্রায়ই চাংওয়ায় খেতে যেতাম। চাঁদা করে খাওয়া হোত। প্রত্যেকের ভাগে এক টাকা। অবশ্যি, বিলের টাকা মেটাবার সময় সবার ভাগেরটা প্রেমেনই দিয়ে দিত বেশিরভাগ।

খাবারদাবার দারুণ সস্তা ছিল তখন চাংওয়ায়। এক টাকায় ঢাউস এক প্লেট কুঁচো চিংড়ি, মাংসের কুঁচি দেওয়া ফ্রায়েড রাইস দিত, যা তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট। আর এক টাকায় গোটা ছয়েক প্রন কাটলেট মিলত, তার স্বাদের তুলনা হয় না। আর এক টাকায় যে কী নেওয়া হত তা এখন মনে পড়ে না। চপটপ কি কারিটারি কিছু হবে বোধহয়।

এছাড়া এক পেগ করে ছিল আবার আরো প্রত্যেকের। ওটা নাকি অবশ্য গ্রাহ।

প্রেমেন বলেছিল এক টাকায় এত এত খাবার দিয়ে ওদের কী লাভ থাকে ভাই! যা কিছু মুনাফা এই মদ বেচেই। এ না নিলে এখানে পাত্তাই মিলবে না একদম।

নিতেই হত বাধ্য হয়ে। তবে একথাও আমি বলতে বাধ্য,বস্তুটির মতন অখাদ্য আর হয় না। প্রথম চুমুকেই আমার গাল গলা এমন জ্বলে গেছল যে জীবনে আমি আর তার দ্বিতীয় চুমুকে যাইনি।

আমার বিবেচনায় নেশা যদি করতেই হয় তো রাবড়ির। চুমুকে চুমুকে খাওয়া যায় আর প্রতি চুমুকেই চমৎকার।

আর বিশ্বসংসার ভুলবার জন্যেই যদি নেশা, তাহলে বলা যায়। ঐ চুমুকেই।

এক চুমুকেই তামাম দুনিয়া দুলিয়ে দেয়, ভুলিয়ে দেয়, রঙীন করে দেয় ঐ চুমুই। যা কোনো লালপানিতে কখনো পারে না।

ব্যক্তিই কি আর কস্তুই কি, প্রথম পরিচয়টা যুতসই না হলে সম্পর্কটা তেমন মজবুতসই হয় না। প্রাথমিক মদালাপটা ঐ রকমটা না হওয়ার দরুণই হয়ত পরে আমার অনেকবার পান করার সুযোগ এলেও, এমন কি শখ গেলেও, শখটা আর জমল না তেমন।

সিগ্রেটের বেলাও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল আমার।

সেকালে রামরাম, হাওয়াগাড়ি এইসব অদ্ভুত নামের সস্তার সিগ্রেট মিলত–দু-চার পয়সা দামের প্যাকেটে। স্কুলের এক বন্ধুর পাল্লায় একবার তার এক টান না টেনেই চোমুখ কপালে উঠে, দম আটকে কাশতে কাশতে মারা যাই আর কি। তারপর এ পর্যন্ত নামী দামী উপাদেয় কতো রকমের সিগ্রেটই না বেরিয়েছে বাজারে, শুনতে পাই, বিজ্ঞাপনেও নজরে পড়ে বইকি, কিন্তু কোনো সিগ্রেটকেই আর কখনো এমুখো হতে দিইনি।

সেদিনই ধরা পড়ে গেছলাম মার কাছে।

ইস্কুলে যাবার সময় মা যেমন আদর করে ছাড়তেন আমাদের, ইস্কুল থেকে ফিরলেও তেমনিই আদর করতেন আবার।

ধরা পড়ে গেলাম সেই মুহূর্তেই-সিগ্রেট খেয়েছিস বুঝি?

হ্যাঁ মা।

আর খাসনে কখনো।

আর, ধরা পড়েছিলাম রিনির কাছেও-সিগ্রেট টানা হয়েছে বাবুর আজ?

কী করে ধরলি? হাত গুণে নাকি?

ধরতে পারি আমরা। ফের যদি তুমি সিগ্রেট খাও তাহলে আর কক্ষনো আমার খেয়ো না। আমিও আর…

আর বলতে হবে না তোকে। ও জিনিস খায় মানুষ! ছ্যা!

তবুও সে তারপরও আরো বলেছিল–সিগ্রেট খেলে আর কোনো মেয়ে তোমায় চুমু খাবে না, এক তোমার বউ ছাড়া। তাহলে তাকেও সিগ্রেট ধরাতে হবে–মনে রেখো।

আমি মনে রেখেছিলাম।

সেই চাংওয়াতেই হেমেনদার দর্শন পেয়েছিলাম প্রথম।

চাংওয়ার দুধারে দুসারি কেবিনের মাঝখানটায় টেবিল পাতা থাকত তখন। কেবিনের বাইরে তারই একটা টেবিল বেছে নিয়ে আমরা বসতাম।

সেখানে বসেই একদিন একটা কেবিনের ভেতর হেমেনদাকে দেখেছিলাম। কেবিনের পর্দা সরিয়ে বেয়ারা খাবার দিতে যাবার সময়ে নজরে পড়ল।

কে একজন চিনিয়ে দিল আমাদের মধ্যে–ঐ যে! হেমেনদা খাচ্ছেন ঐ কেবিনে।

সঙ্গে দারুণ সুন্দর দুটি মেয়ে ভাই! দেখেছ? আমি উচ্ছ্বসিত হয়েছি।

ওঁরই মেয়ে তো!

সে কি! উনি মেয়েদের নিয়ে এখানে এসে এমনি করে পানভোজন করছেন?

দোষ কি তাতে? বাড়িতে বসে মেয়েদের সামনে খেতে যদি কোনো বাধা না থাকে তাহলে…তাছাড়া, উনি একলা এসে এখানে ভালোমন্দ কতো কী খাবেন, আর ওঁর মেয়েরা তা খেতে পাবে না, ওঁর মতন মেহকাতর পিতার মনে সেটা লাগে। সেকথা উনি ভাবতেই পারেন না।

ভেবে দেখলাম, কথাটা ঠিক। ভালোবাসা সহজেই সব সংস্কারমুক্ত করে, কোনোখানেই গণ্ডী রাখতে দেয় না। আমাদের খণ্ডিত দর্শনে তাকে যতই না জটিল-কুটিলরূপে দেখতে যাই, তার মতন সহজ কিছু আর হয় না।

শুধু নিজের মেয়েকেই নয়, পরকেও উনি খাওয়াতে ভালোবাসেন খুব। এমনি করে আমাদেরও ধরে নিয়ে এসে খাইয়েছেন কতদিন এখানে। প্রেমেনই বলেছিল বুঝি।

তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার পর আমিও সেই অভিজ্ঞতার ভুক্তভোগী।

ঘনিষ্ঠতা ঘটেওছিল ভারি অদ্ভুত ভাবেই।

শিশিরকুমারের নাট্যমঞ্চে শরৎচন্দ্রের ষোড়শী নিয়েই এই অঘটন। শরৎবাবুর দেনাপাওনা উপন্যাসের নাট্যরূপ ঐ ষোড়শী।

অবশ্য ষোড়শী নিয়ে মারামারি এই প্রথম নয় এবং আজকেরও না–ট্রয় নগরী স্ট্রেয়ের মূলেও ছিল এই ষোড়শীই, এমনকি তারও আগে সুন্দ-উপসুন্দর আমল থেকেই চলে আসছে এই কাণ্ড।

তবে এবারকার লড়াইটা ছিল কাগজে কাগজেই।

আমার সেই তরুণ বয়সে ইবসেনের নাটক পড়ে বিষয়বস্তুতে তো বটেই, আরো বেশি করে তার রচনার টেকনিকে আমি অভিভূত হয়েছিলাম।

আমাদের দেশে সেকালে থিয়েটারের পালা পাঁচ অঙ্কে অসংখ্য গর্ভাঙ্কে বহু পাত্রপাত্রী এবং সুদীর্ঘ দেশকালে বিস্তৃত বেশ এক গন্ধমাদনী কাণ্ডই ছিল। সেখানে অল্প সময়কালে ঘনবিন্যস্ত ইবসেনের নাটকগুলি স্বভাবতই চমকিত করেছিল আমায়।

বাংলায় কি এমনটা করা যায় না?

আমার মাথায় তখনও মৌলিক নাট্য রচনার কোনো প্লট দানা বাঁধেনি। শরৎচন্দ্রের দেনাপাওনা সে সময় সবে ভারতবর্ষে বেরিয়েছে। আমার মনে হল ওই উপন্যাসটিকে নিয়ে এ ধরনের নাট্যরূপের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় বোধ করি।

শরৎচন্দ্রের প্রায় সব লেখাতেই বেশ নাটকীয়তা রয়েছে দেখা যায়। এককালে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ বাংলা রঙ্গমঞ্চে চলেছিল খুব। কিন্তু তারপরে একালে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস নিয়ে, সে-সবের অন্তর্গত অত নাটকত্ব সত্ত্বেও, কেন যে তেমনটা হয়নি আমি ভেবে পাইনি।

যাই হোক, ইবসনি কায়দায় সেই বিস্তৃত বইকে চার অঙ্কের-প্রত্যেক অঙ্ক একটিমাত্র দৃশ্যে সম্পূর্ণ নাট্যাকারে ঘনসম্বন্ধরূপে দাঁড় করানো গেল। সেই নাট্যরূপ নিয়ে আমি শিশিরবাবুর কাছে গেলাম, তিনি তখন ঘোষ লেনের বাড়িতে থাকতেন।

কিন্তু কেন জানি না ওটা তাঁর মনে ধরল না।

তখন আমি নাটকটি নিয়ে ভারতী সম্পাদিকা সরলাদেবীকে দিলাম। জগৎ ভট্টাচার্য তখন পত্রিকাটার কার্যনির্বাহক ছিলেন। সম্পাদনা কার্যও করতেন তিনি।

ভারতীর পূজাসংখ্যায়, সেইটাই তার নবপৰ্য্যায়ের শেষ সংখ্যা আবার, বেরিয়ে গেল রচনাটা।

বেরল কিন্তু শরৎবাবুর নামেই। নাট্যরূপান্তর সাধনের জন্য তার কোথাও আমার নামগন্ধ কিছুই ছিল না। সেটা যে ব্যবসায়িক কারণেই তা বোঝা তেমন কষ্টকর হয়নি। তাছাড়া, সেই জগতের নিয়ম–ব্যবসায়ী জগতের ধারাই তাই। এইরকমটাই ধারণা হয়েছিল আমার আমার বন্ধু জগৎ ভট্টাচার্যের ওপর কোনো কটাক্ষ করছিনে।

যাই হোক, ওই প্রকাশের ফলে সাড়া পড়ে গেল থিয়েটার পাড়ায়। স্টার থিয়েটারের প্রবোধ গুহ মশাই ওটা তাঁর পাদপিঠে মঞ্চস্থ করতে চাইলেন। এবং তারপরও টনক নড়ল শিশিরবাবুর।

প্রবোধবাবুর আগেভাগেই তিনি পানিত্রাসে গিয়ে শরৎবাবুর কাছ থেকে নাটকের অভিনয় স্বত্ব নিয়ে এলেন।

মহাসমারোহে অভিনীত হয়েছিল বইটা। দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত সাফল্যে চলেছিল সে পালাটা।

অবশ্যি ভারতীর ষোড়শী আর অভিনীত ষোড়শীতে কিছুটা পার্থক্য ছিলই। ভারতীতে প্রকাশিত নাট্যরূপের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অঙ্ক অবিকল রেখে তার প্রথম এবং চতুর্থ অঙ্ক দুটি একাধিক দৃশ্যে ভাগ করে একটু পরিবর্তন সাধিত করা হয়েছিল। আমি যেকালে উপন্যাসের মতই নাটকটিকে বিয়োগান্ত রেখে খোদার ওপর কোনো খোদকারি করতে যাইনি, শিশিরবাবু সেখানে তাঁর রঙ্গলৌকিক প্রয়োগ নৈপুণ্যে কিংবা তৎকালের দর্শকদের মুখ চেয়েই হবে হয়তো বা, কিংবা ব্যবসায়িক সাফল্যের কথাটা ভেবেই বোধহয় মিলনান্তক মাধুর্য দিয়ে নাটকটা সমাপ্ত করেছিলেন।

যাই হোক, তার জন্য আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না, নাট্যরূপের জন্য আমার নাম না থাকলেও নয় তেমনটা কিন্তু উক্ত প্রয়াসে আমার অংশ হেতু, কৃতিত্ব গৌরবের কিছুটা না হোক, আংশিক অর্থ প্রাপ্তির কিঞ্চিৎ প্রত্যাশা স্বভাবতই ছিল আমার।

একজন সংগ্রামী নবীন লেখকের পক্ষে–যদিও এখনকার ব্যাপকতর ভূমিকায় মহত্তর অর্থের সংগ্রামী নয়–নিছক নিজের তুচ্ছ জীবনধারণের জন্যই যার জীবনসংগ্রাম–তার কাছে নাম বা টাকা কোনটাই নেহাত ফ্যালনা নয়।

কিন্তু এই ব্যাপারে নাম তো হলই না, আর টাকাও যা পেলাম তা নামমাত্রই-শত খানেকের বেশি নয় কোনমতেই।

সত্যিই এই ব্যাপারটা আমার কাছে ভারী মর্মান্তিক ঠেকেছিল তখন।

এবং স্বভাবতই শরৎচন্দ্র আর শিশিরকুমারের প্রতি আমার রাগ হয়েছিল দারুণ।

আর আমার সেই রাগের ঝাল সেকালের পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠায় ঝাড়তেও আমি কিছু কসুর করিনি। যথাসাধ্য সাহিত্যিক ভাষায় কষে গাল দিয়েছি তাঁদের।

আমার সেই ঝাল ঝাল লেখাগুলি-অচল টাকা ইত্যাদি–নবশক্তি, নাচঘর এবং আরো কী কী কাগজে যেন বেরিয়েছিল।

আর রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কিত বিখ্যাত সাপ্তাহিক ঐ নাচঘরের সম্পাদক ছিলেন আমাদের হেমেন্দ্রকুমার রায়। শরৎচন্দ্র ও শিশিরকুমারের, বিশেষ করে শিশিরবাবুর অন্তরঙ্গ হলেও হেমেন্দ্রকুমার তাঁর বন্ধুদের আঘাত-করা আমার লেখাগুলি তাঁর পত্রিকায় স্থান দিতে কোন দ্বিধা করেননি, এমন কি, কোথাও কোথাও হয়ত আমার পক্ষ সমর্থন করে থাকবেন। তাঁর নাচঘরে আমার একটি নাটকও (চাকার নীচে) ধারাবাহিক বেরিয়েছিল তারপর (আমার প্রথম মৌলিক নাটক যখন তারা কথা বলবে বেরয় নবশক্তিতে।) তাঁর সপ্রশংস ভূমিকা নিয়েই।

এমনি অসাধারণ সহৃদয় সাহিত্যিক ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার।

অবশ্যি আমার তখনকার সেই মর্মদাহ বেশিদিন থাকেনি। সে বয়সে সবাই স্বভাবতই সব কিছু ক্ষমা করতে পারে, সহজেই ভুলে যায় সব।

তার পরে যখন আমার প্রবন্ধের বই বেরিয়েছে, মস্কো বনাম পন্ডিচেরি আর ফানুস ফাটাই, তার কোনটাতেই ঐ অচল টাকা বা ঐ জাতীয় লেখাগুলি আমি বার করিনি, ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি। এবং আমার জীবনের ঐ পর্ব নিয়ে সমস্ত আলোচনা আর বাদ-বিসংবাদ সযত্নে এড়িয়ে গেছি।

(তবে এর পরে যদি কখনো আমার এতাবৎ যাবতীয় গদ্য রচনা নিয়ে কোনো প্রবন্ধসমগ্র বেরয় তাহলে ঐ লেখাগুলি এবং ঐ কালের আরো কিছু কিছু রচনা সে বইয়ের অন্তর্গত করার বাসনা আমার আছে। বিদ্যাসাগর-জীবনীকার ইন্দ্ৰমিত্ৰমশাই অনুগ্রহ করে তৎকালীন পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে সেগুলি আমায় সংগ্রহ করে দেবেন বলেছেন।)।

বলতে গেলে, আমার ভাগ্যে পর্বতের সেই মূষিক প্রসবে আমার কোনো দুঃখ নেই এখন আর। এবং দুঃখিত নই অনেকদিন থেকেই। আমার জীবনের সেই বিষাদ পর্বকে জীবনের স্বাদ-বয়ে-আনা একটা পার্বণ বলেই মেনে নিয়েছিলাম আমি। তখন তখনই। মনে হয়েছিল আমার যে, ইহাই নিয়ম। পৃথিবীর চেহারাই এই। দুনিয়ার হালচাল এই ধারার। এ নিয়ে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। আর সেই দুঃখ মনের মধ্যে পুষে রাখার মতন অপুষ্টিকর কিছু আর হয় না।

ষোড়শীর সূত্রে টাকা আর স্বীকৃতি পেলে তার সাফল্যে আমি নাট্যজগতের বিপথেই চলে যেতাম হয়ত-রঙ্গমঞ্চের চোরাগলিতেই ঘুরে মরতাম এতদিন। সেই পোষ মা আমার সর্বনাশ ডেকে আনত। তার বদলে যে ধারাবাহিক উপোস মাসগুলি আমায় কাটাতে হয়েছিল, হয়ত তার হেতুই আমার জীবনের সত্যিকার পথ আমি খুঁজে পেয়েছি। তার জন্যই আমি ধন্য। আমি কৃতার্থ।

সেই জন্যেই শিশিরকুমার এবং শরৎচন্দ্রের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি আজ। তাঁদের শাপ আমার বরাতে বর হয়ে এসেছে।

নাট্য রচনা অবশ্যই কোনো সাহিত্যিক বিপথ নয়–কিন্তু আমার পক্ষে তা ঠিক স্বধর্ম হত না, পরধর্মের মত বোধ হয়, ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াত শেষটায়। তা না হয়ে ঐ বিতর্কের সুযোগে হেমেন্দ্রকুমারের সান্নিধ্যে এসে সুধীরকুমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটে মৌচাকের সৌজন্যে কিশোর সাহিত্য রচনার যে রাজপথ দেখা দিল সেই পথেই যেন আমি আমার আমাকে সম্পূর্ণ করে পেলাম, সম্পূর্ণভাবে দিতে পারলাম সবাইকে।

প্রবীণ মানুষদের প্রাজ্ঞ মুখোশের রাজ্য থেকে নির্বাসন লাভ করে তরতাজা কিশোর কিশোরীদের একান্ত আপনার হয়ে তাদের অনন্ত মাধুরী অফুরন্ত মধুর সাম্রাজ্যে আসবার সুযোগ পেলাম আমি।

নাকের বদলে নরুণ নিয়ে নাকাল না হয়ে আমার সম্মুখে এল যত কচি কচি হাসি হাসি মুখ।

বিতর্কিত ষোড়শী নিয়ে কোনো দুঃখই থাকে না আর মনে, নতুন নতুন ষোড়শীরা এসে দেখা দেয় জীবনে। দূরকে করিলে নিকট বন্ধু পরকে করিলে ভাই কবির সেই স্বপ্নটাই সত্য হয়ে ওঠে, সব ঠাঁই নিজের ঘর খুঁজে পাই বুঝি। নিত্যকালের কিশোর-কিশোরীদের চিত্তলোকেই।

.

২৭.

নিত্যকালের চিত্তলোকে। তিনি প্রতিধ্বনিত হন : কথাটা বলেছেন বেশ।

বেশ বলা নয়, বেশি বলা। বাড়িয়ে বলা। আমি বলি : ভালো শোনায়–বলা তাই। মিথ্যে কথামাত্রই তো মিষ্টি শোনায়। শোনায় না? যেমন আপনার ভালোবাসার কথা যত! উদাহরণ স্বরূপ দিয়ে আমার কথাটা যথাযথ করি।

মিথ্যে কথা?

মিথ্যে নয়তো কী? মিথ্যে বলতে আপত্তি থাকে, বলুন অতিরঞ্জিত। আসলে সত্যি নয়। আসল সত্য হচ্ছে নিত্যকালের চিত্তলোকে কারোই কখনো ঠাই হয় না। চিরকালের স্বামীত্ব নেই কারোরই, সবাই ক্ষণকালের আসামী। বর্তমানের বাইরে বলতে গেলে, কারোই কোনো অস্তিত্ব নেই।

অস্তিত্বই নেই? কারোই না?

কোথায় আর! কবিগুরুকেও দুঃখ করতে হয়েছে জানেন না? ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট সে তরী/শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি। মহাকাল কাউকে তাঁর সাথী করেন না। বর্তমানের চাকায় ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা সবাই।

কী বলছেন!

খাঁটি কথা বলে গেছেন ঐ ওমর খৈয়াম। নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও, বাকীর খাতায় শূন্য থাক। এর চেয়ে সত্য কথা আর হয় না।

নিত্যকালের চিত্তলোকে কারোই ঠাঁই হয় না? আপনি বলেন কী মশাই?

কই আর হয়! মহাকালই তো কান্ডারী? তিনি যদি ঠাই না দেন, কী করে হবে? ভগবান চিরকালই হাল ধরে থাকেন–মা বলতেন কথাটা। কথার মধ্যে আবার আরেকটা করে মানে থাকে, বলতেন মা। সেই মানেটা সমঝে নিতে হয়। হাল মানে আবার বর্তমান। ভগবান হাল ধরে আছেন সবার, সব কিছুর, অর্থাৎ সর্বদাই তিনি সবার বর্তমানে আবর্তন কমছেন–নিরন্তর পরিবর্তন আর সমাবর্তনে। তিনিই হচ্ছেন, হওয়াচ্ছেন। এই তাঁর হালচাল। তাঁর অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই। আমাদেরও তাই।

হুম্। তাঁর হুঙ্কার শোনা যায়।

পুনশ্চ অনুযোগ করতে হয় আমায় : এইভাবেই আমরা সবাই বর্তাচ্ছি–অফুরও বর্তমানে। তিনিও বর্তে গেছেন, আমরাও বেঁচে বর্তে রয়েছি–অনন্ত কাল ধরে-পরস্পরের দৌলতে।

ভগবানের ওপর ভবিষ্যতেরও কোনো ভরসা রাখব না? সে কী কথা?

এইমাত্র ভরসা রাখতে পারি যে, ভবিষ্যতেও তিনি বর্তমান থাকবেন। যেমন থাকব আমরাও। নিরবধি বর্তমানে তিনি আবর্তিত। নিয়তই তিনি হচ্ছেন, আমরাও হচ্ছি–এই আমাদের নিয়তি।

তত্ত্বকথা থাক, তথ্যকথায় আসুন। তিনি আসলে আসেন-তাহলেও ষোড়শীরা সব এসেছিল তো আপনার জীবনে? এখন সেটা অতীত কথা হলেও তখন সেটা নগদ লভ্যই হয়েছিল। সেটাও কিছু কম লাভ নয় মশাই! বলে তিনি একটুখানি দম নেন-লাভ কথাটারও আরেকটা মানে আছে আবার। ইংরেজি মানে যদিও।

কোন্ দুঃখে আসতে যাবে তারা? আমি প্ৰকাশ করি–ষোড়শীরা সব শরৎচন্দ্রের এলাকায়। তখনকার ষোড়শীরা অন্তত। সবাই তাঁরা পরিণীতা দেবদাসের মুল্লুকেই তখন। আমার পাঠক পাঠিকারা সব একাদশ থেকে চতুর্দশের মধ্যে। যতই চতুর দশায় থাকি মশাই, আমার বরাতে চিরকাল সেই একাদশী। এবং আমার ভাগ্যে তারা প্রথম এলেও জীবনের প্রথম ভাগের পাঠ নিয়েই না একটু বড় হলেই তারা বড় বড় লিখিয়েদের আওতায় চলে যায়। যেমন এখনও, তেমনি তখনও।

যথা? যেমন?তিনি দৃষ্টান্ত দর্শনে উদগ্রীব।

কেউ তাদের প্রে-মেনে গিয়ে পড়ত, কেউ বা প্ৰবোধ লাভ করত। আমি কই কেউ আবার অচিন্তনীয় কোনো কিছুর সন্ধানেই থাকত হয়ত। কেউ বা ফের বুদ্ধবিহারে গিয়ে রজনীদের উতলা করে তুলত কখন!

এমন কি এখনো হতে পারে নাকি! তিনি বিশ্বাস করতে চান না।–পথ ভুলেও কেউ কেউ কোথাও এসে ফের মরে নাকি? এমন কথাও কি বলে যাননি কবি?

আমার ভাগ্যই সেটা বলতে হবে। সত্যি বলতে, আমার বোনের বাইরে কোনো ষোড়শী সপ্তদশীর মুলাকাত আমি পাইনি। পেলেও সেভাবে পাইনি। বোন হয়ে বন্ধু হয়েই এসেছে তারা আমার জীবনে। অন্যরূপে বন্যরূপে দেখা দেয়নি কখনো। সেজন্য ভাগ্যকে আমার ধন্যবাদ। কেননা, ষোড়শীরা চিরকালই কিছু ষোড়শী থাকেন না, অনিবার্যভাবেই সাঁড়াশী হয়ে দেখা দেন একদিন। নাক নিয়ে টানাটানিতে নাকাল হতে হয় তখন। নারীর হ্লাদিনী রূপটিই ভালো, চিত্তচমৎকারী। আহ্লাদিনীরূপে এলে, তাঁকে নিয়ে বেশি আহ্লাদ করতে গেলে, তিনি জহুদিনী হয়ে ওঠেন শেষটায়।

নারী কি তাঁর হ্লাদিনীরূপে থাকতে পারেন না চিরকাল?

সে রূপ তাঁর সেই কিশোরী বয়সেই। এই কারণেই তো বৈষ্ণব কবির ঐ কথা কিশোরী-ভজন, কিশোরী-পূজনা, কিশোরী গলার মালা! গোপবালারা একটু বয়সে গড়াতেই কেষ্টঠাকুর তাঁর সাধের বৃন্দাবন ছেড়ে পালালেন কেন তাহলে?

আজব কথা কইলেন আপনি!

এসব কথা থাক। যে কথা হচ্ছিল আমাদের…হেমেনদার কথা। এমনি আশ্চর্য লোক ছিলেন আমাদের হেমেনদা। ঘনিষ্ঠতা ঘার পর আমাকেও কতদিন তার পানভোজনের সাথী হতে হয়েছে। একদিন দেখি কি, তিনি কাজী, প্রেমেন, নৃপেনকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সি করে আমার আস্তানায় এসে হাজির। শুনলাম নানান জায়গা থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে এনেছেন তাদের–আমাকেও সহযাত্রী হতে হবে। সবাইকে ধরে বেঁধে নিয়ে চললেন তিনি চাংওয়ায়।

এক নম্বরের বোহেমিয়ান ছিলেন আমাদের হেমেনদা। বইটই লিখে যা তিনি উপায় করতেন, এমনি করে খেয়ে খাইয়ে উড়িয়ে দিতেন সবটাই। পাথুরেঘাটায় পৈতৃক বাড়িতে তাঁর সঙ্গে প্রথমালাপের পর ইদানীং তিনি বাগবাজার ঘাটের কাছে গঙ্গার কিনারের ওপর ভাস্কর্য এবং শিল্পকলার বিরল সগ্রহে সজ্জিত মিনারের মতন যে বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেখানেও গেছি আমি বহুবার।, তার চারতলার ঢাকা বারান্দার কোণে এক টুকরো জায়গায় ছোট্ট একটা টেবিলের ধারে বসে তিনি লিখতেন-অভ্যাগতরাও বসত গিয়ে সেখানে। বাড়িটিই তাঁর ছবির মত ছিল কেবল, সেখান থেকে বিবেকানন্দ সেতু পর্যন্ত বিস্তৃত উদার গঙ্গার দৃশ্যও দেখা যেত যেন ছবির মতই।

চাংওয়ায় গিয়ে আমাদের নিয়ে মশগুল হয়ে উঠলেন তিনি। পানাহারে সবাইকে পরিতৃপ্ত করে এমন আনন্দ পেতেন হেমেনদা! তার ওপরে সেদিন কাজী সঙ্গী আবার! কাজী যেখানে আনন্দ সেখানে–জীবন যেন তরল পানীয়ের মতই শত ধারায় উচ্ছল-উচ্ছ্বসিত।

ফুর্তির চোটে সেদিন ভারী মজার এক কাত করেছিলেন হেমেনদা।

স্নেহের আবেগে প্রেমেনকে জাপটে ধরে, পাশেই বসেছিল সে, খপ করে এক চুমু খেয়ে বসলেন হঠাৎ।

চাবুকের মতই সপাৎ করে পড়ল সেটা প্রেমেনের গালে।

চাংওয়ার চিকেন কাটলেটও যেন বেগুনি হয়ে উঠলো ওর মুখে।

ব্যাপারটা কিছুই না এমন, বাল্মিকীর সম্মুখীন ব্যাধের সেই ক্রৌঞ্চ নিধনের মতই প্রায়, কিন্তু এমন ঝটিকার বেগে সংঘটিত হল যে, সেই মা-নিষাদের মত দু পঙক্তির পজঝটিকা ছন্দে গজিয়ে উঠল আমার মনে।

গল্প না/বৎস, না/কল্পনা/চিত্র।
হেমেন্দ্র/চুম্বিত/প্রেমেন্দ্র মিত্র।

ভাব, ছন্দ আর যতিঃপতনে নিখুঁত নিটোল এমন দুটি লাইন আর কখনো আমার জীবনে আমদানি হয়নি। প্রেরনায় কী না হয়, বোঝা যায় এইতেই!

পরে যখন প্রেমেনের কাছে পয়ারটাকে পড়েছিলাম, মোটেই সে ভালো মনে নেয়নি। এমন ক্ষেপে গেছল আমার ওপরে যে… তার প্রতি আমার এটা অযথা এবং অতিশয় মন্দ আক্রমণ বলেই সে মনে করেছিল তখন।

কিন্তু আমি কী করতে পারি? ছড়াটা না পালটে আমি ছন্দটাকেই পালটে দিলাম তার পর। বললাম, এটা তাহলে পজঝটিকা হবে না ভাই, মন্দাক্রান্তাই বোধ হচ্ছে। যাই হোক, এটা ওই মা-নিষাদের সমগোত্রই–যতই বিষাদের (নাকি, বিস্বাদের?) হোক না।

(অবশ্যি, মন্দাক্রান্তা বা পজঝটিকা যে কী ছন্দ, কেমন চীজ তা আজও আমার জানা নেই সঠিক!)

আহারাদি সাঙ্গ হবার পর হেমেনদা পাড়লেন, চলো এখন এক জায়গায় গিয়ে গানটান শোনা যাক একটু।

প্রেমেন আমাদের সঙ্গ নিল না। কাটল সেখান থেকেই।

হেমেনদা, নজরুল, নৃপেন আর আমি চারজন চললাম ট্যাক্সি নিয়ে।

হ্যারিসন রোডের কাছাকাছি আসইে প্রায় একটা অ্যাকসিডেন্ট বাধে আর কি! কাজীও চেঁচিয়ে উঠেছে-রোকো রোকো! ট্যাসিটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে তক্ষুনি। ড্রাইভারটা ছিল বেশ হুঁশিয়ার।

কিন্তু তারপর আর ছাড়েই না গাড়িটা!

-এই, রোকা কাহে?

–আপ খাড়া করনে বোলা না?

–তুমকো নেহি, ঘোড়াকো।

এক ঘোড়ার এক্কা–একটা ফিটন গাড়ীও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়!

আমাদের চারজনকে নিয়ে চললো ট্যাসি চিত্তরঞ্জন সরণি ধরে সেই চিত্তরঞ্জনী সদনে।

বীডন স্ট্রীট পেরিয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের পাশ কাটিয়ে কোথায় যেন জায়গাটা, মনে পড়ে না ঠিক এখন।

মেয়েটি খুব খাতির করেই অভ্যর্থনা করেছিল হেমেনদাকে, মনে আছে।

সেখানে গিয়ে নৃপেন একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গড়িয়ে পড়ল আরামে।

সৌম্য চেহারায় নৃপেন আর আলুথালু চুলের বাবরি আর কবি কবি ভাব নিয়ে সহজেই সবার চোখ টানতে পারত।

তার উদাস উদাস চাউনি দিয়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাকে বেশ সচেষ্ট দেখা গেল সেখানে।

প্রেমালু চোখে সে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তাকাচ্ছিলাম আমিও…চোখ টানবার মতই মেয়েটা! কিন্তু আমাদের কারো তাকের ওপর দৃষ্টি ছিল না তার। তার যতো খাতির-যত্ন দেখলাম আমাদের হেমেনদাকেই!

আর, তার নজর ছিল ঐ নজরুলের ওপর।

আশ্চর্য কিছু না। তার চমৎকার চেহারা, যেমন পৌরুষব্যঞ্জক তেমনি মোহময়, ভরাট মিষ্টি গলা, প্রাণখোলা হাসি, আয়ত চোখের চাহনি আর কথায় কথায় রসিকতা ছেলেদেরই মজিয়ে দিত, মেয়েদের নজরানা যে সহজেই টানবে সে আর এমন বেশি কি।

মেয়েটি গানও গায়ে বেশ। হেমেনদার অনুরোধে সে কয়েকখানা গাইল। কাজীও গাইল তার নিজের গান, প্রাণমাতানো গজল সুরের কয়েকটা।

-কাজীদা, আপনার গান শেখাবেন আমায়? মেয়েটি অনুরোধ করেছিল কাজীকে।

কাজী সঙ্গে সঙ্গে রাজী। যেমন প্রাণচঞ্চল, তেমনি গান-পাগলা-এ বিষয়ে একবারের বেশি দু বার বলতে হয় না তাকে।

কল্লোলের আসরে যেমন তাকে গজল গানে মেতে থাকতে দেখেছি, তেমনি নিজের গানের টানে বাড়িঘর বিশ্বসংসার সব ভুলে কোথায় না ভেসে গেছে সে!

এই কলকাতায়, এই হুগলিতে, এই ঢাকায়-বাড়ির বা বন্ধুদের কাউকে কোনো খবর না– দিয়েই–এমনি আত্মভোলা জগৎভোলানো মানুষ ছিল নজরুল।

খানিকক্ষণ গানবাজনার পর আমরা উঠে পড়লাম সবাই, কাজী কিন্তু নড়ল না সেখান থেকে।

গান শিখতে চেয়েছে যে। শিখিয়ে যাবো। বলে বসে থাকল।

চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে আনতে পারতাম। হেমেনদা বললেন বাইরে এসে–কিন্তু ভেবে দেখলাম, সেটা ঠিক হবে না। মুসলমান বাচ্চা, যখন চেয়েছে, তখন উচিত মতন শিক্ষা না দিয়ে উঠবে না।

আপনার কি মনে হয় যে কাজী…? তাঁর ইঙ্গিতটা অনুক্তই রাখেন ভদ্রলোক।

না না না, আদৌ না। জনাবের কথার জবাবে আমি কই–সে ধরনের কিছু মনেই হয় না আমার। কি রকম সঙ্গীতমত্ত মানুষ ছিল সে জানেন তো! কাজীর ব্যক্তিত্ব শতধা বিকীর্ণ, সহস্ররূপে বিচ্ছুরিত, অজস্র ধারায় উচ্ছল। যেমন তার শিল্পীসত্তা, বিপ্লবীসত্তা, সাধকসত্তা, তেমনি তার প্রেমিক-সত্তা, আর সব ছাপিয়ে ছিল তার পুরুষসত্তা। সবগুলোই সমান সত্য। তার কোনো ব্যাক্তিরূপকে বাদ দিয়েই কাজী নয়, সব মিলিয়ে মিশিয়েই নজরুল। আমার তো মনে হয়, বাংলার মাটিতে শ্রীচৈতন্যদেবের পর সুভাষচন্দ্র আর নজরুল এক আবির্ভাব। মানুষের গড্ডলিকা প্রবাহে এক ফেনোমেনা। এঁরা সারা বাংলাকে মাতিয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়া …

তা ছাড়া?

তা ছাড়া-আমি আরো ছাড়াই : তেজস্বীদের দোষ হয় না কিছুতেই। তেজীয়সাং ন দোষায়–মহাভারতের কথা। আগুনকে কোনো মালিন্য স্পর্শ করতে পারে না। বহতা নদী সব কিছুই ধুয়েমুছে নিয়ে যায়। আর কাজী তো কেবল প্রবাহিনী নয়, প্রবল বন্যাই।

আমার কথাগুলো হজম করবার পর হাঁফ ছাড়লেন তিনি আপনাদের দৌড় অ্যাঙ্গুর? এই আপনাদের গতিবিধি?

তাঁর কণ্ঠস্বরে মনে হল তিনি রীতিমতন হতাশ।

অবশ্যি, আরেকটা গতিবিধির বৃত্তান্তও দিতে পারি আপনাকে–একান্তই জানতে চান যদি। সেটা প্রায় একরকম রগ ঘেঁষে যাওয়াই।

রগ ঘেঁষে যাওয়া? তিনি কন : শুনি তো রগড়টা।

আমার আওতায় এসে আপনিও প্রায় আমার ভাষার ভাওতা পেয়ে বসেছেন দেখছি! ওঁর রগড়ের কথায় না হেসে পারি না–আমার এক বন্ধুর সঙ্গে গেছলাম সেখানে। সে আমায় বললো-বেড়াতে যাবে এক জায়গায়? মেয়েটেয়ে আছে, গানটান হবে। জমবে খুব। যাবে?

অজানার পথে এগিয়ে যেতে সর্বদাই আমি এক পা বাড়ানো। বললাম, কেন যাব না?

বন্ধুটি কে? কল্লোলের কেউ?

জেনে কী হবে? আমি নিজের মুভপাত করতে পারি, কিন্তু অপরের মাথায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কি আছে আমার? নাম নাই বললাম, তাতে কাহিনীর কোনো হানি হবে না। কলেজ স্ট্রীটি দিয়ে যেতে মেডিকেল কলেজ ছাড়িয়ে শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে গিয়ে সেই গলিটা। গলির মোড় থেকেই মেয়েদের উঁকিঝুঁকি-কিশোরী যুবতী, নানাবয়সী নারীদের আনাগোনা।

ও বাবা! এ যে দেখছি এক স্বনামধন্য রাস্তায় এনে ফেলেছো তুমি আমায়। রাস্তাটার নাম-ফলক দেখে বললাম। আনাড়ি হলেও জায়গাটার মহিমা আমার অজানা ছিল না।

রাস্তাটার নাম জানতে পারি কি? তিনি শুধান।

তা জানতে বাধা কি আর! জনাব সাহেবকে জানাই-প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীট।

.

২৮.

এই প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীট! সেই ডাকসাইটে (নাকি ডাকিনীসাইটে) জায়গা? মহানগরীর নাগর সংস্কৃতির পীঠস্থান? প্রেমের কতটা ছয়লাপ হয় এখানে জানিনে, কিন্তু চাঁদের ছড়াছড়ি দেখি চারধারেই।

সুহৃদ্বরকে সম্বোধন করলান : এ যে একবারে প্রমীলারাজ্যেই এনে ফেললে হে!

বাড়িতে বাড়িতে বারান্দায় বারান্দায় সারি সারি মেয়েরা। এরা কি সব বারাঙ্গনাই? ঘরদোর আনাচকানাচ উপচে রাস্তায় এসে পড়ছে পরীর দল। দারুণ পরিস্থিতি!

রাজপথ না বলে রানীপথ বলাটাই বুঝি সঠিক। এবং যারপর নাই পরাস্ত হবার পানিপথ বুঝি সবার জন্যেই।

অলিন্দে অলিন্দে ফুটন্ত ফুল। গলিতে গলিতে উৎফুল্ল অলি। অলিগলি যদি বলি তো একেই বলা যায় বোধ করি।

ওরই ভেতরে একটি মৌচাকে সুহৃদ্বর আমায় নিয়ে সেঁধুলেন।

খুপরিতে খুপরিতে মক্ষিরাণী। তারই একটা কামরায় বসলাম গিয়ে আমরা।

আঠারো-উনিশ বয়সী বোধহয় মেয়েটি। কচি কচি মুখ। দেখলে মায়া করে।

আমাকে বন্ধু বলে সুহৃদ তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সমভাবেই সে খাতির করছিল দুজনকে। ভারী ভদ্র মেয়েটি। বন্ধুর অনুরোধে খানকয়েক গানও গাইল সে। সুরেলা মিষ্টি গলা।

চা বিস্কুট এল–তিনজনেই খেলাম। বেশ খানিক গল্পগুজবের পর আমরা চলে এলাম সেখান থেকে। আসার আগে সুহৃদ মেয়েটির হাতে কিছু টাকা দিয়েছিল মনে আছে।

চেনা চেনা বলে যেন মনে হোলো মেয়েটাকে। বললাম বাইরে এসে।

তোমাদের দেশের নাকি? শুধোলো সেঃ দেশ পাড়াগাঁ থেকে বেশ কিছু মেয়ে আসে। তাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে বার করে নিয়ে আসে এখানে। আর একবার এ পথে বা বাড়ালে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যায় একেবারে। চিরদিনের মতই বলতে গেলে।

না, দেশের নয়। দেশের কেউ বেরিয়ে এসেছে বলে আমি জানিনে। দেশের কোনো খবর রাখিনে আমি। কোনো সম্পর্ক নেই সেখানের সঙ্গে আর আমার। আমি কই : এমনিই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল কেন যে! কোথায় যেন দেখেছি একে?

ও–তাই! সমঝদারের মত সে হাসল-তাই বলো। বুঝলাম এবার।

কী বুঝলে?

পরীর মত মেয়ে দেখলে এরকমটা মনে হয় বটে। মনে হয় যেন কতকালের পরিচিত। স্বভাবতই এমনটা হয়। না হয়ে পারে না। সবারই হয়ে থাকে। সে হাসে আবার।

মিষ্টি মিষ্টি মুখ দেখলেই চিনি চিনি লাগে–চোখে দেখেই, চেখে না দেখলেও? এই তুমি বলছো তো? মানে কবির ভাষায়, যাকে বলে, দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে?

ঠিক তাই। এখানকার চেনাজানা না হলেও হয়ত বা পূর্বজন্মের পরিচয় বলে ঠাওর হতে থাকে। আশ্চর্য কিছু নয়।

মোটেই তা নয়। এ জন্মেই দেখেছি-ইহলোকেই। আমি জোর দিয়ে জানাই এই কলকাতাতেই দেখেছি কোথাও। এখন ঠিক মনে করতে পারছি না।

বাদ দাও। এখন বলল, মেয়েটি কেমন? কী রকম লাগল তোমার? তাই কও।

চমৎকার! কেমন টানাটানা চোখ-কী মিষ্টি হাসি!…এমন মেয়ে আর হয় না। বলে তখনই তার প্রুফ সংশোধন করিঃ অবশ্যি, সব মেয়ের সম্বন্ধেই তা বলা যায়। সবার লোই একথা খাটে। মেয়ে মাত্রই তো সুন্দর হয়ে থাকে।

তোমার ভালো লাগলো ওকে? ভালো লাগবার মতই মেয়ে! লেখাপড়া জানে, কালচার মেয়ে। কে জানে, কারো প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল, তারপর কিছুদিন ফুর্তির পর ছেলেটা ওর গয়নাগাটি সব নিয়ে ওকে পথে বসিয়ে উধাও হয়েছে। এমনিই তো হয়ে থাকে আকচার।

আহা! মুখখানা দেখলে ভারী মমতা হয়। সত্যি।

আরেকদিন আসা যাবে তাহলে। আসবে? সে শুধায়। নাকি, তুমিই একাই আসতে চাও এখানে? তাও আসতে পারো। বাড়িটা তো চিনেই গেলে। ওর নাম হচ্ছে মায়া। বললেই ওর ঘর দেখিয়ে দেবে সবাই।

না।

না, কেন? কেউ কিছু বলবে না তোমাকে। কোনো ভয় নেইকো।

না, ভয়ের কথা নয়। আবার এলে হয়ত আরো আমার মায়া পড়বে। আবার আবার আসতে ইচ্ছে করবে। অত টাকা আমি পাব কোথায়? টাকা কই আমার?

সেজন্যে ভেব না। যা দেবে তাতেই ও খুশি হবে। ভারী ভালো মেয়ে। তবে একটা কথা মনে রেখো, এদের সব বাঁধা বাবু থাকে, এরও আছে নিশ্চয়। সে যে সময়টায় আসে, এখানে থাকে, তখন যেন তুমি এসো না। তবে তার আবার দিনক্ষণ ঠিক করা আছে। সেটা কৌশলে জেনে নিতে হবে।

না, ভাই! আমার সাহস হয় না। আমি দারুণ মায়াবদ্ধ জীব। ওর মায়ায় জড়িয়ে পড়ব তাহলেই আর রক্ষে নেই আমার। এ পথে এলে আর ফেরা যায় না জানি।

কী করে জানলে? তুমি তো এ পথে আসোনি কখনো এর আগে?

আহা, বই পড়ে জেনেছি। বই পড়ে জানা যায় না? এ পথে এলে কি রেসের মাঠে গেলে কত লোক সর্বস্বান্ত-কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়-কে না জানে। আমি জানাই : বটতলার কত নভেলেই এদের কাহিনী লেখা হয়েছে। জানিনে?

আবার চন্দ্রমুখীরও তো দেখা মিলে যায় কোথাও কোথাও? বটতলার থেকে সে শরৎচন্দ্রের দিকে মুখ ফেরায় : দেবদাস পড়োনি তুমি? সে তো একালেরই কাহিনী।

একালের পাঁক-এও তো পড়েছি গো আবার! কিন্তু পাঁকে পা নামাতে আমার ভরসা হয় না। ডুবে যাই যদি?…..তাছাড়া মায়ার কথা কি কিছু বলা যায়? আমি ভারী মায়ালু। জীব-যদি জড়িয়ে পড়ি ঐ মায়ায়? মেয়েটার নামও নাকি মায়া আবার, বলছো তুমি!

জীবনকে জানার জন্য লেখকদের সব জায়গাতেই যেতে হয়, জানতে হয় সবাইকে-সব কিছুই দেখতে হয়। জীবন না দেখা হলে তা লেখা হবে কি করে? এখানেই জীবন, জীবন তো এই-ই। তাছাড়া তুমি যে উপন্যাসের নায়কদের কথা বলছে-বটতলার উল্লেখ করে সে কয় : সে কথা সব ক্ষেত্রে খাটে না।…লেখক শিল্পীদের স্বাভাবিক নিঃসঙ্গতাবোধ থাকেই। সেই সঙ্গে একটা আত্মচেতনা, সেটাই তাঁদের বাঁচায়। পাঁকাল মাছ যেমন পাঁকে কখনো জড়ায় না, পিছলে বেরিয়ে যেতে পারে…তুমি কেমন জড়িয়ে পড়তে যাবে?

কেন কে জানে! মিষ্টি মুখ দেখলেই আমার কেমন যেন আদর করতে ইচ্ছে করে। আজও করছিল একটু একটু।

করলেই পারতে! করলে না কেন? সে বলে : কিচ্ছু বলত না তোমাকে।

কি করে করি বলো? তুমি ওকে ছুঁলে না পর্যন্ত! একবারটিও হাত দিলে না ওর গায়ে? আমি কি করে একেবারে ওকে আদর করে বসি। তুমি যদি একটু কিছু করতে…আশ্চর্য! এখানে যেজনে লোকে আসে তার তো কিছুই তুমি করলে না!

সেইজন্যেই আসা বুঝি? দেহের পরিতৃপ্তি? মনের আনন্দটা বুঝি কিছু নয়? একটি রূপসী তরুণীর ক্ষণকালের সাহচর্য-তার দাম কি কিছুই না? নারীসঙ্গে কাটানো গেল খানিকক্ষণ, গানটান শোনা হলো, গল্পগুজব করলাম, সময়টা কাটল বেশ–এই ফুর্তি–এই তো যথেষ্ট ভাই!

সঙ্গসুখই ঢের, মানলাম তোমার কথাটা। কিন্তু আসঙ্গ সুখ নাই হোলো, সেই সঙ্গে সামান্য একটুখানি অনুষঙ্গ সুখে কী ক্ষতি ছিল ভাই? আমি কইতে যাই।

ছিল বই কি ক্ষতি। সে খতিয়ে দেখায়ঃ তাতে কী হানি হতে পারে, সেটা কতখানি ঘটতে পারে–তা জানা নেই তোমার। জানো, কী সব শক্ত শক্ত অসুখ থাকে এদের? দূষিত সংসর্গে সেইসব বোগ এদের দেহে এসেছে–এদের থেকে অন্যদের দেহে–সারা সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়বে। এদেশে এসব ব্যাধির সুচিকিৎসার এখনো কোনো সুব্যবস্থা হয়নি। সে রোগ, এই যৌবনকালে রক্তের তেজে এখন চাপা থাকলেও বয়ে একটু পড়ে এলেই প্রকট হবে। তাতে কানা কালা বোবা হয়ে যেতে পারো, পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যায় কেউ কেউ, বংশানুক্রমে ছড়াতে পারে সেই ব্যারাম। ছেলেমেয়েরা কানা, বোবা, হাবা হয়ে জন্মাবে। ছেলেপিলে নাও জন্মাতে পারে তোমার-যদি তুমি এই ব্যারামে বাঁজা হয়ে যাও। সেটা এক পক্ষে মন্দের ভালো। এক পুরুষেই পরিত্রাণ! নইলে কী সর্বনাশ হয় ভেবে দ্যাখো একবার তোমার, তোমার স্ত্রী-পুত্রদের-তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আরো আরো সব পরিজনের-পরিবারের সবাইকার। ক্রমে ক্রমে গোটা সমাজের…আর ধরো তোমাকেই যদি প্যারালিটিক হয়ে বিছানায় পড়ে যোবা মেরে সারা জীবন কাটাতে হয় তাহলেই তো চমৎকার।

উপদংশিত সংক্রামক যেসব দুষ্টব্যাধির খবর কার্তিক বসুর স্বাস্থ্যসমাচারের দৌলতে বহুকাল আগেই আমার পাওয়া, সেইসবই সে নতুন করে আওড়াতে থাকে আমার কাছে। তথ্যবহুল তত্ত্বগুলি সবিস্তারে,শুনিয়ে বোঝাই করে আবার আমায়–এই রাস্তাতেই তুমি দেখতে পাবে, বেশি বয়সী মেয়েদের। উপদংশক্ষত-জর্জর দূষিত দেহ নিয়ে ভিক্ষে করচে এখানে সেখানে–লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে। এই পথেরই শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে তার:-যে পথের গোড়ায় এখন পা দিয়ে রয়েছে এই মেয়েটি।

শুনেই আমি চমকে উঠি, আর আমার মনেও চমক দেয় তৎক্ষণাৎ! আমার মনে পড়ে হয় হঠাৎ

হ্যাঁ! হ্যাঁ! এবার আমার ঠাওর হয়েছে। চিনতে পেরেছি মেয়েটাকে। বুদ্ধদেবের মতন

মুখ ওর–লক্ষ্য করোনি?

গৌতম বুদ্ধ?

গৌতম কি গধাদর তুমিই জানো! সপ্রতিভ কি প্রগতিবান–তাও তোমার অজানা নয়…আমি ঠারেঠোরে কইতে যাই।

শুনি না কে, আহা! এত ভণিতা কিসের? কোথায় দেখেছ এমন মেয়ে আরেকটাকে…

এই কলকাতাতেই। এমন কি তোমার ঐ কল্লোল আপিসেও…

কল্লোল আপিসে। কল্লোল আপিসে মেয়ে?

আহা, মেয়ে কেন হবে গো! ছেলেই তো! আমি প্রাঞ্জল হই, ছেলে-ছেলে মুখ না মেয়েটার? দেখেই তাই চেনা চেনা ঠেকেছিল আমার।

ওরকমটা হয়ে থাকে। অনেক ছেলে মেয়েলি মুখ নিয়ে জন্মায়, অনেক মেয়ে দেখতে হয় যেন ছেলের মতই… বলে সে জৈব প্রকৃতির দৈবলীলার আরেক ফিরিস্তি বিস্তারিত করতে চায়।

থামো। বুঝেছি। কেন যে তুমি এখানে আসো টের পেয়েছি এবার। এই গলির মধ্যে এত মেয়ে থাকতে ওকেই বা কেন বেছে নিয়েছ তাও বুঝতে আমার বাকী নেই আর।

কেন, মেয়েটা কি সুন্দর না? তুমি তো ওকে আদর করতে চেয়েছিলে হে!

সুন্দর না ছাই! আদর করতে চেয়েছিলাম বলে নিজের উপর আমার রাগ হচ্ছে এমন। ওই তোমার সুন্দর? সুন্দর না ঢেঁকি!

বিনা উপরোধেই তো তুমি ঢেঁকি গিলতে যাচ্ছিলে হে।

তাই বলি। তা, তুমি এখানে না এসে সেই বালিগঞ্জে গেলেই পারতে! সোজাসুজি বুদ্ধদেবের ফ্ল্যাটেই। ওর রসিকতায় আমার রাগ আরও জ্বলে ওঠে : এখানে যা খেলে সেখানে গেলেও তা মিলত। ঐ চা আর বিস্কুট।

চা বিস্কুট?

তাছাড়া কী? তাছাড়া সেখানে তোমার একটি পয়সা লাগত না আবার। এই সঙ্গসুখ, এমন সুন্দর মুখ, সেখানেও পেতে তো। সেখানে গিয়ে ঐ আহামরি রূপসুধা পান করার অসুবিধাটা কী ছিল শুনি?…এখানেও তো তুমি কিছু করলে না, সেখানেও করবার কিছু ছিল না।

— কী আজেবাজে বকচো সব! মাথা খারাপ হয়েছে নাকি তোমার?

এই যদি তোমার মনের ইচ্ছা…তা এত ঘুরিয়ে বলার কী দরকার ছিল আমাকে? এখানে এই মেয়েটার কাছে আমায় নিয়ে এসে এমন ঘুরিয়ে নাক দেখানোর কী প্রয়োজন ছিল? সোজাসুজি বললেই পারতে যে বুদ্ধদেবের ওপরেই তোমার বেশ টান। যাও, আর–আমি…এ জীবনে আমি আর তোমার সঙ্গে মিশবো না।

বলে ওর নামলাঞ্ছিত সেই রাস্তার মোইে ওকে ত্যাগ করে মার মানা না মেনে পাণ তুচ্ছ করে সামনের চলতি ট্রামে লাফিয়ে উঠেছি। উলটো দিকে রওনা দিয়েছি সটান?

.

২৯.

ইস্কুলের ছুটির পর বিষ্টু সুকুলের সঙ্গে গল্প করতে করতে ফিরছিলাম, ডাকঘরের শিয়নের সাথে দেখা হয়ে গেল মাঝরাস্তায়। মহানন্দার পুলের ঠিক ওপরটাতেই।

আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হোলো বাবু। আপনাদের বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে হল না আমাকে। একটা চিঠি ছিল আপনার। বললে সে।-ভালোই হোলো যে পেয়ে গেলাম আপনাকে এখানে। পলকমাত্র দেখেই না সেটা পকেটে পুরে ফেলেছি। লেখাতেই চিনতে পেরেছিলাম আমার রিনির চিঠি। কলকাতার থেকে লিখেছে। ডাকপিয়নের কাছে অভাবিত বাবু ডাকের মর্যাদালাভে উৎসাহিত হয়েছিলাম। তারপর খামখানা হাতে পেয়ে মন আনন্দে থই থই করে উঠল।

হ্যাঁ, ভালোই হয়েছে। প্রতিধ্বনিত হয়েছি আমি পিয়নের কথায়। বাড়িতে গিয়ে চিঠিখানা মা-বাবার হাতে পড়েনি-ভাগ্যিস্! কার চিঠি রে? তোর মামার? বিঃ ওবোয়।

হ্যাঁ, আমার। অনুনাসিক সুরে বলার জন্য আমার কথাটা আমার মতই শোনায় অশ্বথামা হত ইতি গজ-র মত সত্যভাষণ হয়ে যায়।

চল বাণিজ্যা ঠাকুরের দোকানে যাই। রসগোল্লা খাই গে চল। সে বলে।

প্রায় প্রাত্যহিক রুটিন আমাদের ওখানে গিয়ে ঐ রসগোল্লা খাওয়া। গরম গরম রসগোল্লা, খাসা খাসা মডা নামায় ওরা বিকেলেই–খেতে যে কী মজা।

দাম দেবারও দায় ছিল না আমাদের। মাস-কাবারে গিয়ে হিসেব দিয়ে বাণিজ্যা ঠাকুরই আদায় করে নেবে বাবার কাছ থেকে। তাছাড়া আমাদের বাড়ির জন্যও যায় রোজকার রসগোল্লা সন্দেশ ওখান থেকেই। গোটা গাঁ জুড়েই বাণিজ্য ঠাকুরের অবাধ বাণিজ্য।

বসে বসে খাচ্ছি আমরা দুজন, এমন সময় বছর ত্রিশ-বত্রিশের এক ভদ্রলোক আসতেই বাণিজ্যাঠাকুর উঠে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালেন তাঁকে–আসুন, আসুন বন্দীবাবু! আসতে আজ্ঞা হোক। কী সৌভাগ্য আমার আজ। চেয়ার এগিয়ে দেয় বসবার।

অবাক হয়ে তাকাই আমরা। বন্দীবাবু আবার কী রে বাবা! কে রে বাবা! এত খাতির কিসের জন্য ওনাকে?

ভদ্রলোক বসেই হাঁকলেন-দিন যা ভালো ভালো খাবার আছে আপনার আজ। কী কী হয়েছে শুনি? পাঁচ দশ টাকার দিয়ে দিন। খাওয়া যাক বসে বসে। খানার খাতির দেখেই তাঁর খাতিরখানার অর্থ জানা যায়!

আজ্ঞে খাজাও হয়েছে আজ। বালুসাইও বানিয়েছি। গরম আছে এখনও–দেবো? তাছাড়া, বড়ো বড়ো বঁদিয়া। রামবোঁদে যার নাম। আর রসগোল্লা মন্ডা রসকদম্ তো রয়েছেই আমাদের।

দিয়ে যান এনতার! যত আপনার প্রাণ চায়।

প্রকান্ড এক থালায় সব সাজিয়ে এনে ধরে ঠাকুরমশাই ভদ্রলোকের সামনে।

বুঁদিয়াগুলোর চেহারা কী মোটা মোটা রে দেখেছিস? কেমন সব হৃষ্টপুষ্ট বোঁদে। বিষ্ণু আমাকে দেখায়।

রসে বুঁদ হয়ে রয়েছে। সজিভ হয়ে আমার রায়।

খাজাগুলোও তো খাসা দেখছি রে! খেলে বেশ মজা হোতো।

খেলে তো ভালোই হতো রে, কিন্তু আমার বরাদ্দের বাইরে গেলে রাগ করবেন বাবা।

তবে থাক্।

ওর ওই ক্ষুণ্ণ কণ্ঠ শুনে ভদ্রলোক বুঝি অক্ষুণ্ণ থাকতে পারেন না। তাকান আমাদের দিকে।

আহা, তুমি সেই ছেলেটি না? বলে ওঠেন আমাকে দেখেই-যুদ্ধে যাবার জন্য যে নাম লিখিয়েছিল সেদিন সব প্রথম? তিনি কন।-শিবরাম না কী যেন নাম?

— হ্যাঁ। শিবরাম চক্রবর্তী। আপনি কী করে জানলেন?

আমিও যে ছিলাম সেদিনকার সভায় গো! আমন্ত্রিত হয়ে গেছলাম। লক্ষ্য করেছি তোমাকে। এ ছেলেটি কে?

আমার বন্ধু। এক ক্লাসে পড়ি।

বেশ বেশ। মন দিয়ে পড়াশুনা করবে-বুঝলে? আর, ব্যায়াম-ট্যায়াম করে শরীরটা বাগাতে হবে। বাণিজ্যামশাই, আমাকে যা যা দিয়েছেন ওদেরও তাই তাই দিন সব। দাম যা লাগে আমি দিয়ে যাচ্ছি।

দুখানা দশ টাকার নোট ফেলে দিয়ে তিনি চলে যান।

ভারী বড়লোক তো লোকটা। কে মশাই উনি? আমি বাণিজ্যাঠাকুরকে শুধাই।

রাজবন্দী ভদ্রলোক, জানো না বুঝি? এখানে ইনটার্ন হয়ে রয়েছেন এই কিছু দিন থেকে। সরকার থেকে মোটা টাকার ভাতা পান কিনা! মাস মাস আসে ওঁর টাকা–দুতিন শ করে হবে বোধ হয়। ঠিক জানি না। পুরো টাকাটা সেই মাসের মধ্যেই খরচ করার নিয়ম সরকারকে। প্রতি মাসে খরচার হিসেব দিতে হয় সরকারকে-খরচ নাহলে যা বাকী থাকে ফেরত পাঠাতে হয় সরকারকে। সেই কারণে ওঁরা মরীয়া হয়েছে খেয়ে না খেয়ে খরচা, করেন. সারা মাস ধরে। এই ব্যাপার।

বাঃ, বেশ তো! শুনেই আমার উৎসাহ হয়। উপায় করার কড়ার নেই অথচ খরচ কার কড়াকড়ি-এর চেয়ে ভালো ধরাধামে আর কিছুই হতে পারে না।

সরকারী কান্ডই আলাদা। ওনাদের হালচাল কি জানার উপায় আছে দাদা? বাণিজ্য ঠাকুর বাতলান।

আমি তো জানতাম, দারুণ অত্যাচার করে ওরা রাজবন্দীদের ওপর। এ তো দেখছি একেবারে উটোই এখানে। ভেবে আমার তাক লাগে। একদিকে যেমন এই বদ বাবহার, অন্যদিকে তেমনি এই বদান্যতা কেমন যেন সরকারী অন্যথা বলেই মনে হতে থাকে আমার।

ও তাই। আমার মনে পড়ে যায় তখন।…

এর আগেও দেখেছি আমি ভদ্রলোককে এখানকার হাটবাজারে কয়েকবার-মার ফরমাস মতন টুকিটাকি কিনতে গিয়েই-উনি আসা মাত্তর সারা বাজারে যেন সাড়া পড়ে যেত অকস্মাৎ।

ঐ বন্দীবাবু আইছে! বন্দীবাবু আইছেন! উল্লাসের হুল্লোড় খেলে যেত কেমন।

আর, আসার সঙ্গে সঙ্গে দর চড়ে যেত বাজারে। দু টাকা সের মাছের দর উঠে যেত সাত টাকায় চড়াৎ করে। বাজারের সব কিনতেন উনি সবাইকে টেক্কা মেরে। নোট ছড়াতে ছড়াতে উনি যেতেন, আর থলে হাতে সঙ্গের লোকটা মোট কুড়াতে কুড়াতে যেত।

মাছ মাংস তরিতরকারি আনাজপাতি মিলিয়ে সে এক ইলাহী মোচ্ছ। তাকিয়ে দেখবার মতই ব্যাপার।

একবার এক দোকানী শুধিয়েছিল ওনাকে, শুনেছিলাম আমি–আচ্ছা বাবু, কী করলে বন্দীবাবু হওয়া যায় কইবেন সেটা একবার আমাদের? আমরাও হতাম তাহলে।

ভদ্রলোক কোনো জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে চলে গেছেন। ভুরু কুঁচকেছিল আমার।

সেই থেকেই একটা কৌতূহল ছিল। আজ চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে সব কিছুর হদিস মিলে গেল এখন।

রাত্তিরে বাবা মা সত্য সকলের শোবার পর আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। আলো জেলে বইয়ের ভেতর থেকে রিনির চিঠিটা বের করলাম… একটু আদর করলাম চিঠিটাকে।

এত রাত্তিরে আলো জেলে কি হচ্ছে আবার? পড়াশোনার সময় পেলিনে আর?

— মা কি ঘুমের মধ্যেও সজাগ? কি করে যে তিনি বুঝতে পারেন সব। চোখ বুজেও বুঝি টের পান মা।

না মা। বেশিক্ষণ না। একটা ভেরি আরজেন্ট হোমটাসকের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। কালকে ক্লাসের ফার্স্ট পীরিয়ইে সেটা আবার। সেরে রাখছি তাই এখন।

কেন, কাল সকালে করলে কি হত না? রাত জেগে পড়াশোনা করলে শরীর খারাপ হয়। পরীক্ষা-টরীক্ষার সময় সে আলাদা কথা।

— কাল সকালে উঠেই মুসলিম হোস্টলে যেতে হবে আমায়। কাবিল হোসেনের কাছে অঙ্ক শিখতে। ফিরে এসেই নেয়ে-টেয়ে ইস্কুল যেতে হবে। এখনই করে রাখছি তাই। বেশিক্ষণ লাগবে না মা, তুমি ঘুমোও।

কত কথাই লিখেছিল রিনি! তুমি কেমন আছ, আমি ভালো আছি ইত্যাদি মামুলি সাত সতেরর পর আনকোরা একটা খবর দিয়েছিল সে…

কলকাতায় এখন বেজায় হইচই বুঝলে। মহাত্মা গান্ধী এসেছেন। অসহযোগ আন্দোলনের খবর পেয়েছে নিশ্চয়। সেই সম্পর্কেই এসেছেন তিনি এখানে। টাকা তুলছেন তিলক স্বরাজ ফান্ডের। লাখ টাকা আয়ের ব্যারিস্টারী ছেড়ে দিয়ে সি আর দাশ রাস্তায় নেমেছেন আজ। আর তাঁর সঙ্গে বিলেত-ফেরত আই-সি-এস সুভাষ বোস হাকিমি না করে। কি চমৎকার দেখতে তাঁকে-দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। আর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ইস্কুল কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে পথে। মদ আর বিলিতি কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করছে তারা। পাঁজা পাঁজা বিলিতি কাপড় পোড়ানো হচ্ছে পার্কে পার্কে। সবাই মেতে উঠেছে একসঙ্গে। আমার ইচ্ছে করছে ইস্কুল- টিস্কুল সব ছেড়েছুঁড়ে আমিও ওদের সঙ্গে গিয়ে ভিড়ে যাই। তুমিও কেন চলে এসো না এখানে এখন? দুজনায় একসঙ্গে দেশের কাজে লাগা যাবে কেমন!

জানতাম বইকি। ততটা উত্তাল না হলেও এই সুদূর গ্রামাঞ্চলেও আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছিল আমাদের। অসহযোগের সব খবর নিয়মিত পেতাম আমরা খবর কাগজের মারফতে। বাবার আসত সাপ্তাহিক হিতবাদী আর সঞ্জীবনী। আর আমার জন্য তিনি আনাতেন অমৃতবাজার পত্রিকার হিতবাদী সংস্করণ, যাতে কিনা, চালু ইংরেজিটা শিখে ঐ ভাষায় আমি একটুখানি সড়ড় হতে পারি।

তা, বিদ্যায় না সড়গড় হই, সংবাদে সরগরম ছিলাম বইকি।

বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়িয়ে বিছানায়।… রিনির আমন্ত্রণের কথাটা ভাবি শুয়ে শুয়ে। কি কর যে যেতে পারি আমি কলকাতায়।

মনে পড়ে একদা হেডমাস্টার মশায়ের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলাম যে, আই ওয়ান্ট টু বি এ পেট্রিয়টু। তারপরে হিংসার পথে সতীশের সঙ্গে দেখোদ্ধার করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি দারুণ। উদ্ধার পেয়েছি দৈবক্রমে। এবার কি তবে অহিংসাব্রতে দেশ সেবার কাজে লেগে পড়তে হবে? রিনির সাথে?

দেশোদ্বারই কি আমার বৃত্তি হবে শেষটায়? বৃত্ত হবে এই জীবনের? শুয়ে শুয়ে ভাবি তাই।

ঘুম আসতে চায় না কিছুতেই।

কুরুক্ষেত্রে সাক্ষাৎ ভগবান পথ দেখিয়েছিলেন পার্থকে। তার জন্মগত ক্ষাত্রবৃত্তির কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যথাকালে। এইভাবে যথোচিত প্রবৃত্ত করে তার বৃত্তপথেরতার রথের সারথি হয়েছিলেন স্বয়ং।

ক্ষত্রিয়সন্তান অর্জুনের ক্ষাত্রবৃত্তি হলে, ব্রাহ্মণসন্তান আমার কী বৃত্তি হবে তাহলে? ব্রাহ্মবৃত্তিই নাকি?

বাবা বলেন যে, ব্ৰহ্ম জানাতি যঃ সঃ ব্রাক্ষণ। ব্রহ্মকে জানতে পারলে তবেই নাকি বামুন হয়। এদিকে ব্রহ্মকে নাকি কিছুতেই জানা যায় না আবার–তিনি সবার বাক্যমনের অতীত, অবাঙমনসোগোচর–বলে থাকেন বাবাই।

বাবার কথাটা মাকে বলায় মা বলেছিলেন যে, অবাক্ মনসোগোচর–কথাটার মানে কিন্তু ই নয় রে! ওর ভেতরের মর্ম আরেক। আ মানে ব্রহ্ম, তিনিই তো আদিস্বর আর বাক্‌-এর অর্থ হচ্ছে বা পানি পাদ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়াদি, মানে, পৃথিবীর আর জীবনের সব কিছু জড়িয়ে বেবাক, ব্রহ্মের বৃত্তপথ, সেই জীবনবৃত্ত আর ইন্দ্রিয়বৃত্তির পথে মনের যে প্রকাশ, তার মধ্যেই তিনি গোচর, তিনি প্রত্যক্ষ। আবার গোচরের অর্থও আছে আলাদা। বামনের সাহায্যে অঙলীন তিনি, যে গোচারণা করছেন, গো অর্থে পৃথিবীও হয় ফের, এইভাবে যে পৃথিবীকে চালাচ্ছেন সেই পৃথিবীতেই তিনি পরিদৃশ্যমান, সবার গোচরীভূত। এই সূত্রে প্রতীকী অর্থে শ্রীকৃষ্ণেন্দ্র গোচারণাকে শুদ্ধ টেনে এনে বাবার কথাটার প্রতীকক্রিয়া তাঁর আলোচনায় প্রকাশ পায়।

আধ আধ ঘুমে মার কথাটা মনের মধ্যে খেলে যায়।

তা না হয় হলো, গোলোকেই থাকলেন না হয় ভদ্রলোক, আর ব্রহ্মও নয় ব্রহ্মলোকে বিরাজ করলেন শাতিতে, যথার্থ বৃত্তপথে প্রবৃত্ত করতে তাদের কেউই এখন আগ বাড়িয়ে আসছেন না আর আমার কাছে।

এদিকে বামুনের বৃত্তি বলতে ইহলোকে তো দেখতে পাই তিনটি ফুৎকার মাত্র–শাঁখে ফু, কানে যু, আর উনুনে ফুঁ মানে শাখ ঘন্টা বাজিয়ে মন্দিরের ঠাকুরের পুরুৎগিরি প্রাত্যহিক দেবসেবায় ভাগ বসাবার–নিয়মিত আলোচাল কাঁচকলা আদায়ের ফিকির, আর কানে ফুঁ হলো কান পাকড়ে মন্ত্র দিয়ে শিষ্যদের ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত করার চক্রান্ত; এবং এর কোনোটাই যদি না হয়, অগত্যা সেই উনুনে ফু–নিজেই রান্নাঘরের ঠাকুর বনে বিরাজ করা শেষ পর্যন্ত। বামুনের এই তিন বৃত্তির কোনোটাতেই আমার প্রবৃত্তি হয় না। এই তিনটি ফুৎকারই এক ফুৎকারে আমি উড়িয়ে দিয়েছি।

ফুৎকৃত হয়ে নিজেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কখন।

পরদিন খুব ভোরেই হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। যে আমার সাত সকালের আগে ভোর হয় না কখনো, সেই কুম্ভকর্ণের এই পাঁচ সকালে ঘুম ভাঙাটা আশ্চর্যই। একটা কোকিল একটানা ডেকে যাচ্ছিল কোথায় যেন!

আর, সেই ডাকে পেটের মধ্যে কী যেন গজ গজ করতে লাগল আমার! মনের ভেতরে গজিয়ে উঠছিল আপনার থেকেই।

অভ্যন্তরের সেই গঞ্জনাকে টেনে এনে খাতার ওপর পেড়ে ফেলতে কেন যে বাসনা জাগলো কে জানে…

মাথার কাছে একটা ছোট্ট টীপয়ের ওপর বইখাতা সব থাকত আমার। টেনে নিয়ে লিখতে বসলাম ফসফস করে। আর খাতার পাতায় যেন লেখা হতে লাগল আপনার থেকেই

কোকিল ডাকে ভোরের ফাঁকে আম্রশাখে
ভোরের বাতাস যায় যে চিরে…
ব্যথার তীরে হঠাৎ ধীরে।
সেই ব্যথা কি যায় চারিয়ে চারি দিকে?
যায় হারিয়ে স্মৃতির পাকে?
নাড়িয়ে দেয় কি জীবনটাকে?
মনে পড়ে ছেলেবেলার বন্ধু খেলার
মিলনমেলার সঙ্গিনীকে
প্রতিদিনের রঙ্গিনীকে।
কথায় গভীর ব্যাথায় নিবিড়
সেই মোহিনীর সঙ্গটাকে!
কোকিল ডাকে।

এই রকম প্রায় আট স্ট্যানজাই। তার পর আর মনে পড়ে না আমার। অভাবিত এই লেখাটা কোথেথকে এল এমন হঠাৎ? এই ছন্দ মিল শব্দের ঝর্ণা প্রপাত-যার মধ্যে কাশীরামী কৃত্তিবাসী পয়ারকীর্তির বিন্দুমাত্র ছায়াপাত নেই? এ কৃতিত্ব কার? অবাক হয়ে আমি ভাবি। নিজের বলে দাবী করতে পারি না কিছুতেই।

সেদিনই কবিতাটা প্রবাসী আর ভারতী–দুই পত্রিকাতেই পাঠিয়ে দিই ছাপার জন্যে।

.

৩০.

দিনকতক বাদে লেখাটা আমার ফেরত এল প্রবাসীর থেকে। সঙ্গে চারুদার এক চিরকুট। চিঠিটার মর্ম মোটামুটি : তোমার কবিতাটা মন্দ হয়নি। কিন্তু এটি প্রবাসীতে ছাপিয়ে তোমাকে উৎসাহ দিতে আমি চাই না। সমস্ত মন দিয়ে এখন তোমার লেখাপড়া করাই উচিত, অন্য কোনোদিকে ঝোঁক যাওয়াটা ঠিক হবে না। লেখা একটা মারাত্মক নেশা, এই বয়সে তোমাকে পেয়ে বসলে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। লেখকও হবে না-মানুষও হতে পারবে না। বরং পরে বড় হয়ে যথাসময়ে এসবের চর্চা কোরো না হয়। সঙ্গীত,কবিত্ব আর ল্যাজ কারো ভেতরে থাকলে তা আটকানো যায় না। তোমার মধ্যে যদি তা থাকেই প্রকাশ পাবেই–যথাকালে দেখা দেবে–অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনো দরকার নেইকো।…ইত্যাকার পত্রখানা সদুপদেশ নিঃসন্দেহেই; কিন্তু মর্মান্তিক। কথাগুলো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়ে ছিল অনেকদিন।

কিন্তু ভারতীর থেকে এদিকে কোনো সাড়াশব্দই নেই। বুঝলাম, চারুদা নেহাৎ সম্পর্কিত বলেই লেখাটা পড়েছেন এবং পাঠিয়েছেন পত্রপাঠ-ভারতীর তেমন কোনো গরজ নেই, সেখানকার কারো সাথে চেনাজানার বালাই নেই আমার। নির্ঘাৎ লেখাটা তাঁদের ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে পাচার হয়েছে।

যাকগে, বয়েই গেল আমার। চারুদার কথাটা মনে পড়ল, ল্যাজ যদি আমার থাকেই, বেরুবেই একদিন। কেউ চাপতে পারবে না। নিজের ল্যাজের প্রতি বেশি টান দেখানোর কোনো মানে হয় না। নাই বেরুলো কোনো পত্রিকায়, প্রকাশ পাওয়া নিয়ে কথা। একেলা গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুইজনে। তেমনি কেবল লেখকের নয় তো লেখা; পাঠকের অপেক্ষা রয়েছে সেখানে।

হাতে লিখে লিখে বিলিয়ে দেবো নাহয় জনে জনে–তার কী হয়েছে? পড়ুয়া নিয়ে হল কথা, পড়ানো নিয়ে ব্যাপার।

কিন্তু কাঁহাতক লেখা যায় বসে বসে? কাগজের পিঠে কলম ঘষে ঘষে রাতদিন? বিলির চেয়ে অন্য কোনো বন্দোবস্ত করাটাই ভালো না কি?

তাই করলাম। ডিমাই সাইজের প্রকান্ড একখানা কাগজ নিয়ে ছোটখাট সাইজের গল্প কবিতা ছাড়া প্রবন্ধ হাস্যকৌতুক, এমনকি, ক্রমশ প্রকাশ্য ধারাবাহিক উপন্যাসেরও একটুখানি দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে, আষ্টেপৃষ্টে ভরে দিলাম। তারপরে শ্রীশিবরাম চক্রবর্তী কর্তৃক সম্পাদিত লিখিত এবং প্রকাশিত সেই পত্রিকাটি হাটখোলার কালী মন্দিরের গায়ে গিয়ে তাঁদের সাহায্যে মুদ্রিত করে দিয়ে এলাম। আঠা দিয়ে উত্তমরূপে সাঁটার পর গদ্গদভাবে তাকালাম তার দিকে।

হট্টমন্দিরের দেয়ালে আমার খেয়ালটা সেই প্রথম দেয়ালা!

আমাদের হাটখোলা জায়গাটা একটুখানি নয়। অশ্রদ্ধা করবার মতন না। কলকাতার শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কের মতন চারখানা আঁটে গিয়ে সেই জায়গাটা। প্রতি বুধবারে সেখানে বিরাট হাট লাগে। বিশাল জনসমাবেশ। আশপাশের পঞ্চাশখানা গাঁয়ের খদ্দের পসারীরা আসে। বহুত ইতরভদ্র জমায়েত হয় সেখানে।

দুপুরের আগেই থেকেই পসারীরা আসতে শুরু করে। দেড়টা-দুটোর মধ্যে হাট জমজমাট। লাখখানেক লোক কেনাবেচায় আসে নির্ঘাৎ। তার ভেতর জনকতকের নেকনজর কি পড়বে না আমার লেখাটার ওপর? কেউ কি দয়া করে পড়বে না একটুখানি দাঁড়িয়ে?

হাটের দিন বুধবার। সেদিন সকালেই ঐ দেয়ালপত্র লাগিয়েছি কালীমন্দিরের গায়।

ইস্কুল ছুটির পর বিকেলে একলাই ফিরছিলাম সেদিন। বিষ্ণু ইনটার-ক্লাস-টুর্নামেন্টের ম্যাচ খেলতে সকাল সকাল ছুটি নিয়ে নেমেছে গিয়ে ফুটবল মাঠে। একা-একাই ফিরতে হচ্ছিল আমাকে।

বাণিজ্যাঠাকুরের দোকানে বাণিজ্য একলাই সারতে হোলো। তারপর বুধবারি ভিড় ঠেলে হট্টমন্দিরের কিনারায় গিয়ে ঠেকলাম।

দুয়েকজনের নজর পড়ছিল দেখলাম আমার কাগজটায়–কিন্তু দেখে দাঁড়িয়ে পড়া, কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার তেমন গরজ কারো বিশেষ দেখা গেল না।

সবাই নিজের বেচাকেনা নিয়েই ব্যস্ত। সাহিত্যোৎসাহী কেউ নয়। একটু-আধটু তাকিয়েই না অবহেলাভরে চলে যাচ্ছিল সবাই। আমি অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে নজর রাখছিলাম।

খানিক বাদে সেই বন্দীবাবুকে দেখা গেল সেইখানে।

আরো দেখা গেল তাঁকে স্থাণুর মতই সেখানে দাঁড়াতে। সকৌতুক আগ্রহে তিনি পড়ছিলেন সব দেখলাম।

সবটা পড়ার পর তিনি ফিরে দাঁড়াতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল আমার।

তুমি তো দেখছি দস্তুরমতন লেখক হে! একটু এগিয়ে এলেন তিনি আমার দিকে।

কী যে বলেন! সলজ্জ আমি বলি–কিচ্ছু হয়নি ওসব। লাগিয়ে দিয়েছি এমনিই। মনে এলো তাই।

না না, বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে। এমনি করেই তো হয়। তোমার একটা কবিতাও বেরিয়েছে বারের ভারতীতে দেখলাম। চমৎকার হয়েছে কবিতাটা!

বলেন কি? শুনেই না আমি লাফিয়ে উঠেছি-কই, আমাদের ভারতী তো আসেনি এখনো। আপনি পেয়ে গেলেন এর মধ্যে?

সব, কাগজই পাই কিনা আমরা। সরকার বাহাদুরের সৌজন্যে। দৈনিক সাপ্তাহিক মাসিকপত্র সব। আমাদের অ্যালাউন্স থেকেই কাটা যায় দামটা। ইচ্ছে করলে যে-কোন বইও আমরা আনাতে পারি-পলিটিক্সের বই বাদে। যাবে তুমি আমাদের বাসায় বইপত্র সব দেখতে? আজই চল না কেন, এখনই?

না, যাব একদিন। খুব শীগগিরই যাব একদিন। তবে আজ না, এখুনি বাড়ি যেতে হবে। ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে মা ভাববে আবার। মাকে বলে আসিনি তো। মাকে বলে যাব একদিন শীগগির।

বলে আমি পাশ কাটাই। আমাদের ভারতীও এসে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণ। তাড়াটা আমার সেইজন্যেই-মার জন্যে নয়।

এসব কী লিখেছিস রে। বাড়িতে পা দিতে না দিইে মার খববদারি–কী লিখেছিস কাগজে এসব?

কী লিখেছি মা? কোথায়? আমি যেন কিছুই জানি না-হাটখোলার ঐ কাগজটার কথা বলছ বুঝি?

আমার হাটের হাঁড়ির খবরটা মার কাছে কেউ এসে ভেঙেছে বলে বোধ হয় আমার।

হাটখোলা কী আবার? ভারতীতে বেরিয়েছে তো! তোর এই পদ্যটা

ও! ওই ভারতীর লেখাটা! নিরুৎসুকের মত বলি–ওটার কথা বলছো?

দুখানা ভারতী এসেছে এবার আজ। একখানা তোর বাবার নামে-যেমন আসে। আরেকখানা তোর নামেই আবার।

দেখি দেখি। আমি হাত বাড়াই-আগ্রহ দমন করে।

দেখবি তো। কিন্তু তোর এই পদ্যটার মানে কী, তা বলবি তো আমায়?

পদ্য পদ্য বোলো না মা। পদ্য না, কবিতা। আমার রাগ হয়ে যায়–ওকে কবিতা বলে।

কবিতাই হল না হয়, কিন্তু মানে তো ওর থাকবে একটা।

কবিতার আবার মানে কী? কবিতার কি কোনো মানে হয় কখনো মা? ধরতে গেলে, মানে তো খুব সোজাই! কেন, তুমি বুঝতে পারছে না?

বোঝা তো সোজাই রে! তা কি আর বুঝতে পারছিনে। কিন্তু মানের মধ্যে আরেকটা মানে থাকে যে। মার জেদ-তোর এই কিশোরকালের সঙ্গিনীটি কে, শুনি।

কে আবার? কেউ না। মনগড়া সব। কবিরা সব মন থেকে বানিয়ে বানিয়ে লেখেন জানো না কি? যেমন রবীন্দ্রনাথ তেমনি আমি।

তাই নাকি! হাসতে থাকেন মা।

তা না তো কী! রবিবাবুর মানসী যেমন, তা কি আর ছিলো নাকি কখনো! সোনার তরী কি চোখে দেখা যায় নাকি? অপরকে শোনানোর জন্যেই বানানো ওসব।…ভারী খিদে পেয়েছে মা, কী খেতে দেবে দাও এখন।

কথাটা ঘুরিয়ে আমি খাবার ঘরের দিকে মাকে ফিরিয়ে দিই।

তারপরও ভারতীতে আমার কবিতা বেরিয়েছিল আরও। তার এক-আধটার এক আধটু মনে আছে আমার এখনো …..

কবিগুরুর সেই ভুলভাঙ্গা কবিতাটার…বুঝেছি আমার নিশার স্বপন হয়েছে ভোর মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে/ রয়েছে ডোর/ নেই আর সেই চুপি চুপি চাওয়া/ ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া/ বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ বাহুতে মোর …

জবাবে একখানা লিখেছিলাম আমি এইধারার

সত্য হে কবি, এ যে ভুল ভাঙা
আর এক ভুল ধরিতে।
এ যে তটিনীর এক কূল ভাঙা
আর এক কূল গড়িতে।
প্রেম চলে যায়, বাঁধা তো রহে না;
তাই ফেলে যায়- বোঝা তো বহে না,
কেন চাহো তারে একটি স্বপনে।
ভরিতে?
সুখবেদনার এ যে ফুল রাঙা
কালি নিশাশেষে ঝরিতে।

এইরকম পাঁচ ছ ছত্রই প্রায়। তারপর আর মনে নেই আমার।

রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই বিদায় অভিশাপের হাসি? হায় সখা, এ ত স্বর্গপুরী নয়। পুষ্পে কীটসম হেথা তৃষ্ণ জেগে রয়…কবিতাটারও একটা উতোর গেয়েছিলাম আবার–ভারতীতে নয়–সাপ্তাহিক সচিত্র শিশির-এর পৃষ্ঠাতেই।

পেয়েছিলে দশ শো বছর দেবযানী,
তবু তোমার মিটলো নাকো তৃষা?
দশটি নিশি পেলেই মোরা ঢের মানি,
তোমার ছিল লক্ষ মধু নিশা।
লক্ষ দিনে সখ্যনীড়ে বন্ধুটিরে/পাওনিকি?
লক্ষ নিশি বঙ্গে মিশি লক্ষ চুমু/খাওনি কি?
লক্ষ চুমুর তুল্য কী?
লক্ষ চুমুর মূল্য কী?
এক জীবন মিললো যাদের
লাখ জীবনে ভুললো কি?
পাইনি মোরা দশ শো বছর–চাইনেও।
সয় না মোদের একটা রাতের/ঘুমহানি।
দুনিয়া আমার স্বর্গ আমার–তাই দেব।
দাও না আমায় এক পলকের
চুমুখানি।
একটি চুমুর/তুল্য কী?/একটি চুমুর
মূল্য কী?
এই জনমে মিললো যাদের/আর
জনমে ভুললো কি?

এ ছাড়া, এর পরে, ভারতবর্ষে বেরিয়েছিল আমার প্রায় শ-দুই ছত্রের দীর্ঘ দুপাতা ব্যাপী এক কবিতা-চুম্বন বলে। সেটাকে চুম্বনের শত নাম–চুমুর হরিহরছত্রই বলা যায়। তাতে ছিলো চুমুর নানা আখ্যানের নানান ব্যাখ্যান। দুঃখের বিষয় সেই ছত্রাকারেরও এক ছিটেও মনে এখন আর পড়ে না আমার।

কবিতাটা এক ফাগুন সংখ্যায় বেরিয়েছিল–যে কারণে সম্পাদককে গাল খেতে হয়েছিল শনিবারের চিঠির কাছে-ফাগুনের ভারতবর্ষে আমাদের জলধরদা বুড়ো বয়সে আগুন ছুটিয়েছেন-ইত্যাকার ব্যঙ্গোক্তির পরিসীমা ছিল না।

তৎকালের লেখা–ভারতবর্ষ উত্তরা কল্লোল প্রভৃতিতে প্রকাশিত-আমার লম্বাচৌড়া কবিতাগুলি মানুষ এবং চুম্বন দুটি বই হয়ে এম সি সরকার থেকে বেরিয়েছিল পরে। সেযুগে কবিতার জন্য একালের মতন পাঠকের তেমন আগ্রহ না থাকলেও বছর খানেকের মধ্যেই বই দুটির সংস্করণ নিঃশেষিত হয়েছিল মনে আছে। কিছু টাকাও এসেছিল আমার পকেটে। কিন্তু তারপরে বই: দুটি আর ছাপা হয়নি। এখন তো তার কোনটারই পাত্তা পাওয়া যায় না আর।

আমার কাছে ওই মানুষ-চুম্বনের কোনো কপি নেই। প্রকাশকের কাছে তো নেইই। এমনকি, খুঁজে দেখেছি ফুটপাথেও তাদের পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পাওয়া গেলে হয়তো ছাপানো যেত এখন।

কিন্তু সেই কাঁচা বয়সের এসব লেখা এমন কিছু চমৎকার হয়েছিল আমি মনে করি না। তবে তার ভেতরকার আবেগটা ছিল হয়ত খুব। চমৎকার না হলেও গোড়াকার আমার। লেখাগুলো যে চুমুৎকার হত বেশ, তার কোনো ভুল নেই।

এমনকি, আন্দামান-ফেরত মহাবিপ্লবী বারীনদা উপেনদার সাপ্তাহিক পত্র বিজলীতেও আমার একটা ছোট্ট চুটকি চমত্ মেরেছিল একসময়…মনে পড়ে বেশঃ

এক চুমুকে গভূষ করার মত লেখাই!

জানি জানি/ সবাই সবে/ ছাড়বে।
চলার পথে/ কে কার চুমু কাড়বে?

চুমু যেমন কাড়াকাড়ির তেমনি ছাড়াছাড়ির, তেমনি আবার চিরকালের মত হারাবার জিনিস! তার কি কোনো ভুল আছে আর?

কিন্তু ভাবি আজ, এই সব কবিতা সেই বয়সে আমার মাথায় এল কি করে? খাতার পাতায়ই বা এল কীসে?

আমার লেখা বলে মনেই হয় না যেন।

তার কিছুদিন আগেই তো আমি মহাকবি কৃত্তিবাসের পদাঙ্ক ধরে, শিবরাম পন্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ/ লঙ্কাকান্ডে গাহিলেন গীত রামায়ণ/ ফেঁদে বসেছিলাম…সেই আমিই কি এই আমি? এই কেঁদে কূল পাচ্ছে না যে?

কার পদাঙ্ক এসব? কোন্ অঙ্কশায়িনীর অনুসরণে এই পদাবলী?

কৃত্তিবাসী কীর্তির হনুকরণে লঙ্কাকান্ডে নিজের মুখ না পুড়িয়ে মিষ্টিমুখের কিসকিন্ধ্যা কান্ডে এমন করে কে টেনে নিয়ে এলো আমায়? কার ইঙ্গিতে লেখা আমার এই সব?…

এমনকি, বহুদিন পরেও সেই সংশয় আমার যায়নি এখনো। বহুবর্ষ পরের এই ছত্র দুটিতেও তা ব্যক্ত হয়েছে :

লিখেছি কি আমি অনেক বন্ধু?
আমি তো সেসব লিখিনি।
ছিলো যে লেখিকা অনেক বন্ধু!
ছিলাম আমি তার লেখনী।

কে ছিল সেই লেখিকা? ওহ্নে কৃতিত্ব কার? এই প্রেরণার জন্য কার কাছে ঋণী আমি?…রিনিই কি?

নাকি, সেই তিনিই?

৩. সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়

৩১.

সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়, বলে না?

সুখী ব্যক্তি মাত্রেই ভূতের কিল খায়, খেতে বাধ্য হয়। আধি ভূত ব্যাধি ভূত–ডাক্তার উকীলের ছদ্মবেশে এসে নানা মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে বারো ভূতে মিলে কষে কিলোয় তাদের শান্তি-স্বস্তি পায় না। ঝুট-ঝামেলায় জেরবার হয়ে যায়।

শুধুই বহির্ভূত নয়, মনের মধ্যেও ভূত থাকে যে আবার! কিছুতেই সুখে থাকতে দেয় কাউকে।

ছেলেরা কিন্তু এমনিতেই সুখী-স্বভাব গুণে সর্বদাই স্বচ্ছন্দ। খুব দুঃখী দরিদ্র পরিবারের ছেলেরাও মনের আনন্দেই থাকে–বাপ-মারা দুঃখকষ্টে কাটালেও সন্তানদের কখনো তার আঁচ পেতে দেন না–ছেলেবেলাটা বেশ কেটে যায় তাদের। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের বেলাতেই তাই। তা যদি নাও হয়, তাহলেও তারা বাস্তবের দুঃখ মনগড়া স্বপ্নের জগতে বাস করে ভুলতে পারে।

তাই বলে কি ছোটদের মনে সুখদুঃখের ছোঁয়া লাগে না? আশপাশের ছোঁয়া লাগে বইকি। তাছাড়া, কোনো কারণ না থাকলেও, অকারণেও নিজের মনে তারা সুখদুঃখ পায়।

এই সুখী, এই অসুখী তারা-ক্ষণে ক্ষণেই। কেন যে তা কে বলবে! অহেতুক দুঃখসুখের খেলা তাদের মনে লেগেই থাকে সময় সময়। সুখের মধ্যে থেকেও কেন যে তারা কষ্ট পায়, কিসের অভাব বোধ করে কোথায় যেতে চায় কে জানে! ছেলেদের দুঃখ কিসের, কে কইতে পারে।

বাল্য কৈশোর সুখের কাল, বলে থাকেন সকলেই। বয়স্করা পিছন পানে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন।

আর হোটদের বয়স্কদের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে বুঝি। বড় হবার, বড়দের মত আচার-আচরণ করার স্বাধীনতার স্বাদ পাবার সাধ জাগে বোধ হয়। অন্তনিহিত অবচেতনের কোনো স্পৃহই কি?

কী সুখেই যে কেটেছিল আমার জীবনের সকালবেলাটা। ক্ৰীচার কমফর্ট বলতে যা বোঝায় তার কোনো কিছুরই অভাব ছিল না আমার। দক্ষিণ পশ্চিমে ভগ্নদশা হলেও এককালে প্রকান্ড প্রাসাদের প্রায় আধখানাই আমাদের। লম্বাচওড়া বড় বড় ঘরে সারি সারি খাট পাতা, তার ওপরে পুরু গদির নরম বিছানা বিছানো। সেই বিছানার কোলে গদিনশীন হয়ে দু ধারে পাশবালিশ নিয়ে সিল্কের মশারির মধ্যে ঘুমানোর কী আরাম। পূবের টানা বারান্দাটার মোটা মোটা থামগুলির খিলানের মাথায় ঝাঁক ঝাঁক পায়রার বাসা–তাদের বকমের মিঠে ডাক শুনে রোজ সকালের ঘুম ভাঙা যেন এক স্বপ্নের মতই।

আর, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই না বাবার প্রসাদ লাভ!

প্রসাদ বলতে গত রাত্রের বাবার খাবারের ভাগ আমাদের ভোগের জন্য রেখে দেওয়া।

সকালে বাবার হত হবিষ্যান্ন; আতপ চালের ভাত গাওয়া ঘি দিয়ে ডাল তরকারির সাথে খাওয়া, মাছটাছ কিছু নয়। তিনি ছিলেন পাক্কা নিরামিষাশী। আর রাত্রে হত তাঁর ফলার। সের দশেক দুধ মন্দা আগুনের আঁচে সারা দিন ধরে ফুটে ফুটে মরে মরে ক্ষীর হয়ে থাকত, তার ওপরে সর পড়তে মোটা রুটির মতই। আ মরি মরি! ক্ষীর ভাগের সবটুকু আর সর ভাগের অর্ধেক বাবা খেতেন রোজ রাত্তিরে–সঙ্গে থাকত সেই সুবিখ্যাত মানকি বলা (কলার ফলার বাবার বারো মাসই) আর সেই ঋতুর যা ফলমূল তাই। আর সেই সরের আদ্ধেকটা তিনি রেখে দিতেন আমাদের দুভায়ের সকালে উঠে খাবার জন্যে। রসগোল্লাও দু-এক জোড়া থাকত তার সঙ্গে আবার।

পুরুষ্টু রসগোল্লাগুলো কুঁচিয়ে কুঁচিয়ে পুরু সরের সঙ্গে মিকচার বানিয়ে আমি খেতাম আহা, রসনার সে যেন স্বর্গলাভ!

সকালে আমরা মার রান্না খেয়ে ইস্কুলে যেতাম–মাছের ঝোল আর ভাত। ইস্কুল থেকে ফিরে খেতাম ফুলকো লুচি। রাত্রেও আবার লুচি, মাছের তরকারি। মার রাঁধা চচ্চড়ি দিয়ে খানকতক লুচি, আবার মিস্টি ক্ষীর মিশিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করে তার ওপর। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা সে লুচির সোয়াদই আলাদা। সেই ছোটবেলাতেই যা খেয়েছি–তারপরে আর পাইনি কোনোখানে, খাইনি কোথাও।

আর সেই বিরাট একখানা ছাদ! সকাল সন্ধ্যে যেখানে মুক্তি অবাধ। মজাসে ফুর্তি করে বেড়াও। কতো কবিতাই না ভেঁজেছি সেই ছাদে বেড়াতে বেড়াতেই-কত চতুস্পদীর সঙ্গেই পায়চারি করা আমার সেখানে! কোথায় গেল সেসব কবিতা-আমার মনের আগুনের ফুলকি যতো! কোথায় গেল তারা? কে জানে!

যত মুকুল ধরে তার সবই কি ফুল হয়ে ফোটে? আম গাছে যত বোল আসে কতটুকুই বা তার ফলাও হয়? তবু তাইতেই তো তার বোলবোলাও! সেই সৌরভেই দশদিক আমোদিত।

স্বপ্নমায়ায় বিভোর হয়ে কেটেছে সেই স্বর্গীয় (এবং স্বৰ্গত) দিনগুলি আমার কৈশোরের।

সেই স্বর্গসুখেও অরুচি ধরতে আমার মাঝে মাঝে। মন যেন উধাও হয়ে যেত কোথায়। ভোগ সুখকে তুচ্ছ করে দুখভোগের জন্য কাঁদত বুঝি মন? হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনোখানে-ভেবে আনচান করত বুঝি প্রাণ?

বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম আমি এক-এক সময়। কাউকে কিছু না জানিয়ে এক বস্ত্রে-একলাটি–সঙ্গে একটিও পয়সা না নিয়ে। পয়সা পাবই বা কোথায় তখন? আর, পয়সা সঙ্গে নেবার দরকারও বোধ করতাম না কখনো। অতিথিপরায়ণ সচ্ছল দেশে আতিথ্যলাভ তখন সহজ ছিল বেশ।

বাবা এককালে সন্ন্যাসী হয়ে দিগ্বিদিক ঘুরেছিলেন, তাঁর মাথার সেই ঘূণী পোকাই কি আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছিল নাকি? কিংবা এ পোকা হয়ত সব ছেলের মগজেই গজগজ করে–বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘূর্ণী হাওয়ায় ঘুরিয়ে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় তাকে সেই ঘূণীপাকে পড়লে আর রক্ষে নেই। এবং এই পোকাই বুবি যথাসময়ে ঘুণপোকা হয়ে ভালোবাসার ছলনায় এসে কুরে কুরে খায় তাকে আবার।

ফি বছর দুর্গাপূজার পর আমাদের সবাইকে নিয়ে বাবা তীর্থভ্রমণে বেরুতেন। বিজয়ার পর তাঁর সেই দিগ্বিজয়ে গোটা সংসারটা যেত আমাদের আনুষাঙ্গিক। বাড়ির কুটোটি পর্যন্ত না নিয়ে তিনি নড়তেন না। মোটা মোটা বড় বড় গাঁটরি বাঁধা হতো–একটা থলে ভর্তি যত বাসনকোশন-পেতলের হাঁড়ি কড়াই, হাতা-খুনতি, থালা বাটি গেলাস সব–এমনকি মায় শিল-নোড়াটি অব্দি (বিদেশ বিভুঁয়ে মশলা বাটার জন্য মিলবে নাকি শিল কোথাও? রেঁধেবেড়ে তো খেতে হবে!) আমি সায় দিতাম বাবার কথায়-হ্যাঁ বাবা, শীল হচ্ছে কুল-ক্ষণ, কেউ কি তা কাউকে দিতে চায় কখনো? মার মতে একটা কুলক্ষণ-ঐ ভূতের বোঝা বয়ে বেড়ান। তোর ভর্তি জামা কাপড় গামছা ভোয়ালে পিরান কুর্তা। তার ওপর তোষক বালিশ মশারি-টশারি নিয়ে বিছনাপত্রের গোটা তিনেক গাটরি। টুকিটাকি জিনিস-টিনিসে ভর্তি তদুপরি আরো দুটো বাক্স আবার।

রাজার পিলখানায় হাতী ছিল বিস্তর–সবার সেরা তাদের মোহনপ্রসাদ। যেমন চেহারায় তেমনি দাঁতের বাহারে। বিরাট আকার হাতীর বড় বড় দুটো দাঁত। যেমন লম্বা তেমনিই মোটা। মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হত মোহনপ্রসাদের। ক্ষেপে গিয়ে সোজা সে চলে যেত সেই রাজবাড়িতে-রাজাবাহাদুরের কাছেই সটান। মাহুত সহিস কেউ তাকে সামলাতে পারত না। রাজাবাহাদুর ভারী ভালোবাসতেন তাকে। তিনি স্বহস্তে হাঁড়ি হাঁড়ি রসগোল্লা তাকে খাওয়াতেন। তাই খেয়ে তবেই সে শান্ত হত। রসগোল্লা খাবার জন্যেই সে ক্ষেপে যেত আমার মনে হয়।

মোহনপ্রসাদ ক্ষেপলে বাণিজ্যাঠাকুরের দারুশ বাণিজ্য! হাতীটা ক্ষেপলেই তিনি চার কড়াই রসগোল্লার ভিয়েন চড়াতেন। দুজনের মধ্যে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কিনা কে জানে!

বাবারও ভারী প্রিয় ছিল মোহনপ্রসাদ। সব হাতীর চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন তিনি ওকেই–ওই নামমাহাত্মের জন্যেই কিনা কে জানে। ওর পিঠে চেপে আর মালপত্রের লটবহরে গোরুর গাড়ি বোঝাই করে সামসি রওনা হতাম আমরা। সামসি ছিল আমাদের কাছাকাছি স্টেশন–দশ বারো মাইল দূরই হবে বোধ হয়। কিন্তু স্টেশনে যাওয়ার আগেও বাবার আরেক যাত্রাপর্ব ছিল আবার। মা বলতেন, যাত্রা নয়, ওটা তার নিতান্তই থিয়েটার করা।

সেটা ছিল তাঁর পাঁজিপুথি দেখে যাত্রা। দিনক্ষণ দেখে, কত প্রহর কত দণ্ড পল বাদে কোন সময়টা যাত্রার পক্ষে শুভ সেটা লক্ষ্য করে, তারপর সবার প্রাতঃকৃত্যাদি সারিয়ে, গাড়ি ধরবার তখন আঠারো ঘণ্টা বিলম্ব থাকলেও। হয়ত রাত তিনটেই ঠিক ক্ষণটি, একটু না ঘুমোতেই রাত দেড়টায় সবাইকে হই হই করে তুলে, সবার প্রাতঃকৃত্যাদি সারিয়ে, শয়নঘর ভোজনঘর বাদ দিয়ে, আমাদের সবাইকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে বৈঠকখানার ঘরটায় নিয়ে এসে তিনি বসে থাকতেন। যথাকালে আসল যাত্রার জন্য অপেক্ষা করতেন সেখানে ঘন্টার পর ঘটা।

মোটঘাট আগের থেকেই বাঁধাছাঁদা হয়ে মজুত থাকত সেইখানে। তিনটেগোরগাড়ি বোঝাই হয়ে যেত আমাদের যত লটবহরে। দশ মাইল রাস্তা গোরুর গাড়িতে টিকিয়ে টিকিয়ে যাওয়া কী কষ্টকর! ইস্টিশনে যাবার পাকা সড়ক হয়নি তখনো। (এখন তো শুনি বাস যায় নাকি পিচমোড়া রাস্তায়।) বেশির ভাগ গোরুর গাড়িইে যেতে হত, কখনো কখনো অবশ্যি রাজবাড়ির থেকে হাতী আসত আমাদের স্টেশনে নিয়ে পৌঁছে দেবার … জন্যে-খবর দিয়ে রাখলে আগের থেকে ফিরতি পর্বেও তেমনি স্টেশন থেকে আমাদের নিয়ে আসার জন্যও হাতীযেত এক এক সময়।

আর হাতী চাপতাম আমরা, সম্বচ্ছরে সেই পূজার সময়। রাজবাড়ির দুর্গোৎসব হত পাহাড়পুরে (এখনও হয় বোধ হয়), সেখানে হাতী চেপেই যেতাম আমরা–আমরা আর বামুনপাড়ার ছেলেরা সবাই। বামুনপাড়ার অনেকে রাজার একরকম আত্মীয়ই হবেন–দূর সম্পর্কিত হলেও। কেউ তাঁদের ডাক্তার, কেউ জোতদার, কেউ বা শুধুই পুরোহিত। পুজোর চারদিন হাতী চাপবার ফুর্তি ছিল আমাদের।

পাহাড়পুর পর্যন্ত চার মাইল রাস্তা হাতী চেপে মসমঁসিয়ে যাবার মজাই ছিল অদ্ভুত! পুজোর আমোদর উপরি আরেক প্রমোদ! এখন, ট্রেনযাত্রার কথাটাই বলা যাক। বাবা আগের থেকেই স্টেশনে লোক পাঠিয়ে গোটা একটা থার্ড ক্লাস কামরা রিজার্ভ করে রাখতেন–লটবহর সমেত আমাদের সবাইকার জন্যে। বাড়ির থেকে শুভযাত্রায় শ্রীদুর্গা স্মরণ করে রওনা হওয়ার পর আমরা সেই কামরায় গিয়ে চাপতাম।

তারপর সারা ট্রেনযাত্রায় সেই লাগেজ তুলতে নামাতে কী কম হাঙ্গামা! গোদা-গাড়িঘাটে ট্রেন ছেড়ে ধরতে হত স্টীমার, ওপারে লালগোলায় গিয়ে চড়তে হত কলকাতার ট্রেনে। অত লাগেজ নিয়ে কুলীদের সে কী চেঁচামেচি-তাদের সঙ্গে কত দর কষাকষি-বকাবকি বাবার! শেয়ালদায় নেমেও সেই ঝঞ্ঝাট ফের! ছ্যাকরা গাড়ির কোচোয়ানের সঙ্গে কচকচিও কম নয়।

ভেবে আমার অবাক লাগত, একদা সংসারবিরাগী বাবা কেন যে এই সারা সংসারের গন্ধমাদন ঘাড়ে করে তীর্থভ্রমণে বেরুতেন! এ জিজ্ঞাসার জবাব আমি খুঁজে পেতাম না।

অথচ যখন তিনি নিজে বেরুতেন একলাটি, কার্যগতিকে কলকাতায় কি আর কোথাও, তখন কোনো লটবহর নয়, কেবল একটিমাত্র হাতব্যাগ থাকত তাঁর সঙ্গে। আর তার ভেতর থাকত আরেক প্রস্থ তাঁর জামাকাপড়, জমা-খরচের খাতা আর দরকারী কাগজপত্র। এই নিয়েই তিনি যেতেন।

কলকাতায় গেলে তিনি ফিরে আসতেন কিছু মোটঘাট নিয়েই অবশ্যি। হয়ত কিছু আনকোরা বাসনপত্র, ছাতাটাতা, নতুন ধুতি, শাড়ি, মশারি-টশারি, বুড়িখানেক ল্যাংড়া আম, ভীমনাগের সন্দেশ–এই মোটমাট।

আমাদের নিয়ে বেরুলে কখনো যেনে তিনি বৈদ্যনাথ দেওঘর, কখনো পুরী ভুবনেশ্বর, কখনো বা কাশীধামে। কখনো আবার শুধুই কলকাতায়–আমাদের মাসিধামে।

মাসির বাড়ি যাওয়ার সুযোগ এলে আমরা যেমন পুলকিত হতাম, মাকেও তেমনি হাসিখুশি দেখা যেত ভারী।

রামতনুবাবুর গলিতে (নম্বর মনে পড়ে না) বড়মাসির বাড়ি উঠতাম আমরা। সাত বোনের ভেতর ঐ খুদিদিদির ওপরই মার টান ছিল বেশি।

পরে আমিও আবার উধাও হয়ে যেতাম ঐ সব জায়গায়। বাবার সঙ্গে গিয়ে গিয়ে যে সব স্থানের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, বাড়ির থেকে পালিয়ে সেখানেই যেতাম বেশি বেশি। কিন্তু ঠিক তীর্থের টানে সেটা নয় বোধ হয় আদৌ। কেননা শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে আমি আর দ্বিতীয়বার যাইনি–সমুদ্র বিশেষ আন্দোলিত করেনি আমায়। সাগরের চেয়ে গঙ্গা ঢের প্রিয় ছিল আমার কাছে–তার কিনারায় বসে ঢেউ গুণে সময় কাটাতে কী আরাম! পুরী কি ভুবনেশ্বর মন্দিরের আকর্ষণ আমি কখনো বোধ করিনি। জগন্নাথ দেবের অন্নপ্রসাদে তেমন উৎসাহ পাইনি বলেই হবে হয়ত। কাশীধামে গেছি–সেখানকার মালাই লচ্ছির তুলনা হয় না, ভাগলপুরেও গেছি ভুল করে–সেখানকার হালুইকরের দোকানের পুরু সর একটু গুরুপাক হলেও অতি উপাদেয়–আর বাবা বৈদ্যনাথের প্রসাদী প্যাঁড়া–কী উপমা দেবো তার? কাশী গয়া প্রয়াগের প্যাঁড়া খেয়েছি বাবার সঙ্গে গিয়ে, কিন্তু দেওঘরের প্যাঁড়ার জোড়া নেইকো-প্যারালাল নাস্তি।

কাটিহার দিয়ে কেটে বেরুতাম, তারপর নানাদিক ঘুরে ফিরে, কিউল বরেটনি মতিহারী নানান জংশন হয়ে (ভাগলপুরও ঐ রকম বিপথের মধ্যেই পড়েছিল বোধ হয়) এখানে সেখানে নেমে এক-আধদিন ধরমশালায় কাটিয়ে অবশেষে পৌঁছে যেতাম সেই দেওঘর ধাম–ততটা বাবা বৈদ্যনাথের প্রতি ভক্তিবশত নয় যতটা ঐ আহামরি প্যাঁড়ার টানেই। আন্ধ্যারালান্ডু প্যাঁড়া!

আশ্চর্য লাগে এখন, টিকিট সঙ্গে না থাকলেও রেলগাড়িতে কখনো আমায় কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। প্রায়ই দেখেছি আমার পাশের সহযাত্রী একগাদা টিকিট বার করে দেখিয়েছেন চেকারকে–এবং চেকার ভদ্রলোক আমাকেও ওঁর আনুষঙ্গিক জ্ঞান করে দৃপাত করেননি আমার দিক ফিরে। এবং আহারাদিরও অসুবিধা হয়নি কখনো। যেখানেই গেছি না, সেখানকার কোনো না কোনো প্রবাসী বাঙালী ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা আদর করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে খাইয়েছেন আমায়-বাড়ি পালানো ছেলে মনে করেই হবে বোধ হয়-কী সব মানুষই না ছিল যে সেকালে! (এখনও অন্য নামে আছেন তাঁরা নিশ্চিত) কেউ কেউ বাড়ি ফেরার গাড়ি ভাড়াও অযাচিত দিতে চেয়েছেন আবার। দিয়েছেনও জোর করে গছিয়ে-বহুৎ সদুপদেশের সহিত। আজও অত অচেনার ভেতরে একজনের কথা আমার মনে আছে এখনো-আমার সমবয়সী ছেলেটি-বাঙালী নয়, বিহারী। বিহারী হলেও বাংলা বলতে পারত বেশ।

মধুপুর স্টেশনে আলাপ হয়েছিল তার সাথে–কোনো পাণ্ডার সাকরেদ হবে–কিংবা বাচ্চা এক পাণ্ডাই-যাত্রী পাকড়াতে বেরিয়েছিল।

টের পেয়েছিল যে আমার টিকিট নেই–সঙ্গে পয়সাটয়সাও নেই একটা। যশিডি জংশনে গাড়ি থামতে আমাদের প্রায় সবাইকে নামতে হল সেখানে-সেখান থেকে বৈদ্যনাথধাম– যাবার অন্য গাড়ি ধরতে হয়। ছেলেটি নেমেই না চার পয়সা দামের একখানা দেওঘরের টিকিট কিনে হাতে দিল আমার। বলল যে, বাবাকে দর্শন করতে যাচ্ছ তো? মন্দিরেই আমার সঙ্গে দেখা হবে–এখন আমি যাত্রী ধরতে চললাম।

স্টেশনে নেমে সোজা চলে গেলাম মহাদেবের মন্দিরে। রাস্তাঘাট সব চেনাজানা ছিল। মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম আগে। দেখলাম সেইরকম মন্দিরের পথের দুপাশে গালার তৈরি কাঁচ পাথরের চুমকি বসানো ঝকমকে যত চুড়ির দোকানসোনার চুড়িকেও হার মানায় তারা-দোকানে বসেই বানাচ্ছে যত কারিগর, যেমনটি নাকি আগেও দেখেছিলাম।

প্যাঁড়ার দোকান তাদের ধারে ধারেই কিন্তু ধারে খাওয়াবার পাত্র নয় কেউ তারা।

মন্দিরের মধ্যে গিয়ে দর্শন করলাম বাবাকে। কষ্টিপাথরের মত নিকষ কালো লেতেলে মাথায় হাত বুলোতে কী আরাম! ভালো লাগল বলেই বাবার মাথায় হাত বুলালাম খানিক।

বাবার মাথাটা একটু টোল খাওয়া। তার কারণ স্থানীয় পুরাণ কথায় যা বলে, খুদে পাণ্ডাটির কাছে তা জানা গেল।

একদা শিবভক্ত রাবণ কৈলাস থেকে বাবাকে টেনে হিঁচড়ে নিজের কাঁধে তুলে স্বর্ণলঙ্কায় নিয়ে যাচ্ছিল। দেবাদিদেবের কিন্তু মোটেই ইচ্ছা ছিল না সেখানে যাবার। কিন্তু ভক্তের বাহুবন্ধন আর মায়াপাশ কাটানো দায়। অ্যান্দুর এসে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল, নিজের শীর্ষস্থানীয় সুরধনীকে রাবণের পেটের মধ্যে তিনি সেঁধিয়ে দিলেন। ফলে রাবণকে দারুণ প্রেরণায় পেয়ে গেল তারপর। বাবাকে ঐখানে নামিয়ে মুক্তধারায় সে স্বচ্ছন্দ হতে বসল। বাবা বললেন, এপ্রহরের মধ্যে তুমি এলে তো এলে, নইলে এই যে আমি বসলাম, নড়ছিনে আর এখান থেকে। রাবণ বলল, প্রহর কিসের ঠাকুর। এক দণ্ডেই আমি আসছি। কিন্তু সেই অফুরন্ত প্রবাহিনীর বেগ কি একটুখানি? চার প্রহর কেটে গেল রাবণের দেখা নেই। তারপরে কাজ সেরে ফিরে এসে কিছুতেই সে আর বাবাকে তুলতে পারে না। নড়নচড়ন নেই আর তার কথারও নড়চড় হবার নয়। রাবণ আর কি করে? ক্রোধভরে বাবার মাথায় বিরাট এক মুক্কা মেরে না নিজের মক্কায় ফিরে গেল সে। তাঁকে একচোট দেখে নিয়ে সেইখানে রেখে গেল অবশেষে।

আর, রাবণের চোট তো চারটিখানি না। তার বিশখানা হারে বিরাণীমণী ধাক্কাই! একটু টোল খেয়ে তার টাল সামলাতে হলো বাবাকে।

তদবধি ভক্তাধীন ভোলানাথ ভক্তবৎসল নারায়ণের ভৃগুপদ লাঞ্ছনার ন্যায় ভক্তের সেই টিপসই নিজের শিরোধার্য করে রয়েছেন। রাবণের সেই কীর্তি, কর্মনাশা নামে কীর্তিত, এখনো দেওঘর দিয়ে প্রবাহিত নাকি–সেই নদীর জল কিন্তু কেউ পান করে না। স্নান করে না কেউ সেখানে।

সুন্দরীর গালের মত সুচারু না হলেও সেই টোলে হাত বুলোতে গিয়ে গোল বাধল যা! মন্দিরের পাণ্ডারা এমন ধমক লাগালো আমায় যে, টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম।

সঙ্গে আমার কোনো পাণ্ডা ছিল না। বিনা দনীর এই দর্শনাথীর অযথা হস্তক্ষেপ। আর, সব পূজারী পাণ্ডার প্রাণে সইল না বোধ হয়। কে না কে তাদের সর্বত্বসংরক্ষিত দেবতার, মাথায় এসে নিখরচায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। হৈ হৈ করে উঠল সবাই। তাদের তাড়নায় বেরিয়ে আসতে হল বাইরে।

বাইরে এসে মন্দিরটা প্রদক্ষিণ করলাম একবার। বার বার করছিলেন ভক্তদের অনেকে। মন্দির বেষ্টন করে তার গা-লাগাও সারি সারি ঘোট ঘোট খুপরির মতন–তার খোপে খোপে মনোবাঞ্ছাপূরণের প্রার্থনায় বাবার কাছে হস্তা দিয়ে পড়ে রয়েছে কতজন।।

তারই একটা খালি মতন পেয়ে তার পৈঠার ওপর পা ঝুলিয়ে বসলাম আরামে। তার আগে চন্নামৃতের কুণ্ড থেকে পেট ভরে পান করে খিদে মিটিয়ে নিয়েছি আমার।

খিদের মুখে সেই চন্নামৃতের স্বাদ প্রায় অমৃই! রাতদিন কত না পূজাথী ভক্তিভরে বাবার মাথায় দুধ ঘি দুই মালাই গঙ্গাজল ঢালছে, প্যাড়ার ভোগ লাগাচ্ছে, তার সবটাই তো ধুয়েমুছে একটা নালি বেয়ে সেই কুণ্ডে এসে জমা হচ্ছে। সে কস্তু যেমন তুষ্টিকর তেমনি পুষ্টিকর, একাধারে ক্ষুধাতৃ দুই-ই মেটায়, সন্দেহ কি।

বসে রয়েছি চুপচাপ। এমন সময়ে কোত্থেকে সহসা আমার সমবয়সী সেই কিশোর পাণ্ডাটি এসে হাজির।

এসেই সে গোটা চারেক প্যাঁড়া দিল আমাকে। দোনার মধ্যে নিয়ে প্যাঁড়াগুলো হাতে করেই এসেছিল সে।

এই প্যাঁড়ার জন্যেই কি এখানে বসে এতক্ষণ ধরে প্রার্থনা করছিলাম আমি নিজের অগোচরে।

কিন্তু আমার মনের কথা ওই ছেলেটা টের পেলো কি করে?

আগেকার কাল হলে, স্বয়ং বাবাই ওর ছদ্মবেশ ধরে আমার কাছে এসেছেন মনে করে তক্ষুনি তার পায়ের তলায় দৎ হয়ে লুটিয়ে পড়তাম হয়ত।

কিন্তু সেরূপ কোনো প্রেরণাই জাগল না আমার–তেমন বিশ্বাস ছিল না তো। পাওয়ামাত্র অম্লানবদনে খেতে লাগলাম প্যাঁড়াগুলো–বিনা বাক্যব্যয়ে। খিদে পেয়েছিল বেজায়…

তোমাদের পাণ্ডা কে এখানে? ছেলেটা শুধালো আমাকে।

পাণ্ডা আছে আমাদের-এর আগে যখন মা-বাবার সঙ্গে এসেছিলাম দেখেছি-তবে নাম জানি না তাঁর। ইয়া গাট্টাগোট্টা চেহারা।

এখানকার সকলের চেহারাই ভাই ঐরকম। বাবার প্রসাদে আর রোজ বিকালে ওই ভাঙ খেয়ে। বলে হাসতে লাগল ছেলেটা-ভাঙই বাবার উত্তম ভোগ। পেস্তা বাদাম পিষে মালাই লচ্ছির সঙ্গে মিলিয়ে বানানো হয়। খেতে যা–কী বলব। আহা! তার দুই চোখ নিমীলিত হয়ে আসে।

ভাঙও খেতে দেবে নাকি আমায়? আমি সভয়ে বলি-বাবার ঐ উত্তম প্রসাদ?

না না, তোমাকে দিতে যাব কেন ভাঙ? সে আমার ভয় ভাঙতে চায় : বাঙালীরা ভাঙ সইতে পারে? খেলে তুমি উলটে পড়বে এখনই।

যে কদিন ওখানে ছিলাম মন্দিরের চত্বরেই পড়ে থাকতাম। রাতভোর ভক্তের ভিড়ে গমগম করত জায়গাটা। খিদে পেলেই চন্নামেও আর মাঝে মাঝে সেই ছেলেটা এসে প্রসাদী প্যাঁড়া দিয়ে যেত আমাকে। যজমানদের পুজো করিয়ে বাবার কাছে দেওয়া তাদের ভোগের থেকে পাওয়া নিজের ভাগের খানিকটাই বোধ হয়।

সকালবেলা উঠে বেরিয়ে পড়তাম এদিকে সেদিকে যেদিকে দু চোখ যায়–দেওঘরের যে কোনো রাস্তা ধরে। একদিন গেছলাম ত্রিকূট পাহাড়ে, আরেকদিন নন্দনকাননে। তবে যেদিন যমুনাজোড়ে ( ঝিরঝির বয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদীর নাম ) গেছলাম সেদিনটির কথা বিশেষ করে মনে আছে আমার এখনো।

চাষীদের সবিস্তার আখের খেত ছিল যমুনাজোড়ের দুধার ঘেঁষে। যেতেই তারা সমাদরে অভ্যর্থনা করে এক ভাঁড় রস (আহা, কী তার মাধুরি!) খেতে দিয়েছিল আমায়। আমি না না করলেও তারা আমার মানা শোনেনি। দেহাতী লোকের এই স্নেহাতিশয্য বিস্মিত করেছিল আমাকে। কে জানে এখনো আখের চাষ হয় কিনা সেখানে-প্রাণ টানে সেখানে যাওয়ার জন্যে আমার এখনো! আখেরে আর যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও আমার। এখনো কি তারা সেদিনের মতই অচেনা অতিথিকে আমন্ত্রণ জানায়–তেমনিই সরস উপচারে সাদরে?

.

৩২.

মাঝে মাঝে এমনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বাইরে দীর্ঘদিনের জন্য ডুব মারলেও বাবা-মার মনে আমার জন্য কোনো ভাবনা হতো বলে মনে হয় না–সামান্য একটা মার্বেল ডুবলেও পুকুরের বুকে যতটুকু তরঙ্গ তোলে, আমাদের বাড়ির নিস্তরঙ্গ পরিবেশে ততটুকুও চাঞ্চল্য জাগত না বোধ করি।

বাড়ি থেকে চলে গেলেও যেমন তাঁরা ভাবিত হতেন না, তেমনি দীর্ঘকালের পর আবার বাড়ি ফিরে এলেও অভাবিত কোনো উল্লাস দেখিনি তাঁদের। সব একেবারে স্বাভাবিক। গতকালও যেন বাড়িতে ছিলাম এইরকম ভাব …অতকাল বাইরে কাটিয়ে এলেও। কোথায় ছিলাম, কী করেছি, কিভাবে কাটালাম তার কোনো প্রশ্নই ছিল না, কৌতূহলও নয়, খাপছাড়া তরোয়ালের মই যথারীতি খাপ খেয়ে যেতাম নিজের বাড়ির খোপে আবার।

বাবা-মা যে আমার প্রতি উদাসীন বা স্নেহহীন ছিলেন তা নয়, তাঁরা ছিলেন ঐ একরকমের। একদা সন্ন্যাসে কাটানোর জন্যেই কিনা কে জানে, বাবা ছিলেন সব বিষয়ে নির্বিকার, সব সময় নিরুদ্বিগ্ন। আর মা? মা তো আমার সম্বন্ধে নিশ্চিতই ছিলেন একপ্রকার। বলতেন, তোদের দু জনকে মার পায়ে সঁপে দিয়েছি, আমার কোনো ভাবনা নেই তোদর জন্যে আর। কোনোদিন তোরা কিছু দুঃখকষ্ট পাবিনে, গোল্লায় যাবিনে কখনোই। আমি নিশ্চিন্ত আছি।

মার কথায় নিশ্চিন্ত ছিলাম আমিও। কদাচ নিজের জন্যে কিছু ভাবিনি কখনো। না বর্তমানের না ভবিষ্যতের ভাবনা-কোনোদিন আমায় বিচলিত করেনি একটুকু। ভাবনার কারণ আসার আগেই তা কাটাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দারিদ্রের মধ্য দিয়ে গেছি দুঃখ পাইনি, আগুনের আওতায় থেকেচি আঁচ লাগেনি গায়ে, কে যেন সবসময় আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে আমায়।

রোগা পটকা দুর্বল দেহ নিয়ে পড়াশুনায় কাঁচা, টাকাকড়িতে ফাঁকা, নিতান্ত অপদার্থ এই আমি কি করে আমার যৎসামান্য জীবনে এত কাণ্ড করলাম, ভাবলে অবাক লাগে। প্রকান্ড তার কোনোটাই হয়ত নয়, কিন্তু সব তিলগুলি জড়ো করে যে তাল, তাকে তো আর বাতিল করা যায় না। পঙ্গু-আমি গিরি লঙন করতে পারিনি ঠিকই, (বিশ হারে অমন বাহুবলশালী রাবণও তো স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু প্রায়-মুখ মুক আমি মুখর হলাম যে! মুখ্য নাই বা হলাম। আমার পক্ষে সেটাই কি কম নাকি! তা যার কৃতিত্বে বা কৃপাতেই হই না কেন! আলো যেখান থেকেই আসুক, এই মাটির প্রদীপেই জ্বলছে তো?

এই জীবনে সব কিছুর সোয়াদই তো এক-আধটু পেয়ে গেছি। কিছুর জন্যেই কোনো খেদ নেই আমার। কোনো লোভ না, কোনো ক্ষোভ নয়।

আত্মতৃপ্ত হলে কিছু হয় না; এই আত্মতৃপ্তির জন্যই বোধ করি কিছুই হল না আমার। লেখককর্মে বা কর্মলেখায় উল্লেখ্য তেমন কিছু। কিন্তু কিছু না হওয়ার মধ্যেও যেমন কিছু হয়ে যায়–কিছু কিছু হওয়া যায়, ভেবে দেখলে সেই-কিছুটা তো কিছু কম নয়। যৎকিঞ্চিৎ জীবনে তাই আমার যথেষ্ট।

আধারটাই বড়ো কথা। বড়ো আধারে বেশি ধরে-বেশি ক্ষমতাই বেশি পারে। হ্রদের বুকে যত জল জমে থোষ্পদে কি আর তত! আকাশের ছায়া অবশ্যি দুজায়গাতেই দেখা যায়-দুখানেই ছড়ানো–দুই-ই তার মায়া জড়ানো; কিন্তু হ্রদের বিশালে যে বেশি বর্ষণ হয় নদের প্রবাহ বয়ে সেই স্নেহধারাই দুধারেই তৃষিত শ্যামল অধর সরস করে সমুদ্রের বুকে গিয়ে হারায় আবার। ফের আবার সূর্যের আকর্ষণে উচ্ছ্বসিত সেই স্নেহই আকাশের মেঘপুঞ্জে সঞ্চিত, হ্রদে বর্ষিত আর নদের দ্বারা বাহিত হয়ে যথাসময়ে সাগরমোহনায় গিয়ে গদগদ। এই-ই লীলা।

পরিমিত শক্তির মধ্যে যে স্তিমিত, সীমিত গন্ডীর মধ্যেই তার লিমিট; নিজ সীমান্তের বাইরে কিছুই তার করার নেই। এবং তার হেতু খেদ করে (কিংবা জেদ করেও) লাভ হয় না কোনো।

১৬৩ রবীন্দ্রনাথ যেমন। একাধারে হ্রদ, নদ আর সমুদ্রের সমাহার। এপর্যন্ত মানুষের পরিণতিতে। পরিপূর্ণ মানবতার ঠিক না হলেও, মানবিক পরিপূর্ণতার মাপকাঠি রূপেই ধরা যায় তাঁকে। সেই রবীন্দ্রনাথকেই ধরুন। আধারটা তাঁর কেমন, দেখুন একবার। জন্মসূত্রে পাওয়া স্বাস্থ্য, শরীর আর