০১. জলাভূমির গোলকধাঁধা

তালাশ – শাহীন আখতার
প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১০ পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস
TALASH (a novel) by Shaheen Akhtar. Published by Ahmed Mahmudul Haque of Mowla Brothers 39/1 Banglabazar, Dhaka 1100. Cover Designed by Dhruba Esh.

.

উৎসর্গ
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী / মুক্তিযুদ্ধের আড়াল-করা-দরজা দিয়ে যিনি আমাকে অন্দরমহলে ঢুকিয়েছিলেন।

.

সবিশেষ কৃতজ্ঞতা

আসক-এর কথ্য ইতিহাস প্রকল্প
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র
মাহবুব আলমের গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে
এবং
নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি

.

জলাভূমির গোলকধাঁধা

যখন তার জীবনের কথা কেউ জানতে চায় কিংবা সে নিজে যখন স্তব্ধ জলাশয়ের মতো দেহ-মন স্থির রেখে বসে ভাবে, তখন ঘোলাজলের ঘূর্ণাবর্তে কচুরিপানা যেন, মরিয়মের চোখের সামনে বহু বছর আগেকার কয়েকটি মুহূর্ত ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠে। সে মরিয়ম, প্রকারান্তরে মেরি, তখন তার ডান হাত ছিল কাপড় শুকোনোর দড়ি খামচে ধরা, আরেক হাত শরীরের বাঁ পাশ ঘেঁষে ঝুলছে। এক পা আধখানা ইটের ওপর, আরেক পা শূন্যে–তিন ইঞ্চি নিচের মাটির আশ্রয়ের জন্য কাতর। মরিয়ম আধা নিরালম্ব, যেন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মন্টুর কাঁদতে কাঁদতে চলে যাওয়া দেখে। আসলে সে দেখে না। গেট খোলার শব্দে বোঝে যে, মন্টু চলে যাচ্ছে। দড়ি হাতড়ে গামছায় নাক ঝেড়ে, চোখ মুছে সে যখন তাকায়, ততক্ষণে মন্টু–তার ছোট ভাই–গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে সময়টায় মরিয়মের চোখ জলে ঝাপসা ছিল। সে দৃষ্টিহীন ছিল। সে কিছু দেখেনি, শোনেনি। লোহার গেট খোলার ধাতব শব্দটি ছাড়া। এই অদৃষ্ট-অশ্রুত সময়, তার অজান্তেই জঠরে ধারণ করেছিল এক ভয়াল বিস্ফোরক। যার ধূমল উদ্‌গিরণে মন্টু চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়। মরিয়ম হামানদিস্তায় থেঁতলানো দেহ আর কোরবানির মাংসের মতো ভাগে ভাগে বেঁটে দেওয়া জীবন নিয়ে বাঁচে। তারপর এই দেহ আর নিজের থাকেনি। নিজের জীবন আর নিজের হয়নি।

সে শুধু যুদ্ধ বলে নয়, যুদ্ধহীন সময়েও নারীর জীবনকে যদি ভাবা হয় চার চাকার গাড়ি, তবে দেহ তার সারথি। নিয়মের বাঁধানো সড়ক থেকে দেহ একচুল সরে গেলে। আস্ত গাড়িটাই গর্তে, আবর্জনায় মুখ থুবড়ে পড়ে। জীবনের পতন ঘটে। নারী পতিত হয়।

মরিয়ম এখন সময়-সময় এ-ও ভাবতে চায় যে, সেদিন মন্টু আর সে ঘরে তালা লাগিয়ে, টিউবওয়েলের জল-কাদায় মাখামাখি ইটের সারির ওপর সতর্ক পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। পেছনে তাদের পরিত্যক্ত বাড়ি আর সামনেই গ্রাম। সে সময় শহরের লোকেরা মিটিং-মিছিল-স্লোগান-গুলিবর্ষণ আর ক্ষমতার পালাবদলের বাইরে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল। শিশুরা ছিল পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়। তাদের ড্রয়িং খাতার বটের নিবিড় ছায়া, দুপুরের ভাঙা হাট, সন্ধ্যার স্নিগ্ধ নদীতীর, পালতোলা নৌকার সারি আর জ্যোৎস্নাভাসা তেপান্তরের মাঠ প্রাপ্তবয়স্কদের পথ দেখায়। তাদের অনেকেই বোঁচকা বেঁধে সেসব জায়গায় চলে যায়, অনেকেই যায় না। কেউ কেউ আবার দু-চার দিন পর নিজেদের বালখিল্যতায় বিরক্ত হয়ে ফিরে আসে। মরিয়ম জোরজবরদস্তি মন্টুকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে শহরের উত্তাল তরঙ্গ আঁকড়ে পড়ে থাকে। তার যত ভয় উঠতি বয়সের ছোট ভাইকে নিয়ে, যে লোহার রড হাতে উতরোল জনতরঙ্গে ইতিহাস রচয়িতাদের একজন হতে চেয়েছিল। মরিয়ম সেই। সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করছে–মন্টু তর্ক জুড়ে দেয়। অনশন করে। মরিয়ম নাছোড়। কথা-কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটির পর সদ্য গজানো দাড়ি-গোঁফের নব্য বিপ্লবী ইতিহাসের প্রসববেদনা নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

মরিয়ম ভাবে, পথে খণ্ড খণ্ড লড়াই যদি বাধে, তা মানুষে মানুষে। তখনো তার ভয় কেবল ভূত আর জিনপরির। মানুষে তখনো সে বিশ্বাস হারায়নি। তাদের হিংস্রতার দৌড়, তার চেতন-অবচেতনে বড়জোর মাথা ফাটাফাটি পর্যন্তই ছিল। মাথায় বাড়ি না-পড়লে আজ চলন্ত বাসেই মন্টুর রাতের এক প্রহর শেষ হবে। তারপর বাড়ি পৌঁছানোর আগে মাইলতিনেক দীর্ঘ, দুই-আড়াই মাইল প্রশস্ত সুন্দরীর জলা। বেলাবেলি পারাপার না হলে পথিক তাতে পথ হারায়, ভূতের আছরে তাদের দাঁতকপাটি লেগে যায়। বর্ষাকালে সওয়ারির সঙ্গে নৌকার মাঝিমাল্লারা থাকে। পথ হারানোর প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলানোর দায় তাদের। বাকি রাত চালক আর সওয়ারি মিলে হাল বায়, হুক্কা টানে, গালগপ্প করে। একসময় জলাভূমির আকাশ ফরসা হয়, পাখপাখালি জেগে ওঠে। শীতের মৌসুমে জলার বুকে আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ। তখন দোজখের নানান চিত্রে বিচিত্র এ জলাভূমি। এরকম এক সময়, একাত্তর সালের মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সুন্দরীর জলায় মন্টু একা। ভাবতেই মেরির সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে।

এর মাত্র তিন বছর আগে ভাইবোন সুন্দরীর জলায় যে নরক-দর্শন করেছিল, সেটি যেন আজীবন তাদের সঙ্গে চলে। একজনকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আরেকজনকে করে ইতিহাসের নিগ্রহের শিকার।

যুদ্ধ বাধার তিন বছর আগে কলেজে মরিয়মের তখন দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। মন্টু ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। দাদির মৃত্যুসংবাদ আসার দিন, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে মন্টুর দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। মায়ের চিঠিতে দাদির জন্য পরওয়ারদিগারের কাছে দোয়া মেঙে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ার নির্দেশ ছিল। কারণ তিনি ছিলেন নেকবান্দা। পরম করুণাময় জায়নামাজে সিজদার সময় তার প্রিয় ইনসানের জান কবজ করিয়াছেন। পর সমাচার এই যে, মেরি ও মন্টু তোমরা অহেতু বিলাপ-আলাপ করিও না। উহাতে তোমাদের প্রিয় দাদির কবরের আজাব বাড়িবে বৈ কমিবে না।

মরিয়ম আর মন্টু, যা করার কথা চিঠিতে নিষেধ ছিল, তা-ই করে। মন্টু বাসায় ফেরার পর বই-খাতা নামিয়ে রাখারও সময় পায় না, ঘরে ঢুকতেই দাদির মৃত্যুসংবাদ তাকে জানানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের ফাউন্টেন পেন মেঝেতে পড়ে যায়। তারপর জ্যামিতির বাক্সটা স্কেল-কম্পাসসহ। মরিয়ম দোয়াদরুদ পড়া বাদ দিয়ে ভাইয়ের গলা ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগ গোছায়। দরজায় তালা লাগিয়ে শেষ বাস ধরার জন্য বাসস্ট্যান্ডে ছোটে।

মধ্যরাতে সুন্দরীর জলায় জনমানুষ দূরে থাক, এক কণা আলোও নেই। মেরি মন্টু কাটা ধানগাছে পা ফেলে অন্ধকারে ফটফট শব্দ করে হাঁটে। মন্টু মাঝসমুদ্রে দিকহারা নাবিকের ভয়ত্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘মেরিবু আমাদের একটা দিগদর্শন যন্ত্র থাকলে পথ হারানোর ভয় থাকত না।’ মরিয়মের আফসোস যে, তাড়াহুড়োয় একটা টর্চ সঙ্গে নিতেও সে ভুলে গেছে। ঠিক তখন অদূরে সে আগুন দেখে। বিজ্ঞানমনস্ক মন্টু বলে, ‘মরীচিকা, এই দ্যাখ এখন নাই।’ তাই তো! পরক্ষণে আবার আগুন জ্বলে ওঠে। একজন দেখে, আরেকজন দেখে না। এই করে করে একসময় তারা দুজনেই তা দেখতে পায়। সেই সঙ্গে শোনে মানুষের মৃদু গুঞ্জন। ‘চোর-ডাকাত না তো, যদি আমাদের ধরে!’ মেরির ভয়টা মন্টু আমলে নেয় না। এ ছাড়া লুকিয়েচুরিয়ে মাত্র। ছ’মাস হয় সিগারেট ধরলেও নেশাটা এখন তার তুঙ্গে। বাড়ির মুরুব্বিদের কাছে ধরা পড়ার ভয়ে দিয়াশলাই-সিগারেট সঙ্গে আনেনি। ওই অগ্নিকুণ্ডের কাছে মানুষ থাকবেই। আর মানুষ থাকলে সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা না-থেকে পারে না। মন্টুর হাঁটার গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। যেতে যেতে সে বলে, ‘মেরিবু, তুই যে কী কস! আমাগো লগে কি ধনসম্পদ আছে যে, ডাকাইতে ধরব?’

তারা যত এগোয় আগুন তত পিছিয়ে যায়। কাছে যেতে মানুষ বা আগুন কিছুই থাকে না। মৌমাছির মতো মানুষের মৃদু গুঞ্জনও অন্তর্হিত। যেন লণ্ঠন হাতে এক ঝাঁক মৌমাছি উড়ে গেছে মধু আহরণে। ভাইবোনের শরীর ভার ভার ঠেকে, ভয়ে বুক কাঁপে, জিব শুকিয়ে যায়। এর মধ্যেও মরিয়মের একবার মনে হয়, এটি আলেয়ার আলো। মুখ ফুটে ভাইকে বলতে গিয়ে দেখে গলায় স্বর নেই। আগুনের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যেন পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ একসঙ্গে সব কটা দিক হারিয়ে ফেলেছে। বাকি আছে নিচে মাটি, ওপরে আকাশ। ভাইবোন মাটিতে বসে উত্তরাকাশে ধ্রুবতারার সন্ধান করে। তারা ঝলমলে আকাশটা যেন জবরজং বেনারসি শাড়ি–এমন ঘন। বুনটের জরির কারুকাজ বিয়েবাড়িতে বাহবা কুড়ালেও, এখন তাদের কাছে মনে হয়। বিভীষিকা। এ থেকে চোখ সরিয়ে যখন নিচে তাকায়–সুন্দরীর জলার শীতের মৌসুমের ছোট ছোট জলাশয়ে তারাখচিত আকাশের টুকরা-টাকরাসমেত নিজেদের দেখে। মাথায় ভর দিয়ে দুজন যেন দাঁড়িয়ে আছে। আর দূর আকাশের নীল আলোর। বিচ্ছুরণ তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

এই হলো সুন্দরীর জলার কুহেলিকা, যা দিগ্ভ্রান্ত মানুষদের বশ করে মৃত্যুফাঁদে নিয়ে ফেলে। কিন্তু মেরি-মন্টুকে এর বশ হলে চলবে না, যে করেই হোক বাড়ি পৌঁছাতে হবে। সেখানে তাদের প্রিয় দাদির দেখা পাওয়া যাবে না ঠিকই, তবে তার কবরটা তো রয়েছে, যে কবরের বুক ফেটে তখনো রসুনের কোয়া থেকে চারা গজায়নি, চারধারের নতুন বাঁশের বেড়াটাও অক্ষত। তখন মন্টু আলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় আর নিজে নিজে ঠিক করে, এখন থেকে অন্ধকারে যা দেখবে, তা বিশ্বাস করবে না। যা দেখবে না, তাতে আস্থা রেখে তাকে বাকি পথ চলতে হবে। ঠিক এরকমই একটা সিদ্ধান্ত সাড়ে তিন বছর পর সে সঙ্গীদের না-জানিয়ে নিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে সীমান্তের নিকটবর্তী একটি ব্রিজ ওড়ানোর সময় ঘটনাটি ঘটে। সব কটা সার্কিটের মাথার সেফটি ফিউজে আগুন দেওয়া হয়ে গেছে। চারদিকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ফরফর আওয়াজ। পরিকল্পনামতো দলের ছেলেরা যেদিকে পালায়, তার ঠিক উল্টোদিক থেকে মন্টু হঠাৎ একটি আলোর রেখা দ্রুতগামী জিপের গতিতে ছুটে আসতে দেখে। সে তেড়ে আসা এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না এবং উইপোকার মৃত্যুতাড়নায় ছুটতে থাকে সেদিকেই, যেদিক থেকে প্রবল বেগে আলোটা আসছিল।

সুন্দরীর জলায় চোখের সামনে ছোট ছোট খড়ের স্তূপ দেখেও মন্টু ভাবে, এগুলো খড় না, খড়ের সারি সারি স্তূপ না, জিনের পঙক্তি ভোজের আসর। সঙ্গে সঙ্গে সে পথ বদলায়। মরিয়ম তার সঙ্গে খানিকটা পিছিয়ে এলেও মানুষের ঘর-বসতির কাছাকাছি এসব খড়ের স্তূপ থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারে না। সে মন্টুর পুলওভার ধরে টানে, বলে ফিরে আসতে। মন্টু গোঁ-গোঁ করে গোঙায়। অন্ধকারে তার পাগল পাগল ভাবটা মরিয়মের তখন ঠাহর হয়। সে খানিকটা জোরাজুরি করতেই ভাই প্রলাপ বকতে শুরু করে, না গো মেরিবু,’ সে কফতোলা ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, ‘ওইদিকে যাইস না, ওরা ঘাড় মটকে পুঁতে ফেলবে সুন্দরীর মতন।’

মন্টুর শরীরটা করাত-কাটা গাছের মতো মটমট শব্দে কাত হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।

কে এই সুন্দরী? মরিয়ম জানে না। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছে। ভাইয়ের গাঁজলা-তোলা মুখ কোল থেকে নামিয়ে সে কাছের জলাশয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে তারার ম্লান ছায়ায় এক ভয়ার্ত নারীর প্রতিবিম্ব। নিজেকে মরিয়ম চিনতে পারে না। মৃদু স্বরে ডাকে, ‘সুন্দরী! সুন্দরী!’ ছায়াটা নড়ে ওঠে। জলের গায়ে ছোট ছোট তরঙ্গ। মেয়েটি যেন বহু বছর পর তার নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনে জলাশয়ের বুকে ঢেউ তুলে জেগে উঠেছে। কে এই নারী? অসফল প্রেমের যন্ত্রণায় কি আত্মহত্যা করেছিল? কিংবা না খেতে পেয়ে? অথবা অবৈধ সন্তান গর্ভে ধারণ করে নির্বাসিত হয়েছিল সুন্দরীর জলায়? তারপর লোকালয়ে ফিরে যায়নি। হারিয়ে গেছে জলাশয়ে, খড়ের স্থূপে, অগণিত তারার প্রতিবিম্বের মাঝখানে। শুধু তার নামে নাম যে জলাভূমির, সূর্যাস্তের পর সেটি আতঙ্ক ছড়ায়। পথিককে দিগ্ভ্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। মরিয়ম জলাশয়ের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুন্দরী নামের কিংবদন্তি নারীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যে এই সমাজ-সংসারের একজন হয়ে বাঁচেনি। যার সব পরিচয় হারিয়ে গিয়ে লোকমুখে ঘোরে শুধু নাম। সেই রাতের শেষ প্রহরে মরিয়ম আর সুন্দরী–একজন হু-হুঁ করে কাঁদে, আরেকজনের হাসির প্রতিধ্বনি হয় শূন্য চরাচরে। কে হাসে, কে কাঁদে–আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় না।

আর মন্টু! বড় বোন পাশে থাকা সত্ত্বেও যে সুন্দরীর জলায় পথ হারিয়ে বেহুঁশ হয়, দুদিন ধরে মুখ দিয়ে গাঁজলা তোলে, সাত দিন জ্বরে ভোগে, এর মাত্র তিন বছর পর তাকে এই জলাভূমি, খড়ের স্তূপ, আলেয়ার আলো, ঘরবাড়ি, শস্যখেত আর মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যুদ্ধে যেতে হয়েছিল, রক্ত দিতে হয়েছিল।

০২. মরিয়ম ওরফে মেরি

 

দেব দেব দেব দেব/ রক্ত রক্ত রক্ত দেব।
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো।

মরিয়মদের বাসার সামনের চিপা গলিতে ঝড়ের বেগে ঢোকে সর্পাকৃতির একটি মিছিল। লোকগুলোর হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা, খাটের স্ট্যান্ড। হঠাৎ মিছিলের পেট চিরে হাঁপাতে হাঁপাতে দুটি ছেলে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ে। ‘মন্টু বাড়ি চলে গেছে,’ মরিয়ম তা বলামাত্র তারা আরেক দৌড়ে ফিরে গিয়ে মিছিলের লেজটাকে ধরে। এ সময় মিছিলের অগ্রভাগে চোঙায় ঝংকার ওঠে, ‘তোমার আমার ঠিকানা,’ সঙ্গে সঙ্গে লেজে আছড়ে পড়ে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’র কুলভাঙা ঐকতান। মরিয়ম যেন নদীতীরের নিঃসঙ্গ গাছ, মাটি ভাঙনের আবেগে থরথরিয়ে কাঁপছে। যে সংগ্রাম আর সবার স্বাধীনতার, তার জন্য বন্দিত্বের। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। অফিস-আদালত হয় কি হয় না। সে নিজে বিএ পাস দিয়ে ঘরে বসে আছে। দেশের এ পরিস্থিতিতে চাকরির খোঁজে বেরোলে লোকে পাগল ভাববে। অবশ্য চাকরিবাকরি তার বর্তমান সমস্যার সমাধানও নয়।

মরিয়মের ইচ্ছে হয়, মিছিলের ছেলে দুটিকে ডেকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘরে বসায়। প্রেসিডেন্ট ভবনের আলোচনা কতদূর, আমরা কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসতে পারব, না যার যা আছে তা-ই দিয়ে যুদ্ধ করে নিজেদের ন্যায্য পাওনা আদায় করতে হবে–এসব জানার জন্য নয়। সে আসলে তাদের কাছে। আবেদের খবর জানতে চায়। লোকটা কি আজ আসবে না? মরিয়মের যে তার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। সেসব জানানোর জন্য মানুষ তো মানুষ, পাখিদেরও এখন তার পক্ষে দূত ভাবা সম্ভব। কারণ মেরি ওরফে মরিয়মের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত চাওয়া ছিল–আর দশটা মেয়ের মতো নানান বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তার যেন একটা নিজস্ব জীবন হয়, যাতে সময়মতো মা হয়ে স্বামীর সংসার করার নিশ্চয়তা থাকে। এদিকে সর্পাকৃতির মিছিলটা তখন গলি কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেছে। মরিয়ম জানে, নদী-শাখানদী সব মিলে যেমন সাগরে পতিত হয়, এটিও তেমনি আর সব মিছিলের সঙ্গে পল্টন ময়দানে গিয়ে পড়বে। যদিও শুরু থেকে শেষতক কোনো মিছিলে সে কখনো ছিল না।

উনসত্তর সালে মরিয়মদের বকশীবাজার কলেজ থেকে রোজ একটা করে মিছিল বেরোত। বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের স্রোতের তোড়ে সেও দু-তিনবার খড়কুটোর মতো ক্লাসরুম, কলেজের মাঠ থেকে ভেসে গেছে। একবার তাদের মিছিলটা বুয়েটের সামনের রাস্তায় পৌঁছানোর পর মরিয়মের পায়ের একপাটি স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। মিছিলটা যাবে ইডেন কলেজে। সে খালি পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে কিছুদূর। তারপর পলাশীর কাছাকাছি। আসতে সুযোগ বুঝে সটকে পড়ে। সেখানে এক মুচির কাছে স্যান্ডেল সারানোর সময়। মরিয়মের প্রথম পরিচয় এসএম হলের আবসিক ছাত্র আবেদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। সেদিন মেরি মিছিল থেকে সটকে না পড়লে, আবেদ প্রায়ই বলত, তাদের হয়তো দেখাই হতো না, তারা যে যার জায়গায় থেকে যেত। উনসত্তর থেকে একাত্তর। এখন আবেদ বলে, ‘তোমার মতো মেয়েরা যখন ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে, রোদে দাঁড়িয়ে লেফট-রাইট করছে, গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে, তোমার মুখে খালি বিয়ে বিয়ে–জপ-তপ।’

কেন মরিয়ম বিয়ের কথা বলে–এখন তা বলতে গেলেও শুনতে চায় না আবেদ। মেয়েটিকে আবর্জনার মতো এড়িয়ে চলে সে।

সর্পিল মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেলে, মরিয়ম টিউবওয়েলের নর্দমার জলকাদা ডিঙিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। এখন তার ঘরে ফেরা উচিত, না আবেদের খোঁজে বেরোবে সে–তা বুঝতে না পেরে গলির মুখেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যত দূর স্মরণ হয়, মরিয়ম সেদিন বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই ছিল, যতক্ষণ না সামনের দোতলা বাড়ির জানালা খুলে দুটি জ্বলজ্বলে চোখ অন্ধকারে জ্বলে ওঠে। তার পরও খানিকটা সময় সে অসাড়, যেন এক জোড়া চোখ নয়, সে আটকে গেছে বন্দুকের গোলাকার রেঞ্জে। নড়ামাত্র গুলি। মরিয়ম লোকটাকে কখনো দেখেনি, তার ওই চোখ জোড়া ছাড়া। সে যে মেয়ে নয়–তা তার আন্দাজই কেবল। কারণ মন্টুর অনুপস্থিতিতেই লোকটা তাদের বাসার দিকের জানালা খুলে ওই বন্দুক চোখে মরিয়মের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন গলিতে একটা মিছিল ঢুকল তো শাট শাট কপাট বন্ধের আওয়াজ। মন্টু বলে, লোকটা খুনের আসামি, না হয় চোর। কদিন আগে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের তালা ভেঙে ৩২৫ জন কয়েদি যে পালিয়েছে, সে হয়তো তাদেরই একজন। তবে লোকটা দালালও হতে পারে। বাড়ির মালিক হাজি সাহেব ব্রিটিশ আমলের মুসলিম লীগার। নির্বাচনের সময় আওয়ামীপন্থি ছেলেকে সপরিবারে তাড়িয়ে দেওয়ার পর মাঝখানে কয়েক মাস দোতলাটা খালি পড়ে ছিল। এখন তো দেশের নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষ আওয়ামী লীগ করে। তাই দোতলাটা ভাড়া দিয়ে বাড়িতে শত্রু তোলেননি তিনি। মরিয়ম ভাবে, হাজি সাহেবকে একদিন বললে হয়–তার নতুন ভাড়াটে মেয়েলোকের দিকে তাকিয়ে থাকে কেন! সে লোকটার বেলাল্লাপনার শাস্তি দাবি করবে। কিন্তু হাজির বাড়ির মহিলারা তো পর্দানশিন, যদি উল্টো নসিহত শুনে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়! এমনিতেই হাজি সাহেব মন্টুর ওপর মহা খাপ্পা। নির্বাচনের সময় সে হাজির বাড়ির চুনকামহীন খড়খড়ে দেয়ালে নৌকার চিকা মেরেছে। কিন্তু মন্টু চিকা মারুক, মেরি তো মারেনি। সে কখনো রিকশার চাকার হাওয়া ছাড়েনি, বাসে আগুন ধরায়নি, পুলিশের গায়ে ঢিল ছোড়েনি। তখন যদি হাজি বলেন, ‘তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি তো একজন কলেজছাত্রী, শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক। আমারে ভেঙে কও দেখি, তুমি পাকিস্তানের অখণ্ডতা চাও, না ভারতের দালালি করে দেশটা ভাগ হোক–হেইডা চাও?’

এখন তো দাঁড়িপাল্লার দুদিকে নব্বই ডিগ্রি কোনাকুনি এই দুই পক্ষের অবস্থান। হাজি সাহেবদের পাল্লায় মণ মণ ওজনের বাটখারা চাপালেও মন্টুদের পাল্লার সমান। হবে না। তাই তিনি একরকম ঘরবন্দি থেকে দল ভারী করার জন্য একটা প্যাচা ধরে দোতলায় রেখে দিয়েছেন। কিন্তু এসবের মধ্যে মরিয়ম কোথায়? আজ মন্টু চলে যাওয়াতে সে পক্ষ-নিরপেক্ষও হয়ে পড়েছে। এই ভাবনাটা তাকে বিচলিত করে। বুকে কাঁপন ধরায়। এখন যে যেখানেই থাকুক, যার যা আছে, তাই নিয়েই সশস্ত্র। মরিয়ম সশস্ত্র হওয়ার জন্য গেটের পাশের বেড়ার খুঁটি ধরে টানাটানি জুড়ে দেয়। কাজটা যত সহজ ভেবেছিল, ততটা নয়। ঘুণে ধরা বাঁশ যেন মাটিতে শিকড় গেড়েছে। ভাঙবে তবু উঠে আসবে না। সে খুঁটি ওপড়ানো ছেড়ে বাড়ির ভেতর চলে যাওয়ার কথা ভাবে একবার। পরক্ষণেই অনুভব করে পিঠের ওপর বন্দুকের সেই গোলাকার চাকতি। গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে টান দিতেই যখন বাঁশটা মাঝখানে ভেঙে হাতে চলে আসে আর মাটিতে পড়তে পড়তে সে টাল সামলে উঠে দাঁড়ায়, তখন দোতলার জানালার জমাট অন্ধকার হাসির তাণ্ডবে খান খান হয়ে যায়। হাসির শব্দে বোঝা যায়, কে হাসে। হায়েনাও তো মানুষের মতো হাসে। কিংবা মানুষ হায়েনার মতো। মরিয়ম এইটুকু ভাঙা-বাঁশ দিয়ে কী করবে? দোতলার জানালা ছুঁতে গেলেও তো আস্ত একটা বাঁশ দরকার। তা বলে বাঁশের টুকরাটা ফেলে দিলে হাত একদম খালি। মরিয়মের ভয় হয়, তারপর সে শুধু নয়, তাদের এই ছোট্ট বাড়িটাও ওই জানালার দখলে চলে যাবে।

ভয়টা মরিয়মের রক্তেই ছিল।

’৬৪ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা এবং ’৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুরা যখন ঝাঁক বেঁধে ভারতে চলে যাচ্ছিল, তখন মেরি-মন্টুর আব্বা পানির দরে রায়ের বাজারের এই জায়গাটা কেনেন। শহরের জমি-জিরাতের ওপর কোনোকালেই তার তেমন লোভ ছিল না। বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফা দেশভাগের পর থেকে হিন্দুদের জমিজমা বেচা-কিনি করে তত দিনে লাখপতি। তিনি জোতদার ভগ্নীপতিকে উপদেশ দেন–এক বছরের পাট বেচার টাকা দিয়ে শহরে যেহেতু জমি পাওয়া যায়, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তার তা করা উচিত। তা ছাড়া একমাত্র ছেলে লেখাপড়া শিখে তো হাল-বাওয়ার জন্য গায়ে পড়ে থাকবে না! তাদের আব্বা কৃষক মানুষ। মাটির সঙ্গে তার নাড়ি-বাঁধা সম্পর্ক। সেই মাটি ফলনশীল, উর্বর। শুরুতে তাই দোনামনা করছিলেন। কিন্তু কেনার পর, চারদিক থেকে দালানকোঠায় টুটি চেপে ধরা জমিটার ওপর তার মায়া পড়ে গেল। জমির প্রাক্তন মালিক ভারতে চলে গেছে। তার পরিত্যক্ত ভঁই এখন শত্ৰু-সম্পত্তি। কোর্ট-কাছারির সিংহভাগ মামলা তখন এসব জমিজমাসংক্রান্ত। বড় শ্যালকের শহুরে জারিজুরির ওপর কোনোকালেই তার তেমন আস্থা ছিল না। তাই অপরিচিত, অনুর্বর, নিষ্ফলা জমি দখলে আনার জন্য নিজ গ্রাম ফুলতলি থেকে দুজন কামলা এনে টিনের চালের দুই কামরার একটি ঘর তড়িঘড়ি বানিয়ে ফেলেন। দেয়াল ইটের গাঁথুনির, চুনকামহীন। ঘরের সামনে গাঁও-গেরামের ধাঁচে ভোলা আঙিনা, পাশে রান্নাঘর, পেছনে বাঁশঝাড়। বাকি দুই ভিটেই খালি, যেখানটায় ফুলতলি গাঁয়ে হলে গোয়ালঘর ও বৈঠকখানা উঠত। উঠানের মধ্যিখানে টিউবওয়েল, তার পাশে টিনের বেড়ার গোসলখানা। সেখানে নদীর ঘাটের অনুরূপ একটা ভারী তক্তা ফেলা হয়েছে বসে বসে গায়ে জল ঢালার, কাপড় কাঁচার জন্য। বাঁশের পাটাতনের ল্যাট্রিনটা বসেছে বাঁশঝাড়ের পাশে। এর তিন দিক চাটাই ঘিরে প্রবেশপথে চটের পর্দা টাঙানো হয়েছে। সবশেষে পুরো চার কাঠা জমি ঘিরে ফেলা হয়েছে মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে। রাস্তার দিকে মুখ করা কালো লোহার গেট। তার ওপর সাদা রং দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা–এই জমির মালিক কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়। বহুদিন নেমপ্লেটে বাড়ির নম্বর ছিল না। বোতলপড়ার মাধ্যমে বাড়িবন্ধ করতে গাঁয়ের এক মৌলবিকে রাহা খরচ দিয়ে শহরে আনা হয়েছিল। সে বাড়ির চার কোনায় চারটি বোতল পুঁতে যায়। এভাবে ফুলতলি গাঁয়ের কফিলউদ্দিন আহমেদ জিন-ইনসানের নজর আটকিয়ে দু’কামরার আধা-শহুরে বাড়ির নিরঙ্কুশ মালিক হন। তারপর বছর খানেক বাড়িটা যে খালি পড়ে ছিল, ভাড়া দেওয়া হয়নি, তা এই কারণে যে, অপরিচিত-অনাত্মীয় লোকজন কটা টাকার বিনিময়ে প্রকারান্তরে বাড়ির মালিক হয়ে বসুক, তিনি সেটি চাননি। বাড়িটা হয়তো খালিই পড়ে থাকত, যদি-না মরিয়ম এমন একটা কাজ করে বসত, যা পরে বড় আর ভয়ংকর হবে, তা না ভেবেই।

মরিয়ম তখন খুব ছোটও নয়, বড়ও নয়, ক্লাস টেনের ছাত্রী। প্রতিবছর একদল ছাত্র দূরদূরান্ত থেকে তাদের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আসত। এক মাইলের ভেতর থানা শহর। সেখানকার হাইস্কুলের দোতলা দালানঘরে আর প্রাইমারির টিনের ছাপরায় পরীক্ষার সেন্টার পড়ে। সেবারও তারা আসে। পরীক্ষার বিরতিতে লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পুকুরের মাছ ধরে আর দিনান্তে হাটে যায়। সিজনের প্রথম আম, ছোট ছোট কোয়ার কাঁঠাল, বিস্কুট, মিষ্টি নিয়ে ফেরে। খাওয়া-থাকা বাবদ গৃহকর্তাকে টাকা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই সবাই মিলে পুকুরের মাছ ঘরে তুলে, বাজারের টুকিটাকি জিনিস কিনে এনে খানিকটা পুষিয়ে দিতে চাইত। পরীক্ষার্থী একজনের প্রথম দিন থেকেই মরিয়মের পড়াশোনার দিকে নজর খুব। দু’বেলা খাওয়ার সময় ভেতর-বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে মরিয়মকে বলত, অঙ্কে লেটার মার্ক তুলতে হলে পাটিগণিত, জ্যামিতিতে ভালো হলে চলে না, বীজগণিতই আসল। ছেলেটা আবার তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নাম জসিম। জসিমুল হক। পরীক্ষার শেষ দিন জসিমুল হক মরিয়মকে সিনেমা দেখার প্রস্তাব দেয়। আব্বা বাড়ি নেই। ঢাকায় বাড়ি বানানো নিয়ে ব্যস্ত আছেন। মাকে না বলেই মরিয়ম জসিমের সঙ্গে সিনেমা দেখতে কাছের জেলাশহরে যায়। বাড়ি ফেরে তিন দিন পর। ছেলেটি ভয়ে পথ থেকেই লাপাত্তা। তারপর প্রথম প্রথম বাড়ির লোকজন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গ্রামদেশে কলঙ্ক শিমুল তুলোর মতো বাতাসে ছড়ায়। যখন বাবা-মা বুঝলেন যে, দেদার খরচা করলেও মেয়ের এখন বিয়ে হবে না, তখন শহরের বাড়িটার কথা তাদের মনে পড়ে। মরিয়ম শহরে চলে যাক, লেখাপড়া করুক, গ্রামের লোকেরা বেশিদিন কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। ক’বছর বাদে তারা এসবও ভুলে যাবে, তখন মেয়ের বিয়ে দিতে কোনো সমস্যাই হবে না। বুদ্ধিটা আসলে কফিলউদ্দিন আহমেদের বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফার। জমির দালালি করে করে মানুষের মনের অন্ধিসন্ধি তার জানা হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তার আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। মরিয়ম তত দিনে ম্যাট্রিক পাস করেছে ফার্স্ট ডিভিশনে, বীজগণিতের সূত্র মুখস্থ করে অঙ্কে সে লেটার মার্কও পায়। যে বাড়ি একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বানানো হয়েছিল, তার উদ্বোধনটা হয় মেয়েকে দিয়ে। মন্টু ফাউ–বড় বোনকে পাহারা দিতেই। তার ঢাকা শহরে আসা।

শহর আক্রান্ত হওয়ার আগমুহূর্তে পাখিরাও যখন নীড় ভেঙে পালাচ্ছে, সে সময় পাহারাদার মন্টুকে বাড়ি পাঠিয়ে, ঘুণে-ধরা ভাঙা বাঁশ হাতে ঘরে ঢোকে মেরি। তাদের বাড়িটা গাঁয়ের নাম-ঠিকানা আর শহরের বাড়ির আধাআধি চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলতলি গাঁয়ের কলঙ্ক রটানোয় ওস্তাদ লোকগুলোর চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য গত পাঁচ বছর তাকে এখানে রাখা হয়েছে। তারপর তাদের ভুলো-মনের সুযোগ নিয়ে তার বিয়ের আয়োজন করা হবে। মরিয়ম তা জানে। যে-কেউ চৌকাঠে দাঁড়ালে তা আন্দাজ করতে পারে। বাড়িটা যেন পান্থনিবাস। এর দু’কামরায় আসবাব বলতে দুটি খাট, একখানা আলনা, পড়ার টেবিলের দু’পাশে দুটি হাতলবিহীন সস্তা কাঠের চেয়ার। আবেদ এলে চেয়ারে না-বসে সরাসরি বিছানায় উঠে যেত। মন্টুও তাতে আপত্তি করত না। প্রথম দিন থেকেই সে তার রাজনীতির চ্যালা বনে গিয়েছিল। আবেদ ভাই, আগরতলায় কি সত্যই একটা ষড়যন্ত্র হইছিল? মোনেম খান নাকি আইয়ুব খানের ভাতিজা? মন্টুর এমন সব বোকা বোকা প্রশ্নে ছাত্রনেতা আবেদ কখনো ধৈর্যচ্যুত হয়নি। বরং সে উত্তেজিত, উদ্দীপ্ত, যেন তার সামনে পল্টন ময়দানের হাজার হাজার শ্রোতা, গলাটা একলাফে আকাশে চড়ে যেত। মরিয়ম তখন ঘর-বাহির করেছে। সে শঙ্কিত একদিকে মন্টুকে নিয়ে, রাজনীতি মাথায় ঢুকে পড়াশোনা যার লাটে ওঠার জোগাড়; অন্যদিকে তার চোখ দুটি চরকির মতো ঘুরত চারপাশের বাড়ির জানালা অলিন্দে। এ বাসায় তৃতীয় ব্যক্তির আনাগোনায় লোকজনের চোখ টাটায়, কানগুলো যেন সারি সারি বন্দুকের নল, এদিকে তাক করা থাকে। তখন আবেদের সময়-অসময় আসা-যাওয়া মরিয়ম ঠেকাতে পারেনি। যদি সে হাতছাড়া হয়ে যায়! তার কাছে বন্ধক দিয়ে ফেলেছে তো নিজেকে! ফেরার পথ নেই। কতবার ফেরা যায়?

জসিমুল হক মহুয়া সিনেমা হলে ইংরেজি মুভি দেখতে দেখতে আবেগে তার হাত চেপে ধরেছিল। ওরা যে রিয়ালে, খেয়াল ছিল না। পাশের সিট থেকে গাঁয়ের একজন সিটি বাজালে তাদের আর বাড়ি ফেরার সাহস হয় না। তিন দিন পথে পথে ফেরা। জসিমের চাকরি থাকলে হাত ধরার খেসারত হিসেবে তারা কোর্টম্যারেজ করত, মেরিকে একা গায়ে ফিরতে হতো না–এই কথা জসিম ইংরেজিতে বলেছিল। তার পাণ্ডিত্যে মরিয়ম তখন মুগ্ধ। এমন গুণী ছেলে তার পনেরো-ষোলো বছরের জীবনে দ্বিতীয় আরেকটিও দেখেনি। মরিয়ম জসিমুল হকের কথা বিশ্বাস করেছিল।

বাড়ি ফেরা ছিল এই কিশোরীর স্বর্গ থেকে পতন। সেই এক বছরেই সে বড় আর বয়স্ক হয়ে ওঠে। পুরুষের প্রতি ভালোবাসা বুঝতে-না-বুঝতেই অকালে ঝরে যায়। সাধারণ বিষয়েও মনে সংশয় জাগে। শুধু বোঝে যে, বিয়ে হলো নারীজীবনের একমাত্র সফল পরিণতি, বাকি সব মিথ্যা। বিদ্বান প্রেমিক সুন্দর সুন্দর কথা বললেই কী, বিয়ে করার তো মুরদ ছিল না। এর ফলে জসিমুল হক লজ্জা-ঘেন্নার কাঁথা-প্যাঁচানো রক্তাক্ত জ্বণের পিণ্ড যেন, অচিরেই তার হৃদয় থেকে আবর্জনায় নির্বাসিত হয়। মরিয়ম ঢাকা আসে পঙ্কে সাঁতার কাটার পর পালক-ঝাড়া শুভ্র হংসিনীর মতো। উপমাটা আবেদের। কলেজ ড্রেসে মরিয়মকে প্রথম দিন দেখে তার নাকি সেরকমই মনে হয়েছিল। পরে সব শোনার পর বলেছে সে। কিন্তু মরিয়মের মনে তখন অন্য ভাবনা। জসিম ছিল সম্ভাবনাময় চারা গাছ, আর সে মনে করে আবেদ হচ্ছে আগামী সিজনে ফল দেবে, এমন এক পরিণত বৃক্ষ। সুযোগ পেলে তাতে চড়ে বসা যায়। তারপর আবেদ ফল যা ফলাবে, সব মরিয়মের। সেইমতো ‘৬৯-৭০, এই দুই বছর আবেদ স্বপ্ন দেখায়, মরিয়ম দেখে.. ’৬

তখন মিছিল-মিটিংয়েও বড় বড় প্রতিশ্রুতি। সেসব এক জায়গায় জড়ো করলে ডজন ডজন উঁচু পাহাড় হয়। পাহাড়গুলো সব বঞ্চিত মানুষের স্বপ্নের। এ দেশের মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি হরেক কিসিমের লাঞ্ছনার-বঞ্চনার শিকার হয়। এর কারণ যে অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী, দেশভাগের পর থেকে তারা তা একটু একটু করে শুনে আসছিল। এবার হাতে-কলমে বোঝাপড়া। পশ্চিম পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে উত্থিত অজগর ভারতের বিশাল ভূখণ্ড ডিঙিয়ে এখানে যে ছোবল মারছে, সচিত্র পোস্টার দেখে তারা এর বিষযন্ত্রণা অনুভব করে। বক্তৃতাগুলো রূপকথার মতো আকর্ষণীয়। সোনার বাংলা লুণ্ঠন করে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তাঘাট সোনার পাতে মোড়া হচ্ছে, সে দৃশ্য শ্রোতাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাকিস্তানটা যেন দেশ নয়, গাভি একটা। তার সামনের দুই পা পূর্বে, পেছনের দুই পা পশ্চিমে। বাঙালিরা রোজ একে ঘাস খাওয়ায়, আর দুধ দুইয়ে নেয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শতকরা ৬০ ভাগ রাজস্ব আয় করে পূর্ব পাকিস্তান, খরচ করতে পারে মাত্র ২৫ ভাগ। বাকিটা যায় পশ্চিম পাকিস্তানের উদরে। সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি, জিনিসপত্রের দাম কম। ‘৭০-এর নির্বাচনী পোস্টারে বৈষম্য আর শোষণের পাই-পাই হিসাব সংখ্যাচিত্রের আকারে ছাপা হয়। মরিয়ম নিজে যেন বঞ্চিত দেশমাতৃকা আর আবেদ হচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল নেতা। সে মেয়েটির উদ্ধারের স্বপ্লবীজ ফুলার রোড থেকে শহিদমিনার, কার্জন হল, রমনাগ্রিনের লেকের গায়ের ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছড়াতে ছড়াতে যায়। আবেদের সমাজবিজ্ঞানে এমএ দেওয়া হয়ে গেছে, এখন চাকরি পেলেই বীজ থেকে গাছ হবে। ‘৭১ সালটা বারুদের গন্ধ নিয়ে আসে। মরিয়মের স্বপ্নগুলো পাখি হয়ে উড়ে যায়। এখন ডামি রাইফেল হাতে ট্রেনিং নেওয়া ছাড়া আবেদকে আর কিছু বলতে শোনা যায় না।

‘৬৬ থেকে ‘৭১-এই পাঁচ বছরে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। ঘোলাজলের পাঁকে পাঁকে জটিল আবর্তও সৃষ্টি হয়েছে। মরিয়ম তখন ছিল কিশোরী। জসিমুল হক শুধু তার হাত ধরেছিল। তার জন্য গ্রাম থেকে তাকে শহরে চলে আসতে হয়। এখন আবেদ আর মরিয়মের সম্পর্ক গড়িয়েছে বিছানা পর্যন্ত। প্রথম প্রথম এসএম হল আর বুয়েটের মাঝখানের দু’সারি বড় বড় মেঘশিরীষের কারুকাজময় ছায়াতলে তারা শান্তই ছিল। পরস্পরের অংশীদারত্ব বলতে বুঝত একটা বাদাম ভেঙে একজন আরেকজনকে দিয়ে খাওয়া। ঢাকা ক্রমশ উত্তপ্ত হতে শুরু করে। আবেদের পড়াশোনা শেষ। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেলে বড় সাহেবরা ভাবেন, তারা প্রভু, যে চাকরি চাইতে এসেছে সে তাদের দাস। তখন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার থাবার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবিক এক স্বাধীন দ্বীপ। সেখানে সামরিক কি বেসামরিক কোনো আইনই কার্যকর ছিল না। এমন এক ভূখণ্ডের অর্ধযুগের স্বাধীন সার্বভৌম বাসিন্দা আবেদ। ইন্টারভিউ টেবিলে বড় সাহেবের প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে তার একটা করে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করে। তা নিবৃত্ত করতে গিয়ে সে আরো খেপে ওঠে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। মোটা হাবড়াদের সালাম ঠুকে, নতজানু হওয়া আর পোষায় না। সে লাইব্রেরি সায়েন্সে ভর্তি হয়ে স্বাধীন দ্বীপে বসবাসের মেয়াদ বর্ধিত করে। এর আগে কখনো-সখনো মিছিলে শ্লোগান দেওয়া কিংবা আইয়ুব খানের কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর সময় পেছন থেকে তালি বাজানোর মধ্যে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। এই পর্বে মিছিলের অগ্রভাগে সে চলে আসে। আগুনও ধরায় স্বহস্তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই স্বাধীন বাসিন্দা তার ক্ষুদ্র দ্বীপটিকে নিয়ে আর সন্তুষ্ট নয়। বড় সাহেবদের যারা আবার অধিকাংশই অবাঙালি, তাদের উচ্ছেদ করে, এর সম্প্রসারণের প্রয়োজন অনুভব করে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবেদ। শিরীষের ছায়ায় হেঁটে হেঁটে বাদাম খাওয়ার দিন ফুরিয়েছে। কিন্তু মরিয়মকে দরকার অন্য কারণে। বীরত্বের পাশাপাশি নারী-শরীরের দখল কায়েমও তার কাছে জরুরি হয়ে পড়ে। তখন হুডতোলা রিকশায় কালো পেড়ে সাদা শাড়ির বেড়া ভেঙে ব্লাউজের তলায় আঙুল চালিয়ে বীরের উত্তেজনা প্রশমিত হচ্ছিল না। এ যেন জ্বলন্ত মশাল হাতে কোথাও আগুন না জ্বালিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো। সঙ্গে আগুন আছে ঠিকই কিন্তু তা জ্বালানো যাচ্ছে না। তার জন্য, সম্পূর্ণভাবে মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য বিছানা চাই। সবকিছু এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে, মরিয়ম বেদিশা হয়ে পড়ে। সে নিজেও কদিন ধরে হুডতোলা রিকশায় সিক্ত হচ্ছিল। তার ভয় ছিল, প্রতিরোধ ছিল না। একদিন মন্টুর অনুপস্থিতির সুযোগে আবেদ ভরদুপুরে মরিয়মকে বিছানায় নেয়। যেখানে পা ভাঁজ করে বসে বছরাধিক সময় সে মন্টুকে রাজনীতির পাঠ দিয়েছে, মুহূর্তেই তা পাল্টে যায়। এলোপাতাড়ি ঝড়ের ভেতর মরিয়ম ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপছিল। বুঝতে পারছিল না, বিয়ের আগে এসব করা ঠিক হচ্ছে কি না। তা ছাড়া মন্টু যে-কোনো সময় চলে আসতে পারে। এবার মরিয়মের ভয়, প্রতিরোধ দুটোই ছিল। প্রতিরোধের ফলেই হয়তো পুরো ব্যাপারটা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। বিছানা রক্তে ভাসিয়ে আবেদ যেন তক্তপোশ থেকে নয়, মঞ্চ থেকে মেঝেতে পদার্পণ করে।

রক্ত ঝরার ভেতর দিয়ে আত্মসমর্পণের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। মরিয়ম অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আবেদকে শুধু প্রেমিক ভাবা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। স্বামীই ভাবতে হচ্ছে। যদিও নিজের জন্য একটা চাকরি, বাসা, বউ, বাচ্চা–এসবের মধ্যে আবেদ আর নেই। ক্ষমতা, রাষ্ট্র, আন্দোলন নিয়ে এখন তার কারবার। কথাও বলে শুধু এসব বিষয়ে। এমনকি তাদের সংক্ষিপ্ত শয্যায় মরিয়ম যখন জোঁকের মতো তাকে আঁকড়ে ধরে, যা বাহ্যত গভীর আলিঙ্গন, তখনো।

মরিয়ম-আবেদের শরীরী সম্পর্কের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রথম কটি সপ্তাহ আবেদ ছিল দিশাহারা। মরিয়মের কাছে এলে মন পড়ে থাকত বাইরে, আর বাইরে থাকার সময় মনটা থাকত মরিয়মের কাছে। একদিকে দেশ, আরেক দিকে নারী। দুজনেরই গা থেকে তত দিনে পোশাক সরে গেছে। কামজ্বরে ফুটছে তার সামনে দুটি নগ্ন শরীর। কোথাও যেন স্বস্তি নেই। মনহীন শরীরটাই তখন তার রাতদিনের সঙ্গী। তাই শরীরের উপস্থিতি শুধু প্রকট হয়ে ওঠে বিছানায়, রাজপথে সর্বত্র। ক্রমে মরিয়মের কাছ থেকে শরীরটা তুলে নিয়ে, মনের সঙ্গে শরীরের সমন্বয় সে ঘটায় বাইরে। যার বিস্তার ৫৬ হাজার বর্গমাইল, সম্ভাবনাও প্রচুর। সেখানে কয়েকটা শব্দের বা সংকেতের যেমন, গাঢ় সবুজের বুকে লাল টুকটুকে সূর্য, সূর্যের মাঝখানে সোনালি মানচিত্র আঁকা পতাকার, জাতীয় সংগীতের আর স্বাধীনতার কী দুর্মর আকর্ষণ! ভাগ্যের অজুহাতে নিজেদের দুর্দশাকে আর মেনে নেওয়া যায় না। অতীত ভোজবাজির মতো ধুলায় মিলিয়ে যাবে, তারপর যা হবে, সব ভবিষ্যতের জঠরে। এর মাঝখানে আছে লড়াই। এক অসম যুদ্ধ-ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনের; ট্যাংক, কামান, রকেট, বিমান আর মেশিনগানের বিপরীতে বোমা, পটকা, লোহার রড, মলোটভ ককটেল, টু-টু বোর রাইফেল, টেটা, বল্লম আর লাঠি। ঘরোয়া হাতিয়ারগুলো বিদ্রোহীর করতলের উত্তাপে ঝলকায়। কে কাকে সামনে টানে, উত্তেজনা জোগায়–বিদ্রোহী, না তাদের হাতের অস্ত্র-অস্ত্রধারীও জানে না। উভয়ে এতটাই বেপরোয়া।

আবেদকে আর চেনা যায় না। কখনো-সখনো তার সঙ্গে মরিয়মের এখন দেখা হয়। বাকি সময় মেয়েটার কাটে এক অদ্ভুত ঘোরে। থেকে থেকে চমকে ওঠে সে। ফুলতলি গায়ে বাবা-মার কাছে ফেরার পথ নেই। তার সামনে রয়েছে বাঁচা-মরার সমতুল্য এক অগ্নিপরীক্ষা।

তখন দেশের সামনেও কঠিন পরীক্ষা। মন্টু চলে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘মেরিবু ঠিক আছে আমি যামু তুইও চল, সামনে যুদ্ধ।

‘যুদ্ধ তো কী? করবে তো আবেদরা।’ সেদিন মরিয়মের কথার পিঠে মন্টু আর কথা বলেনি। বোন আর দু-চারটা দিন ঢাকায় থাকতে চাচ্ছে–থাকুক। কফিলউদ্দিন। আহমেদ যখন নিতে আসবেন, তখন বাপ বাপ করে ঠিকই যাবে। তারপর বাড়ি যাওয়ার অন্যতম শর্ত হিসেবে রেডিওটা সঙ্গে নিয়ে যায় মন্টু।

আজকে ঘরে রেডিও নেই, মন্টুও নেই। অন্যদিন ঘরে-বাইরে পাল্লা দিয়ে শোরগোল চলত। এমনকি কারফিউর সময়ও সারা রাত তাদের গলির তস্যগলিতে

মিছিল। গুলি হচ্ছে জেনে, মানুষগুলো যেন আরো বেশি করে কারফিউ ভেঙে মিছিল করে গুলি খায়। এক কারফিউর রাতে ঝড়ে ঝাঁপটা খাওয়া কাকের মতো আবেদ উপস্থিত। মন্টু তো অবাক। ‘আরে আবেদ ভাই, এত রাইতে? বাইরে না কারফিউ, আসলেন ক্যামনে?’ আবেদ আর ঘরে ঢোকেনি। ‘তোমরা কেমন আছো দেখতে আসলাম।’ বলে মরিয়মের সঙ্গে দেখা না করেই বাইরে থেকে চলে যায়। আজ তো কারফিউ নেই, মন্টুও নেই। আবেদ কি আসতে পারে না? একবার এসে পড়লে আজ আর বাইরে থেকে চলে যেতে হতো না।

গেট নাড়ার শব্দ শুনে মরিয়ম বেরিয়ে আসে। বাতাসই হয়তো অথবা কানের ভুল। তার যত দূর চোখ যায়, একটা কুকুর ছাড়া, গলিটা একদম সুনসান। কুকুরটাকে হাজি সাহেবের বাসার সামনের লাইটপোস্টে বেঁধে রাখা হয়েছে পাহারা দেওয়ার জন্য। মরিয়ম ঠিক করে, বাইরে দাঁড়িয়ে আবেদের জন্য অপেক্ষা করবে। যদি সে আসে! যদি সে গেটে তালা দেখে ফিরে যায়। বাড়ির ভেতর তো মানুষ কি রেডিওরও সাড়াশব্দ নেই। মরিয়ম গেটের মুখটায় এসে দাঁড়ায়। ঠিক তখন হাজির বাড়ির দোতলার জানালাটি ফের মটমট করে খুলে যায়। এই মাঝরাত্তিরে! লোকটার সাহস দেখি বহুৎ বেড়ে গেছে। আবার গলা খাকারিও দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।

সেই রাত্রিরে মরিয়ম বিছানায় একবার শোয় একবার উঠে বসে। অস্বস্তিতে মশারির দড়ি খুলে দেয়। পায়ের পাতায় বাতাসের সুড়সুড়ি। পর্দাটা উড়ে উড়ে জানালায় বাড়ি খাচ্ছে। লাইটপোস্টে বাঁধা কুকুরটা থেকে থেকে কেঁদে ওঠে। দু-চার বাড়ি পর আরো একটা কাঁদে। হাজির বাড়ির সামনের দড়ি-বাঁধা কুকুর যেন নেতৃত্ব দিচ্ছে। দূরের আরো দূরের শত শত কুকুরের করুণ কান্না রাতের বাতাস কাঁপায়, আতঙ্ক ছড়ায়। ফুলতলি গ্রামে মহামারির বছর কুকুর কাঁদত। মরিয়ম শুনেছে–মানুষের শোকে নাকি কুকুর কাঁদে। এই মাসে শতাধিক মানুষ গুলি খেয়ে মারা গেছে। আরো মরবে যদি যুদ্ধ হয়। কুকুরগুলো কি মৃতদের জন্য কাঁদছে, নাকি সংকেত দিচ্ছে–যুদ্ধ বাধার পর আরো মানুষ মারা যাবে! শহরের নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেট খুলে যুদ্ধ এসে মরিয়মদের বাড়ির চৌকাঠে বসে। একটুখানি জিরোয়। তারপর হামা দিয়ে ঘরে ঢোকে। যুদ্ধ মরিয়মের বিছানার চারপাশে নৃত্য করে। আগামী যুদ্ধে সে কি মারা যাবে, যুদ্ধ না করেও? আবেদ মরবে, না বাঁচবে? মন্টু গ্রামে চলে গেছে। একটা যুদ্ধাতঙ্কের রাত মরিয়মকে পাথর চাপা দিয়ে চলে যায়।

পরদিন শহরে জয় বাংলা পতাকার সাজ। রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোর মাথায় নতুন দেশের মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে উড়ছে। মরিয়মের রিকশার ঘণ্টিতে একটা ছয় ইঞ্চি পতাকা সুতো দিয়ে পাটখড়ির দণ্ডে বাঁধা। টুংটাং আওয়াজের ছন্দে হেলেদুলে নাচছে। স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা যদিও মরিয়মের সংকটের দাওয়াই নয়, তবুও মনে তার অশেষ আনন্দ। সে এসএম হলের গেটে নেমে ফেরিঅলার কাছ থেকে কিনে নেয় এক টাকায় দুটি পতাকা। এই তো টাকায় কেনা পতাকা–স্বাধীনতা, রক্তপাত ছাড়াই তার হাতে চলে এসেছে! সে স্বাধীনতার ঝান্ডা উড়িয়ে আবেদের কক্ষে প্রবেশ করে।

মরিয়ম চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতে এসএম হলে এসেছে। কিন্তু আবেদের ক্ষুব্ধ চেহারা দেখামাত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা দুটি তার হাতের মুঠোয় ভাঁজ হতে থাকে। পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। সে তালগোল পাকিয়ে খাটের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে। পড়ে। আবেদ সুস্থির হয়ে তাকালেই দেখতে পেত–রাত-জাগা মেয়েটি ভীষণ অবসন্ন, ভয়ে দিশাহারা, একটুখানি আশ্রয়ের জন্য তার কাছে ছুটে এসেছে। সেদিকে তার চোখ নেই। আজ ২৩ মার্চ। পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস রূপান্তরিত হয়েছে বাঙালির প্রতিরোধ দিবসে। সকালবেলা অনেকগুলো দূতাবাসসহ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জয় বাংলার পতাকা উড়িয়ে এলেও আবেদের মনের ওপর আশঙ্কার পাহাড়। পতাকা তো একখণ্ড কাপড়, ত্যানা। ওড়ানো-নামানো দুমিনিটের ব্যাপার। এদিকে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে অসংখ্য সেনা-সামন্ত এখন ঢাকায়। জলপথে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসছে। এসবের ভেতর শুধু শুধু কতগুলো দিন আলোচনার নামে সাবাড় হচ্ছে। মূল্যবান একেকটা দিন। এর দাম কে দেবে? রুমের মধ্যিখানের স্তূপ করা মশারির স্ট্যান্ড, লাঠি, রড, সুরকি, হাতবোমা বানানোর মশলার প্যাকেট–সব ধরে ধরে তার ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এ দিয়ে হবে যুদ্ধ! ৩২ নম্বরে গিয়ে শেখকে সরাসরি জিগ্যেস করা দরকার, তিনি এভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে কত দিনে দেশটা স্বাধীন করবেন। নাকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব ত্যাগ করতে পারছেন না, এত কিছুর পরও। তিনি জনগণকে বলছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আর নিজে প্রেসিডেন্ট ভবনে বসে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে মাছ কেনার মতো দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন।

আবেদ আর মরিয়মের মাঝখানে বসে পা দোলাতে দোলাতে রুমমেট সুমন নাটকীয়ভাবে বলে, ‘আবেদ ভাই, নেতারা যা-ই করুক, আমাদের কিন্তু পেছন হটার উপায় নেই।’

মরিয়ম ঘরে ঢোকার আগে কোনো কথার সূত্রেই হয়তো কথাটা বলেছে সুমন। যদিও পরিস্থিতি ততক্ষণে পাল্টে গেছে। ঘরে যে তৃতীয় ব্যক্তি উপস্থিত আরেকটি ঘোরতর সমস্যা নিয়ে, দু’রুমমেট তা গ্রাহ্যই করে না এবং করবে বলেও মনে হয় না। মরিয়ম তাই সুমনের কথার পিঠে তাড়াতাড়ি বলে, ‘আমারও পেছন হটার উপায় নেই।’

কথাটার অর্থ বোঝে একা আবেদ। তীক্ষ্ণ চোখে ঝট করে সে মরিয়মের দিকে তাকায়। সুমন ভেবেছিল, হেঁয়ালিই হচ্ছে, এ ছাড়া মেয়েটার কথার এমন কী অর্থ আছে যে, নেতার রেগে যেতে হবে? কিন্তু আবেদের জ্বলন্ত দৃষ্টি তাকেও বিদ্ধ করে। সে মানে মানে ঘর ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়।

আবেদ তখন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তোমার পেছন হটার উপায় নেই, কথাটার মানে কী?’

তার স্বরে চ্যালেঞ্জ ছিল, দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান ছিল। মরিয়মের গলা যেন একখণ্ড ভেজা কাঠ। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলে, ‘আবেদ, তুমি ভালো করে জানো, আমি কী বলতে চাই।’

‘না, আমি জানি না, কিছু জানতে চাই না।’ সে বসা থেকে চিৎকার করতে করতে উঠে দাঁড়ায়। ‘যা বলার খোলাখুলি বলো। এসপার-ওসপার হয়ে যাক।’

মরিয়মের ভয় লাগে। তবু মনে মনে হিসাব করে বলে, ‘এসপার-ওসপার আবার কী। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তার জন্য আমি তোমাকে দায়ী করছি না।’

‘দায়ী! কীসের জন্য দায়ী হব আমি? একহাতে তালি বাজে?’

আজকে আবেদের সঙ্গে কথা বলার জো নেই। সবকিছুর শেষ দেখতে চায় ও-মরিয়মের সঙ্গের সম্পর্কের, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের। সে আজ মারমুখী, যুদ্ধংদেহী।

মরিয়ম ভেতরে ভেতরে রিক্ত হতে থাকে। এখান থেকে বেরিয়ে কী করবে সে। কোথায় যাবে। আবেদের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকার শেষ চেষ্টাস্বরূপ সে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং নেওয়ারও প্রস্তাব দেয়। তাতে আগুনে যেন তেল পড়ে। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে আবেদ। ‘যুদ্ধ! যুদ্ধ করবে তুমি? যুদ্ধ কোনো ছেলেখেলা নয়। হাসপাতালে না গিয়ে এখানে আসছ কেন?’

‘হাসপাতালে যাব না তো বলেছিই!’ মরিয়ম ডাইনির মতো গোঁ ধরে। আবেদ তাকে বাসায় যেতে বললে, ও বলে, বাসায়ও যাবে না। ওখানে একা থাকতে তার ভয় লাগে। জানালা দিয়ে লোকটা এখন খালি তাকায় না, কী যেন ইঙ্গিত করে। দোতলার লোকটার দুঃসাহস নিয়ে মরিয়ম আরো কীসব বানিয়ে বানিয়ে বলতে যাচ্ছিল, আবেদ মাঝখানে চেঁচিয়ে ওঠে, মন্টু কোথায়? ওর মাথায় বাড়ি মারতেছে না ক্যান?

‘মন্টু বাড়ি চলে গেছে। আমিই বলে-কয়ে ওরে পাঠাই দিছি। তুমি তো আজকাল মন্টুর সামনে অস্বস্তি বোধ করো!’

মরিয়মের ইঙ্গিতময় কথায় আবেদের কী যেন মনে পড়ে। সংগ্রাম-আন্দোলনের বাইরের তুচ্ছ কিছু। একেবারে বাতিল করার মতোও নয় আবার। শরীর থাকলে এর খাঁই থাকবেই। হতাশার সমুদুরে ডুবে থাকা কামনা ফের ধীরে ধীরে মাথা তোলে। সে খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় তাকায়। সুমন ওখানে নেই। আবেদ এগিয়ে এসে। মরিয়মের বাহু ধরে কাছে টানে। মেয়েটি অসাড়। আবেদ বিরক্ত হয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘শহরের অবস্থা ভালো নয়, মেরি। তুমি দেশের বাড়ি চলে যাও।’

এ অবস্থায় দেশের বাড়ি যাবে মেরি! আবেদের কি মাথা খারাপ হয়েছে? মরিয়ম রাগ করার বদলে ছেলেটির কাছে একটুখানি দয়া ভিক্ষা চায়, ‘আবেদ, বাচ্চার কী হবে?’

আবেদ ঘরের এদিক-ওদিক দিয়াশলাই খোঁজে। কোথায় রেখেছে মনে করতে পারে না। ইন্টারভিউ দিয়ে তার একটা চাকরি পাওয়ার কথা ছিল। সেই যোগ্যতা দলে-মুছে গেছে বুটের তলায়। তাকে জুতার তলার দুর্গন্ধ শুঁকতে বলছে নাকি মেয়েটা! সে তো এখন অন্য মানুষ। সামনে নতুন দিন। দিয়াশলাই ঠুকে ঠুকে আবেদ সিগারেট ধরায়। তাতে টান দিতে দিতে মরিয়মকে জোর করে কাছে টানে।

মরিয়মের কিছুই আর বলা হলো না। একটা প্রলয়ংকরী মিছিলের ঘায়ে দুজন বিভক্ত হয়ে গেল। আবেদের হুঁশ ফিরেছে-সে তো পদানত এখনো। শত্ৰু এগিয়ে আসছে। সামনে যুদ্ধ। মারতে হবে, না-হয় মরতে হবে। মেরিটা একটা জোক। এখনো তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। যতই যন্ত্রণা হোক, রক্ত ঝরুক, জেঁকটাকে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

সে সময় এসএম হলের সামনের রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছিল–যার গতি ঝোড়ো হওয়ার বেগের। শ্লোগানে ছিল ধারালো শিলাবৃষ্টির তীব্রতা। শিরীষ অরণ্যের পাখিগুলো নীড় ছেড়ে উড়তে শুরু করে। আবেদ শাড়িটা গুছিয়ে পরারও সময় দেয় না। মরিয়মকে। ডানা ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে। তার হাতে লোহার রড। সুমন দৌড়ে এসে একগাদা লাঠি পাঁজাকোলে তুলে নেয়। গুজব রটেছে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনা ভেঙে গেছে। ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত । আবেদের রুমের স্তূপীকৃত হাতিয়ার মুহূর্তেই লোপাট হয়ে যায়। ছাত্ররা হল থেকে দৌড়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। মরিয়ম পদপিষ্ট হওয়ার ভয়ে অন্ধের মতো যা আঁকড়ে ধরে, তা একটা ঠান্ডা, সর্পাকৃতির লোহার রড। আবেদ কয়েক পা দৌড়ে হাত খালি দেখে পিছিয়ে আসে। মরিয়মের হাত থেকে রডটি ছিনিয়ে নিতে তার বল প্রয়োগের দরকার হয় না। তবু পেছন ফেরাটা যেন তার রাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং মরিয়মকে যে সে আর চায় না, কয়েক মুহূর্ত আগের সিদ্ধান্তটা, লোহার রড দু’হাতে চেপে ধরে ডামাডোলের ভেতর জানিয়ে দেয়। তারপর অস্ত্রটি যেন তার বাহুল্য লাগে, বা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সে ফেলে দেয় হাত থেকে। মিছিলেও যায় না। মরিয়মকে নিয়ে জনশূন্য হোস্টেল ছেড়ে রাস্তায় আসে। মেঘশিরীষের কারুকাজময় ছায়ার নিচে রিকশার জন্য দাঁড়ায়। মিছিলটা একবুক তরঙ্গ নিয়ে সরে গেছে। এর অস্পষ্ট কলধ্বনি ভেসে আসে যেন গহিন সাগরের মাঝখান থেকে। এর পরও শিরীষগাছের পাখিরা ভয়ে নীড়ে ফেরে না। চারদিক শূন্য। কোনো পথচারী কি যানবাহনও নেই। আবেদ আর মরিয়মের পায়ে পায়ে রাস্তাটা গিয়ে পলাশীতে পড়ে। সেখানকার ফুটপাতে প্রথম দিনের সেই মুচি জুতো সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে আজও বসে আছে। তার পাশেই একটা খালি রিকশা। মরিয়ম উনসত্তর থেকে একাত্তর, একটা আনন্দ আর বেদনাময় অধ্যায় সমাপ্ত করে রিকশায় উঠে বসে।

ঘরে ফিরে মরিয়মের কান্না কেঁদে কেঁদে বুক হালকা করার জন্য নয়। বুক পাখির পালকের মতো হালকা হলে তারপর কী? তারপরই তো যুদ্ধ। যুদ্ধ মানেই অনিশ্চয়তা। কে বাঁচে, কে মরে–ঠিক নেই। বিবদমান দু’পক্ষের আবেদ এক পক্ষ। যুদ্ধের সনাতন নিয়মানুসারে তার মারার এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আধাআধি। ধরা যাক সে বাঁচল, মরল না। একটা জীবন-মরণ সংঘর্ষ বাধার আগেই তো তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। মেরি পিতাহীন সন্তানের জননী হবে। যুদ্ধ না হলেও এই তার নিয়তি। সে ঘুমের বড়ির পাতাটা এক বসায় শেষ করে দেয়। ফলত বুধ-বৃহস্পতি দু’দিন, যুদ্ধ যে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে দোরগোড়ায়, সেটি তার দেখা হয় না। সেই সময়টায় নতুন করে জন্ম নেওয়ার জন্য মেরি ওরফে মরিয়ম যেন পুনরায় জ্বণাকৃতিতে ফিরে গিয়েছিল।

.

মেরি-মন্টুর খোঁজে পরপর দু’দিন দুজন লোক পাঠিয়েছিলেন গোলাম মোস্তফা। ভাগনে-ভাগনির তথ্য-তালাশ করতে মোস্তফার না আসার কারণ নিজের কাছা সামলাতেই তিনি তখন ব্যস্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা অথবা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর–দুটোর সম্ভাবনাই তখন আধাআধি। বাঙালিরা ক্ষমতাসীন হলে হিন্দুদের ভারত থেকে এসে জমিজমা, দালানকোঠা, ভিটেবাড়ি ফেরত চাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। তা তারা চাইতেই পারে। যদিও তাদের পরিত্যক্ত ডোবাখন্দে এখন বড় বড় ইমারত, কলকারখানা, কারো-বা বাসাবাড়ি। শখের বাগানবাড়িতে মক্তব বসেছে। দাঁতব্য চিকিৎসালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলছে নাটমন্দিরের নোনাধরা দেয়ালগাত্রে। পুকুর, বসতবাড়ি, পূজামণ্ডপ সমান করে ধানপাটের চাষ হচ্ছে। গোলাম মোস্তফার হাত দিয়ে এই চব্বিশ বছরে দেশভাগের নেতাদের স্বপ্নমাফিক হিন্দুস্থান বাস্তবিকই পাকিস্তান হয়েছে। স্বপ্নদ্রষ্টারা তো স্বপ্ন দেখেই খালাস, কবরে নিদ্রা যাচ্ছেন। এখন হিসাবের পালা এসেছে যখন, কৈফিয়ত দিতে হবে এমন একজনকে, যে আদতে এ বিষয়ে কোনো স্বপ্নই দেখেনি। গোলাম মোস্তফা ‘৭০-এর নির্বাচনের সময় গা-বাঁচাতে আওয়ামী লীগে ভিড়ে যান। চড়ে বসেন নৌকায়। মনটা পড়ে থাকে তীরে, নিজের হাতে গড়া পাকিস্তানে। তিনি যার স্বপ্নদ্রষ্টা নন, একজন সাচ্চা কারিগর। তার পরও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুটি মাস তাকে নৌকাতেই থাকতে হয়। কারণ জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের ১৬৭টিতে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের এখতিয়ার এখন তাদেরই। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাহ্যত তা ঠিক ছিল। মার্চের পয়লা তারিখ দুপুর একটায় ইয়াহিয়া খান রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন, যা ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ইয়াহিয়ার ঘোষণা শুনে ক্রিকেট ম্যাচের দর্শকরা যখন গ্যালারি ছেড়ে মাঠে নেমে পড়ে, গোলাম মোস্তফা নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েন পানিতে। তারপর আন্দোলন বিক্ষোভের চোটে তিনি আর তীরে উঠতে পারেননি। এ অবস্থায় বুধবার দিন ভাগনে ভাগনির কথা হঠাৎ তার মনে পড়ে। তিনি তিন ছেলেকে ডেকে তাদের খোঁজ নিতে বলেন। মেজো ছেলে হাবা সাজু, যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মরিয়মকে ছাড়া জীবনে কাউকে শাদি করবে না, সে-ই শুধু পিতৃআজ্ঞা পালনে রাজি হয়। সাজু হাজি সাহেবের বাসা পর্যন্ত ঠিক ঠিক আসে। তারপর কুকুর দেখে পড়িমরি পালায়। মেরি-মন্টুদের বাড়ির পঞ্চাশ গজের ভেতর উল্টে পড়ে থাকা এক পাটি স্যান্ডেল এর সাক্ষী। যদিও কিল-চড় দেওয়ার সময় গোলাম মোস্তফা কথাটা গ্রাহ্যই করেননি। সাজুর দোষ এইটুকুই যে, কুকুরটা যে লাইটপোস্টের সঙ্গে এক হাত দড়িতে বাধা, বেচারা ভয়ের চোটে দিনদুপুরেও তা দেখতে পায়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মামা তার সহকারীকে পাঠান। রাস্তায় আসতে আসতে লোকটা শহরে আর্মি নামানোর নানা প্রকার গুজব শোনে। সৈন্যদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ জেনারেল টিক্কা। সে গুলি ছুঁড়ে গাছের পাতাও রাখবে না। শহরটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। এর মধ্যে শোনা গেল, গেরুয়া পোশাকের সেনারা টহল দিতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। গোলাম মোস্তফার সহকারী ডানে-বাঁয়ে তাকায়, আগু-পিছু করে, তারপর খানিকটা এগোয়। এই করে করে পিলখানা পর্যন্ত সে আসে। তারপর ইপিআর ক্যাম্পের গেটে বালুর বস্তার গানপোস্ট দেখামাত্র সাহেবের ভাগনে-ভাগনির নাম ভুলে যায়। তখন তার জানের মায়ার সঙ্গে যুক্ত হয় চাকরি হারানোর আতঙ্ক। তবে জানে বাঁচলে মানুষের যে চাকরির অভাব হয় না, এই বিশ্বাস তাকে নির্ভয়ে গোলাম মোস্তফার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। আর তোতলাতে তোতলাতে বলে যে, খোকা-খুকু দু’জন অদ্য বৃহস্পতিবার বাদ জোহর দেশের বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু কার কাছ থেকে সংবাদদাতা এ তথ্য পেল? এ প্রশ্নের জবাব দিতে সহকারী অপারগ। মামার ধমক খেয়ে লোকটা রাস্তায় যা যা গুজব শুনেছে, সেসব সবিস্তারে বয়ান করে। গোলাম মোস্তফার বিক্ষুব্ধ মনটা তখন আশকারা পাওয়া, নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়া, শেষ পর্যন্ত তাকে না-বলে বাড়ি চলে যাওয়া ভাগনে-ভাগনির ওপর থেকে সরে গুজবের সোপান বেয়ে উঠতে চায় তীরে–চব্বিশ বছরের পুরোনো পাকিস্তানে। কিন্তু সেই পথে তখনো বাধা বিস্তর। ছাত্র-জনতা তখন। বড় বড় গাছ কেটে শুমার করছিল। তা দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। পথে-ঘাটে জলের ট্যাংক, সুয়ারেজ পাইপ টেনে এনে ফাঁকা জায়গাগুলো বুজিয়ে দেয় ইট দিয়ে। এসব জঞ্জাল সাফ করে সৈন্যদের শহরে ঢুকতে হবে।

গোলাম মোস্তফা অস্থির বোধ করছিলেন।

সে সময় স্বপ্নের ভেতর মরিয়মের শরীর থেকে রক্ত ঝরা শুরু হয়। তা ধাপে ধাপে। দুধদাঁত তোলা দিয়ে যার শুরু। থুতুর সঙ্গে জিবের নোনা স্বাদ জড়িয়ে থকথকে রক্তের দলা বাইরে আসে। সে মন্টুকে অঞ্জলি মেলে দেখায়। মন্টু নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে। তারপর দাঁতটা ফেলার জন্য ভাইবোন হন্যে হয়ে একটা ইঁদুরের গর্ত খোঁজে। ইন্দুর ইন্দুর, আমার বোনের বিশ্রী দাঁতটা নিয়া তোমার সুন্দর দাঁতটা দেও। ইন্দুর ইন্দুর–মায়ের চোখে বিস্ময়। মেয়েটার এত তাড়াতাড়ি মাসিক হলো! পেসাবের রাস্ত য় রক্ত! শরীর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় উষ্ণতা ঝরছে। কালো, খয়েরি, গোলাপি থোক থোক রং জমাট বাঁধে পায়জামায়। এটা কী অসুখ, মা? পায়ের কাছে শীত যে কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকাতে শুরু করেছে! এ সময় কাপড় ভাঁজ করে তলপেটে গরম সেঁক দিতে হয়। তাতে যন্ত্রণা কমে। হারিকেনের সলতে উসকে দিতে কাঁচের চিমনির ভেতর লম্বা জিহ্বা মেলে আগুন। গনগনে উত্তাপে এক টুকরো কাপড় মায়ের হাতে নিঃশব্দে পোড়ে। রক্তের স্রোত নালা উপচে গেট পেরিয়ে রাস্তা ভাসিয়ে পল্টন ময়দানে। জমা হয়। ওখানে বিশাল জনসভা। আবেদ মঞ্চে ওঠে। শ্রোতারা করতালি দেয়। মেরি বাচ্চা প্রসব করে। অবয়বহীন, রক্তপিণ্ড, বাবাছাড়া।

তখন যে বাস্তবতা, তা যুদ্ধের। প্রচণ্ড জোরে অদূরে একটা গোলা ফাটে। জানালার শার্সি ভাঙার ঝনঝন আর্তনাদে মরিয়ম ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তখনো সে চলাচলের শক্তিরহিত, চেতনাহীন। খাটের তলার জমাট অন্ধকার যেন কোল পেতে বসে রয়েছে। আরেকটা বোমা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে অবয়বহীন রক্তপিণ্ড পেছনে ফেলে মরিয়ম অন্ধকারের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ঢাকা তখন জ্বলছে।

০৩. অপারেশন সার্চলাইট

২৫ মার্চের রাতে ঢুকে পড়েছে মুক্তি। তা অন্ধকার-বেহুলার নিচ্ছিদ্র বাসর যেন, মনসার প্রতিশোধের উষ্ণ নিঃশ্বাসে যার মোম-বন্ধ ফুটোটা উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেরকম এক সুচ-ছিদ্র পথ দিয়ে কথা বলতে বলতে দুজন অসমবয়সি নারী সেই কালরাতে প্রবেশ করে। বয়স ছাড়াও তাদের মধ্যে মিলের চেয়ে গরমিলই বেশি। দৃষ্টিভঙ্গিতেও ফারাক বিস্তর। মরিয়ম তখন ছিল খাটের তলায় চেতনাহীন। কয়েকটা বোমার শব্দ ছাড়া সেই রাতের কোনো স্মৃতি নেই। মুক্তি দেখতে চাচ্ছে, মেরি ওরফে মরিয়মের রূপান্তর-পর্বটি, আটাশ বছর আগেকার এক যুদ্ধ যার পূর্বপরিচয় গা থেকে ছাল ছাড়ানোর মতো খসিয়ে গলায় বীরাঙ্গনার বকলেস ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আপন। মহিমায় সেটি কিছুদিন ঢং ঢং বেজেছে।

আটাশ বছর–সিকি শতাব্দীরও অধিক সময়। মুক্তির বয়সও এখন আটাশ। ছাত্র-জনতা যখন গাছের মোটা মোটা ডাল কেটে, পরিত্যক্ত জলের ট্যাংক জড়ো করে। ফুলার রোডের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছিল, সে তখন এসবের একশ গজের ভেতর মেডিক্যাল কলেজের গাইনি ওয়ার্ডে, মায়ের গর্ভের অন্ধকার বিবর ছেড়ে বেরোনোর পাঁয়তারা করছে। পরদিন সকালে তার জন্মের সময় মায়ের পাশে একজন বৃদ্ধা আয়া ছাড়া কেউ ছিল না। লেডি ডাক্তার রোগীর হাতে লেবার পেইনের ড্রিপ লাগিয়ে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর আগেভাগে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে যান। মুক্তির জন্মদিন যে ২৫ মার্চ না হয়ে ২৬ মার্চ সকাল পর্যন্ত গড়াল, মা বলতেন, এর আসল কারণ ডাক্তারের অনুপস্থিতি। বাকিটা আল্লাহর মর্জি। সেই রাতে প্রসববেদনায় কাতরাতে কাতরাতে ডাক্তারকে অভিশাপ দিলেও মা পরে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তির আব্বাকে করেননি। ২৭ মার্চ সাময়িকভাবে কারফিউ তুলে নিলে বাবা হাসপাতালে আসেন। বাইরে ততক্ষণে নরক গুলজার। মুমূর্ষ রোগীতে হাসপাতালের বেড ভর্তি। বারান্দায়, করিডরে পা ফেলা যায় না। আশপাশের কোয়ার্টার আর বস্তি থেকে বাক্স-পেটরাসহ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। মুক্তির আব্বা ভেবেছিলেন, জগন্নাথ হল আর শহিদমিনারের সঙ্গে হাসপাতালটাও বুঝি ২৫ মার্চ রাতে গুঁড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর সুস্থ-সবল স্ত্রী ও ফুটফুটে নবজাতক দেখে তার চেহারা আরো ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এ অবস্থায় স্ত্রী-কন্যা তো বোঝা। মুক্তির মা কেবিনের দরজায় স্বামীকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখলেন। তার ডান পাটা কিছুটা সময় চৌকাঠের বাইরেই ছিল। স্ত্রী যে শুধু চোখ নয়, পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে তাকে পরখ করছে, তা বুঝতে পেরে তিনি রুমে ঢুকলেন। মা ও শিশুর দিকে ফিরেও তাকালেন না। থোকা থোকা আঙুর ফলের নকশাদার থার্মোফ্লাস্কটা ছিপি খুলে টয়লেটের বেসিনে খালি করলেন। যাতে বোঝাটা হালকা হয়। আর স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন, বাচ্চাসহ তাকে অনুসরণ করতে। এই মুহূর্তে শহর না ছাড়লে মা ও শিশুর সঙ্গে তাকেও যে বেঘোরে মরতে হবে, যা তিনি চান না–তাও খোলাখুলিই জানালেন।

যুদ্ধটা মায়ের কিছু বাড়তি দুঃখ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য ছিল শুধু কষ্টের, গৌরব ছিল না তাতে। হাসপাতাল থেকে ত্যানা-জড়ানো বাচ্চা কোলে তারা এক কাপড়ে পথে নেমেছিলেন। থেকেছেন অন্যের বাড়ি। বেবিফুডের তখন দারুণ সংকট। হাতে টাকাকড়িও নেই। ফিডারে ভাতের ফ্যান ভরে বাচ্চাকে খাওয়াতে হতো। এর মধ্যে কখন তার দু-দুটি দাঁত গজাল, মুক্তির আব্বা-আম্মা খেয়ালও করেননি। যেদিন দেশ স্বাধীন হয়, তারা হাসপাতালের ত্যানা খুলে মেয়েকে নির্ভয়ে মাটিতে ছেড়ে দেন। মা-বাবা নানান জায়গায় ঘুরে ঘুরে তখন মায়ের দূর সম্পর্কের এক ফুফুর বাড়ি। তারা সোমত্ত গৃহস্থ। উঠোন ঘিরে উঁচু উঁচু ধানের স্তূপ। এসবের ফাঁকে ইঁদুরের গর্ত। পাশে ঝুরঝুরে বালির ঢিবি। মেয়েটা বসার আগেই হামা দিল। মুঠো ভরে ঝুরঝুরে মাটি মুখে পুরে ফেলল কেউ কিছু বোঝার আগেই। মুক্তির আব্বা-আম্মার কাছে হঠাৎ দেশ স্বাধীন হওয়ার মতোই আশ্চর্য ব্যাপার–মেয়ের হামা দেওয়া, বিজয়ের দিনে মুঠো ভরে বাংলার পবিত্র মাটি খেয়ে ফেলা। তারা অনেকদিন পর একসঙ্গে হাততালি দিয়ে হেসে উঠলেন। নয় মাস বয়সের মেয়ের নাম রাখলেন মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের ভালোবাসার একমাত্র স্মারক, যুদ্ধের নামে মেয়ের নাম।

মুক্তি নাম ব্যতিরেকে যুদ্ধের আর কিছু ধারণ করে না, জানেও না বিশেষ। জানার দরকারও হয়নি বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের চাকরিটা পাওয়ার জন্য। বরং আগেভাগে কিছু জানার চেয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে শোনাটাই যে বেশি জরুরি এবং শুনতে শুনতে একদিন যুদ্ধের আগাপাশতলা জানা হয়ে যাবে, কর্তৃপক্ষ প্রথম দিনই তাকে পইপই করে বলে দিয়েছেন। গত দু’দিন ধরে মুক্তি তা-ই করেছে। মরিয়ম বলে গেছে আর তার কাজ ছিল বিনা বাক্যে শুনে যাওয়া। কিন্তু এখন তো স্বয়ং সাক্ষাৎকারদাতাই অত্যধিক ঘুমের বড়ি খেয়ে বেহুশ। আর সময়টা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, মুক্তির জন্মের আগমুহূর্তের এক বিভীষিকাময় মধ্যরাত। কালনাগের দংশনের রাত। প্রতারণা আর সামঞ্জস্যহীন রাত। গাছের গুঁড়ি, খালি পানির ট্যাংকের ব্যারিকেডের বিরুদ্ধে কামান আর মেশিনগানের রাত। স্লোগানের বিপরীতে অজস্র গুলিবর্ষণের রাত। অসহযোগের বিরুদ্ধে সহিংসতার রাত। তখন মুক্তির মা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন, সামর্থ্যেরও বাইরে শক্তি প্রয়োগ করে চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু ডাক্তারের অভাবে প্রসব করতে পারছেন না। এদিকে মরিয়ম বাবাহীন সন্তানের জন্ম দিতে দিতে নিজেও তখন ভ্রণের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে।

রাত বাড়ছে…

আটাশ বছর, অর্থাৎ–দুই বছর কম তিন দশক। পাহাড়সমান না হলেও, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যুদ্ধের নথিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, বই, গ্রন্থাগারের বাসি গন্ধময় খবরের কাগজের মুক্তিরা উত্তরাধিকার। তবে পড়ে দেখেনি। মাথা অক্ষরহীন কাগজের মতো সাদা। মরিয়মই তাতে প্রথম দাগ কাটে। হাতেখড়িটা হয় তাকে দিয়েই। সূচনার এই পর্বে চোখ ফোটেনি যখন, কোনটা খাদ্য কোনটা অখাদ্য জানে না, প্রাণিজগতের এমন এক অবোধ-অন্ধ নবজাতকের মতো মুক্তি বইপত্রের স্তূপ থেকে ২৫ মার্চ রাতটাকে খুঁটে খুঁটে বাইরে আনে।

এ রাতের অভিনবত্ব–যারা কুশীলব তারাই দর্শক। তারা বাঙালির ঔদ্ধত্যে বিরক্ত হয়ে উত্তর দিক থেকে যখন ঢাকা আক্রমণ করে, দক্ষিণ দিক থেকে তখন বসন্তের বাতাস বইছিল। এ ছিল ফুলের গন্ধভরা বাঁশি বাজানোর ভালোবাসাবাসির এক অপূর্ব রাত। শহর থেকে নিরাপদ দূরত্বে–প্রদেশের রাজধানী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল যে জায়গাটায়, যার নাম তখন ছিল সেকেন্ড ক্যাপিটাল, সেখান থেকে নির্দেশদানকারীরা বায়স্কোপ দেখার মতো তাদের নৃশংসতা উপভোগ করেছিল। তাদের বাধা দেওয়ার মতো আশপাশে কেউ ছিল না। যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মুক্তি ২৫ মার্চ রাত পুনর্নির্মাণে দূরবর্তী সেই নিরাপদ জায়গাটিই বেছে নেয়। আর অনুসরণ করে পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটিকে। অমানবিক সর্তকতা সত্ত্বেও খুনি পায়ের ছাপ রেখে যায়–রক্তের দাগ মুছে দিতে দিতে এগিয়ে গেলেও, অগণিত লাশ বুলডোজার দিয়ে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলার পরও, মেজরের ‘অপারেশন সার্চলাইট—এক’ পরিচ্ছেদে এই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হয়।

মুক্তি খুনির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে…

২৫ মার্চ রাতে সেকেন্ড ক্যাপিটালের ঘাস-ছাঁটা আঙিনায় ‘আউটডোর অপারেশন কক্ষ’ লেখা ব্যানার টাঙানো হয়েছে। ঘাসের ওপর সারি সারি সোফা আর আরামকেদারায় দর্শকরা একে একে আসন গ্রহণ করে। তারা যাতে রণসংগীতের মূর্ঘনায় ঘুমিয়ে না যায়, তাই পাশের টেবিলে ফ্লাস্কভর্তি চা-কফি মজুত রাখা হয়েছে। একটা জিপের পিঠে বসানো হয়েছে বেতারযন্ত্র। যন্ত্রটা যুদ্ধের ধারাবিবরণী পেশ করবে। দর্শকদের মুখ দক্ষিণ দিকে–শহরের পানে। সেখানে দিগন্তব্যাপী ন্যাচরাল স্ক্রিন। যা এখন শূন্য, শান্ত, অন্ধকার। যারা শহরের রাস্তায় বড় বড় গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল তারা পরিশ্রান্ত। ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ কেউ। ৩২ নম্বর বাড়ির ব্রিফিং-পর্ব শেষ। নেতারা অন্ধকারে গা ঢাকা দিচ্ছেন। তাদের নিঃশব্দ সঞ্চরণ পর্দায় দেখা যায় না। দেখা। যায় না, শেখ মুজিবুর রহমানের আনমনে পাইপ টানার দৃশ্যটিও। কারণ পর্দাটা অন্ধকার, বাতি নেভানো ঘুমন্ত শহর বুকে ধারণ করে নিঃসাড় হয়ে আছে তখনো।

সেকেন্ড ক্যাপিটালের দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ডের। এদিকে আক্রমণকারীরাও সশস্ত্র, উদ্যত, অস্থির। বেতারযন্ত্র মারফত মিনিটে মিনিটে আবদার আসছে–ইমামের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, আর কতক্ষণ অস্ত্র হাতে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কিন্তু পিআইএর স্পেশাল ফ্লাইটটার যত দ্রুত করাচির আকাশসীমায় পৌঁছে যাওয়ার কথা, তত দ্রুত পৌঁছাচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাতে সওয়ার। রাতের অন্ধকারে ঢাকা ত্যাগ করে তিনি এখনো কলম্বো করাচির মাঝপথে, ৩০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ছেন। এভাবে কালক্ষেপণ মস্ত বড় হেঁয়ালি। কুশীলবরা মেকআপ নিয়ে বসে আছে অথচ পর্দাটা তোলা হচ্ছে না। জেনারেলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর অতর্কিত আক্রমণ দুটোই প্রয়োজন। একদিকে সময়কে হাতে রাখা, অন্যদিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। শেষমেশ আক্রমণের এইচ-আওয়ার কাগজে-কলমে রাত একটায় গিয়ে ঠেকে। যদিও কার্যত যা শুরু হয় দেড় ঘণ্টা আগে।

বসন্তের মিষ্টি হাওয়ায় সেকেন্ড ক্যাপিটালের দর্শকদের চোখে ঘুম নামে। আয় ঘুম, যায় ঘুম, এর মধ্যে তাদের সিন বাই সিন যুদ্ধ দেখতে হবে। এটি যুদ্ধ করার সমান পুণ্যের।

মহাভারতের অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কুরুক্ষেত্রের পুরো যুদ্ধটা দেখতে হয়েছিল। দেখিয়েছিলেন সঞ্জয়–এক অন্ধ পিতাকে পুত্রদের হত্যাদৃশ্য, কৃষ্ণের কূটচাল, ধর্মপুত্রের মিথ্যাচারণ, বালক অভিমন্যুর চক্রব্যুহে প্রবেশ। সে ছিল আঠারো দিনের যুদ্ধ। দু’পক্ষের উত্থান-পতন আর জয়-পরাজয়ের জটিল কাহিনি। অত বড় হত্যাযজ্ঞের পর যারা জয়ী হয়েছিলেন, তারা রূপকথার রাজা-রানির মতো সুখী হলেন না। গভীর মর্মপীড়া অহর্নিশি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের আত্মহত্যার সবচেয়ে প্রলম্বিত পথ মহাপ্রস্থানের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আজকের এই দর্শকদের হিসাবটা শুধু এক রাতের। তাদের পক্ষ একতরফা মারবে। বাকি নয় মাস হিসাব করেনি। তাই তাদের যুদ্ধ দেখার কাজটা হয়ে ওঠে বায়স্কোপ দেখার মতন। নিরুদ্বেগ, ভয়হীন, বিনোদনমূলক। যা নিদ্রাসুখ পরিত্যাগ না করেই দেখা সম্ভব। তা ছাড়া সঞ্জয় যেমন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের খবরাখবর দিচ্ছিলেন, এখন এ কাজের জন্য বেতারযন্ত্রটি তো রয়েছেই।

রাত ১১টা ৩০ মিনিটে সেনাদের পদভারে পর্দাটা কেঁপে ওঠে। তারা সেনানিবাস ছেড়ে শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নির্ধারিত সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে। তাদের চলার গতিতে আত্মবিশ্বাসটা প্রবল। যেন যুদ্ধ নয়, এপাড়া থেকে ওপাড়ায় পাতানো খেলা খেলতে চলেছে। সামনে শত্রু আছে ঠিকই, তবে নিরস্ত্র। সৈন্যদের সামনে এখন ফার্মগেটের ব্যারিকেড। পর্দাজুড়ে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, নষ্ট গাড়ির খোল, পরিত্যক্ত স্টিমরোলার। প্রতিবন্ধকতার ওপাশে মানুষ দেখা যায় না। কিন্তু অগ্রগামী সেনাদের হকচকিত করে স্লোগান ওঠে–জয় বাংলা!

দর্শকরা স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে ওঠে। তাদের ঘুম ঘুম আমেজ ছুটে যায়। নিজেদের আক্রান্ত হওয়ার কথাই হয়তো ভাবে তখন। কারণ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হতে তখনো দেড় ঘণ্টা বাকি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তখনো শূন্যে। পাকিস্তানের পাকভূমি স্পর্শ না-করা তক তার নিরাপত্তার দিকটি তাদের খেয়াল রাখতে হবে। কারণ ভারতীয়দের বিশ্বাস নেই। ফকার ছিনতাই, লাহোরে তা ধ্বংস করার প্রতিশোধ তারা নিতেই পারে। তা ছাড়া ঢাকা আক্রমণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে প্লেনসুদ্ধ প্রেসিডেন্টকে আকাশ থেকে নামিয়ে ফেলতে পারে ভোকাট্টা ঘুড়ির মতন। হয়তো নামাল না, তোপ মেরে পাঠিয়ে দিল বেহেশতে-এখন শরাব আর হুরি সহযোগে তিনি যার কাছাকাছিই আছেন। দর্শকরা আকাশের দিকে তাকায়ভুলবশত। তারপর পর্দায়। তাদের চোখ পড়ে। ততক্ষণে শ্লোগান নিশানা করে মারণাস্ত্রের মুখ খুলে গেছে। বাতাসে শিস দিচ্ছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। পর্দাটা ঢেকে যায় ধোঁয়ায়। জয় বাংলার কণ্ঠগুলো বুলেটবিদ্ধ হয়। আর স্লোগান শোনা যায় না। সৈন্যরা শহরে ঢোকে। দর্শকরা কফির পেয়ালা হাতে ফের আসন গ্রহণ করে।

পর্দায় তখন রকেট লঞ্চার ছুঁড়ে ৩২ নম্বরের প্রবেশপথের ব্যারিকেড ভাঙা হচ্ছে। অদূরে একটি বিবর্ণ হলদে বাড়ি। পর্দায় যা ধূসর সাদা দেখায়। বাড়িটা গার্ডহীন, অরক্ষিত। সৈন্যরা সেদিকে চলেছে ট্যাংক, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের বিশাল লটবহর নিয়ে। রাস্তার প্রতিবন্ধকতা সরানোর পর বাড়ির চার ফুট উঁচু দেয়াল কমান্ডো বাহিনীর গতিরোধ করে। তারা তা অনায়াসে ডিঙিয়ে যায়। স্টেনগান থেকে ব্রাশফায়ার হয়। বুটের দুপদাপ শব্দ বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠে। পর্দাজুড়ে একটি তালাবন্ধ ঘরের দরজা। ঝুলন্ত ইস্পাতখণ্ডটি বুলেটে বিদীর্ণ হয়। দরজা খুলে যায়। মুজিব বেরিয়ে এসে জানতে চান, ‘তোমরা গুলি ছুড়তাছো ক্যান?’

কমান্ডো আক্রমণের কয়েক মিনিট পর সেকেন্ড ক্যাপিটালের দর্শকরা বেতারযন্ত্রটির কোঁকানো শুনল। তারপর একজনের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, ‘বড় পাখিটা খাঁচার ভেতর…অন্যগুলো নীড়ে নেই…ওভার।’

ততক্ষণে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া নিরাপদে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করেছেন। বেতারযোগে ফরমান আসে, ‘সর্ট দেম আউট।’ বাছাই করো… খতম করো বাঙালিদের।

দর্শকদের সামনের কালো পর্দাটা লোহিতবর্ণ ধারণ করে। লকলকে অগ্নিশিখা লাফিয়ে ছুঁতে চায় আকাশটাকে। বিশাল ধূম্রকুণ্ডলী এর গতিরোধ করে। খানিক আকাশযুদ্ধ চলে ধোঁয়া আর অগ্নির। হঠাৎ আকাশজুড়ে ট্রেসার বুলেটের আতশবাজি-দর্শকরা চমৎকৃত হয়। তাদের আনন্দদানের জন্য তা চলতে থাকে খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে। যেন অগ্নি আর ধূমের একঘেয়ে প্রদর্শনীর মাঝখানে ঝটিকা বিজ্ঞাপন-ঝলমলে, স্মার্ট।

রাত তখন দুটো। কড়কড়িয়ে বেজে ওঠে বেতারযন্ত্রটি। সবাই ছোটে সেদিকে। তবে মাউথ পিসটি মুখের কাছে টেনে নেয় সেই ব্যক্তি, যে এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন ‘হে সঞ্জয়! আমার সৈন্যগণ মহাবল-পরাক্রান্ত লঘু ও আয়তকলেবর, ব্যাধিশূন্য, বর্ম্মসমাচ্ছন্ন, বহু শস্ত্র ও পরিচ্ছদসম্পন্ন, শস্ত্র গ্রহণে সুনিপুণ এবং ন্যায়ানুসারে ব্যূহিত। তাহারা অতিশয় বৃদ্ধও নয়, বালকও নয় এবং কৃশ নয় ও স্কুলও নয়। তাহারা আমাদিগের নিকট সৎকৃত হইয়া আমাদেরই অভিলাষানুসারে সতত কার্য নির্বাহ করিয়া থাকে। তাহারা আরোহণ, অধিরোহণ, প্ৰসরণ, সম্যক প্রহার, প্রবেশ ও নির্গম বিষয়ে সুদক্ষ এবং হস্তী, অশ্ব ও রথচৰ্য্যায় পরীক্ষিত।’

বেতারযন্ত্রটির বাকস্ফুরণ ঘটে…

: ইকবাল হল, জগন্নাথ হলের ছাত্ররা আমাদের দিকে গুলি ছুড়ছে।

: তাদের হাতে অস্ত্র কী আছে?

: থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল।

: তোমাদের?

: রকেট লঞ্চার, রোমিও রোমিও (রিকয়েললেস রাইফেল), মর্টার এবং….

: ননসেন্স! ইমাম বলছেন–সবগুলো একসঙ্গে ব্যবহার করো। দু’ঘণ্টার ভেতর ধ্বংস করো।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের উল্টো দিকে ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপল-এর অফিস। হোটেলের ১১ তলায় দাঁড়িয়ে বিদেশি সাংবাদিকেরা সামনের রাস্তা দিয়ে মেশিনগান বসানো জিপ এগিয়ে যেতে দেখে। পদাতিক বাহিনী পেছনে। তাদের কাঁধে রকেট জাতীয় অস্ত্র। সৈন্যরা একসঙ্গে গোলাবর্ষণ শুরু করে। প্রেসের যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে। ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়।

: দ্য পিপল-এর খবর জানাও। ওভার।

: আমাদের দুজন সৈন্য গুরুতর আহত। সিএমএইচ-এ পাঠানো হয়েছে।

: ক্যাজুয়ালটি কত আনুমানিক?

: এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব। আগুন জ্বলছে। একেবারে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না, এখানে কতজন বাঙালি ছিল।

বেতারযন্ত্রটি পিলখানার ইপিআর ক্যাম্প পতনের খবর দেয় রাত আড়াইটার সময়। দু’দিন আগে আক্রান্তদের নিরস্ত্র করা হয়েছিল এই বলে যে, শিগগির শেখের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, দেশে এখন শান্তি বিরাজ করছে, তোমরা অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রাম নাও। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বাঙালি ইপিআর বাহিনী প্রথম বুঝতে পারে, তারা প্রতারিত হয়েছে। অস্ত্রাগারে তখন বিশাল তালা। মাঝরাতে নিরস্ত্র ইপিআর সদস্যদের দিকে ছুটে আসে কামানের গোলা আর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি।

পর্দাটা লাল, রক্তাক্ত শহর বুকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশটাও লাল। ধোঁয়া হটে গেছে, জায়গায় জায়গায় আগুন। আগুনের রক্তিমাভা। পর্দাটা এখন আগুনের দখলে। বস্তিতে আগুন ধরানোর পর অর্ধভুক্ত, কঙ্কালসার, হালকা-পলকা মানুষগুলো যে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে শুরু করেছে, পর্দায় তা দেখা গেল না। তারপর যে গুলি খাওয়া ছোট ছোট পাখির মতো ঝুরঝুরিয়ে পড়ে গেল মাটিতে, সেই দৃশ্যটিও নয়। বেতারযন্ত্রটি চুপ। আবর্জনার মানুষ আবর্জনা হয়ে গেছে। মাঝখানে ওড়ার দৃশ্যটি শুধু ব্যতিক্রম।

: বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গোলাগুলি চলছে?

: এতগুলো বিল্ডিং শেষ করতে সময় লাগছে। ছাত্ররা গুলি ছুড়ছে। কিন্তু আমাদের কোনো ক্যাজুয়ালটি হয়নি। ওভার।

: খুব শিগগির বিগ ব্রাদার (আর্টিলারি সাপোর্ট) পৌঁছে যাবে। ইকবাল হল, লিয়াকত হল মনে হয় চুপ মেরে গেছে! অ্যাম আই কারেক্ট?

: ইয়েস।

: দ্যাট ইজ জলি গুড! নাউ লিসন। মাইকে কারফিউর ঘোষণা দিতে বলো–নম্বর-এক। নম্বর-দুই, বাংলাদেশের পতাকা যে বাড়ির মাথায় উড়বে, এর ফল ভোগ করতে হবে বাড়ির লোকদের। শহরে যেন একটিও কালো পতাকা দৃশ্যমান না হয়–পরিণাম অত্যন্ত খারাপ হবে, অ্যানাউন্স করে দাও। রাস্তায় কাউকে ব্যারিকেড দিতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি। যে এলাকার রাস্তায় ব্যারিকেড আছে–পিপল ফ্রম দ্যাট লোকালিটি উইল বি প্রসিকিউটেট। অ্যান্ড দ্য হাউজেস…লেফট অ্যান্ড রাইট–আমি আবার বলছি, ডানে-বাঁয়ের বাড়িগুলি ডেমলিশ করে দাও-ডেমলিশড।

কয়েকটা জিপ উত্তর দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে শহিদমিনারের কাছটায়। থামে। রাস্তাজুড়ে বটের মোটা মোটা কাণ্ড। খালি পানির ট্যাংক ইটে বোঝাই। সৈন্যরা গাড়ি থেকে দুপদাপ নেমে পড়ে। রাস্তার বাঁ পাশে বাউন্ডারি ওয়াল, মাঝখানে লোহার গেট। তারা একটানে খুলে ফেলে গেটের তালা। আঙিনা দৌড়ে পার হয়। তিন-চারটা করে সিঁড়ি একলাফে ডিঙিয়ে যায়। ফ্ল্যাটের দরজায় বুটের লাথি পড়ে। পর্দাটা কেঁপে। কেঁপে জানান দেয়, ঘরের ভেতরের মানুষগুলোর হৃৎপিণ্ডের লাফঝাঁপ। যা পরক্ষণেই বুলেট বিদ্ধ হবে, মানুষগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে সিঁড়িতে, ল্যান্ডিংয়ে, ছোট আর সমান করে ছাঁটা সবুজ ঘাসের চাতালটায়। সৈন্যরা দৌড়ে দৌড়ে পর্দা থেকে বেরিয়ে যায়। পেছনে রক্তের ভেলায় ভাসতে থাকে কয়েকজন মৃত্যুপথযাত্রী। তারা শেষবারের মতো পানি খেতে চাইছে।

রাত তিনটার দিকে বেতারযন্ত্রটি ঘর্ঘর করে বলে চলে-রাজারবাগ ক্যাপচাড়…রমনা থানা ক্যাপচাড়…কমলাপুর রেলস্টেশন ক্যাপচার্‌ড্‌…টিভি/রেডিও আন্ডার কন্ট্রোল…এক্সচেঞ্জ ক্যাপচার্‌ড্‌…

: এত আগুন কীসের?

: পুলিশ লাইন জ্বলছে।

: গুড শো!

ভোর চারটায় বেতারযোগে বিশ্ববিদ্যালয় পতনের খবর আসে সেকেন্ড ক্যাপিটালে। মাঠে যেন চূড়ান্ত গোল দেওয়া হয়ে গেছে–আনন্দে উচ্ছ্বাসে লাফায় দর্শকেরা।

সৈন্যরা তখন ‘সারেন্ডার অর ইউ সেল বি কিলড’ ঘোষণা দিতে দিতে জগন্নাথ হলের অভ্যন্তরে ঢুকতে শুরু করেছে কেবল। হত্যাকাণ্ডের মাঝপথে তারা। কক্ষের কোনা, পাঁচিলের নিচ, কচুক্ষেত, সার্ভেন্টস কোয়ার্টার থেকে ছাত্রদের ধরে এনে তখনো গুলি করা বাকি। তারপর আছে ছড়ানো-ছিটানো লাশ টেনে এনে এক জায়গায় শুমার করা। তার জন্য অবশিষ্ট ছাত্র, সুইপার, মালি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আর দারোয়ানদের জড়ো করা হয়। এক পর্যায়ে অবাঙালি মেথর, মালি আর মিস্ত্রিরা দেনদরবার শুরু করে মিলিটারির সঙ্গে, যদি কোনো প্রকারে বাঁচা যায়–

: নেহি সাব, হাম বাঙালি নেহি হ্যায়, পশ্চিমা হ্যায়, হামলোক তো ভাঙ্গি হ্যায়।

: তুম ইহা কেয়া কার রাহা হ্যায়?

: সায়েব হাম তো নোকরি করতা হ্যায়। ঘরমে ছোটা ছোটা বাচ্চা হ্যায় ম্যারা–কোনো কাজ হয় না। লাশ বহন করা শেষ হলে তাদেরও লাইন করিয়ে হত্যা করা হয়। সৈন্যদের চিরুনি অভিযানের পর ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকে কয়েকজন। ম্যানহোলের আশ্রয় থেকে একজন দেখেছিল পুরো হত্যাকাণ্ডটি। উনিশ ঘণ্টা পর বেরিয়ে এসে তার মনে হয়, পৃথিবীর সব লোক মৃত, সেই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যে নর্দমার পাতাল থেকে উঠে এসেছে।

জগন্নাথ হল। উত্তর বাড়ি। ২৯ নম্বর কক্ষ। তিনজন ছাত্রকে একত্রে ব্রাশফায়ার করা হয়। গ্রেনেড ছোড়ে রুমটিতে। ধ্বংসস্তূপ আর রক্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একজন–মানুষ নয়, যেন প্রেতাত্মা।

ছাদে পঁচিশজনকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করা হয়। তার মধ্যে কাঁধে গুলি খেয়ে বাঁচে খর্বাকৃতির একজন। আসল বুলেটটি তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়।

আরেকজন পায়ে গুলি খেয়েছিল কক্ষের ভেতর। সে জানালার রড খুলে বাইরে এসে ড্রেনে পড়ে। তারপর কুলগাছের নিচের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে নেমে যায় পুকুরে। নাকটা শুধু ভাসানো ছিল। মাথার ওপর ভোরের কুয়াশায় ডানা মেলে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক-শকুন উড়ছিল। একটা কাক নেমে আসে নিচে। নাকে ঠোকর দেবে যখন, সে জিব নেড়ে কাকটাকে তাড়ায়।

হলজীবনের সঙ্গী, রুমমেট, শিক্ষকদের মৃতদেহ টেনে এনে জড়ো করা হয়েছিল যে জায়গায়, সেখানে লাশ টানা লোকদের ব্রাশফায়ার করার আগমুহূর্তে একজন ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ে। খোলা পানির কলের মতো কলকলিয়ে গরম রক্ত ছুটে আসছে চারদিক থেকে। সে ঢাকা পড়ে যায় রক্তের আড়ালে। অদূরের কোয়ার্টার থেকে এক অধ্যাপক ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে দেখেন, সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর মৃতদেহের স্তূপ থেকে উঠে এক অদ্ভুত চেহারার লোক ধোয়া আর কুয়াশায় দৌড়ে যাচ্ছে। গায়ের রক্ত দিয়ে যারা আড়াল করেছিল, লোকটির জীবদ্দশায় তারা খালি হাতছানি দিয়ে ডাকত। কারণ বুলডোজার চালিয়ে সমান করার পরও কারো কারো হাত কবজি পর্যন্ত গণকবরের বাইরে থেকে গিয়েছিল।

: বিশ্ববিদ্যালয়ে কত জন হতাহত হলো–তোমার আনুমানিক হিসাবটা বলল। জাস্ট গিভ মি দ্য অ্যাপ্রোক্সিমেট নম্বর। ওভার।

: তিন শ’র মতো।

: এক্সসিলেন্ট। ইমাম জানতে চাচ্ছেন, তিন শ মারা গেছে, না আহতও আছে?

: আমি একটাই বিশ্বাস করি…তিন শ মারা গেছে।

: আমিও তোমার সঙ্গে একমত। ওই কাজটাই সহজ। নো, নাথিং আড়, নাথিং ডান। তোমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি আবারও বলছি, ভালো করেছ। চমৎকার কাজের জন্য আবারও বলছি, শাবাশ। ম্যায় বহৎ খুশ হু।

ওভার… রাত্রি ভোর হয়ে আসছে। পর্দাটা খালি। বায়স্কোপ দেখাও শেষ। দর্শকরা ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছে ঘুমোতে। ইমাম এসি রুমে ঢুকে আবার গত রাতের উন্মুক্ত অপারেশন কক্ষে ফিরে আসেন। চশমার ঘোলা কাঁচ মোছেন রুমালে ঘষে ঘষে। শহরের শরীর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ভোরের আজানের সুরে সুরে ঝরে পড়ছে করুণ আর্তনাদ। ইমাম। চোখে চশমা তুললেন–খোদা মেহেরবান, একটা মানুষও নেই। একটা রাস্তার কুকুর ভয়ে ভয়ে ধোঁয়া ভেদ করে শহরের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়।

০৪. ঢাকা ত্যাগ

২৬ মার্চ সকাল। কারফিউ চলছে। হাজি সাহেবের বাড়ির সামনের লাইটপোস্টে দড়ি বাধা কুকুরটা যে মরে পড়ে আছে, আশপাশের বাড়ির লোকজন তা শুধু জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে, ভয়ে ঘর থেকে বেরোয় না কেউ। তখনো এদিক-ওদিক ফুটফাট গুলির আওয়াজ, বাতাসে পোড়া দুর্গন্ধ। ধারেকাছে নিশ্চয় ঘাপটি মেরে আছে ঘাতক। তা না হলে কুকুরটা মরল কীভাবে? পাড়ার প্রথম শহিদ পাহারাদার কুকুর একদিন একরাত রাস্তায় পড়ে রইল। সকালবেলায় একটা সাদা বিড়াল গুটি গুটি পায়ে মরদেহটা একচক্কর ঘুরে যায়। খানিক পর ডাক্তারের বাড়ির গলাছোলা মুরগিটা এক ঝাঁক ছানাপোনা নিয়ে এর লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত ঠোকরায়, ঘাড় তুলে কুড়কুড়িয়ে বাচ্চাদের কী যেন বলে, তারপর জোরে কোথাও বোমা ফাটতে গম্ভীর চালে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। দুপুরবেলা ডাক্তার সাহেব সাহস করে রাস্তায় নেমে শনাক্ত করেন–কুকুরটা গুলি খায় নাই, হার্টফেল করেছে। তখন ছাদে উঠে পাড়ার ছেলেরা স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেলে ঝটপট। মরা কুকুর ডিঙিয়ে কেউ কেউ ত্রস্তপায়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায়। কে বাঁচে কে মরে, তাদের হয়তো জরুরি কথা আছে প্রতিবেশীকে শেষবার বলার মতো।

২৫ মার্চ রাতে মহল্লার লোকেরা খাটের তলায়, টেবিলের নিচে, দেয়ালের আড়ালে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেঁচেছে, এখন অদৃষ্টে কী আছে, কে জানে। যে কুকুরটা গত দু’দিন করুণ সুরে বিলাপ করে তাদের আগাম বিপদসংকেত জানাচ্ছিল, তার নেতৃত্বের অভাবে শহরের বাদবাকি কুকুরগুলোও চুপ। টেলিফোন বিকল। রেডিওতে সামরিক আইন অধ্যাদেশের মুহূর্মুহূ প্রচার, বিরতিতে যন্ত্রসংগীত, পুনঃপুন ঘোষিত হচ্ছে-রাস্তায় বের হলেই গুলি। নানা রকম আশঙ্কায় দিনটা শেষ হয়। রাতে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ শুনে চোখে সবাই অন্ধকার দেখে।

সেই আঁধারে গা-ঢাকা দিয়ে হাজির বাড়ির দোতলার লোকটা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়। লোহার গেট বেয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ে উঠানে। কোনো শব্দ হয় না। মাটি টিউবওয়েলের জলে ভিজে কর্দমাক্ত। উঠানের বিক্ষিপ্ত ইটের সারি সে সন্তর্পণে পেরিয়ে যায়। খোলা জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরে ঢোকে। অন্ধকারে প্রথম কিছুই ঠাহর হয় না। নাকে দুর্গন্ধ। রক্তপিণ্ডে পা পিছলে কয়েক গজ সামনে চলে যায়-অন্ধকারে বোঝা মুশকিল ভেজা আঠালো জিনিসটা কী। সে ডান দিকে তাকায়–কিছু নেই। বাঁয়ে তাকায়–খাট শূন্য। গেল কোথায় মেয়েটা? সে দম আটকে রেখে কান খাড়া করে। খাটের তলায় হালকা গুঞ্জন। যেন একটা বেখেয়ালি মাছি মাকড়সার জালে আটকে পড়েছে। লোকটা উবু হয়-খাটের নিচে মরিয়ম, যাকে ২৫ মার্চ রাত উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে ওখানে। মরে যে যায়নি, নাকের কাছে আঙুল ধরে কিংবা বুকে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে না। সে মেয়েটিকে খাটের নিচ থেকে টেনে বাইরে আনে। ঘরের মেঝে ভর্তি কাঁচের টুকরো আর ভেজা-আঠালো অদ্ভুত জিনিসটা। সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে এখন এমন উত্তেজিত যে, নিঃশব্দে চলাফেরার কথাও ভুলে যায়। তবে দরজাটা সে খোলে না। হয়তো ভাঙা জানালাটা দিয়েই তার চলাচলের সুবিধা। সে টিউবওয়েল চেপে মগভর্তি পানি নিয়ে এই পথেই আসা-যাওয়া করে। মরিয়মের সারা গা ভিজে জবজবে। তবু জ্ঞান ফেরে না। কতক্ষণ ধরে বেহুশরাত ১২টার আগে নিশ্চয়ই নয়, গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর খাটের তলায় নিজে থেকেই ঢুকেছে যখন। লোকটা আঙুল গুনে হিসাব করে, চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে এখনো দুই আঙুল বাকি। সে অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে যায়। ওখানে দিয়াশলাই, মোম, কেরোসিনের কুপি সব রাখা আছে। চুলার কাছের কাঠের তাকে হলুদ, লবণ, গুড়ো মশলার পাশে শুকনো মরিচের কৌটা। কৌটাটা হাতে তুলে নেওয়ার সময় লোকটাকে মিটিমিটি হাসতে দেখা যায়। সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল আলোর গতিতে একটা হারানো স্মৃতি তার ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে-বউয়ের দাঁতকপাটি লেগে গেছে। দু’দিন যায়, তিন দিন যায়, খোলে না। ওঝা আসে বাড়িতে। মাটির মালশার তুষের আগুনে লাল টুকটুকে মরিচ পোড়ানো হয়। বউ হেঁচে-কেশে রক্ত জবার মতো চোখের পাপড়ি খোলে, যা তিন দিন আগে দু’পাটি দাঁতের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বাপের বাড়ি চলে যায়। সেখান থেকে জোরজবরদস্তি আনতে গিয়েই খুনখারাবির ঘটনাটা ঘটে।

মরিয়ম চোখ খোলে–দুটি ঘুমন্ত রক্তজবা পাপড়ি ছড়ায়। ঘরভর্তি ধোঁয়া, মরিচ পোড়ার তাণ্ডব। এই লঙ্কাকাণ্ডের ভেতর কাকে যেন সে দু’হাতে ধোঁয়া ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে। বোতল পোঁতা বাড়িটা তাকে ভরসা দেয় না। আবার জিনপরির ভয়ে সে চেতনাও হারায় না। সুন্দরীর জলা এখান থেকে বহুদূর। ভূত-পেতনির জায়গা নিয়েছে মানুষ–শহর আক্রান্ত হয়েছে যেসব মানুষের হাতে। অদূরের গোলাগুলির আওয়াজ তাকে জানিয়ে দিতে পারত, এখনো যুদ্ধ চলছে এবং বাড়িতে সে একা। সে ভাবতে পারত, তার একটা অতীত ছিল, যা থেকে এখন সে বিযুক্ত। এমনকি আবেদের সঙ্গের সম্পর্কের গিঁটগুলোও যে যুদ্ধ লাগার ঠিক আগমুহূর্তে ছিঁড়ে গেছে, তা ভেবে সে দুঃখ পেতে পারত। মরিয়মের এসব কিছুই হয় না। সে তলপেটে সামান্য ব্যথা অনুভব করে, তার পরও বোঝে না যে, আপদ নিজে থেকে বিদায় হয়েছে। মরিয়ম শুধু অচেনা লোকটাকে ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে পানির গেলাস হাতে ফিরে আসতে দেখে। লোকটা তাকে বিছানায় শোয়ায়, মাথার পেছনে হাত রেখে চুমুক দিয়ে দিয়ে জল খেতে সাহায্য করে। তারপর গায়ের ওপর ধীরেসুস্থে চাদর টেনে দিয়ে। বেরিয়ে যায়। এসব হয়তো কোনো সিনেমার দৃশ্য। ঘর খালি হতে আরামে চোখ। বোজে মরিয়ম।

‘গাড়ি-ঘোড়া চলতাছে’ বলে দরজায় ঘা দিয়েই চলে যায়। সে গেট টপকে এসেছিল হাজির চোখে ধুলা দিয়ে। ঢাকা ছেড়ে লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। সকাল থেকে দুপুর কারফিউ-মুক্ত। ঘরের জিনিসপত্র যে যতটুকু পারে বোঁচকা বানিয়ে পিঠে, কাঁধে, হাতে তুলে নেয়। দরজায় তালা পড়ে। কোনো দিন যদি ফিরে আসতে পারে, ঘরদোর, জিনিসপত্র ফেরত পাওয়ার আশা নেই। এই মুহূর্তে জীবনটাই সবচেয়ে দামি। মরিয়মও দুর্বল শরীরে ঘরছাড়া মানুষের কাফেলায় ভিড়ে যায়। তাকে চোখে চোখে রেখে বিশাল এক বোঁচকা মাথায় হাঁটছে গত রাতের লোকটা। বোঁচকায় হাজি সাহেবের মালসামান। হাজির খাস চাকর দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মরা কুকুরটাকে। সকারের জন্য নয়, তাকে নাপাক জন্তুটাকে এলাকার বাইরে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাজি সাহেব। তিনি মরিয়মকে আচমকা জিগ্যেস করেন, ‘তোমার ভাই মন্টু না ঝন্টু-হে কই?’ মন্টু গ্রামের বাড়ি গেছে শুনে বিড়বিড়িয়ে মনে হলো বদদোয়া দিলেন। মেরিকে কিছু বললেন না।

হাজি সাহেবের নেতৃত্বে পনেরো-কুড়ি জনের দলটা যখন নৌকা করে বুড়িগঙ্গা পার হয়, তখন কয়েকটা শবদেহ তাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। এদের চলায় জীবিতদের মতো তাড়া নেই। ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় ভাসছে। কোথাও আটকে পড়ছে জলজ গুল্মে, আবর্জনায়। এ দৃশ্য দূর আকাশ থেকে দুরবিন-চোখে দেখছে। একদল শকুন। তখনো এদের পাখা টানটান, ধারালো নখ গুটানো। অপেক্ষাকৃত নিচ দিয়ে ওড়াউড়ি করছে কতগুলো মাংসলোভী কাক।

বেলা চড়ে গেছে। সামনে উত্তপ্ত বালুচর। মরিয়মদের দলটা যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের দিকে। সেখানে মহল্লার আওয়ামী লীগের সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারির মৃত স্ত্রীর বাবার বাড়ি। হাজি সাহেব বিয়েতে ঘটকালি করেছিলেন। সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারি এখনো রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শহরের অফিসঘরটা আগলাতে ব্যস্ত। সেক্রেটারির। অনুপস্থিতিতে হাজি সাহেব পাড়ার এক দঙ্গল লোক নিয়ে যাচ্ছেন নিজের ঘটকালি করা অন্যের শ্বশুরবাড়ি, যে বর্তমানে তার বিরোধীপক্ষও বটে। তবে সব বাঙালিই আপাতত একদিকে। তিনিও মহল্লার পুরোনো লিডার। তাই বিপদের দিনে তার ওপর ভরসা রেখে সবাই যাচ্ছে।

সংগ্রাম কমিটির সেক্রেটারির শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রাতেই উদ্বাস্তুদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বেঁধে গেল। গৃহকর্তা শৌখিন মানুষ। একটা তিন ব্যান্ডের পুরোনো পাই রেডিও চালিয়ে যুদ্ধের আগে অনুরোধের আসরের গান শুনতেন। যন্ত্রটা এখন এজমালি সম্পত্তি। যে হাতের কাছে পায়, সে-ই নব ঘোরায়। রাতে নব ঘোরাতে ঘোরাতে ধরা পড়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। উত্তেজনায় শ্রোতাদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম যখন, হাজি সাহেবের বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ে। স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠ আরম্ভ হয়ে গেছে–আই, মেজর জিয়া, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান…। যুদ্ধটা যে একতরফা হবে না, এখন তা স্পষ্ট। কে এই মেজর জিয়া? হাজি সাহেব নিজেই-বা কার দলে? পাকসৈন্যরা বাছবিচারহীন বাঙালি খতম করছে বলে জানের ভয়ে সপরিবারে তাকেও ঢাকা ছেড়ে পালাতে হয়েছে। ভেবেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে সক্ষম হবে মিলিটারি। পাকিস্তান পাকিস্তানের জায়গায় থেকে যাবে। এখন এদিক থেকেও যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়! আজন্মের শত্রু ভারত তো ওত পেতেই আছে ঘোলাজলে মাছ শিকারের জন্য। হাজি সাহেবের অবস্থা এখন বাঘের ঘরে ঘোগের ছা। নিজে এসে ধরা দিয়েছেন।

উদ্বাস্তুরা শহরের শিক্ষিত মানুষ, সবজান্তা। ঢাকার পতন হলেও সারা দেশে যে দাবানলের মতো যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে, কেরানীগঞ্জ বসে ঠিক ঠিক তা বলে দিচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বন্দি না পলাতক-রাতদিন কানে রেডিও লাগিয়ে তা আন্দাজ করতে পারছে না। লোকগুলো আসলে চোখ থাকতে অন্ধ। কান থাকতে বধির। হাজি সাহেব ভয়ে ভয়ে উচ্চারণ করেন, ‘শেখেরে মনে হয় বন্দি করে আননোন ডেস্টিনেশনে নিয়া যাওয়া অইছে।’ কেউ তার কথার প্রতিবাদ করে না। বিষয়টা অস্বস্তিকর। মাথা না থাকলে ধড় দিয়ে কী হবে? ২৭-২৮ মার্চ দুই দিন হাজি সাহেব সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেন। মনের মতো খবর শোনার জন্য লুকিয়ে-চুরিয়ে রেডিও পাকিস্তান ধরবার উপায় নেই। ২৯ তারিখ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র টিক্কা খানের নিহত হওয়ার গুজব নিউজ আকারে পরিবেশন করে। গৃহকর্তা খুশি হয়ে রাতে ফিস্টের আয়োজন করলেন। হাজি সাহেব দেখলেন, বিপদ ঘাড়ের ওপর। ব্রিটিশ আমল থেকে। তিনি রাজনীতি করছেন। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখেছেন। বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তান চাইতে এবং এখন তা ভাঙতে দেখছেন। বুঝতে পারছিলেন, আড্ডার পরিবেশ বেশি দিন ঠিক থাকবে না। শ্রোতারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং রক্ত। ঝরবে, যা থেকে তিনি নিজেও বাদ যাবেন না। ২৯ মার্চ রাতে বৃষ্টি হয়। হাজি সাহেব বললেন, আগুন নেভাতে অসময়ে আল্লাহতালার এই অমোঘ বর্ষণ। পোড়া শহর আবার চাঙ্গা হবে–মহা প্লাবনের পর পৃথিবী সুজলা-সুফলা হওয়ার কথা আল্লাহর কালাম পাকে যেমন বলা আছে। ভোরবেলা বর্ষণসিক্ত মাটির ওপর দিয়ে সপরিবারে। তিনি ঢাকা ফিরে গেলেন। সঙ্গে নিলেন দোতলার বাসিন্দাকে। যার নাম এখন দলের সবাই জানে রমিজ শেখ। সে দুর্দিনের আশ্রয়দাতা হাজি সাহেবের ডান হাত। কৃতজ্ঞতাবশত বা বাধ্য হয়ে গেলেও রমিজ শেখের মনটা পড়ে থাকল কেরানীগঞ্জে, যেখানে মরিয়ম রয়েছে। যাকে সে মরিচ পুড়িয়ে ধোয়া দিয়ে বাঁচিয়েছে। ফলে মেয়েটার জানের ওপর তার হক আছেই। তা ছাড়া কাউকে মেরে ফেললে যদি শাস্তি পেতে হয়, বাঁচালে এর সুফল ভোগ করবে না কেন মানুষ? যুক্তিটা রমিজ শেখ মাথায় করে নিয়ে যায়।

দলের বাকি লোকজন রাতের বর্ষণে খোদার লীলাখেলার আলামত কিছু দেখতে পায় না। গোলাগুলি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। স্বাভাবিকভাবে তারা নিজের নিজের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাত্রা করে। নিখরচায় ছোট ছোট খেয়া পারাপার হয়। ধানখেতের আইল ধরে হাঁটে। খায়-ঘুমায় অচেনা লোকের বাড়ি। দিনের বেলায় গ্রামবাসী ডাব কেটে, চিড়ে-গুড়, সেদ্ধ ডিম নিয়ে মাঠে, গাছতলে আপ্যায়ন করে। তারা দেখে, ধনী হোক গরিব হোক শহরের লোকগুলো জান নিয়ে পিঁপড়ার মতো পিলপিলিয়ে পালিয়ে আসছে। সাধ্যে যা কুলায়, তাদের সাহায্য করাই কর্তব্য। এদিকে যার যার গন্তব্য অনুযায়ী পথ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। চলতে চলতে বদলে যাচ্ছে দলের লোকজন। উত্তরবঙ্গ থেকে বরিশালে ধান কাটতে যাচ্ছিল কয়েকজন খেতমজুর। তাদের নৌকায় করে মরিয়ম যখন উত্তাল পদ্মা পার হয়, তখন দলের লোক সব তার অপরিচিত। সে ভাত খাচ্ছে নৌকার এক মাল্লার মাটির সানকিতে-পোড়া মরিচ-লবণ মেখে পান্তাভাত। পদ্মায় জেলে-নৌকা বিস্তর, মাছও উঠছে, তখনো মানুষের মৃতদেহ নদীর মাছের খাদ্য তালিকাভুক্ত হয়নি আর মানুষও খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেয়নি নদীর মাছ। কিন্তু পয়সার অভাবে মাল্লা-মজুররা মাছ কিনতে পারছে না। মরিয়মের গাল বেয়ে দু’ফোঁটা নোনা পানি পান্তাভাতে ঝরে পড়ে।

০৫.  স্বর্গধামের পতন

এপ্রিলের মাঝামাঝি মরিয়মদের নতুন দলটা পদ্মা পার হয়ে পাকা সড়ক, বৈদ্যুতিক তার, টেলিফোনের পিলার অনেক অনেক পেছনে ফেলে এক প্রত্যন্ত গাঁয়ের পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়ি ঢোকার মুখে টিনের পাতে খড়ি দিয়ে লেখা-স্বর্গধাম। স্বর্গধামে ঘর প্রচুর, মানুষ নেই। দরজাগুলো হাট করে খোলা। তখনো উঠানের রোদে কাপড় মেলা রয়েছে। চুলার আগুনটাও নেভানো হয়নি। বাড়ির বাসিন্দাদের পালিয়ে যাওয়ার পর, বাড়িটা লুট হওয়ার আগে তারা ওখানে পৌঁছায়। পরিত্যক্ত মালামালের মালিক হয়ে বসে। বাড়ির সুবিধা-অসুবিধাগুলো গভীরভাবে নিরিখ করে। উঠানের কোনের তুলসীমঞ্চ, বাঁশঝাড়ের তলায় শীতলা ঠাকুর দেখে বোঝে যে, বাড়ির লোকগুলো ভারতে চলে গেছে এবং আপাতত ফিরছে না। তারা তুলসীগাছ উপড়ে ফেলে আর শীতলা ঠাকুরকে ভোগের ঝুনা নারকেলসমেত জঙ্গলের ভেতর ঠেলে দেয়। এখন কারো বোঝার সাধ্য নেই যে, বাড়িটা হিন্দুর। তাতে তারা নিরাপদ বোধ করে। ততক্ষণে পাশের ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে এক দঙ্গল মুরগি। সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে ছানাপোনা। বাড়িতে ঢুকেই প্রাপ্তবয়স্ক মুরগিগুলো কুড়কুড়িয়ে ডিম পাড়ার জায়গা খোঁজে। একটিমাত্র মোরগ গলা ফুলিয়ে উঠান, বারান্দা, রান্নাঘর মুরগিদের দাবড়িয়ে বেড়ায়। গোয়ালঘরে লাল ও সাদা গাই দুটি হাম্বা রবে ডেকে ওঠে।

পরিত্যক্ত বাড়ি, রান্নার চুলা, তারে মেলা কাপড়, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা মোরগ-মুরগি আর গোয়ালের গরু-বাছুর দেখে উদ্বাস্তুদের ফের সংসারী হতে ইচ্ছে করে। জোড়াতালি দিয়ে পরিবার রচিত হয়। যা থেকে মরিয়ম বাদ পড়ে যায়। নিজেরা পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমন বিষয় বলতে থাকে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ভয়–যা রাতদিনের যে-কোনো প্রহরে জানান না দিয়ে হতে পারে।

মিসেস আলাউদ্দিন স্বামীর মৃতদেহ ঢাকায় ফেলে এসেছেন। তিনি এখন বিধবা, দুটি কন্যাসন্তানসহ। আট বছরের যমজ শিশু দুটি জানে না তাদের বাবা-মা কোথায়। তারা তিন-চার দিন হয় দলে আশ্রয় নিয়েছে। এদের পরিচয় এখন এতিম। নিঃসন্তান আতিক দম্পতি যমজদের পালক নিলেও প্রকারান্তরে চাকরের মতো খাটাচ্ছেন। মলিনা গুপ্তের স্বামী, দেওর, পুত্র, শ্বশুরসহ পরিবারের ১১ জন পুরুষ লাইন করিয়ে পাকসেনারা হত্যা করেছে। লাইনটি ছিল দৈর্ঘ্যে বাঁকা, উচ্চতায় অসমান। ব্যাটন মেরে, ভয় দেখিয়ে, একজনের জায়গায় আরেকজনকে টেনে এনে সৈন্যরা তা সোজা আর সমান করতে পারেনি। ব্রাশফায়ারের আগমুহূর্ত পর্যন্ত লাইনটা পূর্বাবস্থায় থেকে যায়। সৈন্যরা একে অবাধ্যতা মনে করে ফেরার সময় ঘর-বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মলিনা কোমরের বটুয়ায় স্ত্রীধন আর দু’হাতে দুটি সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। ডাকাত বা মিলিটারির হাতে কে কখন তাকে সোপর্দ করে, এই ভয়েই সন্ত্রস্ত। মনটা তার এখানে নেই, সীমান্তের ওপারে। দাদা-বউদির কৃষ্ণনগরের বাড়িতে বৈধব্যের বেশে ফেরত যাবেন, না সল্টলেকের শরণার্থী ক্যাম্পে উঠবেন–এ নিয়ে খানিকটা সময় ভাবনা-চিন্তা করেন। বাকি সময় নিজের মেয়ে দুটিকে মুরগির মতো ডানার নিচে লুকিয়ে আপনমনে কথা বলেন। একটা বাঁকা ও অসমান লাইনের ধাঁধা তার কিছুতেই ঘোচে না।

ইঞ্জিনিয়ার তৈয়ব ওয়াপদার বড় অফিসার। বারংবার রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি যে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন না, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী স্বপ্ন মনে করে, তা মেরির জন্য। নাম শুনে মনে হয় মেয়েটা খ্রিষ্টান, আবার মুসলমানও হতে পারে। তবে স্বভাবে ছেনাল। ওর স্বামীকে কুপথে টানছে। সাতকুলের সব ফেলে তাদের সঙ্গে ভিড়েছে পুরুষ ধরার জন্য। অন্তঃসত্ত্বা স্বপ্ন, যার সন্তান মাতৃগর্ভে খুন হবে, তিনি দলের আরেকজন সধবাকে ডেকে বলেন, ‘আতিক ভাবি, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করছেন তো মরছেন। ওরা চাইলে মেয়েটারে বাইর কইরা দিতে পারে না স্বর্গধাম থেকে! আলাউদ্দিন ভাবির আর ভাবনা কী। মাথা থাকলেই না মাথাব্যথা। তবে ওনার নৈতিক দিকটা খুব স্ট্রং। বেশ্যা সন্দেহে মেরির সঙ্গে ওঠবোস বন্ধ করে দিয়েছেন।’

মরিয়ম পুরোনো ভুক্তভোগী। আড়াল তার জীবনে ভীষণ প্রয়োজন। খানিকটা ফাঁক পেলেই ওরা ঢুকে পড়বে তার অতীতে। তখন সামান্য যে আশ্রয় যা খুব বড়ও নয়, ছোটও নয়, অনেকটা কবরের মাপের–যে পরিধিতে এখন সে মিসেস আলাউদ্দিন ও তার সন্তানদের পাশে শুয়ে আছে, তাও হারাবে। আহার নিয়ে ভাবনা নেই স্বর্গধামে। এখানে কেউ কারোর খাচ্ছে না। এখানকার গাই দুধ দেয়। ফলের ভারে বাগানের গাছগুলো সেজদার ভঙ্গিতে নুয়ে থাকে। মুরগির ডিম সমান ভাগে ভাগ হয়। দু’দিন ধরে মরিয়ম লক্ষ করছে, খাওয়ার সময় কেউ তাকে ডাকছে না। কাঁসার থালায় প্রসাদ আসে যমজদের হাত দিয়ে। সে দেবী না ডাইনি? এই যে সবার মতো আলাউদ্দিন ভাবিও দিনের বেলায় তাকে এড়িয়ে চলেন, পারত কথা বলেন না, এখন। তিনি অন্ধকার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছেন। রাত কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। স্বর্গধামের পালঙ্ক দুটি দুই জোড়া দম্পতির দখলে। সেখানে সুখ আর আনন্দের ঝড় বইছে। মাস দেড়েক আগে স্বামী বেঁচে থাকাবস্থায় যেসবে মিসেস আলাউদ্দিনের অংশীদার ছিল, এখন ওসব জিনিস দরজা-জানালা ভেদ করে তাকে তিরবিদ্ধ করে। এরকম সময় তিনি মরিয়মকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। জোরে জোরে দু-চারটা কথা বলে তিরগুলোর গতিমুখ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে চান। দিনে যে শত্রু, রাতে সে মিত্র। এ সময় মেরিকে ডাকতে মিসেস আলাউদ্দিনের সংকোচ হয়, কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে, আবার মায়াও হয় মেয়েটার জন্য। দিনে বড় অবিচার করেছেন। কোথায় বাবা-মা, আপনজন। তার তো তবু দুটি সন্তান রয়েছে। দিনের আলোয় মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। মিসেস আলাউদ্দিনের এসব ভাবনা কেবল রাতের বেলার–যখন তিনি একা শরশয্যায়, যখন দিনের মিত্ররা বন্ধ দরজার ওপাশে শত্রুতে রূপান্তরিত হয়।

স্বর্গধামের মানুষগুলো ভুলে যায়, যদিও গরু দুটি বালতি ভরে দুধ দেয়, মুরগি ডিম পাড়ে, গাছ ফল ফলায়–এখন যুদ্ধের সময়। স্বর্গধাম আসলে মায়া, তাদের যুদ্ধ তাড়িত মনের কল্পনা, অথবা স্বপ্ন, ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যা মিলিয়ে যাবে। যদি সত্যিও হয়, মর্তে স্বর্গসুখ বেশিক্ষণ টেকে না। মরিয়ম দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে স্বাধীনতা ভোগ করে, তাতেও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নগুলো দিনে দিনে বড় হয়। তার গোপন অতীত সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বিস্ফোরণ ঘটায় আচমকা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রমিজ শেখ স্বর্গধামে হাজির হয়। তারপর যা ঘটতে থাকে, প্রকারান্তরে তা মরিয়মের জীবনে। আগেই ঘটেছিল।

রমিজ শেখের আগমনে অন্তঃসত্ত্বা স্বপ্ন সবচেয়ে বেশি খুশি। কারণ স্বামীর ওপর তার ভরসা নেই। প্রসবের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন মানুষটা স্ত্রীর প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছেন। একই ঘটনায় মলিনা গুপ্তের প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন। রমিজ শেখের আগমনের রাতেই কোমরের বটুয়ায় স্ত্রীধন বেঁধে মেয়ে দুটিকে নিয়ে তিনি স্বর্গধাম ছেড়ে চলে যান। মিসেস আলাউদ্দিন আর আতিক ভাবি রমিজ শেখকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান। তারা তা করেন স্বপ্নর মতো একই কারণে। তাদের নিজেদের গর্ভজাত বা পালক সন্তান রয়েছে। অথচ এত বড় দলটায় কর্মক্ষম পুরুষ মাত্র দুজন। তাদের আবার স্বর্গধামের আরাম-আয়েশে থেকে গায়ে পোকা পড়ার উপক্রম। আতিক মিয়া আর তৈয়ব সাহেবের অবস্থা দেখে মেয়েরা ভুলতে বসেছিল, পাকসেনার বিরুদ্ধে। এ দেশের পুরুষেরা বন-বাদাড়ে থেকে লড়াই করছে। স্বাধীন বাংলা যতই জাহির। করুক, রেডিওটা তো যন্ত্র। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। বন্দুকধারী রমিজ শেখ রক্ত-মাংসের মানুষ। কখন, কোন দিক থেকে বিপদ চলে আসে–তখন চওড়া কাঁধের, খর্বাকৃতির, অভিব্যক্তিহীন, গেঁয়ো লোকটা সব সামাল দেবে।

এদিকে তৈয়ব সাহেব, আতিক মিয়া মেয়েদের আদেখলাপনায় বিরক্ত। রমিজ শেখ তাদের সৌভাগ্যে ভাগ বসাতে এসেছে, যা পুরুষ হিসেবে দুজন স্বর্গধামে একচেটিয়া ভোগ করছিল। মরিয়মের প্রতি তাদের আকর্ষণ দলের কারো অজানা নয়। এ নিয়ে আড়ালে-আবডালে প্রতিযোগিতাও চলে দুজনের। সেটি প্রকট হয় তাস পেটানোর সময়। খেলার যে নিয়ম-একজন হারলে আরেকজনের জিত হবে, তা তারা ভঙ্গ করে। প্রত্যহ চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে তাস গোটাতে হয়। মরিয়ম মরিয়মের জায়গায়। বিবাহিত পুরুষ হিসেবে তাকে বাগে আনার পথে বাধা বিস্তর, যা রমিজ শেখের নেই। লোকটা গোঁয়ার, বন্য প্রকৃতির, সারা দিন রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। এমন জিনিস হাতে থাকলে আজকের দিনে আর কিছু লাগে! যে যা খুশি করতে পারে। অবিবাহিত যুবতীসহ স্বর্গধামের পুরো কর্তৃত্ব তার হাতে চলে গেলে আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেব বুঝতে পারেন না, তারা তখন কী করবেন। মিলিটারির আক্রমণের চেয়ে এই বিপদটাই দুজনের বড় মনে হয়।

রমিজ শেখের পক্ষে-বিপক্ষে স্বর্গধাম বিভক্ত হয়ে গেলে মরিয়ম ফাঁপরে পড়ে। ভাবে, এই লোকটা তার শত্রু না মিত্র? স্বর্গধামের লোকজনের ব্যাপারে তার মনে কোনো সংশয় নেই। যুদ্ধের আগের ফুলতলি গাঁয়ের মানুষদের সঙ্গে এদের বদলে ফেলা যায়-কুটি আঁকা, তিরস্কার আর ঘৃণায় বাঁকানো মুখের অভিব্যক্তিসমেত। এই বাকা মুখগুলো যেন মৃত্যুঞ্জয়। মাঝখান থেকে মন্টু হারিয়ে যায়, আবেদের খোঁজ থাকে না, কফিলউদ্দিনের পরিবার ক্রমাগত ছোট হতে থাকে, গোলাম মোস্তফা তীরে বসে রোদ পোহান, হাজি সাহেব দেশপ্রেমিক বনে যান, রমিজ শেখ পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলার ভেতর তালগোল পাকিয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

পাকিস্তানি জনগণের বাঙালি-অবাঙালি বিভক্তির সময়টার পাক্কা দশ বছর রমিজ শেখ জেলখানায় ছিল। কী নিয়ে যুদ্ধটা বেধেছে, কে কাকে কেন মারছে–মার্চ এপ্রিলের পর মে মাস, এখনো তার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার নয়। রাজনীতির জ্ঞানগম্যি তার যতটুকু, তাও হাজি সাহেবের কাছ থেকে। তাই উত্তেজিত হলে এখনো পাকিস্তান। জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। জয় বাংলা বলার সময় তোতলায়। যেখানে গলা টিপে মানুষ খুন সম্ভব, অস্ত্রশস্ত্র তার বাহুল্য লাগে। তবে কাঁধের রাইফেলটা সে হাতছাড়া করে না। জিনিসটার বাড়তি শক্তিতে সে মুগ্ধ। এর মসৃণ বাঁটে সময়-অসময় হাত বোলায়, রোজ তেল পালিশ করে। সে দেশপ্রেমিক জনগণ বলতে বোঝে শান্তি কমিটির লোকদের। তার জানামতে, তাদের কাজ শুধু মেয়ে ও মুরগি সরবরাহ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের খেদমত করা। হাজি সাহেব একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক। কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকা ফিরে তিনি শান্তি কমিটির মেম্বার হয়েছেন। রমিজ শেখকেও সঙ্গে রেখেছিলেন। একেক দিন একেক মহল্লায় জাল ফেলার মতো মেয়ে আর মুরগি ধরার নির্দেশ ছিল তার ওপর। এখন শহরে জিনিস দুটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

স্বর্গধামে মোরগ-মুরগির স্বাধীন বিচরণ আর মেয়েদের সংখ্যাধিক্য রমিজ শেখকে নতুন করে ভাবনায় ফেলে। তাকে যদি দেশপ্রেমিক হতেই হয়, সে এখানকার ছোট বড় মেয়েসহ মুরগির ছানা-পোনা আর্মির হাতে তুলে দেবে। কিন্তু মেরিকে নয়। মেয়েটাকে পোড়া মরিচের ধোয়া দিয়ে বাঁচিয়েছে সে। ওর বাকি জীবন তার হাতে। আর এজন্যই হাজির জাল ছিঁড়ে পথ হাতড়ে হাতড়ে স্বর্গধামে তার আগমন।

রমিজ শেখের অতীত না জানলেও তার কিছু ত্রুটি আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেবের নজর এড়ায় না। তারা মুক্তিফৌজের অপেক্ষায় থাকেন। লুঙ্গিপরা একদল লোক খালি পায়ে স্টেনগান কাঁধে কোনো একদিন স্বর্গধামের দরজার কড়া নাড়বে, রাতের মতো আশ্রয় আর ভাত চাইবে। আতিক মিয়া, তৈয়ব সাহেব স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নির্দেশমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন বটে, তার আগে তাদের কানে তুলে দেবেন রমিজ শেখের আড়ষ্ট জিবের তোতলানো জয় বাংলা স্লোগান আর আঙুল দিয়ে দেখাবেন মসৃণ বাঁটের একটি বন্দুক, যা যুদ্ধের বাজারে শত্ৰু না মেরে বেগার বয়ে বেড়ানো হচ্ছে।

দিন যায়, রাত আসে। ভাত আর আশ্রয় চেয়ে দরজায় কাউকে কড়া নাড়তে শোনা যায় না। এর পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের পরস্পরের কাছে লেখা একটা সাংকেতিক চিঠি ভুল করে স্বর্গধামে চলে আসে। চিঠির দুটি লাইন তাদের কলজেয় জোর কামড় বসায়–এতগুলি মুরগি আর ডিম পাঠালাম কোনো কাজেই লাগাচ্ছ না, ব্যাপার কী?…আমি আবারও বলছি বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেই থেকে দুজন ভয়ে অস্থির। রমিজ শেখকে তাদের মনে হয় ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা, যে গোপনে তাদের বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালি করছে। আর নিজেদের তারা ভাবতে শুরু করেন, মুরগির ডিম ভালো কাজে না-লাগিয়ে, খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে এমন এক নতুন ধরনের বিশ্বাসঘাতক–যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

বাকি থাকে মেয়েরা। যারা সংখ্যাগুরু এবং রমিজ শেখের ধামাধরা। স্বর্গধাম বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতন। উত্তাল সাগরে ছোট্ট একটি ছিপ নৌকায় চেপে লোকটা যেন হাজির হয়েছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে একটা বন্দুক, একজোড়া লৌহবর্ণের কাঁধ, বেপরোয়া মনোভাব। মেয়েরা তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে ভূষিত করেছে। আর বীরের জন্য বরাদ্দ হয়েছে দ্বিগুণ খাবারদাবার, উত্তম বিছানা।

যা ভাবনার কথা অথচ কেউ ভাবে না, কিছুদিন পর তা ঘটে। স্বর্গধামে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ফলশূন্য গাছগুলো ডালপালাসমেত মাথা তুলতে শুরু করে। গাভির ওলান শুকিয়ে যায়। মুরগিরা থলে শূন্য হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ডিম পাড়ার পর নিয়মমতো তা দিয়ে বাচ্চা ফোঁটাতে না পেরে খুব হতাশ। শূন্য খাঁচা দেখলে খেপে ওঠে। ডিমপাড়ায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাউন্ডুলেপনা জুড়ে দেয়। এই পরিস্থিতির প্রথম শিকার হয় মরিয়ম। মেয়েরা তার খাবার বন্ধ করে দেয়। তাতে পুরুষ দুজনেরও হাত থাকে। কারণ মরিয়মের প্রতি তাদের ব্যর্থ অনুরাগ তত দিনে ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ছাড়া মেয়েদের হাতে রেখে হলেও স্বর্গধামের কর্তৃত্ব বজায় রাখায় তারা বদ্ধপরিকর।

প্রথম প্রথম নিজের পাতের খাবার মরিয়মকে দিয়ে খেলেও রমিজ শেখ এ অন্যায় বরদাস্ত করে না। মেয়েটি না খেয়ে মরবে তার চোখের সামনে, যাকে সে নিজ হাতে জীবন দান করেছে! স্বর্গধামে প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়। মেয়েরা অবস্থান পরিবর্তন করে এবং পুরুষদের সহযোগিতায় রমিজ শেখকে বীরের আসন থেকে ফেলে দেয়। তারা জনে জনে বলে বেড়ায়, মরিয়ম আর রমিজ শেখ লটঘট করছে, যা বিয়ের আগে করা ঠিক নয়–এ ব্যভিচার।

রটনাটির সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের প্রশ্নই ওঠে না। কেউ এর প্রমাণও চায় না। যুদ্ধের দিন। আইন নেই, আদালত বসে না। এর সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে স্বর্গধাম থেকে বহিষ্কার।

রমিজ শেখের পাতের খাবার ভাগ করে খেতে খেতে মরিয়ম অনুভব করে, তাকে বুক পেতে রক্ষা করছে রমিজ শেখ। লোকটা তার মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বামী-বন্ধু-যে কোনো কিছুই হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। চোখের সামনে আবেদ, মন্টু, কফিলউদ্দিন পরিবার, কলেজের বান্ধবী কেউ নেই যে মরিয়মের পাশে রমিজ শেখকে দেখে ভিরমি খাবে। সে জেলপালানো খুনের আসামি। দশ বছর কয়েদ খেটেছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে রমিজ শেখের পরিচয় কী হবে-মরিয়ম জানে না। এখন দরকার শুধু দুই বেলা খাবার, মাথা গোঁজার ঠাই, নিরাপদ আশ্রয়, যা এই লোকটাই তাকে দিতে পারে।

স্বর্গের নিষিদ্ধ ফল খেতে রমিজ শেখকে প্ররোচিত করে মরিয়ম। বলে যে, এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন ভারতে শরণার্থী। স্বর্গধামের মতো পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজলেই পাওয়া সম্ভব। সেখানে তাদের অপমান করার কেউ থাকবে না।

রমিজ শেখ মরিয়মের কথা ফেলতে পারে না। মেয়েটার বিদ্যাবুদ্ধি অনেক। সে নিজে পড়েছে–অ-তে অজগর, আ-তে আম, ওই অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে। তা বলে দুজন অকর্মা পুরুষ আর এক দঙ্গল মেয়ের ভয়ে পালাতে হবে! যা হোক কথাটা যে বলছে, সে তার নিজের লোক। হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রমিজ শেখ বিনা যুদ্ধে স্বর্গধামের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়।

স্বর্গধাম থেকে বেরিয়ে আসে আদম আর হাওয়া অগ্নিদগ্ধ, খুনাখুনির বিপজ্জনক এক পৃথিবীতে। সঙ্গে নেয় পেছনে ফেলে আসা আবাসের অনুরূপ একটি বাড়ির স্বপ্ন। সেখানে তারা হবে একমাত্র নর-নারী। তাদের দেখতে আকাশের ফালি চাঁদ দূর থেকে উঁকি দেয়। পরক্ষণে ভয় পেয়ে মেঘের আড়ালে লুকোয়। আকাশের বুক ফেটে গুমগুম আওয়াজ ওঠে। ছাই ছাই গাছের পাতা প্রবল ত্রাসে কাঁপতে থাকে। খারাপ কিছুর আশঙ্কা ব্যতিরেকেই দুজন অজানার উদ্দেশে যাত্রা করে।

তখনো রাত শেষ হয়নি। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কর্দমাক্ত রাস্তায় দু’ফাইল করে একদল সৈন্য স্বর্গধামের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের ভুতুড়ে ছায়া পড়েছে রাস্তার পাশের জলাশয়ে। যুদ্ধের এখন তৃতীয় মাস। উদ্যোগ-আয়োজনে তাদের খামতি নেই। খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-মার্চের তালে তালে শেষরাতের পৃথিবী ঘুমের ভেতর চমকে চমকে ওঠে। তাতে ভোরের গান গাওয়া পাখির তাল ভঙ্গ হয়।

স্বর্গের দুয়ারে কোনো পাহারা ছিল না। মরিয়ম আর রমিজ শেখ যে পথ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সৈন্যরা তার ঠিক উল্টো দিক থেকে আসে। স্বর্গধাম শূন্য। লোকজন বুটের আওয়াজ পেয়ে পালিয়েছে। বাউন্ডুলে মুরগিগুলো রাতে খোয়াড়ে না-ঢুকে গাছে উঠে বসেছিল। ওখান থেকে স্বপ্নার প্রসববেদনার কাতরানি শোনা যায়। তার জন্য ধাই আসে না। আতিক ভাবি, পুরুষ মানুষরে বিশ্বাস করছেন তো মরছেন’-কথাটা। কদিন আগে যে বলেছিল, তার জীবনে তা সত্য হয়ে ওঠে। সৈন্যরা প্রতিটি ঘরে। তল্লাশি চালায়। সদ্য ত্যাগ করা উষ্ণ বিছানা-বালিশ রাগে লন্ডভন্ড করে। তবে কোনো গুলি ছোড়ে না। বেয়নেট দিয়ে স্বপ্নর উঁচু পেটটা চিরে দেয়। গোয়ালঘরে তখনো গাই দুটি বাঁধা। তারা এদের আঘাত করে না। শুধু দড়ি খুলে হিড়হিড় করে বাইরে নিয়ে আসে। অপারেশনের লাভের তালিকায়-বাছুরসহ দুটি গরু (জীবিত), একজন নারী ও একটি শিশু (মৃত)। তারা তাতে সন্তুষ্ট হয় না। স্বর্গধামের ঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর গরম আঁচে গাছের ডালে বসা মুরগিগুলো কককক ডাকতে শুরু করে। তাদের গায়ে গায়ে ঠ্যালাঠেলি অন্ধকারে দেখা যায় না। সৈন্যরা সন্ত্রস্ত–যেন এক দল মুক্তিফৌজ এলএমজি কক করে অটোতে নিয়ে বাগিয়ে ধরেছে। তারা ঝটপট মাটিতে। শুয়ে, সেই অবস্থায় পজিশন নেয়। প্রথম দফায় বুলেটগুলো মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। কককক আওয়াজ বাড়তে শুরু করলে সৈন্যরা গাছের ডাল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। বাউন্ডুলে মুরগিগুলো সারেন্ডার করে না। থলে শূন্য হালকা শরীর নিয়ে উড়তে শুরু থাকে। সৈন্যরা নাছোড়, কককক আওয়াজ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত টানা গুলি চালিয়ে যায়।

০৬. এখন যুদ্ধের তৃতীয় মাস

যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মরিয়মের সাক্ষাৎকার যে গ্রহণ করে, অর্থাৎ মুক্তি, সে স্বর্গধামের পতনের রাতটির ওপর মোটা করে হলুদ মার্কারে দাগ টেনে মার্জিনে লেখে—‘দুর্ভাগ্যের সূচনা?’ প্রশ্ন চিহ্নটা শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। কারণ প্রশ্নগুলো জটিল আর উত্তরটা সহজ–বিষয়টা ওর কাছে এমন ছিল না। কারো কারো মনে হতে পারে, মরিয়মের দুর্ভাগ্যের শুরু মহুয়া সিনেমা হল থেকে, যেখানে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী এক তরুণ, পর্দায় লাভসিন দেখে তার হাত চেপে ধরেছিল। কিংবা ভাবা যাক–যুদ্ধ বাধার ঠিক দুদিন আগে, সে যখন মন্টুকে বাড়ি পাঠিয়ে টিউবওয়েলের নর্দমায় আধখানা ইটের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল–সেই মুহূর্তটি। যা মরিয়ম নিজেই দুর্ভাগ্যের সূচনা হিসেবে শনাক্ত করেছিল। হয়তো আলাদা করে এসবের কোনোটাই নয়। মরিয়মের জীবন এ সমস্ত কিছুরই যোগফল। মুক্তির আরো মনে হয়, এ ক্ষেত্রে মেরি প্রকারান্তরে মরিয়ম একটি উদাহরণ মাত্র। তার দুর্ভাগ্যের কারণ হয়তো নারীর প্রজনন অঙ্গটি, যা বংশরক্ষার সূচিমুখ-এর পবিত্রতা। যা শুধু একজন পুরুষের ব্যবহারের জন্য এবং বৈধভাবে। সেটি অরক্ষণীয় হয়ে পড়ে যুদ্ধের বছর। শত্রুর পুরুষাঙ্গ তাতে ঢুকে পড়ে। বীর্য ডিম্বাশয়ে চলে যায়। জ্বণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। স্বাধীনতার পর বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে গর্ভপাত ঘটানোর পরও নারীদেহের পবিত্রতা পুনরুদ্ধার হয়নি।

এসব অবশ্য পরের কথা।

যুদ্ধের এখন তৃতীয় মাস। ফুলতলি গ্রাম আর কত দূর বা ওখানে কোনো দিন পৌঁছানো যাবে কি না মরিয়ম তখনো জানে না। সে রমিজ শেখকে সঙ্গে নিয়ে স্বর্গধামের অনুরূপ একটি বাড়ি খুঁজছে। পরিত্যক্ত, জনহীন, ঐশ্বর্যময়। তারা যেসব জনপদের ওপর দিয়ে যায়, সেখানে দু-চারটা খালি ঘরবাড়ি আছে বটে, সেসব হতদরিদ্র, বসবাসেরও যোগ্য নয়। জানালা-দরজা-বেড়ার চিহ্নমাত্র নেই, চালটুকু শুধু শূন্যে ঝুলে আছে, ভিটাবাড়ির আশপাশে আগাছার জঙ্গল, দিনের বেলা পুকুরপাড়ে শিয়াল ডাকে, বসতবাড়ির কড়িকাঠে পাচা ডিগবাজি খায়, আর উঠানে ঢোকার পথটা শ্যাওলা জমে এমন পিচ্ছিল যে, হাঁটতে গেলে হাত-পা ভাঙার উপক্রম হয়। তবু মরিয়ম আর রমিজ শেখ আশা ছাড়ে না। যুদ্ধ শুধু দু’হাতে নেয় না, দেয়ও। তা না হলে তারা স্বর্গধাম পেয়েছিল কীভাবে! তবে চলার পথে অহেতু ঝঞ্ঝাট কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই যথাসম্ভব মানুষের ছায়া এড়িয়ে চলে। ভুলক্রমে গৃহস্থবাড়ির কাছে। গেলেই ‘কিডা যায় রে, দেখ দিকিনি’ বলে মানুষজন হাঁকডাক জুড়ে দেয়। তখন একথা-সেকথা বলে ছাড়া পেতে অযথা সময় নষ্ট হয়। সেই তুলনায় ফসলের মাঠ নিরাপদ। যুদ্ধের দিনে খেতে যারা কাজ করে, পেটের দায়েই করে। সেখানে বাড়তি কথা বলার সুযোগ কম। তার মধ্যে হঠাৎ দূরের ধানখেতে প্রথম একটা মাথাল, পরে আস্ত মানুষটা মাথা তুলে দাঁড়ায়, ‘আপনেরা যাচ্ছেন কনে-এ-এ, কোথা থেইক্যে আসা হচ্ছে-এ?’ লোকটা দু-দুবার চাচানোর পর আর চুপ থাকা যখন ভালো দেখায় না, তখন রমিজ শেখ সামনের গ্রামটার নাম জানতে চায়। কৃষক দিগন্তের দিকে ঈদের চাঁদের মতো হাতের কাস্তে উঁচিয়ে বলে, ‘ওই-ওইটা হলো গে রাধানগর, মিলিটারিরা পুইড়ে ছাই করে দেছে। তার পরের গিরামের নাম নতুনগাঁও। ওই গিরামে মানুষজোন পালিও পাতি পারেন।’

নতুনগাঁও, রাধানগর নামগুলো কেমন চেনা লাগে মরিয়মের। আজ থেকে বছর তিরিশ আগে তার বড় ফুপু সাহার বানুর বিয়ে হয়েছিল রাধানগর মুন্সিবাড়ি। বিয়ের বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে গুটিবসন্তে ফুপুটা মারা যায়। মেরি তাকে দেখেনি। সে স্কুল ফাঁকি দিলে বা পড়ালেখা করতে না চাইলে কফিলউদ্দিন আহমেদ দুঃখ করে ছোট বোন সাহার বানুর কথা বলতেন। সাহার বানুর নাকি লেখাপড়ায় খুব মাথা ছিল। বিয়ের পর ফিরানির সময় যে ট্রাংকে করে সে বইখাতা নিয়ে যায়, এক বছরে পড়ালেখা দূরে থাক, একবার এর তালা খোলারও সুযোগ পায়নি। সাহার বানুর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা শাড়ি-কাপড়, গয়নাগাটি রেখে তালাবন্ধ ট্রাংকটা শুধু ফুলতলি গ্রামে ফেরত পাঠিয়েছিল। কারণ সেইকালে রাধানগর মুন্সিবাড়িতে বউ ঝিদের লেখাপড়ার রেওয়াজ ছিল না।

কিছুদূর হাঁটার পর রাধানগর গ্রাম ছাড়িয়ে তারা নতুনগাঁওয়ে পৌঁছায়। সেখানকার মানুষগুলো উড় উড়। তাদের এক পা বাইরে, আরেক পা ঘরে। রমিজ শেখের কাঁধে রাইফেল দেখে তারা ইঁদুরের মতো চোঁ-চো পালাতে শুরু করে। সে মুক্তিযোদ্ধা কি রাজাকার, তাতে কিছু যায়-আসে না। মুক্তিফৌজের গন্ধ পেয়ে দু’দিন আগে পাকসেনারা পাশের গ্রাম শশ্মশান বানিয়ে রেখে গেছে। এদিকে রাজাকারের উৎপাতে তারা নিজেরাই অতিষ্ঠ। এ অবস্থায় রমিজ শেখ যে মুক্তি বা রাজাকার নয়, সমানে ডাকহক ছেড়ে জনে জনে তা বোঝতে শুরু করে।

‘তো ভাইজান,’ পনেরো-ষোলো বছরের একটি ছেলে, যার বন্দুক হাতে যুদ্ধ করার শখ, সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ‘রাইফেলটা কেন সঙ্গে রাখিছেন, আমারে দেন দিকি! আমি চালাই।’ বলেই থাবা মেরে নিয়ে যায়।

এমন জবরদস্ত অভ্যর্থনার জন্য মরিয়ম বা রমিজ শেখ কেউ প্রস্তুত ছিল না। যদিও অস্ত্রটা এযাবৎ তাদের কোনো কাজেই লাগেনি, তবু লোকটাকে একই সঙ্গে তা পরিচিত করেছে মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার হিসেবে। পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর জয় বাংলা স্লোগান দুটি এখন রমিজ শেখের সড়গড়। কিন্তু কোনটা কোথায় বলতে হবে-বুঝতে পারছে না। হয়তো পারত পুরো নয় মাস সময় পেলে। এখন সবে যুদ্ধের তৃতীয় মাস।

বন্দুকটা হারিয়ে রমিজ শেখ নতুনগাঁওয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। আগের মতো সে যেন আবার জেলখানায়, হাত-পা ঝাড়া, নিজের বলতে কিছু থাকল না। পুরোনো অভ্যাসমাফিক এক কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার বলতে থাকে। মেরি কেন স্বর্গধাম থেকে তাকে নিয়ে এল, একদঙ্গল মেয়ে আর পুরুষ দুজনকে খেদিয়ে রাজা-রানির হালে তারা থাকতে পারত ওখানে। কিন্তু জেলখানার মতো লোহার গরাদ ধরে এক কেচ্ছা দশবার শোনার শ্রোতা নতুনগাঁওয়ে নেই। অস্ত্র কেড়ে নিলেও গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে তাদের রাতের খাবার আর আশ্রয় জোটে। তারপর গ্রামের মেয়েরা মরিয়মকে নিয়ে পড়ে আর হাতে একখানা লাঠি দিয়ে রমিজ শেখকে পাঠিয়ে দেয় হাফ ডজন জোয়ান মরদের সঙ্গে গ্রাম পাহারা দিতে।

টেঁটা-বল্লম, রামদা, লাঠি হাতে হাঁক ছেড়ে নতুনগাঁওয়ের লোকেরা যেন চর দখল করতে যাচ্ছে, এমনই তাদের হাবভাব, প্রস্তুতি। বা পাকা ধানখেতের ছিঁচকে চোর ধরতে যাচ্ছে যেন। রমিজ শেখ মনে মনে হাসে-গ্রামের লোকেরা কী বোকা, পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র দিয়ে হবে গ্রাম পাহারা! ছয়জন পাহারাদারের মাঝখানে নিজেকে তার বেশ চালাক মনে হয়। বন্দুকটা খোয়ানোর দুঃখ সে ভুলে যায়। গড়গড়ায় টান দিতে দিতে খেতের আইলে বসে নানান কথা বলতে ইচ্ছে করে।

হাফ ডজন পাহারাদার, রমিজ শেখের শহরে মেয়ে আর মুরগি পাকসেনাদের ভেট দেওয়ার কেচ্ছাটা বিনাবাক্যে হজম করে। কিন্তু হাজি সাহেব যে দেশপ্রেমিক নাগরিক, তা তারা মানতে রাজি নয়। তারা বলে, লোকটা বেইমান-মুক্তিরা পেলে তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। কেন? রমিজ শেখ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে জানে, বিশেষত মেয়েদের জোরজবরদস্তি বা কৌশলে আর্মির হাতে তুলে দেওয়াটা খারাপ কাজ। এর কারণ হাজি সাহেবের কাছে একদিন সে জানতেও চেয়েছিল। হাজির ব্যাটা পরহেজগার মানুষ, ধর্মের পথছাড়া এক কদম চলেন না। ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘দেখ। রে বাজান, পূর্ব পাকিস্তানটা এখন শত্রুর দেশ, আর মেয়েরা হইলো গিয়া গনিমতের মাল। যুদ্ধের ময়দানে তাদের ভোগ করার কথা আল্লার কালাম পাকে বলা আছে। তাতেও যখন শ্রোতার মন গলে না, তার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখটা নেমে আসে রমিজ শেখের মুখের কাছে। যাকে রাতের অন্ধকারে কয়েদির পোশাক পাল্টিয়ে নিজের একপ্রস্থ কাপড় পরিয়েছেন, শয্যা পেতে দিয়েছেন ত্যাজ্য পুত্রের বিছানায়-আশ্রয়দাতার অগোচরে তার কিছু থাকতে পারে না। তিনি পরপর দু’দিন জেরা করে কয়েদির অপরাধ-বৃত্তান্তের প্রায় সবটুকু জেনে নেন। তারপর যখন দেখলেন সে দাগি, তা আবার খুনের মামলার, সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন, সে-ই হবে এই অবিশ্বাসের দুনিয়ায় তার বিশ্বস্ত অনুচর। নিজের অপরাধ জানাজানির ভয়ে বাকি জীবন দড়ি-বাঁধা কুকুরের মতো পায়ের কাছটায় পড়ে থাকবে। ভুলেও কুঁই কুঁই করবে না। তবে এখন যুদ্ধের সময়–তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন, সওয়াল-জবাব করতে মন চাচ্ছে যখন কুকুরটার, বাধা দিলে পালিয়ে যাবে। হাজি সাহেবের আনত মুখের লালা ছিটকে পড়ে রমিজ শেখের চোখে-মুখে। রাগ চাপতে গিয়ে তার দু’টি দাঁত প্রবল ঘর্ষণে কিড়মিড় করে, ‘কী হালার পো, নিজে বউ ছাড়া থাকতে পারলি না, বয়ে আনতে গেলি–হা-হা । অরা থাহে ক্যামনে-ক দেহি? হাজার মাইল দূরে বউ-বাচ্চা–মাইয়্যা মানুষ ছাড়া থাহে ক্যামনে, ক দেহি?’ বলে বাপের বয়সি মুরুব্বি রাগ আর গায়ের জোর মিশিয়ে লুঙ্গির ওপর দিয়ে রমিজ শেখের পুরুষাঙ্গটি খপ করে ধরেই মুচড়ে দিলেন। রমিজ শেখ চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে হাজির বাহাস্ শোনে, ‘লাঠিটা খালি তোর একলারই, অগোর নাই!’

পাহারাদারদের কথামতো এখন হাজি সাহেব যদি শাস্তি পান, তার কী হবে। সে নিজেও তো বউ বাপের বাড়ি থেকে আসতে চায়নি বলে গলা টিপে ধরেছিল-নরম তুলতুলে জানটা জিব ঠেলে তার করতলে ছটফটিয়ে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত। জেরা করার সময় উকিল সাহেব আদালতকে জোড়হাতে বলেছিলেন, হুজুর, আমার মক্কেল নির্দোষ, সে জানত না যে, সামান্য রঙ্গ-তামাশায়, তার বিবাহিত স্ত্রী, প্রাণের পুতুলি বেঘোরে প্রাণ হারাবে। আমার মক্কেল হুজুর স্ত্রী-অন্তপ্রাণ। রাতের পর রাত ঘুমাতে না পেরে, আমার মক্কেলের হুজুর, মাথায় বায়ু চড়ে যায়। এটা ঠান্ডা মাথার খুন নয়, এর। পেছনে ভালোবাসার বাড়াবাড়ি ছাড়া অন্য কোনো মোটিভ ছিল না–আদালতের কাছে তা প্রমাণ হয়। তাই মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে, মহামান্য আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। অথচ এর দুই বছর মেয়াদ থাকতে সে পালিয়ে এল জেলখানা থেকে। যুদ্ধের মাপে রমিজ শেখ জানে, এটা কোনো অপরাধই নয় এখন। এমনকি ঠান্ডা মাথায় বউ খুন করাটাও। এসবের জন্য এখন আদালত বসে না। উকিল-মোক্তারকে পয়সা খাওয়াতে হয় না। তাদের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে আগের মতো ভিটেবাড়ি বন্ধক দিতে হয় না। এখন বেঘোরে মানুষ মরছে, কে কাকে মারছে হিসাব নাই। অথচ এই বোকা লোকগুলো বলছে, হাজি সাহেবকে মুক্তিবাহিনী হাতের কাছে পেলে জ্যান্ত কবর দেবে, মেয়ে আর মুরগি আর্মির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। ফের হাসি পায় রমিজ শেখের। কিন্তু সে হাসে না।

নতুনগাওয়ের লোকগুলো, যারা আর্মির হামলা থেকে গ্রাম রক্ষার জন্য টেটা-বল্লম হাতে পাহারায় নেমেছে, তারা রমিজ শেখের ওপর বিরক্ত হয়। আজকের দিনে কে মোনাফেক-বেইমান আর কে দেশপ্রেমিক, তা-ও যদি ভেঙে বলা লাগে! কী রকমের বেকুব সে? হাজি লোকটা তো এখন শহরে বসে রাজাকারি করছে, মুক্তিরা হাতের কাছে পেলে তাকে যে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে–এমন সোজা কথাটাও যে উজবুক বোঝে না, তাকে বোঝাবে কে? ছয়জন পাহারাদার অন্ধকারে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এর মধ্যে একজন হঠাৎ খেপে উঠে বলে, ‘তোমার হাজি সাহেব হলো গিয়া মিরজাফর–বেইমান, নিমকহারাম। দেশটা যে বেচি দেছিলো ইংরেজের কাছে–সে খেয়াল আছে?’ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন হায় হায় করে ওঠে, ‘সত্যি সত্যি বেচে তো দিল, যুদ্ধ তো সে করল না। পলাশীর আম্রকাননে কাঠের পুতুলের মতো খাড়ায় থাকল, ব্যাটা সিপাহসালার!’ তারা হাজি সাহেবকে মিরজাফরের জায়গায় ঠেলে দিয়ে কিছুটা ভারমুক্ত হয়। মনে মনে নিজেদের বুদ্ধিরও তারিফ করে। বাকি থাকেন দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলা।

ফি-বছর শীতকালে নতুনগাঁওয়ের স্কুলমাঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পালা মঞ্চস্থ হয়। ভাটি অঞ্চল থেকে আসে নবরত্ন অপেরা। তারা মাটি খুঁড়ে তাঁবুর খুঁটি পেতে, প্যান্ডেল খাটায়। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে হ্যাঁজাক জ্বেলে যাত্রা শুরু হয়। চলে সকাল পর্যন্ত। কিন্তু পুরোটা কখনো শেষ হয় না। প্যান্ডেলের ফাঁক দিয়ে সূর্যকিরণ হামা দিয়ে মঞ্চে উঠলে দর্শকরা যাত্রাপার্টির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে বাড়ি ফেরে। পরদিন অসমাপ্ত পালা দেখার জন্য ফের স্কুলমাঠে জড়ো হয়। ঘামে ভেজা শ্রমের টাকায় টিকিট কেনে। অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারে আগমনের, গায়ের লোম কাঁটা দেওয়া সেই দৃশ্যটির, যেখানে নকিব চোঙা ফুঁকে ঘোষণা দেবে, ‘নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শাহ্‌কুলি খাঁ মির্জা মুহাম্মদ হায়বতজঙ্গ বা-হা-দু-র।’ তখন তাদের বুকের ছাতি ঢোলের মতো ফুলে ওঠে নবাবের গর্বে। নামটা আরো লম্বা হলে গর্ব আরো বেশি হতো। বুকটা ফুলে হতো দ্বিগুণ। নিজেদের ছোট ছোট অকিঞ্চিৎকর নামগুলো বাষ্পের মতো বাতাসে মিলিয়ে যায়। একবার তো ‘চেয়ে দেখুন বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা’ ডায়লগটা দেওয়ার সময় নবাবের গোঁফের একপাশ খুলে ঝুলে পড়েছিল। দর্শকরা হেসে ওঠেনি, শিস দেয়নি। তারা যেন মুর্শিদাবাদ রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্রের আলো-আঁধারে বন্দি। সিরাজউদ্দৌলার মতোই সংকট তাদের বাঁচা-মরার, জয়-পরাজয়ের। বা তার চেয়েও বেশি–কারণ সিরাজ তো জানতেন না, আর তারা জানে যে, তিনি যুদ্ধে পরাজিত হবেন, রাজ্য হারাবেন, নির্মমভাবে মৃত্যু হবে বাংলার শেষ নবাব, কমবয়সি, দুঃখী সিরাজউদ্দৌলার। তারা এ-ও জানে যে, রাতের পর রাত যাবে, পালা শেষ হবে না, নবাবের অবধারিত মৃত্যুদৃশ্য বুকে পাষাণ বেঁধে তাদের সইতে হবে না। যাত্রার এই পর্বে তখনো তিনি জীবিত। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোলায়মান। দরবারে উপস্থিত–মিরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি ওয়াট্‌স। মঞ্চের নিচের একপাশ থেকে গুমগুম ড্রামের আওয়াজ ছুটে এসে দর্শকের বুকে বাড়ি মারছে। বেলের আঠা খুলে ঝুলে পড়া গোঁফ টেনে বসাতে বসাতে নবাব আগের সেই কম্পিত গলায় বলছেন, ‘বাংলার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা। জাতির সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী। শুধু সুপ্ত সন্তান শিয়রে রুদ্ধমানা জননী–নিশাবসানের অপেক্ষায় প্রহর গণনায় রত। কে তাকে আশা দেবে? কে তাকে ভরসা দেবে? কে তাকে শোনাবে জাগরণের সেই অভয়বাণী? ওঠো, মা ওঠো। মোছো তোমার অশ্রুজল। সাত কোটি বঙ্গসন্তান হিন্দু-মুসলমান। আজ জীবন দিয়ে রুখব আমরণের এই অভিযান।’

মেঘের পর মেঘ জমছে। রাতের পৃথিবী মসিমাখা, তিমির বর্ণের। অদূরে শত্রুর ছাউনি। শিয়াল ডাক ছেড়ে রাতের প্রহর ঘোষণা করছে। প্যাচা অমঙ্গলের সংকেত জানাচ্ছে গাছের মগডাল থেকে। ছয়জন পাহারাদার যেন পলাশীর অন্ধকার প্রান্তরে দণ্ডায়মান। হাতে তাদের টেটা-বল্লম, রামদা। মুখে আমরণের অভিযানের দীপ্ত শপথ। বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বিদেশি শত্রুর হাত থেকে দেশটাকে রক্ষা করবে। তারা হচ্ছে দেশপ্রেমিক, অতীতের নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত অনুচর-মিরমর্দান আর মোহনলাল।

রমিজ শেখ দেশপ্রেমের গাম্ভীর্য ও শহিদি উদ্দীপনার মাঝখানে উশখুশ করে। অদ্ভুত তো এই নতুনগাঁওয়ের মানুষগুলো! সিরাজউদ্দৌলা ভর করেছে ওদের। সেই কোনকালের অদেখা অচেনা এক নবাবের শোকে সবাই যেন পাথর বনে গেছে। আগের গোয়ার্তুমি ভাবটা নেই। কেমন শান্ত মেজাজের ফেরেশতা একেকজন। কিন্তু মনে মনে তাদের এক পণ, দেশের জন্য জান দেবে, বিদেশি শত্রু তাড়াবে আর হত্যা করবে মিরজাফরদের। রমিজ শেখের ভয় ভয় লাগে। এই খুন আর পাল্টা খুনের শেষ কোথায়? এসব ঠান্ডা না গরম মাথার খুন? যুদ্ধ থামার পর আদালত যদি বসে কোন আইনে বিচার হবে তাদের!

দুনিয়াটা এক আজব জায়গা। বিদেশিরা আসবেই লোভ করে। দেশের মধ্যে একজন দেশপ্রেমিক থাকবেনই। আর মিরজাফররাও হাঁটাচলা করবে তাদের কাছাকাছি ছায়ার মতন। যেন একটা সাজানো নাটক। চরিত্রগুলোও গাধা। এর বাইরে কেউ থাকতে নেই–যে মারতে বা মরতে চায় না। কত শত বছর ধরে একই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে আর মানুষগুলো অভিনয় করছে তাদের বাধা ভূমিকায়! রমিজ শেখ নিজে কার দলে–হাজি সাহেব, না এই ছয় পাহারাদারের? দেশপ্রেমিক যে হাজি সাহেব নন, এখন তা স্পষ্ট। তিনি মিরজাফর। কিন্তু যুদ্ধে তো সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় হয়েছিল, বাংলার মসনদে বসেছিল মিরজাফর, যে দেশপ্রেমিক নয়। রমিজ শেখ মরতে চায় না। কপালগুণে ফাঁসির দড়ি ফসকে বেরিয়ে আসা খুনের আসামি সে। জীবনটা যে হেলাফেলার জিনিস নয়, বিচারের রায় পাওয়ার আগের কয়েক মাস হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। রোজ রাতে বউয়ের বেশ ধরে আজরাইল এসে বসত তার গরাদের পৈঠায়। বিয়ের গীত গাইত কুনকুনিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে চলে যেত রাতের শেষ প্রহরে প্রহরীর হুঁশিয়ার ডাক শোনার পর। তার যাবজ্জীবন হওয়ার পর বউ আর আসেনি, অভিমানেই হয়তো!

দেখতে দেখতে জায়গাটা পলাশী হয়ে ওঠে আর সময়টাও দুই শ’ চৌদ্দ বছর পিছিয়ে চলে যায় ১৭৫৭ সালে। নতুনগাঁওয়ের পাহারাদাররা শুধু পাহারাদার থাকে না, হয়ে ওঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত অনুচর। কথা বলে, চলাফেরা করে ঘোরের ভেতর, যাত্রার ঢঙে। তাদের হাতের তেঁটা-বল্লম আর রামদাগুলো যেন তলোয়ার, উত্তেজনার মুহূর্তে এক টানে কোষমুক্ত করে মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরে। গা ছমছম করে রমিজ শেখের। সে যদিও নিজের পক্ষ এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি, তবু মনে হয়, মানুষগুলো তাকে জোর করে মিরজাফরের দলে ঠেলে দিয়েছে। রাইফেলটা সঙ্গে থাকলে এত অসহায় লাগত না। অস্ত্রটা হাতিয়ে নিয়ে গেল কোথায় ছোকরা? এরপর তো তাকে আর দেখা গেল না। পদে পদে এত বিপদ, সে হাজি সাহেবের কাছে থেকে গেলেই পারত! লোকে যতই গালমন্দ করুক, যুদ্ধে জয়লাভ করে তো মিরজাফর, হেরে ভূত হয় সিরাজউদ্দৌলার দল। একটা মেয়েমানুষের জন্য, বিজয়ী পক্ষ ছেড়ে সে জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে নেমেছে–দশ বছর জেল খেটে তো কোনো শিক্ষাই হলো না। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মা-বাপ মরল তার কয়েদবাসের সময়। জীবনের শেষ। ক’টা দিন সর্বস্বান্ত বুড়ো-বুড়ি একমুঠো ভাতের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে ফিরেছে। কেউ ভিক্ষা দেয়নি। খুনি পুত্রের বাপ-মায়ের না-খেয়ে মৃত্যু, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে গাঁয়ের ধনী-গরিব সবাই। রমিজ শেখ জানে না, হাজি সাহেব জায়গা না-দিলে কয়েদির পোশাকে সে কোথায় দাঁড়াত। কে তাকে আশ্রয় দিত। যে দুনিয়ায় নির্দোষ বাবা-মায়ের ঠাই হলো না, তার হতো? দূর সম্পর্কের বড়লোক আত্মীয়, যার চৌকাঠে হাফ প্যান্ট, ছেঁড়া শার্ট আর খালি পায়ে সেই কবে মায়ের হাত ধরে ভয়ে ভয়ে একদিন দাঁড়িয়েছিল, আশ্চর্য যে, এক মুখ দাড়ি-গোঁফ আর কয়েদির পোশাক সত্ত্বেও লহমায় চিনে ফেললেন! বিমুখ করলেন না। সব জানার পর আরো আপন করে নিলেন। রেগে গিয়ে একবার অণ্ডকোষ মুচড়ে দেওয়া ছাড়া হাজির ব্যাটা তার কী ক্ষতি করেছে যে, না বলে-কয়ে সে চলে এল! এই দেশে বেইমান-বিশ্বাসঘাতক যদি কেউ থাকে, সে রমিজ শেখ।

হালে রমিজ শেখ মরিয়মের ভাবগতিকও বুঝতে পারে না। শিক্ষিত মেয়ে, স্বর্গধাম থেকে বেরিয়ে এল তার হাত ধরে, জাতকুল ছেড়ে আসার মতন। টানা দুই দিন ঘুরল পথে পথে। তারপর একটা আশ্রয় যখন পেয়ে গেল, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ময়লা কাপড়ের মতো দলা পাকিয়ে। দুনিয়ার এই বিচার? নতুনগাঁওয়ের লোকদের একবার সে বললে পারত, মানুষটা দুই দিন না-খাওয়া, নিধুম, তোমরা তাকে পাহারায় নিয়ো না, আজকের রাতটা অন্তত সে বিশ্রাম করুক। তা তো বললই না, মনে হলো রমিজ শেখকে চেনেই না–এমন ভাব করে মেয়েদের হাত ধরে অন্দরমহলে চলে গেল । সিরাজউদৌল্লা যাত্রার এই চৌহদ্দি থেকে জান নিয়ে ফিরতে পারলে, লাট সাহেবের বেটিকে সে দেখিয়ে ছাড়বে কত ধানে কত চাল।

কিন্তু সেই সুযোগ মনে হয়, রমিজ শেখের জীবনে আর আসবে না।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা পালা দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। ছয়জন নটের অবস্থা সঙ্গিন। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের বাহিনী হেরে গেছে, মিরজাফর ক্লাইভের শিবিরে। লুকোছাপার পর্ব শেষ। সবকিছু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট–শত্রু-মিত্র চিনতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। ইংরেজ বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে নবাবকে বন্দি করতে। তার সর্বক্ষণের সহচর এখন গোলাম হোসেন। সে নবাবকে ছেড়ে যায়নি। আরেকজনও যায়নি–সে আলেয়া। পাহারাদারদের মধ্যে কোনো নারী না থাকায়, চরিত্রটি আগাগোড়া উহ্যই রেখেছে। নবাব মুখে যতই বলুক, ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন, উপায় নেই,’ আসলে গোলাম হোসেনই এখন তার একমাত্র বল-ভরসা। তা নবাবও জানেন। গোলাম হোসেন সিরাজউদ্দৌলাকে তাড়া দিচ্ছে রাজধানীতে ফিরে গিয়ে দ্রুত সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে পুনরায় যুদ্ধ করতে। ভগ্নহৃদয় নবাব। মুখে যদিও কথার খই ফুটছে, চলাফেরার শক্তি রহিত। গোলাম হোসেন গোঁয়ারের হদ্দ, নবাবকে কৌশলে তাতাচ্ছে—’জাহাপনা, আমরা আবার যুদ্ধ করব। আবার সৈন্য সংগ্রহ করব। এক জন্মে না পারি, জন্ম-জন্মান্তরের সাধনা দিয়ে বাংলা, বাঙালির এই লজ্জা দূর করব।’ এদিকে নবাবও হুঁশের পাগল–চিবিয়ে চিবিয়ে বলছেন, ‘কিন্তু মিরজাফর, জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, উমিচাঁদের দল কি আর জন্মগ্রহণ করবে না গোলাম হোসেন?’

তাহলে উপায়? ছয়জনের বিভ্রান্ত দৃষ্টি পড়ে রমিজ শেখের ওপর। এক পলকে অনেকগুলো বছর দৌড়ে পিছিয়ে যায়। মিরজাফর, জগৎ শেঠরা যুগে যুগে জন্মায় এই বাংলায়, দেশটাকে শত্রুর পদানত করে রাখতে। এই তো সামনে–নবজাতক বিশ্বাসঘাতক। তাদের ঝাড়েবংশে শেষ করতে না পারলে বাঙালির মুক্তি নেই। পাহারাদাররা দ্রুত রমিজ শেখের দিকে এগিয়ে যায়। দুই শ’ বছর আগেকার বাংলা, বাঙালির লজ্জা দূর করার শপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজি সাহেবের বিশ্বস্ত অনুচরের ওপর।

রমিজ শেখ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে সে শত্ৰুবেষ্টিত। তাদের অস্ত্রগুলো তার মুখের ওপর অন্ধকারে ঝলকাচ্ছে। সে তো আর মিরজাফরদের ষড়যন্ত্রে শরিক ছিল না যে, তার প্রস্তুতি থাকবে। তবু রামদায়ের প্রথম কোপটা হাতের তালু দিয়ে ঠেকায়। দুটি তরতাজা আঙুল খসে পড়ে মাটিতে। রমিজ শেখ নিজে না চাইলেও সে একজন নট বটে এই পালার। তাই জানে, পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। অদূরে ইংরেজ শিবির, ওখানে স্বয়ং মিরজাফর আছেন। কোনোক্রমে একবার পৌঁছে গেলে প্রাণে বেঁচে যাবে। রমিজ শেখের গায়ে অসুর ভর করে। সে ছয়জনের বিরুদ্ধে খালি হাতে একা লড়ে শত্রুর বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে যায়। তারপর গা ভরা রক্ত আর ক্ষত নিয়ে ছোটে একাত্তরের মিরজাফরের অনুচর শত্রুশিবিরের দিকে। আর তার পেছন পেছন দৌড়ায় ছয় পাহারাদার। তারা তখনো পালার একাগ্র নট। যে অংশটি অভিনীত হওয়ার আগে ভোর হয়ে যেত, বারবার টিকিট কেটেও কোনোদিন দেখতে পায়নি, সেই অদেখা দৃশ্যে তারা নিজেরা এখন অভিনয় করছে। কাহিনিতে আছে, পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়েছিলেন। দেশপ্রেমিক মোহনলাল রণাঙ্গনে থেকে যায়। বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সে। ইতিহাসের নির্ভুল পুনরাবৃত্তি এবারও ঘটে। আর এর সাক্ষী হয় একাত্তরের এক মেঘমেদুর রাত।

দু’দিন আগে নতুনগাঁওয়ের পার্শ্ববর্তী থানা শহর মল্লিকপুরে মিলিটারি ক্যাম্প করেছে। এলাকার মানুষ গা-ছাড়া। মিলিটারিরা বউ-ঝিদের ধর্ষণ করে জোয়ান ছেলেদের ধরে নিয়ে যায়। দেশপ্রেমিকদের রিপোর্ট অনুযায়ী আশপাশের গায়ে আর কোনো যুবক নেই। যুবতীরা মুমূর্ষ। তাতে সৈন্যরা স্বস্তি বোধ করে এবং পাহারায়। সেন্ট্রি বসিয়ে সকাল সকাল ঘুমোতে যায়। কিন্তু দেশপ্রেমিকদের চোখে ঘুম নেই। আর ঘুমাবেই-বা কোথায়। নামেই দেশপ্রেমিক, আসলে তো তাদের দেশ নেই। ঘরে ফিরলে মুক্তিফৌজ ধরবে। ক্যাম্প থেকেও আজ রাতের মতো ছুটি দেওয়া হয়েছে। তাই গাঁয়ের পথে বন্যপ্রাণী-শিকারির মতো তারা গা-ঢাকা দিয়ে চলে এবং একসময় পেয়েও যায় শিকার। বন্দুকসহ পনেরো-ষোলো বছরের একটি ছেলেকে পিছমোড়া করে বেঁধে সেন্ট্রির সম্মুখে এনে বলে, ইয়ে মুক্তি হ্যায়। বহুৎ কোশিশ করূকে ইসকো পাকড়া। ক্যাম্পের ভেতর রইরই ফুর্তির রব–-মুক্তি মিলা, মুক্তি মিলা। কিশোর বালক কিছুই বুঝতে পারে না। সন্ধ্যা রাতে সে এই বন্দুকটি হাতিয়েছে। ট্রিগার কোথায়, গুলি ছুঁড়তে হয় কীভাবে, এসব জানার জন্য রাতারাতি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে। লোকগুলো তাকে ভুল করে ধরেছে। সে নিজেও তো এদের মতো খুঁজছে মুক্তিদের। কিন্তু এ কথাগুলো বলার আগেই সান্ত্রির প্রহারে সে জ্ঞান হারায়। তারা তাকে চ্যাংদোলা করে লকআপে ফেলে দ্রুত পজিশন নেয়। কারণ সৈন্যরা ভেবেছে, এই কিশোর নিশ্চয়ই অগ্রবর্তী যোদ্ধা, পেছনে রয়েছে মূল বাহিনী। ওরা ক্যাম্প আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। মূল বাহিনীর জন্য সৈন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। রমিজ শেখ রক্তাক্ত দেহে দৌড়ে এলে তারা তাকে বন্দি করে। পেছনে খোদ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ফৌজ। তাদের হাতের বল্লম, তেঁটা, রামদা অন্ধকারে বিদ্যুতের মতো ঝলকায়। দূর আকাশে গুড়গুঁড়িয়ে মেঘ ডেকে ওঠে। সৈন্যরা বিলম্ব করে না। যারা মোহনলালের মতো বুকের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বে ভেবেছিল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নবরত্ন অপেরার পালার মতো তাদের যুদ্ধটাও থাকে অসমাপ্ত–আগামী দিনের অপেক্ষায়।

শত্রুশিবিরে রমিজ শেখের অ্যাপায়নটা হয় কল্পনাতীত। প্রথম তাকে ভোলাই দেয় দেশি বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের চ্যালাচামুণ্ডারা। যে যেভাবে পারে–ডান্ডা ডান্ডা সই, লাখি লাথি সই, ঘুষি ঘুষি সই। তারপর তাকে আধমরা করে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গরাদের ভেতর ফেলে রেখে যে যার মতো চলে যায়। বাকি রাত কীভাবে কেটেছে, রমিজ শেখ বলতে পারবে না। শুধু মাঝেসাজে হুশ ফিরলে নতুনগাওয়ের কিশোর বালকের দুটি বড় বড় চোখ অন্ধকারে সে জ্বলতে দেখে। ক্ষোভে না বিস্ময়ে, তা বোঝা যায় না। সকালবেলায় সুদূর অতীতকাল থেকে ভেসে আসে নকিবের চোঙা ফোকার দীর্ঘ লয়ের আওয়াজ, ‘নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজ-উ-দ্দৌলা শাহ্‌কুলি খাঁ মির্জা মুহাম্মদ হায়বতজঙ্গ বা-হা-দু-র-হা-জি-র।’ ঝনঝন শব্দে গরাদের দরজা খুলে গেলে রমিজ শেখ বুঝতে পারে, তার দরবারে যাওয়ার সময় হয়েছে। তাকে হাতে ধরে খাড়া করায় দুজন লোক। তারপর ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায় একটি লম্বামতন ঘরের বারান্দায়। সেখানে পাঠান হাবিলদারের পাশে একজন রাজাকার বসা। রাজাকারটা তার মোচ ধরে টান মেরে একপাশ থেকে তুলে ফেলে। রমিজ শেখ অপারগ। হাত দুটি পিছমোড়া থাকায় নবরত্ন অপেরায় নটের মতো সেটি স্বস্থানে বসাতে পারে না। মুখ খোলা থাকা সত্ত্বেও জিহ্বায় শক্তি নেই যে, এমন চরম মুহূর্তে যথাযথ ডায়লগ দেবে।

ঘরের ভেতর দরবার বসেছে। এক ধোপদুরস্ত মেজর বিচারক। কোথা থেকে ভাঙা ট্রাংক টানতে টানতে সভাস্থলে হাজির হয় একজন। তার পেছনে আসে আরো কয়েকজন। এরা বাদী। রমিজ শেখ বিবাদী। এ নিয়ে দু’বার তার বিরুদ্ধে এজলাস বসল। প্রথমবার সে ছিল খুনি, এবার মনে হয় খুন হতে যাচ্ছে। তাকে দেখিয়ে বাদী একজন বলে, ‘এই লোক হুজুর, আমার চাচা লাল মোহাম্মদরে মার্ডার করছে।’ তারপর ভাঙা ট্রাংক হাট করে বিচারকের সামনে সে মেলে ধরে, ‘এই দ্যাখেন আমার বাড়ি লুট করছে হুজুর, এই লোক।’ পরের জন চিৎকার দিয়ে মেজরের পা জড়িয়ে ধরে, ‘মার্চ মাসের পয়লা তারিখে আমার পেটের এইখানে চাকু মারছে হুজুর, এই লোক। আপনে এর বিচার কইরেন। নাড়িভুড়ি বেরই গেছিলো আমার। ভাইগ্যক্রমে বাইচে গেছি।’ তৃতীয় ব্যক্তি মওলানা তোফাজ্জেল। ‘এই লোক স্যার আমার বন্দুক কেড়ে নেছে’ বলেই মওলানা তার গালে এমন কষে চড় মারে যে, তার আলগা হয়ে যাওয়া মোচটা উড়ে গিয়ে মেজর সাহেবের কোলে পড়ে। তিনি তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন, ‘তুম লোগ ভাগো ইয়াসে, ইসে ম্যায় সামালুঙ্গা।’

এবার শুরু হয় আসল জেরা। মৃত পাহারাদার ছয়জন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ফৌজ ছিল বলাতে মেজর সাব তার খাস নফরকে হাত দিয়ে ইশারা করেন। লোকটা রমিজ শেখকে প্রথম চেয়ারে বসায়, পরে পা দুটি বেঁধে সিলিংয়ের আড়ায় ঝুলিয়ে দেয়। সোজা এবং উল্টো অবস্থায় সে যখন একই কথা বলে, তখন মেজর খাস নফরকে অর্ডার দেন, ‘লে যাও উসকো, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা কা নওয়াবকো আচ্ছা তারাসে বানা দো।’ ঘরের চৌকাঠে পা দিয়েই নফর যখন তাকে বানাতে উদ্যত, তখন পেছনে থেকে মৃদুস্বরে অর্ডার আসে, কাল ফির লে আনা।

মেজরের রুম থেকে হাজতে ফিরে ছোট ছেলেটিকে রমিজ শেখ দেখতে পায় না। দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা, ‘মাগো কেঁদো না, আমি তোমার খুদিরাম। তাকে সেন্ট্রি জানায়, মাসুম বাচ্চা বাংলাদেশ মে চলা গিয়া। মগর তুম নেহি মানগে, তুম নওয়াব হ্যায় তো কেয়া, তুমহারা হালত অ্যাইসা হোগা।’

পরদিন ফের দরবার বসেছে। জেরা শুরু হবে, তখন ফোন বেজে ওঠে। রিসিভার তুলে মেজর চিৎকার করে ওঠেন, ‘ঘুরলিয়ে! সকাল সকাল ঘুরুলিয়া, নতুনগাঁও, দাউদনগর, খিদিরপুরে মুক্তিবাহিনীর ফাইট স্টার্ট হয়ে গেছে। পেছনের দেয়ালে মানচিত্র। মেজর তা টেবিলে নামিয়ে নাকে চশমা ঝুলিয়ে দেখেন, কোথায় নতুনগাঁও, কোথায় দাউদনগর, কোথায় খিদিরপুর আর কোথায় ঘুরুলিয়া। মানচিত্র দেখা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এর মধ্যে ফিফটি সিসি মোটরসাইকেল চালিয়ে হুড়মুড় করে হাজির হয় শান্তি কমিটির জেলা সভাপতি। স্যার, স্যার, অ্যাটাক হো গিয়া, অ্যাটাক হো গিয়া।’ রমিজ শেখ লোকটাকে চেনে না, দেখেওনি কোনো দিন। তবে ভাবভঙ্গিতে বোঝে যে, সে বিশ্বাসঘাতক মিরজাফরের লোক, বর্তমানে দেশপ্রেমিক নাগরিক, বিদেশি শত্রুকে যুদ্ধের খবর জানাতে ছুটে এসেছে। শুয়ার কা বাচ্চা! মেজর সাব পিস্তল উঁচিয়ে তেড়ে যান শান্তি কমিটির জেলা সভাপতির দিকে, ‘তুম কিউ চিল্লায়া থা? সারা পাবলিক কো মালুম হো গিয়া। তুমকো গোলি কর দেগা।’

ওই লোক তো নাকের ডগায় পিস্তল দেখে সঙ্গে সঙ্গে চুপ। রমিজ শেখের অবাক লাগে–এই যদি হয় দেশপ্রেমিকদের অবস্থা, কীসের আশায় তারা মিরজাফরি করছে? সিংহাসনে তো বসতে পারবে না! রমিজ শেখ যা মার খেয়েছে, তার সিংহভাগ এ লোকগুলোর হাতে। এদিকে মেজর তাড়াতাড়ি স্কোয়াড রেডি করে ফেলেছেন। তিনি সমরনায়ক। দেশপ্রেমিক নাগরিক পথপ্রদর্শক। মিলিটারিরা লাফিয়ে লাফিয়ে গাড়িতে উঠছে। রমিজ শেখ উঠতে গেলে বসার চেয়ারটাও তার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে। তার হাত দুটি চেয়ারের হাতলের সঙ্গে পাটের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। এ অবস্থায় সে দরজার কাছাকাছি চেয়ারসহ হেঁটে চলে আসে। মেজর গাড়িতে স্টার্ট রেখে খাস নফরকে কাছে ডাকেন, এই বাইনচোত কো কাল ফির লে আনা।’ এরপর চলে গেলেন রণক্ষেত্রে।

মেজর সাব যে যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরেছেন, গরাদে থেকে রমিজ শেখ তা টের পায়। সামনের চাতালটায় হাঁস-মুরগির কটর-কটর, গরুর ডাক, ছাগলের চিৎকারে। নরক গুলজার। অন্ধকারে ঝনঝন তালা খুলতেই জনা পাঁচেক লোক তার গায়ের ওপর উড়ে পড়ে। পড়েই হড়হড় করে বমি। রক্তে না বমিতে কয়েদখানা ভেসে যাচ্ছে, আলোর অভাবে তা বোঝা যায় না। পুরুষলোকরা তো এখানে, হাঁস-মুরগিরও ডাক শোনা যাচ্ছে, মেয়েরা কোথায়? নতুনগাঁও আক্রান্ত হলে মরিয়মের ধরা না পড়ে উপায় নেই। কিন্তু বিষয়টা রমিজ শেখকে আগের মতো ভাবায় না। এখন সবাই ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছে।

মাঝরাতে রক্ত আর দাস্তবমির মাঝখানে রমিজ শেখের ঘুম ভাঙে রান্না মাংসের সুঘ্রাণে। বিজয় উপলক্ষে ভোজ চলছে। বাতাসে ভাসতে ভাসতে গন্ধটা গরাদে ঢুকে। তার পেটে ধাক্কা দেয়। কীসের মাংস আহ্-এমন সুন্দর ঘ্রাণ! নতুনগাঁওয়ের চৌধুরী বাড়ির পাতলা খিচুড়ির পর দু’দিন দু’রাত পার হয়ে গেছে, পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। এই প্রথম তার খিদার উদ্রেগ হয় এবং মাংস খাওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে রমিজ শেখ বমি করতে শুরু করে।

পরদিন জেরা, আবারও প্রহসন। রমিজ শেখের যাওয়া-আসার পথে দৃশ্যপট ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে। কয়েদখানা এখন থানার লকআপ ছাড়িয়ে অদূরের স্কুলঘর পর্যন্ত বিস্তৃত। যে ঘরে একসময় হেড মাস্টার বসতেন, মেজরের দরবার বসে সেখানে। কক্ষের কাঁচের আলমারি থেকে ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষার খাতার বান্ডিল সরিয়ে আসামিদের অদৃশ্য ফাইলপত্র রাখা হয়েছে। দরবার চলাকালে মেজরের অর্ডার পেয়ে খাস নফর আলমারি খোলে বটে, তবে শূন্য তাক থেকে এক টুকরো কাগজও বের হয় না। আলমারি বন্ধ করে টেবিলে সে যা রাখে, তা-ও কিছু না। মেজর মিটিমিটি হাসেন। তার পেছনের দেয়ালে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর গুরুগম্ভীর প্রতিকৃতি। ঘরের চালায় পাকিস্তানের চাঁদ-তারা খচিত পতাকা। আগে স্কুলমাঠের দক্ষিণ প্রান্তে কৃষ্ণচূড়াগাছের তলায় যে চারকোনা শহিদমিনারটি ছিল, এখন এর ভাঙা বেদিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কালো আলখাল্লা পরে যে বসে থাকে, সে একজন কসাই। নাম নাঈমুদ্দিন। নাঈমুদ্দিন মানুষের গলাপ্রতি কুড়ি টাকা পায়। সে বেদি থেকে বারবার সিপাহিদের কাছে উঠে আসে তদবির করতে। যুদ্ধের আগে বেশি করে গরু ভাগে পাওয়ার জন্য হাটে আসা ব্যাপারীদের সঙ্গে ঠিক এই কাজটাই করত সে। একদিন দরবার গৃহে যাওয়ার সময় কসাই নাঈমুদ্দিন রমিজ শেখকে কাগজের বিড়ি ফুঁকতে দেয়। হাত বাঁধা থাকায় রক্তের কটু গন্ধময় কসাইয়ের আঙুলে ধরা বিড়িটা সে ঘনঘন টান দিয়ে শেষ করে। জায়গাটা ভারতীয় বাহিনীর দখলে যখন চলে আসে, নাঈমুদ্দিন কালো আলখাল্লা খুলে মুজিব কোটের তলায় বেশিক্ষণ গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা তার এক পা চেপে ধরে, অন্য পা টান মেরে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলার আগে কসাই নাঈমুদ্দিন একটা বিড়ি প্রার্থনা করেছিল।

এখন একবার সোজা করে, পরের বার উল্টিয়ে ঝুলিয়ে প্রতিবার রমিজ শেখের মুখে একই জবানবন্দি শুনে মেজর অশেষ আনন্দ পান। ফাঁকে ফাঁকে নবরত্ন অপেরার সিরাজউদ্দৌলা পালাটাও বিনা টিকিটে দেখা হয়ে যায়। যুদ্ধের উৎসবহীন দিনে মেজরের জন্য এ উপরি পাওনা। তার হুকুমে রমিজ শেখ যখন নবাবের বন্দিত্বের অংশটা রোজ অভিনয় করে দেখায়, তখন নিজেকে তিনি ইংরেজ সেনাপতি ভেবে আঙুলের ডগায় মোচ মোচড়ান। এদিকে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের তরফ থেকে রমিজ শেখের গায়ে যে উত্তম-মধ্যম পড়ে, সেসব অভিনয় নয়, সত্যিকারের।

দরবার গৃহে এভাবে অভিনয় করতে করতে রমিজ শেখ ক্রমে নবাব হয়ে ওঠে। দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলা। শত্রু সৈন্য আর বিশ্বাসঘাতকদের যাবতীয় বিদ্রূপ, অত্যাচার-অবিচার অতিশয় মর্যাদার সঙ্গে সে গ্রহণ করে। নিজেকে সে ভাবে ভগবানগোলায় ধৃত নবাব সিরাজউদ্দৌলা, যাকে শত্রুরা মুর্শিদাবাদে বন্দি করে নিয়ে এসেছিল। যার কণ্টক আসন, ছিন্ন পাদুকা কোনোভাবে নবাবি মেজাজ থেকে টলাতে পারেনি। গভীর রাতে একদিক থেকে যখন মেয়েদের আর্তচিৎকার আর গোঙানির আওয়াজ আসে, আরেক দিকে নদীপাড়ে মৃতদেহের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে শিয়াল কুকুরে মারামারি চলে, তখন কয়েদখানায় বসে বন্দি নবাব আগামী দিনের যুদ্ধের ফন্দি আঁটেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় ছয়জন মৃত পাহারাদার। নবাবের দীনহীন কুটিরের এক কোনায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা রমিজ শেখকে তারা ঠিকই শনাক্ত করে। নবাব তাদের সাদরে গ্রহণ করেন। বসতে দেন বিষ্ঠা আর উচ্ছিষ্টের থালাবাটি সরিয়ে। তারা যেখানে গোল হয়ে বসে, সেদিকের দেয়ালে রক্তের অক্ষরে লেখা, ‘মা গো কেঁদো না, আমি তোমার খুদিরাম।’ লেখাটার দিকে তাকিয়ে পাহারাদারদের একজন বলে, ‘খুদিরামের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে চলিছে।’ কথায় কথায় এলাকায় যে অসময়ে বন্যা শুরু হয়েছে সেই প্রসঙ্গ আসে। সিরাজউদ্দৌলা পালার মঞ্চস্থল এখন দশ হাত পানির নিচে। এ অবস্থায় গ্রাম পাহারা দিয়ে কোনো ফায়দা নেই। মুক্তিবাহিনীও এসে গেছে। তারা পাটখেতের চিপায় পজিশন নিয়ে বসে থাকে। কোনো দিন শিকার মেলে, কোনো দিন মেলে না। কলাগাছের ভেলায় চেপে তাদের খাবার দিয়ে আসে গ্রামের বউ-ঝিরা। ইঞ্জিনবোটের আওয়াজ কানে গেলেই মুক্তিরা ট্যাসট্যাস করে স্টেনগানের গুলি চালায়। গুলি শেষ হয়ে গেলে নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায় গাঁয়ের পেছন দিক দিয়ে। পাকসেনারা আরেক দিক থেকে ঢুকে গাঁয়ের লোকদের মেরে-ধরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে। ‘কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন চলতি দিয়া যায় না, নবাব!’ এ কথা বলে একজন প্রাক্তন পাহারাদার রমিজ শেখের ছিন্ন আঙুলসমেত করতল মুঠোয় তুলে নেয়। একে একে শূন্য জায়গাটায় সবাই হাত বোলায়, গভীর আবেগে চুম্বন করে। রমিজ শেখও তাদের বুলেট-ঝাঁঝরা বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। তারা তখন জানতে চায়, নবাব ফের কবে শত্রু শিবির আক্রমণ করবেন। কবে তারা ফিরতে পারবে জন্মভূমি বাংলায়। তাদের একজন আবার গোলাম হোসেনের মতো ললিত ভঙ্গিতে বলে, বাংলাকে ভালোবেসে বাংলার নবাবকে আমরা ভালোবেসে ফেলেছি। রমিজ শেখ শেকলবদ্ধ টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায়। ঝনঝন শব্দে বাজনা বেজে ওঠে। নবাব আবেগাপ্লুত, কম্পিত কণ্ঠে বলেন, ‘গোলাম হোসেন, বাংলাকে তোমাদের মতো আমি তো ভালোবাসিনি। তবু আজ নিজের সব দুঃখ-দুর্দশা ছাপিয়ে, বাংলার কথাই বারবার মনে পড়ে কেন?’

নবাব কুটিরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। এদিকে সাক্ষাৎকারের সময় উত্তীর্ণ। যখন সেলের দরজা খুলে দুজন সিপাহি নবাবকে মেজরের দরবারে নিতে আসে, তখন মৃত পাহারাদাররা টুটাফাটা শরীর নিয়ে পড়িমরি পালায় ।

সেদিন রমিজ শেখের নবাবি ঘোর তখনো কাটেনি। এ অবস্থায় স্কুলমাঠ পর্যন্ত সিপাহিদের সঙ্গে সঙ্গে যায় সে। তারপর হঠাৎ করেই ‘আলেয়া আলেয়া’ বলে দোতলা স্কুল বাড়িটার দিকে দৌড়াতে থাকে। যাকে সে প্রাণপণ দৌড় ভাবে, দোতলার জানালা দিয়ে মরিয়মের সেটা ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের ছোট ছোট লাফঝাঁপ মনে হয়। রমিজ শেখকে হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া, তার আলেয়া আলেয়া চিৎকার, ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের মতো লম্ফঝম্প–এসব কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। মরিয়মের তখন মাথা ঠিক ছিল না। আহাম্মকটাকে এক্ষুনি থামানো দরকার, তা না হলে গুলি খেয়ে মরবে। কিন্তু বাইরে থেকে ঘরটা ছিল তালাবন্ধ। এ ছাড়া যে বিষয়টি হঠাৎ তার মাথায় আসে, সেটি হলো এক চিলতে অন্তর্বাস ছাড়া তার পরনে কোনো বস্ত্র নেই। এদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে রমিজ শেখ পিঠে একটা ধাক্কা অনুভব করে, সেই সাথে সুচ ফোঁটার মতো চিনচিনে যন্ত্রণা। ব্যথাটা তীব্র নয়, তবে শক্তি ধরে অসম্ভব। সেকেন্ডের মধ্যে নবাবের খোলস ভেঙে আগের পরিচয়ে ফিরে যায় রমিজ শেখ। সেখানে সে একজন সামান্য প্রজা, বউ খুন করার দায়ে যার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল এবং ডামাডোলের ভেতর যে দশ বছরের মাথায় জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। রমিজ শেখ এক হাত দূরে বিয়ের সাজ করা বউকে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। চেঁচিয়ে সরে যেতে বললেও মেয়েটি পুরোপুরি সরে না। ঘাতক স্বামীর মাঝখানে এক হাতের মতো ব্যবধান রেখে সে নিজেও দৌড়ায়। তবে আগের মতো তাদের পথটা মসৃণ আর সোজা থাকে না। তা মোড় নেয় হেড স্যারের রুমের পাশ দিয়ে, দোতলা স্কুলবাড়ি ছাড়িয়ে, পাকিস্তানি পতাকা আর কৃষ্ণচূড়াগাছ নিচে ফেলে ওপরের দিকে–শূন্যে।

০৭. অন্তর্বাস, শাড়ি ও সতীত্ব

ঘটনাটা একটা ক্লুয়ের কাজ করে, যুদ্ধের আটাশ বছর পর। পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে মরিয়মের পরনে যে শুধু অন্তর্বাস ছিল, আর কোনো বস্ত্র ছিল না, তা মুক্তির জন্য একটা জরুরি তথ্য। কারণ সে এ প্রথম বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে মরিয়মের সামান্য হলেও একটা মিল খুঁজে পেয়েছে। যা তার রিপোর্টিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সাহায্য করবে। ‘৭১ সালে পাকসেনারা বন্দি নারীদের গা থেকে শাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে লুঙ্গি বা ত্যানা পরিয়ে দিয়েছিল–আর্মির এ আচরণেরও নানান ব্যাখ্যা আছে। যেমন নতুনগাঁওয়ের জৈতুন বিবি মুক্তিকে বলেন, ‘যিখান থিকে পাকসেনারা এয়েছিল, অইভেনের বিডিরা শুইনছি শাড়ি পরত না, মুসলমানি লম্বা কুর্তা গরে দিত। শাড়ি হচ্ছে গে হিন্দুর পোশাক।’ কলেজছাত্র শাহরুকের বক্তব্য হচ্ছে ‘শাড়ি হচ্ছে বাঙালি রমণীকুলের ভূষণ। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। ওইদিকে পাকিদের ছিল চরম বাঙালিবিদ্বেষ। তারা বাঙালি নারীর বসন-ভূষণ-শাড়ি-ফাড়ি আর বাংলাদেশের পতাকা একসাথ করে পুইড়ে দেছিল যুদ্ধের বছর। আরেকটা কারণ, যা নানান জনের লেখাপত্রে রয়েছে, তা হলো, কিছু মেয়ে সতীত্ব হারানোর পর সেনানিবাস, সেনাক্যাম্পে শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। সৈন্যরা তাই পরনের শাড়ি খুলে নিয়ে তাদের আত্মহত্যার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল। এসব সত্য-মিথ্যা। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বাঙালির লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শাড়ি এবং সতীত্ব-হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের যে ধারা, যা নারীর মাধ্যমে বাহিত এবং লালিত হয়ে আসছিল, যুদ্ধের বছর এ দুটিকে একসঙ্গে খোয়াতে হয়। জাতিগতভাবে বীরাঙ্গনা বিসর্জনের অন্যতম কারণ হিসেবে মুক্তি রিপোর্টিতে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করে।

তারপর মরিয়মের কাহিনি বেশ খানিকটা জটিলতাবর্জিত, ঝরঝরে। আর দশটা বীরাঙ্গনার থেকে কোনোভাবে পৃথক করা যায় না। এ ছাড়া রমিজ শেখের আগমনের পর গোটা কাহিনিটা যেমন লেজে-গোবরে হয়ে উঠেছিল, তারও সমাপ্তি ঘটে এই পর্বে। ভাগ্য ভালো যে, লোকটা পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে মরেছে, মুক্তিযোদ্ধারা তাকে মারেনি। এর ব্যত্যয় হলে, মুক্তি বুঝতে পারে না, সে কীভাবে এর ব্যাখ্যা দিত। যুদ্ধের তিন মাসের মাথায় যে জয় বাংলা আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান দুটির মর্ম আলাদা করে উপলব্ধি করতে পারেনি, তার মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল পাকিস্তানি আর্মি এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে ফিফটি-ফিফটি। তারপর তো মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা নামে একজনের একাত্তরের স্মৃতিকথা পড়ে জানা গেল যে, রমিজ শেখ মৃত্যুর আগে দেশপ্রেমিক বনে গিয়েছিল, যদিও মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণে। পুল ভাঙতে গিয়ে স্টেনগানসহ জনাব শামসুদ্দোহা ধরা পড়েন রাজাকারদের হাতে। রাজাকার কমান্ডার অস্ত্রটা হাতিয়ে তাকে মার্শাল ল কোর্টে প্রডিউস করে। শামসুদ্দোহা বাঙালি হলেও একজন মোহাজের, সাতচল্লিশের দেশভাগের পর ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বাবা মার সঙ্গে পালিয়ে আসেন। তারপর থেকে উক্ত রাজাকার কমান্ডারের পরিবার তাদের পেছনে লেগে আছে। ‘ইয়ে লোক হামকো ফাস আয়াথা জমিজমা লেনেকে লিয়ে স্যার’-–এরকম এক সাজানো কাহিনি বারংবার উর্দুতে বয়ান করে, তিনি মার্শাল ল কোর্ট, এফআইও (ফিল্ড ইনটেলিজেন্স অফিস), এমপির (মিলিটারি পুলিশ) মতো সব কটি মৃত্যুফাঁদ উতরে অক্টোবর মাসে জেলখানায় গিয়ে পড়েন। সেখান থেকে মুক্তিযযাদ্ধারা জেলের তালা ভেঙে দিলে বেরিয়ে আসেন ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।

মে মাসের শেষ দিকে জনাব শামসুদ্দোহা ধরা পড়ার পর বেশ কিছুদিন রমিজ শেখের সঙ্গে মল্লিকপুর থানার লকআপে ছিলেন। এই অদ্ভুত মানুষটাকে কাছ থেকে দেখা তার। স্মৃতিকথায় তিনি প্রশ্নসমেত একটি জরুরি বিষয় উত্থাপন করেন, যা রমিজ শেখের পক্ষে যায়। শামসুদ্দোহা লিখেছেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত টর্চারের ফলে রমিজ শেখের পাগল হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তা না হলে এক সাধারণ প্রজা নিজেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ভাবতে যাবে কেন?’ এ ছাড়া সাক্ষাৎকারে মরিয়মও সবিস্তারে বর্ণনা করেছে, কীভাবে লোকটা আলেয়া-আলেয়া বলে চিৎকার করতে করতে সিপাহিদের বন্দুকের নল দু’হাতে সরিয়ে ওর দিকে দৌড়ে আসছিল। পাগল ছাড়া, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে এরকম ছুটে আসার সাহস কোনো স্বাভাবিক মানুষের হবে?

পিঠে গুলি লাগার পর রমিজ শেখের দৌড়ানোর গতি হঠাৎ বেড়ে যায়। কারণ পায়ের দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় তার দৌড়টা আর ঠ্যাং-বাঁধা মোরগের মতো থাকেনি, বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণের লাফে রূপান্তরিত হয়। মরিয়ম মুক্তিকে বলে, লোকটি যেন মুখ থুবড়ে মাটিতে না পড়ার ধনুকভাঙা পণ করেছিল। প্লেন ওড়ার আগে যেমন ধীরে ধীরে স্পিড তুলে রানওয়েতে দৌড়ায়, সে খানিকক্ষণ তা-ই করল স্কুলমাঠের চারদিকে। শেষ সময়টায় তার পা দুটি মাটি ছোঁয়নি। মুখেও প্লেনের ইঞ্জিনের গোঁ-গোঁ আওয়াজ। মরার আগে লোকটা পাকিস্তানি সৈন্যদের খুব শাসিয়ে গিয়েছিল। তবে তখন সে কী বলছিল, মরিয়ম শুনতে পায়নি। কারণ অনেকগুলো বন্দুকের নল একসঙ্গে গর্জে উঠলে কানে তালা লাগার উপক্রম হয় আর মাঠটা ঘন কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়। তাই রমিজ শেখের শেষযাত্রা উড়ে না দৌড়ে সমাপ্ত হয়েছে, মরিয়ম তা বলতে পারবে না।

ভয়ে, উৎকণ্ঠায় মরিয়মের তখন হিস্টিরিয়া রোগীর অবস্থা। সাক্ষাৎকারে সে মুক্তিকে বলে, ওর দিকে লোকটার দৌড়ে আসাটাই বিচলিত করে বেশি। শুধু ব্রেসিয়ার আর এক চিলতে ত্যানা পরনে থাকায়, জানালার পাশ থেকে সে প্রথম সরে এলেও পরে বিষয়টা তার মনে থাকেনি। কারণ তখন পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ, কল্পনাতীত। ‘ত্যানা পরায়ে রাখল বা ধর্ষণ করল,’ মরিয়ম মুক্তিকে বলে, ‘তা শুধু না। প্রত্যেকটা বুটের লাথি, বেয়নেটের খোঁচা কি সিগারেটের ছ্যাকা–আমার কাছে সমান ভয়াবহ। একটাও নরমাল না। একটার থেকে আরেকটা কম না। মিলিটারি দিনে-রাতে ক’বার ধর্ষণ করেছে, লোকে খালি এর হিসাব জানতে চায়। অন্য সব নির্যাতন তারা নির্যাতন মনে করে না।’

রমিজ শেখের মৃত্যুতে মরিয়ম শোকার্ত হয়েছিল যুদ্ধের বহু বছর পর। যখন সে বুঝতে পারে, তার শত্রু-লাঞ্ছিত দেহটা স্বাধীন বাংলাদেশের পুরুষেরা একইভাবে ব্যবহার করবে, কোনোদিন তারা তাকে আপন ভাববে না, তখন এই ভেবে সে সান্ত্বনা পেত যে, পৃথিবীতে অন্তত একজন পুরুষ তার দিকে ছুটে আসতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তখন রমিজ শেখের এই অদৃশ্য ভূমিকার কথা মরিয়মের বোঝার কথা নয়। তারা দুজনই তখন বন্দি। কেউ কারো উপকারেই লাগছে না।

‘আমার ভাগ্যটাই খারাপ,’ মরিয়ম বলে। তা না হলে নিজের বাড়ি যেখান থেকে মাত্র এক দিনের পথ, এমন এক গায়ে সে ধরা পড়ে! দূরত্বটা নির্ণয় করা হয়েছিল ফুপু সাহার বানুর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসার সময় হিসাব করে। যুদ্ধের তিরিশ বছর আগে সাহার বানুর বিয়ে হয় নতুনগাওয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রাম রাধানগর। তখন ইংরেজ আমল। পথে-ঘাটে ডাকাতের উপদ্রব। তাই কফিলউদ্দিনের মরহুম আব্বাজান সলিমুদ্দিন সূর্য ওঠার আগে পরিচিত বেহারার পালকিতে মেয়েকে উঠিয়ে দিতেন। ‘উঁহুম না উঁহুম না’ করে তারা মুন্সিবাড়ির দরজায় পৌঁছে যেত বাদ-আসর, সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে ডুবো ডুবো করছে। বেহারারা হাঁটে না, দৌড়ায়। সেই হিসেবে পায়ে হেঁটে মরিয়মের বাড়ি পৌঁছাতে বড়জোর রাত দশটা বাজবে। ছয় পাহারাদারসহ রমিজ শেখের নিখোঁজ হওয়ার পরদিন সে রওনাও করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের দিন, পথঘাট নিরাপদ নয়, একা একজন মেয়ের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করাটা নতুনগাঁওয়ের মুরুব্বিরা অনুমোদন করেননি। তখন মিলিটারির গাড়ি পাগলের মতো পাকা সড়কে ছুটোছুটি করছে। পুলের গোড়ায় রাজাকার, মুজাহিদদের প্রহরা। গ্রামে গ্রামে চেকপোস্ট। অবস্থার উন্নতির জন্য মুরুব্বিরা তাকে আরো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে বলে নিখোঁজ গ্রামবাসীর জন্য সাফা খতম পড়াতে মসজিদে চলে যায়। দ্বিতীয় দিনে ছয় ছয়টা লাশ-মৃত পাহারাদারদের। বাড়ি বাড়ি কারবালার মাতম। তারপর তো লাশ দাফন কাফন করতে-না-করতে গায়ে মিলিটারি চলে আসে।

‘মেয়েটা যেন ডাইক্যে আইনলো খান সেনাদের,’ জৈতুন বিবি বললেন। কারণ যুদ্ধ তখন তিন মাসে পড়েছে। মিলিটারিরা ধারেকাছের গ্রাম-বন্দর তছনছ করলেও নতুনগাঁওয়ে তখনো তাদের আঁচড় পড়েনি। মরিয়ম আসতে-না-আসতে একটার পর একটা অঘটন ঘটতে শুরু করে। অথচ চৌধুরীবাড়িতে শহরের একটা মেয়ে এসেছে শুনে, যুদ্ধের ডামাঢোলেও জৈতুন বিবি সেই রাতেই খাল পেরিয়ে তাকে দেখতে যান। শহরের মেয়ে হলে কী, দেখতে-শুনতে কেমন নরম-শরম। চাঁদপানা মুখ। কথাও বলে আস্তেধীরে। তিনি মেয়েটার মান-ইজ্জত যেন ঠিক থাকে, খানেদের হাতে যেন নষ্ট না হয়, এর জন্য দোয়া পড়তে পড়তে সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তারপর তো বিপদ এসে পড়ল তার নিজের ওপর। ছয় পাহারাদারের একজন ছিল জৈতুন বিবির সতিনের বড় ছেলে। কোলে-পিঠে করে ছেলেটাকে তিনি মানুষ করেছেন। ছেলেটা কবরে যাওয়ার সময় তার শরীরের অর্ধেকটা যেন সঙ্গে নিয়ে গেল। তাই খানেরা আসছে শুনেও জৈতুন বিবি আর তার সতিন বাড়ি ছেড়ে নড়েননি। ঘরের পেছনের করমচার ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। খানেরা তখন ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা দিয়ে পঙ্গপালের মতো ধেয়ে আসছে। এই তাদের দেখা গেল দর্জিবাড়ির কাছে, চোখের পলকে হিন্দুপাড়ার বড় বড় পানের বরজ, ফলবাগান আর বাঁশঝাড়ের ভেতর। তখন তাদের কালো কালো পাছা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তারপর দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠল। তারা পেট্রোল ঢেলে হিন্দুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল। হিন্দুবাড়ি যাওয়ার পথে হানাদাররা লুটপাট করার জন্য গাঁয়ের লোকদের ঘর-বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। জৈতুন বিবি আর তার সতিন করমচার ঝোঁপের আড়ালে থেকে লুটের মালসামান নিয়ে লোকজনের ছোটাছুটি দেখেছেন। তারপরই পটপট করে কয়েকটা গুলির শব্দ। সেদিন মঠের পেছনের জঙ্গল থেকে ধরে এনে বলাই সাধুকে দুজন শিষ্যসহ পাকসেনারা এক কাতারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। বলাই সাধু অবস্থা বেগতিক দেখে শিষ্যসমেত পালাতে চেয়েছিলেন। অথচ ভারতে চলে যাওয়ার সময় ভাই-ভাতিজারা তাকে সঙ্গে নিতে চাইলে এক গাল হেসে বলেছিলেন, তোরা যেতি চাচ্ছিস-যা, আমারে নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া করছিস কেন? আমি একেশ্বরে বিশ্বাসী, খানেরা আমারে মারবে না। তারপর পাকসেনারা গায়ের ভেতর বেশিক্ষণ থাকেনি। দিনদুপুরে মানুষ মেরে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খানিক বাদে একই পথ দিয়ে ফিরে যায়। যাওয়ার সময়, করমচার ঝোঁপ থেকেই জৈতুন বিবি দেখেছেন, চৌধুরীবাড়ির কাজের মেয়ে টুকি, যোগেন বাইন্যার বড় বেটি বিন্দুবালাসহ মরিয়মকে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।

কে দেখল, কে দেখল না, মরিয়মের সেদিকে তখন খেয়াল নেই। সে তখন অনুভূতিশূন্য, চোখে অন্ধকার দেখছে। বাড়িতে মিলিটারি ঢুকে পড়লে চৌধুরীবাড়ির বউ-ঝিরা দেউড়িঘরের খিল তুলে দিয়ে কুলহু আল্লাহ সুরা বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করে। বন্ধ ঘরে বাচ্চারা চিল্লাচ্ছে। মুখে কাপড় চাপা দিয়েও তাদের থামানো যাচ্ছে না। হিন্দুবাড়িতে মানুষ মেরে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খানেরা তখন উন্মাদ। তাদের এক লাথিতে দরজার পাল্লা দুটির কবজি খুলে যায়। ঘরে মেয়ে আর শিশু। পুরুষেরা পালিয়েছে। মেয়েদের বেরিয়ে আসতে বললে তারা চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরের চিপায়-চাপায় লুকোয়। মিলিটারির ভাষা বোঝে না। বাচ্চাগুলো ততক্ষণে কান্নাকাটি বন্ধ করে দিয়েছে। মিলিটারির বন্দুকের বাড়ি খেয়ে আরেক দফা চিৎকার করতে করতে মেয়েরা যখন বেরিয়ে আসে, তখনো কয়েকজন জোরে জোরে কুলহু আল্লাহ সুরাটা পড়ছিল। মরিয়মের পরনে ছিল সালোয়ার-কামিজ আর সুতির ওড়না। ওড়নাটা দিয়ে সে মুখের ওপর লম্বা করে ঘোমটা টেনে দিয়েছিল। কিন্তু ঘর থেকে বেরোনোর সময় মেয়েদের ধাক্কাধাক্কিতে ঘোমটা খসে তার চাঁদপনা মুখটা বেরিয়ে পড়ে। সে দেখে উঠোনে পাঁচ-ছজন মিলিটারি। তারা ঠায় দাঁড়ানো, অপারেশনে নেই। হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ডার করছিল। আবার ঘোমটা টানার আগে একজনের চোখ পড়ে মরিয়মের ওপর। লোকটা চিতাবাঘের মতো লাফ দেয়। তারপর যে কী হয়ে গেল। আমার, মরিয়ম বলে, ‘কিছু বুঝতে পারছিলাম না। অনুভব করতে পারছিলাম না। আর্মির হাতে ধরা পড়ে গেলাম! এরা কি আমাকে মেরে ফেলবে? শরীরে কোনো সেন্স ছিল না।’

এ অবস্থায় কীভাবে দুই ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে মল্লিকপুর সদরে এসেছে, মরিয়ম জানে না। অথচ গাঁও-গেরাম যখন, পথের বাঁকে বাঁকে নিশ্চয় মানুষের ঘরবাড়ি ছিল, দু-চারটা খাল-বিলও তাকে পেরোতে হয়েছে, খেত-খামারে তখন ছিল হাঁটুসমান পাটের গাছ, ধানের চারা–অথচ এসবের কিছুই সে দেখতে পায়নি। শহরের পিচের রাস্তায় ওঠার পর পায়ের তলায় গরম সেঁকা লাগতে প্রথম বোঝে যে, পায়ে স্যান্ডেল নেই। তখন সাঁড়াশির মতো তার বাহু খামচে ধরা কয়েকটা আঙুল চোখে পড়ে। ওপরে তাকাতে একজোড়া লালচে মোটা গোঁফ। সিঁড়ি ভেঙে যখন দোতলায় ওঠে তখনো মোচঅলাটা তার বাহু খামচে ধরেছিল। ঘরের ভেতর ফেলে দেওয়ার সময় হাতটা ছেড়ে দেয়। মরিয়ম উড়ে গিয়ে পড়ে ভাঙা বেঞ্চির ওপর।

: বেঞ্চি আসলো কোত্থেকে?

: এটা ছিল স্কুলঘর, আমাকে প্রথম যেখানে রেখেছিল।

: ঘরে ফ্যান ছিল?

: ছিল? না না ছিল না। নাকি ছিল? তখনকার সময়ে স্কুলঘরে ফ্যান চলত?

: প্লিজ, একটু মনে করার চেষ্টা করেন।

: না, মনে পড়ছে না। তবে ফ্যান না থাকলেও হুকটুক ছিল বোধ হয়। কেন?

: আপনার গায়ে কি ওড়না ছিল? সুতির ওড়নাটা?

: হ্যাঁ ওড়না ছিল।

: ওড়না ছিল?

: ছিল। কামিজ ছিল পরনে। ওড়না তো থাকবেই। তখন তো এরকম কামিজ ছিল না। আরেকটু টাইট আর খাটো মতন।

: খাবারের কথা কি মনে আছে? কী ধরনের খাবার খেতেন?

: ডাল দিত, ভাত দিত মনে হয়, কয়েক দিন গোশত দিছিল–এই এক-দুই পিস, ছোট ছোট।

: রুটি?

: হ্যাঁ হ্যাঁ রুটিই দিছে বেশি। তবে ইনফেকশন তো শরীরের এসব জায়গায়। জ্বর থাকত সব সময়। খাওয়ায় রুচি ছিল না।

: পানি খাওয়ার গ্লাসটাস দিছিল?

: মেয়েটা যে কী বলে, আবার পানির গ্লাস! স্কুলের জমাদার বড় একটা মাটির সানকি আর এক বদনি পানি দিয়ে যেত দু’দিন পরপর। সেই পানিতে খাওয়া চলত। পেসাব-পায়খানার পর পরিষ্কারের কাজও সেই পানিতে। ঘরে বাথরুম টাথরুম ছিল না। স্কুল ঘর তো। একদম পেছনে ছাত্রদের জন্য কয়েকটা টাট্টি–খাট্টা পায়খানা। কীভাবে যে দিন কাটাইছি! গোসল করতে পারিনি এক দিনও।

: গন্ধ লাগত না? নিজের শরীরের দুর্গন্ধ?

: লাগত। কাপড়চোপড়ে রক্ত, এর গন্ধ আছে না আলাদা একটা? পরিস্থিতি বাধ্য করেছে এভাবে থাকতে। উপায় নেই তো। এগুলো কি কাউকে বুঝায়ে বলা যায়? এর কোনো ভাষা আছে? কোন ভাষায় বলব?

: কিন্তু সত্যি সত্যি বলেন তো ঘরে ফ্যান ছিল কি না, ফ্যান না থাকলে সিলিংয়ে হুক ছিল কি না।

: হুকটুক থাকলেও থাকতে পারে। কে এত খেয়াল করেছে। নিজের জ্বালায় বাঁচিনে তখন।

: আশ্চর্য সিলিংয়ে হুক ছিল, গায়ে সুতির ওড়না ছিল!

: এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

: এ পরিস্থিতিতে অনেক মেয়ে তো আত্মহত্যা করেছে তখন।

: অহ্! আমি কিন্তু আত্মহত্যার কথা ভাবতাম না। বাঁচার কথা ভাবতাম। আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছি যুদ্ধের পর। আরেকটা কথা মনে পড়েছে–ঘরে একটা জানালা ছিল। এক পাশের পাট ভাঙা। তাই দিয়েই রমিজ শেখকে দৌড়ে আসতে দেখেছিলাম।

: তখন আপনার পরনে সালোয়ার-কামিজ আর ওই ওড়নাটা ছিল?

: না, ছিল না। টাইনে-টুইনে ছিঁড়ে ফেলাই দিছিল মিলিটারিরা। জমাদার বর্জ নেওয়ার সময় দলা পাকিয়ে সেই যে নিল, এগুলো আর ফেরত পেলাম না। তাই রমিজ শেখকে দৌড়ে আসতে দেখে প্রথম সরে গেছিলাম জানালার পাশ থেকে।

: আপনার পরনে তখন কিছু ছিল না?

: ছিল। ব্রেসিয়ার আর এক টুকরা ছিঁড়া ত্যানা।

মুক্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। লম্বা-চওড়া সুতির ওড়নাটা বই-পুস্তকের লিখিত তথ্যের সঙ্গে কিছুতেই খাপ খাচ্ছিল না। বিশেষত যার ঘরে ফ্যান না থাকলেও গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং থেকে ঝুলে পড়ার মতো হুক লাগানো ছিল, তার তো সতীত্ব খোয়ানোর পর আত্মহত্যা করার কথা। এ অবস্থায় স্কুলের জমাদার কাপড়চোপড় তুলে নিয়ে মরিয়মকে শুধু আত্মহত্যা করার দায় থেকেই রেহাই দেয়নি, মুক্তিকেও যারপরনাই স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু চৌধুরীবাড়ির কাজের মেয়ে টুকি আর যোগেন বাইন্যার বড় বেটি বিন্দুবালা-তাদের পরনে তখন কী ছিল? মরিয়মের দ্ব্যর্থবোধক জবাব, শাড়ি ছিল মনে হয়, গ্রামের মেয়েরা শাড়িই পরত তখন, সঙ্গে সায়া, ব্লাউজ। কাজের মেয়ে টুকির পরনে খালি একটা শাড়িই ছিল বোধ হয়। পরে মুক্তিকে এই একই কথা অন্যভাবে বলে টুকি, ‘আমারে ব্লাউজ-পেটিকোট কিনে দিব কিডা? একখান শাড়িই ছিল পরনে। ছাপা শাড়ি। খিদিরপুর হাট থিকা আব্বা কিনা দেছিল ঈদের সোমায়। আমার বয়স অইছে, এ পর্যন্ত আমি কইতে পারি না এক দিনও সালোয়ার-কামিজ পরছি কি না।’

তখন তাদের ধরে এনে কোথায় রেখেছে, কী করেছে মরিয়ম জানে না। চিৎকার শুনেছে শুধু। কে কোথায় কাঁদছে? পাশের রুম, না তার পরের রুম? স্কুলবাড়িতে তো রুমের কমতি নেই! যুদ্ধের আগে সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত ক্লাস চলত একসঙ্গে। কান্নাকাটির শব্দে আন্দাজ করত যে, কাছাকাছি আরো কয়েকটি মেয়ে আছে। তাদের মধ্যে টুকি, বিন্দুবালার থাকাটা অসম্ভব নয়।

মল্লিকপুর থেকে মরিয়ম যেদিন চালান হয়, তখন রাত না দিন, মেয়ে দুটি সঙ্গে আছে কি নেই, তারা শাড়ি পরেছে কি পরেনি, বোঝার উপায় ছিল না। কারণ ঘর থেকে চোখ বেঁধে তাদের বাইরে আনা হয়। সেখানে অন্ধ প্যাঁচার মতো তারা দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মিলিটারিরা পাছায় লাথি মেরে মেরে তাদের গাড়িতে তোলে। ‘নিচা হো যাও, নিচা হো যাও’ অর্ডারটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন স্টার্ট হয়ে যায়। গাড়িটা যে একটা ট্রাক এবং এর খোলা পিঠে ওরা যে উবু হয়ে বসে আছে, তা বুঝতে পারে গায়ের ওপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়লে। মরিয়মের কানের কাছে টুকির মতো একজনের মুখ, ‘এ দি খোলা টেরাক! শরমে বাঁচিনে, রাস্তার মানুষ আমাগের দেইখ্যে ফেইল্লো, ছি!’

ট্রাক যাচ্ছে উঁচু-নিচু এবড়োখেবড়ো পথ ধরে। অনেকক্ষণ শুধু ইঞ্জিনের ঘর্গর আওয়াজ। একসময় তা ছাপিয়ে জনতার হর্ষধ্বনি ভেসে আসে। এরা কারা–এই যুদ্ধের দিনে উল্লাস করে? মরিয়ম হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। অন্তর্বাস পরা শরীরটা ট্রাকের এক কোনায় লেপ্টে থাকে মার-খাওয়া জন্তুর মতো। আর সে অন্ধ চোখে দেখে-মহুয়া সিনেমা হলের সামনে দিয়ে অন্তর্বাস পরা অবস্থায় খোলা ট্রাকে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেদিনের সিনেমা হলের দর্শকদের একজন জসিমুল হক। মরিয়মের প্রথম প্রেমিক, যার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে তিন দিনের মধ্যে প্রণয় এবং বিচ্ছেদ। সে হয়তো হল-ভাঙা দর্শকদের সঙ্গে বিশাল হোর্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছিল, ট্রাক ভর্তি ন্যাংটা মেয়ে দেখে সিটি বাজিয়েছে। এমন দৃশ্য তো ব্ল্যাকে টিকিট কেটে ‘কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ইংরেজি মুভিতেও সচরাচর দেখা যায় না। ওই সময়ের কথা মনে পড়তে মরিয়মের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফোটে। লজ্জায় মাথাটা নুয়ে পড়ে। আর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় পায়ের আঙুলের চিপায়। যুদ্ধের দিনে সিনেমা হলে তো কারোর যাওয়ার কথা নয়। ভাবনাটা যেন আকাশ থেকে হঠাৎ উড়ে পড়ল। মরিয়ম মাথা তুলে মুক্তির দিকে সরাসরি তাকায়, তা না হলে, সামনে মৃত্যু না কী–কিছুই তো জানতাম না তখন, তা আসলো কোত্থেকে!’ তারপর তাদের লজ্জা নিবারণের জন্যই বোধ হয় বৃষ্টিটা আরো জোরে তেড়ে আসে। সে এমন মুষলধারে বৃষ্টি, যেন দুনিয়া ভাসিয়ে নেবে। গাড়িটা ব্রেক কষে থেমে যায়। লোকগুলো নেমে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয় বিশাল বিশাল বাদুড়ের ডানার মতো ত্রিপল। আসলে চোখ বাঁধা থাকায় এমন মনে হইছিল,’ মরিয়ম মৃদু হেসে বলে। তারা প্রত্যেকেই ভেবেছিল, যার যার বাড়ির কাছ দিয়ে ট্রাকে করে যাচ্ছে। যারা শিস দিচ্ছে বা তালি বাজাচ্ছে, তারা তাদের চেনা লোক, কারো কারো প্রাক্তন প্রেমিক। তবে তাদের সেদিনের এ চিন্ত টা ছিল অন্ধের যষ্টির মতো, যা দিয়ে তারা তাদের ভবিষৎকে ছুঁয়েছিল, যেখানে ক্রমে জমা হচ্ছিল আপন-পরনির্বিশেষে সকলের টিটকারি আর ধিক্কার। পরে শত শত ত্রিপল দিয়েও এ থেকে তাদের আড়াল করা যাবে না।

এ চলার যেন শেষ নেই। পথ নয় গোলকধাঁধা–সুন্দরীর জলার মতন। আর মন্টুও আছে সঙ্গে। চোখ-বাঁধা অবস্থায় ত্রিপলের নিচে বসে মেরির মনে হয়, যেন অনন্তকাল ধরে তারা ভাই-বোন নিজেদের বাড়ি ফেরার পথ খুঁজছে। কিন্তু জলাভূমির গোলকধাঁধায় কিছুতেই পথের হদিশ পাচ্ছে না। মন্টুটা আগের মতোই বোকা–এই যুদ্ধের দিনেও। সুন্দরীর জলার রহস্য ভেদ করে যে কখনও প্রাপ্তবয়স্কে উত্তীর্ণ হবে না। শৈশবের প্রশ্নগুলোর মীমাংসা না হতেই এই কিশোরের জীবনে যুদ্ধ চলে আসে। যুদ্ধে যায় সে।

০৮. যোদ্ধা

‘কেয়া, ডর লাগতা হ্যায়?’

‘না স্যার, নেহি।’ বুক টান করে মেজর শর্মার প্রশ্নের জবাব দেয় মন্টু। মেজর এগিয়ে যান ফল ইন-এ দাঁড়ানো পরবর্তী যোদ্ধার দিকে। আজ তাদের প্রথম অপারেশনের দিন। শত্রুর দখলকৃত স্বদেশে তারা ঢুকবে এলএমজি, গ্রেনেড, রাইফেল হাতে। ছেলেদের চেকআপ শেষ করে মেজর এবার বক্তৃতা দিচ্ছেন। মন্টু বুক থেকে পুরো বাতাস বেরিয়ে যেতে দেয় না। প্রাণপণে ধরে রাখে। যাতে মি. শর্মা বক্তৃতা দিতে দিতে অনেকগুলো ছেলের মাঝখানে তার ফোলানো বুকটা দেখতে পান। আর এ কাজে মন্টুর অনেকখানি মনোযোগও ব্যয় হয়। মেজর যোদ্ধাদের তখন তাতাচ্ছেন। মন্টু বুকে দম আটকে মেজরের কথাগুলো মনে মনে মাতৃভাষায় উচ্চারণ করে-বাচ্চারা, মনে হিম্মত রাখো, সাহস রাখো। যুদ্ধ ছাড়া দেশ স্বাধীন করা যায় না। শত্রু তোমাদের জন্মভূমি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তোমাদের মানুষদের মারছে। কুকুর-বিড়ালের মতো। তোমাদের মা-বোনদের ইজ্জত লুঠ করছে।

মন্টুর পশমহীন মসৃণ বুকটাতে ভূমিকম্পের কাঁপন। অতি কষ্টের আটকে রাখা বায়ু বুক তোলপাড় করে গলায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়। মার্চ মাসের পর এপ্রিল চলে গেছে, মেরিবুর খবর নেই। মা মাঝরাত্তিরে উঠে ঘর-বাহির করেন। বাড়িতে কান্নাকাটি নিষেধ। আব্বা সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ‘ঢাকায় এখন একটা কুত্তাবিলাইও নাই।’ শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকদের কাছে এসব কথা শুনে গাঁয়ের মানুষ জানতে চায়, ‘মেরি কই? হে কি বাড়ি আইছে, না ঢাকায় রইছে?’ মা অনেক দিন ‘মেয়্যেটা আমার ছোডু ভাইয়ের বাসায়, দোয়া কইরেন গো, বড় আদরের মেয়ে আমার,’ বলে বলে চালিয়েছেন। তখন তারাও বলত ‘দোয়া করি মা গো, আল্লাহ্ যান সহি সালামতে রাহে আপনের মাইয়্যাডারে।’ গোলাম মোস্তফার সপরিবারে গায়ে আসার পর জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। মায়েরও গায়ের লোকদের বলার মতো কিছু থাকে না, লুকিয়ে কান্নাকাটি করা ছাড়া। মেয়েটা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল–বড়। আদরের মেয়ে গো আমার।

‘তোমরা প্রতিশোধ নাও,’ মন্টু শোনে মেজর শর্মার উত্তেজিত স্বর। এখন বক্তৃতা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিনি বলছেন, ‘ডোন্ট বি অ্যাফরেড। হামলোক তুমহারা সাথ হ্যায়। তুমকো মদদ করে গা। অল শর্টস অব হেলপ। দেখো, একদিন না একদিন তুমহারা দেশ স্বাধীন হোগা। ইয়ে হোনে চাইয়্যে। গুডলাক সান। জয় বাংলা।’

সেই রাতে বর্ডার পেরিয়ে মন্টুদের দল রাজাকার ধরার অভিযান চালায়। রাজাকারকে বাড়ি না পেয়ে তার টাটু ঘোড়াটা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। এর পিঠে চড়ে লোকটা ধানের মৌসুমে ভিক্ষা করতে বেরোত। ফেরার সময় তারা পাঁচটা গ্রেনেডের চারটাই ভিক্ষুকের খালি উঠোনে ছোড়ে। যার একটাই শুধু ফাটে বিকট শব্দে। তারা ছুটছে, সঙ্গে ঘোড়াটাও। দেশের মাটিতে ক্ষণকাল তিষ্টানোরও সাহস নেই তাদের। তাড়াহুড়োয় গ্রেনেডের পিন খুলতেও ভুলে গিয়েছিল। ভারতের সীমানায় ঢুকে তবে তারা দৌড়ানো থামায়। ভাবে, তারা চোর, ঘোড়া চোর। আর চোরের মতোই হয়েছে তাদের প্রথম দিনের অপারেশন।

‘অ্যাই করে হবে যুইদ্ধ, দেশ স্বাধীন হইব এইভাবে?’ তিরস্কারটা করেন স্বয়ং প্লাটুন কমান্ডার। একই প্রশ্ন অপারেশনে যাওয়া ছেলেদেরও। তবে তারা এজন্য খুশি যে, জানটা হাতে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছে। একজনও খোয়া যায়নি। নিজের দেশ যে এত ভীতিকর–জানা ছিল না। ভারতের প্রশিক্ষণ-শিবিরে থাকার সময় শুধু ভেবেছে, কবে মশা আর জোঁকের কামড় থেকে রেহাই পাবে, আধপেটা খেয়ে শারীরিক কসরতের দিন ফুরাবে কবে, কখন স্বদেশে ঢুকবে একজন পরিপূর্ণ যোদ্ধার মতো অস্ত্র হাতে। এর মধ্যে তাদের গায়ের চামড়া পুড়ে তামাবর্ণ ধারণ করেছে, পেশিতে নীল শিরার নকশা ফুটেছে আর মুখ ঘিরে আছে না-কাটা দাড়ি-গোঁফের বিশৃঙ্খল জঙ্গল। পরিবর্তিত অবয়বের তলায় মনটাও ক্রমে বদলে যাচ্ছিল। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কারো এক মুহূর্ত তর সইছিল না।

প্রথমে তারা হতাশ হয় অস্ত্রের স্বল্পতা দেখে। পাকবাহিনীর আছে ট্যাংক, মেশিনগান আরো সব অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। এসবের বিরুদ্ধে রাইফেল, স্টেনগান, গ্রেনেড দিয়ে কত দিনে তারা দেশটা স্বাধীন করবে? তারপর সামান্য গ্রেনেড ব্যবহার করতে না পেরে ভীষণ দমে যায়। প্রতিশোধের আগুনটাও কখন যেন নিভে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র এসব হতাশা, নৈরাজ্য বরদাস্ত করে না। তোমাকে মারতে বা মরতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। প্লাটুন কমান্ডারের এ রকম কড়া কথা শুনে একেক সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাদের পালাতে ইচ্ছা করে। পুরোনো দিনগুলো পেছনে টানে শার্টের আস্তিন ধরে। সেখানে ছিল পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার মতো ক্লান্তিকর জীবন। কখনো কখনো প্রেমপত্র লিখে নাস্তানাবুদও তারা হয়েছে। প্রতারণা আর প্রত্যাখ্যানের ভুক্তভোগী দলের কম-বেশি সবাই। তখন আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো পথ দেখতে পায়নি। যুদ্ধের তোপের মুখে পুরোনো কষ্টগুলো বাতাসে উবে যায় । একঘেয়ে অতীতটা হয়ে ওঠে নানা বর্ণে উজ্জ্বল, স্বপ্নের মতো স্পর্শাতীত।

তত দিনে পুরোদমে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। বেছে বেছে বৃষ্টির রাতগুলোতে অপারেশনের সময় ধার্য করা হয়। তারা গামছায় গ্রেনেড পেঁচিয়ে কোমরে বাঁধে, গায়ে চড়ায় অন্ধকারে মিশে যাওয়ার মতো গাঢ় রঙের শার্ট, কাঁধে ঝোলায় স্টেনগান বা রাইফেল, পরনের লুঙ্গিটা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর তুলে কোমরে গিঁট দেয়, তারপর একটুকরো পলিথিনে মাথা মুড়িয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যাম্প থেকে। শত্রুবাহিনী জোঁকের মতো সঁতসেঁতে বাংকারের গায়ে লেপ্টে আছে। গর্ত ছেড়ে বেরোনোর হিম্মত নেই। এই সুযোগে মন্টুরা অবরুদ্ধ স্বদেশের পথে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চলে। যদিও তারা আসল শত্রুর মুখোমুখি তখনো হয়নি, বুঝতেও পারছে না স্বাধীনতা কত দূর, তবুও প্রতিটি পদক্ষেপে মাড়িয়ে যাওয়া জল-কাদা-ঘাস তাদের মনে হয় নিজেদের অর্জন। এমনকি বর্ষার মেঘ থইথই আকাশ, বাংলার আকাশটায়ও যেন শুধু তাদেরই অংশীদার আর ঘুটঘুঁটে অন্ধকার রাত তাদের একার সঙ্গী। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রমের সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করার বিনিময়ে এসব তারা অর্জন করেছে। মৃত্যুতেও যা হাতছাড়া হওয়ার নয়। অস্ত্রের চেয়ে এই দখলদারি মনোভাবের শক্তি প্রবল। তা তাদের শহিদি প্রেরণা জোগায়, শত্রু খতমে উদ্বুদ্ধ করে।

সমস্যা হলো, অপারেশনের রাতে বেশিরভাগ সময় টার্গেট বাড়ি থাকে না। কী করে যেন আগেভাগে খবর পেয়ে পালিয়ে যায়। তবে মন্টুরা সেসব বাড়ি থেকে খালি হাতে কখনো ফেরে না। গরুটা, ছাগলটা দড়ি ধরে গোয়াল থেকে বের করে আনে। সেই সঙ্গে সংসারের টুকিটাকি জিনিস দিয়ে উঠোনে বসে বোঁচকা বানায়। যুদ্ধের ময়দানে এসব জিনিস কী কাজে দেবে জানে না, তবে লোভে পড়ে বা দালালদের শায়েস্তা করার জন্যই হয়তো মালসামান লুট করে। বা খালি হাতে ফেরার মধ্যে পরাজয়ের যে গ্লানি থাকে, লুটপাটের উত্তেজনায় সেটা চাপা পড়ে যায়।

ফেরার সময় প্রতিবার এক দুর্বোধ্য ভয় মন্টুকে তাড়া করে। তার সামনে যেন রাতের সেই রহস্যময় জলাভূমি, যা পেরিয়ে আর কোনোদিন বাড়ি ফেরা হবে না। সে দু’কলাম করে মার্চ করা মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝখানে অনবরত জায়গা বদলায়। লুটের মালামালের আড়ালে লুকোতে চায়। তারপর একসময় দেখে, সে সবার পেছনে। পেছনটা শূন্য, সামনে অন্ধকার। সেখানে কয়েকটা আলোর ফুটকি। তখন মুখ থেকে। গোঁ-গোঁ আওয়াজ নিঃসৃত হয়–সহযোদ্ধারা যার নাম দিয়েছে ভয়সংগীত। তার এই ভয় জয় করার জন্য দলনেতা যেদিন দালাল খতম করার হুকুম দেন, সেদিনও ফেরার পথে সে একই কাজ করে।

দলনেতা শরিফ ভাইয়ের নির্দেশ পেয়ে গর্বিত পায়ে এগিয়ে যায় মন্টু। এমন একটা গুরুদায়িত্ব জীবনে এই প্রথম, যা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেও নয়। স্কুলে পড়ার সময় বোনের সঙ্গে যে শহরে চলে আসতে হয়েছিল, তাতে জোরজবরদস্তি ছিলই। কেউ একবার জিগ্যেসও করেনি, ‘কি রে মন্টু, শহরে যাবি, না গ্রামে থাকাটা তোর পছন্দ?’ শহরে মন্টুর অবস্থা দাঁড়ায় গাছের খোড়ল থেকে ছিটকে পড়া চোখ-না-ফোঁটা পাখির ছানার মতো, যারা একদিন তার হাতের তালুতে তিরতিরিয়ে কাঁপত। কত রাত সে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে! ওখানে মন্টু ছিল বোনের হাতের ক্রীড়নকতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস। শেষমেশ সে যখন মিছিল-মিটিংয়ের উত্তপ্ত নগরীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল, প্রথমবারের মতো ভাবতে পেরেছিল এটি তার নিজের শহর, তখনই মরিয়ম তাকে জোর করে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। তার বড় হওয়াটা পরিবারের কেউ কখনো গ্রাহ্যই করেনি। এমনকি বাইরের লোকেরাও। এখানে সে যে একজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, সঙ্গের ছেলেরা তাকে একফোঁটাও দাম দেয় না। অবসর সময়ে ‘ডওরা মন্টু, রাইতে হিসি করে বিছানা ভিজায় দিস না কইলাম’ বলে বলে উত্ত্যক্ত করে। কেবল কমান্ডার শরিফ ভাই তাকে আজ যথার্থ সম্মান দিলেন। হাতে স্টেনগান দিয়ে বললেন, ‘কি রে, পারবি?’

পারব শরিফ ভাই, পারব–মাথা নেড়ে অস্ত্রটা হাতে নেয় মন্টু। তার মাত্র তিন গজ দূরে কয়েকটা আলোর ফুটকি–জ্বলছে-নিবছে। ভাই রে মন্টু, ভয় পাস না, এগুলো আলেয়ার আলো। সংসারে এদের অস্তিত্ব নাই রে ভাই। এরা মায়ার জালে জড়িয়ে পথিককে দিগভ্রান্ত করে, ভুল পথে টেনে নিয়ে হত্যা করে। এক-দুই-তিন শরিফ ভাইয়ের কণ্ঠস্বর যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসে। তিনি যেন অন্য কারো গলায় অর্ডার দেন, ‘মন্টু রেডি? ফায়ার ওপেন কর। বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু।’ ঠা-ঠা-ঠা মন্টুর স্টেনগানের মুখ থেকে এক ঝলক আগুন বেরিয়ে যায় অট্টহাসি দিয়ে। আর উড়ে গিয়ে বিদ্ধ করে গাছে বাঁধা লোকটির বক্ষদেশ, কণ্ঠা, দাড়ি। নিমেষে দশাসই লোকটা পাখির ছানার মতো ছটফটিয়ে নিঃসাড় হয়ে গেল। এর আগে পানি খেতে চেয়েছিল পাখির মতোই চঞ্চু ফাঁক করে। সেই রাতের নায়ক মন্টু। শরিফ ভাই নিজ হাতে দিয়াশলাই জ্বেলে চারমিনার ধরিয়ে দেন। ফেরার পথে পিঠ চাপড়িয়ে বলেন, পিছিয়ে না পড়ে পাশাপাশি হাঁটতে। খানিকটা এগিয়ে ফের লুকোচুরি খেলা শুরু করে মন্টু। তারপর যথারীতি গোঁ-গোঁ ভয়সংগীত।

মুখে যে যা-ই বলুক, দলের সবাই যে সাহসীতা নয়। বিষয়টা ধরা পড়ে ভারত থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে আসার দিন। এর আগে তারা ছিল অনুপ্রবেশকারী, আরেক দেশের বর্ডার ক্রস করে চটজলদি আক্রমণ চালিয়ে রাতের অন্ধকারে ফিরে গেছে। যুদ্ধের ভাষায় একে বলে-ইনফিলট্রেশন। কাজটা বেআইনি। যত দিন না ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ বাধানো হচ্ছে, ভারত তত দিন পাকিস্তানের ভূখণ্ডে যুদ্ধ করার জন্য লোক পাঠাতে পারে না। এ ছাড়া মন্টুদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে দেশের মধ্যে ঢুকে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করার জন্য। এর ফলাফল হাতে-নাতে পাওয়া যাবে না ঠিকই, তবে নানান রকম নাশকতামূলক কাজ করে শত্রুকে ব্যস্ত রাখার নামও যুদ্ধ। এতে করে শত্রুসৈন্যের কাজে বিঘ্ন ঘটবে। তারা বিরক্ত হবে। ভয় পাবে। পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে। মেজর শর্মার দীর্ঘ বক্তৃতায় ছেলেরা খুশি হতে পারে না। ভারতের এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ কৌশলে তাদের ঘোর আপত্তি। তাহলে দেশটা স্বাধীন হবে কবে? মেজরের পক্ষে এর জবাবে কিছু ভেঙে বলা সম্ভব নয়, তা স্টেট সিক্রেট। তিনি ছেলেগুলোর ওপর বিরক্ত হন। এরা দেখা যাচ্ছে, দিনদুনিয়ার কোনো খবরই রাখে না! রাতের বেলা দু-চারটা দালাল খতম করে ভারতে বসে স্বপ্ন দেখে দেশ স্বাধীন করার! তিনি তাদের দুই ব্যান্ডের রেডিও কেনার পরামর্শ দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যান। পেছনে তার আদেশটা বহাল থাকে।

রেডিও কেনা হয়, তবে তা শোনার সময় বা ইচ্ছা কারো নেই। দিন থাকতেই পাততাড়ি গোটাতে হবে। সন্ধান করতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ের। দুটি মিলিটারি ট্রাক বর্ডারের কাছাকাছি স্থানে মালসামানসহ মন্টুদের নামিয়ে দিলে তাদের অবস্থা দাঁড়ায় শরণার্থীদের মতন। পার্থক্য শুধু শরণার্থীরা যাচ্ছে ভারতে, তারা উল্টো ঢুকছে শত্রু আক্রান্ত ভূখণ্ডে। দৃশ্যটা সত্যিই বিরল। তা দেখতে আশপাশের দু’চার গায়ের লোক ছুটতে ছুটতে আসে। যেন সার্কাস পার্টি গ্রামে ঢুকেছে। ছোট ছোট ছেলেরা সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। তাড়া করলে খিলখিলিয়ে হেসে পালিয়ে যায়, পরক্ষণে বন্দুকের ধাতব নলগুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য পা টিপে টিপে ফিরে আসে। ভিক্ষুকের ঘোড়াটা সঙ্গে থাকলে একজন ভাবে, তারা নাজেহাল হতো কম। ঘোড়া আভিজাত্যের প্রতীক, এমনকি তা ভিক্ষুকের হলেও। ক্যাম্প গোটানোর সময় একজন প্রস্তাবটা দিয়েছিল। তার যুক্তি ছিল, যুদ্ধে ঘোড়সওয়ার বাহিনী থাকে না! আমরাও একে যুদ্ধের কাজে লাগাতে পারি। তত দিনে কয়েকজন ছেলে অশ্ব চালোনায় সুদক্ষ হয়ে উঠেছে। শরিফ ভাই রাজি হলেন না। উল্টো ঝাড়া এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন-তোমাদের বোঝা দরকার, গেরিলা যুদ্ধ সম্মুখ-সমর নয়। তা করতে হয় নিঃশব্দে, শত্রুকে নিজের উপস্থিতি জানান না দিয়ে। তার জন্য খালি পায়ে জল-কাদা পাড়াতে পাড়াতে আমাদের আঙুলের চিপায় সাদা সাদা ঘা হয়ে গেল, পায়ের তলাটা চালনির মতো ঝাঁঝরা করে ফেলল পানিপোকারা। সহযোদ্ধা মজিবর গুলিবিদ্ধ হলো শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গ্রেনেড ছোঁড়ার সময়…

শরিফ ভাইয়ের এ এক দোষ, সব সময় বক্তৃতা শেষ করেন মজিবরকে দিয়ে। মজিবর তাদের বীরত্ব না ভুলের প্রতীক? এখন বোঁচকা-বাচকি নিয়ে দেশে ঢুকতে গেলে মজিবরের কবরের পাশ দিয়েই তাদের যেতে হবে। কেউ তাতে রাজি হয় না। দেশে ফেরার অন্য কোনো পথও নেই। তাই তারা কৌতূহলী জনতার মাঝখানে। গুটিসুটি বসে রাতের জন্য অপেক্ষা করে। রাত নামার পর অন্ধকারের আড়াল নিয়ে ভীতিকর জায়গাটা পেরিয়ে যাবে, যেখানে দলের প্রথম ক্যাজুয়ালটি শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। মজিবর চিরনিদ্রায় শায়িত।

দুজন ছেলেসহ মজিবরকে মধ্যমগ্রামে পাঠানো হয়েছিল অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্প রেকি করতে। সময়টা দুপুর-বিকালের মাঝামাঝি। পরিষ্কার-ঝকঝকে দিন। তার মধ্যে দু-তিনটা গ্রেনেড অবস্থা বুঝে ফাটাবে। সেই মতো স্টেনগান বাগিয়ে, মাথা নিচু করে, কোমর বেঁকিয়ে শত্রুর আস্তানার পঞ্চাশ গজের ভেতর ঢুকে পড়ার পর সেন্ট্রি টের পেয়ে গেলে শুরু হয় বৃষ্টির মতো অঝোর গুলিবর্ষণ। বাকি দুজন পাটখেতের আড়াল নিয়ে পালিয়ে আসে। মজিবর পজিশন নিয়ে স্টেনগানের ট্রিগারে চাপ দেয়। দু’বারের ব্রাশেই ম্যাগাজিন শূন্য। তখন পাটখেতের ভেতর দিয়ে না পালিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গ্রেনেডের পিন খোলে। তারপর বর্শা নিক্ষেপকারীর মতো সামনে কয়েক পা দৌড়ে গ্রেনেড ছোড়ে এবং সে অবস্থায় গুলি খেয়ে স্থির হয়ে যায়। আশপাশের গাঁয়ের লোক গোলাগুলির শব্দে তখন পালাচ্ছিল। হঠাৎ গোধূলির আলোয় একজন মুক্তিযোদ্ধার উত্তোলিত হাত এবং দৌড়ের ভঙ্গিতে শূন্যে ঝুলে থাকার দৃশ্যটি তাদের নিশ্চল করে দেয়। আরেক দফা গুলিবর্ষণের আগ পর্যন্ত তারা যার যার জায়গায় দাঁড়িয়েই থাকে।

যুদ্ধের উনত্রিশ বছর পর মুক্তির কাছে মধ্যমগ্রামবাসী অভিযোগ করে বলে যে, স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলি ঠিকভাবে তৈরি হচ্ছে না শহরে। তারা মুক্তির কাছে এমন একটা পাথরে খোদাই মুক্তিযোদ্ধার বায়না ধরে, যে উদ্বাহু, শূন্যে স্থির, বাংলার মাটিতে যার খাই নেই। ‘কেন?’ মুক্তির প্রশ্ন শুনে তারা খানিক ভাবে। এরপর বলে, বাস্তবে এমন একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা তারা দেখেছে, যার স্মৃতি পাটগাছ বড় হয়ে মাথা ছাড়িয়ে গেলে তাদের মনে পড়ে। কারণ সে তো যুদ্ধ না করে পাটখেতে লুকোতে পারত। সেটা সে করেনি। কারণ সে মানুষ না, ফেরেশতা ছিল। আর চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটা হলো মানুষের। মানুষ মরলেও দাবি ছাড়ে না। গাঁয়ের এক শহিদের মাকে দেখিয়ে তারা মুক্তিকে শেষের বাক্যটি বলে। তিনি অশীতিপর বৃদ্ধা, সোমত্ত ছেলে যুদ্ধে হারিয়ে উনত্রিশ বছর ভিক্ষা করে খাচ্ছেন। বাংলার মাটিতে তার ছেলের যে দাবি, তা সে ছেড়ে যায়নি। ছেলের হয়ে তিনি তা বহন করছেন। কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই বোঝা তাকে বইতে হবে।

জীবিত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মধ্যমগ্রামবাসীর গর্ব নেই। একসময় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেও সমাজের আর দশজনের মতোই এখন। সবার মতো তাদেরও বয়স বেড়েছে। ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছে, কেউ-বা নাতি-নাতনির দাদা-নানা। যুদ্ধের পর পর তাদের যে জেল্লা আর দাপট ছিল, দেখে মনে হতো এ গাঁয়ের ছেলে হলেও তারা যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছে, তারা গ্রামের গৌরব, বীর মুক্তিযোদ্ধা–এখন আর ওসব কিছু মনে হয় না। চোখের সামনে তাদের উত্থান-পতন দুই-ই দেখেছে। গ্রামবাসী। তখন দু-একজন চাল-গম-কম্বলের ডিলারি করে বিস্তর কামিয়েছিল। যে পথে টাকা এল, সেই পথেই গেল। ভোগ করতে পারল না। তবে রিলিফের সিমেন্টে তৈরি থানা কমান্ডারের দালানবাড়িটা এখনো অক্ষত আছে। সরকার বদলের সঙ্গে দলবদল করে করে সে এখন দু-দুটি কোল্ড স্টোরেজ আর পেট্রোলপাম্পের মালিক। গায়ে থাকে না। নির্বাচনের আগে শহর থেকে নেমে আসে ভোট চাইতে। একেকবার একেক মার্কা। অন্যদের বেলায় সরকার বদল হয় তো বাড়িতে পুলিশ এসে তাদের ধরে নিয়ে যায়–মারে-কাটে। লাঞ্ছনার শেষ নেই। অবশ্য এমনিতেই দু-চারটা খুনখারাবির মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকে। জেল খাটা, কোর্ট-কাছারি করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। গ্রামবাসী মুক্তিকে বলে, আরো আগে তার গায়ে আসা উচিত ছিল। কারণ এখন কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার বলা মুশকিল। একেকটা সরকার ক্ষমতায় এসে যাচাই-বাছাই করে। তখন এমনও হয়, যে ছিল রাজাকার সে হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা আর যে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিল, তার নাম কলমের খোঁচায় তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেল। সবকিছু এখন তালগোল পাকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাথাটা পরিষ্কার আছে কেবল ভূমিহীন কৃষক আমিনুলের।

‘উহু হু-হু, হেই বছরডায় যে কী বিষ্টি!’ আমিনুল ইসলাম মুক্তিকে বলে, ‘আন্ধার রাইত, হাতের তালু দিহা যায় না, এমুন। ওরা আমাগো ঘরের পিছ দিয়া ছপছপ কইরা হাইট্যা যায়, আমরা ঘর থিক্যা টের পাই। পুকি দিয়াও দেহি, কথা কওনের সাহস হয় না।’ একদিন আমিনুল সাহস করে জানালা দিয়ে টর্চ মারে। আর যায়। কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ডসআপ করিয়ে টেনে-হেঁচড়ে বাইরে আনে। একজন মারে তো আরেকজন বাধে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি জরুরি অপারেশন ছিল। আমিনুলকে সঙ্গে নিয়ে তারা ধানখেত, বিল-বাওড় পেরিয়ে যায় আরেক গ্রামে। সেদিন থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে আমিনুলের ওঠা-বসা, বন্ধুত্ব। তার কাছ থেকে মুক্তি জানতে পারে, মধ্যমগ্রামে যার কবর, সে মন্টু নয়, তার নাম মজিবর, উদ্বাহু সেই মুক্তিযোদ্ধা। মজিবরের কবর খুঁড়েছে সে নিজে। দলনেতা শরিফ ভাই মন্টুর শেষ অপারেশনের আগেই পায়ে গুলি লেগে বেহুশ অবস্থায় হাইডআউটে পড়েছিলেন। তিনি আর যুদ্ধ করতে পারেননি। পরে তার পাওটাই কেটে বাদ দিতে হয়। আর মন্টুর মৃত্যুসংবাদ বয়ে নিয়ে গেছে যে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি, নাম সরফরাজ হোসেন, তাকে সে সময় ভারত পাঠানো হয় অস্ত্র বা রসদ আনার জন্য। ‘৭৫ সালের আগস্ট মাসে মরিয়ম সরফরাজের কাছ থেকে মন্টুর কবরসংক্রান্ত ভুল তথ্যই পেয়েছে।

উদ্বাহু মুক্তিযোদ্ধা মজিবরের মৃত্যুর দিনটা আমিনুলের স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল বুধবার, হাটের দিন। আচমকা গোলাগুলি শুনে আমিনুল ভেবেছিল, আর্মি বুঝি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে গ্রামে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু পাল্টা আওয়াজ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আমিনুলের তত দিনে মর্টারের শেল ফাটার শব্দ, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের থেমে থেমে ব্রাশফায়ার আর রাইফেলের সিঙ্গল শট–আলাদা করে চেনা হয়ে গেছে। আর তো বিলম্ব চলে না। চটজলদি বাড়ির বগলের সবচেয়ে উঁচু সুপারিগাছটায় উঠে পড়ে সে।

গোলাগুলির শব্দটা ততক্ষণে থেমে গেছে। কিন্তু মানুষের দৌড়ঝাঁপের খামতি নেই। আমিনুল ওপর থেকে ধোঁয়ার ছোট্ট একটা কুণ্ডলী দেখে ইউপি অফিসের চাতালটায়। বাপরে, দিনদুপুরে শত্রুর আস্তানায় মুক্তিফৌজের আক্রমণ! যা হোক, ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা হয়ে গেছে। এখন কামড়ানোর আগে পালাতে হবে। সেও গাছ থেকে নেমে পলায়নপর মানুষের কাফেলায় ভিড়ে যায়।

সন্ধ্যায় সাত রাজাকারসহ চার আর্মির পাততাড়ি গুটানোর খবর পেয়ে আমিনুল হাঁটা দেয় ক্যাম্পের দিকে। পথে থাকতেই একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুসংবাদ কানে আসে। সে যে মৃত্যুর পরও দণ্ডায়মান, উদ্বাহু ছিল সেসময় পথচারীরা তা বলাবলি করছিল। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে, লাল গামছায় ঢাকা একটি সাধারণ মৃতদেহ। মাথার কাছে কুপি জ্বলছে আর লাশটা ঘিরে বসে আছে সাত-আটজন সহযোদ্ধা। শোকে মোহ্যমান। সংবিৎ ফেরার পর ভারতের ভূখণ্ডে তাদের বেসক্যাম্পে সৈনিকের মর্যাদায় তাকে গোর দেওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু ওপারের কর্তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাতে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। অতীত বিদ্বেষ আবার ফিরে আসে। তারা বলে, দুদিন আগেও ভারত তাদের শত্রু ছিল, এখন মিত্র, কারণ তারা যুদ্ধ করছে ভারতের শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমিনুলের গা ছমছম করে। ভয় পেয়ে সাত রাজাকারসহ চার আর্মি ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছে ঠিকই, তবে যে-কোনো সময় ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফিরতে পারে। শত্রুর দখলকৃত ভূখণ্ডে বসে বসে শোক করা বা রাগ দেখানো ঠিক হচ্ছে না। যে গেছে, গেছে। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তার দিকটা ভাবতে হবে। সে নিজ উদ্যোগে কোদাল হাতে পোর খুঁড়তে শুরু করে। ঠিক সে সময় সহযোদ্ধাদের বেষ্টনী ছেড়ে মন্টু এগিয়ে আসে। চাক-চাক মাটির ওপর দাঁড়িয়ে সে গোরখোদকের। কাছে একটা সিগারেট চায়। আমিনুল কানের গোঁজ থেকে বিড়ি বের করে তার হাতে দিলে সে বলে, জীবনে এই প্রথম কবর খোঁড়া দেখছে। গোরখোদক তাতে অবাক হয়, কোদাল চালাতে চালাতে জিগ্যেস করে, কী কও মিয়া, হাছাই? মন্টু মাটি কাটার ছপছপ শব্দ শোনে, উঁকি দিয়ে অন্ধকার গর্ত দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে, মানুষকে এভাবে গর্তে পোরাটা তার ভাল্লাগে না। কেমন দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। অন্ধকারে আমিনুল ছেলেটার মুখ দেখতে পায় না। তবে বোঝে যে, সে ভয় পেয়েছে। আর ভয় তাড়ানোর জন্যই হয়তো আমিনুলকে না-দিয়ে বিড়িটা একাই সাবাড় করে দিয়েছে। ‘খোদার কী কুদরত,’ মুক্তিকে যুদ্ধের উনত্রিশ বছর পর আমিনুল বলে, ‘ছেলেডা কবরে গেল না। খানেরা লাশ গায়েব করে দিল ওর।’

মন্টুদের দলটা জঙ্গল ঘেরা একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ঘাঁটি গাড়ার পর আমিনুল ইসলাম ঘরবাড়ি ছেড়ে তাদের সঙ্গে থাকতে চলে আসে। কারণ তাকে তখন উত্ত্যক্ত করছিল স্থানীয় রাজাকার বাহিনী। মিলিটারিরও ধরি ধরি ভাব। গ্রামে ঢুকে তারা জনে জনে জিগ্যেস করে, মুক্তিফৌজ কাঁহা হায়, মুক্তিফৌজ কাঁহা হায়। এরপর বাড়ি থাকা যায়? সব শুনে দলনেতা শরিফ ভাই বললেন, ‘আমিনুল, তুমি আমাগো লগে থাকতে চাও ভালো কথা, কিন্তু অস্ত্র ট্রেনিং তো লাগবে। তাইলে পর শত্রুর বিরুদ্ধে ফাইট দিতে পারবা।’ শরিফ ভাই কোমল মনের মানুষ হলেও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি সকাল-সন্ধ্যা আউরপাড়া স্কুলমাঠে আমিনুলকে নিজের হাতে ট্রেনিং করাতে লাগলেন। অস্ত্রের মধ্যে থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর গ্রেনেড। গ্রেনেড চার্জ করতে বললেই আমিনুলের বুকটা কেমন ধড়ফড় করত। তাই থ্রি নট থ্রি রাইফেলটাই সে ব্যবহার করত বেশি।

মন্টুর ছিল স্টেনগান। এই নিয়েই সে অপারেশনে গেছে। আমিনুল ইসলাম গেছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে। তখন একসঙ্গে তাদের খাওয়া-বসা-শোয়া। অবসরমতো তাস পিটিয়েছেও একসঙ্গে। ‘তয় ছেলেডা বড় ডওরা আছিল, ঘুমের মধ্যে খালি কাইন্দা কাইন্দা উঠত।’ আমিনুল দুঃখ করে বলে, ‘হেরে আমি মায়ের পেডের ভাইয়ের মতো জানতাম। বয়সে ছোড়ু আছিল তো! ছেলেডার মনে কী দুঃখু আছিল রে মা, আমারেও কোনোদিন ভাইঙ্গা কয় নাই। দুঃখু কার ছিল না? হক্কলতে বাড়িঘর, বাপ-মা থুইয়্যা যুইদ্ধে গেছে। কারো বাপ শহিদ, বইনের খোঁজ নাই, বউরে মিলিটারি ধইরা নিছে।’

সে সময় ভয়কাতুরে স্বভাবের জন্য দলে মন্টুর খুব দুর্নাম। নিজে ভয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেদেরও সে বিভ্রান্ত করত। তার জন্য পুরো দল দু-দুবার পথ হারিয়ে বিপদে পড়ে। রাতের অপারেশনে বেরিয়ে অন্যে যা দেখে না, সে তাই দেখে, অন্যে যা শোনে না, সে তাই শোনে। তার এই দেখাটা, এই শোনাটা ছিল সংক্রামক। একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে, দলনেতা শরিফ ভাইও তা বিশ্বাস করে ফেলতেন। তখন পথ বদলানোর হিড়িক পড়ে যেত। এই করে করে একবার তারা পাক আর্মির অ্যামবুশের ভেতর পড়ে যায়। গেরিলা যোদ্ধাদের আর যা হোক পালানোর কায়দাটা ভালোই রপ্ত থাকে। সেই রাতে খালবিল সাঁতরে, গোলাবারুদ ভিজিয়ে, পরনের লুঙ্গি ফেলে কোনোক্রমে পালিয়ে আসে ক্যাম্পে। ক্ষতিটা হয় ভয়ংকর। অস্ত্রশস্ত্র শুকোতে, নিজেদের চাঙ্গা হতে তিন থেকে চার দিন লেগে যায়। ফলে দুটি জরুরি অপারেশন বাতিল করতে হয়। এর সাজাস্বরূপ লঙ্গরখানার কাজে ঢোকানো হয়েছিল মন্টুকে। যা ছিল তার জন্য অপমানজনক। কারণ এমন না যে, সে যুদ্ধ করতে চায় না। খুব চায়। কয়েকটা অপারেশনে দুর্ধর্ষ ভূমিকা রেখেছে। এভাবে তাকে বঞ্চিত করাটা অন্যায়। সে হাঙ্গার স্ট্রাইক করে। শরিফ ভাইয়ের দয়ার শরীর। তার জায়গায় আর কেউ হলে, যুদ্ধের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে মন্টুর কোর্টমার্শাল হয়ে যেতে পারত। তিনি শুধু তাকে শপথ করান। সে যদি অন্ধকারে আলোর ফুটকি দেখে, ভূতের কানাকানি শোনে, তবু কাউকে মুখ ফুটে বলবে না। তা গোপন রাখবে। মন্টু আরেক ধাপ এগিয়ে যায়, দলনেতার বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে বলে, সে যদি এসব দেখেও, বা শোনেও নিজে তা বিশ্বাস করবে না। শেষের শপথ বাক্যটা মন্টুর জীবনে কাল হয়েছিল।

হেঁসেল থেকে বেরিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে মন্টু। রাজায় রাজায় যুদ্ধ নয়, গেরিলা যুদ্ধ। তাই কেউ বাদ্য বাজায়নি, শিঙা ফোঁকেনি, বাজি পোড়ায়নি। এই যুদ্ধের বাহ্যিক আড়ম্বর নেই, লোকের পিলে চমকে দেওয়ার মতো শান-শওকত নেই। হাতি নেই, ঘোড়া নেই। তবে মন্টুর মনে দামামা বাজছে, অসম্ভব কিছু করে দেখানোর উত্তেজনায় সে এগিয়ে যাচ্ছে সবার আগে-আগে। এমন পাগলের লাহান করতাছো ক্যান, মিয়া? আমিনুল তার স্টেনগানের ফিতা টেনে ধরে বলে, ‘এত সাহস কিন্তু ভালো না।’ মন্টু তার কথা আমলে নেয় না। আগের মতোই আচরণ করে। কী হয়েছে আজ মন্টুর, হা ভাতের মতো এমন করছে কেন সে? তারা চলেছে বিপজ্জনক এক অপারেশনে। সামনে যে লোহার রেলিং, কাঠের পাটাতনের বারো পিলারের ব্রিজ, এর মুখটায় রাজাকার ক্যাম্প। রাজাকারদের খেদিয়ে ব্রিজ দখলে আনতে হবে। তারপর হাতে সময় থাকলে ব্রিজ ওড়ানোর কাজ। এ অপারেশনে শরিফ ভাই নেই। তিনি পায়ে গুলি লেগে হাইডআউটে পড়ে রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে দলের সেকেন্ডম্যান মতিন পাটোয়ারি। লোকটা দুর্ধর্ষ আর গোঁয়ার। আজকের অপারেশনের শেষ কোথায় খোদা মালুম।

আমিনুলের ডিউটি পড়ে খালের দক্ষিণ পাড়ে। ওইখানে কয়েকটা হিজলগাছ। ফুলের ঝুরি নামিয়েছে। হিজলগাছের আড়ালে পজিশন নিয়ে ফায়ার করতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমিনুল বলে, ‘পানি তো, পানির জন্যি আগুনি যায় না। গাছ ছাড়লে গায়ে গুলি আইসা লাগে। আমি গাছ ছাড়ি নাই। গাছের সাইডে দাঁড়াইয়্যা খালি গুলি করছি। আমার ডাইন সাইডে আমার পিছনে আমার বামে আমার সামনে অনেকে ফায়ারিং করতাছে। তহন কে বাঁশি দিল, মানে যুইদ্ধ শেষ, রাজাকার বাহিনী ভাইগ্যা গেছে। আমরা জাহুর দিয়া, জয় বাংলা স্লোগান দিয়া আগুই গেলাম।

অপারেশন সাকসেসফুল। তখন মাঝরাত। ভোর হতে আরো তিন-চার ঘণ্টা বাকি। এর মধ্যে কাঠের ব্রিজ ভাঙা শুরু হলো। মন্টু আর মিলন পোদ্দার নামে আরেকজনকে পজিশনে রাখা হয়েছে ব্রিজের ওপারে পাকা সড়কের দিকে মুখ করে। সবার নিরাপত্তার বিষয়টি তারা দেখবে। তারপর দলের বাকি ছেলেদের ডাঙায় রেখে মতিন ভাই চারজন যোদ্ধা নিয়ে খালের গলাপানিতে নেমে গেলেন। খালে আমিনুলও আছে। তারা পিলারের গায়ে সবে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়েছে, তখনই মন্টুর সঙ্গের ছেলেটি–মিলন পোদ্দার যার নাম, সে নদীর ধু-ধু চড়া দিয়ে দুজন সৈন্যকে হেঁটে আসতে দেখে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় পানিতে ডুবসাঁতার আর ডাঙায় ছোটাছুটি। সহযোদ্ধারা পালালেও মন্টু নড়ে না। চোখের ভুল বুঝতে পেরে মিলন আগের জায়গায় ফিরে আসে। পজিশন নিয়ে বলে, ‘আমি ভয় পাইছিলাম মন্টু, তুমি ভয় পাও নাই?’ মন্টু তার কথার জবাব দেয় না। সে তখনো চর বরাবর স্টেনগানের নিশানা করে শার্দুলের মতো মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে, যা ব্যতিক্রম শুধু নয়, অস্বাভাবিকও।

তারপর যার যার কাজে লেগে যায় সবাই। সেফটি ফিউজের মাথায় আগুন ধরানো হয়েছে। কাঠের ব্রিজের পাটাতন জ্বলছে ফরফর শব্দ করে। এর আগে ওপার থেকে উইথ ড্র করা হয়েছে মন্টু-মিলনদের। এখন পালানোর সময়। ঠিক তখন উল্টোদিক থেকে একটি তির্যক আলোকরেখা তিরবেগে ছুটে আসে। সবাই দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। মন্টু কোথায়? বিস্ফোরণের আর সামান্য বাকি। আর গাড়িটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমিনুল ঘাড় ফিরিয়ে সেদিন যা দেখেছিল, তা আজও তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে ঘটনাস্থলের তখন এতটা কাছাকাছি, তীব্র আলোর ঝলকানি আর বিকট শব্দে ব্রিজটা যখন ভেঙে পড়ে তখন উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর অনুভব করে, বুকের নিচের মাটি ধাক্কা দিয়ে তাকে আসমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অবশ্য বিস্ফোরণের আগে ঘাড় ফিরিয়ে আমিনুল যা দেখেছিল, সেই দৃশ্যটার তুলনায় এ কিছুই নয়। তখন মন্টুর গায়ে ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, কাঁধে স্টেনগান। সেফটি ফিউজের ম্লান আলোয় তার ভুতুড়ে ছায়াটা প্রথম ব্রিজের কিনারায় উদয় হয়। তারপর সে জ্বলন্ত ব্রিজ ডিঙিয়ে নদীর ওপারের ঝোঁপঝাড় পার হয়ে আর্মির জিপের হেডলাইটের ওপর পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তখন মন্টুর স্টেনগানের নিশানা ছিল না।

০৯. অনুরাধার ডায়েরি

মন্টুর হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ মরিয়ম দেখে ‘৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, পত্রিকার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির পাতায়। সে তখন নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তখন সিনেটর কেনেডিকে যে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল, তার সচিত্র প্রতিবেদনের নিচে একগুচ্ছ ছবিসহ নিখোঁজ বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হয়। তাতে মন্টুর স্কুলজীবনের সাদা-কালো ফটোগ্রাফ। নিচে লেখা সাইফুদ্দিন আহমেদ মন্টু। বয়স বিশ। এর আগে মরিয়ম হাসপাতালের বেডে দৈনিক পত্রিকা নাড়াচাড়া করলেও পড়ে দেখেনি কখনো। অক্ষরগুলো মনে হতো পরস্পর জড়াজড়ি করা, এক লাইন আরেক লাইনের পিঠে চড়ে সিটি বাজিয়ে চলে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে, যার সঙ্গে মরিয়মের কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন দেশের মানুষের হাসি-কান্না, পুনর্মিলনী তাকে স্পর্শ করে না। শহিদ পরিবারের ফ্যামিলি ফটোগ্রাফগুলো বেজায় ক্লান্তিকর। বিদেশি স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার খবরাখবর সে দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে খাটের তলায়। ধ্বংসস্তূপের ওপর এত হাঁকডাক আয়োজন অন্য কারোর জন্য, এর শরিক নয় সে।

সেদিন মন্টুর নিখোঁজ-সংবাদ পত্রিকায় দেখামাত্র, মরিয়ম তা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে। তবে বুঝতে খানিকটা দেরি হয়। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি ক্রমে বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় সে ফের চেনা আলোকচিত্রটির দিকে তাকায়–মন্টুর তেলসিক্ত চুল পরিপাটি আঁচড়ানো, কপালটা ভেজা ভেজা, যেন আঙুল দিয়ে ছুঁলেই তেলের আঠায়। তর্জনী আটকে যাবে। ফুলতলি গায়ের ধূলি-বালি থেকে শহরে উপড়ে আনা কিশোরের দুঃখ ভারাক্রান্ত চোখজোড়ায় ক্যামেরার প্রথম ফ্লাশ বিস্ময় ফোঁটাতে পারেনি। ঠোঁট দুটি আঁটসাঁট–এক বুক অভিমান প্রাণপণে চেপে রাখার চেষ্টা করছে। কিছুতেই বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না–স্টুডিওর লোকটার বারবার এক্স-রে মেশিন অপারেটরের মতো ‘দম ছাড়ো, বি ইজি’ বলার পরও। সেদিন স্টুডিও থেকে বেরিয়ে মরিয়ম ভাইয়ের ওপর খুব চোটপাট করে, ‘তুই একটা গাঁইয়্যা ভূত। এই ছবি দেখলে শহরের স্কুলে ভর্তি নেবে? শুধু শুধু কতগুলি টাকা খরচ!’

‘যারা আজও ফেরেনি’ শিরোনামের সচিত্র খবরের মাঝখানে ‘দম ছাড়ো, বি ইজি’ নির্দেশ অমান্যকারী মন্টুর সেই ফটোগ্রাফ–খবরের কাগজের প্রতিদিনের নিখোঁজের তালিকার আজ জায়গা করে নিয়েছে। মরিয়মের সামনে থেকে কাগজের অক্ষরগুলো জড়াজড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়ায়, এক লাইন আরেক লাইনের পিঠ থেকে নেমে পড়ে, সিটি বাজানো বন্ধ হয়ে দেয়। একাত্তরের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে মন্টু বাড়ি থেকে উধাও। ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার সময় একটা হাতচিঠি পাঠিয়েছিল। তারপর আর খবর নেই। বাবা-মা, ছোট দুই বোন অধীর আগ্রহে তার অপেক্ষা করছে। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি মন্টুর খোঁজ পেলে, তাকে নিম্ন ঠিকানায় যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। পিতা কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়।

এটি হারিয়ে যাওয়া মন্টুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ঠিকানা। সেখানে বাবা-মা, ছোট দুই যমজ বোন রত্না-ছন্দা বাস করে। তারা বেঁচে আছে। মন্টু গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে উধাও। মরিয়ম কোথাও নেই। তার জন্য বাবা-মা, ছোট দুই বোন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে না। করলেও বিজ্ঞাপনে তার উল্লেখ নেই। কিন্তু সে তো বেঁচে আছে এবং ডাক্তারের কথামতো দ্রুত সেরে উঠছে! পুনর্বাসনকেন্দ্র থেকে বারবার তার ঠিকানা চাওয়া হচ্ছিল, যদি আপনজনেরা এসে নিয়ে যায়। কেউ কেউ নিরাময় লাভের পর ইতিমধ্যে নিজের বাড়িঘরে ফিরে গেছে। যদিও সংখ্যায় তারা অতি নগণ্য। ঠিকানা চাইতে এলে মরিয়ম পিঠ ফিরিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে, টুঁ শব্দটি করে না। বিজ্ঞাপনটা পড়ার পর তার মনে একটাই প্রশ্ন, মন্টু নিখোঁজ! স্বাধীনতার দু’মাস পর নিখোঁজ কেউ ফিরে আসে? মন্টু আসবে?

মরিয়মের সামনে থেকে হাসপাতালের সাদা দেয়ালটা সরে দাঁড়ায়। চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে প্রায়ান্ধকার একটি কক্ষ। সেখানে টিমটিমে আলোর বালুবের নিচে ভাগ্যগণনা করছেন একজন কৃশ, খর্বাকৃতির লোক। স্বরটা অসম্ভব ভারী। যেন তার নয়, অন্য কারো কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে—’হাতের তালুতে দীর্ঘ আয়ুরেখা নিয়ে অসময়ে চিরদিনের মতো কেউ হারিয়ে যেতে পারে না, যদি না প্রতিজ্ঞার বরখেলাপ হয়।’ ‘জ্যোতিষশাস্ত্রে সুপণ্ডিত, এশিয়া বিখ্যাত হস্তরেখাবিশারদ প্রফেসর কিউ এম তালুকদার’-এর চলটা ওঠা সঁতসেঁতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে মন্টু। প্রফেসরের পাথরের আংটি পরা বিশাল থাবায় পাখির ছানার মতো তার কচি হাতটা তিরতির করে কাঁপছে। মরিয়ম অদূরে। আবেদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। গলির ভেতরের তস্যগলিতে সে একা আসতে পারবে না বলে ভাইকে সঙ্গে এনেছে। মন্টুর হাত দেখানো ছিল ফাউ। তাই ছোটবেলায় মরিয়ম যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিল, প্রফেসরের প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে সেদিন মনে পড়েনি। আজ পড়ছে।

মেরির সাত আর মন্টুর পাঁচ বছর বয়স তখন। আব্বা-আম্মার বিছানা থেকে সদ্য তাদের চালান দেওয়া হয়েছে পাশের ঘরে। সেখানে ভাই-বোনের জন্য পাশাপাশি দুটি বিছানা। তখন মন্টুর বড় কোনো অসুখ নয়, সামান্য জ্বরই হয়েছিল। ফুলতলি বাজারের হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধে সারছিল না। ভাইয়ের জন্য বোন অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে সেদিন আল্লার কাছে মানত করেছিল, মন্টু সুস্থ হলে ছাপরা মসজিদে চার আনার মোমবাতি দেবে। আজ দেবে, কাল দেবে করে কোনোদিন যা আর দেওয়াই হয়নি। ভাই সুস্থ হওয়ার পর আগের মতোই সেই ঝগড়াঝাটি মারামারি। একজন মেরে পালালে, মার খায় যে, সে অভিশাপ দেয়—’কুষ্ঠ হইয়্যা মরবি তুই।’ বড় হওয়ার পর মেরি-মন্টু একে-অন্যের মরণ চায়নি ঠিকই, তবে দীর্ঘায়ু কামনা করে খোদার দরবারে ফরিয়াদও জানায়নি। হয়তো জানাত, যদি তারা বাঁচতে বাঁচতে একদিন বৃদ্ধ হতো। সে সময়টা আসার বহু আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

মন্টু আজ নিখোঁজ। মেরি হাসপাতালের বেডে। তাকে বাবা-মার অস্বীকৃতিটাও মনে খুব বাজে। যদিও কেন্দ্রের রেজিস্ট্রেশনের দিন থেকে সে তাদের লাগাতার অস্বীকার করে এসেছে, নিজের পরিচয়টাও ঠিকভাবে কেসহিস্ট্রিতে লিখতে দেয়নি। তবে দুটি বিষয়ে ফারাক বিস্তর–বাবা-মা অস্বীকার করছে সন্তান আর সে আড়াল করেছে নিজের পূর্বপরিচয়, যে পরিচয়ে বাস্তবিকই সে আর বাঁচবে না। নির্যাতন ক্যাম্পের দেয়ালের কিনারে যে মেয়েটি আড়ি পেতে বসত, যার নাম অনুরাধা সরকার, এটি ছিল তার ভবিষ্যদ্বাণী। হাতের রেখা না দেখেই অনুরাধা ভবিষ্যৎ বলে। দিতে পারত।

তারা তখন হলরুমের মতো লম্বা একটি ঘরে বন্দি। জায়গাটা কোথায় মরিয়ম জানে না। কারণ চোখ বেঁধে তাদের ওখানে আনা হয়েছে, কয়েকবার বের করেও নিয়ে গেছে চোখ-বাঁধা অবস্থায়। প্রথম দিনেই মরিয়ম দেখেছে, ঘরের জানালা পেরেক। ঠুকে বন্ধ করা। প্রধান ফটক বাদে সব কটা দরজায় বাইরে থেকে তালা ঝোলানো। বিশাল ঘরে বাতির ব্যবস্থা নেই। যেটুকু আলো আসে ভেন্টিলেটর দিয়ে। ঘরে কয়েকটা ভূগ্রস্ত মেয়ে কম্বল গায়ে নড়াচড়া করে। তাদের আলাদা কোনো চেহারা নেই, পরিচয় নেই, নাম নেই।

‘ধরো আমার নাম অনুরাধা সরকার’–দেয়ালে আড়ি-পাতা মেয়েটি একদিন মরিয়মকে ফিসফিস করে বলে। মরিয়ম তার চোখ দুটি কাছ থেকে দেখে অবাক হয়। মাইনাস ফাইভ চশমার পরকলার অভাবে তার যে মাছের মতো ঘোলা চোখ-কথাটা বলে মরিয়মের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে অনুরাধা সরকার। তাকে তখন আরো অদ্ভুত দেখায়। পাকসেনারা বিএম কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রীটিকে বইয়ের জগৎ থেকে উপড়ে এনে ফেলেছিল চার দেয়ালের মাঝখানে। প্রথম দিনের ধস্তাধস্তির ফলে। চশমাটা ভেঙে যায়। থাকলে কী হতো? এখানে তো এর কোনো কার্যকারিতাই নেই। তবে কাগজ-কলম বরাদ্দ থাকলে, অনুরাধা তাকে বলে, সে আনা ফ্রাংকের মতো। বন্দিজীবনের ডায়েরি লিখত।

যেদিন হলঘরের সর্বকনিষ্ঠ মেয়েটিকে দরজার বাইরে গুলি করে হত্যা করে মিলিটারিরা, অনুরাধা দেয়ালের কিনার থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে মরিয়মকে। সঁতসেঁতে দেয়াল। গত কদিন ধরে মেয়েটির কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ছিল। যক্ষ্মা হয়েছিল বোধ হয়। তা বলে গুলি করে মেরে ফেলবে! হলঘরের মেয়েরা যখন নড়াচড়া করতেও ভয় পাচ্ছিল, দেয়ালে আড়িপাতার খেলা শুরু হয়ে যায় অনুরাধার। তারপর শুরু হবে অদৃশ্য খাতার পাতায় ডায়েরি লেখা। মরিয়ম এগিয়ে যেতে অনুরাধা। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘দেয়ালে কান পাতো, মেরি। কি, শুনতে পাচ্ছ কিছু?’ মরিয়ম মাথা। নাড়ে। ‘শক্ত করে চেপে ধরো। পাবা। আরেক হাত রাখো ওই কানটায়। কী শুনতেছ?’ মরিয়ম ঠোঁটে তর্জনী চেপে তাকে চুপ থাকতে বলে। অনেকক্ষণ পর শোনে, রিমঝিম বৃষ্টির সুরেলা আওয়াজ। সে হয়তো অসম্ভব কিছু শোনার প্রত্যাশা করেছিল, তাই মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘এহ বৃষ্টি!’

‘হ্যাঁ বৃষ্টি।’ অনুরাধার চোখের কোণ দুটি সরু, কপালে গভীর কুঞ্চন। মরিয়ম কান খাড়া করে। অদৃশ্য খাতার পাতায় অনুরাধা কলম ছাড়া ডায়েরি লেখে-বর্ষাকাল এসে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিল, সৈন্যরা জল-কাদায় নড়তে-চড়তে পারবে না। বৃষ্টির ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকবে। তাদের অনুমান ভুল। সর্বাংশেই ভুল। স্পিডবোটে চড়ে সৈন্যরা এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে গাঁয়ের মেয়েতে হলঘরটা ভরে উঠবে। এখন আমরা যদি হই পাঁচ, মাস শেষে দশ হব।

সত্যি সত্যি তা-ই হয়েছিল। নতুন মেয়েগুলোর একজনের নাম ছিল শোভা রানী। ঘোর বর্ষায় বাড়ির পেছনের জঙ্গলে সে ধরা পড়ে। শোভা রানীর বিয়ে হয়েছে। ছয় মাসও হয়নি। এর মধ্যে সে স্বামী হারিয়েছে। সুযোগ পেলেই গড়গড়িয়ে নিজের অত্যাচারের কাহিনি বলত আর হাপুস নয়নে কাঁদত। সেদিন জঙ্গল থেকে ধরে এনে। বাড়ির আঙিনায় দুজন সৈন্য তাকে ধর্ষণ করে। ঘটনাস্থলের অদূরেই ছিল কুমড়োর মাচা। যা শোভা রানীর স্বামীর পারিবারিক সম্পত্তি। যুদ্ধ শুরুর আগে সে মাটি কুপিয়ে নিজহাতে বীজ বুনেছিল। আর্মির ভয়ে পালিয়ে বেড়ানোর সময়ও গাছের গোড়ার আগাছা সাফ করেছে, পুকুর থেকে কলসি ভরে পানি এনে ঢেলেছে। স্বামী বিমল দাসকে সঙ্গে নিয়ে একটা একটা করে লকলকে ডগা সযত্নে তুলে দিয়েছে কাঁচা বাঁশের মাচায়। কুমড়ো-লতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল। অজস্র হলদে ফুল ফুটিয়ে ফল। ফলাল। তখন চোর নেই চুরি করার। নিজেরা যে কুমড়ো পেড়ে স্বস্তিতে রান্না করে। একবেলা সবাই মিলে খাবে, সেই সুযোগও মিলিটারি আর রাজাকাররা তাদের দেয়নি। অথচ সেদিন একজন সৈন্য মাচার বড় কুমড়োটার বোঁটা ছিঁড়ে তাকে ধর্ষণের পারিশ্রমিক দিতে চায়। শোভা রানী ঘেন্নায় নেয় না। শাস্তিস্বরূপ উঠানের ঘাস-কাদায়। মাখামাখি তার রক্তাক্ত শরীরটা ক্যাম্পে চালান করে। এর আগে স্বামীকে গুলি করে মারে সেই মাচাটার নিচে। শোভা রানীর বৃদ্ধা শাশুড়ি সুরবালা তখন মুখ-বাঁধা অবস্থায় গলাকাটা মুরগির মতো দাওয়ার ওপর দাপাদাপি করছিলেন।

আস্তে আস্তে দিনগুলো আরো কঠিন হচ্ছে। গণধর্ষণের ফলে জবা নামের হাসিখুশি মেয়েটি সবার চোখের সামনেই মারা গেল। শেষ সৈন্যটি শরীরে থাকতেই ওর দম বেরিয়ে যায়। দিন গিয়ে রাত নামে, ডেডবডি সরাতে কেউ আসে না। কম্বলের নিচে পচে উঠছে তাদের রাতদিনের সঙ্গী, ফুলের মতো মেয়ে জবার শরীর। এরকম সময় অনুরাধা অদৃশ্য খাতার পাতায় ডায়েরি লিখছে–হানাদারদের সামনে দৃশ্যত এখন কোনো শত্রু নেই। যারা আছে, তারা পাটখেতের আড়াল থেকে রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়, পাকা সড়কে বা জলপথে অ্যামবুশ রচনা করে। অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে সৈন্যরা তাই কাণ্ডজ্ঞানরহিত, দিশাহারা। এভাবে ভয় পেতে পেতে মনোবল হারিয়ে ফেললে তাদের দিয়ে আর যুদ্ধ হবে না। বাড়ির কথা মনে পড়বে–গলফ ক্লাব, টেনিস বল, ঘি আর টেংরি কাবাবের সেই সুখী, নিরাপদ, ভোগবিলাসের জীবন। কর্তারা তাই লাগাম খুলে দিয়েছেন–যে যত পারো খুন-ধর্ষণ লুণ্ঠন করো। এ কাজগুলো হচ্ছে ফুয়েল-পেট্রোলের মতো, যা যুদ্ধ চালু রাখে, এর গতি বাড়ায়। কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে…অনুরাধা কথার মাঝখানে খেই হারিয়ে ফেলে। আচমকা বর্তমান সময়টা ছুটতে ছুটতে আটকে যায় ধূসর অ্যালবামের পাতায়। যেখানে কতগুলো সাদা-কালো ছবি, যা ভবিষ্যতের মানুষ পাতা উল্টিয়ে দেখছে, বিশেষত আজকের মতো কোনো এক বৃষ্টির দিনে।

যুদ্ধের পর এই ঘরগুলোতে একদল অনুসন্ধানকারী হয়তো তল্লাশি চালাবে। কিন্তু লুঙ্গি-গেঞ্জির ছেঁড়া টুকরা, হাড়গোড় এসব দেখে প্রথম বুঝতে পারবে না বন্দিরা নারী, পুরুষ ছিল। নিজের জট পাকানো চুল মুখের কাছে টেনে এনে অনুরাধার সেদিনের ভবিষ্যদ্বাণী–‘এই চুল তখন সাক্ষী দেবে।’

হয়েছিলও তাই। ভূগর্ভস্থ বাংকার আর ব্যারাকগুলোতে স্বাধীনতার পর রাশি রাশি লম্বা চুল আবিষ্কৃত হয়। মাদার তেরেসা ঢাকা সেনানিবাসে পৌঁছে গিয়েছিলেন ডিসেম্বর কি জানুয়ারিতে। তার মাথায় ছিল ভ্রুণহত্যার খ্রিষ্টীয় পাপ আর অনাগত শিশুদের দত্তক বানিয়ে বিদেশে পাঠানোর পাঁয়তারা। সেখানে মাদার কোনো মেয়ে দেখতে পাননি। গোছা গোছা লম্বা চুল, ঘেঁড়া পেটিকোট আর কিছু টুকিটাকি আবর্জনা দেখে সেইবার তাকে কলকাতায় ফিরে যেতে হয়েছিল।

অনুরাধা আরেক দিন আড়িপাতা বাদ দিয়ে মরিয়মকে উদ্ভট একটা প্রস্তাব দেয়, ‘চলো দেয়ালের গন্ধ শুকি। কানের বদলে নাক! কেন? মরিয়ম বেঁকে বসে। তখন ঘরের আরেক প্রান্ত থেকে ছুটে আসে শোভা রানী। অনাহারক্লিষ্ট দুর্বল শরীর, ঘন ঘন দম নেয়-হাঁপায়। দেয়ালে নাক ঘষে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে, ‘অ্যাঁ রাম, কুমড়োর গন্ধ!’ শোভা রানী তখন গর্ভবতী। বলেই চাক চাক কুমড়ার টুকরা হড়হড় করে বমি করে দেয়। যদিও গত এক মাসের মেন্যুতে এক দিনও মিষ্টি কুমড়োর ঘাট ছিল না। শোভা রানীর পর মরিয়মের পালা। সে দেয়ালের ঘ্রাণ শোঁকে–ভেজা ইট-সিমেন্টের বালি বালি গন্ধ। ‘নাকটা চেপে ধরো!’ অনুরাধা উচ্ছ্বসিত, ‘কি, পাচ্ছ তো? আহা ধোঁয়া ধোঁয়া শিশিরের গায়ে জড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলের মিষ্টি সৌরভ!’ বমির ওপর থেকে। শোভা রানী ক্লান্ত স্বরে বিড়বিড় করে, ‘মা দুর্গা কৈলাস ছেড়ে অচিরেই আসছেন।’ ইন্দিরা গান্ধীর চেহারাটা তার মনে আসে না।

শরৎ এসে গেছে, তারপর হেমন্ত। তাদের আর কতকাল এভাবে বাঁচতে হবে? অনুরাধা বলে, ‘মনোবল হারালে সৈন্যরা যেমন যুদ্ধ করতে পারে না, আমরাও তেমন বাঁচতে পারব না।’

মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুক্তির দিকে তাকায়। যার এত বাঁচার শখ ছিল, সে আজ বেঁচে আছে না মারা গেছে? কত আশা ছিল মেয়েটার! ভবিষ্যৎ নিয়ে কত কথা! মুক্তি নড়েচড়ে বসে। তখন সময়টাই ছিল অন্যরকম। সে এক আশাবাদের যুগ-জটিলতাবর্জিত আর একরৈখিক। যেমন এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা, এক স্লোগান। জয়বাংলা স্লোগান দেওয়ার বিনিময়ে মানুষ মরতে প্রস্তুত ছিল। তারা বিশ্বাস করত, রক্ত দিয়ে যে-কোনো অর্জনই সম্ভব। রক্তের আরাধনায় গীতিকার-গায়কেরাও মেতে ওঠেন–রক্তে যদি ফোটে জীবনের ফুল/ ফুটুক না ফুটুক না ফুটুক না। সেই বেহিসেবি আশাবাদের কালে অনুরাধার অমরত্বে বিশ্বাস ছিল।

অনুরাধা চেয়েছিল, কীভাবে তারা নির্যাতিত হলো, কারা তাদের নির্যাতন করল, কেন নির্যাতন করল–ভবিষ্যতের মানুষ সেসব জানুক, তাদের কথা মনে রাখুক। মুক্তিদের গবেষণার প্রকল্পে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের একটি সম্ভাব্য ছক, যা অনুরাধার মাথায় ছিল না। কারণ সময়টা ছিল ১৯৭১। মেয়েদের পক্ষ থেকে বিচারের দাবি উঠতে আরো দু’দশক লেগে যায় এবং তা বিস্তার লাভ করে পৃথিবীর আরেক ভূখণ্ডে। সেখানকার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পঁয়তাল্লিশ বছর পরে। অভিযোগকারীরা কমফোর্ট উইমেন, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জোরপূর্বক সৈন্যদের যৌনসেবায় নিয়োজিত ছিল। যুদ্ধশেষে এ মেয়েরা যেন দুর্গন্ধময় পচা মাছ-সমাজ-পরিবারে জায়গা পায়নি। সে আরেক কাহিনি–পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তের, সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের, ঈশ্বরের প্রতিভূ সূর্যবংশীয় সম্রাট হিরোহিতোর আর তার সাম্রাজ্য বিস্তারের।

সম্রাট হিরোহিতোর যুদ্ধ ১৯৩২-এ মাঞ্চুরিয়ায় শুরু হয়ে, শেষ হয় ১৩ বছর পর ১৯৪৫ সালে বার্মায়, বর্তমান মিয়ানমারে। জাপানি সৈন্যরা নিয়তির মতো গোটা পথ বয়ে নিয়ে বেড়ায় কমফোর্ট স্টেশনসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বন্দি নারীদের। তারা তাদের বেঁধে-বেড়ে খাওয়ায়, নোংরা কাপড় কেচে দেয়, স্ত্রী বা গেইশাদের মতো যৌনসুখ বিলায়। বিনিময়ে রাজকীয় সেনারা সেসব মেয়েদের যৌনাঙ্গে তলোয়ার চালায়, স্তন কেটে নেয়, স্তন থেকে দাঁত দিয়ে বোঁটা উপড়ে ফেলে, গর্ভপাত করায়, শরীরে গনোরিয়া-সিফিলিসের জীবাণু ছড়ায়, গুলি করে, সাবমেরিনে তুলে গভীর সমুদ্রে ডুবিয়ে মারে। ’৪৫-এর আগস্ট মাসে তিন দিন আগে-পরে বোমা পড়ে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে। সম্রাট হিরোহিতো যুদ্ধে হেরে যান। ১৫ আগস্ট অনুগত সুনাগরিকদের উদ্দেশে রেডিওতে ভাষণ দেন তিনি, ‘আমি এখন থেকে আর ঈশ্বর নই, আমি মানুষ। মানুষ! জাপানিরা নাগাসাকি-হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে বলে নয়, যুদ্ধে হেরে গেছে বলে নয়, সেদিন গণকান্নায় ভেঙে পড়ে তাদের এত কালের আরাধ্য। ঈশ্বরকে হারিয়ে। সেই ঈশ্বর ’৯১ সাল থেকে ক্রমাগত আসামির কাঠগড়ায়। কমফোর্ট নারীরা তাকে রাজকীয় কবর থেকে তুলে এনেছে। মানুষরূপী ঈশ্বর ধর্ষণের হোতা, কমফোর্ট স্টেশনের প্রতিষ্ঠাতা। উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ-জেনারেলসহ তার বিচার হোক, সে ক্ষমা চাক, ক্ষতিপূরণ দিক। ’৩২ থেকে ৪৫-এর নির্যাতনের জন্য তো বটেই, যুদ্ধ পরবর্তী নারীর আমৃত্যু ক্ষয়ক্ষতির মাসুলও তাকে গুনতে হবে।

মুক্তির মুখে যুদ্ধাপরাধের বিচারের গল্প শুনতে শুনতে বহু বছর পর মরিয়মের মনে পড়ে একজন মেয়ের কথা, যার নাম শ্যামলী-শ্যামলী রহমান। মুক্তিযুদ্ধের পর শ্যামলী রহমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের অপেক্ষা করেনি, নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছিল। অথচ সে ছিল মরিয়মের জানামতে একমাত্র নারী, যুদ্ধাবস্থায় হলঘর থেকে জীবিত ছাড়া পাওয়ার সৌভাগ্য যার হয়েছে। এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি টাল খায় অনুরাধা। অমরত্বের ঊর্ধ্বলোক থেকে সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে। আর তখন থেকেই ভাবতে শুরু করে, সব যুদ্ধই একদিন শেষ হয়, এই যুদ্ধও হবে। কিন্তু তারা পূর্বপরিচয়ে আগের ঠিকানায় ফিরে যেতে পারবে না, তাদের জায়গা হবে দেশ বিদেশের বেশ্যালয়ে।

যুদ্ধের কয়েক বছর পর শ্যামলীর সঙ্গে মরিয়মের ফের দেখা পাকিস্তান। দূতাবাসের সামনে। সে মরচে ধরা কিচেন নাইফ কোমরে গুঁজে দিনেদুপুরে ঘুরঘুর করছে। পায়ে পোয়াতির মতো পানি নেমে গেছে, পরনে ময়লা শাড়ি, চুল মাথার ওপর উঁই করে বাঁধা, মুখে মদের গন্ধ। মরিয়মকে দেখামাত্র হাত ধরে টানতে টানতে রাস্তার ওপাশে নিয়ে শাড়ির কুঁচি সরিয়ে সে ছুরিটা দেখায়–যা দিয়ে মানুষ খুন করবে।

কাকে?

পাকিস্তানি আর্মি অফিসার শাহাদতকে, কারণ প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও লোকটা শ্যামলীকে বিয়ে করেনি। মাঝখান থেকে তার ছোট ছেলে বুলু মারা যায়, বিনা চিকিৎসায়, অবহেলায়।

কত কথা ডুবে ডুবে রয়েছে, কত শত নির্যাতন! বলতে চাইলেও পুরোটা মুখ ফুটে বলা যায় না। বা কথা তো গাছের পাতা, একবার খসে পড়লে ডালে ফেরত যাবে। কেঁচো খুঁড়তে হয়তো সাপ বেরিয়ে পড়বে। ‘কিন্তু’ মুক্তি তাকে জিগ্যেস করে, ‘যদি এমন হয় যে আপনারা সে সময়ের কয়েকজন একসঙ্গে বসলেন, বাইরের কেউ আশপাশে থাকল না, তখন কি বলা সম্ভব?’

সম্ভব কি না মরিয়ম জানে না। তবে মুক্তির কথা শুনে তার মুখে হাসি ফোটে। অনুরাধা নিজের কানে এ উদ্ভট প্রস্তাবটা শুনলে বইয়ের ভাষায় নাম দিত–নির্যাতিতের কনফারেন্স।

১০. নির্যাতিতের কনফারেন্স

শ্যামলী রহমান, যে মদ খেতে খেতে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে মারা যাবে, সে বলে, ‘পাক-আর্মি আমারে ধরেছে ওষুধের দোকান থেকে, ভুলবশত। কারণ আমি অফিস করে দোকানে গেছিলাম ওষুধ কিনতে। আমার ছোট ছেলেটার অসুখ।’

‘ছেলের অসুখ তো বুঝলাম। কিন্তু মেয়েরা অফিস করত নাকি যুদ্ধের বছর?’

যুদ্ধের দিনে শ্যামলী অফিস করেছে। তার অফিসের নাম মুন জুট মিল। বস পাঞ্জাবি। সে নিজে একজন বাঙালি টেলিফোন অপারেটর। পাকড়াও হওয়ার দিনও শ্যামলী অফিসে গেছে। তবে অফিস ছুটির এক ঘণ্টা আগে ফোনে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তাকে যেতে হবে রেললাইন পেরিয়ে শহরের বাইরে গ্রামমতো এক নিরিবিলি জায়গায়, নাম তালতলা। সেখানে শ্যামলীর বিধবা মায়ের তত্ত্বাবধানে তার ছেলে দুটিকে রেখেছে। ছোট ছেলে বুলুর অসুখ। মিলের গেটে বিহারি দারোয়ান হাতের তালুতে খৈনি পিষছিল। মুখ না তুলেই সে জানতে চায়, কাহা যারাহাহে, দিদি?’

‘হাম? হাম দাওয়াই লেকে।’

সেদিন শহরের অবস্থা খুব খারাপ। এলোপাতাড়ি ধরপাকড় চলছে। শান্তি কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতা দিনদুপুরে খুন হয়েছেন। হত্যাকারীর দলে শাড়িপরা একটি মেয়েও ছিল। কিন্তু ছেলের জন্য শ্যামলীর ওষুধ না কিনলেই নয়। সে দোকানে ঢুকে ব্যাগ থেকে প্রেসক্রিপশন বের করেছে, বিহারি কম্পাউন্ডার তা দেখার সুযোগও পায়নি, তখন এক দল আর্মি হুড়মুড়িয়ে ঢোকে। ছেলের জন্য সে ওষুধ কিনবেই আর আর্মিরা তাকে কিনতে দেবে না। এ সময় কিঞ্চিৎ সওয়াল-জওয়াবও হয়। যেমন কোথায় সে চাকরি করে, কোন আর্মি অফিসার তার চেনা, কে তার বন্ধু। এসব বলার পর পিস্তলের নল পিঠে ঠেকে গেলে, সে শুধু প্রেসক্রিপশনের উল্টো পিঠে দু’কলম লিখে কম্পাউন্ডারের হাতে চালান দেওয়ার ফুসরতটুকু পায়। এরপর মিলিটারিরা তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে জিপে তোলে।

যোগেন বাইন্যার মেয়ে বিন্দুবালা, যে মরিয়মের সঙ্গে একই দিনে নতুনগাঁও থেকে ধরা পড়ে, ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধা নজর আলী শাদি করার ফলে যার নতুন নাম হয় লাইলি বেগম, সে বলে, রাস্তা থিক্যা আমাগো বাড়ি হইছে আধা মাইল পথ। গিরামের বাড়ি তো–ঝোঁপজঙ্গল। গাছগাছালির ভিতর দে খালি ধোঁয়া দেখা যায়। আগুন, আগুন। গুলির আওয়াজ পাতিছি আর মানুষ সব পালাচ্ছে। বাবা মাকে বলে, তুমি বাচ্চা কয়ডা নিয়া অমুকখানে চলে যাও। আমি থাকি। মা কয়, তোমারে একা বাড়ি থুয়ে আমি যাব না। তো সবাই মিলে যাচ্ছি। আমরা খুব গরিব ছিলাম। এটুখানি যেয়ে মা কয়, বিন্দু গামলার ভাত চারটা এক দৌড়ে নে আয় তো, মা। ভাত খাতি না পেলে ছাওয়াল-পাওয়াল বাঁচপে না। বিন্দুবালা আগুনের ভেতর দিয়ে সার্কাসের মেয়ের মতো দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি ফেরে। ভাতের গামলায় ডাল ঢালার সময়টুকু সে শুধু পায়। গামলা তুলে দৌড় দেওয়ার আগে পেছন থেকে একজন মিলিটারি তাকে জাপটে ধরে।

‘আপনে জোরাজুরি করেন নাই ওদের সঙ্গে?’

বিন্দুবালার মাথায় ছিল লম্বা বেণি। আগের রাতে চুলে তেল মেখে বুড়ি ঠাকুরমা শক্ত দড়ির মতো বিনুনি পাকিয়ে দিয়েছিলেন। তার লম্বা বেণিটা খপ করে ধরে মিলিটারি আর সে ধরে ঘরের খুঁটি। বিন্দুবালা বলে, ‘অগো সাথে পারা যায় না তো! এই খুঁটি ভাইঙা আমারে চিত করে ফালাই দিয়া ছেচড়াতে ছেচড়াতে নিয়া আসে। রাস্তায় রাইফেল কাঁধে করে রাজাকাররা আগে আগে হাঁটে, মেলেটারি হাঁটে অগো পিছন পিছন। আমি মধ্যিখানে।’

‘আপনার পরনে কী ছিল তখন?’

‘খয়েরি রঙের একটা ছাপা শাড়ি ছিল। এই কাপড়ের আঁচলডা এক্কেরে টানের চোটে দুই ভাগ হইয়ে গেছিল, ফাইরা হালোই ছিল কাপড়। বেলাউজ ছিল না শইলে। পেটিকোট ছিল না, না ছিল–এত বছর আগের কথা, আমি ঠিক বলতে পারি না।’

মুক্তিযোদ্ধা পারুল, যার নাম স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে এক সরকারের আমলে লেখা হয়ে পরের সরকারের সময় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে বাদ পড়ে যাবে, সে বলে, ‘আমি ধরা পড়িছি সম্মুখসমরে। ওইটা শুক্কুরবার দিনগত রাইত। অস্ত্রসহ আমরা ধরা পড়িলাম। তখন পালাব কী কইরে? আর কোথায় পালাব? বর্ষার পানিতে খাল-বিল, খেত-খামার টুপু টুপু কচ্চে। আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।’

‘আপনে যে একজন মুক্তিযোদ্ধা, হের প্রমাণ কী? বন্দুক চালাতি পারেন?’

‘হে পারি। পারি–দ্যাকপেন? আমরা ইভাবে সিনা টান টান করি থিরি নট থিরি রাইফেল ধরিতাম। চেম্বারে গুলি উঠোইয়ে যখন ফায়ার করতি হবে, তখন হাতের বাজুতে ঠেকিয়ে নিরিখ করে গুলি মাইরতে হবে। বাম হাত থাইকপে রাইফেলের মধ্যিখানে আর ডান হাত থাইকবে চাবির গোড়ায়।’

আর্মি ক্যাম্পে ধরে আনার পর একজন রাজাকার পারুলের হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে বলেছিল–এই অস্ত্র ছাড়। তুই কী রকম আমাগের সাথে যুদ্ধ করেছিস দ্যাকা দিকি! দ্যাকা কীরকমভাবে ফায়ার করতি অয়।

‘তো আপনে গুলি করলেন?’

‘হে করিলাম। করার পর রাজাকার বুইল্লো–ওরেবাহ্ এ তো কিছু থোবে না নে। শ্যাষ করে দেবে। আমাগের গুষ্টি-গেরাত সব মাইরে ফেলাবে।’

শ্যামলী বলে, ‘কিন্তু কেউ ভারত যাচ্ছে কি না বা সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে কি না বা মুক্তিবাহিনী তৈরি হচ্ছে কি না–আমি জানি না। আমি নিজের যুদ্ধ নিয়াই ব্যস্ত।’ কেননা তখন সবে স্বামীর সঙ্গে শ্যামলীর ছাড়াছাড়ি হয়েছে, ছেলে দুটি থাকে এক জায়গায়, সে নিজে আরেক জায়গায়। এ রকম খারাপ সময়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। শ্যামলীর এলাকায় যুদ্ধের আগে থেকেই গন্ডগোল। বাঙালি-বিহারি লাগাতার দাঙ্গা। আজ এ ওরে মারে তো কাল ওরে এ মারে। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, মিল ধর্মঘট কখনো বন্ধ হয় না। অসহযোগের সময় কয়েক দফা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়ে গেল বিহারি-বাঙালিতে। সর্বত্র লাশ। রক্তে পথঘাট পিছল। নদীতে নৌকো চলে না। লাশে লগি আটকে যায়। ফলে ২৫ মার্চের পর আর্মির তাড়া খেয়ে সেই এলাকার বাঙালিদের পালাতে দেরি হয়েছিল।

ব্যারিকেড ভেঙে মিলিটারিরা যেদিন শহরে ঢোকে, শ্যামলী লাশের ওপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। আশপাশের আর যারা পালাচ্ছে, সবারই পরিবার আছে, ওর ছাড়া। দশ-বারো জন উদ্বাস্তুর সঙ্গে সে এক পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শ্যামলী তখন পুরোদমে নিঃস্ব। চাকরি নেই, টাকা নেই, স্বামী নেই, সন্তান নেই। পথের ভিখিরির অবস্থা তার। তবু সে এপ্রিল মাসটা সেই বাড়ির আশ্রিত পুরুষদের ভজিয়ে ভাজিয়ে থাকবার চেষ্টা করে। তাতে করে মেয়েরা তার বিরুদ্ধে চলে যায়।

স্বর্গধামের অনুরূপ অবস্থা–মরিয়মের মনে পড়ে।

মুক্তিযোদ্ধা পারুল বলে, আমার অবস্থাটা ভেন্ন। ভাগ ভাগ হয়ি ভাইগের সাথ আমরা থাইকতাম। রাতে কোনো দিন কেউ এক জায়গায় থাকতে পারিনি। যত দিন ধরা না পড়িছি, তত দিন জানে-মানে কোনো সময় নিরাপদ থাকিনি। কেননা কখন কোন বিপদ আসপে, কখন কার হাতে ধরা পড়ব, কে আমাদের ক্ষতি করবে, এই একটা চিন্তাভাবনায় সব সোমায় অস্থির হয়ে থাকতাম। আমরা পানির ভিতর কত দিন কাটাইছি! আমাদের রাইতও কাটছে পানির ভিতর। তখন তো ভাদ্র মাস।

‘এই যে মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে থাকতেন কোনো অসুবিধা হয়নি?’

‘না, তখন এরকম কিছু হয়টয়নি। ছেলেতে-মেয়েতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে যাচ্ছি। সমস্যা হয়েছে যুইদ্ধের পর, যখন সহযোদ্ধা শরাফত মিথ্যা কথা বুইলে পতিতালয় বিক্কিরি করতি নিয়ে গেল আমারে।’

‘কী সাজ্জাতিক অপমান!’ শ্যামলী ঝরঝরিয়ে কাঁদে। ওই বাড়ির লোকগুলো তাকে খেতে দিচ্ছে না, তার শোওয়ার বিছানাটাও মেঝে থেকে তুলে নিয়েছে। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু সে বলে, আমি বাঁচতে ভালোবাসি। এ অবস্থায় অতীত জীবনটা ফিরে পাওয়া একান্ত জরুরি। যেখানে একটা চাকরি আছে। মাসের শেষে মাইনে পাওয়া যায়। তা-ই দিয়ে নিজের হাতে সে বাজার করতে পারে। মিষ্টি আর খেলনা কিনে দিলে ছেলে দুটিও খুশি হয়। হাতে টাকা থাকলে তোকজন আড়ালে যা-ই বলুক, সামনে কিছু বলার সাহস পায় না।

শ্যামলীর নামেই অফিস। যুদ্ধের সময় আসল অফিস শুরু হয় বিকাল পাঁচটার পর। একেক দিন একেক আর্মি অফিসার গাড়ি হাঁকিয়ে আসে। বস সিডিউল করে দেন। আজ নৌবাহিনীর উইং কমান্ডার, কাল সার্কিট হাউস থেকে আসবে মেজর, পড়শু দিন মার্শাল ল কোর্টের কর্নেল–এইভাবে। তবে শেষ সময়েও সিডিউল রদবদল হতে পারে। যদি উইং কমান্ডার পর পর দুদিনই চান, সে ক্ষেত্রে মেজরের নাম কলমের খোঁচায় বাদ পড়ে যায়। জীবনের চেহারা ক্রমে পাল্টে যাচ্ছিল। আলিশান গাড়ি ড্রাইভ করে একেক দিন একেক অফিসার আসে–যেদিন যার পালা। জলের ভেতর যেন সাঁতারু মাছ, শহরের বিপণির সামনে দিয়ে গাড়ির আরোহীরা তেমনি নির্বিঘ্নে চলাচল করে। সুন্দর সুন্দর সিল্ক শাড়ি, পারফিউম, লিপস্টিক, ঘড়ি-গাড়ির জানালা দিয়ে চলে আসে। নেমে দোকান পর্যন্তও যেতে হয় না। দাম পরিশোধেরও বালাই নেই।

বিন্দুবালা বলে, ‘মিলিটারিরা ওই যে গেরামেরতে কেউর খাসি ধরে নিয়াসতো, কেউর মুরগি, গরু ধরে নিয়াসততা, দোকান লুটপাট করে চাউল, ডাইল, ত্যাল আনতো, রাজাকাররা ডাকবাংলায় বসে ওই তা রান্না করত।’

‘আপনেরে দিত খেতে?’

‘একবেলা চাইরডা ভাত দিত।’

‘ভাতের সঙ্গে?’

‘ওই যে রাজাকাররা মিলিটারিরা মুরগি ধরত, মুরগির ঠ্যাং-সিনা…’

‘পানিটানি দিত?’

‘পানির কথা বুল্লে ডাবের খোলায় করে পস্রাব আনি দিত আর পস্রাব করব বুলে পানিভইর‍্যা ডাবের খোলা আনতো।’

‘কাপড়-চোপড় কিছু দিছিল?’

‘না, আমি হেইকালে একদম বেবস্ত্র।’ বিন্দুবালা ঠোঁট চেপে কান্না রোধ করে, ‘এহনও রাইতে রাইতে স্বপ্ন দেহি, খাল-বিল ভাইঙা ওরা আসতিছে…’

সরকার বাড়ির কাজের মেয়ে টুকি, যে মরিয়মের সঙ্গে নতুনগাঁও থেকে একই দিনে ধরা পড়ে, যুদ্ধের বিশ বছর পর যে গার্মেন্টসের চাকরি ছেড়ে মরিয়মদের রায়েরবাজারের বাসায় মুরগি পুষতে শুরু করে, সে বলে, ‘আফা, এমনি আমার স্মৃতিশক্তি কম। মিলিটারির অইত্যাচারে অইত্যাচারে আরো কমে গেছে। এরা যে আমারে কই নিয়া রাইখলো, কী কইরলো–স্মরণে আসে না। তখন আঠারো বচ্ছর বয়স আমার। ওই বয়সে বাচ্চা হতিই পারে একজন মেয়েছেলের। সিখানে তাই আমার একটা বাচ্চা হয়্যেছিল।’ টুকির বাচ্চাটা ছিল স্টিলবর্ন–মরা। সে মেঝে থেকে পাটের বস্তা তুলে তা-ই দিয়ে বাচ্চাটাকে পোটলা বানিয়ে ঘরের কোনে রেখে দেয় । সেদিন আবার দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে মিলিটারি। টুকি বলে, ‘দুইকেই ওরা টাচ করতি চাচ্ছে আমাকে। অত্যাচারের একটা ইস্কিম নিয়ে আমার দিকে আউগাচ্ছে।’ তখন সে তাড়াতাড়ি পোটলাটা তাদের দিকে ঠেলে দেয়। বাচ্চা নিয়ে সেই রাতের মতো তারা সরে পড়লেও ঘরটা অপরিষ্কার থেকে গেল। টুকির শরীরে দুর্গন্ধ। ‘ঘরটা যে পরিষ্কার করতি হবে–হাঁড়িকুড়ি, ঝাঁটা-বালতি, কাঁথা-কাপড় কিছুই তো নেই আমার,’ টুকি আফসোস করে বলে। ‘আমি কোনোরকমে মাথা গুঁজে সিখানে বসে থাকি। কোনোদিন দেলো চারটা খালাম, না দেলো না-খালাম। পাগলের মতো সেখানে বাস করি।’

শ্যামলীর অবস্থাটা ভিন্ন। বিনা পয়সায় শাড়ি, কসমেটিকস সওদা করে আর্মি অফিসার যখন তাকে নিয়ে গেস্টহাউসে আসে তখন তার চোখ বাঁধা থাকে না। মেয়েটিকে তাদের ভয় পাবার কারণ নেই। যুদ্ধের দিনে চাকরি করতে এসেছে। অভাবের সংসার। ডির্ভোসি। দেশের লোক ভালো চোখে দেখে না। চাকরি ছেড়ে চলে গেলে আহার-বাসস্থানের অভাবে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে। এভাবে মৃত্যুবরণ বোকামি। শ্যামলী মরতে চায় না। মনে-প্রাণেও যতটা সম্ভব উদার। তা বলে একেক দিন একেকজনের সাথে সেক্স করা অস্ত্রের মুখে–শ্যামলী ভয় আর উৎকণ্ঠায় শক্ত হয়ে থাকে। তখন কেউ বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বিছানায় নেয়। কেউ মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে শুরু করে। ‘হাউ ওল্ড আর ইউ–সিক্সটিন?’ এরা ফ্লার্ট করে। লুক অ্যাট ইউ–সাচ সেক্সি লিপস! কাম অন, প্লে উইথ মি। কারো ধারণা মেয়েটাকে হুইস্কি গেলাতে পারলে কাজটা সহজ আর আনন্দদায়ক হবে। দুটি গ্লাসে মদ ঢালা হয়। একটায় কম, আরেকটায় বেশি। বেশিটায় ঘনঘন ঢালতে লাগে। কারণ বউ-বাচ্চার কথা বলতে বলতে, ইয়াহিয়া-ভুট্টো-শেখ মুজিবকে গাল দিতে দিতে সুরা নেমে যায় গ্লাসের তলায়। শ্যামলীর সামনের গ্লাস যেমন ছিল তেমন। ড্রিংক, ড্রিংক! প্রথম জোর করে ঠোঁটের ফাঁকে গ্লাস ঠেলে। জোরজবরদস্তকারীর চোখ লাল, স্বর জড়ানো। তার পরও শ্যামলী আপত্তি জানালে গ্লাস উপুড় করে ঢেলে দেয় তার যৌনাঙ্গে। বিকট চিৎকার আর অট্টহাসির মাঝখানে কয়েকটা মিনিট অন্ধকার।

মরিয়মের সারা শরীর প্রবলভাবে কেঁপে ওঠে। লাল সোফায় বসে বসে ঢুলছিল যে আর্মি অফিসারটি, তার নাম মেজর ইশতিয়াক। সন্ধ্যা থেকে ড্রিংক করছে মেজর। মাঝরাতে হলরুমের তালা খুলে মরিয়মকে এনে ফেলে দিয়েছে পাড় মাতালটার পায়ের কাছে। এর আগে গাড়িতে অর্ডার তালিম করা সৈন্যটি একবার পেছন দিয়ে আরেকবার সামনে থেকে পরপর দু’বার তাকে ধর্ষণ করে। তৃতীয়বার উদ্যত যখন, গাড়িটা সার্কিট হাউসের কোর্টইয়ার্ডে ঢুকে যায়। মরিয়মের গা-ভৰ্তি ঘামেভেজা ময়লা কাদা, চুল জট-পাকানো। সে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সার্কিট হাউসের ডাইনিং রুম দুর্গন্ধে ভরে যায়। মেজরের ব্যাটম্যান গলদা চিংড়ির ডিশ টেবিলে নামিয়ে এক জমাদারনিকে ডেকে আনে। সে তাড়াতাড়ি মরিয়মকে বাথরুমে ঢোকায়। তবে গোসলের সময় দরজা বন্ধ করতে দেয় না। পরনের ছেঁড়া লুঙ্গি-জামা জমাদারনিই খুলে দেয়। এ অবস্থায় শাওয়ারের নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তোয়ালে জড়িয়ে মরিয়ম যখন বেরিয়ে আসে, ততক্ষণে ডিনার টেবিল সাজানো হয়ে গেছে। তাতে ঘিয়ে ভাজা লাল লাল গলদা চিংড়ি, মুরগির রোস্ট, পোলাও, জগভর্তি ফুটজুস। কত দিন পেট পুরে ভালো-মন্দ খায় না–মরিয়মের জিবে পানি চলে আসে। স্নান শেষে তাকে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু পাতে কেউ খাবার তুলে দিচ্ছে না। নিজেরও তোলার সুযোগ নেই। টেবিলের ওপর মূল্যবান ডিশগুলো হাউজির নম্বরের মতো ঘুরতে ঘুরতে যখন তার সামনে থামে, তখন খালি ডিশ, শূন্য জগ বা চিংড়ির ঠ্যাং। মেজর ইশতিয়াক হো হো করে মাতালের হাসি হাসে।

‘ডু ইউ স্মোক?’ তার মস্তবড় থাবার ভেতর ডানহিলের প্যাকেট। তবে তা টেবিলের ডিশগুলোর মতো অস্থির বা খালি নয়। মরিয়ম আঁতকে ওঠে। তার দিকে সিগারেট এগিয়ে না দিয়ে, পিস্তল ধরলে সে অপ্রস্তুত কম হতো হয়তো। যেন যুদ্ধ নয়, এ শান্তির সময় আর তার দিকে ডানহিলের প্যাকেট ভুলবশত এগিয়ে দিয়েছেন তার অফিস বস, চটজলদি মরিয়ম তাই ‘নো নো থ্যাংক ইউ স্যার,’ বলে তার অপারগতা জানায়। মেজর খুশি হয়। সিগারেটের প্যাকেট ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, ‘ডু ইউ নো ইংলিশ?’ জবাবের অপেক্ষা না করেই তার গা থেকে প্রথম তোয়ালে সরায়, তারপর পাঁজাকোলে করে নিয়ে যায় বেডরুমে। লোকটার অপ্রত্যাশিত আচরণে মরিয়ম মুগ্ধ না হয়ে ভয়ে কাঁপে। হাঁটু দুটি বাড়ি খেতে শুরু করে। জসিমুল হককে তার ভালো লেগেছিল ছেলেটি ইংরেজি জানত বলে। সেসব দূর অতীতের এক গাঁয়ের কথা, যেখানে ইংরেজিতে কেউ কথা বলতে পারত না। মেজর ফিসফিস করে বলছে, ‘আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ। আই হ্যাভ টু টক টু সামওয়ান। সাচ এ ব্লাডি ওয়ার, ইফ আই কান্ট, আই উইল ডাই।’ কথা বলতে বলতে তার চোখ পড়ে মেয়েটির হাঁটু জোড়ার ওপর, যা কিছুতেই বশ মানছিল না। হোয়াট হেপেন্ড? লোকটার উম্মা দেখে, গাড়িতে যা যা ঘটেছিল মরিয়ম সব খুলে বলে। তাতে মেজরের চেহারা পাল্টে গিয়ে এমন বিকট আকার ধারণ করে, যা মরিয়ম শুরু থেকে প্রত্যাশা করেছিল। শালা নূর খান, শালে শুয়ার কা বাচ্চা!’ নূর খানকে শাসাতে বোধ করি টেলিফোনের দিকে ছুটে যায় মেজর। ফোনে তাকে পাওয়া যায় না। ঘুরে তাকাতেই দেখে মরিয়ম খাটের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। ব্লাডি হোর! মেজর ছুটে এসে এমন জোরে গালে থাপ্পড় মারে, মরিয়মের অত্যাচার-অনাহার ক্লিষ্ট শরীরটা খোলা দরজা দিয়ে গাছের পাতার মতো উড়তে উড়তে বারান্দা পেরিয়ে রেলিংয়ের গায়ে আটকে যায়। রেলিংটা মাথা সমান উঁচু না হলে, পরদিন সার্কিট হাউসের চাতালে তার লাশ পড়ে থাকত।

পারুল বলে, ‘অনেকগুলি লাশ আমি নিজেই মাটি দিছি। অত্যাচার করে করে এদের মেরেই ফেলাইছে মিলিটারিরা। তারা রাইতের অন্ধকারে কোদাল-সাপোল এনে দিত। গর্ত খুঁইড়ে টানতে টানতে তিনজন, চাইরজন আইনে এর ভিতর পুঁইতেছি। ছোট ছোট মেয়ে সব, আমারই বয়সের, কিংবা আমার চেয়ে ছুটো। পুরা ক্যান্টনমেন্ট চইষে ফেলে দিতে অয়-তালি পর লাশ বেরোবে অনেক।’

‘আপনি যখন গর্ত খুঁড়তেন, আর্মি পাহারায় থাকত?’

‘হে, ওই পাশেই ঘুরঘুর কইরত। সিগারেট খাইত, গল্প-গুজব করত, হাসি তামশা করত। কেননা রাইতের বেলা তারা মদ-বিড়ি-সিগারেট খাইত।’

‘মদ খাইয়্যা আলি পর’ বিন্দুবালা বলে, ‘রাজাকাররা তাগো ঘরে দিয়া নিজেরা সইরে পড়ছে। আমরা চার-পাঁচজন মেয়েছেলে টিন দে কাঠ দে তোলা একটা ঘরে। এই ঘরেই অত্যাচার কইরত। সবার সামনে। কোনো আড়াল ছেল না, কোনো ভেদাভেদ ছেল না।’

‘কয়জন ঢুকত একসঙ্গে?’

‘একসঙ্গে চাইরজন-পাঁচজন কইরা ঢুকত। আর ভয় দিত যে, আমাগো কথামতো যদি না চলছ, তাইলে কইলাম মাইরা ফালাই দিমু নদীতে। ইসব কথা মনে পড়লে, ভয়েতে আমার কলজের রক্ত শুকোয় যায়।’

‘কথা বুঝতে পারতেন তাদের? আমি তো এক বর্ণও উর্দু বুঝতাম না।’

‘কী তারা বলত আমরা বুঝতে পারতাম না, আমরা খালি ভ্যাবলার মতো দাঁড়াই থাকতাম।’

স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে যে অ্যালকোহলিক হয়ে যাবে, মদ আর টাকার লোভে গুলশান এলাকায় সন্ধ্যার পর যে ঘুরঘুর করবে, বা টাকাও নয়, মাত্র কয়েক পেগ হুইস্কির বিনিময়ে যে সারা রাতের সঙ্গী হবে সাদা পুরুষদের, সে অর্থাৎ শ্যামলী রহমান বলে, ‘মেরেধরে এক ফোঁটা মদও অফিসাররা তখন আমারে খাওয়াইতে পারে নাই, তাই চিড়বিড়িয়ে মাথায় আগুন ধরে যাইত ওদের।’

মদ আর শরীর নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতে করতে মাঝরাত। যেসব আর্মি অফিসার মদ খাওয়ার পর জীবনের পরোয়া করত না, তারা গভীর রাতে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির দরজা পর্যন্ত শ্যামলীকে পৌঁছে দিত। বেশিরভাগ লোক কাজ শেষ হলে বিছানা ছেড়ে নড়তে নারাজ। শ্যামলীর কান্নাকাটিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের একজন শুয়ে শুয়ে একদিন ফোন করে, ‘হ্যাল্লো শওকত জঙ্গ, জলদি আযা ভাই। আই হ্যাভ অ্যা গেস্ট। শি নিডস আ লিফট ইয়ার!’ তাঁবেদার অবাঙালি ব্যবসায়ী পাঁচ মিনিটে গাড়ি নিয়ে হাজির। রাস্তায় শ্যামলীর সঙ্গে কথা হয় না। বাড়ির দরজায় নামিয়ে দেওয়ার সময় সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলে, ‘তোমাকে তো ভালো মেয়ে জানতাম। এ লাইনে কবে থেকে?’ শ্যামলী জানে, সে-ও তাকে কুপ্রস্তাব দেবে, তবে দুই দিন পর। ‘বুঝলে তো ইয়ে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে একদম…’ প্রস্তাব দেওয়ার ভাষাটা বেসামরিক পুরুষদের ছিল এরকম। ‘এখন এসব কথা মনে পড়লে’ শ্যামলী বলে, ‘মাথায় আগুন ধরে যায়।’

পরদিন বস অফিসরুম লক করে তার ভাগের ট্যাক্স আদায় করে। আপত্তি জানালে আগে আগে চেক কেটে টেবিলের ওপর রেখে দেয়। বলে, ‘ইউ আর নাথিং বাট এ হোর।’ প্রথম প্রথম শ্যামলীর টাকাটা ছুঁতে ঘেন্না হতো। পরে দেখেছে নিলেও যা, না নিলেও তা। এদিকে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন লুকিয়ে-চুরিয়ে টাকা চাইতে আসে। আড়ালে গিয়ে তারাই আবার কুৎসা রটায়। শ্যামলীর শরীরটা বারোয়ারি সম্পত্তি। তাই তার টাকায়ও হক আছে সবার। অফিসের ড্রাইভার-পিয়ন উঠতে বসতে গায়ে হাত দেয়, রাতে শোয়ার অফার করে।

কিন্তু শ্যামলী তো বন্দি ছিল না। সে অফিস থেকে পালাল না কেন?

শ্যামলী বলে, একজন আর্মি অফিসার যখন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে, সে পালাতে যাবে কেন। তাকে অচিরেই সে বিয়ে করবে। কনফারেন্স কক্ষে হাসির রোল পড়ে। শ্যামলী তো তখনো বন্দি। বন্দিদশায় বিয়েটা হতো কী প্রকারে?

বন্দি কারণ সেই ভুল-বোঝাবুঝি। তাকে ভুল করে ধরেছে পাকসেনারা। ক্যান্টনমেন্টে জেরা-নির্যাতন করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ওষুধের দোকানের বিহারি কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে অফিসারের হাতে চিরকুট পৌঁছাতে যত দিন লাগে, তত দিন তাকে বন্দি থাকতে হয়। তারপর আর্মি অফিসারটি শ্যামলীকে যে বিয়ে করবে, এ ব্যাপারে সে তখন একশ ভাগ নিশ্চিত। লোকটা শ্যামলীর মা খোদেজা বিবিকে আম্মি ডাকত আর বাচ্চা দুটিকে কোলে নিয়ে হাউ সুইট’ বলে গাল টিপে আদর করত। ছোট বাচ্চাটা তার গ্রেফতারের আগের সপ্তাহে হিসি করে অফিসারের ইউনিফর্ম ভিজিয়ে দেয়। শ্যামলী ভয়ে অস্থির। ‘এই এই বুলু, ছি বাবা, তুই যে আমার সর্বনাশ করলি!’ কিন্তু সর্বনাশ করেছে যে, তার সঙ্গে লোকটা তখন শিশুর মতো খিলখিলিয়ে হাসছে। কী নিষ্পাপ হাসি!

মুক্তিযোদ্ধা পারুলও তাতে সায় দেয়, ‘সবাই তো এক রকম ছেল না। আমারে যেদিন ধইরে নিয়ে আইসলো, আমার এ সমস্ত জাগায় বেয়নেট মারা ছিল তো, সমস্ত শরীর রক্তাক্ত। ওনার নাম ‘র’ দে শুরু। রউফ, আবদুর রউফ। একজন ডাকিলো তাই বুইঝলাম। তো উনি আমার গায়েটায়ে হাত বুলোয়ে দেখিলো জিনিসগুলি। তারপর উঠে গিয়ে একটা মলম কিনে আইনলো আমার জন্য। আর মালিশ দিতি দিতি অনেক কথা কইলো, যা লেখাপড়ার অভাবে আমি বুইঝতে পারিনি।’

‘গায়ের জোরে মিথ্যা বলব কেন?’ শ্যামলী আদালতের জবানবন্দির মতো হলফ করে বলে, ‘যা সত্য তা-ই বলব, সত্য বৈ মিথ্যা বলব না।’ অফিসারটা বিকালে এসে বলে, ‘ভালো লাগছে না। চলো একটু ঘুরেটুরে আসি। তারা গাড়িতে করে ঘোরাঘুরি করে। চলো কোথাও বসে একটুখানি চা খাই।’ শ্যামলী বলে, ‘চা না আমি কফি খাব। আল-এসলাম রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাওয়ার পর অফিসার বলে, ‘জায়গাটা নিরাপদ না, মুক্তিফৌজ অ্যাটাক করতে পারে। যাবে আমার গেস্টহাউসে? ‘চলো যাই।’ লোকটা হাসে, না যেতে চাইলে জোর করব না।’ ‘না-না চলো।’ শ্রোতারা তাজ্জব। তবে অভিসার অভিসারই। জোরজবরদস্তি ধর্ষণ তো করছে না। কিন্তু সব যুদ্ধই একদিন শেষ হয়, এই যুদ্ধও শেষ হবে। শ্যামলী তখন কী করবে?

‘যুইদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই,’ বিন্দুবালা আঙুলের কড়া গুনে বলে, এই ধরেন আষাঢ় মাসে আমারে ধইরে নেছে, শাওন-ভাদর-আশ্বিন, তিন মাস পর কার্তিক মাসে মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আমাগের মুক্ত কইরলো। তখন তো বিন্দুবালাদের গায়ে কোনো পোশাকই ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা আশপাশের বাড়ি থেকে কাপড় এনে তাদের পরতে দেয়। ওখান থেকে বন্দি মেয়েরা চলে যায় যার যার বাড়ি। কিন্তু বিন্দুবালা যাবে কোথায়। যোগেন বাইন্যা তার পরিবার নিয়ে চলে গেছেন ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে। ভারতে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ডেইলি যাওয়া-আসা, আদান-প্রদান, যোগাযোগ। তারা বলল, ‘চলো বিন্দু, তোমারে আমরা ভারত দিয়ে আসি।’ বিন্দুবালা বেঁকে বসে, আর যেখানেই যেতে বলুক যাবে, ভারত সে যাবে না।

‘কেন?’

‘আমি যদি ভারতে যাই তো লোকে কবে তোরে মিলিটারিতে টাইন্যে নেছে, তোরে অত্যাচার কইরছে, তুই আবার এহনে ইন্ডিয়ায় আইছস ক্যা? তো আমি রাজি হলাম না। আর মুক্তিযোদ্ধা ভাইগের কইলাম-এই দেশ এই মাটি আমার মা, এই মাটিই আমার সব, মরতে হয় এই দেশেই আমি মরব। বলি, এক যুদ্ধ করে আইছি, আরেক যুদ্ধ করতে চাই। এই বুলে আমি তাগের হাতে হাত মিলাইলাম।’

টুকি বলে, ‘আমার শরীলের রক্ত দিয়ালে দিয়ালে হাত দিয়ে মেখ্যে আসিলাম, যে ঘরে ওরা আমারে একতালে চার মাস আটক রাখছিল।’

‘কেন?’

‘রাখিলাম, কেননা ইগুলি হলো চিহ্ন–নির্যাতনের চিহ্ন। মুক্তিফৌজ যেয়ে সেই ঘরে যে রক্তের দাগ পাইলো, ও তা আমারই শরীলের রক্ত।’

এদিকে শ্যামলীর লেখা চিঠি ওষুধের দোকান থেকে আর্মি অফিসার শাহাদতের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে দু’দিন আর রিলিজ অর্ডার পেতে লাগে দু’দিন। চার দিনের মাথায় তার বন্দিজীবনের আকস্মিক পরিসমাপ্তি ঘটে।

১১. ভবিষ্যতের জল্পনা-কল্পনা

শ্যামলীর মুক্ত হওয়ার দিন অনুরাধা সারা রাত ঘুমাতে পারে না। মরিয়ম স্বপ্নের ভেতর অচেনা এক শহরের রাস্তা দিয়ে নগ্ন দেহে হেঁটে যায়। শোভা রানী দেখে, সে বিমল দাসের সঙ্গে গাড়িতে ঘুরছে। তাদের নিজস্ব গাড়ি–সাদা রঙের। বর্ণনাটা শোনার পর মরিয়ম বলে, শোভা রানীর স্বপ্নের গাড়িটার নাম ফক্সওয়াগন।

সেদিন ছিল ২৫ অক্টোবর ১৯৭১, সোমবার, টাইম ম্যাগাজিনের চাঞ্চল্যকর খবর-ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৫৬৩ জন মেয়ের প্রত্যেকেই গর্ভবতী। তাদের গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। খবরটা বড় শ্যালক গোলাম মোস্তফার মুখে শোনার পর কফিলউদ্দিন আহমেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি মগবাজারের বাসার ড্রয়িংরুমের সোফা ছেড়ে কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। সেখান থেকে গোলাম মোস্তফার পা দুটির দূরত্ব মাত্র এক হাত। ফুলতলি থেকে এক দিনের পথ পাঁচ দিনে পাড়ি দিয়ে কফিলউদ্দিন আহমেদ গতকাল ঢাকা পৌঁছেছেন। উদ্দেশ্য, বয়সে আর সম্পর্কে ছোট হলেও শ্যালকের হাতে-পায়ে ধরে যদি মেয়েটাকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু গোলাম মোস্তফা যত বার না-না করে মাথা নাড়েন, ততবার তার পদযুগল দোল খায় ডানে-বাঁয়ে। মুখে কিছু বলেন না। ফুলতলি, বল্লবপুর, নবীনগর, কোমলকান্দিসহ আশপাশের আট-দশ মৌজায় যার এত দাপট, ঢাকায় সে মশা মাছিরও অধম, এ কি বিশ্বাস করার মতো, না এ বিশ্বাস করা যায়? এমন কথায় গোলাম মোস্তফার মুখে হাসি ফোটে, দুলাভাই যে আমারে কী ভাবেন, তা কেবল আপনের খোদায় জানে।’ তবে শ্যালক-দুলাভাই দুজনেরই ধারণা, যে মেয়ে ঢাকা থেকে নিখোঁজ, সে যদি মরে গিয়ে না থাকে তো ওই সেনানিবাসেই আছে। সেখানে থাকার অর্থ তাদের অবিবাহিত মেয়েটা এখন গর্ভবতী এবং তার গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।

ঢাকার সেনানিবাসে না থাকলেও মরিয়ম, অনুরাধা, শোভা রানী–এক কম্বলের নিচে এখন এই যে তিনজন, তিনজনই গর্ভবতী। এর মধ্যে গর্ভপাতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে শোভা রানীর। তবে কফিলউদ্দিন আহমেদ বা গোলাম মোস্তফার মতো সে এ নিয়ে মোটেও ভাবিত নয়। সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গর্ভের সন্তানের নড়াচড়া তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ‘মেরি দিদি, অনুরাধা দিদি তোমাগের হাত দুটি ইখানে থোও। বাচ্চাডা যে কি লাখোন লাথোয়, ভাষায় বুঝাতে পারি না। আমার স্বামীও খুব রাগী ছেল।’

শোভা রানীর আধো আধো আদুরে কথা অনুরাধার কানে ঢোকে না। সে আজ অন্যমনস্ক। কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গেছে। কত মেয়ে রোগে-শোকে অত্যাচারে-গুলিতে শেষ হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে! অমরত্বের চেয়ে বেঁচে থাকাটা অনুরাধার হঠাৎ দামি মনে হয়। আনা ফ্রাংকের ডায়েরি এত দিন যার প্রেরণা ছিল, সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে অন্য দৃষ্টান্ত। শ্যামলীর বাঁচার উপায়টা শর্টকাট-হাতেনাতে ফল পাওয়া যায়। এমন সুযোগ কি তাদের জীবনে আসবে? সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে বোঝা যায়, যুদ্ধটা এখন আর একতরফা হচ্ছে না। অচিরেই দেশ স্বাধীন হবে। শোভা রানীর পেটের ওপর অনুরাধার নিরাসক্ত হাত। উত্তেজিত হয়ে সে বলে, ‘খুব শিগগির বড় একটা যুদ্ধ হবে। ভারত আগায় আসতেছে।’

বিছানায় নড়ে ওঠে শোভা রানীর শরীরটা। মরিয়ম শিশুর মতো প্রশ্ন করে, ‘অনুরাধা, কী করে তুমি বুঝলে?’

‘বুঝলাম? কারণ পানি শুকায়ে পথঘাট এখন ভেসে উঠছে। ভারতের প্রস্তুতিও প্রায় শেষ। ট্যাংক আর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে ভারতীয় সৈন্যদের কোনো অসুবিধাই হবে না। জনগণও সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’

অনুরাধার কথা শুনতে শুনতে মরিয়মের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। ‘স্বাধীনতাটা যে আকাশ থেকে পড়বে না, তার জন্য ট্যাংক-কামান-বিমান নিয়ে তুমুল একটা যুদ্ধ হবে,’ মুক্তিকে সে উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘আমাদের মাথায় এই চিন্তাটা আসেনি। আমরা মিলিটারির অত্যাচার-অবিচার সামলাতেই তখন ব্যস্ত। তুমি ভাবো একবার তোমার মাথার ওপর যুদ্ধবিমান মৌমাছির মতো গুনগুন করে উড়ছে আর তুমি আটকা পড়ে রইছো একটা তালাবন্ধ ঘরে!’

দৃশ্যটা সত্যি ইঁদুরের গর্তে পড়ে মরার মতো করুণ। ‘কিন্তু এত মেয়ে চোখের সামনে মারা যাচ্ছে, ভাবেন নাই যে, আপনিও মারা যেতে পারেন?’ মুক্তির প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম বলে, ‘ভেবেছি, তবে আর যা-ই হোক এইভাবে না। আটকাবস্থায় অসহায়ের মতো না। তা ছাড়া নিজের পক্ষের বোমার আঘাতে আমরা কেউ তখন মরতে চাইনি।’

পক্ষ-বিপক্ষ তখনো একটা বড় ব্যাপার-যুদ্ধবন্দি মেয়েদের কাছে। স্বাধীনতার পর বিভাজনরেখাটা মুছে গিয়ে সবাই বিপক্ষে চলে যায়। অনুরাধার এ ভবিষ্যদ্বাণীটা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাসাধিককাল আগের কথা। আসল যুদ্ধটা যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত করবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাশে থেকে সহযোগিতা দেবে, তখনই মরিয়ম জানতে পারে। কারণ পাঁচ মাস হতে চলেছে সে বন্দি। তখন যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলস থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার পথে, তা তার জানার কথা নয়। তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে উড়ে যাচ্ছেন আর দরবার করছেন। বক্তব্য এবার পরিষ্কার। ব্রাসেলসের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে ভারত। আর পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার কোনো ভিত্তি নেই। অর্থাৎ-পাক-ভারত যুদ্ধ আসন্ন। দেশ স্বাধীন হতে চলেছে।

মরিয়ম আগাম বোমাতঙ্কে দিশাহারা। অনুরাধা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ধরো, বোমার আঘাতে তুমি মরলা না, বেঁচে থাকলা, দেশ স্বাধীন হইল। তখন কী করবা তুমি? কই যাইবা?’

‘আমি যামু শ্বশুরের ভিটায়।’ কথার মাঝখানে শোভা রানী ঢুকে পড়ে। ঘৃণা অত্যাচার-অনাহার সত্ত্বেও তার গর্ভের সন্তান মাচাংয়ের কুমড়োর মতো বাড়ছে। পাকিস্তানিদের হিন্দু নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানের এ এক ব্যর্থতার দিক। সৈন্যরা স্বামীকে হত্যা করে স্ত্রীর পেটে সন্তান দিয়েছে। স্বাধীন দেশে শোভা রানী পুত্রসন্তানের জননী হবে। পোড়া ভিটায় আবার ঘর উঠবে, শঙ্খ বাজবে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে, ফুল-পাতা সাজিয়ে দেব-দেবীর অর্চনা হবে। গোবর লেপা আঙিনায় হামাগুড়ি দেবে হিন্দুর ভবিষ্যৎ বংশধর। তাদের নির্বংশ করার যে প্রক্রিয়া অপারেশন সার্চলাইটের রাত থেকেই পাকিস্তানিরা জারি রেখেছিল, পুরো নয় মাস লুঙ্গি তুলে খতনাহীন পুরুষাঙ্গের লোকগুলোকে আলাদা লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরেছে, সেই রক্তবীজ থেকে জন্ম নেবে শোভা রানীর গর্ভজাত সন্তান। পিতা ছাড়া, তবে পরিচয়হীন নয়।

শোভা রানী যখন ভবিষ্যৎ ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছে, মরিয়ম তখন ফুলতলি গাঁয়ে ঢুকে এসএম হলের শিরীষ অরণ্যের তল দিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে। সব কটা আশ্রয়ই সে যুদ্ধের আগে হারিয়েছে। তারপর ২৭ মার্চ থেকে তার যে উদ্বাস্তুর আর বন্দির জীবন, এর ভাগীদার দেশের লাখ লাখ মানুষ। নিজের পুরোনো সমস্যাগুলো সেই ডামাডোলে হারিয়ে যায়। কিন্তু তখনকার মতো এখনো সে অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় যদি দেশ স্বাধীন হয়, কোথায় ফিরবে? কার কাছে? অনুরাধার কথা তখনো শেষ হয় নাই। সে বলে, ‘তুমি ভাবছো স্বাধীন দেশের মানুষ মালা দিয়া আমাদের বরণ করবে? না মেরি, পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটে নাই। যুদ্ধ শেষে পুরুষেরা হয় বীর, মেয়েরা হয় কলঙ্কিনী।’

কী অলুক্ষুনে কথা! শাস্ত্রে যা বলা নেই মেয়েটা দেখি তা-ই বলছে! শোভা রানী বিরক্ত হয়। ভগবানের অশেষ কৃপায় তার পেটে সন্তান এসেছে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেই সন্তান এখন লকলকিয়ে বাড়ছে। তা না হলে বাজা-বিধবার দুর্নাম নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে হতো। শ্বশুরের ভিটেয় বাতি জ্বালানোরও কেউ থাকত না। পুত্র-সন্তানের জন্য কত দুঃখী নারীর দেবতার শরণাপন্ন হওয়ার কথা শাস্ত্রে বলা আছে! যে নিয়মে সত্যবতী, কুন্তী সতী, শোভা রানীও সেই নিয়মে সতী। অনুরাধার হাতটা পেটের ওপর থেকে আলগোছে সরিয়ে দেয় সে।

কিন্তু অনুরাধার কথায় মরিয়মের ভয় বাড়ে। বহু বছর আগে জসিমুল হক শুধু তার হাত ধরেছিল। তাতেই যদি অপরাধ হয়, এখন তবে কী? দিনের পর দিন তাকে যারা ধর্ষণ করছে, তাদের নাম কী, বাড়ি কোথায়, বংশ কেমন, লেখাপড়া কর, বিবাহিত না অবিবাহিত কিছুই তো সে জানে না। মুখগুলোও প্রত্যেকের একই রকম, আচার-ব্যবহারেও কোনো ফারাক নেই। তাই তারা একশ’, পঞ্চাশ, বিশ–কতগুলো। সংখ্যা। এর মধ্যে কেবল লাল সোফায় বসা সেই আর্মি অফিসারের চেহারা তার মনে আছে, যার নাম ইশতিয়াক। লোকটি নিজের দুর্ভাগ্যের কথা তাকে বলতে চেয়েছিল, যদিও মাতাল অবস্থায়।

‘মাতাল তো খালি মদ খেয়ে হয় না,’ অনুরাধা বলে, ‘যুদ্ধটাই পুরুষের সবচেয়ে বড় মাতলামি।’

‘তা হতে পারে।’

‘তাইলে ভয় পাইছিলা ক্যান সেইদিন? লোকটার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত ছিল তোমার। দেখতে–কী বলে?’

‘ওর কথা শুনে আমার লাভ?’

‘তোমার লাভ মানে? লোকটার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গোছাতে!’

‘তা কি বাস্তবিকই সম্ভব যুদ্ধের দিনে? যে আবার তোমার শত্রু?’

‘শ্যামলীকে তোমার কী মনে হয়?’

‘আমার মনে হয় বিশ্বাসঘাতক।’

‘বিশ্বাসঘাতকতা কার প্রতি?’

‘নিজের দেশের প্রতি।’

‘কোন দেশ? যে দেশ তোমার ওপর শত্রুর নির্যাতনকে নির্যাতন বলে দেখবে না, দেখবে নিজের বেইজ্জতি হিসেবে, তারপর হয় আমাদের লুকিয়ে ফেলবে, না-হয় বেশ্যালয়ের দিকে ঠেলে দেবে–সেই দেশের প্রতি?’

অনুরাধার কথাগুলো মরিয়মের হৃৎপিণ্ডে বঁড়শির মতো গেঁথে যায়। যন্ত্রণায় ছটফট করে সে। জীবন যদি এমন হয়, এর শেষ কোথায়? অনুরাধা তখনো আপন মনে কথা ভাজছে। তারপর বলে, ‘মেরি, তুমি যদি মেজর ইশতিয়াকের সঙ্গে পাকিস্তান যাও, তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে না।’

‘কী হবে?’

অনুরাধার জবাব, ‘তা হবে প্রতিশোধ।’

১২. মাঝখানে বিরতি

১৯৭২ সালে যুদ্ধজয়ের পর যখন পাকিস্তানি বন্দিরা ভারতের উদ্দেশ্যে এ ভূখণ্ড ত্যাগ করে, তখন আমি জানতে পারি প্রায় ত্রিশ-চল্লিশজন ধর্ষিতা নারী এ বন্দিদের সঙ্গে দেশ ত্যাগ করছেন। অবিলম্বে আমি ভারতীয় দূতাবাসের সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার অশোক ভোরা এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত মরহুম নুরুল মোমেন খান যাকে আমরা মিহির নামে জানতাম তাঁদের শরণাপন্ন হই। উভয়েই একান্ত সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এসব মেয়েদের সাক্ষাৎকার নেবার সুযোগ আমাদের করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নওসাবা শরাফী, ড. শরীফা খাতুন ও আমি সেনানিবাসে যাই এবং মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা লাভ করি।
–নীলিমা ইব্রাহিম, আমি বীরাঙ্গনা বলছি

.

‘প্রতিশোধ! কার প্রতি?’ মহিলা সমাজকর্মী একজন তো আকাশ থেকে পড়লেন। অথচ তারা ঘোষণা দিতে দিতে ব্যারাকে ঢুকেছিলেন যে, তোমরা চলে যেয়ো না। আমরা তোমাদের জন্য কিছু করতে এসেছি, আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি। হাত বাড়িয়ে সাহায্য নেওয়ার বদলে সামনের মেয়েটি বারুদের মতো জ্বলে ওঠে, ‘শুনবেন কার ওপর প্রতিশোধ? এই সোনার বাংলার ওপর, এর সোনার টুকরো ছেলেদের ওপর আর…’

‘ব্যস ব্যস তোমাকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। কী কথা-প্রতিশোধ!’ তিনি দু’কদম পিছিয়ে যান। ওখানে তখন ভয়ানক অরাজকতা। একজনের বাবা এসেছে মেয়েকে নিতে, সে কিছুতেই যাবে না। আরেকজন সমাজকর্মী তাকে আগ বাড়িয়ে বলছেন, ‘বেশ তো বাবার সঙ্গে যেতে না চাও, আমার বাড়ি চলো!’

‘আপনার বাড়ি? কেন?’ এ মেয়েটি আরেক কাঠি সরেস। গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে ওস্তাদ। সে চেঁচিয়ে বলে, আমরা কি চিড়িয়াখানার জন্তু যে, আপনার বাড়ির দরজা খুলে রোজ দর্শনার্থীদের দেখাবেন আর নিজে বাহবা নিবেন?

‘যদি বাহবা নিই তোমার অসুবিধা আছে?’ এবার সমাজকর্মীও রেগে আগুন। ‘পাকিস্তানে গিয়ে তুমি কী করবে? ওখানে তো পতিতালয়ে বিক্রিই হবে?’

‘হলে হব। আপনার অসুবিধা আছে কোনো?’ এ জবাবটা আসে আরেকজনের কাছ থেকে।

‘বাপ রে বাপ, কারা এরা?’ মুক্তির প্রশ্নের জবাবে সেদিনের এক সমাজকর্মী জানান-ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব ধরনের মেয়েই ছিল ওখানে। তবে পরিস্থিতি বুঝতে আমাদের ভুল হয়েছিল। কারণ এটাই ছিল আমাদের জীবনের প্রথম যুদ্ধ। মুক্তিকে তিনি আরো বলেন, এখন একা বসে বসে ভাবি, ওখানে গিয়ে হয়তো তারা বিক্রি হয়ে যাবে, তাদের দিয়ে ব্যবসা করানো হবে, এসব জেনেও এখানে থাকার চাইতে পাকিস্তানে চলে যাওয়াটা তারা প্রেফার করেছিল কেন?

সেদিন সংবাদ পেয়ে কারো কারো বাপ-ভাইয়েরা ক্যান্টনমেন্টে ছুটে আসেন। বিশেষত বাবারা। মেয়ের একগুয়েমি দেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরে যান। স্বামীরাও এসেছিল-বউদের নিতে নয়, শাড়ি উপহার দিতে। এটা ছিল তাদের বৈবাহিক ভরণপোষণের শেষকৃত্যানুষ্ঠান।

: এই যে এতগুলি মেয়ে আপনাদের চোখের সামনে দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেল, এর কোনো অফিসিয়াল রেকর্ড আছে?

: থাকা তো উচিত। যদি নষ্ট না হয়ে থাকে।

: কোথায় থাকতে পারে? কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এটা?

: এটা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পড়ে সম্ভবত।

: নাকি সমাজকল্যাণ, এখন যেটা মহিলা অধিদপ্তর?

: আরেকটা সোর্স হতে পারে মি. অশোক ভোরা, ভারতীয় দূতাবাসের যিনি মিলিটারি অ্যাটাশে ছিলেন।

: হু, ভারতে থাকতে পারে।

: এটা খুব লজ্জাজনক যে, দেশে কাগজপত্র পাচ্ছি না, বিদেশ খুঁজতে যাচ্ছি। মরিয়মের কাছে ফিরে আসে মুক্তি। ‘আপনি তো শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে গেলেন না। রয়ে গেলেন। কেন?’ প্রশ্নটা এমন যে, হাতে টিকিট থাকা সত্ত্বেও কোনো প্যাসেঞ্জারকে যেন গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, অস্বস্তিতে মরিয়মের মুখে মাছির মতো ঘাম ফোটে। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। কাঁপা কাঁপা হাত দুটি শাড়ির ভাঁজের নিচে তলপেটে কী যেন খোঁজে। কারণ সমস্যাটা তার নয়, এখন আঙুলের চাপে নিষ্পেষিত হচ্ছে যা–সেই গর্ভাধারের।

মেয়েগুলোর তখন ওয়ার প্রিজনারের স্ট্যাটাস। তারা হানাদার বাহিনীর সদস্যদের হয়তো পাতানো স্ত্রী বা সঙ্গী, একদল ক্রিমিনালের সঙ্গে আরেক দল। ক্রিমিনাল, ভারতের ওপর দিয়ে ট্রেনে চেপে পাকিস্তান চলে যাবে। পরিচয়টা এমন গুলিয়ে ওঠে যে, নয় মাসের খুন-ধর্ষণ-নির্যাতনের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য সবকিছুই তখন উল্টেপাল্টে গিয়েছিল। ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দি। ভারতীয়রা সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওখানে। সেনানিবাসের ভূগর্ভস্থ বাংকার আর টর্চার চেম্বারগুলোর জমাটবাঁধা কালচে রক্তে ঝাঁকে ঝাঁকে উঁশ মাছি। মেঝেতে, দেয়ালের গায়ে চর্বি-মাংসের কালশিটে দাগ। যত্রতত্র মেয়েদের হাতের চুড়ি, লম্বা লম্বা। চুলের স্তূপ। হাড় থেকে পচা-গলা মাংসের দলা তখনো খসে পড়েনি। কোনো প্রতিকার ছাড়াই হঠাৎ সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েরা তখন বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার প্রতীক্ষা করছে। তিনি পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে ওয়ার প্রিজনারদের ভারত পর্যন্ত যাওয়ার ছাড়পত্র দেবেন। এ রকম অনিশ্চয়তায় মরিয়মের পেটের বাচ্চা নড়াচড়া জুড়ে দেয়। পুনর্বাসনকেন্দ্রে গর্ভপাতের সর্বোচ্চ মেয়াদ চার মাস। এর পর বিদেশি ডাক্তারদেরও সাধ্যের বাইরে চলে যাবে। কেন্দ্রের দ্রুত চিকিৎসা কর্মসূচির আন্ডারে মরিয়ম ভর্তি হয়ে গেল। সেখানে চিকিৎসা, বিশ্রাম তারপর গর্ভপাতের লম্বা সিরিয়াল। তত দিনে তার সঙ্গের মেয়েরা যুদ্ধবন্দি সৈন্যদের সঙ্গে ভারত হয়ে পাকিস্তান চলে গেছে।

‘তা না হলে আপনিও যেতেন?’

‘যেতাম হয়তো।’

‘এ ব্যাপারে আপনার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল?’ মুক্তির পেশাদারি প্রশ্নের জবাবে মরিয়ম পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কোন ব্যাপারে?’

‘এই ধরেন পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যাপারে? ওখানে গিয়ে কী করতেন, কোথায় থাকতেন, হেন-তেন এসব।’

‘দেশে থাকলে কোথায় থাকতাম, কী করতাম–হেন-তেন এসব কি তখন ঠিক করা ছিল? বা এখনো কি ঠিক আছে?’ মরিয়মকে উত্তেজিত হতে দেখে মুক্তি চুপ মেরে যায়। ওই জেনারেশনটাই অদ্ভুত। একবার চটে গেলে কথা বলাই হয়তো বন্ধ করে দেবে। তার তখন রেকর্ডার-টেকর্ডার গুছিয়ে, ক্যাসেট-ব্যাটারি কিছু থুয়ে, কিছু নিয়ে সুড়সুড়িয়ে কেটে পড়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

মরিয়মের কপালের ভাঁজ দ্রুত ঘন হয়। আশ্চর্য! মানুষ বদলালেও প্রশ্নের ধরন ধারণ বদলায় না। যখন এসব কথা জিগ্যেস করা হতো, আজ থেকে আটাশ বছর আগে, তখন হয়তো মুক্তি জন্মায়ওনি। এরা প্রশ্নগুলো শিখে ফেলে মায়ের পেটে থাকতে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা স্টেজের উঠে চিল্লাফাল্লা করেন–দু’লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হইছে। সেই দু’লক্ষ মা-বোন কই? পাকিস্তানে গেছে না-হয় ত্রিশ-চল্লিশজন! বাকিরা কোথায়? তারা কেমন আছে? মুক্তির কাছে মরিয়মের পাল্টা প্রশ্ন, ‘এখন যে বাংলাদেশের মেয়েরা হরদম পাকিস্তানে পাচার হচ্ছে, ওইখানে বেশ্যাবৃত্তি করছে, এই নিয়ে কারো মাথাব্যথা নাই কেন?’

মুক্তি কাচুমাচু করে। কী বলবে বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, তখন আর এখনকার মধ্যে একটা ফারাক আছে। তখন সবে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ঘা-টা দগদগে। সেই তিরিশ-চল্লিশটা মেয়ে স্বেচ্ছায় পাকিস্তান চলে গিয়ে কাঁচা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে–অনুরাধার ভাষায় যা ছিল প্রতিশোধ।

তখন অবশ্য অনুরাধার কথায় মরিয়মের সায় ছিল না। আর থাকবেই-বা কী করে। কোনো কিছু করার জন্য একটা উপলক্ষ লাগে, অবলম্বনেরও দরকার হয়। একটা বড় বিদ্রোহের পেছনে কিছু পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত ঘটনা থাকে, সেসব পৃথিবীর আরেক প্রান্তে সংঘটিত হলেও।

১৩. লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি ও ধবধবে সাদা বিছানা

তখন পাকসেনারা সারাক্ষণ মুক্তিফৌজের ভূত দেখছে। সঙ্গে ভারতীয় আক্রমণের ভয়। প্রহরা আরো কড়াকড়ি হয়েছিল। শ্যামলী চলে যাওয়ার পরের সপ্তাহে হলরুমের সদর দরজায় একটা গ্রেনেড ফাটে। তাতে হত হয় দ্বাররক্ষী। জমাদারনি ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত ছিল, সেটাই তার অপরাধ। বন্ধ ঘরে ধোঁয়া ঢুকে পড়ায় মেয়েরা বেদম কাশছিল। সুতরাং তারাও সন্দেহের তালিকাভুক্ত হলো। সেটা এ কারণে, নাকি জেরার মুখে জমাদারনি তাদের যে ক’জনের নাম জানত বলে দিয়েছে, মরিয়ম আজও জানে না। ঘটনার দিন তাদের টেনে-হেঁচড়ে হলঘরের বাইরে আনা হয়। ‘সব শালি কো মার ঢালো, বাদ মে…’ মরিয়ম আর কিছু শুনতে পায়নি। তার পরের দৃশ্যগুলো মাঝখানে মাঝখানে ছেঁড়া, দাগ-পড়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া ফিল্মের রিলের মতো।

চলন্ত গাড়ির পেছনের সিটে চিত হয়ে পড়ে আছে মরিয়ম। মাথার আধখানা ঝুলছে সিটের বাইরে। এ অবস্থায় উরুর মাঝখানে রাইফেলের বাটের গুঁতো, দু’বগলে দুটি পুরুষাঙ্গের বিরামহীন ঘষাঘষি এবং ঠোঁটের দু’দিক টেনে ধরে একটি দুর্গন্ধময় পুরুষাঙ্গ মুখে ঢোকানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। গাড়িটা কোথাও থামছে না। চলতে চলতে একসময় এবড়োখেবড়ো রাস্তায় পড়ে। তাতে রাইফেলের বাঁটসহ পুরুষাঙ্গ দুটি পথভ্রষ্ট হয়, বগলের মাঝখানে ছন্দপতন ঘটে। তাতে লোকগুলো বিরক্ত হয়। মসৃণ রাস্তায় ওঠার পর, পুরো কাজটা ফের প্রথম থেকে শুরু করতে হয়। তার আগে বগল দুটি নিজেদের মধ্যে বদলাবদলি করে নিয়েছে দুজন। আর রাইফেলের বাঁট ফেলে পেছনের লোকটা সামনে চলে আসে, দুর্গন্ধময় পুরুষাঙ্গ মুখ বেজার করে চলে যায়। পেছনে। বিরতিতে ধুলা ওড়ে। গাড়িতে ঢুকে পড়ে শীতের দুপুরের ঝিলমিলে সোনালি রোদ্দুর।

পরের দৃশ্যে একজন মহিলা রক্ত-বীর্যের শুকনো দাগগুলো মুছিয়ে তাকে একটা আনকোরা কাপড় পরায়। মরিয়ম কাত হয়ে নেতিয়ে পড়তে ষন্ডামার্কা এক লোক তার লটপট শরীরটা উপুড় করে কাঁধে ঝুলিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা দেয়। তার পরের দৃশ্যে খোয়া ছড়ানো পথের দু’ধারে টবে বসানো সারি সারি ওল্টানো পাতাবাহারের গাছ। কাছেই চুনকাম করা একটি দোতলা বাড়ি, যার পেছনে বিকালের সূর্য পেন্ডুলামের মতো ডানে-বাঁয়ে দোল খাচ্ছে।

যে চেয়ারটায় মরিয়ম এখন বসে আছে, এর হাতলের সঙ্গে তার হাত দুটি শক্ত করে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা। সামনে একটা ঝোলা মুখ ঠোঁটে কলম চেপে ক্রমাগত তার দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। মরিয়ম কেশে উঠতে লোকটি পেট ফাটিয়ে হাসল। ‘নাউ টেল মি, হোয়াট ডু ইউ থিং অ্যাবাউড সভূরেন্টি। অ্যান্ড হাউ ডু ইউ এক্সপ্লেইন দ্য কনসেপ্ট অব ফ্রিডম। সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যকারীর কণ্ঠে বাংলা তর্জমা, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? স্বাধীনতা শব্দটিকে তুমি কীভাবে ব্যাখ্যা করো।’ ধোঁয়ার ফাঁকে ঝোলা মুখ ফের আবির্ভূত হয়, ‘ডু ইউ বিলিভ ইন টু ন্যাশন থিওরি? টেল মি, হোয়াট দ্য ফিউচার অব পাকিস্তান?’ অদৃশ্য লোকটি—’তুমি কি দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করো? পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কী–আমাকে বলো।’

‘হ্যাভ ইউ সিন শেখ মুজিব? ডোন্ট ইউ থিং দ্যাট দ্য সিক্স-পয়েন্ট ডিমান্ড প্রেসড বাই মুজিব ইজ ভায়োলেশন অব আর্টিকেল সিক্সটিন অব দ্য মার্শাল ল প্রোক্লেমেশন? অ্যান্ড দ্যাট বাসটার্ড শুড বি হাঙ্গড ফর দ্যাট?’

‘তুমি শেখ মুজিবকে দেখেছ? তার ছয় দফা প্রচারণা, তুমি কি মনে করো না, সামরিক আইনের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদের চূড়ান্ত লঙ্ঘন? এবং তার জন্য জারজটার ফাঁসি হওয়া উচিত?’

মরার আগে মনে হয় কলমা পড়ানো হচ্ছে। মরিয়ম ঢুকে পড়েছে সুন্দরীর জলার গোলকধাঁধায়। বেরোনোর পথ কই! সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকির আলো, ঝোলা মুখটা তার ঠিক মধ্যিখানে, ‘উল্লু টর্চ বন্ধ করো!’ নেপথ্যের লোকটি ধমকে ওঠে, ‘বাতি নেভা উল্লুক!’ টেবিলের ওপাশ থেকে ঝোলা মুখের লোকটা এবার কচ্ছপের মতো গলা তোলে, ‘ডিড ইউ কিল হাবিলদার তাজ খান? ইফ ইউ ডিড নট, টেল মি হু আর দ্য কিলারস। তর্জমাকারী ফিসফিস করে, ‘তুমি কি হাবিলদার তাজ খানকে হত্যা করেছ?’ পরক্ষণে গলাটা তার সপ্তমে চড়ে যায়, ‘যদি না করে থাকো, বলো কে করেছে।’

ঝোলা মুখ দু’কাঁধের মাঝখানে গলাটা ঢুকিয়ে চেয়ারে হেলান দেয়, ‘নাউ উই আর ভেরি মাচ সিওর দ্যাট ইউ আর এ মিসক্রিয়েন্ট। ইফ ইউ অ্যাডমিট দ্যাট, ইউ উইল বি ফ্রি।’ স্খলিত গলায় তর্জমাকারী, ‘তুমি যে একজন দুষ্কৃতকারী, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত? তা যদি নিজের মুখে স্বীকার করো, তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে।’

তারপর অন্ধকারে খানিক চেয়ার টানাটানি। এদিক-ওদিক খুটখাট আওয়াজ। ‘আচ্ছা ইন্টারভিউ থা।’ তর্জমাকারী খুশিতে বাগ বাগ, ‘সাক্ষাৎকারটা খুব ভালো হয়েছে। চেয়ারের হাতল থেকে মরিয়মের হাত দুটি খসিয়ে স্ট্রেচারে ধরাধরি করে শোয়ানো হয়েছে। মুখের ওপর ঝোলা মুখটা ধীরে ধীরে নেমে আসে, বহৎ আচ্ছি লাড়কি হো তুম।’ বিব্রত কণ্ঠে দ্রুত তর্জমা, ‘খুব ভালো মেয়ে তুমি।’

‘গুডনাইট।’

‘শুভরাত্রি।’

সাদা ধবধবে বিছানায় একটা লাল গোলাপ। পাশে জারুল ফুলের রঙের ভাঁজ করা সিল্ক শাড়ি। একটা দুই লিটার আন্দাজের স্যালাইন বোতল খাটের স্ট্যান্ড থেকে ঝুলছে। মরিয়ম পাশ ফিরতে হাতে তারের টান লাগে। তবে কম্বলের নিচে পা দুটি মুক্ত। দেশ কি স্বাধীন হয়েছে? অনুরাধা কোথায়? তাদের না পাকিস্তান চলে যাওয়ার কথা! হাউ ডু ইউ ফিল?’ হঠাৎ ঝোলা মুখটা তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়তে মরিয়ম আরো একটা সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু এবার আর অদৃশ্য তর্জমাকারীর কণ্ঠ শোনা যায় না। এ এক নতুন উপদ্রব। তবু আগের চেয়ে ভালো। হলরুমের নোংরা কম্বল-শয্যা থেকে ক্যাম্প খাট, সাদা নিপাট-পরিচ্ছন্ন বিছানা, শিয়রে লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি। তার মানে সব জায়গাতেই পদোন্নতির ব্যবস্থা আছে–সেটি বন্দিশিবির আর সময়টা ১৯৭১ সাল হলেও!

‘আর ইউ ওকে?’ মরিয়ম বালিশের ওপর ভারী মাথাটা এদিক-ওদিক করে এবং এই প্রথম শোনে যে, সে নিজের মুখে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে–‘ইয়েস।’ লোকটা মেজর ইশতিয়াকের মতো খুশি হয়। তার সংক্ষিপ্ত ইংরেজি ভাষ্য শুনে নাকি তাকে সুস্থ হয়ে উঠতে দেখে-মরিয়ম জানে না। তার শীর্ণ হাতটা কোলে তুলে বিছানায় বসার পর, ঝোলা মুখ রূপান্তরিত হয় মেজর ইশতিয়াকের ঢুলুঢুলু মাতাল চেহারায়। মরিয়মের মনে পড়ে, সার্কিট হাউসের সেই মাতালটার থাপ্পড়, যার ধাক্কায় সে উড়তে উড়তে রেলিংয়ের গায়ে পাতার মতো সেঁটে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও অনুরাধার উপদেশ স্মরণ করে সে জানতে চায়, আর ইউ মেজর ইশতিয়াক? তার প্রশ্ন শুনে লোকটা যেন বিদ্যুতের শক্ খেয়েছে, ঝপ করে হাতটা ছেড়ে দেয়। চেঁচিয়ে বলে, ‘নো নো, হাউ ডু ইউ নো হিম?’ এর জবাব মরিয়ম কেন দেবে? যুদ্ধের দিনে বাঙালি মেয়ের সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মির কীভাবে সাক্ষাৎ-পরিচয় ঘটে–প্রশ্নকর্তারই তো তা ভালো জানার কথা। মেজর ইশতিয়াকের নামটাই শুধু তার মনে ছিল। এ ছাড়া ইউনিফরম পরা প্রত্যেকটা লোকই এক। ততক্ষণে লোকটার চেহারা পাল্টে আগের মতো ঝুলে পড়েছে। মিনিটে মিনিটে চেহারার পরিবর্তন–মরিয়মের মাথা ঘুরে ওঠে।

‘হাউ ডিড ইউ নো হিম?’ লোকটা তো নাছোড়বান্দা! মরিয়ম সরাসরি প্রশ্নের জবাব দেয় না, ঘুরিয়ে বলে, ‘হি ওয়াজ কাইন্ড টু মি।’ দেখা যাক কোথাকার জল। কোথায় গড়ায়। চোখের কোণ দিয়ে সে তার ভাবান্তর লক্ষ্য করে। কিন্তু এ কি চোখের ভুল, নাকি লোকটা আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে চেহারা পাল্টে ফেলার! ঝোলা মুখ ক্রমে মেজর ইশতিয়াকে রূপান্তর হতে হতে মরিয়ম শুনতে পায় বলছে, ‘হি ওয়াজ কিন্ড ডে বিফোর ইয়াসটারডে।

কী আশ্চর্য! ওরাও বিলক্ষণ খুন হয়? মরিয়মের না তার সঙ্গে পাকিস্তান চলে যাওয়ার কথা–অনুরাধা বলেছিল!

নিজের লোকজনের হতাহতের খবর শত্রুপক্ষকে জানানো বোধ হয় যুদ্ধের নিয়মবহির্ভূত। ঝোলা মুখ নিজে নিয়মভঙ্গ করে, চোখের পলকে মরিয়মের ওপর খেপে ওঠে। বিছানা ছেড়ে সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘ডোন্ট ট্রাই টু মুভ। স্টিল ইউ আর সাসপেক্টেড। ইউ হ্যাভ টু অ্যামার-হুঁ আর দি কিলারস অব দ্যাট হাবিলদার।’

লোকটা গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। লাল গোলাপ আর সিল্ক শাড়িটা পড়ে থাকে বিছানায়। হয়তো তুলে নিতে ভুলে গেছে। শত্রুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের আখের গোছানো কি সোজা কথা? শ্যামলী যা পেরেছে, অনুরাধা নিজে তা পারবে? কখনো তো বড় বড় কথা বলার বাইরে সাহসী কিছু করে দেখাতে পারল না। মেজর ইশতিয়াকের চেহারা, নাকি ঝোলা মুখটা নিয়ে লোকটা আবার আবির্ভূত হয়, কে জানে।

‘শি ইজ সিক নাউ।’ গলাটা পরিচিত মনে হলেও ঘুমের ভান করে মরিয়ম মরার মতো পড়ে থাকে। নতুন ফন্দি এঁটে আর কাজ নেই। চুপচাপ থাকাই ভালো। ‘তা ছাড়া আমি মনে করি, সে সুযোগ পেলেই মুক্তিবাহিনীতে চলে যাবে।’ অপরিচিত কণ্ঠ—’লেটস সি।’

এভাবে লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি ও ধবধবে সাদা বিছানা মরিয়মের অধিকারে চলে আসে। যে ঘরে তাকে রাখা হয়েছে, এর যাবতীয় জিনিসপত্রও এখন তার। ছুঁয়ে দেখলে বারণ করার কেউ নেই। স্বর্গধামের মতো ফেলে যাওয়া কোনো পরিবারের সয়-সম্পত্তি হয়তো এসব। বা হালের কোনো বিনোদন কেন্দ্র। টাল টাল খালি মদের বোতল আর দেয়ালে লালচে লিপস্টিকের মতো রক্তের দাগ এমন সাক্ষ্যই দেয়। এ ছাড়া কফির কৌটা, আচারের বয়াম, চিনির ডিব্বার তলায় সবকিছু একটু-আধটু লেগে রয়েছে। মরিয়ম আঙুল দিয়ে টক টক আমের আচার মুখে পোরে। এখনো তিতকুটে বিস্বাদ হয়ে যায়নি। সরষে ফোড়নের ঝাঁঝটা নাকে সুড়সুড়ি দেয়। হেঁচে-কেশে ওপরে তাকাতেই তার চোখে পড়ে সারি সারি ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ। পোশাকে-চেহারায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে লোকগুলো অবাঙালি। ভারতের আক্রমণের ভয়েই হয়তো পাকিস্তান চলে গেছে। গলায় আচারের টুকরো মাকড়সার জাল বুনতে শুরু করলে সে হড়হড় করে বমি করে মেঝের কার্পেট নষ্ট করে দেয়। সেখানে একটা তার-ছেঁড়া তানপুরা ঘিরে শোকে মোহমান খান কতক তবলা। এর পাশের দেয়ালে লটকানো তৈলচিত্রগুলো অশেষ পীড়াদায়ক। যদিও নর্তকীদের স্থির অঙ্গ-বিভঙ্গ থেকে চোখ সরিয়ে নিলে তালাবন্ধ বিশাল ঘরটা মরিয়মের একার মনে হয়। চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো সে চাইলে খাঁচায় পায়চারি করতে পারে। দেয়াল আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে কথা বলায়, হাই তোলায়, এমনকি ভেংচি কাটায় এখানে তার অপার স্বাধীনতা রয়েছে।

ঝোলা মুখের লোকটা নিজের নাম বলে মেজর ইশতিয়াক। তার কথামতো সে দ্বিতীয়। প্রাক্তন যুদ্ধে মারা গেছে। সে এখন ঝোলা মুখ বাইরে রেখে মৃত মেজর ইশতিয়াকের মাতাল চেহারাটা নিয়ে ঘরে ঢোকে। আর প্রাক্তনের মতোই বলে, ‘আই হ্যাভ টু টক টু ইউ। ইফ আই কান্ট, সাচ এ ব্লাডি ওয়ার, আই উইল ডাই।’

দোজখেও এক কণা বেহেশত থাকে। উল্টো করে বললে, বেহেশতের চারদিকে তখন দোজখের দাউদাউ আগুন। দ্বিতীয় মেজর ইশতিয়াক বারুদগন্ধময় পোশাক ছেড়ে, রক্তমাখা হাত মুছে বেহেশতের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। বন্ধ ঘরের তালা খুলতেই তার নাকের পাটা ফুলে ওঠে। সে চোখ বুজে বুকে টেনে নেয় অজানা স্বর্গের সৌরভ।

চূর্ণ অলক থেকে এক পরী
মৃগনাভির এ গন্ধ ছড়ায়;
না, অরণ্যের হরিণ নয় সে
মানুষ দেখে যে বিষম ডরায়।
[কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনূদিত—হাফিজ]

মরিয়ম দরজা খোলার মধুময় ছন্দে দু’কদম পিছিয়ে আসে–এ প্রস্তুতি-পর্ব। তারপর বেহেশত আর দোজখের মাঝখানের দুয়ার বন্ধ হতে যতখানি সময়, তারপরই শিকারের ওপর চোখ বুজে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারি। স্বর্গারোহণেও কালবিলম্ব হয় না। বাইরের গোলাগুলি আর বিকট আওয়াজ, যা মানুষকে সন্ত্রস্ত করে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা তাদের স্বর্গসম্ভোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি না-করে আরোহণের মেয়াদ দীর্ঘতর করে। দুজনের মাঝখানের ফাঁকগুলো কানায় কানায় ভরে যায়।

পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সামনে যে বৈরী পৃথিবী, সেখানে মরিয়ম আর মেজর ইশতিয়াক একে অন্যের দুশমন। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। প্রকারান্তরে একজন আরেকজনকে মারতেই চায় স্বর্গারোহণের সময়টুকু বাদ দিয়ে।

তবু লাল গোলাপ আসে, মদ সহযোগে ওমর খৈয়াম, হাফিজ পাঠ হয়। বুলবুলকণ্ঠী নূরজাহান বন্ধ ঘরে মায়াজাল বুনে চলেন। প্রেম রসসিক্ত ঘন হয়। ভালোবাসা আর মদিরায় যুদ্ধের প্রহরগুলো যুদ্ধের নিয়মের বাইরে চলে যায়।

মরিয়ম হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে করে ভারতীয়রা যে এগিয়ে আসছে, তারপর বড় একটা যুদ্ধ হবে-অনুরাধার কথাগুলো সে বেমালুম ভুলে যায়। সে রাত-দিন এমন এক খোয়াবে বাস করে, যা ভাঙা না-ভাঙা সমান। তবে ভালো হয়, যদি বাকি জীবন এর মধ্যে থাকা যায়। ঝোলা মুখের মেজর তাকে রূপকথার দেশ আর এক রাজপুত্রের গল্প শোনায়। পঞ্চ নদের দেশ পাঞ্জাব-সুজলা-সুফলা। মোগল সম্রাটদের গড়া লাহোরকে খালি শহর বললে ভুল বলা হবে। ফুলবাগিচা, সুরম্য অট্টালিকার এক আশ্চর্য নগরী লাহোর। এর পাশ দিয়ে স্বচ্ছ জলের যে নহর বইছে, তার দু’ধার বৃক্ষশোভিত। অজানা ফুলের ঘ্রাণ পথিকের মন মাতোয়ারা করে। মরিয়ম পাঠ্যবইয়ে শালিমার বাগের ছবি দেখেছে। এর সারি সারি ঝাউবীথির পাশে যে ফোয়ারা, তার কোল ঘেঁষে টাইট কামিজ, চুড়িদার পরা মেয়েরা পায়রার মতো ঘুরে বেড়ায়। মাথার তালু ঘিরে এক ফালি দোপাট্টা সোহাগ করে গলা জড়িয়ে রাখে। তবে নিউজপ্রিন্টের ছাপার সাদা-কালো মুখগুলো স্পষ্ট হয় না। এসব অস্পষ্ট চেহারার একজন মরিয়মের মনে হয়-মেজর ইশতিয়াকের স্ত্রী। মেজর বলে, সেই মেয়েটি এখন ফুলবাগিচা-বেষ্টিত এক সুরম্য অট্টালিকায় বাস করে, যেখানে একদা এক সুখী রাজপুত্র তার স্বামী ছিল। যুদ্ধ লাগার পর স্বামীটিকে চলে যেতে হয় বাংলামুলুকে। সেখানে সম্মোহনী চোখ আর কালো কেশরাশির বিরল প্রজাতির নারীদের বাস। তারা জাদুকরী। তাদের মোহিনী রূপ সেই কোন কালে মেজর ইশতিয়াকের পূর্বপুরুষদের বশ করেছিল, সেই লোকগুলো পশ্চিম ভারতের রুখুশুকু, লাবণ্যহীন নারীদের কাছে আর ফিরে আসেনি। সেখানেই থেকে গিয়েছিল। স্বামী হারানোর বেদনা এ মহিলারা ভুলতে পারেনি, বংশপরম্পরায় আজও তা বয়ে বেড়াচ্ছে।

মেজর ইশতিয়াকের বুকপকেট থেকে বেরিয়ে আসে গোলাপি লিপস্টিক রঞ্জিত ঠোঁট, সরু আঁকা জ্বর এক ভয়ার্ত নারী। চিঠিতে যে বারংবার স্বামীকে চরিত্র ঠিক রাখার কসম খাওয়ায় আর অনবরত ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। খান্দান রক্ষার্থে সে আত্মঘাতিনীও হতে পারে, যদি জানে যে, তার খসম জাদুটোনার খপ্পরে পড়ে কালো কালো বাঙালি নারীর শাড়ির আঁচল ধরা হয়ে গেছে এবং ঠিকমতো যুদ্ধ করছে না। মেজরের স্ত্রী জর্জেটের স্বচ্ছ ওড়নার ফাঁক দিয়ে বারো শ’ মাইল দূর থেকে ঘৃণা আর অবিশ্বাস নিয়ে মরিয়মের দিকে তাকায়। জাদুকরীর তাতে ভাবান্তর হয় না। সে তখনো এসব হিসাব-নিকাশের বাইরে। তা ছাড়া মানুষের জীবনই যেখানে মিথ্যা, সেখানে একটা ফটোর মূল্য কী। কিন্তু ছবিটাকে উপলক্ষ করে কদিন পর প্রেমিক-প্রেমিকার মনে ভাটার টান লাগে। জোয়ারের ঢেউগুলো বিষাক্ত শৈবালের মতো তাদের শুকনো বেলাভূমিতে আছড়ে ফেলে ক্রমে দূরে সরে যায়। কী আশ্চর্য! মরিয়মের হঠাৎ হুঁশ ফেরে, খুনি-ধর্ষক লোকটাকে নিয়ে গত কয়েকটা দিন সে মাতোয়ারা ছিল! যার বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানও রয়েছে! যে তাকে বিশ্বাস করে না পর্যন্ত! তালাবন্ধ ঘরে রাতদিন আটকে রেখেছে। লাল গোলাপ, সিল্ক শাড়ি, গজল–সব মেকি আর প্রেমটা হচ্ছে চাতুরী। সত্য যে, লোকটা তাকে ভালোবাসে না, সে তার জন্ম-জন্মান্তরের শত্রু।

এদিকে মেজর ইশতিয়াক মনে করে বাঙালিরা মানুষ না–প্যাট, পোষ্য, বিড়াল স্বভাবের। আশপাশে মিউমিউ ডাক ছাড়বে। কোলে বসে চোখ বুজে দোল খাবে। কিন্তু সুযোগ পেলে আঁচড়টা-খামচিটা দিতে ভুল করবে না। মেজরের দুঃখ যে, ইংরেজদের মতো তারা সঠিকভাবে দেশটা শাসন করতে পারেনি। তাই দুই শ বছরের জায়গায় চব্বিশ না পেরোতেই দুর্ভোগের একশেষ। আত্মসমালোচনাটা মেজর ইশতিয়াক এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করে। তাই বন্ধুমহলে উদারনৈতিক হিসেবে তার খুব নামডাক। মরিয়মকে একদিন ‘আর ইউ হিন্দু অলসো?’ মেজর ইশতিয়াক দুম করে প্রশ্নটা করে বসে। এ প্রশ্নের কী জবাব দেওয়া যায়? হিন্দু বললে মেজর তাকে মেরে ফেলবে? মলিনা গুপ্তের স্বামী, শ্বশুর, ভাশুর, আর শোভা রানীর স্বামীর মতো?

মরিয়ম মুসলমান শুনেও মেজর ইশতিয়াকের রাগ পড়ে না। বাঙালি মুসলমান আবার মুসলমান নাকি! হিন্দুরা তাদের কাফের বানিয়ে ফেলেছে। মুসলমান ভ্রাতৃত্বের মাঝখানে সুকৌশলে ছুরি চালিয়ে দু’ফালি করে দিল শালার মালাউনরা। ব্লাডি ওয়ারের একটা ভালো দিক মেজর মনে করে, তারা হিন্দুদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিলম্বে হলেও নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছে। বাকিগুলো এখন ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরায় ধুকে ধুকে মরছে। ওই নরক থেকে কাফেরগণের আর ফিরতে হবে না।

এদিকটা বাদ দিলে সত্য যা–মেজর ইশতিয়াকের যুদ্ধ করতে আর ভালো লাগে না। সে ক্লান্ত। শত্রুপক্ষের সৈন্যদলের সঙ্গে লড়াই করলে জয়-পরাজয় থাকে। কিন্তু নিরস্ত্র সিভিলিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা, তার মনে হয় একই ব্যাপার। এর শুরু আছে, শেষ নেই।

অবশেষে আসল যুদ্ধটা ঘোষণা দিয়ে শুরু হলো। জন্মাবধি একে অপরের শত্রু–পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান আবারও পরস্পরের মুখোমুখি। এবার কাশ্মীর বা রান অফ কাঁচ নয়-বাংলা। পশ্চিম সীমান্তে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার খেলা যখন চলছে, পূর্বে যুদ্ধটা ঝড়ের আকার ধারণ করে। ঝটিকা ঝড়, যার মেয়াদ মাত্র বারো দিন। জেনারেল ব্যাঘ ওরফে নিয়াজির তখত টলে ওঠে, গর্জন থেমে যায়, ভূগর্ভস্থ কক্ষে অস্থির পদচারণা শুরু হয়। সেখানে নিরাপদবোধ করার কোনো কারণ ছিল না। কেননা দেয়ালের মানচিত্রের তিরচিহ্নগুলো একই সঙ্গে নির্দেশ করছে পাকিস্তানিদের পশ্চাদপসরণ আর ভারতীয়দের অগ্রযাত্রা। টেলিফোন, বেতারযন্ত্র মারফত একের পর এক তার অধস্তনদের পথ হারানোর, আত্মসমপর্ণের, ডুবে মরার খবর আসছে। অথচ পশ্চিম অর্থাৎ কেন্দ্র নির্বিকার।

মেজর ইশতিয়াকরা শক্ৰবেষ্টিত। এই অবস্থায় ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে ইস্টার্ন কমান্ডের নির্দেশ আসে-শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কেজুয়্যালটির আগে ডিফেনসিভ পজিশন ছেড়ে কেউ পালাতে পারবে না। নির্দেশটা মৃত্যুর পরোয়ানা। ভূগর্ভস্থ নির্দেশটিকে মেজর ইশতিয়াক বিচার করে বাস্তবতার নিরিখে। শত্রু জল, স্থল, অন্তরীক্ষ–সর্বত্র বিরাজমান। এ অবস্থায় যুদ্ধ নিরর্থক, পালানো কাপুরুষতা। তারপর বাকি থাকে মৃত্যু। ‘মুজে মাফ কর্‌ দো’ বলে ভারতীয়দের বোমাবর্ষণের মধ্যে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মরিয়ম হতভম্ব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শোনে দরজায় তালা লাগানোর ঝনঝন আওয়াজ। ‘এই, এই কী হচ্ছে? প্লিজ লেট মি ফ্রি, আই বেগ ইউ!’ সে দৌড়ে যায় দোর পর্যন্ত। বাইরে থেকে তখন জবাব আসে, ‘অর্ডার নেই।’

১৪. উদ্ধার পর্ব

তালা ভেঙে মরিয়মকে যারা উদ্ধার করে, অকুস্থলে পৌঁছাতে তাদের আরো চার দিন বাকি। পাকিস্তানি ট্যাংক আর যৌথ বাহিনীর ট্যাংক তখন সামনাসামনি মোকাবিলা করছে। ট্যাংকের ওপর গোলমতন ফাঁকা জায়গায় গ্রেনেড চার্জ করছে মুক্তিবাহিনী। প্রথমটা ছুঁড়ে দেওয়ার পর যখন বাস্ট হলো, ‘হা-হা-হা’ মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম হাসতে হাসতে মুক্তিকে বলে, ‘তখন খুব আনন্দ পালাম।’ তারপর দুপাশে মাথা নাড়ে, ‘এ বলা যায় না তো–এ ছিল স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ।’ সেদিনের ট্যাংক ফাইটে তাদের ছয় থেকে সাতজন ছেলে মারা যায়। পরেরটা বাস্ট হলো কি না, কাজটা চুরি চুরি করে করা হচ্ছে বলে রফিকুল বলতে পারবে না। তবে দ্বিতীয় দিনে তারা অনেক দূর অ্যাডভান্স করে। তৃতীয় দিনে তারা আরো অ্যাডভান্স করে। কমান্ডিং অফিসার শুধু অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন–অ্যাডভান্স। গুলির বৃষ্টিতে তারা ঢুকে পড়েছে। জীবনের পরোয়া নেই। তখন মুক্তিযযাদ্ধাদের কাছে রিপোর্ট এল, ‘পাকবাহিনী ভাইগ্যা যাচ্ছে। ওরা পালাচ্ছে। এদিকে ফায়ার চলছে। পেছনে আর্টিলারি। আর্টিলারি সেল নিক্ষেপ করে যথারীতি অপারেশন পার্টিকে কাভার দিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাডভান্স করছে। চারপাশের গ্রাম দেখতে পাচ্ছে তারা। আশপাশের গ্রামের মানুষ গরুগাড়ি করে, পায়ে হেঁটে সরে যাচ্ছে। তাদের আগে আগে পাঞ্জাবিরাও যাচ্ছে। পালাচ্ছে।

চতুর্থ দিন সকালবেলা একটা খোলা জিপে করে রফিকুল ইসলামরা শহরে ঢোকে। তাদের জিপের এক সাইডে ফিট করা মেশিনগান, অন্য সাইডে এলএমজি। শহর একবারে ফাঁকা। পাকিস্তানি সৈন্যরা আগেই পালিয়েছে। কোনো লোকজনও নেই। রাস্তার কুকুরগুলো পাগলের মতো এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের জয় বাংলা ধ্বনি আর ব্ল্যাংক ফায়ার চারদিক থেকে শুরু হয়ে গেছে। রফিকুলদের গাড়িটা চালাচ্ছিল সিক্সথ বেঙ্গলের একটি ছেলে। নাম স্বপন। পাশের সিটে আর পেছনে স্টেনগান হাতে ওরা পাঁচজন। একজন হলো রুস্তম আলি, যাকে ’৭৩ সালে মহররমের আশুরার দিন কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি গুলি করে হত্যা করে। সে জাসদের গণবাহিনী করত। আরেকজন ছিল কালো হ্যাংলা মতন, নাম সিরাজ। কমিশনার সাহেবের মেয়ে সে বিয়ে করেছে। এখন কন্ট্রাকটরি করে। পরের জন সুধীর, শহিদ সুধীর পাল, পরদিন নারকেলবাড়িয়ার যুদ্ধে সুধীর শহিদ হয়। এখন জেলখানার দিকে যেতে যে সাদা একতলা বাড়িটা, এর মালিক আগে স্টেশনমাস্টার ছিল, পরে ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে কাজ করত, তার মেজো ছেলে, কোনো এক ব্যাংকের এখন ডিরেক্টর, সে ছিল রফিকুলদের দলের চতুর্থ ব্যক্তি। আর রফিকুল নিজে হচ্ছে একজন প্রাক্তন ব্যবসায়ী। ব্যবসায় লাল বাত্তি জ্বলে উঠলে রাস্তার ওপরের দোকান বেচে দিয়ে, দোকানের পেছনের নামায় একটা ছাপরা মতন ঘর বেঁধে থাকে। তার কথামতো, এখন মদ না খেলে রাতে ঘুম হয় না।

পাঁচজনের দলটা একটা ভোলা জিপ নিয়ে সেদিন বন্দি মানুষদের উদ্ধারে নেমে পড়ে। তারা জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে প্রথম জেলখানার দিকে যায়। জেলের তালা ভেঙে ছোটে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। মরিয়ম বলে, ‘সকাল থেকে খালি কানে আসতেছে জয় বাংলা স্লোগান। সারা দিনই জয় বাংলা স্লোগান শুনছি। গোলাগুলির শব্দও দূর থেকে ভেসে আসছে।

মেজর ইশতিয়াক চলে যাওয়ার দিন থেকে মরিয়ম না-খাওয়া। এই চার দিনে এক বেলাও খাবার জোটেনি। বাথরুমের কল ছেড়ে দু’দিন শুধু পানি খেয়েছে। তারপর কলেও পানি নেই। পানি-বাতি সব বন্ধ। জিব দিয়ে ঠোঁট চাটতে গেলে জিব। জড়িয়ে আসে। খিদা-তৃষ্ণার বোধটা ধীরে ধীরে শরীর থেকে চলে যাচ্ছিল। এই বুঝি শেষ, না-খেয়ে মরতে হবে। এই অবস্থায় জয় বাংলা স্লোগানটা আরো নিকটে এলে, মরিয়ম বলে, ‘তখন যে কী অনুভূতি হচ্ছিল তা ভাষায় বোঝাতে পারব না। আরে আল্লা, আমরা তাইলে বেঁচে গেছি, বোমার আঘাতে বা না-খেয়ে আমাদের আর মরতে হবে না!’ শরীরে তখন অসুর ভর করে। ‘ও বাবা, ও ভাই’ চিৎকার করে করে মরিয়ম তখন দরজায় লাথি মারছে। বাইরে থেকেও চিৎকার আসে, ‘ও মা, ও বুইন আমরা আসছি, আমরা আসছি। মা-মা, এই যে আমরা আসছি, এই যে আমরা আসছি।’

আঁচলে চোখ মোছে মরিয়ম, ‘কান্না পায় কথাগুলো মনে পড়লে। এত বছর পর কান পাতলে আজও শুনি মা-মা চিৎকার করে ওরা আসছে।’ মরিয়ম যে কোনোদিন জীবিত সন্তানের মা হতে পারল না, দূর থেকে ভেসে আসা ওই মা-মা চিৎকারটা ওর কষ্ট এখন আরো বাড়িয়ে দেয়। তখন কত আশা ছিল, মেজর ইশতিয়াক পালিয়ে গেছে–যাক, দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিবাহিনী এগিয়ে আসছে তাদের উদ্ধার করতে।

‘আমরা তো পাগলের মতো একটার পর একটা তালা ভেঙে আগুই যাচ্ছি।’ রফিকুল বলে, ‘কতগুলি বিদগুটে চেহারার মেয়েছেলে পিলপিল করে বেরিয়ে আসলো। সারা গায়ে ঘা। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েছে। শরীরে এক ফোঁটা গোশত নেই। একেকটা কঙ্কাল। তখন ওদের মানুষ বুইলে মনে হতো না। হাফম্যাড। কাপড় বলতে এদের যা ছিল, এ তো ভাষায় বলা যাবে না! এরা মনে হয় যোনিদ্বারটা শুধু ঢাইক্যা রাখছিল।’

কিন্তু সিল্ক শাড়ি? খোঁপায় লাল গোলাপ? দেয়ালে তৈলচিত্র? মেঝেতে হারমোনিয়াম-তবলা? কোথাও একটা গোলমাল হয়েছে। রফিকুল যাদের তালা ভাঙার পর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছে, তারা অন্য কেউ, সেখানে মরিয়ম ছিল না। মুক্তি তার সন্দেহের কথা জানালে একটানে হাঁটুর ওপর শাড়ি তুলে ডান পায়ের ক্ষতস্থান দেখায় মরিয়ম। ‘দেখতে চাও? আরো দেখাই,’ বলে যখন সে ব্লাউজ খুলতে যাচ্ছিল, মুক্তি বাধা দেয়। ‘তোমাকে যে বলেছে মিথ্যা বলেছে,’ মরিয়ম রাগে কাঁপতে থাকে। ‘ওরা তখন আমাদের দ্যাখবে কেন? নজর তো অন্যদিকে। আমরা হলাম গিয়ে বাসি, মিলিটারি আমাদের ইজ্জত মারছে। গায়ে খোঁচা খোঁচা দাগ। রক্ত, গন্ধ। আমাদের এরা চিনবে কেন?’ রেগে হড়হড় করে একসঙ্গে এতগুলো কথা বললেও সিল্ক শাড়ি, লাল গোলাপ, তৈলচিত্র, হারমোনিয়াম-তবলা নিয়ে একটি কথাও আর বলে না মরিয়ম। রফিকুলকে দেখানোর জন্য তার কাছে ছবি চাইলে হালের একটা পাসপোর্ট সাইজের সাদাকালো ছবি দিয়ে মুক্তিকে বিদায় করে। বাইশ বছরের তরুণীকে যে দেখেছে, সে বায়ান্নতে তোলা ছবি দেখে তাকে চিনতে পারবে?

হারিকেনের ঘোলা আলোয় সাদা-কালো ছবিটা চোখের সামনে মেলে ধরে রফিকুল। ‘এহ্‌ হে, এ তো বুড়ি! আমরা যাদের তালা ভেঙে বের করে দেছিলাম, ওরা সব মোলো-সতেরো বচ্ছরের ছুঁড়ি ছেল। তয় ঘিন্না লাগত ওদের দেখলে।’

‘আপনেও তো বুড়া।’ বলে মুক্তি ছবিটা ফিরিয়ে নিতে হাত বাড়ায়। রফিকুল তার হাত সরিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে ছবিটা। একদিন আবেগের বশে তালা ভেঙে যাদের বের করেছিল, তারা কোথায় গেল, কী করল, বেঁচে আছে না মরে গেছে, মাঝখানে এতগুলো বছর, কোনো দিন খোঁজ নেওয়া হলো না। সে নিজেও একজন মেয়েটি বলল, ‘বুড়া’। লিভার পচে গেছে। আজ আছে কাল নেই। রফিকুলের মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অনেকগুলো মুখের ভেতর একটা মুখ। যার গালের মাঝখানে একটা আঁচিল ছিল গোলাপি রঙের, সাদা-কালো ছবিতে যদিও বোঝা যাচ্ছে না, এ কি সেই? মুক্তি সায় দিতে লোকটা হে-হে করে হাসতে থাকে। ‘গালে আঁচিল একটা মেয়ে বেরুইয়ে পানি খাতি চাইল। আমরা পানি দেলাম। বাড়ি কোথায় বলল না। খালি কইল, ঢাকাত থ্যে বাড়ি যাচ্ছিল, পথে ধরা পড়ছে। তখন এ খুব রোগা ছিল। এখন দেখি গায়ে গোশত হয়েছে–হে-হে-হে।’

‘পরনে কী শাড়ি ছিল? সিল্ক শাড়ি?’

‘শাড়ি-টাড়ি কিছু ছিল না। ও-ওই রহমই। হাফম্যাড। পরে, অনেক বছর পরেও রাতে ঘুম ভাঙলে ওই চেহারা কয়ডা মনের পর্দায় ভেসে উঠত।’

‘ঘরের মধ্যে কি হারমোনিয়াম-তবলা বা দেয়ালে পেইন্টিং ছিল?’

‘কে কয়? যে ব্যারাকে এদের আটক রাখছিল, তা একটা নোংরা-ময়লা ঘর। নয় মাস ঝাড় পড়ে নাই। এর মধ্যে হাফম্যাড–পাগলের মতো মেয়েটা বইসে ছেল।’

‘তো আপনি প্রথম তাদের হাসপাতালে নিলেন, না সামনের ইস্পাহানি স্কুলে?’

‘হাসপাতালে কারে নেয়া হচ্ছে, কারে নেয়া হচ্ছে না…’

‘ইস্কুল ঘরে?’

‘ইস্কুল ঘরে কারে নেয়া হচ্ছে, কারে নেয়া হচ্ছে না…’

রফিকুলের গ্লাস খালি। কথায় বিরতি দিয়ে কাজের ছেলের কাছে সে ইনিয়ে বিনিয়ে আরেকটু মদ চায়। তারপর ফের শুরু হয় কথাবার্তা, ‘কথা হইল গে ওই সময় সৈনিকের দুটো মন থাকে। একটা মন থাকে মানুষরে উদ্ধার করার জন্য, আরেকটা মন থাকে শত্রুরে মারার জন্য। মানুষ তো খালি মদ খেয়ে মাতাল হয় না! যারা জীবন্ত মানুষ গুলি করে মারে, ওরাও মাতাল।’

গ্লাসের তলানিটুকু গলায় ঢেলে রফিকুল বলে, ‘আমি যত পুড়ি ততই আমার ভালো লাগে। হা-হা-হা।’

পাকিস্তানি মিলিটারি তখন পালাচ্ছে। যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি। রফিকুলরা শুধু তালা ভেঙে দিয়েছে। হাসপাতালে কাকে নেয়া হচ্ছে, কাকে নেয়া হচ্ছে না, ইস্কুল ঘরে কাকে নেয়া হচ্ছে, কাকে নেওয়া হচ্ছে না–সেসব দেখা তাদের কাজ না। যুদ্ধ করার জন্য মাতালের মতো অবস্থা তখন তাদের। এ সময়ে কমান্ডারের নির্দেশ আসে–অ্যাডভান্স! সামনে বাড়ো!

১৫. সারেন্ডার সারেন্ডার, একটি জরুরি ঘোষণা

মেজর ইশতিয়াকের দলটা শত্রুর তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে। পলায়নবৃত্তি কাপুরুষতা, তবে মৃত্যুর চেয়ে ভালো।

ব্যারাক ছাড়ার আগে মেজর ইশতিয়াকরা সাদা আর হলুদ মিত্রদের জন্য অপেক্ষা করে। তারা আকাশের দিকে তাকায়, সাগরের ওপর চোখ রাখে। শূন্যের রং নীল, সাগরেরও তাই। চীনা বা আমেরিকানদের এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। রং শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। তাতে অযথা কালক্ষেপণ হয়। অবশেষে মাকড়সার জালে বন্দি মাছির মতো ভনভন করতে করতে রাতের অন্ধকারে একটি নদীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। উড়োজাহাজ থেকে দেখা রুপোলি সর্পিল জলাধার, তীরে নোঙর করা সারি সারি গানবোট–যেগুলো পদ্মার ওপর দিয়ে কুলচিহ্নহীন মেঘনার মোহনা পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দেবে। তারপর সাদা পতাকাবাহী জাহাজে চেপে বিক্ষুব্ধ সাগরের তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাবে এমন এক নিরাপদ বন্দরে, যার জেটিতে স্ত্রী-সন্তানেরা চোখে জল আর হাতে রুমাল নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু দিনশেষে রাত নামে। শুকনো খাল-বিল ছাড়া কিছু নজরে পড়ে না। নদীগুলো যেন যুদ্ধাক্রান্ত জনগোষ্ঠী, তাদের বুটের আওয়াজে দ্রুত পালাচ্ছে। অগত্যা সমুদ্রপথে পলায়নের পরিকল্পনাটা বাতিল হয়। কিন্তু শত্রু পেছনে রেখে ডাঙায় টিকে থাকা কঠিন, বিশেষ করে এমন এক জনপদে, যেখানে তুমি কারো সাহায্য আশা করতে পারো না। স্থানীয় লোকজন সামনে পেলে শিয়াল-কুকুরের মতো পিটিয়ে মারবে। শত্রু অঞ্চলে একটা বিচ্ছিন্ন দলের বাঁচার উপায় তারা স্টাফ কলেজের প্রশিক্ষণকালে পাতানো যুদ্ধের মাধ্যমে শিখেছিল। কিন্তু বাস্তবটা অন্যরকম। দিনে গা-ঢাকা দেওয়ার যে জনপ্রাণীহীন ল্যান্ডস্কেপ থাকার কথা, সে রকম কিছু কোথাও নেই। রাত কাটে খেতের সবজি চুরি করে, অনিদ্রায়, আতঙ্কে। পাতার খসখস আওয়াজ, ব্যাঙের ডাক, শিয়ালের খকখক হাসি শুনে তারা বন্দুকের ট্রিগার টিপে ধরে। এর মধ্যে এক রাতে সবজি চুরি করার সময় এমন এক অঘটন ঘটে, যা সেই গাঁয়ের লোক গর্ব আর শোকের স্মৃতি হিসেবে যুদ্ধের বহু বছর পরও মনে রাখবে এবং যে-কোনো আগন্তুকের কাছে তারা তা বয়ান করবে। তাতে মর্সিয়ার মাতম সহযোগে কারবালার কাহিনি শোনাবেন এক বৃদ্ধ। যার বয়সের গাছপাথর নেই।

সেদিনের ঘটনার শুরু বর্তমান মুদি দোকানদার ইব্রাহিম বিশ্বাসকে দিয়ে।

ইব্রাহিমের বয়স তখন দশ। অবেলায় খেজুরের রস খেয়ে তার পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। ভোররাতের দিকে পেটে মোচড় দিতে সে একাই বাড়ির নামায় গিয়ে বসে। নিজেকে খালাস করে বসাবস্থায় অদূরের সবজির মাঠে আয়েশ করে তাকায়। আমি ছোট্ট এইখানি তো, সামনের একটা ন্যাংটা বাচ্চাকে দেখিয়ে মুক্তিকে বলে ইব্রাহিম, ‘ভাবিলাম মুলো খেতে বুঝি শেয়াল পড়িছে। ঝাঁকে ঝাঁকে শেয়াল। আগে ইব্রাহিমদের গাঁয়ে মানুষ মরলে শিয়াল ডাকত। তখন যুদ্ধের বছর, হরবখত মানুষ মারা যাচ্ছে। রাতের প্রহরে প্রহরে শোনা যায় বজ্জাতগুলির হুঙ্কুতি আর হুক্কা হুয়া হাঁকডাক। খালে বিলে এত মরা থাকতে, ইব্রাহিম অবাক হয়ে ভাবে, ‘সবজি খেতে তেনারা মুলো খাইতে আসিছে কেন।

মুলাখেতের পাশেই লঙ্কার আবাদ। আর ওখানেও শিয়াল। শিয়ালগুলো বড় বড়, সংখ্যায় মনে হয় কয়েক গন্ডা। ইব্রাহিমের ধন্ধ লাগে। এ তো শিয়াল নয়, মানুষ-ছপছপ করে পাতাসুদ্ধ মুলো খাচ্ছে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। তার আর পুকুরঘাটে যাওয়া হয় না। পরনের হাফপ্যান্ট পতাকার মতো মাথার ওপর নাচাতে নাচাতে সে বাপজানকে গলা ফাটিয়ে ডাকে। যতটা জোরে ডাকলে মানুষের ভয় পালায় ঠিক ততখানি গলা ফাটিয়ে। বাপ বেরিয়ে এলে সে ‘মুলো খেতে শেয়াল পড়িছে’ বলে, বলে না যে মানুষ। কারণ মানুষ বলতে তখনো তার গা ছমছম করছিল। যা হোক যুদ্ধের দিন, লোকজন ঘুমালেও কান দুটি জেগে থাকে। বাপবেটার চিল্লাচিল্লিতে পাড়াপড়শির ঘুম ভেঙে যায়। তারা দলে দলে বেরিয়ে আসে হাতে লাঠিসোটা নিয়ে। ততক্ষণে ভোরের কুয়াশা কেটে গেছে। সকাল হয় হয়। তবু তারা খেতে পাকসেনাদের ছোটাছুটি করতে দেখে শিয়ালই ভাবে, মানুষ ভাবে না। কারণ বাজারের ক্যাম্প ভেঙে দু’দিন হয় পাক আর্মি চলে গেছে। বিহারিরা সপরিবারে গেছে তাদের পেছন পেছন। রাজাকাররাও লাপাত্তা। এ অবস্থায় খেতে শিয়াল নয় তো কী। দেখতে-শুনতে বা আচার-ব্যবহারে ভোরের আলো-আঁধারে এদের শিয়াল বলেই গণ্য হয়। তেনারাও মানুষজন দেখে শেয়ালের মতো লেজ দুলিয়ে নাইচতে লাগিছেন, ইব্রাহিমের কথার মাঝখানে বলে ওঠে ঘটনার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী ওসমান গনি। অবশ্য বিষয়টা তখন আর ইব্রাহিমের একার থাকে না। প্রাপ্তবয়স্কদের এখতিয়ারে চলে। যায়। তারা হাতের লাঠিসোটা নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধের যেন শেষ নেই। আর ফসলের খেতগুলোও মনে হয় কারবালার ময়দান। ওসমান গনি কাহিনির এই জায়গায় কথা বন্ধ করতেই একজন বৃদ্ধ নিচু স্বরে কারবালার গীত গেয়ে ওঠেন। এ যেন আগে থেকে রিহার্সেল করা–কথা থামলে গান শুরু হবে। চোখ বুজে বৃদ্ধ গাইছেন–

কারবালারো কথা কইতে যায় গো হৃদয় ফাটিয়া
কান্দে মায়ে বাচ্ছা কোলে লইয়া।
নবীর বংশ ধ্বংস হইল শুধু পানির লাগিয়া
কান্দে মায়ে বাচ্ছা কোলে লইয়া।

জমায়েতটা ইস্পাতের মতো স্থির। বাতাসের কম্পন কখন যেন থেমে গেছে। মুক্তি তাকিয়ে দেখে, বৃদ্ধের ভাঙাচোরা দেহটা দু’হাঁটুর মধ্যিখানে। শোকে তিনি মোহ্যমান। গান শেষে তার স্বল্প কেশের মাথাটা নুয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সে বৃদ্ধের বয়স জানতে চাইলে গাঁয়ের কেউ সঠিক বলতে পারে না। গাঁয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি ওসমান গনি জানায়–সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর সাগর উপকূলের এক গ্রাম থেকে নিঃস্ব অবস্থায় বৃদ্ধ এখানে আসেন। তার পরনে ছিল ছেঁড়া তবন, গায়ে তাপ্লিমারা ফতুয়া আর বগলে খান কয়েক জীর্ণ পুঁথি। এসে বললেন, সংসারে জনমনুষ্যি কেউ বেঁচে নেই। সাগর টেনে নিয়েছে। নোনা পানি বৃদ্ধের হাড়মাস খেয়ে ফেলেছিল। চামড়াও নুন-পোড়া। এসেই ঘড়া ঘড়া পুকুরের পানি একেক টানে যখন খেয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে আজকের মতোই। শীতের শেষে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। তখন কারবালার কাহিনি শুনিয়ে শুনিয়ে বৃদ্ধ কমলগঞ্জের মানুষদের আসন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে প্রস্তুত করেন। জনে জনে তিনি বলেন যে, বিক্ষুব্ধ সাগরের মতোই যুদ্ধ। তা ধ্বংস করে, আপনজনের মৃত্যু ঘটায় আর সয়সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা অন্ধ-বড়লোক ছোটলোক মানে না, নারীদের উলঙ্গ আর বেইজ্জত করে। যুদ্ধশেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফরসা চেহারার শহুরে বা ভিনদেশি মানুষেরা খাদ্য-খাবার, ক্যামেরা নিয়ে আসে। নিজেরা সঙ্গে আনা বোতলের পানি খায়, সেই পানিতে ভাগ বসাতে দেয় না। খাদ্য কম্বল বিতরণ করে ছবি তুলে চলে যায়।

বৃদ্ধের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। অকারণে এত মৃত্যু, তা-ও আবার সমুদ্রের আক্রোশে নয়, মানুষের ষড়যন্ত্রের ফলে, এ শোক স্বজনহারা মানুষ সামলাবে। কী করে! তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বৃদ্ধকে তারা যেতে দেয়নি। সেই থেকেই তিনি আছেন। তার গানের বিষয়ও একটা কারবালা। যখনই একাত্তর নিয়ে কথা ওঠে, তিনি তাদের কারবালার কাহিনি শোনান। কাজটা অনিয়মিত। তবু এর বিনিময়ে তাকে তারা দু’বেলা খেতে দেয়। খুব সামান্যই তিনি আহার করেন। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে তাকে খাওয়াতে তাই তাদের অসুবিধা হচ্ছে না। এরপর গ্রামবাসীর বক্তব্য শেষ হলে বৃদ্ধ ‘হায় গো দুলদুল’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যান, যা তাদের রিহার্সেলের অংশ বলে মনে হয় মুক্তির ।

ওসমান গনি জানায়, সেদিন দুপুরের আগেই উভয় পক্ষের চারটা লাশ পড়ে। সৈন্য যদি মরে একজন, গাঁয়ের লোক মারা যায় তিনজন। কারণ সৈন্যদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র । গাঁয়ের লোকজনের সম্বল বলতে লাঠিসোটা আর ঘৃণা। তা-ই দিয়েই তারা লড়ে যাচ্ছিল। দুপুরের দিকে রণকৌশলে কিছুটা রদবদল হয়। যারা খেত-খামারে যুদ্ধ করছিল, তারা পিছিয়ে আসে। কয়েক গাঁয়ের লোক টেটা-বল্লম হাতে সৈন্যদের ঘিরে দাঁড়ায়। বৃত্তটা দ্বিতীয় দিনে ছোট আর আকারে হয় গোল। সৈন্যরা গুলি চালাতে চালাতে বৃত্তের কোনা ভেঙে বেরিয়ে গেলে তাদের সেদিনের গুলিবর্ষণে শহিদ হন ইব্রাহিমের বাবা ইসমাইল।

পাকসেনাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র যতই থাকুক লোকবল তো কম। তারা মোটে বিশ পঁচিশ। এদিকে গ্রামবাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় হাজার হাজার। উপায়ান্তর না দেখে পাকসেনারা বাজারের মসজিদে ঢুকে দোর আটকে দেয়। গুলির মুখে গাঁয়ের লোকজনের মসজিদের দরজা ভাঙার সাহস হয় না, তবে তারা সরেও যায় না। জায়গাটা ঘিরে রাখে। ততক্ষণে আশপাশের পাঁচ ছ’ গাঁয়ের নর-নারী, ছেলে-বুড়ো সবাই যুদ্ধে শরিক হয়ে গেছে। তারা গায়ের যোদ্ধাদের জন্য ডালা ভরে খই-চিড়ে আর মাটির মটকায় করে গুড় নিয়ে আসে। তেষ্টা নিবারণ হয় মসজিদসংলগ্ন পুকুরের পানিতে। হায় গো কারবালার যুদ্ধ!’ ভিড়ের মধ্য থেকে বৃদ্ধের কণ্ঠ ফের ভেসে আসে। ফোরাতের পানি রক্তে ভাইস্যে গেল, তবু যুদ্ধ থামল না।’ এটুকু বলে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণের পর পুনরায় পুঁথির ভুবনে ঢুকে পড়েন বৃদ্ধ। তার মাথাটা হাঁটুর বেশ খানিকটা ওপর। ভঙ্গুর দেহটা সাপের মতো দুলছে যেন কোনো। এক অদৃশ্য সাপুরের বাঁশির সুরে সুরে–

এই কথা শুনিয়া রে কাশেম জ্বলিয়া উঠিল
ছাগলের পালে যেমন বাঘ ঝাঁপ দিল।
কলার বাগিচা যেমন হাতিতে লুটায়
দুই হাতে তলোয়ার লইয়া অমনি কাটে ভাই।

মুক্তির মনে হয়, সবাই যেন ইতিহাসের যোদ্ধা–প্রাণপণে শত্রুর মোকাবিলা করছে। আর বৃদ্ধ তাদের গানে গানে বলে যাচ্ছে, তোমরা অনর্থক কালক্ষেপণ করিয়ো না। পুকুরের পানি শুকিয়ে তলায় লেগে গেছে। আচমকাই তার চোখে নামে বিষাদের কালো ছায়া। সেখানে শুধুই শোক, বহু বছর আগেকার এক বালক যোদ্ধা কাশেমের জন্য। ঘরে যার সদ্য বিয়ে করা বালিকা বধূ সখিনা। যোদ্ধা নিজে তিরবিদ্ধ, জলতেষ্টায় কাতর। ভূমিতে পড়ে ছটফট করছে। বৃদ্ধের কণ্ঠে ঝরনার মতো ঝিরঝিরিয়ে বিষাদের সুর নামে।

ইব্রাহিমের মা মদিনা বিবিসহ অন্য বিধবারা শুরু থেকেই পুকুরপাড়ে। মাঠে ময়দানে পড়ে থাকা লাশের কাছে কেউ নেই। মহিলাদের ভাবখানা এমন, মসজিদের শত্রুরা নিহত হলে, তাদের স্বামীরা আপনা হতে জ্যান্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরবে, যেমন করে হাল বাওয়ার পর গোধূলি বেলায় মাঠ থেকে লাঙল-গরু নিয়ে ফিরত। এদিকে মসজিদ ভাঙা ছাড়া শত্রু নিধনের অন্য কোনো উপায় নেই। এ নিয়ে যখন মতভেদ চলছে, তখন স্কুলছাত্র মহিবুলকে দেখা যায় ‘সারেন্ডার সারেন্ডার’ বলে ফসলের মাঠ চিরে দৌড়ে আসতে। সে রেডিওতে জেনারেল মানেকশ’র আত্মসমর্পণের নির্দেশটা শুনে আর দেরি করেনি। মসজিদের কাছাকাছি এসে তোতা পাখির মতো এর পুনরাবৃত্তি করে, ‘ভাইসব তোমরা চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়িছো। আকাশপথ-সমুদ্রপথ বন্ধ। পালানোর উপায় নেই। তোমরা সারেন্ডার করো, নতুবা মৃত্যু। সারেন্ডার করলে জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক তোমাদের প্রতি যুদ্ধবন্দির আচরণ করা হইবে।’

মহিবুলের মুখে জেনারেল মানেকশ’র ঘোষণাটি সবাই ধৈর্য সহকারে শোনে। সারেন্ডার যে মাথার ওপর হাত তোলা, এই নয় মাসে তারা তা শিখেছে। ‘কিন্তু জেনেভা কী রে, মহিবুল?’ মসজিদের বেষ্টনী ধরে রেখে ওসমান গনি গলা তুলে জানতে চায়। ‘জেনেভা হলো গে দেশ, একটা স্বাধীন রাষ্ট্র।’ মহিবুল দম নেওয়ার ফাঁকে গভীরভাবে চিন্তা করে আরো বলে, ‘সারেন্ডার করলি পর তেনাদের জেনেভা দেশে চালান করি দিবে।’

খবরটা শুনে সবার মাথায় হাত। ভারতের এ কেমন বিচার! ‘নয় মাস ধরে জ্বালাল-পোড়াল, খুন করল, ইজ্জত নিল–সাজা হবে না? জেনেভা দেশে পাঠাই দিবে!’

‘জে,’ মহিবুল নিজে যেন ভারতীয় সৈন্য, মৃদুস্বরে অপরাধীর গলায় তা স্বীকার করে।

ওসমান গনি বেষ্টনী ছেড়ে এক লাফে পুকুরের উঁচু পাড়ে ওঠে। রাগে-অপমানে মুখটা তার লাকড়ির চুলার মতো গনগনে লাল। ভায়েরা, শেয়াল মারিছ না তোমরা অতীতকালে!’ সে তর্জনী নাচিয়ে নাচিয়ে বক্তৃতা আরম্ভ করে, ‘গর্তের মুখে ধোয়া দিয়ে মোরা এখন শেয়াল ধরিব–চলো।’ যেই কথা সেই কাজ। বস্তা ভরে লঙ্কার গুঁড়ো এল। শুকনো কচুরিপানা, খড়ের বিচালি, পাটখড়ি, কেরোসিন জোগাড় হয়ে গেল হাতে হাতে। একজন মই বেয়ে উঠে গেল মসজিদের গম্বুজের চূড়ায়। হাতুড়ি, বাটাল, শাবল দিয়ে মসজিদের ছাদ ফুটো করে ফেলল। ছিদ্রপথে দাহ্য পদার্থের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হলো লাল লঙ্কার গুঁড়ো। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠতে থাকলে সেদিন সূর্য ঢাকা পড়ে মধ্যাহ্নেই কমলগঞ্জে নেমে আসে রাতের অন্ধকার।

ধোঁয়া-অন্ধকারের আড়ালে মানুষগুলো ওত পাতে মসজিদের দরজায়। একেকজন সৈন্য মাথার ওপর হাত তুলে সারেন্ডার করে বেরোয় তো, মানেকশ’র ঘোষণা অগ্রাহ্য করে তারা শিয়ালের মতো পিটিয়ে মারে। হত্যার বহ্নি উৎসবে কখন ত্রাণকর্তারা ট্যাংক নিয়ে হাজির হয়েছে, তারা তা দেখতে পায়নি।

দেখেছিল এক বিহারি, মজিদ নাম, ঘটনাস্থল থেকে এক মাইল দূরে। লোকটা ছিটগ্রস্ত। আজগুবি চিন্তায় মাথাটা ভরপুর। অন্য সব বিহারি পাকিস্তান আর্মির পেছন পেছন সটকে পড়লে সে শুধু রয়ে যায় তাদের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাকিস্তানি যোদ্ধারা এইভাবে চোরের মতো পালিয়ে যাবে, চোখের সামনে দেখেও তার বিশ্বাস হয়নি। তাহলে তো আসমানের চান-সুরুজ মিথ্যা হয়ে যায়। তৃতীয় দিনে তার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। মজিদ বিহারি দেশভাগ দেখেছে। বন্দে মাতরম আর নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর-এর মুখোমুখি সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ আর ছোরার ঝলকানির সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। রাতের আঁধারে বিহারের টিলাটক্কর, কাঁটা ঝোঁপড় আর বাংলামুলুকের একাংশ ডিঙিয়ে এপারে চলে আসার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তার আছে। তারপর নয় মাস যাবৎ এত বড় একটা যুদ্ধ গেল, আশ্চর্য যে সে কোনোদিন ট্যাংক দেখেনি। লোকটা ট্যাংক দেখে ভাবে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী বুঝি শক্তিমান যানে চেপে ড় তুলে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসছে। তাদের আগমন মাটি কাঁপানো ভূমিকম্পের মতন। তাতে তার শরীর আবেগে থরথর করে। সে আর বিলম্ব করে না। ‘রোকো রোকো ভাইয়া, হামলোক বিহারি আদমি, তুমহারা দোস্ত!’ ধ্বনি তুলে মজিদ বিহারি কম্পমান মাটির ওপর দিয়ে নতুন হাঁটতে শেখা শিশুর মতো টলতে টলতে দৌড়ে যায় যন্ত্রদানবের দিকে।

দৃশ্যটা দেখেছিল ট্যাংকের ওপর থেকে ইব্রাহিমের বড় বোন মর্জিনার স্বামী আতা মিয়া। মুক্তির ইশারায় সে বসাবস্থা থেকে সিনা টান করে উঠে দাঁড়ায়, নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।’

সেদিন ‘ট্যাংকের ওপর আপনি কী করছিলেন?’ মুক্তির প্রশ্ন শুনে আতা মিয়া থ। যুদ্ধের এত বছর পর, কেউ এমন প্রশ্ন করতে পারে, তার ধারণা ছিল না। সে মনে বেদম চোট পায়। সত্যি, সেদিন ট্যাংকের কমান্ডার, ক্রু বা চালক এসব গুরুত্বপূর্ণ পদের কেউ ছিল না আতা মিয়া। তার থাকার কথাও নয়। তাদের দল তখন মিত্রবাহিনীর ট্যাংকের পথপ্রদর্শক। শত্রু ঠেঙাতে ঠেঙাতে বীরের বেশে স্বদেশে ফিরছে। কিন্তু চোখে-মুখে, শরীরের ভঙ্গিমায় বীরত্বের ভাবটা কিছুতেই ফুটিয়ে তুলতে পারছিল না। ট্যাংকের ইস্পাতের বডিটা পিচ্ছিল আর সামনের দিকটা ঢালু। ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে শরীর পিছলে পিছলে পড়ে যেতে চায় নাক উঁচু ট্যাংকের কনভেয়ার বেল্টের তলায়। এই অবস্থায় হাতের তালুর ওপর ভর রেখে টাল সামলাতে বেশ নাজেহাল হতে হচ্ছিল পথপ্রদর্শকদের। কিন্তু সেসব তো তখনকার কথা। তারপর আতা মিয়া যখনই নিজের গৌরবময় দিনগুলোর কথা ভাবে, তখন একটা নাক উঁচু ট্যাংক ঘড়ঘড়িয়ে তার স্মৃতিতে ঢুকে পড়ে। তখন সে আর দু’কাঠা ধানি জমির মালিক, পেশায় গার্লস স্কুলের দফতরি, ইব্রাহিমদের বাড়ির ঘরজামাই থাকে না। হয়ে যায় ট্যাংকআরোহী-বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার বীজ বপন করতে করতে যে এগিয়ে আসছে। মুক্তির প্রশ্নটা তাই তার স্মৃতির প্রতি হুমকি। যাচাই-বাছাইয়ের সময় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে কলমের খোঁচায় নাম কাটা যাওয়ার চেয়েও বেদনাদায়ক।

সে সময় যুদ্ধের মতিগতি হঠাৎ পাল্টে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তখনো জানে না যে, এবার গেরিলা যুদ্ধ খতম, সামনে আসল যুদ্ধ–একেবারে শত্রুর মুখোমুখি, যার নেতৃত্বে থাকবে মিত্রবাহিনী, আতা মিয়ারা থাকবে পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখা গেল, সামনে হাফ ডজন ট্যাংক। ট্যাংক কমান্ডারের গলায় দুরবিন, মাথায় হেলমেট। ক্রুরা সব ডাংরি পরে ট্যাংকের নিরাপদ গহ্বরে ঢুকে বসে আছে। পথঘাট চেনানোর জন্য দীনহীন বেশের আতা মিয়াদের বসিয়ে দেওয়া হয় অভিজাত ট্যাংকের ওপর। আতা মিয়া ভয়ে তটস্থ। তার মনে হচ্ছিল, তোপের মুখে মিত্রবাহিনী তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ভয়ের চেয়েও বিষয়টা অপমানের। কিন্তু খানিক পর উল্টো দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আসতে শুরু করলে, আতা মিয়া বলে-মারাঠি ট্যাংক কমান্ডার ‘আপনারা নেমে যান, নেমে যান’ নির্দেশ দিয়ে নিজে ঢাকনার নিচে ঢুকে পড়ে। তারপর ঝাং-গুরুম, ঝাং-গুরুম শব্দে গোলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে আসল যুদ্ধটা ট্যাংকবাহিনীই চালিয়ে যায়। আতা মিয়ারা থাকে পেছনে–শোয়া পজিশনে। এই অবস্থায় অর্ডার আসে, পাকিস্তান আর্মি পালিয়েছে, তোমরা এগিয়ে গিয়ে ক্যাম্প দখল করো। দখল আর কী-পোড়া মাটি, ধ্বংসস্তূপ, পরিত্যক্ত বাংকার, অর্ধভুক্ত বিরিয়ানি, থালাবাসন, কয়েকটা তাজা লাশ। কিন্তু ট্যাংকগুলো থামে না। কারণ জাতিসংঘের নিউ ইয়র্ক অফিসে তখন তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিষয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। যুদ্ধবিরতি ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ১০৪-১১টি ভোট পড়ে। বিপক্ষের ভোটাররা ভারত আর সোভিয়েত লবির মাত্র ১১টি দেশ। এদিকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী জে এ ভুট্টো সাত সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল নিয়ে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছেন। অবস্থা সঙ্গিন। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়ার আগেই ভারতীয় ট্যাংকবাহিনীর দ্রুত ঢাকা পৌঁছাতে হবে। শত্রুকে তাড়া করে তাই তারা এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি মার্চ করছে সহযোগী পদাতিক বাহিনী। আর আতা মিয়ারা তো আছেই সঙ্গে।

এভাবে দিন কয়েক চলার পর, কমলগঞ্জে জনতার সঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যের খণ্ডযুদ্ধের খবরটা তাদের কাছে ওয়ারলেস মারফত আসে। কমলগঞ্জ আতা মিয়ার চেনা জায়গা, নিজের গ্রাম থেকে মাত্র দুই ক্রোশ পথ। তাই তাকে সমাদর করে প্রথম দিনের মতো ফের ট্যাংকে তোলা হয়। ট্যাংক-কমান্ডার খুশিতে ডগমগ—’দোস্ত জলদি চলো। মওকা মিল গিয়া।’ মৃত সৈন্য নয়, এখন তাদের দরকার জ্যান্ত যুদ্ধবন্দি। কমান্ডার আতা মিয়ার দিকে তাকালেই সে হাতের ইশারায় সামনের দিকটা দেখিয়ে দেয়। অর্থাৎ-চিন্তার কোনো কারণ নেই-কমলগঞ্জ সামনেই। ঠিক সে সময় মজিদ বিহারির ট্যাংকের সামনে হঠাৎ চলে আসাটা ছিল উটকো ঝামেলা। আতা মিয়া প্রথম বুঝতে পারেনি। সে তখন দ্রুতগামী ট্যাংকের পিঠে নিজেকে ধরে রাখতেই ব্যস্ত। তারপর ‘রোকো রোকো…’ চিৎকারটা যখন শোনে, ততক্ষণে মজিদ বিহারি পদাতিক বাহিনীর গুলি খেয়ে উড়তে উড়তে রাস্তার বাইরে চলে গেছে। দৃশ্যটা তাকে এতই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, সামনের মসজিদে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখেও তার কোনো ভাবান্তর হয় না। তবে হাফ ডজন ট্যাংকের পরোয়া না-করে উন্মত্ত জনতাকে যখন মারদাঙ্গা চালিয়ে যেতে দেখে, তখন সে ট্যাংকের পিঠ থেকে খুশিতে লাফিয়ে পড়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়–জয় বাংলা!

মসজিদের দরজাটা পদাতিক বাহিনীর দখল নিতে নিতে খান পাঁচেক পাক আর্মির লাশ পড়ে যায়। তাতেও লোকগুলোর রাগ কমে না। জেনেভা দেশে হানাদারদের জামাই আদরে থাকাটা যে-করে হোক ঠেকাবেই। এই মানেকশ’র ‘সারেন্ডার সারেন্ডার’ ঘোষণাটি যত অনিষ্টের মূল। গত ন’মাসে তারা রেডিও শুনেছে বিস্তর, কিন্তু কোনো খবরই এভাবে তাদের নাকে-মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয়নি। মিত্রবাহিনীর দাবড়ানি খেয়ে ওসমান গনি পুকুরের উঁচু পাড়ে ফের এক লাফে উঠে যায়, ‘ভায়েরা শোনেন, একবারটি মোর কথা শুনি লন। ইব্রাহিমের বাপ ইসমাইলকে নচ্ছাররা যখন গুলি করইলো, মানিক শার চ্যালা-চামুণ্ডারা তখন কনে ছিল! কনে ছিল আফিলুদ্দিন যখন শহিদ হয়–’

ওসমান গনির ফাটা বাঁশের মতো ভাঙা খ্যানখেনে গলা আর আতা মিয়ার মুহূর্মুহূ জয় বাংলা স্লোগান মিত্রবাহিনীর ফাঁকা আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করে। তারা দৌড়ঝাঁপ করতে করতে একসময় পৌঁছে যায় দুদিন আগের পচাগলা লাশের কাছে। সেখানকার বাস্তবতা তখন ভিন্ন…।

যে যে-জায়গায় গুলি খেয়ে পড়েছিল, সেখানেই ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আর তাদের নিয়ে চলেছে কাক, শকুন, কুকুরের ত্রিমুখী লড়াই। বাঙালি আর পাকিস্তানি লাশের মধ্যে তরতফাত নেই। গাঁয়ের মহিলারা শত্রু-মিত্র ভুলে সব কটা লাশের জন্য আছাড়ি-পিছাড়ি বিলাপ জুড়ে দেয়। নারীদের অরাজনৈতিক কাণ্ডকারখানায় পুরুষেরা বিরক্ত হয়। তারা পাকসেনার লাশগুলো কোনোরকমে মাটি চাপা দিয়ে, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর অর্ধভুক্ত দেহাবশেষ বাঁশের মাচায় তুলে কাঁধে করে বাড়ি ফেরে।

গাঁয়ের বাড়িগুলো যখন শোকে মোহমান, কান্না আর দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারাক্রান্ত, রাতের অন্ধকারে এবার সত্যিকারের শিয়ালের পাল ফসলের মাঠে ঝাকে। আঁকে প্রবেশ করে। পিতৃহারা ইব্রাহিম এই দৃশ্য বাড়ির নামায় বসে দেখে। কিন্তু সে চাঁচায় না। ভয়ও পায় না। কাঁচা লঙ্কা দিয়ে শিয়ালের মুলো খাওয়ার কথাটা মনে পড়তে এত দুঃখের মাঝেও তার মুখে হাসি ফোটে। সে ভাবে, দু’দিন আগেও সে কত ছোট আর বেকুব ছিল। শিয়াল যে আমিষাশী-মাংস খায়, লঙ্কা দিয়ে মুলো খায় না, তা-ও তার জানা ছিল না। বাপ মরে গিয়ে রাতারাতি তাকে সাবালক বানিয়ে দিয়ে গেছে।

মৃত সৈন্যদের নিয়ে শিয়ালের পাল যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন জ্যান্ত যুদ্ধবন্দিরা এক মাইল দূরের সদরের এক খুপরি ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। জেনেভা কনভেনশন শীতের রাতে মৌতাতের মতো। তা পেটের দানাপানি না জোগালেও ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করে। সে সময় আতা মিয়া অদূরের খোলা মাঠে পরিত্যক্ত বাংকারের কাঠখড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছিল। তার পাশে গানে গানে কারবালার কাহিনি বয়ান করেন। যে, সেই বৃদ্ধ। তখনো বৃদ্ধের স্বল্প কেশের মাথাটা দু’হাঁটুর মাঝখানে, যা আগুনের রক্তিমাভায় ঝিকমিক করছে। আজ পুঁথির বীরযোদ্ধাদের সশরীরে পেয়ে এলাকার লোকজন বৃদ্ধের কথা ভুলে গেছে। খাওয়ার সময় তাকে ডাকেনি। শোয়ার জায়গাটাও বেহাত হয়ে গেছে। এখন মুক্তিযোদ্ধারা এর-ওর বাড়ির সম্মানীয় অতিথি। মুক্তাঞ্চলের তারা নব্য শাসক। গতকাল পর্যন্ত যেসব দোর তাদের সামনে রুদ্ধ ছিল, সেসব এখন অবাধ, উন্মুক্ত। তাদের আপ্যায়ন করতে সদরের আশপাশ এলাকা আজ উৎসবমুখর। শামিয়ানার নিচে বড় বড় তামার ডেকচিতে গরুর মাংস, খিচুড়ি। পরিবেশনের জন্য এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে আনা হয়েছে চিনামাটির বাসন, কাঁচের গেলাস, কাঁসার চিলমচি। ভূরিভোজের পর বহুদিন পর যোদ্ধারা আজ গরম বিছানায় সুখনিদ্রা যাচ্ছে। আতা মিয়ার চোখে ঘুম নেই।

দিনের বেলা মিত্রবাহিনীর তাড়া খেয়ে ওসমান গনির দল যখন ফসলের মাঠের দিকে দৌড়ে যায়, আতা মিয়া তখন তাদের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করে। তারপর দলছুট কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে ইব্রাহিমদের উঠোনে হাজির হয়। সেখানে দু-দুটি লাশ। একটা ইসমাইলের, অন্যটা আবদুর রবের। যার সঙ্গে সাত দিন আগে ইসমাইল বিশ্বাসের কন্যা মর্জিনা বিবির শাদি হয়েছিল। আহা রে, ঘুরেফিরে আবার সেই কারবালা। মর্জিনার অবস্থা বিবি সখিনার মতো। বাবা নেই। নতুন বিয়ে। করা স্বামী নেই। একটু পরপর মেয়েটা মূৰ্ছা যাচ্ছিল। মা মদিনার এত শোকের মধ্যেও বাস্তব জ্ঞানটা টনটনে। বাড়ির উঠোনে দু’দুটি লাশ আছে, একজন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাও তো আছে। মর্জিনা দশটা জল ঝাঁপটা খেয়ে একবার চোখ খুলে তো, মা তাকে মুক্তিযোদ্ধার জন্য শরবত বানানোর তাড়া দেন। এই করে করে একসময় মেয়ের মাথায় মায়ের নির্দেশটা ঢোকে। কিন্তু শরবতের গ্লাস হাতে মর্জিনা বিবি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হুড়মুড়িয়ে কলাগাছের মতো ভেঙে পড়ে মুক্তিযোদ্ধার পায়ের কাছে। এত বড় সম্মানের জন্য আতা মিয়া মোটেও তৈরি ছিল না। তড়াক করে সে লাফ দেয়, যেন আর একটু হলেই শত্রুর পোঁতা মাইনে পা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ইসমাইলের বাড়ির সীমানা ছাড়ার পরপরই মনে তার অনুতাপ আসে। যাক, যা হবার হয়ে গেছে। এখন ফেরার পথ নেই। দিন শেষ। নিজের অধিনায়কের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। তা না হলে দলের লোকেরা তাকে ক্যাজুয়ালটির দলে ফেলে। দিতে পারে। সে সদরে যাওয়ার রাস্তায় ওঠার আগে মর্জিনাদের বাড়ির পথটা ভালো করে দেখে নেয়, যাতে দ্বিতীয়বার পথ চিনতে কোনোক্রমেই ভুল না হয়।

এদিকে সদরে তখন আরেক হট্টগোল। ট্যাংকসহ মিত্রবাহিনী এগিয়ে গেছে। পেছনে রেখে গেছে আর্বজনাস্বরূপ যুদ্ধবন্দিদের। তবে কড়া প্রহরায়। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আতা মিয়াকে নিরস্ত্র করে ভারতীয় সান্ত্রিরা মাননীয় মেহমানগণের সঙ্গে সাক্ষাতের ছাড়পত্র দেয়। তখন মনে যদিও আরেক চিন্তা–আতা মিয়া মুক্তিকে বলে, তবু একবার পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখের দেখা দেখার জন্য সে বন্দিশিবিরে প্রবেশ করে। আট-দশ জন আধমরা, ক্ষতবিক্ষত হানাদার কোনোরকমে বোর্ড অফিসের খাস কামরার খালি মেঝেতে পড়ে আছে। চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো অসহায়, বিহ্বল চাহনি। এ তাহলে প্রবল পরাক্রান্ত শত্ৰু, যাদের বিরুদ্ধে গত ছয়টা মাস আতা মিয়া খেয়ে না-খেয়ে যুদ্ধ করেছে! এখন উভয় পক্ষ মুখোমুখি অথচ কেউ কাউকে মারছে না। আতা মিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ-করে তাদের দেখে। ভাবে, মর্জিনা বিবি সঙ্গে থাকলে বেশ হতো। কিন্তু কী হতো–সে জানে না। মেয়েটার কথা ভাবতে গেলে, চেহারাছবি কিছু মনে পড়ে না, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুলপাতা আঁকা একটা কাঁচের গেলাস। যার মিষ্টি শরবতে কয়েক ফোঁটা কষ্টের নোনা পানি মিশে রয়েছে। তারপর তো সে ওখান থেকে পড়িমরি পালায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আতা মিয়া অস্বস্তিতে ডান পায়ের পাতা দিয়ে বাঁ পা ঘষে। ভঙ্গিটা মিত্রবাহিনীর নিয়োগকৃত সান্ত্রির পছন্দ হয় না। সে পেছন থেকে তাগাদা দেয়, আপকা টাইম ওভার হুয়া।

অন্য সময় হলে আতা মিয়ার মাথায় রক্ত চড়ে যেত। আজ যেন তার কী হয়েছে। ওখান থেকে নড়তেও ইচ্ছে করে না। অথচ দাঁড়িয়ে থাকতে গেলে পা ঘষাঘষি বাদ দিয়ে অন্য কিছু করা দরকার। কী করা যায়-ভাবতে ভাবতে আতা মিয়ার চোখ পড়ে পালের গোদা একজন অফিসারের ওপর। দেখে সেও তার দিকে অপলক চেয়ে আছে। যা মর্জিনাকে বলতে পারত অথচ বলা হয়নি, আতা মিয়ার গলার কাছে সেসব কথা ভিড় করে। সৈন্যটিকে সে জিগ্যেস করে, ‘ভাইসাব, আপ ক্যায়সা হো?’ সম্বোধনের জবাবে লোকটি নিরুত্তর। একটু যেন আবেগে কেঁপে উঠল। প্রশ্নটা নির্দোষ। কিন্তু অদ্ভুত ধরনের। সারা দিন সান্ত্রিটি নানান রকমের গালাগাল দিতে দেখেছে লোকজনদের। কিন্তু এমন প্রশ্ন কেউ করেনি। তাকে গোঁফের তলায় মিটিমিটি হাসতে দেখে আতা মিয়ার কথা বলার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। সে তার পছন্দের সৈন্যটিকে বলে, ‘আপলোক ভিজা বিড়াল বন গয়া কিউ? আভি ডর লাগতা হ্যায়?’ যুদ্ধবন্দি বেজায় সেয়ানা। তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আড়চোখে সান্ত্রির দিকে তাকায়। যেন বোঝাপড়াটা শুধু পাকিস্তানে আর হিন্দুস্থানে। মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ফাউ। এখনো তাদের প্রজা। আতা মিয়ার হাত নিশপিশ করে। কিন্তু তার মর্জিনাকে বলতে-না-পারা কথাগুলো এখনো শেষ হয়নি। বিনয়ের সঙ্গে সে বলে, ‘আপলোক কভ পাকিস্তান সে আয়া?’ এবার সৈন্যটার শুকনো ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে। আতা মিয়া এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়, মেরা নাম আতা মিয়া। ফ্রিডম ফাইটার। ভাইসাব আপকা নাম?’

‘মেজর ইশতিয়াক।’

আতা মিয়া এক গাল হেসে মুক্তিকে বলে, ‘আপনে জানতে চাচ্ছেন বলে কচ্ছি।’ তা না হলে যুদ্ধবন্দিদের মাঝখানে পালের গোদা আছে জেনেও সেদিন তার তেমন উত্তেজনা বা আনন্দ হয়নি। বরং তার কথা বলার আগ্রহ তখন বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে, যে। শীতের রাতে ভোলা মাঠে আগুন পোহাচ্ছে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিম পড়তে শুরু করে। গায়ে তাদের কাপড়চোপড় তেমন নেই। আগুনের উত্তাপে সামনেটা গরম হলেও পেছন দিকটা জমে যাওয়ার উপক্রম। অদূরেই পাকসেনার বাংকারগুলো খালি পড়ে রয়েছে। এতে রাতের মতো ঢুকে পড়লেই চলত। কিন্তু জিন্দা থাকতে গর্তে ঢুকতে নারাজ বৃদ্ধ। আতা মিয়া দৌড়ঝাঁপ করে কাঠখড় জোগাড় করে, বৃদ্ধ এক চুলও নড়ে না। সেই যে আগুনের পাশে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে আছে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও সোজা হওয়ার তার লক্ষণ নেই। এ কেমন মানুষ? মুক্তিযোদ্ধা আতা মিয়ার তাকে তখন ভয় দেখাতে ইচ্ছে করে। বলে, ‘বুড়া মিয়া, নয় মাস দেশে থাকি কী করিছেন? জানি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। রাজাকারি করিছেন?’

‘মুই?’ বৃদ্ধ চমকে উঠে তাকায়। ‘বয়স কই রে বাপ, যে যুদ্ধ করিব, রাজাকারি করিব?’

‘বয়স থাকলে রাজাকারি করতেন?’

বৃদ্ধ চরম গোঁয়ার। আতা মিয়ার মারাত্মক প্রশ্নটার জবাব দেয় না। মাথাটাও ফের গুঁজে দিয়েছে দু’হাঁটুর মধ্যিখানে। বয়সকালে ডাকাত ছিল নাকি লোকটা? ডরভয় বলে কিছু নেই! রাজাকারির শাস্তি এখন মৃত্যুদণ্ড। এ এক দিনে ডজন খানেক রাজাকারের লাশ পড়েছে কমলগঞ্জে। কিন্তু বয়স থাকলে যে রাজাকার হতো তার শাস্তি কী? এখন অবশ্য চাইলেই যা খুশি করা যায়। আইনের বই দেখে তো আর বিচার-সালিশ হচ্ছে না না! সবাই প্রতিহিংসায় পাগল। হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র। একেকটা অভিযোগ আসে, অনতিবিলম্বে শাস্তি কার্যকর হয়ে যায়। সাক্ষী-সাবুদের দরকার পড়ে না। আতা মিয়া অবশ্য গ করতে চায় না। তার আগ্রহটা অন্য জায়গায়। সে বৃদ্ধের সাপোর্ট চায়। আগামীকাল মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করে সে ঢাকার দিকে অ্যাডভান্স করবে, না কমলগঞ্জে থেকে যাবে, যেখানে বিবি মর্জিনা স্বামীশোকে ঘন ঘন মূর্ছা যাচ্ছে। ‘যুদ্ধ বড়, না মানুষের মিল-মহব্বত বড়–বুড়া মিয়া?’ আতা মিয়ার মুখ ফসকে অযোদ্ধাসুলভ প্রশ্নটা তিরের বেগে বেরিয়ে যায়। আর এর ধাক্কায় বৃদ্ধের মাথাটা হাঁটুর প্যাঁচ ছেড়ে উত্থিত হয়। তিনি পরম তাচ্ছিল্য ভরে বলেন, ‘যুদ্ধ রাজারে প্রজা বানায় না। প্রজারে রাজা বানায় না। সত্য যা, তা কারবালা।’

পরদিন কয়েকটা বাসি ও টাটকা খবর উড়তে উড়তে আসে–

মাটি-ল্যাপা, ডালপাতায় সাজানো কয়েকটা মাইক্রোবাস কারফিউর ভেতর ঢাকার অলিগলি চষে ফেলছে। আলবদর বাহিনী খুব তৎপর। তারা দেশের বাছা বাছা সন্তানদের চোখ বেঁধে মাইক্রোতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে।

মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ ভিয়েতনাম ছেড়ে এখন ভারত মহাসাগরে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণের ফলে গভর্নর হাউসে আগুন ধরে যায়। আক্রমণকারীরা নিশানা ঠিক করেছিল ঢাকার টুরিস্ট গাইড দেখে। তাতে ভয় পেয়ে গভর্নর স্বয়ং ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে দলবলসহ আন্তর্জাতিক জোন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছেন।

মিত্রবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। ভৈরব হয়ে তাদের একদল এখন ডেমরায়। আরেক দল মানিকগঞ্জ রোড ধরে এগিয়ে মিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি অবস্থান। নিয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে টাঙ্গাইলে অবতরণকারী একদল ছত্রীসেনা। বিদেশি সূত্রমতে ছত্রীর সংখ্যা ৫০০০।

তখন একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষের দেয়াল বেয়ে একটা বিষধর কেউটে মানচিত্রে উঠে গেল। তারপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ফণা তুলল ঢাকার ওপর। জেনারেল ব্যাঘ্র ভয়ে গর্জন করলেন, কিন্তু তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। তার কানের পাশে মাছির মতো ভনভন করে উড়ছে একটি প্রলোভনসারেন্ডার সারেন্ডার, একটি জরুরি ঘোষণা। তিনি মাছিটিকে না তাড়িয়ে উড়তে দিলেন।

ঠিক সেসময় জে এ ভুট্টো জাতিসংঘের বর্ধিত সভায় আমরা যুদ্ধ করব, হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করব’ বলে চেঁচাচ্ছিলেন। তারপর হলিউডি কায়দায় যে কাগজটি না পড়েই তিনি ছিঁড়ে ফেললেন, আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তা ছিল যুদ্ধবিরতির সোভিয়েত লবির দেশ পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে।

জেনারেল ব্যাঘ্র দেয়াল থেকে মানচিত্র নামানোর আদেশ দিয়ে সাজঘরে ঢুকলেন। সাজটা যুদ্ধের নয়–আত্মসমর্পণের।

.

আতা মিয়া কমান্ডারের কাছে গিয়ে মিথ্যা করে বলে, ‘মনটা জানি কেমুন করতে লাগিছে, ভাইজান। আমারে দুই দিন ছুটি দেন। আমি বাড়ি যাইয়্যাম।’ এরকম একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যে-কোনো সময় ঢাকা থেকে পাকবাহিনীর সারেন্ডারের খবর আসতে পারে, সারা বছর যুদ্ধ করে কে চায় এ দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতে! প্রস্তাবটা পাগলামির পর্যায়ের হলেও ভাইজান সানন্দে ছুটি মঞ্জুর করেন। রাস্তার চৌমাথায় এসে আতা মিয়া টানাটানিতে পড়ে যায়-তার সামনে চারদিকে চারটা রাস্তা। একটা গেছে মর্জিনাদের বাড়ির দিকে। দিনের আলোয় তার মনে হয়, শোকের বাড়িতে এভাবে যাওয়া ভালো দেখায় না। চার দিনের খতম পড়ানো হয়ে গেলে যাওয়া যাবে বরং। তার পরের রাস্তা গেছে ঢাকা। ঢাকা বহু দূর। তৃতীয়টা ধরলে দুই ক্রোশ পর যদিও তার নিজের বাড়ি, বাড়িতে আছেন বৃদ্ধ বাপজান আর তার পরের সংসারের স্ত্রী-পুত্র পরিজন, বেকার ছেলে যুদ্ধে যাওয়াতে একজনের খোরাকি বেঁচে গিয়েছিল, এখন স্টেনগান কাঁধে আতা মিয়া বাপজানের সামনে খালি হাতে দাঁড়াতে চায় না। চতুর্থ রাস্তায় গেলে পথে পড়ে যে জেলা শহর, সেখানে থাকেন তার মাতৃতুল্য ফুপু, তাকে পুত্রস্নেহে লালন করে যিনি নিজের গর্ভজাত পুত্রসন্তানের অভাব পূরণ করেছিলেন। শহরটা স্বাধীন হয়েছে আজ তিন দিন। আতা মিয়া আর যুদ্ধ করতে চায় না ঠিকই, তবে স্বচক্ষে বিজয় দেখা থেকে বঞ্চিত হবে, সেটাও তার ইচ্ছে নয়। সহিসালামতে শহরটায় পৌঁছাতে পারলে সাপও মারা পড়বে, হাতের লাঠিও ভাঙবে না।

১৬. বুলি আজও তোরে ভুলি নাই

আতা মিয়া উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে যখন শহরে ঢোকে, তখন দক্ষিণ সীমানা থেকে ৭/৮ মাইল দূরে পাকবাহিনী-যৌথবাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। পথেই পাড়াতুতো এক মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। ছেলেটা অস্ত্র খুইয়ে কোনোরকমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছে। উদ্ভ্রান্ত চেহারা। দুই দিন তিন রাত একনাগাড়ে যুদ্ধ করেছে। সে বলে, পাকবাহিনী এক ইঞ্চি জমিনও ছাড়তে রাজি নয়, শস্যখেত ভরে গেছে লাশে লাশে। ওখান থেকে যুদ্ধের আওয়াজ এলেও শহরের অবস্থা স্বাভাবিক। রাস্তাঘাটে কিছু মানুষ লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত। কারো দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। আতা মিয়াদের পাশ দিয়ে সেমাইয়ের পোটলা হাতে একজন দৌড়ে চলে যায়। অদূরে বাড়িঘরের দরজা-কপাট ভেঙে কিছু লোক ভ্যানে তুলছে। কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে রিকশাভর্তি লেপ-তোশকের ওপর পা ছড়িয়ে বসে একজন আসছিল তাদের দিকে। পাড়াতুতো ভাই বলে, ‘শালারে হ্যান্ডসআপ করায়ে পিস্তলডা নে, আমার অস্ত্রের দরকার।’ যে কথা সেই কাজ। লোকটা পিস্তল ফেলে লেপ-তোশকের রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে পালাল। বুলেট নেই পিস্তলে। ‘শালা মাগনা পেয়ে তুলে নেইছে। যা-ই হোক, যুদ্ধের সোমায় হাতে লগার-ফগার কিছু থাকা ভালো।’ তারা আবার হাঁটতে শুরু করে। পথিমধ্যে শোনে যে, বোমায় পা উড়ে গেছে তাদের পরিচিত ফ্রিডম ফাইটার একজনের। তাকে আহত অবস্থায় সদর হাসপাতালে আনা হয়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথে আরেক কাণ্ড। কয়েকটা পাঞ্জাবি সৈন্য কোথা থেকে রাস্তায় এসে পড়ে। পাবলিক তাদের দেখে। জয় বাংলা স্লোগান দেয়। ভয়ে পাঞ্জাবিরা চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে ব্ল্যাংক ফায়ার। করলে পাবলিক ভাবে, পাকবাহিনী আবার এসে গেছে, তারা রাস্তার ধারের দোকানপাট ভেঙেচুরে দেয় দৌড়। আতা মিয়ারাও দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণ দেখে না। দুজনের হাতেই অস্ত্র আছে, তবে গুলি সাকল্যে দুটি, তা-ও আতা মিয়ার কোমরের গামছায় বাঁধা। সে তো যুদ্ধ করবে না বলেই শত্রুমুক্ত শহরে ঢুকেছে। তাই তার প্রস্তুতিও নেই।

হাসপাতালের অবস্থা করুণ। সেখানে কোনো ডাক্তার নেই। সিভিল সার্জন যে, সে অবাঙালি, চিকিৎসা করবে কী, নিজেই প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে। নার্সরা ছোটাছুটি করে কোনোরকমে কাজ চালাচ্ছিল। ‘তখন তো হাসপাতালে দুইশ-আড়াইশ বেড ছিল না, ডাক্তারও কম।’ আতা মিয়া মুক্তিকে বলে, ‘ধরেন আজকে যেমন নাকের ডাক্তার হয়েছে, কানের ডাক্তার হয়েছে–একটা হসপিটালে বিশ রকমের ডাক্তার, তখন তো এসব ছিল না! তা-ও সদর হসপিটালে যে কজন ছিল–পলাইছে।’

এদিকে রণাঙ্গন থেকে আহতদের এনে তোলা হচ্ছে সদর হাসপাতালে। মুক্তিযোদ্ধারা কোত্থেকে এক ডাক্তার ধরে আনে। একা কী করবে সে। যার পেটে গুলি ঢুকে আছে, তার তো জরুরি অপারেশন দরকার, অথচ তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পানি নেই, বাতি নেই। রাতে আবার বিমান হামলার আশঙ্কায় শহর নিষ্প্রদীপ। আতা মিয়া রোগী দেখতে এসে ফেঁসে যায়। পাড়াতুতো ভাই যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, তার বিশ্রাম দরকার, কোন ফাঁকে সে সরে পড়েছে। আতা মিয়ারও কেটে পড়ি পড়ি ভাব। হঠাৎ ঠা-ঠা করে গুলি ফাটল। বোঝা যাচ্ছে ব্ল্যাংক ফায়ার-পাকসেনারা আবার ফিরে আসলো নাকি! আতা মিয়া তখনো জানে না যে, তা বিজয়োৎসবের। সে অন্ধকার হাসপাতালের করিডোরে নেমে আসে। গুলির আওয়াজেই সম্ভবত, করিডোরের রোগীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যারা চলতে-ফিরতে সক্ষম তারা বাইরে বেরিয়ে আসে। উল্টো দিক থেকে হনহন করে হেঁটে আসে জোর করে ধরে আনা সেই ডাক্তার। এসেই মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ বাধা সামনের। রোগীটাকে বুকে জড়িয়ে একটানে মাথার ওপর তুলে ফেলে। তাকে নামিয়ে আরেকজনকে। এভাবে পাঁচজনের সময় ডাক্তার আর লোকটিকে মাথায় তোলে না। শূন্য থেকে ছেড়ে দিয়ে আতা মিয়াকে স্টেনগানসহ জাপটে ধরে, ‘মুক্তিযোদ্ধা ভাই, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। আমরা স্বাধীন। স্বাধীন দেশের নাগরিক।’

ডাক্তারের চিৎকার করিডোর ছেড়ে পুরুষের ওয়ার্ড পেরিয়ে বন্ধ দরজার ওপাশে। মহিলা ওয়ার্ডের একমাত্র রোগী মরিয়মের কানে পৌঁছায়। এতে তার কোনো ভাবান্তর। হয় না। ইস্পাহানি স্কুল থেকে গতকাল তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। আগের। দু’দিন মরিয়মের অবস্থা ছিল চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো। দলে দলে লোক দেখতে। আসছিল। অন্য মেয়েরা কে কোন দিকে চলে গেছে। সে একা। খাওয়া না, নাওয়া না, মানুষের ঠাট্টা-মশকরা শুনে শুনে সে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি কিছুতেই বন্ধ। হচ্ছিল না। হাসপাতালে আনার পর একজন নার্স যত্ন করে গোসল করিয়ে তাকে বমির ওষুধ খাইয়ে দেয়। সেই থেকে সে ঘুমাচ্ছে।

সেদিন বিকেলে জেনারেল নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করছিলেন, মরিয়ম তখন ওষুধের ঘোরে প্রবেশ করে সেখানে, যেখানে শালিমার বাগ আছে আর শহরটার নাম হচ্ছে লাহোর। সে লাহোরের সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যায়, ফোয়ারার ধারে চকিতে দাঁড়ায়, সারি সারি ঝাউবীথির মনোরম শোভা উপভোগ করে। কিন্তু টাইট কামিজ আর চুড়িদার পরা, গলায় দোপাট্টা প্যাঁচানো কোনো নারীকে সেখানে দেখতে পায় না। দৃশ্যটা তাকে স্বস্তি দেয় এবং ভবিষ্যতের জন্য একটা দরজা খোলা রেখে সে ফের ঘুমিয়ে পড়ে।

আতা মিয়া ডাক্তারের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সে এখন বিজয়োৎসব করুক চাই না করুক, তার জন্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়াটা জরুরি। বাইরের অবস্থা তখন আরো হতাশাজনক। দিনের বেলা লুটপাট, পাকহানাদের ব্ল্যাংক ফায়ার–সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব প্রাণবন্ত ছিল। এখন একে মনে হচ্ছে একটা মরা শহর। পথচারী বলতে একা আতা মিয়া। হাঁটতে হাঁটতে সে টাউন হলের সামনে আসে। ওখানে কয়েকটা খাবার হোটেল। মিষ্টির একটি মাত্র দোকানে ভিড় লেগে আছে মানুষের। দোকানের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে বিজয়োৎসব করার জন্য একজন রিকশায় বসে মাইকিং করছিল। উৎসবই বলে হচ্ছে না, তার আবার শান্তি-অশান্তি! একটুখানি উৎসব করার জন্য আতা মিয়ার মনটা ছটফট করে। এর আগে দু-চারটা মিষ্টি খাওয়া দরকার। পকেটে পয়সা নেই তো কী, কাঁধের স্টেনগানই যথেষ্ট। আতা মিয়া মুক্তিকে কৈফিয়ত দিয়ে বলে, ‘ওইসব দিনে মুক্তিবাহিনীরে মানুষ ফিরিই খাওয়াইছে। টেনে টেনে বাড়ি নিয়ে বিছনা পাইতে বলেছে–ভাইজান ঘুমাই পড়েন।’ তবে আতা মিয়ার সেদিন মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয় না। দোকানে পৌঁছানোর আগেই কাঁচের আলমারির তাক সব ফাঁকা। দোকানদার হাত কচলায়, ‘স্যার, ময়দা আছে, দুইডা পরোডা বানাই দিই?’ পরোটা ভাজার আগেই মাইকিং বাদ দিয়ে ফ্রিডম ফাইটার শাহজাহান সিদ্দিক রিকশা থেকে নেমে আসে। কত দিন পর দেখা, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, প্রথম একজন আরেকজনকে চিনতে পারেনি। কোলাকুলির পর বলে যে, ‘দোস্ত উপশহরে গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। এখন পরোটা খাওয়ার সময় নয়। পরে তোরে আমি গোশত-ভাত খাওয়াব-চল।

উপশহরে বাস করে বিহারিরা। আতা মিয়া আর শাহজাহান সিদ্দিক ওখানে মাইকে স্লোগান দেয়, ‘বাঙালি-বিহারি ভাই ভাই/এক থালাতে ভাত খাই। তুমি কে আমি কে/ স্বাধীন বাংলার নাগরিক।’ তাদের স্লোগান, অভয়বাণী বিহারিরা শুনছে বলে মনে হয় না, শুনলেও বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। তাদের দরকার নিরাপদ আশ্রয়। এদিকে রাত গম্ভীর হচ্ছে। তারা যখন শাহজাহান সিদ্দিকের ডেরায় ফিরে আসে, ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধাদের হাট বসে গেছে ওখানে। কে কার চেনা বা অচেনা, কে বড়লোক বা ঘোটলোক এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার আপাতত দরকার নেই। সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা, সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাদের কথারও শেষ নেই। বীরত্বের কথা, দুঃখের কথা, কষ্টের কথা, আনন্দের কথা বলতে বলতে রাত কাবার। মাঝখানে দু’দুবার পাশের হোটেল মাংস-ভাত সরবরাহ করে। তারা যখন ঘুমাতে যায়, স্বাধীন দেশের প্রথম সূর্যকিরণ ততক্ষণে হামাগুড়ি দিয়ে তাদের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে।

পরদিন সন্ধ্যায় আতা মিয়া নিজেকে আবিষ্কার করে শহরের তস্যগলির শেষ মাথায় জোড়া তালগাছের পেছনে টিনের চাল আর বাঁশের বেড়ার একটা শোকার্ত বাড়ির সামনে। তালগাছ দুটি মোটা আর লম্বা হওয়া ছাড়া বহির্বাড়ির কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু অন্দরমহলের চেহারা করুণ। ফুপুর মোটাকাটা শরীরটা শুকিয়ে চেরা তক্তার মতো পাতলা হয়ে গেছে। একসময়ের তেল জবজবে কালো চুল এখন রুক্ষ আর সাদা। সুখী গৃহিণীর খোঁপা ভেঙে তা পিঠের ওপর লুটাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাইপোকে দেখে ফুপু হাউমাউ করে কেঁদে উঠে কী বলেন স্পষ্ট বোঝা যায় না। ফুপাজানের শহিদ হওয়ার খবর আতা মিয়া ফুপাতো বোন দুলির কাছ থেকে তখন। শোনে। কোনো অপরাধ ছাড়াই মিলিটারিরা তালগাছের গোড়ায় তাকে গুলি করে। দুই দিন দুই রাত লাশটা জোড়া তালগাছের চিপায় পড়ে ছিল। মুসলমান মুসলমানের কবর দেবে, ফরজ কাজ, তবু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসে না। কুকুর আর কাকের উপদ্রপে যখন পাড়ার লোকজন অস্থির, দুর্গন্ধে টেকা দায়, তখন দুলির স্বামী আমজাদ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশের পাশেই গর্ত খোঁড়ে। দুলি পচাগলা বাপজানের শরীরটা কবরে নামাতে হাত লাগায়। তারপর কচি ঘাস-দুব্বো দিয়ে কবরটা ঢেকে দেয় রাতারাতি। মাত্র দুই মাসের পুরোনো কবর, আতা মিয়া তাই জোড়া তালগাছ পার হওয়ার সময় প্রথম দর্শনে তা শনাক্ত করতে পারেনি। কবর জিয়ারত করার সময়ও তার মনে হচ্ছিল, ফুপাজান আবদুল করিম-চল্লিশ বছর যিনি কোর্টের পেশকার ছিলেন, তিনি এখানে শায়িত আছেন তো, নাকি সে জ্যান্ত তালগাছ দুটির রুহের মাগফেরাত কামনা করছে!

‘তোর ফুপারে নিয়ে যে শোক করব, তা আমার নসিবে ছিল না রে, বাপ। তিরিশ বচ্ছর একসঙ্গে ঘর করলাম, এক চালের নিচে থাকলাম, মানুষটা চোখের সামনে গুলি খেয়ে ঘাপাতে ঘাপাতে মরি গেল, এক ফোঁটা চক্ষের পানি ফেলতি সময় পালাম না আমি! আমার বিপদের কোনো শেষ আছে?’

কথা বলতে বলতে ফুপু হঠাৎ থেমে যান। দুলি, আমজাদ আমতা আমতা করে। আতা মিয়ার টনক নড়ে, ‘বুলি কনে ফুপু আম্মা? ওরে যে দেখতে পাচ্ছিনে!’ বাড়ির চার-পাঁচ বছরের মেয়েটি এতক্ষণ হাঁ করে স্টেনগান দেখছিল, এই প্রথম তার কথা বলার সুযোগ আসে। সে স্টেনগানের ফিতা ধরে টান দেয়, ‘বুলি খালারে মিলিটারি ধরে নে গেছে, মামা।’ সঙ্গে সঙ্গে ফুপু ডুকরে কেঁদে ওঠেন, আর দুলির মেয়েটা আগ বাড়িয়ে কথা বলার জন্য মায়ের হাতে দুমদুম কিল খায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের কোথাও কি এক ফোঁটা শান্তি নেই? কুত্তার বাচ্চারা কী করে থুয়ে গেছে দেশটার? আতা মিয়ার আর সহ্য হয় না। সে বাইরের দিকে পা বাড়াতে ফুপু খপ করে তার স্টেনগানের ফিতা ধরে ফেলেন, ‘বাজান কনে যাচ্ছিস। যাওয়ার আগে তোর ফুপুরে মাইরে থুয়ে যা।’ এখন ঠ্যালা সামলাও! পেছনে কুপির সলতেটা ফুপুর আহাজারিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আতা মিয়া নিষ্কম্প। স্থির দাঁড়িয়ে ভুতুড়ে তালগাছ দুটির দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, যুদ্ধের পরও যে আরেক যুদ্ধ, এর জোয়াল বয়ে বেড়ানোর দায় আছে কি না একজন মুক্তিযোদ্ধার। কমলগঞ্জের মর্জিনা বিবিকে সে চিনে না, দেখেওনি কোনোদিন অথচ মা মদিনা উঠোনে লাশ রেখে তার হাতে মেয়েকে সঁপে দিতে চাইলেন। তার একটা মন পড়ে আছে ওখানে। এদিকে ফুপুও তার পর নয়। দুই মাস আগে ফুপাজানকে মেরে ফুপাতো বোন বুলিকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। এই বুলির সঙ্গেই একবার আতা মিয়ার বিয়ের কথা হয়েছিল। পাত্রের পড়ালেখা কম থাকায় প্রস্তাবটা টেকেনি। মানুষের জীবনে কখন যে কী হয়! এলাকা শত্রুমুক্ত হয়েছে তো চার দিন। আমজাদ হোসেন এ কয় দিন শালির জন্য কী করেছে? নাকি শ্বশুরের লাশ মাটি চাপা দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ?

এবার তার প্রশ্নের জবাব দেয় বুলির বড় বোন দুলি। মুন্নির আব্বা একা মানুষ, কী করবে। তুমি যখন আসি পড়িছো একটুখানি দেখো দিনি ঘটনাটা কী!’ ফুপু মেয়ের চেয়ে এককাঠি বাড়া। তিনি ভাইপোকে জড়িয়ে ধরে বলেন, দেশ স্বাধীন হইয়ে গেল রে বাপ, আমার মেয়ে কই? তোরা তারে এনে দে। বুকের আগুন আমি পানি ঢালি নিবাই।’ দুই মাস বুকে পাষাণ বেঁধে পড়ে থাকলেও ফুপুর আর একমুহূর্তও তর সইছে না, তিনি নিজের বুকে দুমদুম কিল বসাচ্ছেন। এদিকে আমজাদ হোসেন সোয়েটার গায় দিয়ে রেডি, শালিকে সে মুক্তিযোদ্ধা আতা মিয়ার সঙ্গে খুঁজতে যাবে।

সব শুনে শাহজাহান সিদ্দিক চার-পাঁচ জায়গার নাম দিয়ে বলে, ‘এখন কি আর খুঁজে পাবি? বেঁচে থাকলি তো এদ্দিনে নিজবাড়িই ফিরত। তবে এমনও হতি পারে লজ্জায় সে মুখ দেখাতি পারছে না। দ্যাখ তবে চেষ্টা করে।’

শাহজাহান সিদ্দিকের সঙ্গে কথা বলে আতা মিয়া আর আমজাদ হোসেন সোজা নদীর পাড়ের ভাগাড়ে চলে যায়। পরে ভাগাড়টার নাম হয় কালীতলা বধ্যভূমি। তারা প্রথম সেখানে যায়, কারণ জায়গাটা কাছে আর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যেহেতু বুলির কম-শাহজাহান সিদ্দিক বলে দিয়েছে। সেখানে তখন শয়ে শয়ে কেরোসিনের লম্প। মানুষ আপনজনের লাশ খুঁজতে বেরিয়েছে হারিকেন দিয়ে। কত দিনের পচাগলা লাশ, বেশির ভাগই কঙ্কাল। কার লাশ কে নিয়ে যাচ্ছে। আতা মিয়াদের সঙ্গে হারিকেনও নেই। তারা ভাগাড় থেকে চলে যায় উপশহর, যেখানে বিহারিদের আবাস। বিহারিরা পাকবাহিনীর যোগসাজশে নয় মাস বাঙালি কেটে কেটে ম্যানহোল ভরেছে। এবার পাল্টাপাল্টির সময়। সেই রাতে ম্যানহোলের ঢাকনা তুলে পচাগলা যে কটা বাঙালির লাশ তোলা সম্ভব হয়, সেই খালি জায়গায় কেটে কেটে ফেলতে থাকে বিহারির লাশ। এই চলে পরদিন ভোর পর্যন্ত। সকালের দিকে সেই যে শাহজাহান সিদ্দিক বলেছিল ‘এমনও হতি পারে সে লজ্জায় বাড়ি যাতি পারছে না’ কথাটা মনে পড়তে আতা মিয়া আর আমজাদ হোসেন নয়াবাজারের বাংকারের দিকে ছোটে। সঙ্গে নেয় বুলির লজ্জা নিবারণের জন্য একখানা নাইলনের শাড়ি, যা কাঁধের স্টেনগান দেখিয়ে আতা মিয়া চকবাজারের এক আড়তদারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। শাড়িটা সঙ্গে নিয়ে লাভ হয়নি। বাংকারে সেদিন কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পাকবাহিনীর মাইনে পড়ে এক মুক্তিযোদ্ধার হাত-পা উড়ে গেছে। তাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি। দ্বিতীয় দিনে মিত্রবাহিনীর সার্চ করা নয়াবাজারের বাংকারে তারা কোনোরকমে প্রবেশ করে। সেখানে হাতের চুড়ি, শাড়ি, লম্বা চুলের গোছা সব আছে, মানুষ নেই। তারপর তারা যায় আইয়ুব স্কুলে, পরে যার নাম হয় এ কে ফজলুল হক স্কুল। স্কুলে গিয়ে দেখে টুল-বেঞ্চি-ব্ল্যাকবোর্ডহীন একটা ক্লাসরুমে কয়েকটা মেয়ে মুখ ঢেকে নতুন বউয়ের মতো বসে রয়েছে।

স্কুলঘরের চারদিক থেকে কৌতূহলী মানুষ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। গেটে সশস্ত্র সান্ত্রি। মুক্তিবাহিনীর কয়েকটা ছেলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ছেলেছোকরাদের জানালা থেকে নামানো হয় তো তারা বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর চড়ে বসে। বা বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে গাছের মগডালে উঠে যায়। ইতিমধ্যে গাছ থেকে পড়ে দুটি ছেলের পা ভেঙেছে। সব শুনে একজন চেনা মুক্তিযোদ্ধা আতা মিয়াদের নির্ধারিত কক্ষে নিয়ে আসে। তারপর মুক্তিযোদ্ধার কথামতো বুলির নাম, তার আব্বার নাম বলে স্কুলের রোল-কল করার মতো তারা দুজন চারবার ডাক ছাড়ে। কিন্তু মুখঢাকা মেয়েগুলো সাড়া দেয় না। একজন শুধু শেষবার ডাকার সময় শীর্ণ একটা হাত বের করে পিঠ চুলকায়। আতা মিয়া তাকে বুলি মনে করে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে হাত তুলে বাধা দেয় মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি। মুখে বলে, ‘আপনি যা ভাবিছেন তা না, গর্তে থাকি থাকি ওদের গায়ে উকুন পড়ে গেছে। হাত দিয়ে চুলকোচ্ছে তাই।’ তারপর রাইফেলের বাঁট নিয়ে নিজের গা চুলকাতে চুলকাতে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি হাসপাতালের বেড খালি হওয়ামাত্র তাদের ওখানে স্থানান্তর করা হবে বলে জানায়। কিন্তু আতা মিয়ার সন্দেহ দূর হয় না। সবার গায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি উকুন থাকলে, তাদের একজন খালি পিঠ চুলকাবে কেন, যখন সে বুলির নাম ধরে ডাকছিল! ‘কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে,’ চেনা মুক্তিযোদ্ধা বলে। ‘কেউ নিজের মুখ দেখাতে না চাইলে আপনি জোর করে দেখতে পারেন না।’ এ ছাড়া আতা মিয়া নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সর্বাগ্রে তারই তো নিয়ম মানা উচিত।

এরপর তারা হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করে। যদিও বেড খালি না হলে মেয়েগুলোকে ওখানে স্থানান্তর করা হবে না। আইয়ুব স্কুল আর সদর হাসপাতালের মধ্যিখানে টাউন হল ময়দান। ওখানে তখন এ অঞ্চলের যুদ্ধবন্দিদের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া চলছে। জায়গাটা ঘিরে রেখেছে মিত্রবাহিনী। পাবলিক মাঠের বাইরে থেকে শ্লোগান দিচ্ছে, ‘একটা একটা সৈন্য ধরো, সকাল-বিকাল নাস্তা করো। বিচার চাই বিচার চাই, ইয়াহিয়ার বিচার চাই। বিচার চাই বিচার চাই, নরহত্যার বিচার চাই। ইয়াহিয়া-ভুট্টো, কুত্তার বাচ্চা কুত্তো।’ সেখানে আতা মিয়ার সহযোদ্ধারা মহা ব্যস্ত। তারা কোনো-না-কোনোভাবে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়ে গেছে, যা বুলিকে খোঁজার চেয়ে উঁচুদরের কাজ। আতা মিয়াও তাতে শরিক হয়। এই ফাঁকে আমজাদ হোসেন তার কাছ-ছাড়া হয়ে গেলে, দুই রাত দুই দিন পর টাউন হল ময়দানের সামনে বুলিকে খোঁজাখুঁজির ইতি ঘটে।

মেয়েটা মরে গেল না বেঁচে রইল–আতা মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা, পথে পথে ঘুরেও এর সুরাহা করতে পারল না, ফুপুকে মুখ দেখাবে কেমন করে! পরদিন কাউকে কিছু না বলে সে শহর ছেড়ে চলে আসে। যায় কমলগঞ্জ। মর্জিনা বিবির তখনো ইদ্দতকাল চলছে। এ অবস্থায় শাদি নাজায়েজ। তখন সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আইনকানুন ঢিলেঢালা। রাজাকারি করুক চাই না-করুক গাঁয়ের মোল্লা-মৌলবিরা পলাতক। তাই তাদের শাদিটাও নিয়ম ভঙ্গ করে হয়ে যায় নির্বিঘ্নে।

ঢাকার স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমা দিয়ে সরকারি কম্বল হাতে আতা মিয়া এ গাঁয়েই ফেরে। এখানে বৃদ্ধ আছেন কারবালার পুঁথি নিয়ে, আতা মিয়া আছে মর্জিনা বিবি, তাদের ছেলেমেয়ে আর গার্লস স্কুলের দফতরির চাকরিটা নিয়ে। এখনো আতা মিয়া ভুলতে পারে না শীর্ণ হাতের মেয়েটির কথা, যে তার ডাক শুনে পিঠ চুলকাচ্ছিল অথচ মুখ দেখাতে চায়নি। কিন্তু সে বুলি হয়ে থাকলে এত দিনে কি বাড়ি ফিরত না?

বেঁচে থাকলেই সবাই বাড়ি ফিরেছে–তা কিন্তু নয়। আতা মিয়া টাউন হল ময়দানে যুদ্ধবন্দিদের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় যখন উঁচুদরের ভূমিকা রাখছিল, তখন কাছের সদর হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে কিছু মেয়ে জড়ো হয়। তারা কেউই উদ্ধারকারীদের নিজের বাড়ির ঠিকানা দেয়নি। পরদিন ঢাকাগামী ভারতীয় মিলিটারি কনভয়ের যাত্রী ছিল ওরা। সঙ্গে যুদ্ধবন্দি পাকসেনারাও ছিল। মেজর ইশতিয়াকের কপালে, হাতে কমলগঞ্জের গণপ্রতিরোধের ফলক–দগদগে কাটা ঘা। উন্মুক্ত, ব্যান্ডেজহীন। ফেরি-পারাপারের সময় পদ্মার উত্তাল তরঙ্গের দিকে তাকিয়ে মেজর আহত হাত তুলে আনমনে একটা মাছি তাড়ায়। তা দেখে ফেরির পানিবিক্রেতা ছেলেটি ভাবে, খুনি লোকটা বুঝি তাকে সালাম দিচ্ছে। সে সালামের প্রতি-উত্তরে মেজরকে গাল দেয়, ‘শালা বাইনচোত!’ কেউ কিছু বলছে না যখন, ছেলেটি বীরত্ব দেখাতে তার বাদামবিক্রেতা বন্ধুকে ডেকে আনে। এবার তাদের টার্গেট হয় মরিয়ম আর সঙ্গের মেয়েরা, যারা কেউই উদ্ধারকারীদের বাড়ির ঠিকানা দেয়নি। বাদামবিক্রেতা পানিঅলাকে বলে, ‘এই দ্যাখ দ্যাখ, মাইয়্যা গুলান মিলিটারির লগ লইছে। খানকি মাগিরা যায় কই?’

মরিয়মের মাথার ভেতর মেজর ইশতিয়াকের তাড়িয়ে দেওয়া মাছিটা ভনভন করে উড়তে থাকে। তাদের ঘিরে রেখেছে বাচ্চা বাচ্চা ফেরিঅলারা। স্বাধীন দেশে এ কেমন সংবর্ধনা! ভারতীয় সৈন্যরা এর মর্মার্থ না বুঝেই হাসছে আর যারা হাত বাড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে ঝুঁকে ঝুঁকে হ্যান্ডশেক করছে।

ভারতীয় মিলিটারি কনভয় ফেরি ছেড়ে নদীর ঢাল বেয়ে তীরে উঠলে মরিয়ম মনে মনে পদ্মাকে বিদায় জানায়। গোধূলির রক্ত বর্ণের আকাশকে নিঃশব্দে বলে, অন্য দেশের সন্ধ্যা কী রকম, আমি জানি না। কিন্তু নিজের দেশ আমাকে কী দিল। বাইশ বছর কি অনেক সময়? জীবন তার চেয়েও দীর্ঘ।

 ১৭. বীরাঙ্গনা অফিস

‘আপনার কাছে বীরাঙ্গনাদের কোনো ছবি নাই?’ ঢাকার এক প্রাক্তন সমাজকর্মীর ড্রয়িংরুমে বসে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল মুক্তি। সামনের দেয়ালে মাদার তেরেসা, সরোজিনী নাইডু, অরুণা আসফ আলী, মাদাম টিটোসহ নাম-না-জানা বিদেশিনিদের সঙ্গে গৃহকত্রীর স্বাধীনতা-উত্তরকালের কয়েকটি ফ্রেমে বাঁধানো গ্রুপ ছবি, যা একই সঙ্গে তার যৌবনকাল এবং সমাজসেবার মূল্যবান স্মারক। মরিয়ম ফটোগ্রাফে কি রক্তমাংসের শরীরে তখনো ধরা দেয়নি। বীরাঙ্গনা বলতে মুক্তি শুধু দেখেছে কিশোর পারেখের একটি সাদা-কালো আলোকচিত্র। তাতে দুজন অনামা নারীর একজন লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে রেখেছে, আরেকজনের মুখের এক পাশ ভোলা। তার আধখানা কপাল ঘিরে ছোট ছোট চুল। মুখটা শীর্ণ। সমাজকর্মী বললেন, ‘মেয়েদের ছবি পাবে কোথায় তুমি। সামনে ক্যামেরা দেখলেই ওরা লজ্জায় না ঘেন্নায় লম্বা ঘোমটার নিচে মুখ লুকাতো।’

ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকোনো সম্ভব হলেও, পেটে তখন টাইমবোমা, বাচ্চারা টিকটিক করে বাড়ছে। যে-কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নতুন দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস। করে দিতে পারে। ‘অথচ’ সমাজকর্মী বলেন, ‘দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে ধ্বংস আর ক্ষয়ক্ষতি। কাজ করার লোক কম। প্রশিক্ষণের অভাব। কারো মাথা ঠিক ছিল না। কোনটা ছেড়ে কোনটা করব। সবই করা দরকার এবং তাড়াতাড়ি।’

’৭২ সালে বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে মেয়েদের গর্ভপাত করানোর ব্যবস্থা হয়। বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ ডাক্তাররা আসেন। যাদের গর্ভধারণের মেয়াদ চার মাস পেরিয়ে গেছে, তাদের সন্তান জন্মাতে দেওয়া হলো। মাদার তেরেসা খুশি হলেন। একটা স্বাধীন জাতি জ্বণহত্যার পাপ থেকে আধাআধি উদ্ধার পেল। তার চ্যারিটি হোমের ছয়জন নার্স ইনকিউবেটর হাতে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে নেমে ঘোষণা দেন, ‘আমরা যুদ্ধশিশুদের বাঁচাতে এসেছি।’ মায়েরা পুনর্বাসনকেন্দ্রের নার্সদের নির্দেশ বা সহযোগিতায় ডেলিভারির আগের রাতে চুল আঁচড়ে টাইট করে বেণি বাঁধে, নিজেরা পরিচ্ছন্ন হয় আর পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। তারা একটি নিঘুম রাত কাটায়, যা যুদ্ধের রাতগুলোর চেয়ে আলাদা ও ব্যঞ্জনাময়। পরদিন শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি, ভয় আর ভবিষ্যৎ উৎকণ্ঠায় তাদের প্রসবকাল দীর্ঘ আর জটিল হওয়া বিচিত্র নয়। অথচ প্রসবের পর মাথার বিনুনি ঢিলা হওয়ার আগেই তাদের বাচ্চারা দত্তক হিসেবে বিদেশে চলে যায়। পরের দিনের খবরের কাগজে পাঠকরা হয়তো দেখলেন–নার্সদের কোলে শিশু আর উড্ডীয়মান একটি বিমান।

‘তুমি কাজটা যত সহজ ভাবছ, তত সহজ ছিল না।’ মুক্তির দীর্ঘ বয়ান শুনে প্রাক্তন সমাজকর্মী বললেন, ‘মেয়েরা চিল্লাফাল্লা করত। এমনও হয়েছে যে, মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে চুপিচুপি বাচ্চাটা সরাতে হয়েছে। এসব বাচ্চা দেশে রাখা যাবে না–এরা পাকিস্তানি বাস্টার্ড। যদি কোনো ফরেন কান্ট্রি অফার করে, তাহলে আমরা বাচ্চা দিয়ে দেব ফর অ্যাডপশন। তো বেশিরভাগ বাচ্চা গেছে কানাডায়। স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় আমাদের প্রচুর বাচ্চা গেছে।’ সমাজকর্মী কথা বলতে বলতে মুক্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে আসেন, ‘ওই যে মোল্লারা, ওরা তখন টেলিফোন করে বলত, বাইরে বাচ্চা দিতে পারবেন না, সব খ্রিষ্টান হয়ে যাবে। তারা কিন্তু ভালো কোনো কাজে ছিল না। নয় মাস হয়তো রাজাকারিই করেছে–তবু।’

এই সমাজকর্মী যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হুঁশিয়ার করে বেনামে উড়া চিঠি দিয়েছেন। লিফলেট বিলি করেছেন। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তার কাছে হাতচিঠি পাঠাত, ‘খাল্লামা, সামনে শীত। আমাদের পঞ্চাশটা পুলওভার পাঠাবেন কালো রঙের।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী সোয়েটার বুনতে বসে গেলেন। যুদ্ধের দিন, বাড়িতে কখন মিলিটারি আসে, কাকে ধরে নিয়ে যায়, মেরে ফেলে–তার ভেতর ডজন খানেক সোয়েটার বুনলেনও, যার একটিও পরে কাজে লাগেনি। কারণ শীতের শুরুতেই হঠাৎ করে যুদ্ধটা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

এই মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোথায় কোন বাংকারে, আর্মির প্রমোদখানায়, গুদামঘরে মেয়েরা আটকা পড়ে আছে, সেসব খবর আনতে শুরু করে। মেয়েগুলো রুগ্‌ণ, অসহায়। তাদের তুলে আনার জন্য গাড়ি, রাখার জন্য বাড়ি, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল দরকার। একে একে সবকিছুরই ব্যবস্থা হলো। তবে কে কোনটা করছে, আরেকজন সঠিকভাবে জানছে না। ‘আসলে কাজগুলো তখন হাতে হাতে হচ্ছিল,’ আরেকজন সমাজকর্মী মুক্তিকে বলেন। ‘আমাদের দিয়েই হচ্ছিল। অথচ আমরা জানছি না–কে কোনটা করছি।’ আর তাই যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মুক্তি কয়েকজন সমাজকর্মীর সাক্ষাৎকার কাট অ্যান্ড পেস্ট করেও ‘বীরাঙ্গনা অফিস’ নামে। একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় দাঁড় করাতে পারল না। মেয়েদের উদ্ধার করা থেকে শুরু করে পুনর্বাসনের দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি কয়েকজন মানুষের সাক্ষাৎকার, পেপার কাটিং আর দু চারটা ছেঁড়া ছেঁড়া ঘটনায় আটকে থাকল।

গর্ভপাতের আগ পর্যন্ত মরিয়ম নিজেকে নিজের হাতে রাখে। এরপর আর সম্ভব হয় না। কারণ বিষয়টা ক্লিনিক্যাল। তত দিনে বিদেশি ডাক্তার, নার্স আর স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকা পৌঁছে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ধানমন্ডির তিন নম্বর রোডের একটি সাদা বাড়ি, যা তখন বীরাঙ্গনা অফিস নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে, সেখানে তখন দিনে গড়পড়তা একশ জনের গর্ভপাত, প্রসব করানো আর আনুষঙ্গিক চিকিৎসা চলছে। হাসপাতাল শেষে সুস্থ মেয়েদের গন্তব্য দুটি। হয় তারা নিজেদের আগের ঠিকানায় ফিরে যাবে, না-হয় নিউ ইস্কাটন রোডে আশ্রয় নেবে। সেখানে মুখোমুখি দুটি বাড়ির একটিতে ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অন্যটি হোস্টেল। হোস্টেলে সেসব মেয়েই ছিল, যাদের বাড়িঘরের ঠিকানা তখনো পাওয়া যায়নি। বা পেলেও বাবা এসে হয়তো। বললেন, ‘মা পরে এসে নিয়ে যাব। আর দুইডা দিন কষ্ট করে থাক।’ তারপর বাবা ভাই কেউ আর নিতে আসেনি। পরের দিকে হোস্টেলটা শুধু বীরাঙ্গনা নয়, দুস্থ নারী আর এতিম শিশুদেরও আশ্রয়স্থল হয়। ‘যারা খাইতে দিতে পারত না, যাগো অনেক পোলাপাইন হইত, তারা রাইতের আন্ধারে পুনর্বাসনকেন্দ্রে বাচ্চা ফালাই দিয়া যাইত।’ কথাগুলো বলে সে সময়কার পুনর্বাসনকেন্দ্রের বাসিন্দা, বর্তমানে বাংলা ছায়াছবির সাইড একট্রেস বকুল বেগম। সে ’৭২ থেকে ’৭৪-এ দুই বছর আশ্রয়কেন্দ্রে পালাক্রমে এক সপ্তাহ রান্না করেছে, আরেক সপ্তাহ এতিম বাচ্চাদের গোসল দিয়েছে। বকুলের কাহিনি মুক্তি পরে শুনবে। সে এফডিসির সমান পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পরপর দু’দিন তার সাক্ষাৎকার দেয়। এই দু’দিনের পারিশ্রমিক ছিল মাত্র পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশ টাকা।

মন্টুর নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হওয়ার মাস খানেক পর মরিয়ম সংস্থার কর্তৃপক্ষকে যেচে তার ঠিকানা দেয়। পিতা কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপার। সেই সঙ্গে বলে যে, এটা তার নয়, মন্টুর বাড়ি ফেরার ঠিকানা। যে মন্টু একাত্তরের এপ্রিল মাস থেকে নিখোঁজ, যার জন্য বাড়িতে বাবা-মা-ছোট দুই বোন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

মরিয়মের বিলম্বিত কেসহিস্ট্রি সেদিনই প্রথম লেখা হয়। আর কাজটা করে তার সমবয়সি বেবি নামের একটি মেয়ে, যুদ্ধে যে স্বামী হারিয়েছে। মরিয়মের কথা বেবির মনে আছে এজন্য যে, তার বয়ানটা ছিল অভূতপূর্ব। লিখতে লিখতে কয়েকটা ফর্ম নষ্ট করতে হয়েছিল। অথচ প্রতিদিন কমপক্ষে একশ সোয়া শ ফর্ম কাটাকাটি না-করেই ফিলআপ করেছে বেবি। সেসব মেয়ের নাম-ঠিকানা দূরে থাক, চেহারাও আজ মনে নেই। ‘বড় নিষ্ঠুর এক সময়,’ বেবি কাঁচ-ঢাকা টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ার থেকে মুক্তিকে বলে, ‘আয়নায় নিজের মুখ দেখতেও তখন ভয় লাগত।’

এটা তার অফিসকক্ষের নিজস্ব টেবিল। যার কাঁচের ঢাকনায় বেবির পঞ্চাশোর্ধ্ব বলিরেখাময় মুখের প্রতিবিম্ব নড়াচড়া করছে একজন তরুণের পাসপোর্ট সাইজের ফটোর ওপর। ‘ছবিটা কার?’ প্রশ্নটা করেই মুক্তির মনে হয়, সে ভুল করে আগুনে খানিকটা ঘি ঢেলে দিয়েছে। ‘স্মৃতি বড় জ্বালাময়’, বেবি বাংলা গানের কলিটা সুরহীন গাইলেও, তাতে বিষাদের ছোঁয়া থাকে। তার দ্বিতীয় স্বামী কিছুতেই চায় না যে, প্রথমজনের স্মৃতির ছিটেফোঁটা বাড়ির কোথাও থাকুক। তাই প্রাক্তন স্বামী ঠাঁই নিয়েছে। অফিসের কাঁচ-ঢাকা টেবিলে। আমার অনুভূতিগুলি খাঁচাবন্দি পাখি, বেবি পাখির গলায় বলে, ‘তাই এখানে এদের লুকিয়ে রাখতে হয়।’ যতক্ষণ অফিস ততক্ষণ প্রথম স্বামী। ঘরে ঢুকলেই বর্তমান স্বামীর খপ্পরে সে পড়ে যায়। ‘দেশ আর আমার অবস্থা এক। একইভাবে ইতিহাসকে লুকাতে হচ্ছে।’ বলে ছোট্ট করে দম নেয় বেবি। সে পুনর্বাসন সংস্থায় বাহাত্তরে যে চাকরি করতে গিয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত নারী হিসেবে, দেশোদ্ধারের জন্য নয়, কথাটা মুক্তিকে সরাসরি আর অকপটে বয়ান করে। তবে তাকে যখন যা করতে বলা হয়েছে, সে বিনাবাক্যে করেছে। কাজে কখনো গাফিলতি হয়নি।

সে এক এলাহি কাণ্ড। বাচ্চাগুলো বিদেশ চলে যাচ্ছে। আর বিদেশ থেকে আসছে টাকাকড়ি, অদ্ভুত চেহারার মানুষজন আর নানান কিসিমের খাবারদাবার। সেলাই মেশিন, কম্বল, দুধ, পরিজ, কাপড়-চোপড়। স্বামী-পরিত্যক্ত, বাপে-ভাইয়ে খেদানো, ভবিষ্যৎহীন, জরায়ুশূন্য মেয়েগুলো লন্ড্রি, বেকারি চালাবে, কাপড় সেলাই করবে, রুমালে আর বালিশের ওয়াড়ে ফুল তুলবে। এটি গরিব দেশের পুনর্বাসন প্রকল্প। তাই সর্বাগ্রে টাকা রোজগার করে তাদের উদরপূর্তির কথা ভাবা হয়েছিল। নিরুপায় মেয়েরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। তাদের তৈরি কাগজের ফুলে অতিরিক্ত জৌলুস থাকত। বাচ্চাদের জামাগুলো হতো প্রমাণ সাইজের-রোগা-মোটা সব্বার জন্য মানানসই। তারা সুলভ আর স্বল্পমূল্যের কাঁচামাল, যেমন–বাঁশ আর পাট দিয়ে এমন সব নিত্যব্যবহার্য জিনিস বানাত, যা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির সহায়ক। তারা সূচিকর্ম ও সূক্ষ্ম কারুকাজের মাধ্যমে গর্বিত বাঙালি জাতিকে অলংকৃত করতে সচেষ্ট ছিল। প্রথম বিজয় দিবসের প্রদর্শনীতে এসব সামগ্রীর পাশে রাখা ছিল একটি কাঁচের ঢেকি–তাদের কারো কারো হারিয়ে যাওয়া জীবনের একমাত্র স্মারক। তাতে মেয়েরা ধান কুটছে। অদূরে ধানের আঁটি মাথায় কয়েকজন পুরুষ। এ ছাড়া তাদের রান্না করা সুস্বাদু খাবার ঢাকার বিপণিকেন্দ্রের পসার বাড়িয়েছিল। আজকের দিনে শহর এলাকার কনফেকশনারিগুলোতে যে হোমমেড আচার, জেলি, জ্যাম, কেক, বিস্কুট, নকশি-পিঠা, গুঁড়ো মশলাসহ নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সুলভে পাওয়া যায়, এর পেছনে আছে বীরাঙ্গনা ও বীরাঙ্গনাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা মেশানো শ্রম। ‘নিজেদের উজাড় করে দেশকে তারা অনেক দিয়েছে,’ বেবি মুক্তিকে বলে। ‘কিন্তু মানুষ তা মনে রাখে নাই।’

একজন বেতনভুক সমাজসেবীর মুখে এসব কথা শুনে মুক্তি অবাক হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের যে আত্মত্যাগ আর বিড়ম্বনা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে, কী নিষ্ঠুর পরিহাস, তা প্রস্ফুটিত হয়েছিল সামান্য ক’টা কাঁচের বয়ামে, প্লাস্টিকের ঠোঙায় আর রঙিন কাগজের ফুলে। শহরের গুণী মহিলারা যে যে-খাবারটা রাঁধতে জানতেন, গাড়ি করে এসে ঝটপট তাদের শিখিয়ে দিয়ে সেই গাড়িতেই বাড়ি ফিরে যেতেন। এভাবে মেয়েরা একেকজন বিনা খরচে ডাকসাইটে রাঁধুনি হয়ে উঠেছিল। তাদের তৈরি খাবার রোজ প্যাকেটে করে এমনকি সচিবালয়েও গেছে আমলাদের লাঞ্চ হিসেবে। বেবির আফসোস, ‘অতি বড় ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড় রাঁধুনি না পায় বর।’ তা না হলে, সরকারি-বেসরকারি সব রকম উদ্যোগ-আয়োজন সত্ত্বেও ওদের ভালো ঘরে বিয়ে হলো না কেন?

শুরুতে পত্রিকায় বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখে পুরুষের দল চিল-শকুনের মতো হামলে পড়ে। অনেক আবেদনপত্রের ইনভেলপ বেবি নিজের হাতে খুলেছে। সময়টা ’৭২ সালের এপ্রিল মাস। তখনো মেয়েগুলোর পুরুষভীতি প্রবল। বিয়ে তো বিয়ে, কথা বলায়ও চরম অনীহা। তারা আবেগশূন্য আর পাথর হয়ে গিয়েছিল। মেয়েরা নির্বাক, বেবিরাও নির্বাক। সবচেয়ে বড় কথা, তখন কারো মুখে কোনো কথা ছিল না। অগত্যা পাল্টা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিয়ের আবেদনকারীদের বিরত রাখা হয়।

‘দুঃখী, জনমের দুঃখী এরা। মন্দভাগ্য নিয়া জন্মাইছিল,’ বেবি হাহাকার করে। ‘আমার যত দূর মনে পড়ে, একবার দশ জনকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ওয়াইফ সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র, সেলাই মেশিন-টেশিন দিলেন। যারা টাকা নিয়ে বিয়ে করল, তারা খালি টাকা নিল, বউ নেয়নি। যারা বউ নিল, তারা তাদের পদে পদে অপমান করার জন্য নিল।’

আরেকজন সমাজকর্মী, যার নেশা এবং পেশা মেয়েদের স্বাবলম্বী করা, তিনি বললেন, একটা মেয়ের নাম ফুলের নাম দিয়ে, তারে আমরা বিয়ে দিছিলাম। বিয়ের পর সে সুখে আছে। বাহাত্তর থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, চাকরি দেওয়া দুটি কাজই সমান দক্ষতায় তিনি করেছেন। মেয়েরা সমস্যায় পড়লে এখনো ছুটে আসে তার কাছে, খালাম্মা, আপনি আমার বয়স কী দিছিলেন চাকরির সময়? এখনই আমার রিটায়ারের সময় হয়ে গেছে! তখন কী দিয়েছিলেন তাড়াহুড়োয় নিজেরও তার মনে নেই। আসলে দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় মেয়েগুলোকে তখন বয়স্ক দেখাত। ষোলো বছরের মেয়েকে মনে হতো ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের। তিনি স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে বেরিয়েছিলেন, মেয়েরা কে কেমন আছে খোঁজখবর নিতে। একজন বাড়ির গেট থেকেই জানিয়ে দেয়, আপনি এখানে আর আসবেন না। আপনারে দেখলে আমার অনেক কথা মনে পড়ে। আমার কষ্ট আরো বাড়ে। তবে দুটি বাচ্চা নিয়ে সে ভালোই আছে। সেদিন আরেকটা বাড়ি গিয়ে শোনেন, মেয়েটি দশ বছর আগে আত্মহত্যা করেছে। স্বামী দেরিতে জানতে পারে, যুদ্ধের সময় বউ শত্রুর ছাউনিতে ছিল।

‘এমন ঘটনা তো আমারও ঘটতে পারত,’ বেবি মুক্তিকে বলে। আমার বোনের ঘটতে পারত। আমার মায়ের ঘটতে পারত। আমরা বিরাট বাঁচা বাঁইচা গেছি।’ তবে চোখের সামনে যেসব মেয়ের সীমাহীন বিড়ম্বনা দেখতে দেখতে বেবি নিজের অকালবৈধব্যের যন্ত্রণা ভুলেছিল, তাদের প্রতি বরাবরই তার টান। তাদের আড়াল করার ব্যাপারে এখনো সে সচেষ্ট। বেবিরা তখন কেসহিস্ট্রি লিখে ঠিকানার অংশটা কেটে ছিঁড়ে ফেলত, যাতে মেয়েরা নির্বিঘ্নে ঘর-সংসার করতে পারে, ভবিষ্যতে কেউ তাদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া করার সুযোগ না-পায়।

এ হলো পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত পুনর্বাসনকারীদের চিন্তা ও কাজ। পরে যারা ক্ষমতায় আসে, তারা বান্ডিল বান্ডিল কেসহিস্ট্রি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরকম দামি রেকর্ড, ইতিহাসের উপকরণ আপনাদের কিংবা তাদের এভাবে নষ্ট করা কি ঠিক হয়েছে? এ ব্যাপারে বেবির মতামত, পেট্রোল দিয়ে পোড়ানো উচিত হয়নি, তবে এখন যে ইতিহাসের দোহাই দিয়ে মেয়েদের গরুখোঁজা হচ্ছে, তা-ও ঠিক নয়। ‘তোমরা কী করবে-না-করবে তার জন্য তারা কিন্তু বসে নেই,’ বেবি বলে। কারণ। ‘ওরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা মেনে নিয়েছে, কাজেই সেই জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অবকাশ আর থাকছে না।’

তার পরও মুক্তি বেবির কাছে মরিয়মের ঠিকানা চায়! যে ঠিকানা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, বেবি নিজেই অবাক–কেমন করে তা এত বছর পরও মনে রইল! সে মুক্তিকে কড়াল করায়, কঠিন কঠিন শর্ত দেয়। তারপর দুজনে আবদ্ধ হয় এক অলিখিত চুক্তিনামায়।

বে : ঠিকানা গোপন রাখতে হবে।

মু : হ্যাঁ, নামটাও গোপন থাকবে।

বে : ওকে নিয়ে পরিহাস করা চলবে না।

মু : না! কোনো তথ্যবিকৃতিও ঘটবে না।

বে : পত্রিকায় এ নিয়ে চমকপ্রদ ফিচার লেখা চলবে না।

মু : রিপোর্ট বা পত্রিকায় কলাম লেখাও হবে না।

বে : টিভিতে প্যাকেজ নাটক করা যাবে না।

মু : স্বল্প বা পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও নয়।

বে : ছবি ছাপানো যাবে না।

মু : সাদা-কালো বা রঙিন কোনোটাই নয়।

বে : কাজটা কঠিন কিন্তু।

মু : হ্যাঁ, খুবই কঠিন।

শর্তগুলো ছিল মৌখিক। তাই মরিয়মকে মুখে মুখেই জানাতে হচ্ছিল মুক্তির। সে শোনামাত্র এক ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেয়। বলে, তার পক্ষে এমন কেউ শর্তারোপ করতে পারে না, যার সঙ্গে দীর্ঘ আটাশ বছর একবারও দেখা হয়নি, এমনকি যার চেহারাও তার মনে নেই। তবে মরিয়ম বেবির মতোই বলে, ‘তখন এমন এক সময় গেছে, যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখতেও ভয় লাগত।’ এ ছাড়া এই মুখ, এই শরীর আর কারো সঙ্গে বদলে ফেলার তীব্র ইচ্ছা হতো মরিয়মের। কিন্তু কে তাতে রাজি হবে? এমন যে দুস্থ নারী বেবিরা, যুদ্ধে স্বামী হারিয়েছে, তারাও তাতে রাজি হতো না। বিধবার বসন শুধু শুভ্র নয়, দেহটাও নিষ্কলঙ্ক, যা মরিয়মদের নেই। একদিন এক রিকশাঅলা ধানমন্ডির বাড়িটাকে বীরাঙ্গনা অফিস বলাতে সমাজকর্মীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কে কোনদিকে পালাবে তার ঠিক নেই। তারপর তারা নিজেরা যে বীরাঙ্গনা নয়, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু তা প্রমাণ করবে কীভাবে? বীরাঙ্গনাদের তো মেডেল দেওয়া হয়নি যে, অবীরাঙ্গনারা গলার কাপড় সরিয়ে বলবে, এই দেখেন ভাই, আমার গলায় মেডেল নাই, আমি বীরাঙ্গনা না। এদিকে চাকরি বা বিশেষ পদটা ঠিক রাখার জন্য এখানে রোজই তাদের আসতে হচ্ছে। গাড়ি না থাকলে রিকশাই একমাত্র বাহন। বীরাঙ্গনা উপাধিটা যেন বিষাক্ত পোকা কিংবা ছোঁয়াচে রোগ, মরিয়ম ভয়ানক তিক্ততা নিয়ে মুক্তিকে বলে, ‘এর ছোঁয়া লাগলে শরীরে ঘা হবে, হাত-পা পচেগলে খসে পড়বে।’ অথচ তারাই শতমুখে বলত, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা জাতির গর্ব, তোমরা মহীয়সী নারী!’ বেবিরা মহীয়সী নারী হতে চাইত, জাতির গর্ব তাদের কেউ কেউ তো হয়েইছিল, কিন্তু কোনোভাবে বীরাঙ্গনা নয়। মরিয়মের ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।

সাইড একট্রেস বকুলের কিন্তু মরিয়মের মতো অভিযোগ নেই। বরং তার বিরুদ্ধে মুক্তির কাছে নালিশ জানালেন তখনকার একজন সমাজকর্মী। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। বকুলের ঘটনার পর কান ধরে কসম খেয়েছেন, খোদা যেন ইহজনমে তার হাত দিয়ে অন্যের উপকার না-করায়। কারণ ভদ্রমহিলাকে সে প্রায় পথে বসাচ্ছিল। সংসারটা হয়তো ভেঙেই যেত, যদি তার সহকর্মীরা সময়মতো এগিয়ে না আসতেন। ‘মানুষের উপকার করতে নেই। বিপদ কেটে গেলে উল্টা ছোবল মারে।’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বৃদ্ধা কথাটা বললেন মুক্তিকে।

কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বকুলের। পুনর্বাসনকেন্দ্রের সেলাই-ফোঁড়াই- এমব্রয়ডারিতেও মন নেই। একবার ছোট ছেলের জন্মদিনে হাতে হাতে খানিকটা সাহায্য করার জন্য সমাজকর্মী তাকে বাসায় দাওয়াত করে এনেছিলেন। জন্মদিনটা যেন এ বাড়ির ছেলের নয়–ওর। বকুল সেদিন অনেক ফুর্তি আর মজা করল। ‘খালাম্মা এত সোন্দর বাসা আপনের, এইহানে থাকতে মন চায়।’ গৃহকত্রী নিজগৃহের প্রশংসা শুনে হাসলেন, ‘ধুর পাগলি, মন চাইলেই কি সব সম্ভব!’ কিন্তু মনে মনে ভাবলেন অন্য কথা। পুরোনো বাবুর্চির বয়স হয়েছে। চোখে দেখে না। দারচিনি ভেবে মরা আরশোলা তরকারিতে ছেড়ে দেয়। মেয়েটা থেকে গেলে মন্দ হয় না। বকুল থেকে গেল। রান্নাটা সে ভালোই করত। কর্তা তো তেলে-ঝোলে খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অফিস ছুটির পর রোজ সাবান, স্নো, পারফিউম এটা-সেটা ব্যাগে নিয়ে ফেরেন। স্ত্রীর রাগী মুখ দেখলে বলেন, ‘আমাদের মেয়ে থাকলে দিতে না এসব? ধরো ও আমাদের মেয়ে।’ তারপর আর কথা থাকে!

বকুল আসলে তাদের মেয়ের মতোই ছিল। বাসায় মেহমান এলে স্বামী-স্ত্রী তাকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন। মেয়েটাও তাদের আব্বা-আম্মা বলে পাখির মতো কলকলিয়ে ডাকত। কিন্তু এভাবে এক বছরও ঘুরল না। বকুলের পেটে বাচ্চা চলে এল। ‘তুই আমায় বল, কে তোর এত বড় সর্বনাশ করল। ওর সঙ্গে এখনই আমি তোর বিয়ে দেই।’ তিনি ভেবেছিলেন, বাড়ির ড্রাইভার মতিন না হয় সাদেক। জোরাজুরি করতে বকুল বলে, ‘আব্বা।’ তবু ভালো, পুনর্বাসনকেন্দ্রে ভদ্রমহিলার সহকর্মীদের জেরার মুখে সে সাদেক ড্রাইভারের নাম বলেছিল। পুরোনো ড্রাইভার ছাড়িয়ে নতুন ড্রাইভার পাওয়া গেছে। কিন্তু স্বামীর নামে কলঙ্ক রটে গেলে তিনি কী করতেন? এটা যুদ্ধের চার বছর পরের ঘটনা। বিদেশি ডাক্তাররা অনেক আগে চলে গেছে। বিশেষ অর্ডিন্যান্সের মেয়াদও শেষ। তাই বকুলের গর্ভপাত করাতে তাদের অশেষ বেগ পেতে হয়।

মুক্তি তো অবাক, এত বড় ঘটনা, অথচ বকুল বেগমের তা মনে নেই। সে বলে, ‘পিতা-পুত্রী ছায়াছবির কথা কচ্ছো নাকি তুমি?’ কারণ সেই ছবিতেও তার এরকম একটা পার্ট ছিল। সেখানে গর্ভপাত করানোর পর বিবি সাহেবের বাসা থেকে তাকে তাড়ানোর মধ্য দিয়ে কাহিনি শেষ হয়। বয়সকালে বকুল এই কিসিমের বহু সাইড পার্ট করেছে। আজকাল এসব তার মনেও থাকে না। একটার কথা ভাবলে আরেকটার কাহিনি চলে আসে। তবে সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিল তখন। চেহারা ভালো, স্লিম। ফিগার। একবার চিত্রতারকা শাবানার প্রধান সখির পার্ট করার সময় নাচ আর ছোটাছুটির অংশটা একা তার ভাগে পড়েছিল। এমনকি পুরুষের সঙ্গে টেক্কা দিতে ছবিতে সে হিরোইনকে সিগারেট খাওয়া ধরায়, জুডো-কারাতে শেখায়। ছবির শ্রেষ্ঠাংশে বড়মানুষের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলো কার? কার আবার সিগারেটখোর শাবানার, জনমদুখিনি বকুলের নয়। এ নিয়ে তখন তার খুব মনঃকষ্ট গেছে। অভিনয় শেষে রাতে ভালো ঘুম হতো না। কান্নাকাটি করে বালিশ ভিজিয়ে ফেলত। মনে হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যায়ের জায়গা সিনেমা। তবে পেটে দানাপানি থাকলে মানুষ নানান কিছু নিয়ে ভাবে, অযথা দুঃখ করে। তখন বয়স কম ছিল, টাকাও ছিল। এখন কালেভদ্রে ডাক পড়ে। নানি-দাদির পার্ট। সারা দিন স্টুডিওতে বসে বসে পিঠব্যথা, মাজার হাড় কনকন করে। দিন শেষে ম্যানেজার ছোকরা এসে বলে, ‘বকুলি, আজ হলো না রে, কাল আবার আসিস।’ এখন তো রোজ হিসেবে পেমেন্ট। তো খালি হাতে বাড়ি ফেরা। হাত খালি তো পেট খালি।

‘অন্য কাজ খুঁজে নেন না ক্যান?’ মুক্তির কথা শুনে বিরক্ত হয় বকুল। ‘সবাই বলে কাজ খোঁজো, কাজ করো,’ সে মুখ ঝামটা দেয়। ‘করলে কি কাজের অভাব? আমি তো ছিড়া ব্লাউজ-পেটিকোট পইরা রাস্তায় পয়সা তুলতে পারি। আমার অসুবিধা নাই কোনো। কিন্তু ভয়টা ইজ্জতের। বীরাঙ্গনার ইজ্জত না বাঁচলে, দেশের ইজ্জত বাঁচবো?’

‘অহ্, আপনে যে বীরাঙ্গনা, হেইডা কোন ছায়াছবির পার্ট?’

‘জীবন নামের ছায়াছবির,’ হাসিমুখে বকুলের ঝটপট জবাব।

‘এইটা ভোলেন নাই যে বড়?’

‘ভুলতে চাইলে কি ভোলো যায় রে পাগলি? কিছু কিছু জিনিস মনে থেকেই যায়।’

যে দৃশ্যটা কোনো ছায়াছবির নয়, অথচ বকুল বেগম গত উনত্রিশ বছরে এক দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি, তা মাত্র ১৫ মিনিটের। তারিখটা আজ মনে নেই। সেদিন ছিল সোমবার। বেলা দশটার দিকে বাড়িতে মিলিটারি আসে। উঠোনে তাদের দেখামাত্র বকুল লম্বা ঘোমটা টেনে দেয়। তারা উর্দুতে ‘কুছ নেহি, ডর নেহি’ বলতে বলতে ঘরের দাওয়ায় উঠে আসে। সঙ্গিন উঁচিয়ে একজন দাঁড়ায় দরজায়। আরেকজন বকুলকে জাপটে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঠের তক্তপোশের ওপর।

‘লোকটা দেখতে কেমন ছিল?’ মুক্তির প্রশ্নটা ধর্ষিত মেয়েকে উকিলের জেরা করার মতো শোনায়। নিজের কানেই তা বেখাপ্পা ঠেকে। তবু সে নিরুপায়। বকুলের মুখে ধর্ষণের বীভৎস বর্ণনা শোনার চেয়ে এ মুহূর্তে প্রশ্ন করাটাই শ্রেয়। মুখ বেঁকিয়ে বকুল বলে, ‘কালো-ছালো, হ্যাংলা!’ আর নিজে সে তখন ছিল হালকা-পাতলা, গায়ের রং শ্যামবর্ণের। ‘এখনো সাজলে তুমি আমারে চিনতে পারবা না।’ বকুল মুক্তিকে গর্ব করে বলে। যা হোক, ১৫ মিনিটে কেয়ামত হয়ে গেল। পাশের ঘরে শাশুড়ি ছোট ছোট দুই নাতনি নিয়ে জায়নামাজে বসা। উঠে আসারও সময় পেলেন না। দরজার সঙ্গিনধারী ঘরে ঢুকে বাক্সের তালা ভেঙে স্বর্ণের মাকড়িজোড়া তুলে নিল। দেয়ালের তাক থেকে সরাল মোরগমার্কা টেবিল ঘড়িটা, যা বড় মেয়ের জন্মের পর ওর নানা নাতনিকে উপহার দিয়েছিল। সেটা পকেটে ঢুকিয়ে পাষণ্ডটা লেদারের সুটকেসটা দু’ভাগ করে রেখে চলে যাওয়ার সময় বকুলের মুখে একদলা থুতু ছিটাল আর কিছু করেনি।

স্বামী বাড়ি ফিরে এটা ভাঙে, ওটা আছাড় মারে। মিলিটারির মতোই তার আচার ব্যবহার। শ্বশুর-শাশুড়ি পুত্রবধূর হাতের রান্না খান না। বকুল পাকের ঘরে বিছানা পেতে চোখের পাতা এক করলে শুধু দেখে, মিলিটারির ভয়ে সে পালাচ্ছে-এই পাড়া থেকে ওই পাড়া, ওই পাড়া থেকে এই পাড়া। কেউ তাকে আশ্রয় দিচ্ছে না। এভাবে কোনোমতে দেশ স্বাধীন হয়। বকুলের দূরসম্পর্কের মামা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। দেনদরবার করেও কিছু হয় না। মেয়ে দুটিকে তারা রেখে দেয়। বকুল শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে মাফ চেয়ে জন্মের মতো স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। ধানমন্ডির তিন নম্বর বাড়িতে তার এমআর হয়েছিল ’৭২ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে।

মরিয়ম তখনো পুনর্বাসনকেন্দ্রের হাসপাতালে। ছোটখাটো সমস্যা বাদ দিলে সুস্থই আছে। কিন্তু সেলাই-ফোঁড়াই, টাইপিং বা রান্না শেখায় তার মন নেই। সে মুক্তিকে বলে, ‘এসব কাজে মনের স্থিরতা লাগে, গিন্নিবান্নির মতো ধৈর্যের দরকার হয়,’ যার একটিও তখন তার ছিল না। কারণ অতীতটা বিভীষিকা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত আর মন্টুর অস্তিত্ব শুধু নিখোঁজ সংবাদের পাতায়, এদিকে পত্র পাঠানো সত্ত্বেও কফিলউদ্দিন আহমেদের দেখা নেই। এ কষ্টের ভেতর পূর্বপরিচিত বলতে মিলিটারি ক্যাম্পের সঙ্গী শোভা রানী। সে হানাদার বাহিনীর ছেলের মা হবে। ডেলিভারির আগের রাতে মরিয়ম তার মাথার চুল দু’ভাগ করে দুটি বেণি করে দেয়। বিধবার প্রথম সন্তান। এটা শেষ চান্সও বটে। মরিয়মের বয়স মাত্র বাইশ। যখন তার বিয়ে হবে, বাচ্চা বিয়োনোর সময় আসবে, তখন শোভা রানী পাশে না থাকুক, অন্য কেউ নিশ্চয় চুল আচড়ে বেণি করে দেবে। শোভা রানী উত্তেজিত। বলে, ‘ইশ্‌ মেরিদি, কী গরম!’ তার গলায় আর মুখে মরিয়ম আদর করে পাউডার পাফ বুলিয়ে দেয়। লেবার রুমে ডাক্তারের নির্দেশমতো ঘন ঘন চাপ প্রয়োগ আর কাতরানোর সময় তার ঘাম ও চোখের জলে পাউডার ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল। প্রসূতি একবার কাঁদে, একবার হাসে। সে একটা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা রাত যুদ্ধ করে। ভোররাতে উঁচু পেটটা ধীরে ধীরে নেমে গিয়ে শোভা রানীর দু’পায়ের ফাঁকে বিমল দাসের বংশের প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

কফিলউদ্দিন আহমেদ সপরিবারে ঢাকা আসার চার দিন আগে শোভা রানীর শাশুড়ি সুরবালা লোকজনকে জিগ্যেস করে করে বীরাঙ্গনা অফিসে পৌঁছে যান। পুনর্বাসনকেন্দ্রের পত্র পেয়ে নবজাতকের ঠাকুমার আর তর সইছিল না। কাপড়ে চিড়ে-গুড় বেঁধে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। শোভা রানী যা ভেবেছে, তা সত্য হয়েছে। কিন্তু অনুরাধা কই? দরজায় গ্রেনেড ফাটার পর থেকেই সে উধাও। হানাদাররা হলরুমে তাকে ফেরত পাঠায়নি। শোভা রানী স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত ওখানেই ছিল। কী হলো অনুরাধার? মরিয়মের মতো ক্যান্টনমেন্টের কোনো একটি ঘরে হয়তো আরেকজন আর্মি অফিসার রিপোর্টে ‘বিপজ্জনক’ লিখে তাকে আটকে রেখেছিল। অনুরাধা কি শেষমেশ পাকিস্তান যেতে পেরেছে? মরিয়মের হঠাৎ মেজর ইশতিয়াকের কথা মনে পড়ে। নিজের ওপর তার আস্থার অভাব। পেটে বাচ্চা নিয়ে লাহোরের গুলবাগিচায় যাওয়াটা তাই বেমানান মনে হয়েছিল। পাঞ্জাবি মহিলার গোলাপি লিপস্টিক রঞ্জিত ঠোঁট আর আঁকা ড্রর কাছে সে নির্ঘাত হেরে যেত। সম্মোহনী চোখ, মোহিনী রূপ বাংলামুলুকের নিজস্ব সম্পদ। এখানেই বিকাশ, এখানেই লয়। বাইরে হয়তো তা লক্ষ্যভেদী হয় না। অনুরাধা মাইনাস ফাইভ পরকলায় ঢাকা ঘোলা চোখ নিয়ে ওখানে গিয়ে থাকলে, এখন কী করছে?

পুত্র কোলে শাশুড়ি সুরবালার সঙ্গে শোভা রানীর চলে যাওয়ার পর মরিয়মের নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। জরায়ুর শূন্যতা হঠাৎ তাকে গ্রাস করে। একই দিনে ডাকে ফেলা চিঠির সাড়া দিয়ে সুরবালা এসে নাতি-পুত্রবধূ নিয়ে চলে গেলেন, কফিলউদ্দিন আহমেদের এখনো দেখা নেই। বংশের বাতিই সব, জীবিত মেয়ের কোনো দাম নেই, এত বড় একটা যুদ্ধের পরও? লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, সেবাসদন আর অন্যসব জায়গায় বীরাঙ্গনাদের বাচ্চা হয়েছিল কয়টা। তাদের বিদেশ না পাঠালে স্বাধীন দেশটার কী ক্ষতি হতো? তারা পাকিস্তানি জালিমের বাচ্চা শুধু, বাঙালি মেয়ের নয়? খোঁচাখুঁচি করার ফলে জরায়ু আহত হয়েছে তো মরিয়মের একার, মেজর ইশতিয়াক যে শরীর নিয়ে এসেছিল সেই শরীরেই ফিরে গেছে। তার আসা-যাওয়ার পথটাই শুধু বদলে গিয়েছিল। আগমন : পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ। নির্গমন : বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তান। ব্যস, এইটুকুই। মাঝখানে কতশত মানুষ মারা গেল, কতশত মেয়ে নির্যাতিত হলো, কতশত ঘর পুড়ল, কয়েক শ ব্রিজ আর কালভার্ট উড়ে গেল-মরিয়ম বীরাঙ্গনা অফিসে জনে জনে জিগ্যেস করে আর আঙুল গুনে হিসাব করে। সকালের দিকে সংখ্যাটা গণনাযোগ্য মনে হলেও দুপুর নাগাদ সে খেই হারায়। রাতটা পার হয় মরফিনের ঘোরে। পরদিন সংখ্যাগুলো ছোট ছোট সাপের আকৃতি নেয়। তৃতীয় দিনে ডাক্তার রোগ নির্ণয় করলেন–ইপিলেপসি সাইকোসিস। এর উপসর্গ হচ্ছে ঘুম না হওয়া, খেতে না পারা, মূৰ্ছা যাওয়া, ছোটাছুটি করা, অস্থির হয়ে পড়া। চতুর্থ দিনে কফিলউদ্দিন আহমেদ মেয়েকে শনাক্ত করলেন। কর্তৃপক্ষকে বললেন যে, পাগলামিটা তাদের পারিবারিক অসুখ। যুদ্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মেরির দাদিরও মাথা গরম ছিল। তার এই নাতনি কোনো কারণ ছাড়াই একবার সিনেমা দেখার নাম। করে বাড়ি থেকে চলে যায়। ২৫ মার্চের আগে শহরের লোকজন যখন যার যার গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছিল, সে তখন ছোট ভাইকে ফুলতলি পাঠিয়ে রায়েরবাজারের বাসায় একা পড়ে থাকে। এসব কি পাগলামির লক্ষণ নয়? কফিলউদ্দিন আহমেদের হাটে হাঁড়ি ভাঙার কারণ আর কিছু নয়, তিনি শুধু মেয়েকে এই কলঙ্কের জায়গা থেকে গোলাম মোস্তফার কথামতো তড়িঘড়ি সরিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। তার পরও ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আরো এক সপ্তাহ বীরাঙ্গনা অফিসে থাকতে হয় মরিয়মকে।

১৮. একটি আদর্শ জাদুঘর

কফিলউদ্দিন আহমেদের ঢাকা আসার বিলম্বের কারণ সাত-পাঁচ ভাবনা। মেয়েকে গাঁয়ে আনা ঠিক হবে না, বীরাঙ্গনা অফিসে রাখাও সমীচীন নয়, রায়েরবাজারের বাড়িটা শুনেছেন বাসযোগ্য নেই, তাহলে কোথায়? তিনি তার চিরকালের উপদেষ্টা গোলাম মোস্তফার শরণাপন্ন হন। যদিও চতুর শ্যালকের অবস্থা আর আগের মতো নেই। বিজয়ের আট সপ্তাহের মাথায় পত্রিকার হিসাবমতে চার হাজার দালাল গ্রেফতার হয়েছে। এদিকে গোলাম মোস্তফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা একবার ধরে, একবার ছাড়ে। সহায়-সম্পদ বেহাত হওয়ার জোগাড়। ঢাকার তিনটা বাড়ির দুটোই এখন মুক্তিযোদ্ধা নামদারদের দখলে। পুত্র-কন্যা এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দিয়ে, মগবাজারের তিন কামরার বাসায় তিনি ঘাপটি মেরে আছেন। এই অবস্থায় কফিলউদ্দিন আহমেদের চিঠি হাতে আসে, ‘ভাই মোস্তফা, আমার নিদানকালের বন্ধু। তুমি জানো হয়তো, আমার বেয়াড়া মেয়েটা এখন পুনর্বাসনকেন্দ্রে। এরে নিয়া কী করি, কই যাই?’

বীরাঙ্গনা জাতির গর্ব। তাদের নিয়ে আজকাল খুব নাচানাচি হচ্ছে। কেবল দেশের লোকই নাচছে না, বিদেশিরাও নাচছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাগনেটা আজ বেঁচে থাকলে গোলাম মোস্তফার এই দুরবস্থা হতো না। স্বাধীনের চার মাস পরও সে যখন ফিরল না, আর কি ফিরবে? গোষ্ঠীতে একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকলে আজকাল পুলসেরাতও পার হওয়া যায়। তিন-তিনটা বেজন্মার পিতা হয়েছেন তিনি। একটাও যদি কোনো কাজে লাগে। যুদ্ধের নয়টা মাস, বিছানায় শুয়ে-বসে ছাড়পোকার ডিমে তা দিয়ে বংশ বিস্তার ঘটিয়েছে শুধু। ফাঁকে ফাঁকে তাস নিয়ে বাজি। পাকিস্তান হারবে না ভারত জিতবে। যেন ক্রিকেট ম্যাচ। তাদের একজনও যদি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিত বা যুদ্ধে শহিদ হতো, তাহলে তো তিনি আজ বীর বিক্রম (বিবি) কি বীর প্রতীক। (বিপি) মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যবান পিতা। তার সম্পত্তি দখল নেয়, এমন বুকের পাটা কার। যা হোক বাকি আছে ভাগনিটা, সে একজন বীরাঙ্গনা, জাতির গর্ব। গোলাম মোস্তফা মনে মনে ফন্দি এঁটে কফিলউদ্দিন আহমেদকে লিখেন, ‘দুলাভাই, আপনার নসিবটাই মন্দ। কোন পাপে খোদা নাখোশ হলেন কে জানে। সব তার মর্জি। আমরা তার আজ্ঞাবহ মাত্র। তবে মুশকিল যিনি দেন, আসানও তিনি করেন। বুবুসহ অতিসত্বর ঢাকা চলে আসেন। যত খারাপ অবস্থায়ই থাকি না কেন, আপনার পুত্র কন্যার জন্য এই অধমের দ্বার অবারিত। ইতি আপনার স্নেহের গোলাম মোস্তফা।’

চিঠিটা ভাঁজ করে তোরঙ্গে রেখে কফিলউদ্দিন আহমেদ তৈরি হতে বলেন স্ত্রীকে। কী ব্যাপার কী বৃত্তান্ত, মনোয়ারা বেগম কিছুই জানেন না। শ্যালক-দুলাভাইয়ের চিঠি চালাচালি তার কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। তিনি ভাবলেন, মন্টুর কোনো খবর, যা খারাপই। ভালো কিছু হলে ছেলে নিজেই বাড়ি আসত। মন্টু, তার জলজ্যান্ত ছেলেটা, গত এক বছর খালি স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। ঘুম ভাঙার পর নাই, কোথাও নাই। তার। চোখের সমুদ্রে দিনমান ডুবে থেকে রাতের অন্ধকারে দূরতম সাগরের মাঝখানে ভেসে ওঠে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরায়। তাকে ছোঁয়া যায় না। তার নির্দিষ্ট কোনো আকারও। নেই। একেক দিন একেক রকম। গর্ভে থাকার সময়টার মতন। এভাবে স্বপ্নের মধ্য দিয়ে, বিশ বছর পর, মন্টু যেন মাতৃগর্ভে ফিরে আসে।

মন্টু পেটে আসার পর মনোয়ারা বেগম মনেপ্রাণে চাইতেন, ছেলে হোক। ছেলেই যেন হয় খোদা। দু-দুটো মরা ছেলে জন্ম দেওয়ার পর বিয়ের দশ বছরের মাথায় মেরি হলো। মেয়েটা স্বাস্থ্যবতী, হাস্যোজ্জ্বল। কিন্তু কেউ খুশি হলো না তাতে। এর চেয়ে মৃত পুত্রের জননী হওয়া যেন গর্বের–সকলের এমনই মনোভাব। অনেক তাবিজ-কবচ আর পিরের থানে শিরনি দেওয়ার পর মন্টু এল। বংশের একমাত্র ছেলে। মাটিতে রাখলে পিঁপড়ে খাবে, পানিতে নিলে সাপে কাটবে, এমন তুলুতুলু করে মানুষ। করেছেন। মেরির একগুঁয়েমির পাশে ছেলে হয়েও সে নম্র-শান্ত। খেতে না পেলে যে কাঁদত না, যা করতে বলা হতো তা-ই করত, সেই ছেলের বুকে এত আগুন ছিল? সে যুদ্ধে চলে গেল নিজের মাকে না বলে! ছেলের হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে তার বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণাটাই যেন প্রবল। শরীরের একটি অঙ্গ যেন প্রতারণা করল বাকি শরীরটার সঙ্গে। মনোয়ারা বেগম ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

এ দৃশ্য কফিলউদ্দিন আহমেদের আর সহ্য হয় না। যুদ্ধের পুরো সময়টায় পাকসেনার ভয়ে পুত্রকে আর সমাজের ভয়ে মেয়েকে আড়াল করতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে দেয়াল উঠে গেছে। এর পলেস্তারা এখন খসে পড়ছে। মুখব্যাদান করছে। কুৎসিত ইটের গাঁথুনি। কী হবে তাদের? বাকি জীবন কাটাবেন কী করে? খোদার হাতে এমন কিছু কী দেওয়ার আছে, যা থেকে তারা এর পরও বাঁচার খোরাক পাবেন? একমাত্র ছেলেটা নেই। মেয়ের এভাবে থাকার চেয়ে না-থাকাটাই ভালো ছিল। কিন্তু তাকে ফেলতেও তো পারছেন না। কফিলউদ্দিন আহমেদ বাবা। তিনি আর সব। বাবাদের মতো বিশ্বাস করেন, সন্তানদের দুনিয়ার মুখ দেখিয়েছেন এই অঙ্গীকারে যে, সর্বশক্তি দিয়ে, শেষ সামর্থ খরচ করে তিনি তাদের রক্ষা করবেন। এত বড় যুদ্ধ। কত অসহায় তিনি। পারলেন না ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে।

যে মানুষকে কোনো দিন কাঁদতে দেখা যায় না, সে যে কাঁদতে জানে, মানুষ তা ভুলে যায়। তার হো-হো শব্দে বুকফাটা চিৎকারটা তাই ঠাট্টার মতো শোনায়। মনোয়ারা বেগম প্রথম বুঝতে না-পেরে চমকে ওঠেন। দুজনের মাঝখানের দেয়ালটা যেন ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। পাথরসদৃশ একজন মানুষ, স্ত্রীর লুকিয়ে কান্নাও গত এক বছর যার অনুমোদন পায়নি, চোখের সামনে তাকে ভেঙেচুরে মাটি-কাদায় মিশে যেতে দেখছেন মনোয়ারা বেগম। হায় বাপ! এমন নিষ্ঠুর কেউ কি দুনিয়ায় আছে, যে সন্তানের মরা মুখ দেখার আগে নিজের মরণ চায় না? তার স্বামী আসলে তো একটা জিন্দা লাশ। মিলিটারির ভয়ে এতদিন বাঁচার ভান করে ছিলেন। মনোয়ারা বেগমের একার গোপন কান্না আর গোপন থাকে না, দুজনের কণ্ঠ চিরে তা জনসমক্ষে বেরিয়ে আসে।

দরজার পাল্লা ধরে হিক্কা তুলে কাঁদছে ছোট দুটি যমজ মেয়ে রত্না আর ছন্দা। চোখের জল আর হাতের কাদায় তাদের কচি গাল দুটি মাখামাখি। ফুলতলি গ্রাম ভেঙে পড়েছে বাড়ির উঠোনে। এক ঝাক কাক কা কা করে উড়ে আসে সুন্দরীর জলার ওপর দিয়ে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেখতে দেখতে আজ চার মাস হয়ে গেল। এলাকার কে বাঁচল, কে মারা গেল–এর হিসাব-নিকাশ শেষ। যুদ্ধের নয় মাস মিলিটারির ভয়ে গোপন রাখা হলেও মন্টুর ঘটনাটা এখন প্রকাশ্য। খবরের কাগজে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে তা জানান দেওয়া হয়ে গেছে। মেরি একা রহস্যময় পর্দার আড়ালে। তা বলে গাঁয়ের লোকের অজানা কিছু নেই। তারা শুধু এত দিনের গুজবটার সত্যতা যাচাই করতে উঠানে জড়ো হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর যৌথ শোকপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা তা জেনেও গেছে। কফিলউদ্দিন আহমেদ যখন সস্ত্রীক ঢাকা রওনা করেন, গোপনীয়তার আব্রু হারিয়ে তখন পথের ভিখিরির অবস্থা তার। নিঃস্ব, সম্মানহীন। এই অবস্থায় তিনি সুন্দরীর জলা অতিক্রম করেন, ভিড় ঠেলে বাসে চড়েন, ভাঙা ব্রিজের নিচ দিয়ে খেয়া পার হন, তারপর খানিকটা রিকশা, ফেরি পারাপার, আবারও বাস, অবশেষে ঢাকা। সেখানে আছে গোলাম মোস্তফা, তার নিদানকালের বন্ধু, যে তাকে খোয়ানো সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারে।

গোলাম মোস্তফা তার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন।

মগবাজারের বাড়িতে যদিও আগের সেই জেল্লা নাই, জানালার পর্দা ঘেঁড়া, টেবিলের কাপড় ও বালিশের ওয়াড়ে ময়লা জমে মাটি মাটি; রসুইঘরের চুলায় রেশনের দুর্গন্ধময় চাল ফুটছে, তবু গোলাম মোস্তফা সদাহাস্যময় চেহারাটা নিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানান। মনোয়ারা বেগম মায়ের পেটের ভাইকে জড়িয়ে কেঁদেকেটে একশেষ। মামার কথায় ছেলেমেয়ে দুটিকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন শহরে। কখনো দুর্ভাগ্যের জন্য নিজের কপালের দোষ দিচ্ছেন, পরক্ষণে গোলাম মোস্তফাঁকে দায়ী করছেন। কফিলউদ্দিনের হাবভাব কিন্তু ভিন্ন। তিনি যেন মাতৃজঠরের নিরাপত্তায় প্রবেশ করেছেন। এমন একজন অবিচল মানুষই আজ তার দরকার, যে তার সামনে দাঁড়িয়ে এবং শত অভিযোগ-বিড়ম্বনায়ও যে চুল পরিমাণ টলছে না। তবে লোকটার পূর্বের কর্মোদ্যম আর তৎপরতায় যেন কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছে। বাড়ি থেকে সারা দিনে একবারও তাকে বেরোতে দেখা যায় না। বন্ধুবান্ধব থেকেও নেই। খবরের কাগজের অক্ষরগুলোই এখন তার দিকনির্দেশক। টাল টাল কাগজের তলা থেকে কফিলউদ্দিন আহমেদকে দেখানোর জন্য কয়েকটা পাতা তিনি টেনে বাইরে আনেন। মেরির মতো মেয়েদের চিকিৎসা আর পুনর্বাসনের জন্য বিদেশ থেকে টাকা আর মানুষ আসছে। মেয়েগুলো সুস্থ হওয়ার পর কাজ শিখবে। অর্থের অভাব নেই। তাদের চাকরি দেওয়া হবে। চাইলে কেউ কেউ ব্যবসা ফেঁদেও বসতে পারে। কিন্তু এসব কি জীবনের সব? বিয়ের দিকটা ভাবা দরকার। এ নিয়ে এমনকি সরকারও ভাবছে। বিয়ের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। গোলাম মোস্তফা নিউজপ্রিন্টের পাতাটা ভগ্নীপতির সামনে মেলে ধরে বলেন, ‘দুলাভাই, এই দেখেন।’

কফিলউদ্দিন আহমেদ ভিরমি খেলেন। সরকারের এত প্রশংসা যে, শ্যালক আবার দলবদল করল নাকি? তিনি গোলাম মোস্তফাঁকে দেখবেন, না কাগজের দিকে তাকাবেন। যেহেতু মেয়েটা তার এবং এ নিয়েই কথা হচ্ছে, তিনি কাগজে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু গোলাম মোস্তফা মনে করছেন, বীরাঙ্গনাদের যারা বিয়ে করতে আসছে তারা সৎ নয়, এখানে তাদের স্বার্থ আছে। সরকার যতই বাহবা দিক, তাদের দেশপ্রেমিক বলুক, তারা আসলে দেশপ্রেম থেকে আসে না বিয়ে করতে। সবার যেমনই হোক, মেরেকেটে একটা পরিবার আছে, সমাজ আছে। সমাজ চুপ থাকবে না। থাকলেও কত দিন। ওস্তাদের মার শেষ রাতে। যুদ্ধের শোকতাপ ফুরোনোর আগেই সমাজের বাকস্ফুরণ ঘটবে। ‘এ ছাড়া দুলাভাই!’ বড় বোন বা স্ত্রী আশপাশে আছে কি না একবার দেখে নিয়ে গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আপনে পুরুষ, আমিও পুরুষ। আপনে ওদের বিয়ে করবেন, না আমি করব? কফিলউদ্দিন আহমেদকে। অপ্রস্তুত আর দুঃখিত হতে দেখে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলেন তিনি। গলা থেকে চি-চি করে একটা চিকন আওয়াজও বেরোল। একা দ্বৈতকণ্ঠে হাসতে হাসতে গোলাম। মোস্তফা বড় বোনের স্বামীকে বললেন, ‘গতকাল দুলাভাই, সাজুকে কাগজটা দেখিয়ে কচ্ছিলাম–কি রে বিয়া করবি? অমনি ছেলের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।’

কফিলউদ্দিন আহমেদের মুখটাও শ্যালকের কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কত আশা করে ঢাকা এসেছেন। মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তো আসেননি। বাড়ি নিয়ে কী করবেন? ঘরের খুঁটি দেবেন? ওর একটা সুব্যবস্থার জন্যই স্বামী-স্ত্রীর ঢাকা আসা। বীরাঙ্গনা বিয়ে করতে হাবা সাজুরও যদি অরুচি, অন্যরা কী করবে?

গোলাম মোস্তফা এরকমই চাইছিলেন আর এভাবে। কফিলউদ্দিন আহমেদকে অকূল দরিয়ায় ঠেলে দিয়ে, মেরির সঙ্গে সাজুর বিয়ের টোপ বঁড়শিতে গেঁথে তিনি পানিতে ফেললেন। দুলাভাইয়ের এখন টোপ না-গিলে তীরে ওঠার জো নেই। বীরাঙ্গনা যে বিয়ে করে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সে যদি দেশপ্রেমিক হয়, তার বাপ কি রাজাকার? সে-ও দেশপ্রেমিকই। তবে মুখে বললেন, এ বিয়েতে গোলাম মোস্তফার কোনো খাই নেই, কোনো ডিমান্ড নেই। সরকার ঘোষিত সেলাই মেশিন, সংসারের হাঁড়িপাতিল, বাসনকোশন কিছুই তার চাই না। বর্তমানে বেহাল অবস্থায় পড়েছেন তো কী, এখনো মেরিকে দশটা সেলাই মেশিন কিনে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। রহমানের রাহিমের অশেষ কৃপা যে, সাজু ছোটবেলা থেকে মেরিকে ভালোবাসে। হোক না বোকা-হাবা, ভালোবাসার খামতি নেই। বিয়েতে তার আপত্তি থাকবে না।

কফিলউদ্দিন আহমেদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে–একটা লালা-ঝরা মুখ, বেকুব চেহারা, ঘিলুহীন মাথা। তার বিএ পাস মেয়েটার বিয়ে এই অমানুষটার সঙ্গে! অন্য সময় হলে এক থাপ্পড়ে শালার বড় মুখ ভোঁতা করে দিতেন। খোদা তাকে মেরে রেখেছে। ছেলেটা বেঁচে থাকলে দু’দিন আগে হোক পরে হোক এর শোধ তিনি তুলতেনই। কিন্তু আজ ভবিষ্যৎ বলেও তার কিছু নেই। মেয়েটাও কপালপোড়া। তাকে নিয়ে তিনি কী করবেন? ফুলতলি গায়ে ফিরবেন কোন মুখে? ভয়টা তার ওখানেই। শ্যালকের পীড়াপীড়িতে একসময় শ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার বুবুর সঙ্গে কথা কয়ে দেখি। মেয়েটা তো তারও–নাকি?’

বাহ্ বাহ্, ভূতের মুখে রাম নাম। কস্মিনকালে কফিলউদ্দিন আহমেদ স্ত্রীর মত নিয়েছেন কি না সন্দেহ। কখন আবার বলে বসেন, মায়ের সঙ্গে মেয়েরও মত লাগবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে জেনানারাও স্বাধীন, কোন কিতাবে লেখা আছে। রোজ তিন চারটা পত্রিকা তো গোলাম মোস্তফা একাই নাড়াচাড়া করেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। এই যে দফায় দফায় মিলিটারির জারজ বাচ্চা পাঠানো হচ্ছে বিদেশে, তা কি মায়েদের মত নিয়ে? হোক না বীরাঙ্গনা, মা তো। কোন মা বুক খালি করে চিরতরে দুধের সন্তান বিদেশ পাঠায়! আসলে স্ত্রীর মত নেওয়ার মতো কাঁচা লোক কফিলউদ্দিন নন। পাত্র হিসেবে সাজুর নাম গালে উঠছে না, তাই ছুতো খুঁজছেন। সময় নিচ্ছেন। যদি দৈবক্রমে বড় ঘরের পাত্র জুটে যায়! বাইরে সহজ-সরল, ভেতরে জিলিপির প্যাঁচ, নিজের এই ভগ্নীপতিকে তিনি ভালোমতোই চেনেন। তবে কথা হলো, শুভ কাজে বিলম্ব করতে নেই। তাই গোলাম মোস্তফা বললেন, ‘বুবুরে রাজি করানোর ভার আমার। ভাইপোটা তো তারও নাকি?’

এ শুধু কথার মারপ্যাঁচ নয়। বাস্তবটা অত্যন্ত কঠিন। বিশেষত সেই বাবা-মার জন্য, যাদের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ আর মেয়ে বীরাঙ্গনা। এ সমস্ত কথা, একটা ময়লা বালিশ আর চোখের জল মনোয়ারা বেগম রাত জেগে স্বামীর সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। বহুদিন পর মানুষটা আজ তার শোকের প্রকাশ্য অংশীদার। একসঙ্গে কাঁদছেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন, কথা বলছেন। এ ছাড়া পাশের ঘরে মায়ের পেটের ভাই ঘুমাচ্ছে। তার নাক ডাকার আওয়াজটাও কেমন স্বস্তিদায়ক। মনোয়ারা বেগম ভাবছিলেন, জীবন অসহ্য কষ্টের হলেও দুনিয়ায় তিনি একা দুঃখী নন। একই ছাদের নিচে আজ রাতে তার স্বামী আছেন, ভাই আছে। পরদিন হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে দেখতে পাবেন। শোক-তাপের মধ্যেও হাতে কিছু-না-কিছু থাকেই মানুষের-একটি ক্রন্দনের রাত, বালিশ আর বেদনা ভাগাভাগির রাত, প্রতীক্ষার রাত, নিঘুম রাত। এর মাত্র মাস তিনেক পর মনোয়ারা বেগমের মনে হবে, এই রাতটা তার জীবনে কোনোদিন আসেনি। এসে থাকলেও, এ ছিল স্বপ্ন। স্বামী, ভাই, নিজের বলে কেউ কোনোদিন তার ছিল না। একমাত্র সত্য যা, তিনি পুত্রহীন। আরেকটা ছেলের জন্ম দেওয়ার তার ক্ষমতা নেই।

পরদিন সকাল থেকে অঘটনগুলো ঘটতে শুরু করে। বোনের বীরাঙ্গনা অফিসে মেয়েমানুষ দেখলেই লোকজন সন্দেহ করে। সে যে-কোনো বয়সের হোক না-কেন, ভাবে বীরাঙ্গনা। অগত্যা কফিলউদ্দিন আহমেদ একাই গেলেন। গোলাম মোস্তফা থাকলেন আড়ালে, সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে এক পান দোকানদারের টঙের পেছনে। তবে ঘুড়ির লাটাই তার হাতে। সেখান থেকেই তিনি সুতো টানছিলেন আর ছাড়ছিলেন। প্রথমবার তিন নম্বর রোডের মাথায় কফিলউদ্দিন আহমেদকে একা ফিরতে দেখে তার মাথায় আগুন ধরে যায়। বাবা মেয়ে আনতে গেছে, শ্বশুরবাড়ি নাকি। যে তারা মেয়ে দেবে না, আটকে রাখবে? তারপর মেরির মাথা বিগড়ে যাওয়ার খবরটাও তাকে টলাতে পারে না। ভগ্নীপতিকে বললেন, বংশে পাগল থাকলে যুদ্ধের কী দোষ। এই অবস্থায় ডাক্তাররাই-বা কী করবে। যা করার মেয়ের বাপ-মা করবে। কফিলউদ্দিন আহমেদ দ্বিতীয়বার ফিরে এসে যখন জানালেন, মেরিকে সপ্তাহ খানেক পর রিলিজ দেওয়া হবে, তখন গোলাম মোস্তফার বুদ্ধির থলে শূন্য হয়ে গেল। এখন। খানিকটা সময় নিরিবিলি চিন্তা করা দরকার। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়। কখন কে দেখে ফেলে। হিন্দুরা দলে দলে ভারত থেকে ফিরে আসছে। যুদ্ধের সময় ঢাকায় গোলাম মোস্তফার কর্মকাণ্ড শূন্য। যা করেছেন গাঁয়ে। এই যেমন ঘরবাড়ি লুটপাট করে, ভয় দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের ছাঁ-পোনাসহ হিন্দুস্থানে চলে যেতে বাধ্য করা। কারণ ভয়টা তার হিন্দুদের চেয়ে তাদের জমিজমা নিয়েই বেশি। ঝাড়ে-বংশে মালাওন খেদাতে না-পারলে নিজে তিনি বিপদমুক্ত হচ্ছিলেন না। অন্যদিকে নয় মাস মুসলমানদের কাঠি দিয়েও ছুঁয়ে দেখেননি তিনি। দু-চারজনকে বরং কৌশলে গুলির মুখ থেকে বাঁচিয়েছেন। সেই সুবাদে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাকে বন্দি করলে আরেক দল এসে ছেড়ে দেয়। এই খেলাই গত চার মাস ধরে চলছে। তার পরও বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। তাই কফিলউদ্দিন আহমেদ রায়েরবাজারের বাসা থেকে এক পাক ঘুরে আসতে চাইলে, তিনি তাকে একা রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যান।

বাসার সামনের রাস্তা ধরে কফিলউদ্দিন আহমেদ বারবার টহল দিচ্ছেন, অথচ নিজের বাড়ি চিনতে পারছেন না। যে বাঁশঝাড়টা নিশানা হতে পারত, তা উধাও। কালো গেটের গায়ে সাদা রঙে লেখা ঠিকানাটা নেই। উঠোনের টিউবওয়েলের মাথা ভাঙা। চারপাশের মুলিবাঁশের বেড়া মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সন্তান আর জমি–এই যার সারা জীবনের অর্জন, এসব চলে গেলে আর কী থাকে মানুষের! গাঁয়ে বসেই শহরের বাসার হালহকিকত লোকমুখে তিনি শুনেছিলেন। তবে এসে যে বাড়িটা খুঁজে পাবেন না, তা গায়েব হয়ে যাবে-ভাবতে পারেননি। নিজের কপালের গাল-মন্দ করতে করতে যখন ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তখন পাশের বাড়ি থেকে একজন রাস্তায় নেমে আসে। লোকটা সুহৃদ। কফিলউদ্দিন আহমেদকে চেনে বাড়ি করার সময় থেকে। তারপর বহুদিন দেখা হয়নি। তবে যুদ্ধ মানুষের চেহারা-ছবি এমন বদলে দিয়েছে যে, আপনজনকেও আজকাল অচেনা লাগে। ঘরদোরের কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। কফিলউদ্দিন আহমেদকে লোকটা বাড়ির দোর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। মাইনের ভয়ে নিজে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বয়ং বাড়ির মালিকেরও তখন আর সাহস হয় না ভেতরে ঢোকার। তিনিও পড়শির পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

বাড়িটা বলতে গেলে যুদ্ধের পুরো সময় আর্মির প্রমোদখানা ছিল। তখনই মুক্তিফৌজের ভয়ে বাঁশঝাড় নির্মূল করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় লেখা ঠিকানাটা মুছে এর জায়গায় টাঙানো হয় নতুন সাইনবোর্ড, তাতে উর্দুতে লেখা–হারেম। এসব হাজি সাহেবের অসামান্য কীর্তি। তবে পড়শি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ যে, আশপাশের লোকজনের জানমাল তিনি রক্ষা করেছেন। কিন্তু আমার জানমালের যে ক্ষতি করল-কফিলউদ্দিন আহমেদ চটে গেলেন। সবাই যদি এভাবে রাজাকারদের সাফাই গায়, সরকার যতই দালাল-রাজাকার পাকড়াও করুক, বিচারটা হবে কীভাবে। অপরাধ প্রমাণ করতে সাক্ষী তো লাগে, নাকি? পড়শি কফিলউদ্দিন আহমেদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তবে তার ক্ষতির ব্যাপারে একমত নয়। কারণ হাজি সাহেব বাঁশঝাড় কেটে সাফ করে অন্যায় কিছু করেননি। শহরে ঝোঁপজঙ্গল থাকাটাই বেমানান। কফিলউদ্দিন আহমেদ এবার লজ্জায় অপোবদন, অজায়গায় একটা বাঁশঝাড় জন্ম দিয়ে তিনি যেন রাজাকারির চেয়েও বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। পড়শির আগ্রহ তাতে বেড়ে যায়। সে বলে, সেই সঙ্গে হাজির খরচায় তার খাট্টা পায়খানাটা যে তখন পাকা হয়ে গেল, এই হিসাবটাও ধরা দরকার। চলে যাওয়ার আগে বাড়ির ভিটায় মাইন পুঁতে গেছে মিলিটারি। আর টিউবওয়েলের মাথা গায়েব হয়েছে স্বাধীনতার সময়। এরপর এখানে তৈরি হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। তারা উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড টেনে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। মিলিটারিরা দরজা-জানালার পাল্লা ভেঙে বিরানি পাকিয়েছিল। কাঠের চেয়ার টেবিল আলনা খাট আর টিনের চাল খুলে দিনদুপুরে লোক লাগিয়ে নিয়ে গেছে। হাজির এক সাগরেদ। আর রাতের বেলা বই-খাতা, হাঁড়িপাতিল সের দরে বিক্রির জন্য তুলে নেয় এক ছিঁচকে চোর। মাইন ফেটে একজন মুক্তিযোদ্ধার পা উড়ে গেল। সেই পা হাসপাতালে যাওয়ার পর কেটে বাদ দিয়েছিল এক বিদেশি ডাক্তার। পাতকুয়োটা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে যুদ্ধের পর, কারণ মেয়েদের মাথার চুল আর হাড়গোড়ে তা ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যরা মাইন উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।

পড়শি ক্লান্ত হয়ে থামে। আর কফিলউদ্দিন আহমেদ হতবুদ্ধি হয়ে। ভাবেন–বাড়িটার কে কখন কী ক্ষতি করেছে, এভাবে দশবার বললেও তার মাথায় ঢুকবে না। তার সামনে দণ্ডায়মান কঙ্কাল-একটা বাড়ির, একটা দেশের । একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষমতার পালাবদলের যা জবরদস্ত সাক্ষী হতে পারে। এমনকি হতে পারে একটি আদর্শ জাদুঘর। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিদেশি পর্যটক, মফস্বলের কৌতূহলী মানুষ আর প্রেমিক-প্রেমিকার দর্শনীয় স্থান। স্বল্পমূল্যের টিকিটের বিনিময়ে তারা যে ফটক পেরিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করবে, এর গায়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড লটকানো থাকবে। তাতে লেখা–এই বাড়ির মালিক কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপাড়। তিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর জনৈক হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিখিল চন্দ্র সাহার পাঁচ কাঠা জমি জলের দরে খরিদ করেন, গায়ের অনুরূপ একটি বাটি এখানে নির্মাণ করেন। তাতে মন্টু নামদার পুত্র এবং মেরি নাম্নী এক কন্যা বসবাস করত। তারা উভয়েই ছিল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মন্টু শহিদ হয় আর মেরি প্রকারান্তরে মরিয়ম হয় বীরাঙ্গনা। বাড়িটা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতবদল হয়ে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে গৃহকর্তা কফিলউদ্দিন আহমেদের হস্তগত হয়। তারপর যে অবস্থায় বাড়িটা তিনি হস্তান্তর করেছেন, কোনোরূপ পরিবর্তন বা বিকৃতি ব্যতিরেকে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তদাবস্থায় তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে।

মরিয়মই প্রথম দর্শক, যে বাড়িটিতে প্রবেশ করে, তবে ঘোরের মধ্যে। সে কালো গেট দিয়ে ঢুকে এলোমেলো ইটের ওপর পা ফেলে কর্দমাক্ত জায়গাটা পেরিয়ে যায়। কল চেপে পেট পুরে পানি খায়। খানিকটা বাঁশঝাড়ের ছায়ায় জিরিয়ে, মন্টুর রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায় নিজের ঘরে। তারপর শুয়ে পড়ে সেই বিছানায়, যেখান থেকে ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ ভাঙার পর মহল্লার লোকজনের সঙ্গে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বহুদিন পর আজ নিজের ঘরে, নিজের শয্যায়। বালিশে মাথা রাখতেই এক রাজ্যের ঘুম তাকে গ্রাস করে।

গত দুদিন মগবাজারের বাসায় এমন হয়েছে যে, মরিয়ম ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারেনি। পাশের ঘরে দফায় দফায় গোলাম মোস্তফার সঙ্গে কফিলউদ্দিন আহমেদের বৈঠক বসছে আর রাগারাগি, চিল্লাচিল্লির মধ্য দিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। বিষয়টা কী-মরিয়ম জানে না। তাকে জানানোও হয়নি। তবে ঘুমের ঘোরে সে বুঝে যে, একটা ষড়যন্ত্র চলছে, যা পুরোনো। তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে। নওশা সেজে যে আসে, সে আর কেউ নয়–সাজু। সে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলে মনোয়ারা বেগম তাকে আবার শুইয়ে দেন বিছানায়। পানির গ্লাস হাতে ছুটে আসেন গোলাম মোস্তফার স্বল্পবাক স্ত্রী জ্বলেখা বিবি। শেষবার মরিয়মের শরীরে অসুর ভর করে। সে বিছানা থেকে উঠেই মনোয়ারা বেগমকে ধাক্কা মেরে, জ্বলেখা বিবির হাতের গ্লাস উল্টে দিয়ে, দুয়ার খুলে বেরিয়ে যায়। কফিলউদ্দিন আহমেদ চিৎকার করে, রায়েরবাজারের বাসায় যে মাইন পোঁতা আছে, সেই ভয় দেখান মেয়েকে। তাতে কাজ হয় না। অগত্যা আরেকটা রিকশায় লাফিয়ে উঠে মেয়ের পেছন পেছন তিনি ছোটেন।

বাড়িটা দেখলেই কফিলউদ্দিন আহমেদের মনে আধ্যাত্মিক ভাব জেগে ওঠে। এ তো শূন্যের মধ্যে বসতবাড়ি। তার জীবনের অনুরূপ। কপাটবিহীন দরজা-জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, বাতাস নির্বিঘ্নে চলাচল করে। পাখিরা উড়ে বেড়ায়। মাথার ওপর রোদ-বৃষ্টি সরাসরি কিরণ ও পানি দেয়। মগবাজার থেকে রায়েরবাজার রিকশায় এটুকু পথ আসতেই মরিয়মের শক্তি বা তেজ নিঃশেষ হয়ে গেছে। কফিলউদ্দিন আহমেদ পৌঁছে দেখেন, খোলা ছাদের নিচে, খালি মেঝেতে কুঁকড়ে-মুকড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে সে। মেয়েটা কি তার শেষমেশ পাগল হয়ে গেল? যে বাড়ির ছাদ নেই, দুয়ার নেই, ফটক নেই, বাউন্ডারি ওয়াল নেই, সেখানে পাগল ছাড়া কেউ এমন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে?

একদিকে মেয়ে, আরেক দিকে শ্যালক-দুজনেই স্বজন, দুজনেই তার শত্রু। মাঝখানে পড়ে গলায় দড়ি দেওয়ার উপক্রম হয়েছে তার। মেয়েটার চোখের দিকে আজকাল আর তাকানো যায় না। যতক্ষণ চেতন থাকে, লাটিমের মতো চোখের তারা দুটি ঘোরে, না-হয় জ্বলতে থাকে ধকধক করে। যেন একখণ্ড কাঠ কি কাগজের টুকরা কাছে ধরলেই দপ করে আগুন জ্বলে উঠবে। অবিকল কফিলউদ্দিন আহমেদের আম্মাজানের চোখ। বছরের দু-তিনটা মাস ছাড়া বাকি সময় তিনি পাগল থাকতেন। তখন দুনিয়াদারির বিরুদ্ধে তার অজস্র অভিযোগ। কফিলউদ্দিন আহমেদের নানাজান সেই কোন কালে মেয়েকে যে গাজির গীত শুনতে যেতে দেননি, তা নিয়ে তিনি আস্ত এক দুপুর নিজের বাপকে গালমন্দ করতেন। বাকি দিনটা কাটত মৃত শাশুড়ির পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে। কারণ গাঁয়ে যেইবার খুনের আসামি ধরতে গুর্খা সৈন্য আসে, সেইবার জ্যৈষ্ঠ মাসে তাকে বাপেরবাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। তবে উচিত শাস্তি হয়েছে। যে, গুর্খারা আসামি না-পেয়ে গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঢুকে চাল-ডাল সব এক করে রেখে গেলে এর পরের ছয় মাস গোটা গ্রাম শুধু খিচুড়ি খেয়ে কাটায়। পঞ্চাশ সনের দুর্ভিক্ষের বছর একদিন বাড়ির সবাই ভাত খেয়ে তার জন্য যে ফ্যান রেখে দিয়েছিল, সেই দুঃখ কফিলউদ্দিন আহমেদের আম্মাজানের বছরের নয় মাসের কোনো একদিন ঠিক মনে পড়ে যেত। সেদিন তিনি উপোস থাকতেন। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা হাতে-পায়ে ধরেও তাকে ভাত খাওয়াতে পারত না। স্বামী এক চোখ কানা, নিরীহ মানুষ। কলাপাতার শয্যায় গুটিবসন্ত তাকে ফেলে গেলেও একটা চোখ নিয়ে নেয়। অন্য চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় স্ত্রীর পাগলামি সহ্য করা ছাড়া কফিলউদ্দিন আহমেদের আব্বাজান সলিমুদ্দিনের আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু মেরিকে সহ্য করবে কে, এক সাজু ছাড়া?

কফিলউদ্দিন আহমেদের এই বিয়েতে যে অমত নেই, তা যেন গোলাম মোস্তফার বিশ্বাস হতে চায় না। মেয়েটা ওষুধের ঘোরে থাকতে থাকতে মৌলবি ডেকে বিয়েটা তিনি পড়িয়ে ফেলতে চান। তারপর শামিয়ানা টাঙিয়ে মাইক বাজিয়ে উৎসব হবে। প্রধান অতিথি সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু। তিনি ব্যস্ততার কারণে আসতে না পারলে, বেগম মুজিব ঠিকই আসবেন। বীরাঙ্গনা-বিবাহের তিনি সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তা। এভাবে মরা হাতিও। যে লাখ টাকা, গোলাম মোস্তফা দেশবাসীকে তা জানিয়ে ছাড়বেন। কাগজে ছবি ছাপা হবে–আরেকটি বীরাঙ্গনা-বিবাহ। কন্যা সম্প্রদান করছেন স্বয়ং বেগম মুজিব। পাত্র সাজেদ মোস্তফা ওরফে সাজু, পিতা গোলাম মোস্তফা আর পাত্রী হচ্ছেন বীরাঙ্গনা মোসাম্মৎ মরিয়ম বেগম, পিতা কফিলউদ্দিন আহমেদ। এই শেষের বাক্যটায়

কফিলউদ্দিন আহমেদের অসুবিধা আছে। কাগজে ছবি ছাপিয়ে ঢাকঢোল পিটানোতেও তার ঘোর আপত্তি। এখনো যেসব লোক মরিয়মের ঘটনা জানে না, গোলাম মোস্তফা এসব করে তাদের জানিয়ে ছাড়বে। তিনি তাতে রাজি নন। শ্যালকও নিজের কথা থেকে এক চুল নড়বে না। পাশের ঘরে মেয়েটা ঘুমাবে কী, এ নিয়ে তো বাড়িতে মহা শোরগোল।

পরিস্থিতি এমন যে কারো সঙ্গে কারো মতের মিল হচ্ছে না, কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। তবে বাইরে বাইরে সবাই একটা আপোসের ভাব বজায় রেখে চলে। কারণ গোলাম মোস্তফার পাকিস্তানের দালাল থেকে রাতারাতি দেশপ্রেমিক হওয়া দরকার। এতে করে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বাড়ি দুটির পুনর্দখলও সম্ভব। আর কফিলউদ্দিন আহমেদ কন্যাদায়গ্রস্ত অবস্থা থেকে আশু মুক্তি চান। সেই মতো ঠিক হয়, মেরির ওষুধের ঘোর কাটার পর বিয়ের আয়োজন করা হবে। পত্রিকায় বিয়ের খবর যাবে, তবে ছবি ছাপা হবে না। এ নিয়ে মগবাজারের বাড়িতে সভা-সমিতি বন্ধ থাকবে। হইহট্টগোল করা থেকে উভয় পক্ষ কিছুদিন অন্তত বিরত থাকবেন।

আপাতশান্তিপূর্ণ এমন এক পরিবেশে রায়েরবাজার থেকে মগবাজারের বাসায় এনে দরজায় শিকল দিয়ে মেরিকে কয়েক দিন রাখা হয়। কিন্তু গোলাম মোস্তফাঁকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, বিশেষত ছবি ছাপানোর ব্যাপারে। এ ছাড়া কাগজে বিয়ের খবর প্রকাশ হওয়াই তো যথেষ্ট। মানুষ নাম-ঠিকানা জেনে ঠিকই চেহারা বের করে ফেলবে। কফিলউদ্দিন আহমেদ তাতে গররাজি। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছেন না। বিয়েশাদি দর-কষাকষির ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে লুকোছাপার দরকার পড়েই, যা গোলাম মোস্তফার আশ্রয়ে থেকে সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজের দিকটা শক্ত রাখার জন্য রায়েরবাজারের ভাঙা বাড়ি মেরামতে তড়িঘড়ি হাত দেন।

মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। এদিক দিয়ে গোলাম মোস্তফা কফিলউদ্দিন আহমেদের চেয়ে সঠিক ছিলেন। মরিয়মের ওষুধের ঘোর কাটার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের যাবতীয় পরিকল্পনা-প্রস্তুতি মাঠে মারা যায়। অন্ধ পিতা যে কারণে স্ত্রীকে পোষ মানাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, চোখ থাকা সত্ত্বেও সেই একই কারণে পুত্র তার কন্যাকে বাগে আনতে পারেননি। কারণ নারী দুটি ছিল সত্যিকারের পাগল।

১৯. পেটকাটা মানুষ ও জাগ্রত যুবসমাজ

মরিয়ম বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এসএম হলে হাজির হয়। সবকিছু আগের মতোই আছে, দেয়ালে বুলেটের গর্তগুলি খালি নতুন। আর আবেদ কোথাও নেই। সুমন দাঁত মাজছিল। মরিয়মকে দেখে মুখভর্তি টুথপেস্ট গিলে ফেলে। পাশের রুম থেকে সিটি বাজায় একজন। মরিয়ম অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসল। সুমন তাতে আরো অবাক হয়। নোংরা তোয়ালে মুখ মুছে, শার্ট গায় দিতে দিতে ভাবে, আবেদ ভাই এত বদলে গেলেন-রাত যেন দিন, দিন যেন রাত। এখন মেয়েটিকে সে কী বলবে–সত্য না মিথ্যা? দিনটা মিথ্যা দিয়ে শুরু করে তার লাভ? আবেদ ভাই তো রুমমেট সুমনকেও আজকাল চিনেন না। অথচ ২৫ মার্চ রাতে তার ভারী শরীরটা এপাশ থেকে সে ধাক্কা দিয়ে তুলে না-দিলে তিনি দেয়াল টপকাতেই পারতেন না। ততক্ষণে হলের ভেতর মিলিটারি ঢুকে পড়েছে। জাস্ট এক বছর দুই মাস। কত তাড়াতাড়ি মানুষ সবকিছু ভুলে যায়, বিশেষত নেতারা। সে একজন সাধারণ কর্মী। এ অবস্থায় বিদ্রোহ করার অধিকার তার আছেই।

এক অবাঙালির সওদাগরি অফিসের মালিক এখন আবেদ। প্রাক্তন মালিককে ভারত হয়ে পাকিস্তান পালিয়ে যেতে সাহায্য করার বিনিময়ে তার পরমাসুন্দরী মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধজয়ের পর পুরো রাজত্বসহ রাজকন্যা তার ভাগে। হাতে হাতে স্বাধীনতার ফল। অথচ যুদ্ধে সুমন আর মন্টুও গিয়েছিল। একজন নোংরা তোয়ালেতে এখন মুখ মুছছে, আরেকজন ফিরে আসেনি। দুজনই আবেদের অনুজ, পরম শিষ্যের মতো ছিল। সুমনকে আরো অবাক করে দিয়ে মরিয়ম বলে যে, যুদ্ধের আগে তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। আবেদের ব্যক্তিগত জীবন জানার তার দরকার নেই। মরিয়ম শুধু তার ঠিকানাটা চায়। সে নিজে একজন বীরাঙ্গনা। ‘বীরাঙ্গনা মানে জানো তো,’ সুমনের হাঁ-করা মুখের সামনে পাঁচ আঙুল ঘুরিয়ে বলে, ‘যে জাতির গর্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র নারী!’

শিরীষ অরণ্যের কারুকাজময় ছায়ায় প্রবেশ করে মরিয়মের বিস্মৃতকালের এক গল্প মনে পড়ে। ফুলবাগিচা আর সুরম্য প্রাসাদের এক আশ্চর্য নগরীর গল্প। সেখানে বাস করত এক রাজকুমার। তার স্ত্রী ছিল, পুত্র ছিল। সংসার সুখের ছিল কি না, জানে না। তাকে যুদ্ধে যেতে হলো এমন এক দেশে, যেখানে কালো চুলের, সম্মোহনী। চোখের নারীদের বাস। সে তাদের একজনকে ভালোবাসল, কিন্তু বন্দি করে রাখল। সে তাকে প্রাণের কথা খুলে বলল কিন্তু যুদ্ধ শেষে নিজের দেশে চলে গেল। গল্পটা শেষ হয় এখানে। তবে কিছু কিছু গল্প থাকে, যা কখনো শেষ হয় না।

আবেদের স্ত্রী পাকিস্তানি, পাঞ্জাবি নয় তো, তার বাড়ি কি লাহোরে?

মরিয়ম রিকশার জন্য পলাশীর মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তাকে এগিয়ে দিতে এসেছে সুমন। সে এখন বেশ ধাতস্থ আর আন্তরিক। সেখানে প্রথম আর শেষ দিনের সেই মুচিকে তারা দেখতে পেল না। জায়গাটা শূন্য। পাশের বস্তিটিও নেই। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত মানুষদের নিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। সুমন পোড়া জমিনের দিকে তর্জনী তুলে বলে, ‘মুচির বাসা ছিল ওই বস্তিতে।’

আবেদের বদলে রাস্তায় আজ সুমন। মুচি তার বস্তিসহ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মরিয়ম যেন পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখি, যার ধ্বংস নেই। পোড়া ছাই থেকে নতুন শরীর নিয়ে সে উড়ে এসেছে বিগত জীবনে, আগের ঠিকানায়। এটা যুদ্ধ-পরবর্তী যে কোনো দেশের যে-কোনো সময়ের মানুষের কাহিনি। যার একটাই শিরোনাম, যা লেখাও হয় বারবার, তাতে যুদ্ধ থামেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বা সময় কোনোটাই মরিয়মের অনুকূলে নেই যে, নিজের জন্য বা আর কারো জন্য একদণ্ড বসে শোক করবে।

কফিলউদ্দিন আহমেদ এখন বঁটি হাতে যে কালো গেটের আড়ালে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন, তাতে নতুন কালিতে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা হয়ে গেছে। বাঁশঝাড়টাই শুধু রাতারাতি ফলানো যায়নি। সিজনের প্রথম বর্ষণে থোকা থোকা জংলি ফুল ফুটেছে যে পাতকুয়োটায়, সেটা এখনো বোজা। এ ছাড়া বাদবাকি ঠিকঠাক। এখন মেয়েকে আসতে দেখলে তিনি এক কোপে খতম করে দেবেন। মনোয়ারা বেগমের সতর্কবাণী, ‘নিজে নিজের পথ দেখো। বাঁচলে নিজে বাঁচবা, মরলে নিজে মরবা। আমরা তোমার সাথে-পাছে নাই। মরিয়ম তাই নিজের পথ নিজে দেখছে–একটা ফিনিক্স পাখি। নতুন জীবন পেলেও পুরোনো পথে সে বিচরণ করে, যেখানে আবার আগের মানুষ নেই, যারা আছে তারা আগের জায়গায় নেই। একটা মৃত্যু থেকে আরেকবার জন্মলাভের জন্য তার বয়সটা খুব অল্প–মাত্র ২৩ বছর।

সঙ্গে ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও আবেদের অফিস খুঁজে পেতে সেই দুপুর। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। মরিয়ম গেটের ধারে অপেক্ষা করে। পাশেই সুসজ্জিত দারোয়ান। তবে পোশাকের নিচে সে অপেশাদার একজন মানুষ। নিজের টুলে মরিয়মকে বসতে দিয়ে জানায়, সে আবেদের দেশের বাড়ি থেকে এসেছে, সম্পর্কে চাচা হয়। পুরোনো অফিসের রেওয়াজমাফিক সাহেবকে এখন তার স্যার বলতে হচ্ছে। আগের দারোয়ান বিহারি ছিল। সে যে কতল হয়েছে, নিজের গলা বরাবর তর্জনী চালিয়ে নতুন দারোয়ান তা দেখায়। তবে নিজের ভাতিজা বলে নয়, স্যার খুব ভালো আর পরোপকারী। বীরাঙ্গনা অফিসের প্যাকেট দিয়ে লাঞ্চ সারে। বলে ‘ঘেন্না করবা না, ওরা তোমাদের মা-বোন, দেশের জন্য ইজ্জত দিছে। নিজের ভাতিজা বলে নয়, ‘স্যারের চেত-ঘিন কিছু নাই, নইলে ওই মাগি গো হাতের খানা খায়-কন?’ এবার আবেদের দূরসম্পর্কের চাচার কিছু গোপন কথা বলার আছে। একবার অফিসের দিকে সে তাকায়, একবার মরিয়মের দিকে ঘোরে, ‘বউ অবাঙ্গাইল্লা বুঝচ্ছেন, যুদ্ধের ফক্করে পড়ে বিয়া করছে, ভাত-মাছ রান্‌তে জানে না। অফিস থেকে একজনকে বেরিয়ে আসতে দেখে দারোয়ানের খুব গরম লাগে। মাথার ক্যাপ হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে আপন মনে বলে, ‘নতুন জিনিস তো ওম ছাড়ে নাই।’ তারপর নিজের পোশাকের সে তারিফ করে, ‘ডেরেসটা এক্কেরে ভাতিজা, থুক্কু স্যারের নিজের হাতে কিনা।’

আবেদের দূর সম্পর্কের চাচার সঙ্গে রমিজ শেখের কোথায় যেন মিল আছে। মরিয়ম ভাবে, সে বেঁচে থাকলে কি এ অফিসের দারোয়ান হতো আর মরিয়ম হতো সাহেবের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি কাম টেলিফোন অপারেটর? একটা যুদ্ধ অনেক অসম্ভবও সম্ভব করে তোলে। মরিয়মের ডাক এসেছে স্যারের রুম থেকে। দারোয়ান মাথায় ক্যাপ চাপিয়ে আনাড়িভাবে সালাম ঠুকে বলে, ‘আইয়্যেন গো বড়মানুষের মাইয়্যা মাঝেসাঝে, কথা কওনের মানুষ পাই না আমি।’ রমিজ শেখ একই কথা বারবার বলত। কারণ তার তিরিশ বছরের জীবনের দশটা বছর কেটেছে জেলখানায়।

মরিয়ম জানে, সে কোথায় আর কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আবেদের বোধ হয় দর্শনার্থী কে, জানা ছিল না। যত তাড়াতাড়ি পেছনে চেয়ার ঠেলে সে উঠে দাঁড়ায়, তার চেয়ে ক্ষিপ্রগতিতে বসে পড়ে। নিজেকে সামলাতে সামলাতে মিনিটের ভগ্নাংশ মনে হয় ঘণ্টা, দিন–আস্ত একটা বছর, আরো দুটি বাড়তি মাস। পলাশীর মোড় থেকে ২৫ মার্চ, ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প, যুদ্ধ, রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ, রাজত্বের সঙ্গে রাজকন্যা, এসব কিছুর ওপর দিয়ে তাকে তখন প্রাণপণে দৌড়াতে হয়। তারপর থামে যখন, তখনো মরিয়ম দাঁড়িয়ে, তাকে বসতে বলা হয়নি। বসার পর বিকট শব্দে একটা বোমা ফাটে। শব্দের পরিবর্তে তা বারুদভর্তি হলে সুসজ্জিত অফিসটাই উড়ে যেত। কিন্তু মরিয়ম অটল। ঝানু, ক্ষমতাবান, সশস্ত্র পুরুষদের যে দিনের পর দিন দেখেছে। উলঙ্গ হতে, খুন করতে, ভোগ করতে, ঘৃণা করতে, ভালোবাসতে-পূৰ্বপ্রেম তার মনে ছায়া ফেলে না। প্রাক্তন প্রেমিককে মনে হয় অর্বাচীন বালক। তার ভালোবাসা-প্রতারণা চৈত্রের কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি যেন, যা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের পর বর্ষার প্রবল বর্ষণে হারিয়ে গেছে। তাকে ক্ষমা করা-না-করা সমান। মরিয়মের এখন একটা চাকরি দরকার, আবেদ ছাড়া এত বড় শহরে চাকরিদাতা কাউকে চেনে না সে। এখন আবেদ যদি বলে ক্ষমা করার বিনিময়ে মরিয়মকে একটা চাকরি দেবে, তাহলে খুশি মনেই সে তাকে ক্ষমা করবে। তাই নিজের বীরাঙ্গনা পরিচয় দিয়ে সে একটা চাকরি চাইছে আবেদের কাছে। চাকরিটা যে তার খুব দরকার, তা বোঝাতে কফিলউদ্দিন আহমেদের বঁটি হাতে গেটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আর মনোয়ারা বেগমের নিজের পথ নিজে দেখো’ উক্তিটিরও স উল্লেখ করে। তারপর বলে যে, দারোয়ান পদে আরো একজনের চাকরির জন্য সে এখানে আবেদন করত। তার আর দরকার নেই। কারণ লোকটা যুদ্ধে মারা গেছে। আর পদটাও দেখা যাচ্ছে খালি নেই। এ ছাড়া মন্টুর খবর আবেদও জিগ্যেস করে না, মরিয়মও তাকে বলে না। একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার বোন হিসাবে কেন, তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ই তো যথেষ্ট একটা চাকরি পাবার জন্য। আবেদ নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তদুপরি আরোহণ করেছে সেই চেয়ারে, যেখানে একদিন মোটা মাথার অবাঙালিদের বসে থাকাটা তাকে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধে তার পক্ষ জিতেছে। নিজগুণে চেয়ারটাও সে বাগিয়েছে। মরিয়ম এখন চাকরি না-পেলে আবেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?

আবেদের মাথায় কিছু কথা ঢোকে, কিছু ঢোকে না। অবাক হওয়ার পর সে হতাশ হয় এই ভেবে যে, তাকে হারিয়ে মেয়েটার মনে কোনো হাহাকার নেই। সে যদি চাকরি চাওয়ার পরিবর্তে তার গালে দুটি চড় মারত, আবেদের ভালো লাগত। তার নবলব্ধ ক্ষমতা সার্থক হতো। অর্থবিত্ত, ভালো একটা বাড়ি, সুন্দরী স্ত্রী পুরুষের সব নয়। আরো লাগে। এসবের একটা হলো, যাকে সে ছেঁড়া কাপড়ের পুটলি বানিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, কুকুরীর মতো পুরুষটির পদতলে তার বারবার ফিরে আসা। মেয়েটা সেইভাবে আসেনি। সে নিজের তালে আছে। কিন্তু যুদ্ধের আগে তো এমন ছিল না! তখন বিয়ে ছাড়া যে মেয়ে কিছু বুঝত না, কয়টা পুরুষের নিচে শুয়েছে যে, এখন আর পুরুষ নয়, হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে? চেহারায়ও কেমন রাভি রান্ডি ভাব। যেন দুনিয়া জয় করে ফিরেছে। বীরাঙ্গনা মানে অসহায়-নির্যাতিত নারী, সহানুভূতির আড়ালে সর্বান্তঃকরণে সকলে তাদের ঘৃণাই করে। তারপর এত সাহস সে কই পায় যে, প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে প্রেম ফেরত না-চেয়ে, চাকরি চাইতে আসে? শুধু নিজের জন্য নয়, একটা মরা লোকের জন্যও, যে বেঁচে থাকলে নাকি এই অফিসের দারোয়ান হতো। কোথাও একটা গলদ আছে। তা খুঁজে বের করতে সময় আর ভাবনা দরকার। আবেদ তাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনতিবিলম্বে বিদায় করে।

মরিয়ম সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে ওঠে না। চাকরি পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে তার মনে এক রাজ্যের সংশয়। আবেদকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। তাই বসে থেকেই সে বলে, মরিয়ম তার প্রাক্তন প্রেমিকা, তাকে সে বিয়ে করেনি, তা না করুক, মেয়েটার এখন যখন একটা চাকরি দরকার, তা তো দিতেই পারে। মৃত লোকটা, যে বেঁচে থাকলে আবেদের অফিসের দারোয়ান হতে পারত, তার কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। যদিও ক্ষমতার তখতে যে বসে আছে, তার জন্য শহিদ আর বীরাঙ্গনা উভয়ের সেবা করা ফরজ। এর ব্যত্যয় ঘটলে, আবেদ কি নিশ্চিত আরেকটা যুদ্ধ হবে না?

আবেদের ড্রয়ারে পিস্তল থাকা বিচিত্র নয়। কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিলেও কেউ কেউ দেয়নি। সে তাকে গুলি করতে পারে। পুলিশ ডেকে বলতে পারে, মেয়েটা একজন ছিনতাইকারী বা পাকিস্তানি গুপ্তচর বা সিআইএ’র এজেন্ট, টাকা খেয়ে একজন স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধার জান কবজ করতে এসেছে। এসবের কোনো একটা ঘটার আগে মরিয়ম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তাকে সালাম ঠুকে গেট খুলে দেয় সেই লোকটা, যার জায়গায় বেঁচে থাকলে রমিজ শেখের চাকরির আবেদন সে করতে পারত।

অ্যাডভেঞ্চারের সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সেগুনবাগিচা থেকে হাতিরপুল। বাংলাদেশের জাগ্রত যুবসমাজের এক পাতার একটি লিফলেট মরিয়মের চলন্ত রিকশায় উড়ে আসে। যার লোমহর্ষক শিরোনাম পেটকাটা মানুষ। তাতে মহিলাদের অশালীন পোশাক পরিহারের জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। তার পরও যদি এমতাবস্থায় রাস্তায় কাউকে দেখা যায়, দুর্ভাগ্যজনক ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। জাগ্রত যুবসমাজ মনে করে, পেটকাটা ও হাতকাটা ব্লাউজ আর নাভির নিচে শাড়ি পরা অশালীন। এ ধরনের পোশাক স্বাধীন দেশে চলতে দেওয়া হবে না। মরিয়মের পরনে মিলের লাল পেড়ে কোড়া শাড়ি আর লম্বা হাতার ব্লাউজ বীরাঙ্গনাসুলভ পোশাক-আশাক। তবে পুনর্বাসনকেন্দ্রে এমন সাজসজ্জার দু-চারজনকে সে দেখেছে। তারা ভারতফেরত। ফ্যাশনটা বোধ হয় ওখানকারই, যা স্বাধীনতার পাঁচ মাসের মাথায় বাংলাদেশের জাগ্রত যুবসমাজ বরদাস্ত করতে পারছে না। এই জাগ্রতরা আসলে কারা?

‘কারা আবার, বদমাশ লোকেরা। যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়।’ মরিয়মের কলেজ-লাইফের বান্ধবী রিনা লিফলেটটা দেখে চটে যায়। কারণ দর্জি দিয়ে এরকম আধ ডজন ব্লাউজ সে গত মাসেই বানিয়েছে। এখনো সব কটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরা হয়ে ওঠেনি। পরে যাবেই-বা কোথায়। কলেজের মেয়াদ শেষ। বাসা থেকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করানো হবে না, যদি পড়তে চায় বিয়ের পর পড়বে। বদমাশ ছেলেদের লিফলেটটা দলা পাকাতে পাকাতে মরিয়মের হাতের ব্যাগের দিকে তার চোখ যায়। ব্যাপারটা নতুন নয়। এ বাসার দ্বার রিনার বান্ধবীদের জন্য অবারিত। মরিয়ম সেই ভরসাতেই এসেছে। দু-চারটা রাতের মামলা। চাকরি পেলে সে চলে যাবে। তবে কতগুলো কথা তাকে জনে জনে বানিয়ে বলতে হয়। প্রথম বাসায় ঢুকে যেমন রিনাকে বলল একবার। সেই একই কথা বলল, যখন রান্নাঘর থেকে রিনার মা খালাম্মা বেরিয়ে এলেন। তৃতীয়বার বলতে হলো, খালুজান অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর। রিনাদের একদম বাসার পাশেই বক্তৃতার মাঠ। সেখানে বিকাল থেকে একটা বামপন্থি দলের জনসভা চলছে। মরিয়মের মিথ্যা কথাগুলোর মাঝখানে প্রত্যেকবার তাই বক্তৃতার ভগ্নাংশ ঢুকে পড়ছিল : কমরেড লেনিন। বাবা-মা মেরিকে নিয়ে নয় মাস খুব উৎকণ্ঠায় ছিলেন। বাড়ির কাছে মিলিটারি ক্যাম্প। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এখনই সুবর্ণ সুযোগ। তারা মন্টুকে নিয়ে ভাবেননি। দেশে থাকলে মিলিটারি মারত, তবু ভালো যে, সে যুদ্ধ করছে। স্বাধীনতার ধাত্রী যদি হয় ভারত, তবে পিতা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নতুন দেশের পরিচয় তার পিতার নামেই হবে, হওয়া উচিত। সেই মন্টুই আর ফিরল না। চাকরি খোঁজা ছাড়া এখন উপায় কী মরিয়মের। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবা-মা খুব ভেঙে পড়েছেন। ঢাকায় আসতে দিতে চান নাই। একপ্রকার জোর করেই ফুলতলি থেকে তাকে চলে আসতে হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে আমরা মুজিব সরকারকে সর্বান্তকরণে সাহায্য করব। (সর্বহারা জনতার করতালিসহ স্লোগান) ইনকিলাব জিন্দাবাদ। তোমার নেতা আমার নেতা। মুজিব-ইন্দিরা-কোসেগিন। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর মরিয়ম ঘুমাতে যায় রিনার ঘরে। সারা দিন সে পাগলের মতো বকবক করেছে। তার মধ্যে কটা সত্য, কটা মিথ্যা–ভেবেছিল গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। রিনা ঘ্যান ঘ্যান করে তাকে সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে। যুদ্ধের বছরটা মাত্র ন’মাসের হলেও অনেক লম্বা। আর বিরক্তিকর। রিনা তাই লুডুখেলা ধরেছিল। ওর ১৩-১৪ বছরের ভাই দুটি ধরেছিল বিড়ি ফোকা। তারা তখন মামার বাড়িতে।

আবার শুরু হলো যুদ্ধ! মরিয়মের মাথার মধ্যে ধুমধাম আওয়াজ। সেখানে কালভার্ট, স্কুলঘর, দালানকোঠা ভাঙতে শুরু করেছে। ততক্ষণে রিনা আবার যুদ্ধ ছেড়ে সোজা চলে যায় ভালোবাসা, মন দেওয়া-নেওয়ার। গাঁয়ে মিলিটারি ঢুকে মেয়েদের কখন ধরে নিয়ে যায়, এ নিয়ে চিন্তা করে করে তার বাবা-মায়ের যখন পাগল হওয়ার জোগাড়, সে তখন চুরিচামারি করে লুডুর গুটি পাকাতে ব্যস্ত। শুরুতে এই কাজে বাগড়া দিলেও মামাদের পাশের বাড়ির একটি ছেলে হঠাৎ তাকে সাহায্য করতে শুরু করে। খেলার পার্টনার হিসাবে ছেলেটা তার বিপক্ষে। তাহলেও সাপের ছোবল থেকে বাঁচিয়ে মইয়ের চূড়ায় রিনাকে সে কয়েকবার পৌঁছে দেয়। তাতে করে খেলা জমে না ঠিকই, প্রেম জমজমাট হয়। একটা চারকোনা কাগজের ওপর কয়েকটা ছোট-বড় সাপ। আর মই নিয়ে তারা যুদ্ধের ভেতর যুদ্ধকে বাদ দিয়ে এক ঝুঁকিপূর্ণ ভালোবাসায় মেতে ওঠে। সে এক তুলকালাম কাণ্ড। তাদের একবার সাপে খায়, তারপর মই বেয়ে তারা ঊর্ধ্বে উঠে যায়, সেখান থেকে পিছলে পড়ে নিচে, তার পরও থামে না, মইয়ের দিকে ছুটে যায়, যার চূড়ার পাশের ঘরেই এক মস্তবড় সাপ হাঁ করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া সংখ্যাগুলো দ্রুত বাড়ে-কমে তাদের পতন ও উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তারা প্রেমপ্রতিজ্ঞায় থাকে অবিচল। এমনকি বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরও।

ছেলেটা যুদ্ধের বাজার হিসাব করলে সুপাত্রই। তবে নিচু বংশের। বাপ-দাদারা কোত্থেকে এসেছে, কী বৃত্তান্ত-কারো জানা নেই। এ গাঁয়ে আবাস স্থাপনের পর রিনার মামার বড় আব্বার রায়ত ছিলেন তারা। রিনার বাবা-মা-মামার এ বিয়েতে তাই ঘোর আপত্তি। তারা সাপখোপ মইটইসহ লুডুর ঘর পুকুরে ফেলে দিয়ে মেয়েকে। ঘরবন্দি করেন। আশ্চর্য, যুদ্ধের দিনে ছেলেমেয়ে দুটি পালিয়ে যেত কোথায়! ভারতের শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়া তো অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। ঘরবন্দি হয়েও বিপদ কাটেনি। মাথায় কোরান শরিফ নিয়ে তওবা কাটার দিন রিনা যখন মইয়ের ওপর ভয়ে টলমল করছে, ছেলের বড় বোন তখন জানালা পথে শক্তপোক্ত মই আঁকা একটা কাগজ ছুঁয়ে তাকে কিরা কাটতে বলে। আর বলে যে, আসলে আগের তওবাটা সাপ ছিল। বোনের মারফত ছেলেটি তাকে সাপের ছোবল থেকে বাঁচানোর আর মইয়ের চূড়ায় পৌঁছে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছে। রিনা কিরা কাটে আবার। একদিকে সাপ, আরেক দিকে মই। ভারত-পাকিস্তান তখন যুদ্ধ বেধে গেছে। মাত্র বারো দিনের মামলা। রিনার বাবা-মা জানালাপথে চিঠি আসার খবর ঠিকই জানতে পেয়েছিলেন মামাতো বোন পিচকির মারফত। তাতে শুধু মই আছে, কিছু লেখাজোখা নেই শুনে তারা নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু সে নিজে কোনোক্রমে বিষয়টার ফয়সালা করতে পারছে না। তার পক্ষে যোগাযোগ করার উপায় নেই। কারণ ছেলেটা এখন কোথায়–তাও সে জানে না। সময় সময় মনে হয়, তাকে গাছে তুলে মইটা বুঝি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

সেই রাতে রিনাকে স্বপ্নে সাপে কাটে, মরিয়ম মই থেকে পড়ে যায়।

পরের রাতে ঠিক উল্টো। তৃতীয় রাতে প্রথম রাতের স্বপ্নটা ফিরে আসে। মরিয়মের ঘুমের ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। এদিকে চাকরিবাকরির খবর নেই। রিনার পেটকাটা, হাতকাটা ব্লাউজ একেক দিন একেকটা গায় দিয়ে সে আবেদের অফিসে যায়। কিছুটা সময় মুখোমুখি চেয়ারে বসে যেসব কথা রিনাদের বাসায় গোপন রাখে, সেসব কথা সে আবেদকে শোনায়। হাতিরপুলের বাসায় সে শহিদ মুক্তিযোদ্ধার বোন, যে চাকরি খুঁজছে। এখানে সে বীরাঙ্গনা, চাকরি যার প্রাপ্য। আবেদকে তা দিতেই হবে, কারণ সে এখন তখতে বসে আছে। আবেদ প্রথম দিনের মতো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোজ তাকে বিদায় করে। পরদিন আবার পেটকাটা-হাতকাটা ব্লাউজ, রিনার যেসব বাইরে পরে যাওয়ার সুযোগ নেই, তা পরে মরিয়ম বেরোয়। আবেদের মুখোমুখি বসে। সামনের টেবিলের ওপর অদৃশ্য চৌকো কাগজে সাপ আর মই। তাতে তারা দুজনেই গুটি চালে। সেখানে সাপে কাটার বা মই বেয়ে উর্ধ্বে ওঠারলাভ-লোকসানের ঝুঁকি সমান সমান। তার মধ্যে একদিন মরিয়মের অসতর্কে চাল দেওয়া গুটি মেজর ইশতিয়াকের ঘরে পড়ে যায়। তাতে সর্বাঙ্গে সর্পদংশনের জ্বালা অনুভব করে আবেদ। সে এই বলে মরিয়মকে শাসায় যে, তার তেজ কোত্থেকে আসে এখন সে বুঝতে পারছে। মেরি আসলে দালাল, ভুয়া বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের সময় মিলিটারির রক্ষিতা ছিল। আরেকবার চাকরি চাইতে এলে সে তাকে পুলিশে দেবে। কত মেয়ে-দালাল এখন সেন্ট্রাল জেলে পচে মরছে! মরিয়মও গুটি-ঘর সব উল্টে দিয়ে তাকে জানায়, মুক্তিযোদ্ধার আসল আর নকল বাজারে আছে। মানুষ সুযোগ পেলে পিটিয়ে মারে নকলদের। আবেদ যে আসল না, তা সে আগে থেকেই জানত, এখন জনে জনে তা রটিয়ে দেবে। মরিয়ম আর্মির রক্ষিতা হলে আবেদ কী। সেও তো অবাঙালি সওদাগর আর তার মেয়ের পয়সায় কেনা গোলাম।

সেই রাতে মরিয়মকে সাপে কাটে, মই থেকেও সে পড়ে যায়।

পরদিন অফিসে ঢোকার আগে বড় রাস্তার মুখে দারোয়ান মরিয়মের জন্য অপেক্ষা করে। নতুন পোশাকটার নিচে সে দরদরিয়ে ঘামছে আর সময় জানার জন্য হাতে ঘড়ি না থাকায় ঘন-ঘন আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আবেদ ভাতিজা হয়েছে তো কী, হঠাৎ বড়লোক, তাই পয়সার গরমি দেখায়। তা না হলে কেউ নিজের অফিসে পুলিশ ডেকে আনে একটা মেয়েকে ধরিয়ে দিতে! তারও তো ঘরে মা-বোন আছে। তাদের পুলিশ ধরলে কেমন লাগবে আবেদ মিয়ার? সব রক্তের দোষ। আবেদের বাপ-চাচারা মামলাবাজ ছিল। নিজের ভালো করতে না পারলেও অন্যের ক্ষতি করতে পিছপা হতো না। আবেদের আপন দাদা, দারোয়ানের আব্বার সব জমিজমা জাল দলিল করে দখলে নিয়ে নেয়। সেই কারণে আবেদ মিয়া আজকে স্যার, সে দারোয়ান। নিকুচি করি চাকরির। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে দারোয়ানের ইউনিফরম খুলে ফেলে। আর মামলাবাজের নাতির গোলামি নয়, সে একজন মুক্ত মানুষ। স্বাধীন দেশের নাগরিক।

রাস্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে রিকশা থামায়, মরিয়ম প্রথম তাকে চিনতে পারে না। ভাবে, রিনার ভাষায় বদমাশদের একজন; পেটকাটা-হাতকাটা, নাভির নিচে শাড়ি পরা মেয়েদের বিরুদ্ধে জাগ্রত যুবসমাজের নামে বাজারে যারা লিফলেট ছেড়েছে, তাদেরই একজন হয়তো ল্যাঙ্গট পরে তার রিকশায় চড়াও হচ্ছে। কিন্তু লোকটা সেরকম নয়, ভদ্র আর বিনয়ী, হাতজোড় করে তাকে সামনে এগোতে বারণ করছে। কেন? আল্লাহর দোহাই, আবেদের দূরসম্পর্কের চাচা ল্যাঙ্গট পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মরিয়মকে বলে, আবেদ তার ভাতিজা হয়েছে তো কী। অফিসে পুলিশ। মরিয়ম একপাও যেন আর না এগোয়। খোদা সাক্ষী। তাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হবে। আবেদ এখন অফিসের লনে বসিয়ে তাদের চা-নাশতা খাওয়াচ্ছে।

রিকশার চাকা আবার হাতিরপুলের বাসার দিকে ঘুরে যায়। বাসাসংলগ্ন মাঠে বক্তৃতার মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হাতুড়ি-কাস্তে খচিত লাল ঝান্ডা আর দাবিদাওয়ার অসংখ্য প্ল্যাকার্ড। সর্বহারার মুক্তি আসন্ন। শুধু মজুরি বাড়ালে চলবে না, চাই সমাজতন্ত্র। শিল্প-কারখানার জাতীয়করণ ত্বরান্বিত করতে হবে।

দরজা খুলে দেন রিনার মা। মরিয়মের আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরাটা চাকরির ব্যাপারে তাকে আশান্বিত করে। এখন আর এ বাড়িতে যুদ্ধ নিয়ে, পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নিয়ে কথা হয় না। বাজারদর, চুরি-ডাকাতি আলোচনার মূল বিষয়। মন্টুর প্রতি যতখানি সহানুভূতি তাদের ছিল, খবরের কাগজে মুক্তিবাহিনীর লুটতরাজ আর খুনখারাবির সংবাদ পড়ে তা-ও উবে গেছে। বেঁচে থাকলে সে তো ডাকাতই হতো। তবু ভালো, ছেলেটা শহিদ হয়ে কলঙ্কের দায় থেকে বাবা-মাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। মরিয়মের গলায় তাদের তুলে দেওয়া ভাত আটকে যায়। টেবিলের চড়া দামে কেনা খাবারগুলো মনে হয় দূরের এক ভোজসভার। তাতে হক নেই ওর। রিনা অন্যমনস্ক। গাছ থেকে নামার জন্য তার একটা মই দরকার ছিল, সে তা পেয়েও গেছে।

চাকরির পরিবর্তে মরিয়মকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা আবেদ যেদিন করে, সেদিনই রিনার নামে মই আঁকা একটি চিঠি আসে। মই আর সাপ। সাপ আর মই । দুর্ভাগ্য আর সৌভাগ্য একটা চৌকো ঘরে পাশাপাশি অবস্থান করে। ছেলেটি চিটাগাং থেকে ঢাকা বদলি হওয়ার যে তদবির করছিল, তা হয়ে গেছে। সে মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তবে নয় মাস চাকরি না করায় এই তার পুরস্কার। রিনা খুশিতে অস্থির হয়ে হাফ ডজন পেটকাটা-হাতকাটা ব্লাউজ মরিয়মকে দুম করে দিয়ে দেয়। বলে যে, ছয়টার একটাও তাকে আর ফেরত দিতে হবে না। তবে তার প্রশ্ন–যুদ্ধের নয় মাস, মরিয়ম কী নিয়ে ব্যস্ত ছিল যে, তার সাপ-লুডো খেলা হলো না? তাহলে কি আজকে চাকরি চাকরি করে পথে পথে ঘুরতে হতো! ইশ, কী বোকা মেয়ে, রিনা মরিয়মকে তিরস্কার করে–সে কী করে জানে না যে, সাপ যেখানে, মেয়েদের সৌভাগ্যও সেখানে!

পরদিন মরিয়ম ব্যাগ গোছায়। চাকরির সম্ভাবনা নেই যখন, ঢাকা বসে থেকে কী হবে। খালাম্মা, খালুজানকে বলে, সে আপাতত ফুলতলি গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। তারা খুশি হন। রিনা পেটকাটা-হাতকাটা ব্লাউজের সঙ্গে ম্যাচ করে বড় বড় সূর্যমুখী ছাপার রুবিয়া ভয়েলের শাড়ি তার নাভির নিচে পরিয়ে দেয়। হাতে তুলে দেয় লম্বা ডান্ডার একটা কালো ছাতা, যা জাগ্রত যুবসমাজের মাথায় ব্যবহারের জন্য রাস্তায় তার দরকার হতে পারে। যদিও লিফলেটটা দেখেছে শুধু মরিয়ম আর রিনা কিন্তু খালাম্মা-খালুজান একসঙ্গে হেসে ওঠেন। একটি সুখী-সমৃদ্ধিশীল পরিবারকে পেছনে ফেলে রাস্তায় নামে মরিয়ম। সে ফিরে যাচ্ছে ফুলতলি গায়ে নয়, নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রে। সেখানে পৌঁছেই তার প্রথম কাজ হবে পরনের পোশাক ছেড়ে বিনা মূল্যের মিলের শাড়ি আর লম্বা হাতার ব্লাউজ ঝটপট পরে ফেলা।

২০. পিতা-পুত্র

মনোয়ারা বেগম রোজ রাতে মরিয়মের গলায় কার যেন কান্না শোনেন। শব্দটা আসে বোজা কুয়াটার তল থেকে। কী আছে ওখানে, কেন টলটলে পানির কুয়াটা এভাবে মাটি দিয়ে বুজিয়ে ফেলা হলো–স্বামীকে বারবার জিগ্যেস করেও এর কোনো সদুত্তর পান না। তার সান্ত্বনা যে, মেরি যেখানেই থাকুক, বেঁচে আছে। কান্নার আওয়াজটা হয়তো তার কল্পনা। এত বড় একটা যুদ্ধ গেল, কত শত মানুষ মারা গেছে, কত শত স্বজনহারা কণ্ঠের ক্রন্দন, বাতাস কি এর কণামাত্রও ধরে রাখেনি! তার ভেতরটাও তো নিরালে কাঁদে। সময় সময় নিজের কান্নার শব্দে তিনি চমকে ওঠেন। এক মা ছাড়া দুনিয়ার কেউ এর আওয়াজ পায় না। ছেলেটা তার কোথায় গেল। কুয়াটা মন্টুর কবর নয় তো, যা তার কাছে গোপন রাখা হচ্ছে? মনোয়ারা বেগমের পীড়াপীড়িতে মন্টুর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি পুনরায় ছাপা হয় পত্রিকায়।

বিজ্ঞাপনটা পড়ে যে কালবিলম্ব করেনি, কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে পুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে, সে মন্টুর সহযোদ্ধা সরফরাজ হোসেন। ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার। সময় মন্টু বলেছিল, যদি কখনো দরকার হয়, ফুলতলি গাঁয়ের সন্ধানে তাকে গ্রামাঞ্চলে যেতে হবে না, ঢাকা শহরে খুঁজলেই চলবে। সেইমতো সরফরাজ একটা নদী পার হয়। নদীর পাড়েই কুমারদের আবাস। সেখানে ঘূর্ণায়মান চাকার ওপর তাল তাল। মাটি নানান তৈজসপত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। কুম্ভকারের আঙুলের ফাঁকে হাতি, ঘোড়া, টেপা পুতুল। পইন থেকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে বের হচ্ছে অবিশ্বাস্য সব জন্তু-জানোয়ার। ভাঙা হাঁড়িকুড়ি আর স্তূপীকৃত ভাঙা ফুলের টবের পাশ দিয়ে সরফরাজকে পথ চিনিয়ে। নিয়ে চলে মন্টু। অদূরের ট্যানারির সে গন্ধ শুঁকে মন্টুরই নাক দিয়ে। কিন্তু বাড়ির সামনে এসে ওর কথামতো বাঁশঝাড়টা দেখতে পায় না। এমনকি বাড়ির ভেতর থেকে। মেরিবু’র যে বেরিয়ে আসার কথা, সে না-এসে আসেন মন্টুর বাবা-মা। তাদের পেছন পেছন ঘরে ঢোকার পর সরফরাজকে ছেড়ে মন্টু পালিয়ে যায়। সে একা এখন কী করবে। তার সামনে উদগ্রীব দুজন মানুষ। দেশের বিজয় নিয়ে তারা এমন মেতেছিল যে, সহযোদ্ধার মৃত্যুসংবাদটিও সময়মতো পরিবারকে জানানোর দায়িত্ববোধ করেনি। সে নিজের ওপর বিরক্ত হয়। হাতের মুঠোতে ভরা খবরের কাগজের টুকরাটার মতো গলার ভেতর মৃত্যুসংবাদটা দলা পাকাতে থাকে। মন্টুর মা সে কিছু বলার আগে কাঁদতে শুরু করেন। বাবা একদম চুপ। ঝড় আসার আগ মুহূর্তে আকাশটা যেমন থমথম করে, বাতাস যেমন বন্ধ হয়ে যায়, সেরকম তার অবস্থা। অতীতকালের রাজা বাদশারা দূরদূরান্ত থেকে যে মৃত্যুখবর বয়ে আনত, তার গর্দান ফেলে দিত।

সরফরাজ গর্দানসহ মন্টুদের বাড়ি থেকে যখন বের হয়, তখনো দিন শেষ হওয়ার অনেকটা সময় বাকি। কিন্তু সে আর দেরি করে না। মন্টু এত দিন যেন বেঁচেই ছিল। তার মৃত্যু হলো আজ, যখন তার বাবা-মা খবরটা জানতে পারলেন। সরফরাজ জোরে জোরে পা চালায়। কারণ ভাঙা হাঁড়িকুড়ি, ফুলের টব, অবিশ্বাস্য সব জন্তুজানোয়ারের পাশ দিয়ে, ট্যানারির গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে তাকে এখন একা ফিরতে হবে।

সেই রাতে মনোয়ারা বেগম নিজের কান্নার শব্দ শুনতে পান না। তবে কুয়ার মাটিচাপা ক্রন্দনটা গুমরে গুমরে ওপরে উঠে সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তাতে পড়শিদের ঘুম ভেঙে যায়। তারা রাতের প্রহরে প্রহরে যে ছেলেটার মায়ের বিলাপ শোনে, সে যুদ্ধের আগে কালো কালিতে দেয়ালে শ্লোগান লিখত। তার হস্তাক্ষর ছিল ছাপার অক্ষরের মতো সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন। মিলিটারির ভয়ে চুনকাম করে তারা সেসব ঢেকে দিয়েছে। আজ তার মৃত্যুসংবাদ এসেছে। ঘুমভাঙা মানুষদের নিজের হাতে মুছে ফেলা সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন সারবাঁধা সব অক্ষর মনে পড়ে। কিন্তু স্লোগানের কথাগুলো স্মরণ হয় না।

পরদিন তিক্ততা ভুলে গোলাম মোস্তফা সপরিবারে ছুটে আসেন। গ্রাম থেকে আনানো হয় ছোট দুটি মেয়ে রত্না আর ছন্দাকে। তারা মনোয়ারা বেগমকে সারা দিন জড়িয়ে ধরে রইল দুধের শিশুর মতো। যে বাড়িতে বড় বোনের পাহারাদারির জন্য মন্টুকে পাঠানো হয়েছিল, সেখানে তার কুলখানির আয়োজন হয়। মেরির নাম একবারও উচ্চারিত হয় না। গোলাম মোস্তফা শুধু বললেন, ছেলেমেয়ে দুজনের নামেই কোরান খতম হোক। কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মনোয়ারা বেগম। মেয়ে তো বেঁচে আছে, তার ভাই কী নিষ্ঠুর! তিরিশ জন মাওলানা কুয়ার বুনো ঘাসের ওপর বদনির পানি ঢেলে অজু করে, সাদা চাদরের চারদিকে গোল হয়ে বসেন পবিত্র কোরানপাঠে। তবে দিনকাল ভালো নয় বলে কাজটা এত দ্রুততার সঙ্গে তারা শেষ করেন যে, মনে হলো, এক দরজা দিয়ে ঢুকে আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাদের পবিত্র গুঞ্জন আতর-আগরবাতির সুগন্ধি ধোঁয়ায় পরকালের ভীতিসঞ্চার করে খানিকক্ষণ ভেসে থাকল।

ঢাকার পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে সরফরাজের আগমনের দিনটা মন্টুর মৃত্যুদিন বলে সাব্যস্ত হলো। কারণ কবে কোথায় সে মারা গেছে, ছেলেটি এক-দু’বার বললেও কফিলউদ্দিন আহমেদ বা মনোয়ারা বেগমের অবস্থা ছিল না তা মনে রাখার। এ ছাড়া সংবাদবাহক নিজের ঠিকানা না-দিয়েই যে পথে এসেছিল, সেই পথেই ফিরে গেছে। তার নির্গমনের চতুর্থ দিনে বাড়িতে মিলাদ পড়ানো হয়, সঙ্গে কাঙালিভোজ। যে দেয়ালে যুদ্ধের আগে মন্টু সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে স্লোগান লিখেছিল, তার কিনার ঘেঁষে ফকির-মিসকিনরা কলাপাতা পেতে খেতে বসেছে। মহিষের মাংস আর লাউয়ের তরকারিতে ভাত মেখে যতবার তারা মুখ উঁচু করে লোকমা তোলে, ততবারই চুনকাম করা একটা সাদা দেয়াল তাদের দৃষ্টি রোধ করে দাঁড়ায়। কারো কারো তাতে অস্বস্তি হয়। তারা রাস্তায় ঝোল ফেলতে ফেলতে একবার এপাশে আসে, আরেকবার ওপাশে যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, তারা তো এখনো ভিখিরি। কাঙালিভোজে ভালোমন্দ খেতে এসেছে। মানুষের এত অভাব-অভিযোগ থাকতে খালি থাকে নাকি শহরের উঁচু-লম্বা দেয়াল! তবে অল্প কদিনের মধ্যেই সেসব আর সাদা থাকবে না। ভিক্ষুকদের দাবিদাওয়াসহ অন্য রকম অভিযোগ আর ভর্ৎসনায় ভরে যাবে। লিখবে মন্টুর বদলে আরেকজন–সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষরে, যে এখন তারই বয়সি।

কফিলউদ্দিন আহমেদ পকেট উজাড় করে টাকা খরচ করেছেন। একমাত্র ছেলে, যে সবে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিল, তার জন্য সামনে অনেক খরচাপাতির ব্যাপার ছিল। সেই তুলনায় শত শত কাঙালিভোজ বা পঞ্চাশ-একশ মাওলানা খাওয়ানো কিছুই নয়। তা ছাড়া ছেলেই যখন নেই, কার জন্য ঘরবাড়ি, জমিজমা আর ধনসম্পদ। গোলাম মোস্তফা পরামর্শ দেন, ‘দুলাভাই, বাসাটা ভাড়া দিয়া দেন।’ আগে ঢাকা ছিল প্রাদেশিক রাজধানী, এখন সারা দেশের প্রাণকেন্দ্র। সাহায্য করতে এসে এর ওপর বিদেশিদেরও নজর পড়েছে। হু-হুঁ করে ধানচালের দামের মতো বাড়িভাড়াও বাড়বে। ঢাকার মাটি বিকোবে সোনার দরে। কিন্তু মেরি? নামটা উহ্য থাকলেও সবার মাথায় সে নড়াচড়া করে। এ ব্যাপারেও গোলাম মোস্তফার বক্তব্য আছে। মেয়েটা এবার নিজের পায়ে দাঁড়াক। মানুষ জন্মায় যেমন নিঃস্ব আর একা, কেউ চাক-না-চাক যুদ্ধ তাকে সেই অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে। তেইশ বছর বয়সে সে একবার মরে আবার জন্ম নিয়েছে। দ্বিতীয়বার জন্মদানের ভাগিদার তার বাবা-মা নয়। মন্টুর কুলখানিতে মেরির নামেও কোরান খতম হয়েছে। ধরা যাক, এই পাতকুয়াটাই তার কবর। মা-বাবা ওখানে মেয়ের গোর দিয়েছেন। সব চুকেবুকে গেছে। এখন এই নতুন জীবনের দায় তার নিজের, না হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। গোলাম মোস্তফা নগণ্য মানুষ। জীবনে লেখাপড়ার ধার ধারেন নাই। তবু সাহস করে শিক্ষিত ভাগনির ভাঙাচোরা জীবনটা গড়ে দিতে চেয়েছিলেন। খোদা যা করে, মানুষের ভালোর জন্যই করে। দুলাভাই, একবার আমার কথা ভাবেন দেখি! একদিকে নিজের ছেলে, আরেক দিকে মায়ের তুল্য বড় বোনের মেয়ে। আমি কার স্বার্থ দেখলাম, নাকি দেখলাম না? কফিলউদ্দিন আহমেদ তার জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে উশখুশ করেন। শোকের বাড়িতে পুরোনো কথা তুলে আর অপমান করা কেন! গোলাম মোস্তফা নাছোড়বান্দা। সুযোগের তিনি কখনো হাতছাড়া করেন না। ছেলেটার যদি খুঁত থাকে, মেয়েটারও আছে, ঠিক কি না। এত যে বুঝলেন দুলাভাই, বলেন দেখি কার খুঁত বেশি–আপনার মেয়ের, না আমার ছেলের?

শ্যালকের মুখের দিকে কফিলউদ্দিন আহমেদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। খোদা দিন দিয়েছে, যা খুশি বলুক। এসব কথা সহ্য হয় না মনোয়ারা বেগমের। তিনি জায়নামাজ হাতে পাশের ঘরে চলে যান। তাতে গোলাম মোস্তফার যেন হুশ হয়। তিনি সযত্নে কথার মোড় ঘোরান। খোদা যা করে বান্দার ভালোর জন্যই করে। হঠাৎ খুশির চোটে জোরে একটা চাপড় মারেন কফিলউদ্দিন আহমেদের উরুতে, ‘দুলাভাই, রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা ক’দিন পরই দেখবেন এক ঘাটে জল খাচ্ছে। অবস্থা যত খারাপ ভাবছেন অত খারাপ না। মনে মনে যতই আপনার-আমার শত্রুতা থাক, মুসলমান মুসলমান মাত্র ভাই-ভাইই তো! আর পাক-ভারতও দুইটা দেশ–হিন্দুস্থান আর পাকিস্তান। মাঝখানে বাংলাদেশটা ফাউ। আইজ আছে কাইল নাই।’

গোলাম মোস্তফার বাঁচালতার কারণ বিলম্বে হলেও জানা গেল। আসন্ন বকরি ঈদে তিনি যাচ্ছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে মোবারকবাদ জানাতে। সরকারের খুব কাছের একজন এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন লড়াইটা বোঝলেন দুলাভাই, হিন্দুস্থানে আর পাকিস্তানে নাই, তামান দুনিয়াই জড়াই গেছে। খোদার কিরা–এক্কেবারে ভিতরের খবর। গোলাম মোস্তফার মুখ আর কফিলউদ্দিন আহমেদের কান এক জায়গায় চলে আসে। তার কথা শোনা না গেলেও বিষয়টা হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যেই এখন দুটি দল–একদল ভারত আর রাশিয়াপন্থি, আরেক দল আমেরিকাপন্থি। দুই পন্থিরা সংখ্যায় সমান সমান। মাঝখানে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছেন বঙ্গবন্ধু। আজন্ম ভারতের শত্রু গোলাম মোস্তফা আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে আমেরিকার পক্ষেই এবার ফাইট দেবেন। তার কাজকর্ম শুরু হবে পবিত্র ঈদুল আজহার পরদিন থেকে।

কফিলউদ্দিন আহমেদ মাঝরাতে জেগে ওঠেন প্রচণ্ড এক হাহাকার নিয়ে। স্বপ্নটা কী ছিল মনে নেই। তবে সত্য যা, তিনি পুত্রহীন এবং এ অবস্থায় একদিন দুনিয়া থেকে তাকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু কেন। কার ক্ষতি করেছেন যে, এত বড় সাজাটা তাকে মাথা পেতে নিতে হবে? দিনের বেলায় তিনি যে নিজহাতে মিলাদের মিষ্টি বেঁটেছেন, পকেটের টাকা গুনে গুনে তুলে দিয়েছেন মওলানাদের হাতে, সেসব ছিল লৌকিকতা, যা কেবল দিনেই সম্ভব। মধ্যরাতে তার চিত্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মৃতপুত্রের আত্মার মাগফেরাত না চেয়ে তিনি চান একটি জীবন্ত পুত্র–যে তার কবরে একদিন মাটি ফেলবে, যখন তিনি থাকবেন না তার রক্ত প্রবাহিত হবে যার ধমনিতে, যে তার নাক দিয়ে দম নিয়ে তারই ফুসফুসে বায়ু সঞ্চালন করবে, যখন তার নাক এমনকি ফুসফুসও থাকবে না। কফিলউদ্দিন আহমেদের একটি পুত্রসন্তান চাই-ই চাই। সেই মতো পরিপূর্ণ তেজ নিয়ে তিনি অগ্রসর হন। মন আর দেহ দুই-ই প্রস্তুত। কিন্তু তার আরোহণ আরেকটা ক্রোধের জন্ম দেয়। স্ত্রী যে আর রজস্বলা হন না, রাতের কুহক এমন যে, তা ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে ভুল পথে চালিত করেছিল। কাজটা ক্ষমাহীন। শোকার্ত একজন মায়ের জন্য নির্যাতনতুল্য। পুত্রপ্রত্যাশী পিতার বেলায় অপূরণীয় ব্যর্থতা, যা তাকে আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এভাবে একটা ক্রোধ থেকে আরেকটা ক্রোধ-রাতের সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়ে চলল। মনোয়ারা বেগম দুঃখে-অপমানে কাঁদতে কাঁদতে দেখলেন, লোকটাকে ঘর ছেড়ে ছায়ার মতো বেরিয়ে যেতে। তার এক হাতে শাবল আরেক হাতে একটা টুকরি।

ডুবন্ত চাঁদের আলোয় কফিলউদ্দিন আহমেদ মাটি খুঁড়ছেন। ষাটোর্ধ্ব পেশি শাবলের সঙ্গে ওঠানামা করছে স্বাভাবিকের চেয়ে ক্ষিপ্রগতিতে। তালহীন। এ বেতাল অবস্থাটা বিছানা থেকে তার সঙ্গ নিয়েছে। কাকভোরে বাড়ির চারকোনায় বড় বড় চারটি গর্ত তৈরি হয়। তা থেকে বেরোয় পবিত্র চারটি বোতল, যা টুটাফাটা। তিনি সেসব আছড়ে-আছড়ে গুঁড়ো করে টুকরিতে ভরেন। এবার দ্বিতীয় অভিযান। স্থান পাতকুয়া। দিনের আলোয় ঘামে ভেজা মানুষটি বিকট আকার ধারণ করে। মনোয়ারা বেগম ছোট মেয়ে দুটিকে নিয়ে বাধা দেন। কাজ হয় না। তাদের চেঁচামেচিতে পড়শি একজন বেরিয়ে আসে। সে জানায়, কুয়া খোঁড়ার এখতিয়ার কফিলউদ্দিন আহমেদের নেই। যদিও তার নিজের জায়গায় নিজস্ব খরচে তৈরি এই পাতকুয়া। যারা কুয়াটা বন্ধ করেছে, সরকারের অনুমতি নিয়ে তারাই কেবল খুঁড়তে পারবে। তা ছাড়া পাড়ার মুরুব্বি হাজি সাহেব মন্টুর কুলখানির রাতেই ফিরে এসেছেন। এসব কাজে এখন। থেকে তার পারমিশন আবশ্যক।

হাজি সাহেবের নাম শুনে কফিলউদ্দিন আহমেদ শাবল ছেড়ে দেন। কাঁচ-ভাঙায় ভর্তি টুকরিটা উল্টে পড়ে। শিশুর মতো ভীত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। যাদের লুকিয়ে থাকার কথা, তারা আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে! যেন গর্ত থেকে সাপ। মন্টুর মৃত্যুসংবাদ শোনার পর হাজি সাহেব আর বিলম্ব করেননি। পথের কাঁটা চিরতরে সরে গেছে। এই সুবর্ণ সুযোগ। এবার তাহলে গোলাম মোস্তফার মতো আমেরিকাপন্থি হয়ে তিনি ফাইট করবেন? কী হলো দেশটার? যুদ্ধ তাহলে শেষ হয়নি! পুত্রকামনায় গত রাতে যে মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, তিনি যুদ্ধে হারানো মৃত সন্তানদের জন্য চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। রত্না-ছন্দা বিচলিত। মন্টুর কুলখানির রাতে হাজি সাহেবের ফিরে আসার সম্পর্ক তারা বুঝতে পারে না। এ বাড়ির ইতিহাসও তাদের অজানা। তাই বোতল আর পাতকুয়া রহস্যজনক মনে হয়। এসব রহস্যের প্রদর্শনী কেবল একটি আদর্শ জাদুঘরেই হওয়া সম্ভব। তবু বাবা-মায়ের সঙ্গে ফুলতলি গায়ে ফেরার আগে, ছোট ছোট হাতে মাটি দিয়ে তারা গর্ত চারটি ভরে দেয়। আর কুয়ার বুনো ঘাস সাফ করে তাতে একটা হাস্নাহেনার চারা রোপণ করে। বুদ্ধিটা যমজদের নিজস্ব। হাস্নাহেনা ফুলের সুবাসে রাতের বেলা সাপ আসবে। তাদের একমাত্র ভাই যুদ্ধে মারা গেছে। বড় বোন ঘরত্যাগী। যমজদের বড় হওয়া পর্যন্ত বাড়িটা পাহারা দেবে মন্ত্রপড়া বোতলের পরিবর্তে বিষধর সর্পকুল।

২১. পার্কের বিকল্প ঘর, ঘাসের বিকল্প তোশক

পুত্রসন্তানের জন্য বাড়ি তৈরি হলেও এর প্রথম বাসিন্দা মরিয়ম। কোনো-না কোনোভাবে তার হক থেকেই যায়। যদিও সে এখন ঘরছাড়া, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ক্রমাগত ঠিকানা বদলে চলেছে। তবে যুদ্ধের সময়ের মতো দল বেঁধে নয়। একা একা। রিনাদের বাসা, পুনর্বাসনকেন্দ্র, তারপর নিউ ইস্কাটন রোডের বাড়ি হয়ে সে এখন কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে। তার মতো আরো ক’জন বীরাঙ্গনা আছে এখানে। তাদের চাকরিস্থল ভিন্ন ভিন্ন। যে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই মেয়েরা ধর্ষিত হলো, চাকরি করা ছাড়া সেই দেশের পুনর্গঠন কাজে কি লুটপাটের মধ্যে তারা নেই। তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিপ্লবী মনোভাব নিয়ে চোরাচালান প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন’ ডাকে সাড়া দেয়নি। কলকারখানা রাষ্ট্রীয়করণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। ঘন ঘন পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ বা আগুন নেভানো কোনোটাই করছে না। খুন-ছিনতাই-রাহাজানি সংঘটনে বা এর প্রতিরোধে তারা কখনো এগিয়ে আসেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন, নতুন নতুন আইন তৈরির সময় তারা হাত গুটিয়ে বসে রইল। ‘দালাল আইন ১৯৭২’-এর ফাঁকফোকর নিয়ে মাথা ঘামায়নি। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা চুপ করে শুনল। রক্ষীবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে তারা একবারও নিন্দা জানায়নি। সর্বহারাদের শ্রেণিশত্রু খতম অভিযানেও শরিক হলো না। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ পাস হওয়ার পর আইনমন্ত্রীকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়নি। যদিও অ্যাক্টের ২(ক) ধারায় ‘ধর্ষণ’কে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখনো এ নিয়ে তারা উচ্চবাচ্য করেনি। তারা বাকশালে যোগ দেয়নি। আসলে তারা একটা লড়াইয়ের মধ্যে ছিল। এজেন্ডা তাদের একটাই–বীরাঙ্গনার সামাজিক পুর্নবাসন। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে, যৌতুকের প্রলোভন দেখিয়ে সরকার যে কাজে ব্যর্থ হয়েছে, তারা তা সমাধা করতে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কর্মজীবী মেয়েদের হোস্টেলের পাশে জাতীয় নাট্যশালা, অদূরে রমনা পার্ক। আশপাশের রাস্তাগুলো সন্ধ্যার পর নির্জন। লাইটপোস্টের আর গাছগাছালির আলো আঁধারে মরিয়মরা ভালো কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। কাগজের ঠোঙা থেকে চানাচুর, ঝালমুড়ি বের করে ভাগাভাগি করে খায়। টাকা নষ্ট করে টিকিট কিনে নাটক দেখতে যায় না। আলোর নিচে বসে পড়া বা দাঁড়িয়ে থাকা থেকেও বিরত থাকে। তারা কেবল একের পর এক অন্ধকার নির্জন রাস্তায় পাক খেয়ে খেয়ে অন্ধের মতো ঘোরে।

সন্ধ্যার পর রমনা পার্কে বেশ্যার শরীর বেচাকিনির হাট। ওখান থেকে একদল খদ্দের দলচ্যুত হয়ে একদিন বেরিয়ে পড়ে। ঘাসের ওপর দিনের পর দিন বেশ্যাগমন একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। তার ওপর পুলিশের উৎপাত। তারা হাঁটতে হাঁটতে নির্জন রাস্তায় প্রবেশ করে, যেখানে মরিয়মরা সেজেগুজে আগে থেকেই ঘোরাঘুরি করছিল। মেয়েরা চানাচুর-ঝালমুড়ির ঠোঙাগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। পুরুষদের হাত ধরে নাট্যশালায় ঢোকে। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পাশাপাশি দুটি চেয়ারে একজন বীরাঙ্গনা আর রমনা পার্কের একজন প্রাক্তন খদ্দের–তারা জোড়ায় জোড়ায় ঝালমুড়ি চানাচুর খায়, নাটক দেখে। যাদের উচ্চমার্গের নাট্যকলা বুঝতে অসুবিধা, তারা জোড় বেঁধে চলে যায় বলাকা, নাজ বা মধুমিতায়। সিনেমাহলগুলোতে বধূ মাতা কন্যা, কাঁচের স্বর্গ, জীবন সঙ্গীত দ্বিতীয় সপ্তাহেও হাউসফুল। তুলনায় গোপালভাঁড় ছবিটা পাত পায় কম। বাঙালি আসলে হাসতে ভুলে গেছে। রমনা পার্কের প্রাক্তন খদ্দেরদের কেউ কেউ ভাড়ামি দেখতে চাইলে মেয়েরা তাতে বাদ সাধে। বলে, ‘গোপালভাড় নামটা শুনলেই খালি হাসি পায়। লোকটা জানি কেমন!’ এসব কথার কথা। আসলে রঙ্গ-তামাশা দেখার জন্য তারা এই জোড় বাঁধেনি। একঘেয়েমি কাটানো বা রুচি বদলের মতো বিলাসিতাও তাদের নেই। দেশ বা জাতি যে সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ, যাকে বলে বীরাঙ্গনার সামাজিক পুনর্বাসন–সেই গুরুদায়িত্ব এখন তাদের কাঁধে। যে সকল নেতা-নেত্রী বলে বেড়াচ্ছিলেন, ‘এত বড় একটা দুর্যোগ আমরা তো ওভারকাম করেছি,’ তাদের আত্মতৃপ্তির ফাটল দিয়ে মরিয়মরা রাস্তায় এসে পড়েছে। যা করার এখন নিজেদেরই মেরে-কেটে করতে হবে। এ ব্যাপারে পত্রিকাগুলো সহায়ক ভূমিকা নেয়। তারা চুলে মুখ ঢাকা এক বীরাঙ্গনার ছবি অনবরত কাগজে ছাপিয়ে আগে থেকেই তাদের অবয়বশূন্য করে রেখেছিল। আর সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে স্লোগান দেওয়া বা প্রেস কনফারেন্স করা থেকে বিরত থাকায় বরাবরই তারা কণ্ঠহীন। ফলে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ তো বটেই দিনের আলোতেও কেউ তাদের শনাক্ত করতে পারে না। তারা একরাশ ঘন কালো চুলের আড়াল নিয়ে, চানাচুর-ঝালমুড়ি খেতে খেতে, নাটক বা সিনেমা দেখতে দেখতে জাতীয় সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যায়।

মমতাজ নামটা মরিয়ম এযাবৎ ভেবেছে মেয়েদের। তবে সে পুরুষই। পরিচয় পর্বে লোকটা সদর্পে জানায়, রমনা পার্কের বেশ্যাদের সে একজন প্রাক্তন খদ্দের। পেশায় ব্যবসায়ী। অস্ত্রহাতে যুদ্ধ না করলেও মনেপ্রাণে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই সুবাদে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় হয়ে গেছে। তাই দিয়ে ব্যবসার লাইসেন্সও জুটেছে। কাজটা যে রিলিফের চাল, গম, কম্বল কালোবাজারে কিনে খোলা বাজারে বিক্রির, মরিয়ম পরে তা জানতে পারবে। আপাতত হবু বর ঘাসের শয্যা ছেড়ে ঘরের নিরাপদ বিছানায় ফিরতে চায়। মরিয়মেরও ঘরে ফেরা দরকার। প্রথম ঘর, তারপর সমাজ–বিয়ের মাধ্যমে বীরাঙ্গনার সামাজিক পুনর্বাসন।

নাটক-সিনেমা দেখতে দেখতে, ঝালমুড়ি-চানাচুর চিবোনোর এক ফাঁকে মমতাজ একদিন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মরিয়ম তাতে মিউজিক্যাল চেয়ারে ত্বরিত বসে পড়ার রেফারির বাঁশির সংকেত শোনে। আর বিয়েটাও হয়ে যায় সামনের খালি চেয়ারে ঝপ করে বসে পড়ার মতো। বীরাঙ্গনা, অ-বীরাঙ্গনা মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলই। তার ওপর খেলার নিয়মানুযায়ী একটা চেয়ার কম। তবে ভয়টা তা