- বইয়ের নামঃ বানিয়ালুলু
- লেখকের নামঃ শিবব্রত বর্মন
- প্রকাশনাঃ বাতিঘর
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০. উৎসর্গ / ভূমিকা / সূচীপত্র
বানিয়ালুলু – শিবব্রত বর্মন / বিজ্ঞান কল্পগল্প
Banialulu (A collection of science fiction stories) by Shibabrata Barman
প্রথম প্রকাশ : মাঘ ১৪২৫, ফেব্রুয়ারি ২০১৯
.
বিজ্ঞান-কল্পকাহিনির চেনা সীমানা ডিঙিয়ে এই গল্পগুলোতে বিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির এমন এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে। যা পাঠককে মুগ্ধ ও স্তম্ভিত করে রাখবে।
.
এমন এক দেশ, মানচিত্রে কোথাও যার উল্লেখ নেই, চরাচরব্যাপী এক ষড়যন্ত্র দেশটির অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে, কিন্তু দেশটি যে আছে, মাঝে-মধ্যে পরোক্ষ আভাস। পাওয়া যায়; এমন এক জনপ্রিয় লেখক, যার বসবাস অন্য আরেক লেখকের মগজের ভেতরে; এমন এক আপেল, যা আসলে আপেল নয়–শেক্সপিয়রের সনেট; এমন এক তৈলচিত্র, যা যৌথভাবে আঁকছেন দুই সমান্তরাল মহাবিশ্বে বসবাসকারী দুজন শিল্পী; এমন এক কবিতা যা লেখার আগেই চুরি হয়ে গেছে; এমন এক খুনি, যাকে ধরতে হলে প্রমাণ করতে হবে লোকটা রোবটের ওপর নির্যাতন চালাত।
বানিয়ালুলু গল্পগ্রন্থে শিবব্রত বর্মন বিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসির এমন এক কল্পলোক তৈরি করেছেন যা পাঠককে একই সঙ্গে আবিষ্ট করে রাখে অনুসন্ধিৎসায় ও সন্তরণমগ্নতায়।
.
শিবব্রত বর্মন
জন্ম ১৯৭৩, ডোমার, নীলফামারী। বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি করলেও প্রধান ঝোঁক গল্প-উপন্যাসে। প্রথম বই ছায়াহীন বেরিয়েছিল ২০০৯ সালে। বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি ও রহস্যকাহিনি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত।
.
উৎসর্গ
আলতাফ শাহনেওয়াজ
আবুল বাসার
যাদের শ্রম ও ঘামের
ফসল এই বই
.
It is not down in any map;
true places never are.
–Moby Dick
Herman Melville
.
সূচীপত্র
বানিয়ালুলু
জাগার বেলা হলো
দুই শিল্পী
ভেতরে আসতে পারি?
প্রতিদ্বন্দ্বী
দ্বিখণ্ডিত
ড. মারদ্রুসের বাগান
বহুযুগের ওপার হতে
সার্কাডিয়ান ছন্দ
বুলগাশেম প্যারাডক্স
মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস
০১. বানিয়ালুলু
বানিয়ালুলু নামে যে একটা দেশ আছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় না এলে এটা কারও জানাই হতো না। জানা হতো না, লুলু নামে বানিয়ালুলুর একটা দাপ্তরিক ভাষা আছে এবং সোয়া কোটি লোক সেই ভাষায় কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে গিয়ে এই দেশটির অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গেছে। কীভাবে সেটা ঘটল, সেই কাহিনি একাধারে কৌতুকময়, চমকপ্রদ এবং কিছুটা শ্বাসরুদ্ধকরও বটে, কেননা এর সঙ্গে একজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার যোগ আছে। যিনি নিখোঁজ হয়েছেন, তিনি একজন সাংবাদিক। তাঁর কথা আমি যথাস্থানে বলব। এখন শুরুর কথা শুরুতে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাতটি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই সাতটি দেশ হলো ইরান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, শাদ এবং উত্তর কোরিয়া। এই নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী। দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে এটি স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে জারি করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এটি ছিল ওই দিন একই বিষয়ে জারি করা দ্বিতীয় আদেশ। এর আধা ঘণ্টা আগে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে যে আদেশটি জারি করা হয়েছিল, তাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ছিল আটটি দেশের নাম। অস্বাভাবিক দ্রুততায় সেই আদেশ বাতিল করে দ্বিতীয় আদেশ জারি করা হয়। সেখানে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সাতটি দেশের নাম দেখা যাচ্ছে। যে অষ্টম দেশটির নাম কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি বানিয়ালুলু। এই দেশটির নাম আগে কেউ কখনো শোনেনি। এই নামে কোনো দেশ নেই।
হোয়াইট হাউসের অফিশিয়াল ঘোষণায় কী করে অস্তিত্বহীন একটি দেশের নাম এল, তা নিয়ে কেউ খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। অনেকেই এটাকে দাপ্তরিক প্রমাদ হিসেবে ধরে নেয়। তা ছাড়া সাত দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে হই-হাঙ্গামা শুরু হয়, সবার নজর সেদিকে সরে গিয়েছিল। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতে হাঁপ ছেড়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন হোয়াইট হাউসের আসন্ন বহু কেলেঙ্কারির মধ্যে অন্তত একটি আপাতত চাপা দেওয়া গেছে। তাদের এই ভাবনা যে ভুল ছিল, বড়দিন আসার আগেই সেটা টের পাওয়া গেছে।
এখন আমি আমাদের সেই সাংবাদিক বন্ধুর কথা বলব, ২৪ সেপ্টেম্বরের প্রথম ঘোষণাটির দিকে যিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন এবং দ্বিতীয় ঘোষণা আসা সত্ত্বেও যার কোঁচকানো ভ্র সোজা হয়নি। তিনি এর মধ্যে ইঁদুর মরার গন্ধ পেয়েছিলেন এবং সেই গন্ধ তাঁর নাকে ক্রমাগত ঘনীভূত হয়েছে। একাধিক সূত্র তাকে নিশ্চিত করেছে, ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম ঘোষণার কেলেঙ্কারির পরপর ওই দিন দুপুরেই হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের অতি আস্থাভাজন ‘ইনার সার্কেল’ তাৎক্ষণিক জরুরি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে এবং ওই দিন সন্ধ্যার আগেই কয়েকটি দপ্তরের পাঁচজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পুরো বিষয়টির মধ্যে একটি অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো ছিল এবং সবকিছুর ওপর গোপনীয়তার একটা চাদর টেনে দেওয়া হয়েছিল।
চাকরি হারানো পাঁচ কর্মকর্তার একজন ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রেকর্ড শাখার আর্কাইভিস্ট। কয়েক সপ্তাহ পর অক্টোবরের কোনো এক বিকেলে ম্যানহাটানের নবম ও দশম ব্লকের মাঝে ডেমি জোন্স নামে একটি ক্যাফেতে তাঁকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তার সামনে বসে ছিলেন বাতিকগ্রস্ত সেই সাংবাদিক। তাকে এখন থেকে আমরা র্যাট স্মেলার নামে ডাকব। আর্কাইভিস্ট ও র্যাট স্মেলার পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট সেখানে বসে ছিলেন। তাঁরা নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। কথা শেষে বিল মিটিয়ে তারা ট্যাক্সি নিয়ে দুজন। দুদিকে চলে যান।
শোনা যায়, র্যাট স্মেলার তাঁর দেড় কক্ষের ক্ষুদ্র অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচ হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু দলিলপত্রও জোগাড় করে ফেলেছিলেন তিনি। প্রতিবেদনের প্রস্তাবিত শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন বানিয়ালুলু একটি দেশের নাম। আটলান্টিকের অপর পারে একটি ইংরেজি ট্যাবলয়েডের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছিল বলেও জানা যায়, তবে কেউ নিশ্চিত নন, নির্মীয়মাণ প্রতিবেদনের কোনো অসম্পূর্ণ খসড়া তিনি সেই পত্রিকার অফিসে পাঠিয়েছিলেন কি না। তত দিনে তার প্রতিবেদনের। বিষয়বস্তু নানাভাবে প্রচার পেতে শুরু করেছে এবং তিনি কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন, একটা পর্যায় পর্যন্ত সেটা জানাজানি হয়ে গেছে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে র্যাট স্মেলার নিখোঁজ হন। অনেকে বলেন, তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই অন্তর্ধানের যোগ আছে। থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
র্যাট স্মেলার একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রচারে নেমেছিলেন। তার দাবি, ট্রাম্পের প্রথম ঘোষণায় কোনো দাপ্তরিক প্রমাদ ছিল না। বানিয়ালুলু নামে একটি দেশের অস্তিত্ব সত্যি আছে। বেলজিয়াম বা দক্ষিণ আফ্রিকা বা প্যারাগুয়ে নামক দেশগুলো যেভাবে অস্তিত্বশীল, বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তফাতের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্য দেশের তালিকায় এটির নাম নেই, পৃথিবীর কোনো মানচিত্রে এটির উল্লেখ পাওয়া যায় না এবং কোনো ভূগোলের বইতেও এর সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টের গোপন কুঠুরি থেকে র্যাট স্মেলার যেসব দালিলিক তথ্য-উপাত্ত হাত করেছেন, সেগুলোর ভিত্তিতে বানিয়ালুলুর কিছু বিবরণ দাঁড় করানো সম্ভব। তবে স্বীকার না করে উপায় নেই, সেই বিবরণ বড়ই ছেঁড়াছেঁড়া, অসম্পূর্ণ এবং জোড়াতালিময়। এগুলো দেশটি সম্পর্কে কোনো অখণ্ড, সঙ্গতিপূর্ণ ছবি হাজির করে না। যেমন ধরা যাক, আমরা বানিয়ালুলুর রাজধানী শহরের নাম পাই না, অথচ রাজধানীর পূর্ব প্রান্তে ইমাহাতি নামে যে একটি মহল্লা আছে এবং সেই মহল্লার ৩৩৬ ও ৩৩৭ নম্বর বৈদ্যুতিক খুঁটির মধ্যবর্তী দূরত্ব যে ১৬ গজ–এই অপ্রয়োজনীয় তথ্য আমরা জানতে পারি। দেশটির দাপ্তরিক ভাষা লুলুর নিজস্ব লিপি নেই, এই তথ্য একাধিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু আমরা জানতে পারি না, কোন ধার করা লিপিতে তা লেখা হচ্ছে। এক স্থানে খুবই পরোক্ষ একটি উল্লেখে বলা হয়েছে, নেপোলিয়নের অস্টারলিৎসের যুদ্ধ জয়ের সময়কাল থেকে লুলু ভাষা মান্দারিন লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। কিন্তু এ থেকে অনুমান করার কোনো কারণ নেই যে দেশটির সঙ্গে চীনা ভাষাভাষি অঞ্চলের কোনো ভৌগোলিক যোগ আছে।
বানিয়ালুলু সম্পর্কে কিছু বিবরণে শুধু যে সঙ্গতির অভাব প্রকট–তা-ই নয়, কিছু বিবরণ পরস্পরবিরোধীও বটে। যেমন ধরা যাক, কয়েকটি উল্লেখ থেকে মনে হতে পারে, দেশটি সিরিয়া এবং আজারবাইজানের মাঝামাঝি কোনো মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। আবার অপর একটি উল্লেখে মনে হবে, দেশটি বাল্টিক সাগর তীরবর্তী। অথচ নামের ধ্বনিবিন্যাসের কারণে অনেকের অনুমান, বানিয়ালুলুর অবস্থান আফ্রিকা মহাদেশের কোথাও অনেকে লাতিন আমেরিকাকেও সন্দেহে রাখতে পারেন। তবে অবস্থান নিয়ে যত ধোঁয়াশাই থাক না কেন, দুটি বিষয় সন্দেহের উর্ধ্বে। প্রথমত, বানিয়ালুলু কোনো দ্বীপ দেশ নয়। এটির অবস্থান। পৃথিবীর বৃহৎ মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলোর কোনো একটিতে। দ্বিতীয়ত, দেশটি বিষুবীয় অঞ্চলের দেশ নয়।
র্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর ভূ-প্রকৃতি, কৃষি, জলবায়ু এবং মানুষের জীবনযাত্রা-সংক্রান্ত যেসব দলিল জোগাড় করেছেন, আমি বলব, সেগুলো বরং অনেক বেশি সুসঙ্গত এবং বিশদ। কিছু বিবরণ রেমব্রান্টের ছবির মতো জীবন্ত। একটি বিবরণে আদ্দিশ নামে একটি পাহাড়ের পাদদেশে সাত সদস্যের একটি পরিবারের। এক দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা আছে। পরিবারের একটি মেয়ে পাতকুয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলছে। এমনকি সেই বালতির প্রতিটি রিভেটের গায়ে হলদেটে মরচের বিবরণও আমরা পাই। পরিবারটির বসতভিটা থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি নদী, যার নাম যদিও উল্লেখ করা নেই, তবে সেই নদীর স্বচ্ছ জলের তলদেশে খেলা করা প্রতিটি মাছের নামধামসহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া আছে। সেই বিবরণ এত নিখুঁত যে মাছের প্রতিটি আঁশ থেকে ছুটে আসা রোদের ঝিলিক চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
র্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষের বোটানি বইয়ের (রুশ ভাষায় ভাষান্তরিত) পঞ্চম অধ্যায়ের পুরোটাই হাতে পেয়েছেন। সেখানে বানিয়ালুলুর ছয় ধরনের বায়ুপরাগী ফুলের প্রস্থচ্ছেদের ছবি দেওয়া আছে। পাঁচটি ফুল অতি পরিচিত। ষষ্ঠ ফুলটি আমাদের জবা ফুলের মতো দেখতে হলেও একটু ভালো করে তাকালে পাপড়ির বিন্যাসের অমিলগুলো চোখে পড়বে।
ষাটের দশকে দেশটিতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল বলে একটি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোথাও বলা হয়নি, বানিয়ালুলুর প্রধান ফসল কী। ভুট্টাজাতীয় একটি ফসলের উল্লেখ এক স্থানে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাইলে তা হবে অতি সাধারণীকরণ।
র্যাট স্মেলার দেশটির গ্রামাঞ্চলে একটি বিয়ের বনের দীর্ঘ ক্লান্তিকর বিবরণ দিয়েছেন। তা থেকে সেখানকার লোকাঁচার, পোশাক এবং খাদ্যাভাস সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। এমনকি যে চারটি বিয়ের গীতের লিরিক তুলে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে প্রচলিত লোকবিশ্বাস এবং অধিবাসীদের যৌথ মনোজগৎ সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় অনুমান করা যায়। শেয়াল আর কাকের চালাকি নিয়ে কয়েকটি উপদেশমূলক গল্পের একটি সিরিজ এ ক্ষেত্রে সোনার খনি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এগুলো থেকে সহজে অনুমেয়, সেখানকার কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোয় এখনো কৌম সমাজকাঠামোর প্রভাব প্রবল এবং শহরাঞ্চলে অর্থবিত্তের চেয়ে দৈহিক শক্তি এবং বংশপরিচয়কে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়।
র্যাট স্মেলার দেশটির মুদ্রা এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সামান্য কিছু বিবরণ হাজির করতে পেরেছেন। এ ছাড়া দেশটির শিল্প অঞ্চলে অবস্থিত একটি কারাগারের পঞ্চাশজন কয়েদির অপরাধের বিবরণ থেকে সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা এবং এমনকি আর্থসামাজিক কাঠামো সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
মোটকথা র্যাট স্মেলার যেসব বিচ্ছিন্ন দলিল ও বিবরণ উদ্ধার করেছেন, সেগুলো জোড়া লাগিয়ে বানিয়ালুলুর একটি ছবি দাঁড় করানো যায় বটে, তবে সেই ছবি একটা পুরোনো বিবর্ণ পারিবারিক অ্যালবামের ফাংগাস আক্রান্ত গ্রুপ ছবির মতোই ধোঁয়াশাময়। তাতে প্রকাশিত অংশের চেয়ে অপ্রকাশিত অংশই বেশি।
র্যাট স্মেলারের প্রতিবেদনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, সমগ্র বিশ্বের কাছে বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব কী করে এত দিন গোপন রাখা সম্ভব হলো আর এ নিয়ে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড়ের কারণ কী এগুলোর কোনো ব্যাখা এতে নেই। এ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত বা অনুমানের সূক্ষ্ম সূত্রও হাজির করতে পারেননি তিনি। আমার মনে হয়েছে, গোপনীয়তার এই রহস্য ভেদের চেয়ে দেশটির বিবরণ দেওয়ার দিকেই তার ঝোঁক ছিল।
এই সব বিবরণ থেকে কতগুলো সাধারণ জিনিস যৌক্তিকভাবে প্রতিপন্ন হয়। প্রথমত, বানিয়ালুলু কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। মান্দারিন লিপি গ্রহণ, রুশ ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বইপত্রের উপস্থিতি এবং সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় (ভুলবশত) উল্লেখ প্রমাণ করছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে এটির যোগাযোগ আর দশটা দেশের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘটছে। র্যাট স্মেলার এমনকি তুরস্কের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের বানিয়ালুলু সফর এবং দেশটি থেকে গ্রানাইট পাথর আমদানিসংক্রান্ত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করেছেন।
এরপরও বানিয়ালুলুর অদৃশ্য থেকে যাওয়ার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে দুৰ্জেয় রহস্যগুলোর একটি। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে এই বিষয়টিতেই র্যাট স্মেলারের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
আমি নিজে এ বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করে অবশেষে বুঝতে পেরেছি, এ ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতির সুযোগ নেই। বানিয়ালুলুর অনস্তিত্ব কোনো অভিপ্রায়হীন নিরীহ ঘটনা নয়। এর পেছনে চরাচরব্যাপী ষড়যন্ত্রের সুদীর্ঘ জাল বিছানো। সেই জাল ভেদ করা শুধু যে অসম্ভব, তা-ই নয়, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও। আমরা বড়জোর ষড়যন্ত্রটির প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু আঁচ অনুমান করতে পারি।
বানিয়ালুলুর অনস্তিত্বের দুটি লক্ষণীয় দিক আছে। প্রথম কথা হলো, এটির উপস্থিতি বিশ্বের যৌথ মানব অনুধাবন থেকে এমন বিশেষ কায়দায় মুছে ফেলা হয়েছে, যেন ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই এটির অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ অবলোপন প্রক্রিয়াটির একটি রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট বিদ্যমান। এটা অর্জন প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়। দ্বিতীয়ত, বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব অবলোপনের সঙ্গে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের যোগ আছে। এই অবলোপন প্রক্রিয়াটির সাফল্যের সঙ্গে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে বিস্তৃত একটি সুবিশাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার টিকে থাকা না-থাকার প্রশ্ন জড়িত।
অবলোপন প্রক্রিয়াটি কীভাবে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে, এ বিষয়ে আমার একটি অনুমান বা হাইপোথিসিস আছে। অনুমানটি আমার মধ্যে বিদ্যুভূলকের মতো উঁকি দিয়েছে, যখন আমি দক্ষিণ আমেরিকায় হিস্পানি উপনিবেশ বিস্তার প্রক্রিয়া নিয়ে পোস্ট-কলোনিয়ান ইতিহাসবিদ টমাস মানরোর একটি বই পড়ছিলাম। মানরো দেখিয়েছেন, কী করে হিস্পানি কনকিস্তাদোররা একটি বিশাল অ্যাজটেক মন্দির ফিজিকালি ধ্বংস না করে সেটার অস্তিত্ব মুছে দিতে পেরেছিল। পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরটির দেড় হাজার সিঁড়ির ধাপের একটি পাথরও না সরিয়ে, একটি মূর্তিও অপসারণ না করে মন্দিরটি এমনভাবে গায়েব করা হয়েছে, কোথাও কোনোভাবে এটি আর দেখতে পাওয়া যায় না, দেখতে পাওয়া যাবে না। যে অভিনব কায়দায় এ কাজটি করা হয়েছে, টমাস মানরো সেটার নাম দিয়েছেন ‘কালচারাল ডিজইন্টিগ্রেশন’। মন্দিরসংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, সমস্ত উপাত্ত টুকরো টুকরো করে এমন বিশেষ কায়দায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য তথ্যের সঙ্গে তা মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এগুলো সমন্বিত করে মন্দিরসংক্রান্ত কোনো অভিন্ন অনুধাবন কারও পক্ষে গড়ে তোলা আর সম্ভব নয়। ফলে কারও অনুধাবনে মন্দিরটি একটি প্রাচীন বৃক্ষ, কারও অনুধাবনে এটি একটি প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ড, আবার অনেকের অনুধাবনে এটি একটি লন্ড্রির দোকান হিসেবে প্রতিভাত হয়।
হতে পারে বানিয়ালুলুর ক্ষেত্রে এ রকম নিখুঁত রেট্রো এফেক্ট অর্জন করা সম্ভব হয়েছে ওই একই কালচারাল ডিজইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে মানতে হবে, বানিয়ালুলুকে ফিরিয়ে আনার আর কোনো সুযোগ নেই। দেশটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমরা বড়জোর মার্কিন সাংস্কৃতিক প্রক্ষেপগুলোর মধ্যে বানিয়ালুলুর ডিজইন্টিগ্রেটেড অস্তিত্বের পরোক্ষ কিছু আভাস খুঁজতে পারি মাত্র। এ জন্যে আমাদের পর্যবেক্ষণ শক্তিকে প্রখর ও শাণিত করতে হবে। অনুসন্ধানী চোখে তাকাতে হবে হলিউডের স্টুডিওগুলো থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর কাহিনি ও সংলাপের দিকে, কান পাততে হবে রক-অ্যান্ড-রোলের প্রতিটি ড্রাম বিটের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র অবকাশবিন্দুতে, বার্নস অ্যান্ড নবলের প্রত্যেক তলার প্রতিটি নিউ অ্যারাইভালের প্রতিটি পাতার দুটি লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলোর বিন্যাস লক্ষ করতে হবে এবং এমনকি নিউইয়র্কের প্রতিটি সড়কের ফুটপাতে প্রতিটি ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দেওয়া কফির মগ লক্ষ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা বানিয়ালুলুর খুবই পরোক্ষ উল্লেখের কোনো কোনো আণুবীক্ষণিক টুকরো হয়তো মাঝে মাঝে শনাক্ত করতে সক্ষম হব।
র্যাট স্মেলারের প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। অনেকে তাঁর অনুপস্থিতিকে জবরদস্তিমূলক অন্তর্ধানের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন। তবে আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও দুটি সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেওয়া যাবে না। বানিয়ালুলুর বিবরণ সরবরাহ করতে গিয়ে দেশটির ব্যাপারে ব্যাট স্মেলারের ক্রমবর্ধমান মুগ্ধতা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। হতে পারে, দেশটিতে পাড়ি জমানোর কোনো গোপন সুড়ঙ্গ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। অথবা তিনি আদৌ নিখোঁজই হননি। অজস্র তথ্য আর উল্লেখের মধ্যে বিশ্লিষ্ট হয়ে তিনি হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ম্যানহাটানেরই রাস্তায় রাস্তায়, আমাদের পাশে পাশে।
০২. জাগার বেলা হলো
‘আমি এখন আর কোনো স্বপ্ন দেখি না, লোকটা বলল। এমনভাবে বলল, যেন অভূতপূর্ব কোনো কথা শোনাচ্ছে।
কথাটা বলে একটু দম নিল লোকটা। গভীর আর্তিভরা চোখে তাকাল আমার দিকে। আমার প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়।
আমার কোনো ভাবান্তর হলো না। বললাম, এ যুগে স্বপ্ন দেখা কঠিন। আমাদের কোনো স্বপ্নই তো আর অবশিষ্ট নেই।’ বলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম।
লোকটা আমাকে হতাশ করেছে। আমি আরও চমকপ্রদ কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খুব গুপ্ত, গূঢ় কোনো কথা। এমন কিছু, যা শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে যাবে। কৌতূহল জাগবে। অন্তত আমার সামনে বসার পর লোকটা শুরুতে এ রকমই তো আভাস দিয়েছিল। বলেছিল, অত্যন্ত জটিল আর বিস্ময়কর একটা সমস্যা নিয়ে সে আমার কাছে এসেছে। কিন্তু এখন দেখছি, সে অযুত-সহস্র হতাশাগ্রস্ত মধ্যবয়সীদের একজন। আমিও সে কারণেই তাকে একটা বাজারচলতি কিন্তু অর্থহীন সান্ত্বনাবাক্য বললাম।
‘আমি কিন্তু সে কথা বলিনি। স্বপ্ন দেখি না বলতে আমি বোঝাচ্ছি, আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না। ঘুমের মধ্যে আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না।’
‘স্বপ্ন দেখেন। ঘুম ভেঙে মনে থাকে না যে আপনি স্বপ্ন দেখেছেন।’
‘আমি স্বপ্ন দেখি না,’ লোকটা জোর দিয়ে বলল। খুব জেদি আর গোঁয়ার ভঙ্গি তার গলায়।
‘সেই অর্থে আমরা কিন্তু কেউই স্বপ্ন দেখি না। ঘুম ভাঙার পর স্বপ্ন দেখার একটা ধোয়াটে স্মৃতি কেবল থাকে আমাদের। মানে বলতে চাচ্ছি, স্বপ্ন দেখাটা আসলে স্বপ্ন দেখার একটা স্মৃতিমাত্র, একটা অসম্পূর্ণ ক্ষয়িষ্ণু অপভ্রংশ স্মৃতি।’
আমি খুব দার্শনিক ভঙ্গি করে কথাটা বললাম। লক্ষ রাখলাম, বলার সময় যাতে আমার জ্ঞান আর প্রজ্ঞার ওজন প্রকাশ পায়।
লোকটা একটু বিরক্ত গলায় বলে, ‘আমি স্বপ্ন দেখি না, কেননা আমি ঘুমাই না।’
‘ও, আপনি তাহলে স্লিপ ডিজঅর্ডার নিয়ে এসেছেন! প্যারাসমনিয়া!’’
‘হতে পারে। আমি তো আর এসব শব্দ জানি না।’
কবে থেকে এই সমস্যা?
‘দুই বছর।’
‘মানে কি দুই বছর ধরে আপনি ঘুমান না?’
লোকটা মাথা নাড়ে। সে এবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে।
‘আপনি শব্দটা কী বললেন যেন, প্যারাসমনিয়া?”
‘হুম।’
‘আমি ইনসমনিয়া শব্দটা শুনেছি। এটা শুনিনি।’
‘শব্দ জানা জরুরি নয়। আপনি দুই বছর ধরে ঘুমান না?’
‘হ্যাঁ।’
‘সর্বনাশ। আপনি মারা যাবেন তো!’
লোকটা চুপ করে থাকে। ‘সমস্যা হয় না? ক্লান্তি?’
‘না, হয় না।’
হওয়ার কথা। ঘুমের ঘাটতি হলে প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স আর টেমপোরাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মগজের কতগুলো এলাকা। তখন যুক্তিশৃঙ্খল এলোমেলো হয়ে যায়, চিন্তাশক্তি কমে। যায়, কথাবার্তাও অসংলগ্ন হয়ে যায়।’
লোকটা মাথা নিচু করে থাকে। যেন বাধ্য ছাত্র, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া নিচ্ছে।
‘আপনি কোনো নিউরোলজিস্টের কাছে গেলে ভালো করবেন। এটা একটা নিউরোলজিক্যাল সমস্যা। আমি একজন সাইকোলজিস্ট। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি আমার বিদ্যা। আমার কারবার মন নিয়ে। আপনি আমার কাছে খামোখা এসেছেন।’
‘যাব,’ লোকটা অলসভাবে বলে।
মনে হলো, লোকটা এবার উঠবে। উঠুক। আমারও তাড়া আছে। অ্যাসিসট্যান্ট ছেলেটাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। আমিও এখনই উঠব। তার আগে ড্রাইভারকে ফোন দিতে হবে। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই।
আমার এই ভঙ্গি দেখে লোকটা উঠে দাঁড়ায়।
আমি বলি, ‘আচ্ছা, একটা কথা। আপনি ঘুমের সমস্যা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু শুরুটা করলেন স্বপ্নের কথা বলে। কেন?’
‘মানে?’
‘মানে আপনি “ঘুমান না” না-বলে বললেন, আপনি “স্বপ্ন দেখেন না”। কেন?’
লোকটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেন একটা ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে সে আবার বসে পড়ে। এই সেরেছে, রে।
‘আমি তো সেই কথাটাই বলতে এসেছি। আপনি প্লিজ মনোযোগ দিয়ে আমার কথাটা শুনুন। প্লিজ।’
‘শুনব। কথা শোনাই আমাদের কাজ। কিন্তু আপনি কি সংক্ষেপে বলতে পারবেন? মানে আমার একটু তাড়া আছে।’
‘আমি খুবই সংক্ষেপে বলব। আপনি প্লিজ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।’
লোকটা নড়েচড়ে বসে। আমি তার মধ্যে কোনো তাড়া দেখি না। এ লোক সংক্ষেপে বলবে না।
‘আপনি একটু আগে বললেন না নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে?’
‘বলেছি।’
‘ইনফ্যাক্ট ঢাকা শহরে এমন কোনো নিউরোলজিস্ট নেই, আমি যার কাছে যাইনি। গত দুই বছর ধরে এমন কোনো ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা নেই, আমাকে করানো হয়নি। কিছুই ধরা পড়েনি। কত রকম যে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি।’
আমি চুপ করে থাকি।
‘আমি নিজে অনেক চিন্তা করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, সমস্যাটা কোথায়। অনেক ভেবে…অনেক ভেবে…বুঝেছেন… অনেক চিন্তাভাবনা করে অবশেষে আমি বের করে ফেলেছি, কেন আমার ঘুম হয় না।’
এটুকু বলে লোকটা থামে। থেমেই থাকে।
লোকটা আমার কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন আশা করছে।
আমি বলি, “তা, কেন ঘুম হয় না?’
লোকটা সামনে ঝুঁকে আসে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভারি নিশ্বাস পড়ছে। অত্যন্ত নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে লোকটা বলে, ‘আমার ঘুম হয় না, কারণ আমি আসলে ঘুমিয়ে আছি।’
বলেই লোকটা সোজা হয়ে বসে। পায়ের ভর পরিবর্তন করে। বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে।
আমি কিছু বলি না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি ঘড়ির ডায়ালের দিকে। সেকেন্ডের কাটাটা টিকটিক করে এগোচ্ছে।
‘আপনি কি কাল আবার আসতে পারবেন?’
‘আমি আর সামান্য কয়েকটা মিনিট সময় নেব। প্লিজ, আমাকে পুরোটা বলতে দিন।’
‘বলুন।’
‘আমি অনেক ভেবে দেখলাম, যে লোক ঘুমিয়ে আছে, সে আর ঘুমাবে কী করে! তার পক্ষে তো আর ঘুমানো সম্ভব নয়।’
‘ঠিক কথা। তাহলে আপনি ঘুমিয়ে আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
‘ঘুমিয়ে কথা বলছি না। আমি আসলে কথাই বলছি না। আমি স্বপ্ন দেখছি।’
‘দুর্দান্ত বলেছেন! আপনি স্বপ্নে দেখছেন যে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ। আমি আসলে একটা দীর্ঘ স্বপ্নের ভেতর আছি।’
‘আর এ কারণেই আপনি কোনো স্বপ্ন দেখেন না?’
‘ইয়েস।’
‘দারুণ! দারুণ!’ আমি এবার ঘর কাঁপিয়ে হো-হো করে হেসে উঠি।
আমার এই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত প্রতিক্রিয়া দেখে লোকটা অপ্রতিভ ভঙ্গিতে বসে থাকে।
‘আপনি স্বপ্নে দেখছেন যে আপনি এই মুহূর্তে এই ঘরে বসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
লোকটা চুপ করে থাকে।
‘তার মানে এই ঘরটা, এই যে টেবিল, এই যে ফুলদানি, ওই যে জানালা, জানালার পর্দা…দেয়ালে ক্যালেন্ডার, ক্যালেন্ডারের পাশে টিকটিকি…এগুলো…এই পুরা জগৎটা আপনার স্বপ্ন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার মানে আপনার সামনে এই যে আমি বসে আছি, আমার কোনো অস্তিত্ব নাই? আমিও আপনার স্বপ্ন?’
লোকটা মাথা নিচু করে। যেন আমাকে স্বপ্নে পর্যবসিত করায় সে কিছুটা বিব্রত, লজ্জিত।
আমি বলি, ‘হুম। ইন্টারেস্টিং। কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। কিন্তু দয়া করে বলবেন কি, ঠিক কী কারণে আপনার এই কথা মনে হলো? মানে আপনি কীভাবে এই সিদ্ধান্তে এলেন?
‘আমি পুরোটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেব। আপনি একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন আমার কথা।’
‘অবশ্যই শুনব। আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছে। আপনি সময় নিয়ে বলুন।’
‘আমাকে পাগল মনে হচ্ছে আপনার, তাই না?’’
‘মোটেই না। এক্কেবারে না। আপনি আমার কাছে এসেছেন। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনছি। আপনার প্রতিটি কথা আমি বিবেচনা করছি, আমার মতো করে।’
আমি উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। কাঁচের ওপারে নিচে রাতের শহর। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো কেমন ঝাপসা, ল্যাপটানো। গাড়ির হেডলাইটের আলো পিছলে যাচ্ছে রাস্তার পিচে।
‘আপনি কি কিছু খাবেন, চা, কফি?’
‘কফি দিতে পারেন।’
আমি কফি বানাই। মগটা তার হাতে দিয়ে আমার চেয়ারে বসি।
‘আপনি ম্যাট্রিক্স দেখেছেন?’
লোকটা কী যেন ভাবছিল। আমার প্রশ্নে চমক ভাঙে।
‘না। কী সেটা?’
‘একটা সিনেমা।’
‘ওহ।’
আমি আয়েশ করে বসে কফিতে চুমুক দিই, ‘এবার বলুন।’
‘কী বলব?’
‘বলুন, কীভাবে এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে এলেন যে, আপনি আসলে স্বপ্ন দেখছেন, দীর্ঘ একটা স্বপ্ন?’
‘বলছি,’ লোকটাও আয়েশ করে বসে। আমি ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি, ফার্স্ট অফিসার পদে। ছোট পোষ্ট। কাজ বেশি। থাকি পলাশীতে স্টাফ কোয়ার্টারে। বছর দুয়েক কি তারও বেশি আগের ঘটনা। আমার অফিসে একটা আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। অনেক হইচই। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক যেটা, তদন্তে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অথচ এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ নেই আমার। ব্যাপারটা আমার জন্য বিপর্যয়কর। আমি প্রচণ্ড মানসিক শক পাই। আমার শোবার ঘরের ড্রয়ারে দু-পাতা ইনকটিন ছিল।’
‘ঘুমের ওষুধ?
‘হুম। আমি চল্লিশটা হাই পাওয়ার্ড ঘুমের বড়ি একসঙ্গে খেয়ে ফেলি।’
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘আমি বেঁচে যাই। অচেতন অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ওয়াশ-টোয়াশ করানো হয়। সতেরো দিন পর আমার ঘুম ভাঙে। মানে এগুলো পরে জেনেছি আমি। আমাকে বলা হয়েছে।’
‘ও, আচ্ছা।’
‘বেশ কিছুদিন খুব দুর্বল কাটে। হরলিক্স, ফলমূল খাওয়ানো হয়। ধীরে ধীরে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। অফিসও শুরু করি। কিন্তু অফিসে গিয়ে দেখি, কেউ আর ওই কেলেঙ্কারি বা তদন্তের কথাটা বলে না। আমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। আমি একটু অবাক হই। ভাবি, আমার আত্মহত্যার চেষ্টার কারণে সবাই এখন এগুলো লুকানোর চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়ে শুনি যে এ রকম কোনো তদন্তই নাকি কখনো হয়নি। একটু খটকা লাগে। তবে ভাবি, এটাও আমাকে বিব্রত না করার একটা কৌশলমাত্র। আমি আর এটা নিয়ে ভাবব না বলে ঠিক করি। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। কোথাও কোনো ঘাপলা নেই, কোনো গড়বড় নেই। শুধু একটাই সমস্যা। ইনসমনিয়া। আমার ঘুম হয় না। কিছুতেই না। এক ফোঁটা ঘুম হয় না। ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার প্রথমে বলে, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার রিঅ্যাকশন। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয় না। আমি সারাক্ষণ জেগে থাকি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে বারান্দায় পায়চারি করে কাটাই। ঘুম নেই, ঘুমহীনতার কোনো ক্লান্তিও নেই। ফলে খুব বেশি চিন্তিত হই না। সপ্তাহ দুয়েক পরে একটা ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করে দেয়।’
লোকটা আবারও চুপ করে আমার কাছ থেকে একটা প্রশ্ন আশা করতে থাকে।
‘কী সেটা?’
‘আমি বাসা থেকে অফিসে যাতায়াত করি পাবলিক বাসে। আমাদের অফিসের একটা পিক-ড্রপ বাস আছে বটে। কিন্তু সেটা আমার রুটে পড়ে না। ফলে আমি পলাশী মোড় থেকে একুশ নম্বর বাসে চড়ি। সেটা মৎস্য ভবনে আমার অফিসের সামনেই আমাকে নামিয়ে দেয়। যে দিনকার ঘটনার কথা বলছি, সেটা ছিল রবিবার। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছি। মাঝখানের আইলে হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। বাসে ঠাসাঠাসি ভিড়। বাস কোন দিকে যাচ্ছে, বোঝা যায় না। তবে কন্ডাক্টরের ঘোষণা আর বাসের মোচড় নেওয়া গুনে বলে দেওয়া যায়, কখন কোন রাস্তায় আছি। একসময় আমার গন্তব্য চলে আসে। আমি খুব কষ্টে দরজার দিকে এগিয়ে যাই। “স্যার বাম পা আগে ফেইলেন,” কন্ডাক্টর সতর্ক করে দেয়। আমি বাম পা আগে ফেলে নামি। কিন্তু নেমেই থ হয়ে যাই। কোথায় মৎস্য ভবন, কোথায় কী! আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। যে বাহনটা থেকে নামলাম, সেটা একটা ট্রেন, সবুজ রঙের বগি। আর সেটা এখনো প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছে। একটা ভোজবাজির মতো আমার চারপাশের জগৎটাকে কেউ বদলে ফেলেছে, বদলে মৎস্য ভবনের জায়গায় একটা রেলস্টেশন বসিয়ে দিয়েছে। আমার পাশ ঘেঁষে লোকজন ট্রেনে উঠছে, নামছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম। আমার হাতে একটা নীল ট্রাভেল ব্যাগ। আমার পাশে আমার স্ত্রী। সে ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। “কী ব্যাপার?” স্ত্রী জিজ্ঞেস করে। আমি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলি না। যখন ঘোরটা একটু কাটে, তখন জিজ্ঞেস করি, “এটা কোথায়?” স্ত্রী অবাক হয়। “কী ব্যাপার, তোমার কি অসুস্থ লাগছে?” আমি প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চে বসে পড়ি। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, এটা ঢাকা-নাটোর রেললাইনের একটা ছোট্ট স্টেশন, নাম ইদ্রিসপুর। আমরা এসেছি আমাদের এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে। আমি তাকিয়ে দেখলাম, এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ব্যাপারটা কীভাবে ঘটল, কেন ঘটল–আমি কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না।’
‘খুব সহজ। মেমোরি লস।’
‘আমিও সেটাই ভাবি। মানে, ব্যাপারটা এমন যে রবিবার সকালে আমার অফিসের উদ্দেশে বেরোনো আর সেই অচেনা প্ল্যাটফর্মে নামার মধ্যবর্তী পুরো সময়ের স্মৃতি মুছে গেছে আমার মাথা থেকে। তা-ই তো?”
‘হ্যাঁ। তা-ই।’
‘মেমোরি লস। ইনসমনিয়ার সাইড-এফেক্ট। সেটাই হওয়ার কথা। আর কীই-বা ব্যাখ্যা হতে পারে। এরপর নিয়মিতই এইসব টুকটাক মেমোরি লসের ঘটনা ঘটতে থাকল। ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর। জানেন, মাঝে মাঝে তো খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে হয়। তবে আমি এই পরিস্থিতির সঙ্গেও মানিয়ে নিতে শুরু করলাম একসময়। চিকিৎসকেরাও সে রকমই পরামর্শ দিল। তবে মুশকিল কী জানেন, ওর মধ্যেও আমি আরেকটা খটকার ব্যাপার খুঁজে পেলাম। যতই মেমোরি লসের ঘটনা ঘটুক, ক্যালেন্ডারের পাতা তো ঠিক থাকবে, তাই না? সময় তো একমুখী এগোবে। মানে, প্রতিবার মেমোরি লস করলে আমি নিজেকে ওই সময়ের পরের সময়ে আবিষ্কার করব। মানে ধরুন, রোববার মেমোরি লস করে আমি নিজেকে সোমবার বা মঙ্গলবারে গিয়ে আবিষ্কার করব। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম, সব সময় এটা ঘটছে না। মাঝে মাঝে সময় উল্টো দিকে যাচ্ছে। মানে ধরুন, রোববারের পরমুহূর্তে আমি নিজেকে আগের দিন শনিবার বা তার আগের দিন শুক্রবারে আবিষ্কার করছি। এটা হওয়ার কথা না।’
এগুলোও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এ থেকে কোনোভাবেই এমন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় যে….মানে ওই যে, যে-সিদ্ধান্তে আপনি। এসেছেন আরকি…..
‘আমি জানি। এগুলো থেকে কোনোভাবেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু আমি সবটা তো বলিনি এখনো। এরপর আমার জীবনে আরও গভীর কিছু জটিলতা দেখা দিতে শুরু করল। এমন কিছু জটিলতা, যেগুলো একেবারে হতবুদ্ধি করে দেয়।’
‘যেমন?’
যেমন ধরুন, মাসুদ এসে একদিন উপস্থিত হলো আমাদের বাসায়।’ বলে লোকটা চুপ করে গেল। যেন এটুকু বললেই আমি বুঝে যাব ঘটনার জটিলতা। )
‘মাসুদ কে?’
‘মাসুদ আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসমেট। কলেজ জীবন শেষে সে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। সেখানেই বসবাস করে। মাঝে মাঝে ফোন দেয়।’
‘তো মাসুদ এলে সমস্যাটা কী?’
‘সমস্যাটা হলো, আমাদের বাসায় এসে উঠল প্রাইমারি স্কুলের মাসুদ। ক্লাস ফোরে পড়া মাসুদ। হাফপ্যান্ট পরা। বয়স নয় কী দশ বছর।’
‘মাই গড।’
‘সে এসে আমার সঙ্গে থাকছে। আমার সঙ্গে এক টেবিলে খাচ্ছে। গল্পগুজব করছে। যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে অস্ট্রেলিয়ার মাসুদ ফোন করে। চিন্তা করুন দৃশ্যটা। আমি কথা বলছি আমার সমবয়সী ক্লাসমেট মাসুদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। ঠিক সে সময় দশ-বারো বছরের ওই মাসুদই আমার সামনে দুষ্টুমি করছে। এ রকম একের পর এক জটিল সব ঘটনা আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিতে শুরু করল। আমি যুক্তিবাদী মানুষ। কিন্তু এগুলোর কোনো মাথামুণ্ডু পাই না।’
আমার কফি শেষ হয়ে গেছে। মগটা নামিয়ে রাখলাম।
‘তবু বলব, এ থেকে প্রমাণ হয় না আপনি স্বপ্ন দেখছেন।’
‘সারা রাত আলো নিভিয়ে আমি বারান্দায় পায়চারি করি। ওখানে একটা বেতের সোফা আছে। তাতে বসে থাকি। মাঝে মাঝে আমি কান পাতলে কিছু কথোপকথন শুনি। অস্পষ্ট। তবে ভালো করে শুনলে বোঝা যায়। একদল লোক কথা বলছে। আমার মাথার ভেতরেই যেন কথা বলছে তারা।’
‘কী বলছে?’
‘সব কথা বুঝতে পারি না। দুয়েকটা শব্দ বা বাক্যের খণ্ডাংশ কানে আসে। “ঘুম” “স্বপ্ন”–এই সব শব্দ কানে আসে। মনে হয়, লোকগুলো আমাকে ঘিরে আছে। আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। একদিন একটা লোক আরেকটা লোককে জিজ্ঞেস করল, ‘এভাবে কত দিন ঘুমাবে?’ আমি টের পাই..কীভাবে টের পাই–জানি না, তবে টের পাই, এরা কেউ কেউ চিকিৎসক। আমি কোনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। এবং ঘুমিয়ে আছি। গভীর ঘুম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নটা পাতলা হয়ে গেলে, মানে ঘুমটা পাতলা হয়ে গেলে আমি চারপাশের সত্যিকার জগতের কিছু শব্দ শুনতে পাই। মানে, ওই যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমি অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম, সম্ভবত কোমায় চলে গেছি, এরপর আর ঘুম ভাঙেনি আমার। আমি হাসপাতালে অথবা নিজের বাসার বিছানায় ঘুমিয়ে আছি। এইটাই সবকিছুর একমাত্র ব্যাখ্যা।’
লোকটা দম নেয়। কফির মগ রেখে পেছনে গা এলিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে সে যেন কিছুটা ক্লান্ত। প্রশ্নবোধক দষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি গলা খাঁকারি দিই। চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নিচে রাতের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এখনো ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে।
‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। এই জগক্টা ইস্যুশন নয়। খুব সহজ কয়েকটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন।
লোকটা অপেক্ষা করে।
‘অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া।’
‘মানে?’
‘আপনিই বলুন, কী মানে শব্দটার।’
‘আমি জানি না।’
‘অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া হলো এক বিশেষ ধরনের কালার ব্লাইন্ডনেস। এটা হলে লোকে কিছু বিশেষ কালার বা রং পিরসিভ করতে পারে না।’
‘কিন্তু এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’
‘সম্পর্ক নেই। আমি সেটাই তো বলছি। সম্পর্ক নেই। কথা হলো অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া শব্দটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটা জটিল। জারগন। আপনার এই শব্দ জানার কিংবা এর আগে শোনার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। তাহলে যে স্বপ্ন আপনি দেখছেন, সেই স্বপ্নের ভেতর এই শব্দটা উচ্চারিত হবে না, তাই না? অথচ দেখুন আপনার সামনে এই শব্দটা আমি উচ্চারণ করছি, করেই যাচ্ছি–অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া, অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া, অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া…’
আমি তোতাপাখির মতো শব্দটা বলতে থাকি।
লোকটা চুপ করে বসে থাকে।
‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন মানেই হলো আমি আপনার স্বপ্নের একটা উপাদানমাত্র। মানে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি এই ঘরে আসার আগে আমার অস্তিত্ব ছিল না। আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তাহলে আমার কোনো স্মৃতি থাকার কথা নয়। কিন্তু ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, গত ৪২ বছরের প্রায় পুরোটা স্মৃতি আমার মনে আছে। আমার এই মোবাইল ফোনে প্রায় সাড়ে চারশ নম্বর সেভ করা আছে। তারা আমার বন্ধু, পরিচিত। আপনি তাদের কারও নাম জানেন না, শোনেননি। আমার স্ত্রী এ মুহূর্তে এখান থেকে দেড় মাইল দূরে একটা সিনেমা হলের সামনে দুটি টিকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনি। এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র তারা সবাই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না।’
‘যাবে,’ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটা একরোখার মতো বলল।
‘আচ্ছা, আমি আপনাকে আরেকটা ব্যাখ্যা দিই। খুব সহজ, সাধারণ ব্যাখ্যা। ধরে নিলাম এই জগৎটা আসলে আপনার একটা কল্পনামাত্র, একটা ইস্যুশন, একটা কল্পলোক। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, কী ভীষণ ডিটেইল এই জগৎটা। এখানকার প্রতিটি জিনিস, প্রতিটা বস্তু অসম্ভব পুঙ্খানুপুঙ্খ। এই যে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। লক্ষ-কোটি বৃষ্টির ফোঁটা আলাদা-আলাদাভাবে পড়ছে, তার প্রতিটি আপনাকে আলাদাভাবে কল্পনা করতে হচ্ছে। সম্ভব? এই জানালার পর্দাটার দিকে তাকান। প্রতিটি সুতা আলাদাভাবে বোনা। সম্ভব?’
লোকটা চুপ করে থাকে।
আমার একটু একটু করে জেদ চাপছে।
‘আচ্ছা, চিন্তা করে দেখেছেন, আপনার এই কল্পজগৎ সব সময় পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম নিখুঁতভাবে মেনে চলছে। নিউটনের বলবিদ্যা মানছে, থার্মোডাইনামিক্সের সব নিয়ম মানছে, ম্যাক্সওয়েল মানছে, আপনি যেসব নিয়ম-সূত্র এখনো জানেন না, সেগুলোও সবই মানছে। কেন মানছে?’
‘জানি না কেন মানছে।’
‘এই যে এখানে এই কাঠের পেপার ওয়েট। এটা আমি গত বৈশাখি মেলায় কিনেছি। এটা এই যে হাতে তুলে নিলাম। এখন আমি যদি এটা ছেড়ে দিই, এটা ভেসে থাকবে না। মাটিতে পড়ে যাবে। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মানবে এটা। আপনার কথা অনুযায়ী, এটা তো বস্তু নয়, একটা স্বপ্নের উপাদান। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মানার কোনো বাধ্যবাধকতা তো নেই এটার। আছে? এই যে দেখুন। লক্ষ করুন।’
আমি পেপার ওয়েটটা ছেড়ে দিলাম। ঠকাস শব্দে সেটা মেঝেতে পড়ে গেল।
লোকটা চমকে উঠল। আমিও একটু চমকালাম। টের পেলাম আমি কিছুটা বেপরোয়া আচরণ করছি। পেপার ওয়েট তুলে আমি টেবিলে রেখে দিলাম।
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আমি কি এখন উঠব?’
‘হ্যাঁ। উঠবেন। আমার আসলেই তাড়া আছে। তবে আপনি কাল আবার আসবেন। আমার মনে হয়, আমাকে দরকার হবে আপনার।
‘নিউরোলজিস্টের কাছে যাব না?’ লোকটার কণ্ঠে কোথায় যেন একটা কৌতুক।
‘না, যাবেন না। আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন।’
লোকটা ওঠে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমরা হ্যান্ডশেক করি।
‘আমি অপেক্ষা করব। সিরিয়াল দিতে হবে না। আমি বলে রাখব। আসবেন, কেননা আপনি চলে গেলেও কিন্তু এই ঘরটা এ রকমই থাকবে।’
লোকটা দরজার দিকে পা বাড়ায়।
‘আপনি ছাতা এনেছেন?’
‘না।’
‘বাইরে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘আমি ভিজব না,’ বলল লোকটা, ঠোঁটে এমন এক লুকানো কৌতুক নিয়ে বলল, যেন কথাটার মধ্যে গভীর কোনো তাৎপর্য আছে।
লোকটা দরজার হাতলে হাত রেখেছে।
একবার, সেকেন্ডের একটা ভগ্নাংশের তরে মনে হলো আমার মনের কোথাও কেউ যেন খুব করে চাইছে, লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে না যাক। লোকটা যাওয়ামাত্র কোথাও কিছু একটা বদলে যাবে।
লোকটা চলে গেল।
এতক্ষণে সিনেমা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আমি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। ড্রাইভারকে ফোন দিচ্ছি। ধরে না। গাড়ির ভেতর। ঘুমিয়ে গেছে বোধ হয়।
আমি দ্রুত ব্যাগটা কাঁধে নাই।
দরজার দিকে পা বাড়াই।
এ সময় একটা ঘটনা ঘটে।
আমার ব্যাগের একটা প্রান্ত গিয়ে লাগে টেবিলের ওপর রাখা পেপার ওয়েটের গায়ে। পেপার ওয়েটটা টেবিল থেকে গড়িয়ে যায়।
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
টেবিলের প্রান্ত পেরিয়ে গেলেও পেপার ওয়েটটা মেঝেতে পড়েনি।
কোনো অবলম্বন ছাড়া সেটা শূন্যে ভেসে আছে।
০৩. দুই শিল্পী
আমরা দুজন মিলে একটা ছবি আঁকছি। একটা ক্যানভাসে। আমরা দুই শিল্পী। আমাদের মধ্যে অমিলের শেষ নেই। দুটি ভিন্ন জগতে আমাদের অবস্থান। দুটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কারণ, দুটি মহাবিশ্বের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কোনো এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে না দুই জগতের মধ্যে। কোনো টেলিযোগাযোগব্যবস্থা নেই। কোনো ধরনের যোগাযোগ কোনো দিন সম্ভবও না।
আমার মহাবিশ্বটা এগারো মাত্রার। অপরটা কত মাত্রার, আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, ছবি আঁকার এই ক্যানভাস ছাড়া দুটি জগতের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। এই ক্যানভাস যেনবা একটা সুড়ঙ্গ, একটা রঞ্জু, দুটি জগৎকে যা বেঁধে রেখেছে। বেঁধে না রাখলে জগৎ দুটি ভেসে আরও দূরে দূরে চলে যেত কি না, আমি জানি না। কেননা অপর জগৎ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কেউই কিছু জানে না। কিছু জানা সম্ভবও নয়। আমাদের সকল বিবরণ কেবল আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য।
আমি শুধু এটুকু জানি, আমার স্টুডিওর একটা বিশেষ ক্যানভাসের তলে দুটি সমান্তরাল জগৎ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। এ যেন দুই যমজের জন্মমুহুতের নাভিরজ্জ্ব বা অ্যাম্বিলিকাল কর্ড। কিন্তু এই নাভির মধ্য দিয়ে কিছুই বাহিত হয় না, কিছু রঞ্জক পদার্থ বা পিগমেন্ট আর কিছু অবয়ব ছাড়া।
দেখতে অতি সাধারণ, অতি তুচ্ছ একটা ছবি আঁকার ক্যানভাস। আয়তাকার। আকারে খুব বড়ও নয়। তিন ফুট বাই সাড়ে চার ফুট। আমার স্টুডিওর বেশির ভাগ ক্যানভাসই তা-ই। বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে পারি না আমি।
কেরোসিন কাঠের ফ্রেমের ওপর মোটা মার্কিন কাপড় মুড়ে বানানো ক্যানভাসটাকে আলাদা করার জো নেই। কাপড়ের ওপর দু-দফায় সাদা কোটিং দেওয়া হয়েছে। সবগুলোতেই দেওয়া হয়। সেই একই দোকান থেকে এটা কিনেছি আমি, অন্যগুলো যেখান থেকে কেনা।
যেদিন প্রথম তুলি ছোঁয়াই ক্যানভাসে, মাস চারেক আগে, সেদিন এমন না যে আমার মাথায় বিশেষ কোনো চিন্তা কাজ করছিল। আনমনা ছিলাম আমি। একটা ধোঁয়াটে অবয়ব, একটা আকারহীন চিন্তা পাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। কিন্তু ঠিক সেটাকেই যে ক্যানভাসে আকার দেব, এমন ভেবে ঠিক করিনি। প্রথম। কয়েকটা তুলির আঁচড় আমি পরিকল্পনাহীনভাবেই দিই। সেই আঁচড় থেকে জন্ম নিতে থাকে অবয়ব আর চিন্তা আর পরিকল্পনার বীজ। সব সৃজনশীল কাজের বেলাতেই নিশ্চয় তা-ই হয়। শুরুতে সব সৃষ্টি থাকে আকস্মিক, তারপর ধীরে ধীরে পরিকল্পনার পরত পড়তে থাকে তার ওপর। ঢাকা পড়ে যেতে থাকে আকস্মিকতা। একসময় মনে হয়, পুরোটাই পূর্বনির্ধারিত।
আমি সাধারণত তেলরঙে আঁকি। অ্যাক্রিলিক ছুঁয়েও দেখি না। তেলরঙে আঁকার নানান ঝক্কি, নানান প্রস্তুতি। রঙের পিগমেন্টের সঙ্গে তাৰ্পিন তেল, লিনসিড অয়েল মেশাও। এক পরত রং চড়ালে সেটা শুকানোর জন্য অপেক্ষা করো। এভাবে অতি ধীরে, একটু একটু করে ক্যানভাসে যা ফুটে ওঠে, সকলে তাকে বলে ছবি। আমি বলি, এটা একটা ধারণা।
আমার ক্যানভাসে আরেকজন কেউ আঁকছে–এটা বুঝতে আমার কয়েক দিন সময় লেগে গেছে। আমি আত্মভোলা, তন্ময় ধরনের শিল্পী না হলে হয়তো আরও আগে টের পাওয়া যেত। প্রথম দিকটায় কেমন একটা ভৌতিক গা ছমছম করা অনুভূতি হয়েছিল। কোথাও একটা কিছু যে ঠিক নেই, এটা সবার আগে। টের পেয়েছিল আমার ঘ্রাণশক্তি। ছবি আঁকার সময় বিশেষ করে তাৰ্পিন তেলের গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে। একটা ঝাঁজালো গন্ধের নেশায় আচ্ছন্ন থাকি সারাক্ষণ। কিন্তু সেবার ছবি আঁকা শুরুর দ্বিতীয় দিন থেকে তাৰ্পিন তেলের সঙ্গে আরেকটা কিছুর গন্ধ পেতে শুরু করি আমি। সেটাও ঝাঁজালো গন্ধই, তবে একেবারে অন্য রকম। কোনো চেনা গন্ধের সঙ্গে সেটার কোনো মিল নেই। একটা বুনো ফুলের গন্ধ যেন। তবে ফুলের গন্ধ যেমন স্নিগ্ধ, নরম হয়, সে রকম নয়। উগ্র গন্ধ। ভেবেছিলাম, বাইরে থেকে হয়তো বাতাসে ভেসে আসছে কোনো শিল্পকারখানার গ্যাসীয় অধঃক্ষেপ। জানালা বন্ধ করার পর গন্ধটা আরও বেড়ে যায়। টের পাই, এর উৎস ঘরের ভেতরেই কোথাও। আরও ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি, ক্যানভাসের ভেতর থেকেই আসছে এই গন্ধটা। ক্যানভাসের রঙের পিগমেন্টের ভেতর থেকে।
দ্বিতীয় যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলাম, তা হলো ক্যানভাসে রঙের বদলে যাওয়া। আমি এক রং ক্যানভাসে চাপিয়ে ঘুমাতে যাই। পরদিন ঘুম থেকে এসে দেখি রং বদলে গেছে। আগের দিন হয়তো সবুজ রং চড়িয়েছি, পরদিন এসে দেখি সেটা বেগুনি বা ভায়োলেট হয়ে আছে। ভার্মিলিয়ন রেড বদলে হয়ে যাচ্ছিল। কোবাল্ট রু। কখনো কখনো আমার চোখের সামনেই রং বদলে যাচ্ছিল। প্রথমটায় ভেবেছিলাম, আমি বোধ হয় বর্ণান্ধতা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু চোখের ডাক্তার। সে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল। চোখ ঠিকই আছে।
সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এল ক্যানভাসে অবয়বগুলোর আকার বদলে যাওয়ার ধরন দেখে। ক্যানভাসে আমি কোনো বৃত্ত আঁকতে পারছিলাম না। যখনই কোনো বৃত্ত আঁকছি, সেটা কখনো উপবৃত্তের আকার নিচ্ছে, কখনো হয়ে যাচ্ছে অধিবৃত্ত বা পরাবৃত্ত। কোনো সরল রেখাও আঁকতে পারছিলাম না আমি। সেগুলো ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল। তখনো এ সবকিছুকে আমার কোনো জটিল স্নায়বিক রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখছিলাম আমি। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলাম। তখনো টের পাইনি, নিরীহ এই ক্যানভাসের অতিনিরীহ উপরিতল আসলে দুটি ভিন্ন মহাবিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকে ধারণ করে আছে। যেকোনো জ্যামিতিক অবয়ব বা যেকোনো রঙের পিগমেন্ট এখানে প্রবেশ করামাত্র স্থানের জটিল কাঠামো তাকে শুষে নিচ্ছে নিজের মধ্যে।
সপ্তম দিন আমি একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে যাই, এই ক্যানভাসে অন্য কেউ আঁকছে। একই সঙ্গে। আর সেই শিল্পী আমাদের মহাবিশ্বের বাসিন্দা নয়। স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই, আমার একার পক্ষে এ রকম উন্মাদ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনো দিনই সম্ভব ছিল না। এ কাজে আমাকে প্রভাবিত করেছে আমার এক খ্যাপাটে বন্ধু। বন্ধুটি গণিতের অধ্যাপক। বদমেজাজ ছাড়াও একাডেমিক চক্রে তার আরও নানা রকম কুখ্যাতি আছে। একদিন সে যখন আমার বাসায় বেড়াতে এল, কথাচ্ছলে ক্যানভাসের এই বিদঘুঁটে ভৌতিক আচরণের কথা আমি তাকে বলেছিলাম, আর সে তখন এসে দাঁড়িয়েছিল এই ক্যানভাসের সামনে। ইজেলে হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাসের দিকে সে চোখ কুঁচকে এমন করে তাকিয়ে ছিল, ঠিক যেমন করে লাল একফালি কাপড় হাতে মাতাদোর তাকিয়ে থাকে মাথা নিচু করা ষাড়ের দিকে।
দুটি মহাবিশ্বের পরস্পর মিথস্ক্রিয়ার গাণিতিক অভিব্যক্তি কেমন হতে পারে, আমার বন্ধু প্রথম দিনই সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতির বিবরণ যে প্রচলিত কোনো গাণিতিক কাঠামো দিয়ে সম্ভব নয়, এর জন্য যে নতুন আর অভিনব এক গাণিতিক কাঠামো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আমি এর কিছুই আসলে ভাবছিলাম না। সম্পর্কহীন দুটি জগতের মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তির বিনিময় কীভাবে সম্ভব–আমি সেই চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলাম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, দুই জগতের মধ্যে অভিজ্ঞতার কোনো অর্থপূর্ণ বিনিময় কোনো দিনও সম্ভব নয়। কেননা, দুটি অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু নেই। বিনিময়ের এই অসম্ভাব্যতার খানিকটা নজির পাওয়া গিয়েছিল আমেরিকার ভূখণ্ডে কলম্বাসের প্রথম পা রাখার সময়।
হতে পারে, ক্যানভাসের এক ক্ষুদ্র অস্থায়ী জানালায় এসে দুটি জগৎ আছড়ে পড়ছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতির অদ্ভুত কৌতুককর দিকটি এ-ই ছিল যে, বিনিময়ের কোনো সম্ভাবনা যদি আদৌ থেকে থাকে, তা বাস্তবায়িত হচ্ছিল দুজন শিল্পীর তুলির ভেতর দিয়ে। আমি নিশ্চিত, চিত্রকলার ইতিহাসে এর আগে আর কখনোই একজন শিল্পীর তুলি এতটা সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠেনি, একজন শিল্পীর কাঁধে কখনোই এতটা মহাজাগতিক দায় এসে চাপেনি এর আগে। টের পেলাম, ক্যানভাসের সঙ্গে উল্লম্বভাবে ধরে রাখা আমার তুলির ওপারেই আরেকটি তুলি একই কৌণিক বিন্যাসে ধরে রাখা আছে। দুটি তুলি এক অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
কিন্তু শিগগিরই বোঝা গেল, এই নাভিরজ্জুর ভেতর দিয়ে অতি সীমিত কিছু নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো কিছুরই বিনিময় সম্ভব নয়। আর সেটাই সম্ভবত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পরিস্থিতি। দুটি জগৎ যখন আপাদমস্তক ভিন্ন কাঠামোয় গড়া হয়, দুটি জগতের অভিজ্ঞতার যখন কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু থাকে না, তখন দুই জগতের মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার বিনিময় ছাড়া আর কীই-বা ঘটা সম্ভব?
আগেই বলেছি, আমার উন্মার্গগামী বন্ধু এই অভিজ্ঞতার গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টায় নিমগ্ন হলো। সে চাইছিল, এর ভেতর দিয়ে অপর মহাবিশ্ব সম্পর্কে যতটা পারা যায়, তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু আমাদের কাঁচামাল বড়ই সীমিত। আর এগুলো থেকে আমরা শেষ পর্যন্ত কোনো বোধগম্য বিবরণে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। অজন্তার মন্দিরগুহায় জ্যাকসন পোলকের চিত্র এঁকে রাখলে একজন পূজারি যেমন শূন্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে, আমাদের অন্তঃসারশূন্য গাণিতিক বিবরণগুলোর দিকেও আমরা তাকিয়ে ছিলাম সেভাবে।
আমি অনুমান করলাম, সমস্যাটা কিছু পরিমাণে ভাষাতাত্ত্বিক হতে পারে, যদিও ভাষাতত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যগুলো সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা ছিল না। আমার অজ্ঞতাই এ ক্ষেত্রে বরং আমাকে সৃজনশীল করে তুলছিল। আমি বললাম, আমাদের পার্থিব ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের নন্দনতাত্ত্বিক নির্মাণের যে সম্পর্ক, সেটার কোনো গাণিতিক কাঠামো যখন দাঁড় করানো যাবে, তখন যেকোনো নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাই গাণিতিক কাঠামোয় রূপান্তরযোগ্য হবে। ভেঙে সহজ করে বললে, ক্যানভাসে ভেসে ওঠা ছবির সঙ্গে তুলি নামক বস্তু আর রঙের পিগমেন্টের নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ককে গাণিতিক কাঠামোয় রূপ দিতে হবে। ছবি একটা চিন্তামাত্র, এটা এক পরিবর্তনশীল অস্থির প্রবাহ, যার ভেতরে অনবরত চিহ্ন আর অর্থের জটিল মিথস্ক্রিয়া চলছে। ছবি নামক এই চিন্তাপ্রবাহের সঙ্গে রঙের পিগমেন্ট, তার্পিন তেল আর ক্যানভাসের সুতার বুননের কোনো না কোনো যোগসূত্র। অবশ্যই আছে, তা যত পরোক্ষই মনে হোক না কেন। সেটাকে গাণিতিক কাঠামোয় রূপান্তর করতে পারলে আমরা সেখান থেকে উল্টো পথে ভিন্ন আরেক ধরনের রঙের পিগমেন্ট, ভিন্ন আরেকটা তুলি আর সেই সঙ্গে সেই তুলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভিন্ন আরেক শিল্পীকে পুনর্নির্মাণ করতে পারব। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা সম্ভব হবে পুরো একটা মহাবিশ্ব, এমন একটা জগৎ–যেটা আমাদের মতো নয়।
ক্যানভাসে তুলি চাপানোর সাড়ে চার মাস পর একদিন টের পেলাম, আমাদের ছবিটি আঁকা হয়ে গেছে। একজন শিল্পী কখন ঠিক করেন, তাঁর শিল্পকর্মটি পরিপূর্ণ হয়েছে, সেটা এক জটিল রহস্য বটে। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে আমি এবং আমরা দুজনেই সম্ভবত একই সময়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই।
ছবিটা শেষ করে আমি ইজেল থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে তাকাই ক্যানভাসের দিকে। আমি নিশ্চিত অপর প্রান্তে, স্থানের জটিল, অপার নদীর ভিন্ন পাড়ে অবস্থানকারী সেই শিল্পীও একইভাবে তাকিয়ে আছে এই ক্যানভাসের দিকে। আমরা কি একই ছবি দেখছি? একই অবয়ব? তারও পাশে কি তাঁর কোনো গণিতবিদ বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে? শিল্প-অভিজ্ঞতার ভিন্ন এক গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করানোর প্রাণান্ত চেষ্টা কি চালিয়ে যাচ্ছে সেই গণিতবিদও? আমরা সফল হইনি, কিন্তু যদি সেই গণিতবিদ সফল হয়ে থাকেন? আমরা কি কোনো দিনও জানতে পারব তাঁর সাফল্যের বার্তা? আমি আমার বসন্তকালীন প্রদর্শনীতে টাঙালাম এই ক্যানভাস। গ্যালারিতে আর দশটা ক্যানভাসের পাশে সাদামাটাভাবেই রাখা হলো এটা। দর্শকেরা যখন এটার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, আমি সাবধানে তাকাচ্ছি তাদের চোখের দিকে, বিস্ময়ের কোনো অচেনা অনুভূতির চিহ্ন খুঁজছি আমি সেখানে। আর তখন নিজের অজান্তে কল্পনা করছি ভিন্ন একটা গ্যালারির কথা, ভিন্ন একসারি দর্শক আর তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা কৌতূহলী অন্য এক শিল্পীর চেহারা।
০৪. ভেতরে আসতে পারি?
আমি এসেছি কমিশন থেকে।
কমিশন মানে?
কমিশন ফর এলিমিনেশন অব জুয়েলটি টুওয়ার্ডস রোবটস। অনেক বড় নাম। সংক্ষেপে কমিশন বললেই সবাই বুঝে যায়। আপনার সময় হবে?
আমি ভালো করে তাকালাম লোকটার দিকে। একটা সানগ্লাস পরে আছে। গায়ে একরঙা টি-শার্ট। বয়স চল্লিশের কোঠায়। কেমন। চালাক চালাক একটা ভাব। দেখে সরকারি লোক মনে হয় না।
বললাম, আমার একটু তাড়া আছে। বের হব।
সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা সময় নেব।
আসুন।
লোকটা ঘরে ঢুকে সোফায় বসল। লক্ষ করলাম, তার হাতে একটা ছোট্ট বাহারি নোটবুক, স্কেচ খাতার মতো দেখতে। সেটা খুলে লোকটা কলম হাতে নিয়ে বসল।
বলুন, কী করতে পারি?
আমি কমিশনের ফিল্ড ইন্সপেকটর। আমাদের কমিশন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার?
সামান্য।
রোবটদের ওপর কোনো নিষ্ঠুরতা, তাদের প্রতি রূঢ় আচরণের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা সেটা ফার্স্ট হ্যান্ড ইন্সপেক্ট করি। কিছু ফর্ম পূরণ। আমাদের জোনাল অফিস একটা রিপোর্ট জেনারেট করে। সেটা কয়েকটা ডিপার্টমেন্টে যায়। এইটাই রুটিন।
কোনো অভিযোগ গেছে?
যায়নি।
তাহলে?
সেটাই খতিয়ে দেখতে এসেছি। কেন যায়নি।
মানে?
আপনি একটা রোবট কমিশন করেছিলেন। মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড বি-টু-সিক্স সিরিজের।
সে তো সতেরো বছর আগের কথা। সেটা এখন আর আমার সঙ্গে নেই।
কিন্তু আপনি সেটা ডিকমিশন করেননি।
করিনি। ভুলে গেছি। তাতে হয়েছেটা কী?
এগুলোকে এখন আর মামুলি গাফিলতি হিসেবে দেখা হয় না। নতুন কিছু আইন-কানুন হয়েছে। রোবটদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারে এখন অনেক কড়াকড়ি। আমাদের কমিশন এখন আর ছোট প্রান্তিক দপ্তর নেই। একটা পূর্ণাঙ্গ সরকারি ডিপার্টমেন্টের অধীনে চলে গেছে।
হুম। শুনেছি সিনেটে নাকি কোটা চাওয়া হচ্ছে। অ্যান্ড্রয়েড কোটা। রোবটরা বসবে সিনেটে! হাস্যরসের একটা সীমা থাকা উচিত।
সিনেটে বসতে দেওয়ার দাবি মানা হয়নি বটে। তবে তাদের জোর আন্দোলন একেবারে বিফলে গেছে, বলা যাবে কি? বিশেষ করে টানা সতেরো দিনের ধর্মঘটের পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত সিনেটের একটা বিশেষ ককাস তো গঠন করতেই হলো। চাকা কিছুটা তো ঘুরেছে। সেটাই বা কম কী! এই ককাস এখন রোবটদের দিকটা দেখাশোনা করে। আমাদের কমিশন তাদের কাছেই জবাবদিহি করে। রিপোর্টের একটা কপি সেখানে যায়।
মানে আপনি এখানে সিনেট কমিটির প্রতিনিধিত্ব করছেন, বলতে চান নাকি?
ঘুরপথে তো তা-ই বটে।
কী সাংঘাতিক। আসল কথায় আসুন।
আপনি একটা মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড কিনেছিলেন।
একবার বলেছেন কথাটা। কিন্তু আপনি সেটা ডিকমিশন করেননি। মানে ফেরত দেননি। অথচ সেটা এখন আর আপনার সঙ্গে নেই।
নেই, হারিয়ে গেছে। কিংবা স্ক্র্যাপ করেছি। কবেকার কথা।
আমাদের মনে হয়েছে, এ ক্ষেত্রে আপনার বিরুদ্ধে আর্টিকেল টোয়েন্টি এইট ট্রিগার করার অবকাশ আছে।
হোয়াট! সেটা আবার কী?
বুঝিয়ে বলছি। টোয়েন্টি এইট আওয়ার ল-এর কথা শুনেছেন? অনেক পুরোনো একটা আইন।
শুনিনি।
১৮৭১ সালে আমেরিকায় রেলওয়ে কোম্পানির জন্যে শুরুতে এই আইনটা তৈরি করা হয়েছিল। রেলের ওয়াগনে পশু পরিবহনের ক্ষেত্রে কতগুলো মান্য নিয়মকানুন। রেলযাত্রা যদি একটানা ২৮ ঘণ্টার বেশি লম্বা হয়, সে ক্ষেত্রে ওয়াগনে পরিবহন করা পশুর কতগুলো বিশেষ যত্ন নিশ্চিত করতে হয়। যেমন ধরা যাক, নির্দিষ্ট একটা সময় পরপর দানাপানি দেওয়া এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর ট্রেন থামিয়ে জানালাগুলো খুলে দেওয়া, যাতে আলো-বাতাস প্রবেশ করে।
রেল কোম্পানির একটা প্রাচীন আইন এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিক?
ওই যে জানালা খুলে দেওয়া, আলো-বাতাস চলাচলের কথা বলা হচ্ছে, ওইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।
বুঝিনি।
বলছি। অ্যান্ড্রয়েড বা রোবটদের অধিকার নিয়ে যখন আইন কানুন তৈরি করা শুরু হলো, তখন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটল। বেশির ভাগ বিধিবিধান ধার করা শুরু হলো উনবিংশ শতাব্দীর পশু অধিকার-সংক্রান্ত আইন-কানুন থেকে। শিল্প বিপ্লবের কারণে উনবিংশ শতকে পশুপাখি আর মানুষের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছিল। ফলে মানবেতর পশুদের অধিকারের দাবি উঠতে শুরু করে। এবার ফিফথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশনের যুগে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এবার পশুদের জায়গায় রোবট বা অ্যান্ড্রয়েড। রোবট অধিকার সংরক্ষণে এযাবকালের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ আর্টিকেল টোয়েন্টি এইট এসেছে রেল ওয়াগনের ওই আইন থেকে।
আমার একটু তাড়া আছে। একটা শোক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। লোকজন অপেক্ষা করছে। আইনের ইতিহাসবিষয়ক ক্লাস লেকচার শোনার মুডে আমি এখন নেই।
জানি। আপনার স্ত্রীর শোক অনুষ্ঠান। অতি সম্প্রতি আপনার যে একটা পারিবারিক ট্রাজেডি ঘটে গেছে, সেটা শুনেছি। আমি সমব্যথী। যে কথা বলছিলাম, আপনি যে বি-টু-সিক্স সিরিজের মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড কমিশন করেছিলেন, সেই সিরিজটার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলোর বাইরের অবয়ব সেকেলে ধাঁচের, একেবারে প্রথম যুগের রোবটদের মতো, যখন রোবটেরা দেখতে রোবটের মতো ছিল। নস্টালজিক লোকেরা এভাবেই চায়। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, সিরিজটা নিঃসঙ্গ বুড়োবুড়িদের জন্য কাস্টমাইজ করা। ফলে এগুলোর মধ্যে বিশেষ কিছু অ্যালগরিদম প্রোগ্রামড় করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, এরা নিঃসঙ্গতা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। নির্জনতা এদের মধ্যে তীব্র সাফোকেশনের অনুভূতি তৈরি করে। আতঙ্কে এরা পাগলের মতো হয়ে যায়। এক ধরনের অ্যাকিউট সাইকোলজিক্যাল ট্রমার ইলেকট্রনিক প্রতিরূপ আরকি। এই বিশেষ সিরিজের আরেকটা চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাকলুফোবিয়া।
সেটা কী জিনিস?
অন্ধকারভীতি। অন্ধকারে এদের দশা যে কী করুণ হয়, চিন্তা করা যায় না! অবর্ণনীয়! বীভৎস!
তো, সমস্যা কী?
সমস্যা হলো, এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলো আপনি জানতেন। ভালো করে জানতেন। কেনার সময় ম্যানুয়েল দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী এক দিনের একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণও আপনাকে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কাছে তথ্য আছে, আপনি আপনার ওই হাইপার-অ্যান্ড্রয়েডটাকে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখতেন।
বাজে কথা।
এবং আপনি সেটাকে একা বাড়িতে তালাবদ্ধ করে রেখে মাঝে মাঝে প্রমোদভ্রমণে বের হতেন। কয়েক দিনের জন্যে। পুরো বাড়িতে একটা মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড একা। এর চেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ আমরা চিন্তা করতে পারি না।
কিন্তু আমি এই সব কেন করব?
করবেন এক ধরনের জুস্যাডিজম থেকে। পশুদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে মর্ষকামী লোক যে কারণে মজা পায়। আপনি এক ধরনের জুস্যাডিস্ট।
ধরুন আমি জুস্যাডিস্ট। কিংবা ব্যাকরণ মেনে যদি বলি, ধরুন আমি রোবো-স্যাডিস্ট। তাতে?
এটা প্রমাণিত হলে আপনার সাজা হবে। নতুন আইন বড় কড়া।
কী সাজা?
আর্টিকেল টোয়েন্টি এইটের সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী, আপনার নামের পাশে লাল কালিতে দাগ পড়ে যাবে। শুধু মেট্রোনোম সিরিজের নয়, ভবিষ্যতে কোনো বর্গের, কোনো সিরিজের, কোনো হাইপার-অ্যান্ড্রয়েডই আপনি আর কমিশন করতে পারবেন না। মোটা অঙ্কের জরিমানাও গুনতে হতে। পারে।
আমার আর্থিক সামর্থ্য সম্পর্কে আপনার ভালো ধারণা নেই। আমি এখন উঠব।
আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি?
কোথায়?
শোক অনুষ্ঠানে?
না। পারেন না। আপনার সঙ্গ আমার অসহ্য লাগছে।
আমার আরও কিছু বলার আছে। সেটা যেতে যেতে বলি?
.
গাড়ি ছুটে চলেছে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে।
আমি পাশে বসা লোকটার কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। লোকটা আবার সেই খাতা খুলে কলম হাতে বসেছে। কিছুই লিখছে না। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এ তো খুবই ভোগাবে দেখছি।
লোকটা বলল, আপনার স্ত্রীর দুর্ঘটনা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
আমি চুপ করে থাকি।
গাড়িটা কি আপনিই চালাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ।
শুনছি এটা নিয়ে এক ধরনের কানাঘুষা শুরু হয়েছে।
কী রকম?
মানে নিন্দুকেরা যা করে আরকি। আপনার তো শত্রুর অভাব নেই। তারাই হয়ত ছড়াচ্ছে।
কী বলে তারা?
বাদ দিন। আমরা ওই রোবটটার প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড সিরিজের?
লোকটা আমার দিকে তাকায়। আমার কণ্ঠস্বরের ঠেসটা ধরতে পেরেছে মনে হলো।
হ্যাঁ। বি-টু-সিক্স সিরিজের। ওটার প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো, তার প্রমাণ আমরা কীভাবে পেলাম, অনুমান করতে পারেন?
পারি। আমার স্ত্রীর ডায়েরি থেকে। ও নিয়মিত ডায়েরি লিখত, আমি জানি।
আপনি বুদ্ধিমান।
একটা মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রেখে লোকটা আবার চুপ করে বসে থাকে। নীরবতা ভাঙতে আমি নিজে বাধ্য হয়ে কথা বলি।
একটা ব্যাপার আমাকে বুঝিয়ে দিন তো, আমার বাসায় একটা অত্যন্ত সেকেলে হাউসহোল্ড রোবটের প্রতি নির্দয় আচরণ করা হতো, তা-ও বছর সতের আগে, এটা প্রমাণ করা আপনার জন্যে এত জরুরি কেন?
আইন-কানুন বদলেছে। অনেক কিছুতে এখন কড়াকড়ি।
বাজে কথা রাখুন। আমি অত গর্দভ না যে কিছুই আঁচ করতে পারব না। আপনি এসেছেন আমার স্ত্রীর মৃত্যুরহস্য তদন্ত করতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আসল কথায় না গিয়ে আপনি গৃহকাজে নিযুক্ত একটা নগণরোবটের কথা বার বার আনছেন কেন।
কারণ আমি যদি প্রমাণ করতে পারি, আপনি রোবটটার প্রতি নির্দয় আচরণ করতেন, জেনেশুনে করতেন, কোনো কারণ ছাড়া শুধু এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পাওয়ার জন্য করতেন, তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে, আপনার স্ত্রীর ওই দুর্ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না। যেটা কানাঘুষা চলছে, সেটাই আসলে ঠিক–আপনি তাকে হত্যা করেছেন।
আমি তাকিয়ে থাকি লোকটার দিকে। নিরীহ লোকটার সাহসের তারিফ করতে হয়।
লোকটা বলল, যোগসূত্রটা ধরতে পারছেন না? আচ্ছা, বঝিয়ে দিচ্ছি। সুয়েতোনিয়াস নামে এক রোমান ইতিহাসবিদ ছিলেন, নাম শুনেছেন?
আবার বক্তৃতা!
উনি ১২ জন রোমান সম্রাটের ওপর একটা বই লিখেছিলেন, নাম দ্য টুয়েলভ সিজারস। সেখানে দোমিন নামে এক সম্রাটের কথা বলা আছে। দোমিতানের একটা খুব বিদঘুঁটে স্বভাব ছিল। তিনি নানা রকম পোকামাকড় ধরতেন। তারপর সুচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেগুলো হত্যা করতেন। দিনের বড় একটা সময় তিনি ব্যয় করতেন এ কাজে।
তো?
গুজব চালু আছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন।
অর্থহীন কথাবার্তা।
এবার আসি আসল কথায়। নতুন ধারার অপরাধবিজ্ঞানের একটা বড় মাথাব্যথা হলো, খুনি ব্যক্তির আচরণের কিছু সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন বের করা, যাতে আগাম ইন্টারভেন করা যায়। এ ক্ষেত্রে হোমিসাইডাল ট্রায়াড় নামে একটা ধারণা অপরাধবিজ্ঞানে প্রায় ধ্রুব সত্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে। এটার আদি নাম ছিল ম্যাকডোনাল্ড ট্রায়াড়। গবেষণা করে দেখা গেছে, বিশেষ তিনটা চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ যদি কারও মধ্যে দেখা যায়, তাহলে একশ ভাগ সম্ভাবনা, লোকটা খুনি হবে। তবে এর জন্যে তিনটা বৈশিষ্ট্যই থাকতে হবে। একটা বা দুটা থাকলে হবে না।
তো, কী সেই তিন বৈশিষ্ট্য?
প্রথমটা হলো, লোকটার তোতলানোর স্বভাব থাকবে। ছোট বেলায় তো বটেই, বড় হয়েও। দ্বিতীয়ত, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি লোকটার থাকবে অন্ধ আকর্ষণ। ছোটবেলায় খেলনা অস্ত্রের প্রতি। বড় হয়ে সত্যিকার আগ্নেয়াস্ত্র। আপনার মধ্যে দুটি লক্ষণই পূর্ণমাত্রায় দেখা গেছে। ম্যাকডোনাল্ড ট্রায়াডের তৃতীয় লক্ষণটি হলো রোবটদের প্রতি নিষ্ঠুরতা। এবং এটা আপনার স্বভাবে আছে বলে আমি আদালতে প্রমাণ করতে পারব।
প্রমাণ হলে?
আদালত আর বাড়তি কোনো প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করবে না। এটা অনেকটা গণিতের মতো। আপনার ফাঁসি হয়ে যাবে। নতুন সাক্ষ্য আইনে এখন ম্যাকডোনাল্ড ট্রায়াডকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এটা অনেকটা মেন্টাল ফিঙ্গারপ্রিন্টের মর্যাদা পায়। বলতে পারেন, এটাই সিনেটের অ্যান্ড্রয়েড ককাসের এযাবকালের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আমি এখন নামব। সামনের ওই মোড়টায় আমাকে নামিয়ে দিলেই চলবে।
শোকসভায় যাবেন না?
মানুষের শোকসভায় অ্যান্ড্রয়েডদের যেতে মানা।
আমি গাড়ি থামাতে বলি। লোকটা নেমে যায়।
তার হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।
০৫. প্রতিদ্বন্দ্বী
১৯৬৮ সালের এক শরতের দুপুরে লাহোর জংশন রেলস্টেশনে পা রেখে আমার মনে হয়েছিল, কবিরা বড় বজ্জাত প্রজাতির। তাদের হৃদয় পঙ্কিল, অস্থিমজ্জা অসুয়াদুষ্ট। এই ধারণা আমি। আজও ত্যাগ করতে পারিনি।
রেলস্টেশনের দুর্গ আকৃতির লাল ইটের ভবনের বাইরে আমাকে স্বাগত জানাতে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে নামকরা কবিদের একজন–সুলতান চুঘতাই। একটা ধূসররঙা মাজদা কাপেলার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকটিকে দেখে অবশ্য বিশ্বাস করা কঠিন ছিল, ইনি উর্দু কবিতায় নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছেন। লোকটি মোটেও সৌম্যকান্তি নন, চেহারা বিশেষত্বহীন। দেখে বোঝার উপায় নেই, এ লোক পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে বনেদি পরিবারগুলোর একটির সন্তান।
সুলতান চুঘতাই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘ওয়েলকাম টু দ্য সিটি অব পোয়েটস।’
কথাটা উনি সম্ভবত বাড়িয়েই বলেছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে লাহোরে উর্দু কবিতার এমন কোনো জোয়ার বইছিল না।
কবিতার সমঝদার আমি কখনো ছিলাম না। আইনকানুন, মামলা-মোকদ্দমা আমার কর্মক্ষেত্র। ঢাকা হাইকোর্টের একজন জাঁদরেল আইনবিদের চেম্বারে নবিশ হিসেবে আমি সবে যোগ দিয়েছি। আমি লাহোরে পা রেখেছি তার সহকারী হিসেবে। সুলতান চুঘতাই চুরির মামলা ঠুকেছেন তাঁর ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী কবি তালাল লুধিয়ানির বিরুদ্ধে।
লাহোরের হাকিম আদালতে চুঘতাই যে অভিযোগ এনেছেন, তা এতই বিস্ফোরক, তখনকার দিনের লাহোর শহর কেঁপে উঠেছিল। অভিযোগ প্লেজিয়ারিজম বা কুম্ভিলকবৃত্তির। লুধিয়ানি চুরি করেছেন চুঘতাইয়ের লেখা।
ওই রাতে পূর্ব লাহোরের সোদিয়াল এলাকায় ভিক্টোরিয়ান কায়দায় বানানো চুঘতাই পরিবারের প্রাসাদোপম বসতবাড়ির ছাদ পর্যন্ত বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরি কক্ষে বসে আমি বললাম, ‘শুনেছি আপনার হাতে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। আদালতে আপনি কিছুই দাঁড় করাতে পারেননি। হাকিম আদালত আপনার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দিয়েছেন। জজকোর্টও।’
কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে চুঘতাই বললেন, ‘হ্যাঁ, দিয়েছেন। তো?’
‘আপনি লাহোর হাইকোর্টে মামলা করেছেন। শুনছি, সেখানেও হারতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ আপনার অভিযোগ একেবারে কাঁচা।’
সে জন্যই তো সুদূর ঢাকা থেকে আইনজীবী আনিয়েছি। আপনার সিনিয়র ব্যারিস্টার আরশাদ আজিজ আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। উনি এত জাদরেল উকিল, পুরো পাকিস্তানে সবাই ওনাকে একনামে চেনে। আমি চেয়েছিলাম উনি নিজে আসুন। এখন যেহেতু উনি আপনাকে পাঠিয়েছেন, ধরে নিচ্ছি বয়সে তরুণ দেখালেও আপনার মধ্যে গুণপনার কমতি নেই। আপনি নিজে প্রমাণ জোগাড় করুন। যে পদক্ষেপ নিতে হয়, নিন।
আপনার কোন কবিতা উনি চুরি করেছেন বলছেন?
‘একটি বা দুটি কবিতা নয়, উনি একের পর এক আমার তিনটি কিতাব মেরে দিয়েছেন।’
পরদিন নাশতার টেবিলে বসে আমি বললাম, ‘লুধিয়ানি আপনার যেসব বই নকল করেছেন বলে আপনি অভিযোগ করেছেন, সেসব বই আপনি আদালতে দাখিল করতে পারেননি, চুঘতাইজি।’
চুঘতাই উদাস গলায় বললেন, ‘পারিনি।’
‘কেন?’
‘কারণ, আমার বই ছাপাই হয়নি।’
‘যে বই ছাপা হয়নি, সেই বই নকল করা হয়েছে–এই অভিযোগ টিকবে?’
‘আমার কাছে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আছে। নিজ হাতে লেখা।’
‘তাতে কী! ডিফেন্স বলবে, লুধিয়ানির ছাপানো বই থেকে আপনি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন।’
‘তা-ই তো বলেছে।’
‘তাহলে আর কী, কেস ফিনিশড। কিছুই করার নেই।’
এই প্রথম ভদ্রতার খোলস খসে গিয়ে চুঘতাইয়ের চোখে ক্রোধের ছাপ। বললেন, ‘কিছুই করার নেই মানে! এই বেইনসাফির কোনো বিচার নেই! একটা চোর, একটা ভিখারির সন্তান দিনের পর দিন আমার সব কবিতা, সব ছন্দ, সব অক্ষর চুরি করে নিয়ে যাবে, আমার তৈরি উপমা, শব্দে শব্দে ঠোক্কর খাওয়া ধ্বনিমাধুর্য দখল করে আমারই প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠবে, তাঁকে বলা হতে থাকবে উর্দু কবিতার নয়া সিতারা, আর তা মেনে নিতে হবে আমাকে? শুনে রাখুন, সাহিত্যের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় জোচ্চুরি, বড় বেইনসাফি কোনো দিন হয়নি।’
আমি বললাম, ‘আপনি আপনার পরবর্তী পাণ্ডুলিপি সুরক্ষিত রাখুন, চুঘতাইজি। পাণ্ডুলিপি যাতে কেউ চুরি করতে না পারে।’
চুঘতাই তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘পরেরটাও চুরি হবে। আমি নিশ্চিত।’
‘আপনি লিখে সিন্দুকে ভরে রাখুন।’
‘পৃথিবীর কোনো সিন্দুক ওই ছুঁচোকে আটকাতে পারবে না।’
‘আপনি বাড়ির লোকজনকে সন্দেহ করছেন, বা প্রেসের লোকজনকে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘পুরোটা বুঝতে হলে উকিল সাহেব, আপনাকে উর্দু কবিতার ইতিহাস জানতে হবে। বুঝতে হবে এর সাম্প্রতিক প্রবণতা। এবং বুঝতে হবে চুঘতাই আর লুধিয়ানির দ্বন্দ্বের স্বরূপ। একমাত্র তাহলেই আপনি পারবেন পুরো বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরতে। আমি চাই, আপনি আদালতে বিষয়টা বিস্তারিত তুলে ধরুন শুধু। জিতি না-জিতি, কথাগুলো অন্তত বলা তো হোক।’
.
তো, এইভাবে কবিতাবিমুখ এক আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও শুধু মক্কেলের ফেরে আমাকে উর্দু কবিতার গোলকধাঁধার মধ্যে প্রবেশ করতে হয়েছিল। পরবর্তী কয়েকটি দিন রসুল পার্কের ছায়াঢাকা তরুবীথি বেয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে চুঘতাই আমার সামনে উর্দু কবিতার বিশাল ভূখণ্ডের দরজা উন্মোচন করতে শুরু করেন। সেই দরজায় উঁকি দিয়ে আমি ভেতরে অদ্ভুত এক মোহনীয় বাগিচা দেখতে শুরু করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি চুঘতাইয়ের কথার জাদুতে ঝুঁদ হয়ে থাকতাম। পঞ্চম দিন থেকে টের পেতে শুরু করি, আমার মক্কেলের মামলার সুরাহা কবিতার এই গোলকধাঁধাময় গলিপথের ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে আছে, আইনের ধারা-উপধারার মধ্যে তা খুঁজতে যাওয়া বৃথা। সে ক্ষেত্রে একজন পরিপূর্ণ কবি-বিচারকই কেবল আমার মক্কেলকে ইনসাফ দিতে পারেন। আর কেউ নন।
.
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে পরবর্তী দশটি বছরের উর্দু কবিতার ইতিহাস চুঘতাই আর লুধিয়ানির দ্বন্দ্বযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁদের কলম ও ঠোঁটের মধ্য দিয়ে উর্দু কবিতার দুটি শক্তিশালী স্রোতোধারা প্রবহমান হয়েছে। এই দুই সমবয়সী কবি কী করে ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে ঘোরতর শত্রু হয়ে উঠলেন, সেই গল্প লাহোরের সাহিত্য আড্ডার মুখরোচক কিংবদন্তি। তাতে সত্যের পাশাপাশি অনেক মিথ্যার খাদও মিশে আছে। যেমন কেউ কেউ বলেন, দেশভাগের পর লুধিয়ানা থেকে লাহোরে আসা মোহাজির, কপর্দকহীন কিশোর লুধিয়ানি বেশ কিছুদিন চুঘতাই পরিবারে আশ্রিত ছিলেন। সে বয়সে দুজনই ওই পরিবারের এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারীর প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সেখান থেকে।
কিংবদন্তি যা-ই চালু থাক, লাহোরের উত্তর অংশের বনেদি এলাকায় বেড়ে ওঠা চুঘতাই আর দক্ষিণ অংশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মহল্লায় বসবাসকারী লুধিয়ানির কবিতার জগৎ যে ভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। তরুণ বয়সে লুধিয়ানি হকিকত পসন্দ বা বাস্তববাদ নামক একটি নতুন কাব্য-আন্দোলনের জন্ম দেন। এটির দুর্বিনীত অনুসারীরা উর্দু কবিতায় চল্লিশের দশক থেকে চালু রুহানী বা মরমি ধারার কবিদের নির্দয় সমালোচনা করতেন। বলতে কি, চুঘতাই ছিলেন এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তিক্ত বিদিষ্ট চুঘতাই একপর্যায়ে ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের প্রভাববলয়ে আসেন, তাতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি তাঁর কবিতা নতুন দিকে বাঁক নেয়। উর্দু কবিতায় প্রতীকবাদী ধারা যে দ্রুত বিকাশ লাভ করতে শুরু করে, সেটার একক কৃতিত্ব চুঘতাইকেই দিতে হবে। পরবর্তীকালে পরাবাস্তববাদী উপকরণও মিশে যেতে থাকে তাঁর কবিতায়। এ সময় চুঘতাইয়ের জনপ্রিয়তা এত বেড়ে যায় যে তিনি একপ্রকার গার্হস্থ্য নামে পরিণত হন। তাঁর কবিতার বই নেই, পুরো পশ্চিম পাকিস্তানে এমন মধ্যবিত্তের বাড়ি খুঁজে পাওয়া যেত না।
চুঘতাইয়ের জনপ্রিয়তার চাপে লুধিয়ানির বাস্তববাদী ধারাটি শুকিয়ে যেতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে লুধিয়ানির কলম থেমে যায়। বেশ কিছুদিন তিনি নিরুদ্দেশ থাকেন। এ সময় তাঁকে ঘিরে নানা রকম গুজব ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। বছর দুয়েক পর তিনি ফিরে আসেন এবং গুলো কি মহেক নামে তাঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। সমালোচকেরা সবাই স্বীকার করেন, এই বইয়ের কবিতাগুলো লুধিয়ানির এত দিনকার প্রবণতা ও ভঙ্গিমার অনেকটাই বিপরীত। তিনি এক নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।
কিন্তু বইটি প্রকাশের পরপরই হইচই শুরু করে দেন চুঘতাই। লাহোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে অভিযোগ করেন, তা উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে কেলেঙ্কারিময় ইলজাম। লুধিয়ানির বিরুদ্ধে তিনি কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ আনেন। প্রমাণ হিসেবে নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি হাজির করেন। ওই দিনের পর থেকে অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ঈর্ষাকাতর চুঘতাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন।
পরবর্তী দুই বছরে লুধিয়ানির আরও দুটি কবিতার বই বের হয় এবং দুবারই একইভাবে পাণ্ডুলিপি চুরির অভিযোগ আনেন চুঘতাই। দুবারই তিনি হাস্যরসের জন্ম দেন। এর পরপরই আদালতে মামলা।
.
‘লোকটা জোচ্চোর, উকিল সাহেব। এ নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ রাখবেন না’, বললেন চুঘতাই।
আমি তার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কিন্তু প্রমাণ তো লাগবে।’
‘ওর কবিতাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। ও লিখেছে, ‘লৌট আও বো চমনমে/ যাহা গুলাবোঁ কি পারি নিশাবাজ হো কে/শোয়ে হ্যায় ঘাস কি গালিচে পে৷’ (ফিরে এসো সেই বাগানে/যেখানে গোলাপের পাপড়ি শুকিয়ে/লুটিয়ে আছে ঘাসের গালিচায়)। এই চিত্রকল্প তৈরি করা ওর বাবার পক্ষেও সম্ভব নয়। এই ভাষা ওর নয়। আরও প্রমাণ দেব? গত দেড় বছরে আমি একটাও নতুন কবিতা লিখিনি। এই দেড় বছরে ওর নতুন বই বের হওয়াও বন্ধ। বলে কিনা রাইটার্স ব্লক।’
আমি বললাম, ‘আপনার পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো লেখার পর নিচে তারিখ দেওয়া থাকে না?’
প্রশ্ন শুনে চুঘতাই বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর যা বললেন, সে রকম অদ্ভুত কথা আমি জীবনে শুনিনি। তিনি বললেন, ‘ওর কবিতার বই বের হচ্ছে আমার কবিতাগুলো লেখারও আগে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও আমার কবিতাই চুরি করছে।’
স্তম্ভিত হয়ে চুঘতাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।
চুঘতাই বলেন, ‘আপনি বিশ্বাস করছেন না আমার কথা, তা-ই না?’
‘আপনি ব্যাখ্যা করে বলুন।’
‘আমার পাণ্ডুলিপি লেখার অন্তত ছয় মাস থেকে দেড় বছর আগে বের হচ্ছে ওর কবিতার বই। তবু বলব, ও আমার পাণ্ডুলিপিই চুরি করছে।’
‘যে পাণ্ডুলিপি লেখাই হয়নি, সেই পাণ্ডুলিপি চুরি হয় কী করে?’
চুঘতাইয়ের চোখে অসহায় চাহনি। তাঁকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে কী চিন্তা দানা বাঁধছে, তিনি বোধ হয় টের পেতে শুরু করেছেন।
.
চুঘতাইদের বাগানবাড়ির দোতলার বারান্দায় সারা রাত বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবলাম আমি। ভোরের দিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
নাশতার টেবিলে চুঘতাইয়ের মুখোমুখি বসে বললাম, ‘উপমা-উৎপ্রেক্ষা, কবিতার শব্দচয়ন প্রবণতা, চিত্রকল্প তৈরির কৌশল–যা-ই বলুন, এগুলো কিছুই এজলাসে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে না।’
‘আপনি কি ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন?’
‘না। একটু আগে টেলিগ্রাম করে এলাম, ফিরতে আরও এক মাস দেরি হবে।’
‘কী করবেন আপনি?’
‘চোরকে হাতেনাতে ধরব।’
‘কীভাবে?’
‘ফাঁদ পেতে। ঢাকায় আমার এক কবিবন্ধু আছে। আরিফ হাসান। ব্যর্থ কবি। বছর পাঁচেক আগে তাঁর একটি কবিতার বই বেরিয়েছে। এখানে আপনার এই বাগানবাড়িতে বসে বসে আমি ওই বাংলা কবিতার বইটি এখন উর্দুতে অনুবাদ করব। গোপনে। আপনি সেগুলো আবার কপি করবেন। হুবহু। তারপর আপনার নামে ওই কবিতার পাণ্ডুলিপি ছাপতে জমা দেবেন প্রকাশকের কাছে। ছাপবেন না। ছাপতে দেবেন শুধু।’
চুঘতাই তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার চোখ চকচক করছে।
.
১৯৬৮ সালের ৭ নভেম্বর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে গেল। বাংলা কবিতার বইয়ের নাম ছিল সময়চক্র। উর্দুতে সেটা দাঁড়াল ওঅক্ত কা সিলসিলা। প্রকাশককে দেওয়া হলো ৯ নভেম্বর। আর তখনই খবর পেলাম, ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ কবি তালাল লুধিয়ানির নতুন বই বেরিয়ে গেছে, নাম ওঅক্ত কা সিলসিলা। সেই বইয়ের জন্য তিনি অল পাকিস্তান উর্দু একাডেমির পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার লাহোরে পা রাখারও দেড় বছর আগে এসব ঘটে গেছে।
আমি আশ্চর্য হলাম না। আমার কাছে সবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। লুধিয়ানি চুরি করছেন পৃথিবীর তাজ্জবতম উপায়ে। এই চুরি ঠেকানোর কোনো পথ নেই।
কিন্তু আমার পাতা ফাঁদে তাকে পড়তেই হলো।
ঢাকার কবির বাংলা কবিতা মেরে দেওয়ার অভিযোগে মামলা হলো লুধিয়ানির বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় অভিযোগ, উর্দু একাডেমির সঙ্গে প্রতারণা করে পুরস্কার বাগানো। দ্বিতীয় অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো।
লুধিয়ানিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পারার কথা নয়। সময়ের জটিল গলিপথে লুকিয়ে পড়ার কৌশল তিনি জেনে গেছেন। তার লেখার কক্ষের দরজা ভেঙে পুলিশ ঢুকে দেখে, ঘর খালি। লুধিয়ানির স্ত্রীর দাবি, পুলিশ দরজা ভাঙার সময়ও ভেতরে স্বামীর গলার আওয়াজ তিনি শুনেছেন।
ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো পথ নেই।
০৬. দ্বিখণ্ডিত
আমি পরপর কয়েকটি ঘটনা বলব। একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কহীন মনে হতে পারে। তবু একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন, প্লিজ। শুনলে এগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারেন। পাবেনই। আর শেষে আমি আপনাকে বলব, কেন এখানে এসেছি।
হিলারি স্টেপস কী জিনিস জানেন? জানার কথা নয়। এভারেস্ট শৃঙ্গের ঠিক আগে আগে একটা বিরাট পাথরের চাঙড়। ১২ মিটার উঁচু খাড়া একটা দেয়ালের মতো। ধরুন জেলখানার দেয়াল কত উঁচু হয়? চৌদ্দ-পনেরো ফুট হবে। সেটাই কী দুর্লঙ্ঘ্য লাগে! আর এ তো পাক্কা ১২ মিটার! যারা এভারেস্টে চড়েন, পর্বতারোহীরা, তাঁদের চোখে এটা হলো সর্বশেষ বড় চ্যালেঞ্জ। সাড়ে আট হাজার মিটারের ওপরে, অত উঁচুতে, একটা দৈব নিষেধ যেন দাঁড়িয়ে আছে–বলছে, এসো না, উঠো না। কাব্য করছি না। বইপত্রে পড়ুন, এটার কথা বলা আছে, হিলারি স্টেপসের কথা। ওইটা পার হতে বিরাট কসরত। অনেকে ওখান থেকে ফিরে আসে। কী আফসোেস দেখুন! এভারেস্টের মাত্র ৫৮ মিটার নিচ থেকে ফিরে আসা। স্বর্গের দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে আসা আরকি।
গত সপ্তাহে পত্রিকায় একটা খবর এসেছে, আপনার চোখে পড়ার কথা। টিম মোসেডেল নামে এক ব্রিটিশ পর্বতারোহী এভারেস্ট থেকে নেমে এসে প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, হিলারি স্টেপস আর নেই। নেই মানে, যাওয়া-আসার পথে তিনি পাথরটা দেখতে পাননি। কোথায় গেল? সম্ভবত ধসে পড়েছে। দু বছর আগে নেপালে একটা ভয়ানক ভূমিকম্প হয়েছিল, আপনার মনে থাকার কথা। মোসেডেলের অনুমান, সেটার ঝাঁকিতে পড়ে গিয়ে থাকবে পাথরটা। হতেই পারে। এ রকম ভূকম্পনের আঁকাআঁকিতে কত কিছুই তো অদলবদল ঘটে। স্বয়ং হিমালয় পর্বতখানাই তো উঠে এসেছে এমন এক তুলাধোনা ঝাঁকুনিতে।
তো, হিলারি স্টেপস নেই, ভালো কথা। না থাকলে সমস্যা তো নেই। যারা এভারেস্টে চড়বেন, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। কিন্তু গোল বাধল এর দুদিন পরে। অং শেরিং নামে এক শেরপা কাঠমান্ডুতে পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, হিলারি স্টেপস ওখানেই আছে। বহাল তবিয়তে। অং শেরিং নিজে সেটা দেখেছেন। শুধু শেরিং নন, আরও অনেক শেরপাই দেখেছেন। মোসেডেলের আগে-পরে যারা এভারেস্টে উঠেছেন, তাঁরা সবাই সেটা দেখেছেন। এখনো দেখছেন।
তাহলে ঝামেলাটা কোথায়? অং শেরিং বললেন, মোসেডেলের দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে। অতিরিক্ত তুষারে পাথরটা হয়তো এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেছে, চোখে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যাক না-যাক, পাথরটা আছে। তার জায়গাতেই আছে। সরে তো যায়ইনি, একটু টালও খায়নি। যারা এভারেস্টে চড়ছেন, তাদের আগের মতোই কষ্ট করে পাথরটা ডিঙাতে হচ্ছে।
ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়ার কথা। শেরপারা যুগ যুগ ধরে এই পথ বেয়ে উঠছেন, নামছেন। জায়গাটা তাদের হাতের তালুর মতো চেনাজানা। তারা যেটা বলবেন, সেটাই ধ্রুব সত্য। কিন্তু সমস্যা হয়েছে কী, মোসেডেলও ফেলনা কেউ নন। এ নিয়ে ষষ্ঠবার এভারেস্টে চড়েছেন তিনি। এই পথ তারও কম চেনা নয়। হিলারি স্টেপসের মতো অত বড় একটা পাথরখণ্ড থাকার পরও সেটাকে নেই ভাবার মতো আনাড়ি তিনি নন। আর তা ছাড়া মোসেডেল খাঁটি ব্রিটিশ চিজ। তিনি জায়গাটার একটা ছবিও তুলে এনেছেন। তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পাথরটা নেই। চার বছর আগে পঞ্চমবার যখন এভারেস্টে চড়েছিলেন, তখনকার ছবিও দেখালেন মোসেডেল। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই অ্যাঙ্গেলে ভোলা ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে পাথরটা আছে। তার মানে মধ্যবর্তী কোনো এক সময় তা নেই হয়ে গেছে। সেটা ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের সময় ঘটেছে বলে অনুমান করলে খুব বেশি কষ্টকল্পনা মনে হয় কি?
এদিকে শেরপা অং শেরিংই বা ছাড়বেন কেন। ছবি তিনিও বের করলেন। একই জায়গার ছবি। একই অ্যাঙ্গেলে। সেখানে পাথরটা আছে।
ব্যাপার তো খুবই জটিল হয়ে গেল। একটা পাথর আছে, আবার নেই। কিংবা একজনের জন্য তাঁছে, আরেকজনের জন্য নেই। এই প্যাঁচ খুলবে কে?
আপনি শুনছেন তো? বিরক্ত লাগছে না তো? এবার তাহলে আরেকটা ঘটনা বলি। একটু অতীতের।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। ঘটনা বলা ঠিক হচ্ছে। আসলে একটা ছবি। ছবিটাই ঘটনা। একটা আলোকচিত্র। ছবিটা আমি পকেটে করে এনেছি। একটা পেপার কাটিং। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে কাটিং করেছি। ঢাকায় আনন্দবাজার একটা জায়গাতেই পাওয়া যায়। ধানমন্ডি দুইয়ে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে। সেখানে রিডিং টেবিলে বসে কাঁচি দিয়ে কেটে পকেটে ভরেছি। কেউ দেখেনি।
এই যে ছবিটা আপনার টেবিলে বিছিয়ে দিলাম। একটু দেখুন। কী দেখছেন? একটা লোক বসে আছে। তার চারপাশে বইপত্রের স্থপ। লোকটার নাম কেশবন। বি এস কেশবন। দক্ষিণ ভারতের লোক। বোঝাই যাচ্ছে জায়গাটা একটা লাইব্রেরি। গ্রন্থাগার। আর কেশবন এটার লাইব্রেরিয়ান। কেশবন ভারতের প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগারিক। ছবিতে তাঁকে গালে একটা হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একটু যেন বিমর্ষ। চারপাশের স্তূপ করে রাখা বইগুলো তিনি দুই ভাগে ভাগ করছেন। কেন ভাগ করছেন? কারণ দেশ ভাগ হচ্ছে। তারিখটা লক্ষ করুন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাস। এক মাস পরেই ইংরেজরা চলে যাবে। সবকিছু পাকাপাকি হয়ে গেছে। ভারত উপনিবেশ ভাগের প্রস্তুতি চলছে। যেখানে যা কিছু আছে, দুই ভাগ। হিসাব-কিতাব চলছে। কেশবন তার লাইব্রেরির বইপত্রও দুই ভাগ করছেন। ছবিতে দেখুন, এক পাশের বইয়ের ওপর প্ল্যাকার্ডে রোমান হরফে লেখা। ‘পাকিস্তান’। আরেক ভাগে ইন্ডিয়া।
ছবিটা তুলেছেন ডেভিড ডগলাস ডানকান নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক। ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট আমেরিকার লাইফ ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপা হয় এটা। পঞ্চাশ বছর পর ১৯৯৭ সালের আগস্টে টাইম ম্যাগাজিনে আবার ছাপা হয় এই ছবি। একেবারে প্রচ্ছদে। ভারত ভাগের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তারা প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল। আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ছবিটা ছাপা হয়েছে।
দেশভাগের গ্রাউন্ড রিয়েলিটি ফুটে উঠেছে সামান্য একটা ছবিতে। বিখ্যাত ছবি। আইকনিক ছবি। কিন্তু ছবিটা খুবই কনফিউজিং। রহস্য দেখা দিয়েছে ছবিটার লোকেশন নিয়ে। কেশবন লাইব্রেরির বই ভাগ করছেন। কিন্তু কোন লাইব্রেরির বই?
লাইফ ম্যাগাজিনসহ প্রথম দিককার পত্রপত্রিকায় লেখা হলো, জায়গাটা দিল্লির ইমপেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি। কেশবন সেটারই লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন বাদে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে কলকাতার ম্যাগাজিনগুলো দাবি করতে শুরু করল, জায়গাটা আসলে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি। কেশবন ওই সময় নাকি ছিলেন ওই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। নানান তথ্য-প্রমাণ দিয়ে এই দাবি তোলা হলো। সেসব তথ্যপ্রমাণ এত অকাট্য, অস্বীকার করার জো নেই। এই যে আমি আনন্দবাজার থেকে কেটে এনেছি যে ছবিটা, সেটার ক্যাপশনেও দেখুন একই কথা দাবি করা হয়েছে।
তাহলে একটা ছবি। একটা ঘটনা। কিন্তু সেটার লোকেশন দুটা। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। অথচ একটা দৃশ্যের তো একটাই লোকেশন হবে, তা-ই না? দুটো লোকেশন তো হতে পারে না।
এই ছবির রহস্য ভেদ করতে নেমেছিলেন আনহাদ হুনদাল নামে এক ভারতীয় সাংবাদিক। ছবিটা নিয়ে নানান জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। এঁকে দেখান, তাঁকে দেখান। কেউ কিছু জানেন কিনা, জিজ্ঞেস করেন। এভাবে একদিন তিনি গেলেন অন্বেষা সেনগুপ্ত নামে এক মহিলার কাছে। অন্বেষা দেশভাগ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ছবি দেখে অন্বেষা বললেন, দেশভাগের সময় নানান কিছুই ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছিল বটে। কোনো সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ভাগ হয়নি। প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু কোনো পক্ষই সম্মত হয়নি। ফুলে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিই হোক, আর যোক দিল্লির ইমপেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি, কোনোটাতেই এই দৃশ্যের অবতারণা হয়নি।
তাহলে বই ভাগাভাগির ছবিটা এল কোথা থেকে? এর জবাব দিতে পারবেন দুজন। এক, যিনি ছবিটা তুলেছেন, মানে ডেভিড ডগলাস ডানকান। দুই, যিনি ছবির বিষয়বস্তু, মানে কেশবন। ডগলাস কবে মরে ভূত হয়ে গেছেন! কেশবন এখনো বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু স্মৃতি এমন ক্ষয়ে গেছে, ভরসা করা কঠিন। তবু নয়াদিল্লির এক শহরতলিতে তাঁর নিরিবিলি বাগানবাড়িতে গিয়ে অশীতিপর লাইব্রেরিয়ানের চোখের সামনে মেলে ধরা হলো ছবিটা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে কেশবন ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘লোকটা আমিই বটে। কিন্তু ঘটনাটা কখনো ঘটেনি।’
কোন ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করছেন কেশবন? লাইব্রেরি ভাগ হওয়াটা? না, মোটেও তা নয়। কেশবনের ছেলে মুকুল কেশবন বললেন, ‘বাবা বোঝাতে চাচ্ছেন, দেশভাগের ঘটনাটাই আসলে ঘটেনি।
মানে? মানে হলো, ভারত ভাগ হয়েছে–এটাই কেশবন। বিশ্বাস করেন না। আজীবন করেননি। তিনি বরাবর মনে করে এসেছেন, একটা অখণ্ড ভারতে তিনি বসবাস করছেন। ইংরেজরা চলে গেছে বটে, তবে র্যাডক্লিফের মানচিত্রটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। ওটার আর দরকার হয়নি। শেষ মুহূর্তে মুসলিম লীগ আর কংগ্রেস লিডারদের মধ্যে একটা রফা হয়েছিল। জিন্নাহকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল। তাতে কলকাতার দাঙ্গাও আর হয়নি। লাহোরেও কাউকে কচুকাটা করা হয়নি।
একটা লোকের পক্ষে সারা জীবন এ রকম বিরাট এক বিভ্রান্তির মধ্যে বসবাস করা কী করে সম্ভব, আমার মাথায় ঢোকে না। এটা স্রেফ পাগলামি। কিন্তু কেশবনের এই ছবিটার ব্যাখা কে দেবে? ছবিটা একটা বিরাট খটকাই থেকে গেল।
ভাবছেন এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন বলছি আপনাকে? আপনার সঙ্গে এগুলোর কী যোগ? আরেকটু ধৈর্য ধরুন। কিংবা এক কাপ চা খাওয়াতে পারেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার ওই পারে একটা হোটেল আছে। মালাই দেওয়া চা বানায়। ফ্লাস্ক হাতে কাউকে যদি পাঠিয়ে দিতেন। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।
এবার বর্তমান সময়ে আসি। তিন বছর আগের কথা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি দৈনিক পত্রিকায় দুটি খবর ছাপা হলো। খুব মামুলি খবর। এক মন্ত্রীর খবর। আমি তার নাম বলছি না। একটি খবরে বলা হলো, মন্ত্রী নেত্রকোনায় একটা সেতু উদ্বোধন করেছেন। আরেকটি খবরে বলা হলো, মন্ত্রী খুলনায় পার্টির একটি সভায় যোগ দিয়েছেন। দিতেই পারেন। মন্ত্রীরা এসব কাজই তো করবেন। সমস্যা হলো, পত্রিকা দুটি একই দিনে ছাপা হওয়া। এবং দুটি পত্রিকাই দাবি করছে, ছাপা হওয়ার আগের দিন মন্ত্রী এ কাজটি করেছেন। মানে একই দিনে। শুধু যে একই দিনে, তা-ই নয়, একই সময়ে বিকেলবেলা।
দুটি জায়গা লক্ষ করুন, একটা নেত্রকোনা, আরেকটা খুলনা। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? হয় পত্রিকা দুটির কোনো একটি তারিখে ভুল করেছে। অথবা মন্ত্রী এক জায়গায় কাজ সেরে আসলেই আরেক জায়গায় গিয়েছেন। সমস্যা হলো, বাংলাদেশে নেত্রকোনায় বিকেলবেলা একটি সেতু উদ্বোধন করে বিকেলবেলাতেই খুলনায় গিয়ে পার্টির সভা করা সম্ভব নয়। বিমানে বা হেলিকপ্টারে করে গেলেও না। তার মানে পত্রিকা দুটির কোনো একটা ভুল নিউজ করেছে। না, পত্রিকা দুটির কোনোটিই ভুল নিউজ করেনি। আমি দুটি পত্রিকা অফিসে গিয়েছি। শুধু পত্রিকা অফিস নয়, নেত্রকোনা এবং খুলনাতেও গিয়েছি। মন্ত্রী আসলেই পত্রিকায় উল্লিখিত দিনে ওখানে গিয়েছিলেন। ওই সব কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছেন।
মন্ত্রী আমাদের এলাকার লোক। একে-ওকে ধরে আমি একদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তার সঙ্গে দেখা করলাম। পত্রিকার কাটিং তুলে দিলাম তাঁর হাতে। তিনি দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু বললেন না।
চা-টা এরা ভালোই বানিয়েছে। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। বৃষ্টি কমে এসেছে। আমিও উঠব। আরেকটা ঘটনা বলেই আমি শেষ করব। তারপর আসল কথায় আসব।
এবার যেটা বলব, সেটার সঙ্গে আমি নিজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আমি একটা সরকারি দপ্তরে ছোটখাটো পদে চাকরি করি। দপ্তরটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তো ফিল্ম সেন্সর বোর্ডেও কিছুদিন কাজ করতে হয়েছে আমাকে। সেন্সর বোর্ড কী করে, জানেন তো? যারা ছবি বানায়, চলচ্চিত্র, তারা একটা করে কপি জমা দেয়। সেন্সর বোর্ড সেটা স্ক্রিনিং করে। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে ছবি দেখে। তারপর আলাদাভাবে রিপোর্ট করে। কোথাও কোনো আপত্তি আছে কি না, সরকারি গাইডলাইন ঠিকমতো মানা হয়েছে কি না–এসব বিষয়ে রিপোর্ট। আমার কাজ ছিল এসব রিপোর্ট কম্পাইল করা, সুপারিশগুলোর একটা তালিকা করে সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া। নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের খুব দুর্দিন যাচ্ছিল, মনে আছে? অশ্লীলতাবিরোধী আন্দোলনের কারণে খুব মন্দা। বছরে দশ বারোটি ছবিও বানানো হয় কি হয় না। সেন্সর বোর্ডে কাজ নেই। বোর্ড মেম্বাররা কালেভদ্রে একত্রে বসে ছবি দেখার সুযোগ পান। এ রকম সময়ে একদিন তরুণ এক চলচ্চিত্র নির্মাতার একটা ছবি জমা পড়ল। লোকটা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে ছবিটা তৈরি করেছেন।
সেন্সর বোর্ডে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কাজ পাওয়া গেছে। একদিন সন্ধ্যার পরপর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে সেন্সর বোর্ডের অফিসে ফিল্ম স্ক্রিনিংয়ের বন্দোবস্ত হলো। আমিও তাতে উপস্থিত ছিলাম। সদস্য না হয়েও। ছবির কাহিনি বেশ জটিল। আর্ট ফিল্ম বলতে পারেন। বিষয়বস্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন। বিশ্বজুড়ে বামধারার রাজনীতির বিদায়ঘণ্টা বাজছে। নানান অস্তিত্ববাদী ক্রাইসিস। এ নিয়ে জটিল কাসুন্দি। ছবির প্রায় কিছুই বুঝলাম না। সমাপ্তিটা তো মাথার ওপর দিয়ে গেল।
এ রকম সিনেমা ঢাকার হলগুলোয় চলবে না। এগুলো ফেস্টিভ্যালে দেওয়ার জন্য। পুরস্কার-টুরস্কার পাবে। পত্রপত্রিকায় উচ্ছ্বসিত রিভিউ হবে।
ছবি শেষে বোর্ড মেম্বাররা গম্ভীর মুখে চলে গেলেন। তিন দিনের মধ্যে সবাই নিজ নিজ রিপোর্ট জমা দিলেন। সেগুলো সবই আমার টেবিলে এল। দাপ্তরিক দায়িত্ব হিসেবে আমাকে সেগুলো পড়তে হলো। পড়তে পড়তে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। রিপোর্টগুলো পড়ে বোঝার উপায় নেই, দশ বোর্ড মেম্বার আসলে একটি অভিন্ন ছবি দেখেছেন। দেখলাম, তারা আসলে দশটি আলাদা আলাদা ছবির কথা বলছেন। একেক জনের ছবি শেষ হয়েছে একেকভাবে। যেমন একজন বললেন, তাঁর আপত্তি ছবিটির অহেতুক বিয়োগান্তক সমাপ্তি নিয়ে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রধান চরিত্রের মৃত্যু অপ্রাসঙ্গিক। এটা দর্শকদের মধ্যে ভুল মেসেজ দেবে। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা ভেবে যে, ছবিতে তো প্রধান চরিত্রের মৃত্যুই হয়নি। ছুরিকাঘাতে মৃত্যুর কোনো দৃশ্যই কোথাও নেই। এভাবে একেকটা রিভিউ রিপোর্ট পড়ছি, আর আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
তাই বলে ভাববেন না, আমার জীবনে এই ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। বলতে কি, অনেক ছোটবেলা থেকে আমি এ রকম অসংগতি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমি লক্ষ করেছি, জগতে এ রকম অসংগতির ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। একটা ঘটনা দু-টুকরো হয়ে দুটি ঘটনায় পরিণত হয়। একটা লোক একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করে। খুব অল্প সময়ের জন্য করে। অধিকাংশ লোকেরই এগুলো নজর এড়িয়ে যায়। তবে কারও কারও চোখে পড়ে। তারা এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। চেপে যায়।
আমি চেপে গেলাম না। এ রকম ঘটনা আমি অনুসন্ধান শুরু করলাম। কড়া নজর রাখা। দেখলাম, যতটা বিরল ভেবেছিলাম, ততটা বিরল নয় এসব ঘটনা। সতর্ক থাকলে চোখে পড়ে। মাঝে মাঝেই পড়ে।
ব্যাখ্যা? না কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তবে এটুকু বুঝি, আমরা যতটা সরল মনে করি, জগৎটা তত সরল নয়। যেটাকে আমরা বাস্তবতা বলি, সেটা একটা বিছিয়ে রাখা চাদরের মতো। যুক্তির চাদর। কিন্তু সমস্যা কী জানেন, চাদরটার এখানে-সেখানে ছেঁড়াফাটা, কোথাও কোথাও সেলাই খুলে যাওয়া, কোথাও তাপ্পি মারা। ওই ছেঁড়া ফুটোগুলো দিয়ে আরেকটা জগৎ উঁকি দেয়। সূক্ষ্ম একটা আভাস পাওয়া যায়, বাস্তবতার এই চাদরের নিচে আরেকটা বৃহত্তর জমিন আছে। সেখানে দুইয়ে দুইয়ে সব সময় চার হয় না। সেখানে লজিক চলে তার নিজের নিয়মে।
সবচেয়ে অদ্ভুত কথা কী জানেন, এই বিশেষ ধরনের ঘটনা, এইসব অসংগতি খুঁজতে খুঁজতে আমি এগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা প্যাটার্ন আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। ব্যাখ্যা করতে পারব না, কিন্তু এটা ঠিক যে আমি আগাম আভাস পাই। আমি প্রেডিক্ট করতে পারি। টের পাই, কখন এ রকম ঘটনা আবার ঘটতে যাচ্ছে। এটা আমার একটা বাড়তি ক্ষমতাই বলতে পারেন। আমি আগাম বুঝতে পারি, চাদরটার কোথায় কোথায় ছেঁড়া।
আপনি যে বিরক্ত হচ্ছেন সেটা স্পষ্ট। হবেনই-বা না কেন! এতক্ষণ ধরে বকবক করছি। এভারেস্টের চূড়ার একটা পাথরখণ্ড, দেশভাগের সময়কার একটা লাইব্রেরি ভাগের ছবি, সেন্সর বোর্ডের সিনেমা নিয়ে গ্যাঞ্জাম–এসব হাবিজাবি কথা এ রকম বৃষ্টির দুপুরে মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে বলার কী মানে? আপনি যে এতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনেছেন, এটাই অবাক বিষয়। আপনার ঘড়িতে এখন কটা বাজে? দুপুর দুটা সাঁইত্রিশ মিনিট, তাই তো? বেশ। এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। আমি এসেছি একটা জিডি করতে। আপনি আমার নামে একটা জিডি রেকর্ড করবেন। হ্যাঁ, এখন। কী লিখবেন? লিখুন, একটা লোক আমাকে হুমকি দিচ্ছে। লোকটাকে আমি চিনি না। নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। টেলিফোনে দিচ্ছে, রাস্তায় দেখা করে দিচ্ছে। বলছে, আমাকে মেরে ফেলবে। লিখছেন? জিডি করার সময়টা ভালো করে লিখুন। দুইটা সাঁইত্রিশ মিনিট। পারলে সেকেন্ডটাও লিখুন। এবার কি সই দিতে হবে আমাকে? দিচ্ছি। এবার তাহলে উঠি। জানতে চান এসবের মানে কী? কেন এত বকবক করলাম? আরে, আমি তো ভেবেছিলাম আপনার কৌতূহল বলে কিছুই নেই। এতক্ষণ যেভাবে মুখ গোমড়া করে ফোনে গেম খেলছিলেন, ভেবেছি আপনি কিছুই শোনেননি। শুনুন, আপনাকে খোলাসা করেই বলি। আপনাকে বলাই যায়। ইনফ্যাক্ট আপনাকে বলাই ভালো। জিডির অভিযোগের তদন্ত করাটা আমার জন্য খুব দরকারি না। দরকারি হলো জিডি করাটা। এটাই আমার অ্যালিবাই। আমার দরকার এটা প্রমাণ করা যে এই দুপুর দুইটা সঁইত্রিশ মিনিটে আমি মোহাম্মদপুর থানায় বসে ছিলাম একেবারে ওসি সাহেবের সামনে। একবারও নড়িনি। কোথাও যাইনি। কারণ কী? কারণ, ঠিক এই মুহূর্তে এই দুটা সাঁইত্রিশ মিনিটে বনানী এগারো নম্বর রোডে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে। ছয়জন ডাকাত ভয়ানক অস্ত্র তাক করে সবাইকে জিম্মি করে ভল্টের টাকাপয়সা সব নিয়ে যাচ্ছে। আজই সন্ধ্যাবেলা এটা নিয়ে থানায় মামলা হবে। আজ রাত থেকেই তদন্ত শুরু হবে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ছয় ডাকাতের দুজনকে চেনা যাবে। তাদের একজন আমি। হ্যাঁ, আমি। কোনো ভুল নেই। এই আমিই–তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক ক্লার্ক। কীভাবে সেটা সম্ভব, এতক্ষণ ধরে সেটাই তো বোঝানোর চেষ্টা করলাম আপনাকে।
আমার এখন একটাই ভরসা। আপনি। আপনার সাক্ষ্য। আর এই জিডি।