- বইয়ের নামঃ গল্প (শিবরাম চক্রবর্তী)
- লেখকের নামঃ শিবরাম চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কালান্তক লাল ফিতা
আমি আত্মহত্যা করার পর দিনকতক তাই নিয়ে খুব জোর হৈচৈ হয়েছিল। গত ১৯৫৩ সালের দোসরা এপ্রিলের কাগজে-কাগজে কেবল এই কথাই ছিল। বেশি দিনের কাণ্ড নয়, অতএব তোমাদের কারো কারো মনে থাকতেও পারে।
আত্মহত্যার খবরটাই শুধু তোমরা পেয়েছ, কিন্তু কেন এবং কোন দুঃখে যে এ জন্য আর কাউকে না বেছে নিয়ে হঠাৎ নিজেকেই খুন করে বসলাম—তার নিগূঢ় রহস্য তোমরা কেউই জানো না। সেই মর্মন্তুদ কাহিনীই এখানে বলব। খুব সংক্ষেপেই সারব।
রেড টেপিজম কাকে বলে, জানো তোমরা হয়তো। যদি কোনো আপিসে কখনো গিয়ে থাক, তাহলে লাল ফিতার বাঁধা ফাইল নিশ্চয়ই তোমরা দেখেছ, ফাইলের পর ফাইল সাজানো, বড় বড় বান্ডিলের থাকও তোমাদের চোখে পড়েছে নিশ্চয়, কিন্তু সরকারি দপ্তরখানায় তোমরা কখনো ঢুকেছ কি না জানি না, আমার একবার সেখানে ঢোকার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। আর তখন ঐ রকম লাল ফিতার ফাইল—ফাইলের স্তূপাকার আর বান্ডিলের আন্ডিল দেখেই হঠাৎ কেমন আমার মাথা বিগড়ে গেল; আর আমি ঐ মারাত্মক কাণ্ড করে বসলাম।
লাল ফিতার একটা নিজস্ব ধর্ম আছে। পৃথিবীতে যত রংস আবিষ্কৃত হয়েছে, ইঁফফযরংস থেকে শুরু করে ৎযবঁসধঃরংস পর্যন্ত, জবফ-ঞধঢ়রংস তাদের কারুর থেকেই কম যায় না। আমার মতে লাল ফিতার ধর্মই সবচেয়ে বেশি পরাক্রান্ত, কেননা পরকে আক্রমণ করতে আর করে কাবু করতে এর জুড়ি নেই।
এখন আসল ঘটনায় আসা যাক—টিপু সুলতাই হন বা তাঁর বাবা হায়দার আলিই হন—অবশ্যি আজকের কথা নয়, কোম্পানির আমলের কাহিনী—যাই হোক, ওঁদের একজন ওয়ারেন হেস্টিংসের বেজায় বিরক্তির কারণ হয়ে পড়েন। হেস্টিংস সাহেব সেই বিরক্তি দমন করতে না পেরে হায়দার আলিকেই দমন করবেন—এই স্থির করলেন। স্থির করেই তিনি কর্নেল কূটকে সসৈন্যে পাঠিয়ে দিলেন হায়দারের উদ্দেশে। সেই সময় অর্থাৎ সতেরো শো সাতাত্তর খ্রিস্টাব্দের পয়লা এপ্রিল নাগাদ বিক্রমপুরের বলরাম পাঠকের সঙ্গে হেস্টিংসের সরকারের এই চুক্তি হয় যে, উক্ত পাঠক উক্ত কর্নেল কূটকে তাঁর গোরা পল্টনের রসদ বাবদ এক হাজার খাসি অথবা পাঁঠা সরবরাহ করবেন।
এই হলো গোড়ার ইতিহাস অথবা আদিম কাণ্ড।
এত আগে শুরু করবার কারণ এই যে, এর সঙ্গে আমার অন্তিম কাণ্ড ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্রমশই সেই রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।
এখন বলরাম পাঠক প্রাণান্ত পরিশ্রমে এক হাজার খাসি এবং পাঁঠা দিগ্বিদিক থেকে সংগ্রহ করে কলকাতার কেল্লার দরজা পর্যন্ত যখন তাড়িয়ে এনেছেন, তখন শুনতে পেলেন, কর্নেল কূট পাঁঠাদের জন্য প্রতীক্ষামাত্র না করে সসৈন্যে মহীশূরের দিকে সটকে পড়েছেন কখন।
বললাম ভাবিত হয়ে পড়লেন, কী করবেন? সরকারি চুক্তি তো অবহেলার বস্তু নয়। পাঁঠার জোগাড়ে টাকা জোগাতে হয়েছে (কম টাকা না!) আর অতগুলো পাঁঠা (কিংবা খাসিই হোক) একা কিংবা সপরিবারে খেয়ে খতম করা বলরামের একপুরুষের কম্ম নয়!
অনেক ভেবেচিন্তে বলরাম স্থির করলেন, পাঁঠাদের সমভিব্যহারে তিনিও কূটের অনুসরণ করবেন এবং কোথাও না কোথাও তাঁকে পাকড়াতে পারবেনই—তাহলেই তাঁর চুক্তি বজায় রাখা যাবে।
এতএব যেমন এসেছিলেন, তেমনি তিনি চললেন পাঁঠা তাড়িয়ে কূটের পেছন পেছন ধাওয়া করে মহীশূরের দিকে।
কটকে উপনীত হয়ে তিনি শুনলেন, কূট আরো দক্ষিণে বহরমপুরের দিকে পাড়ি মেরেছেন। তখন তিনিও পাঁঠাদের সঙ্গে নিয়ে বহরমপুরের উদ্দেশ্যে ধাবিত হলেন, কিন্তু সেখানেও পৌঁছলেন দেরি করে—দিন কয়েক আগে কূট চলে গেছেন হায়দ্রাবাদের অভিমুখে। অদ্ভুত এই কূটনীতি। কূটের চালচলনে বলরাম তো নাজেহাল হয়ে পড়লেনই, পাঁঠারাও হিমশিম খেয়ে গেল।
তারপর—তারপর আর কী? হায়দ্রাবাদ থেকে এলোর, এলোর থেকে মছলি-পত্তন, সেখান থেকে কোদ্দাপা (হাঁটতে হাঁটতে পাঁঠাদের চার পায়ে খিল ধরে গেল, বলরামের তো মোটে দুটো পা)। এই রকমে তিনি কর্নেলের পশ্চাদ্ধাবন করে চললেন কিন্তু গোদা পা নিয়ে কোদ্দাপা পার হয়েও কর্নেলের পাত্তা তিনি পেলেন না। পল্টনের নাগাল পাওয়া তাঁর আর হলো না। তিনি তো হয়রান হয়ে হাঁপিয়ে উঠলেনই, পাঁঠারাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বাহাত্তর দিন এইভাবে দারুণ দৌড়াদৌড়ির পর মহীশূরের প্রায় সীমান্তে এসে অবশেষে যখন তিনি কর্নেল কূটের কাছাকাছি অর্থাৎ তাঁর ফৌজের ছাউনির চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছেছেন তখন এক বর্গীর দল এসে তাঁর দলে হানা দিল।
আক্রান্ত হয়ে তাঁর দলবল এমন চ্যাঁ-ভ্যাঁ শুরু করল যে, সে আর কহতব্য নয়। সেই দারুণ গণ্ডগোল আর ছত্রভঙ্গের ভেতর পাঠক মহাশয় (পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে তখন তাঁরই এক সহযাত্রী ঝোল বানিয়ে সবেমাত্র মুখে তুলতে যাচ্ছিলেন!) ভাতের থালার অন্তরালে আত্মগোপন করতে যাবেন, এমন সময় অতর্কিতে বর্শাবিদ্ধ হয়ে তাঁকে প্রাণ ত্যাগ করতে হয়।
বর্গীরা পাঁঠাদের নিয়ে পিঠটান দিল। সেই পলায়নের মুখে কয়েকটা পাঁঠা (অথবা খাসি) পথ ভুলেই হোক বা বর্গীদের সঙ্গে না পছন্দ করেই হোক (সংখ্যায় অবশ্যি তারা মুষ্টিমেয়), কর্নেল কূটের ছাউনির মধ্যে গিয়ে পড়ে এবং ধৃত হয়। বলা বাহুল্য, কর্নেল সাহেব সসৈন্যে তাদের উদরসাৎ করতে দ্বিধা করেননি। সুতরাং রসদরূপে তাদের সদ্ব্যবহার হয়েছিল বলতে হবে। এই রূপে বীর বলরাম পাঠক মারা গিয়েও পাঁঠাদের সাহায্যে কোনো প্রকারে আংশিকভাবে নিজের চুক্তি বজায় রেখেছিলেন।
পাঠক মহাশয় মহীশূর মহাপ্রস্থানের প্রাক্কালেই সরকারি চুক্তিপত্রটি তাঁর ছেলে বাবুরামকে উইল করে দিয়ে যান। বাবুরাম তাঁর বাবা মারা যাওয়ার খবর পাবামাত্র নিম্নলিখিত বিলটি ওয়ারেন হেস্টিংসের দরবারে পেশ করেন, করবার পর তিনিও খতম হন। বিলটি এইরূপ—
মহামান্য কম্পানি সরকার বরাবরেষু-বিক্রমপুরের বাবু বললাম পাঠক, সম্প্রতি বিগত, উক্ত মহাশয়ের প্রাপ্য সম্পর্কে হিসাব … হিঃ—
বাবুরাম তো মরলেন, কিন্তু মরবার আগে তাঁর ভাগনে ত্রিবিক্রম মহাপাত্রকে ডেকে তাঁর ওপর ভার দিয়ে গেলেন বিলের টাকাটা আদার করার। ত্রিবিক্রম উপযুক্ত পাত্র; আদায়ের জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বিক্রমের সূত্রপাতেই তাঁকে দেহ রক্ষা করতে হয়। তাঁর থেকে দিগম্বর তরফদারের হাতে এলো ঐ বিল। কিন্তু তিনিও বেশিদিন টিকলেন না। তস্যভ্রাতা সুদর্শন তরফদার ঐ উত্তরাধিকার সূত্রটি লাভ করলেন। কিছুদূর ঐ সূত্র টেনেও তিনি, এমনকি খাজাঞ্চিখানার সপ্তম সেরেস্তাদার পর্যন্ত তিনি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে কালের কঠোরহস্ত এমন আদর্শ-অধ্যবসায়ের মাঝখানে অকস্মাৎ পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিল।
সুদর্শন তাঁর এক আত্মীয়ের হাতে এই বিল সমর্পণ করে যান, সে বেচারা তার ঠেলায় মাত্র পাঁচ হ্না পৃথিবীতে টিকতে পারল। তবে এই অল্প সময়ের ভেতরেই সে রেকর্ড রেখে গেছে। লাল ফিতা দপ্তরখানার তেরো নম্বর সেরেস্তা সে পার হয়েছিল। তার উইলে এই বিল সে নিজের মামা আনন্দময় চৌধুরীকে উৎসর্গ করে যায়। আনন্দময়ের পক্ষে এই আনন্দের ধাক্কা সামলানো সহজ হয়নি। তারপর খুব অল্পদিনই তিনি এই ধরাধামে ছিলেন। অন্তিম নিঃশ্বাসের আগে তাঁর বিদায়-বাক্য হচ্ছে এই—’তোমরা আমার জন্যে কেঁদো না, বড় আনন্দেই আমি যেতে পারছি। মৃত্যু—হ্যাঁ—মৃত্যুই আমার পক্ষে এখন একমাত্র কাম্য।’
তিনি তো মরে বাঁচলেন, কিন্তু মেরে গেলেন আরো অনেককে। তারপর সাতজনের দখলেই এই বিল আসে, কিন্তু তাদের কেউই আর এখন ইহলোকে নেই। সবশেষে এই বস্তু এলো আমার হাতে, আমার এক মামার হাত হয়ে।
আমার দূর সম্পর্কের খুড়তুতো মামা—গুরুদাস গাঙ্গুলী—হঠাৎ এলাহাবাদ থেকে আমাকে তার পাঠালেন। কোনোদিনই যে আমাদের মধ্যে প্রাণের টান ছিল, এমন কথা বলা যায় না; বরং বলতে গেলে বলতে হয়, বরাবরই তিনি আমার প্রতি অহেতুক বিরাগ পোষণ করতেন; কখনো তিনি সইতে পারতেন না আমাকে, চিরকাল এইটেই দেখেছি, কাজেই টেলিগ্রাম পেয়ে অবাক হয়ে ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম, তিনি মৃত্যুশয্যায়। কিন্তু অবাক হবার তখনো বুঝি কিছুটা বাকি ছিল। তিনি তো সর্বান্তকরণে আমাকে মার্জনা করলেনই, এমনকি তাঁর প্রিয়পাত্রদের আর নিজের প্রিয়পুত্রদের বঞ্চিত করেই এই মূল্যবান সম্পত্তি অশ্রুপূর্ণ নেত্রে আমার হাতে সঁপে দিয়ে গেলেন।
আমার কবলে আসা পর্যন্ত এর ইতিহাস হচ্ছে এই। মামাতো ভাইদের ডবল-শোকাতুর করে একুশ হাজার টাকার এই বিল নিয়ে তো আমি লাফাতে লাফাতে কলকাতা ফিরলাম।
ফিরেই উঠেপড়ে লেগে গেলাম টাকা উদ্ধারের চেষ্টায়। এক-আধ টাকা নয়, একুশ হাজার! ইয়াল্লা!
প্রথমেই গিয়ে লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলাম। কার্ড পাঠালেই কিছু পরে আমাকে তাঁর খাসকামরায় নিয়ে গেলেন।
আমাকে দেখবামাত্র তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁ, কী দরকার আমার কাছে? আমার সময় খুব কম, ভারি ব্যস্ত আমি; তা কী করতে পারি আমি তোমার জন্যে বলো দেখি?’
সবিনয়ে বললাম, ‘আজ্ঞে হুজুর, সতেরো শো সাতাত্তর খ্রিস্টাব্দের পয়লা এপ্রিল তারিখে বা ঐ রকম সময়ে বিক্রমপুর জিলার বাবু বলরাম পাঠক কর্নেল কূট সাহেবের সঙ্গে মোট এক হাজার পাঁঠা কিংবা খাসি সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন—’
এই পর্যন্ত শোনামাত্র তিনি আমাকে বিদায় নিতে বাধ্য করলেন। এর বেশি কিছুতেই তাঁকে শোনানো গেল না। আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর টেবিলের কাগজপত্রে এমন গভীরভাবে মন দিলেন যে, স্পষ্ট বোঝা গেল—বলরাম, আমার বা পাঁঠার—কারো ব্যাপারেই তাঁর কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই।
পরের দিন আমি কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে মুলাকাত করলাম।
‘কী চাই?’ দেখেই আমাকে প্রশ্ন হলো তাঁর।
‘আজ্ঞে মহাশয়, সতেরো শো সাতাত্তর খ্রিস্টাব্দের পয়লা এপ্রিল নাগাদ বিক্রমপুর জেলার বাবু বলরাম—’
তিনি আমাকে বাধা দিলেন, ‘আমার মন্ত্রিত্ব তো মাত্র তিন বছরের, তিন শতাব্দীর তো নয়! আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।’
তবে? তিন শো বছরের প্রাচীন লোক আর কে আছে এখন? কার কাছে যাব আমি? ওয়ারেন হেস্টিংসও তো এখন বেঁচে নেই। তবে? তাহলে? আমি মনে মনে ভাবি।
কী করব? নমস্কার করে সেখান থেকে সরে পড়লাম।
পরের দিন ভয়ানক ভেবেচিন্তে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। তিনি মন দিয়ে আনুপূর্বিক শুনলেন। একটু চিন্তাও করলেন মনে হলো। শেষে বললেন, ‘চতুষ্পদ পাঁঠা তো? তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী সম্পর্ক? তারা তো আর আমাদের ছাত্র না! ও ব্যাপারে আমরা কী করতে পারি বলো?’
অগত্যা সেখান থেকেও চলে আসতে হলো।
কন্ট্রাক্ট নিয়ে করপোরেশন চলে, এই রকম একটা কথা কানে এসেছিল, সেইখানেই হয়তো এই বিলের ব্যবস্থা না হোক, এর সুরাহার একটা হদিস মিলতে পারে, এই রকম ভেবে মেয়রের সঙ্গে দেখা করলাম তার পরদিন।
‘মহাশয়, সতেরো শো সাতাত্তর খ্রিস্টাব্দের পয়লা এপ্রিল বা ওর কিছু আগে বা পরে বিক্রমপুর জিলানিবাসী, সম্প্রতি বিগত শ্রীযুক্ত বাবু বলরাম পাঠকের সঙ্গে কর্নেল কূট সাহেবের এক চুক্তি হয় যে—’
এই পর্যন্ত কোনো রকমে এগোতে পেরেছি, মেয়র মহাশয় আমাকে থামিয়ে দিলেন—’কর্নেল কূটের সঙ্গে করপোরেশনের কী? ওসব ব্যাপার এখানে নয়। তা ছাড়া, কোনো রাজনৈতিক কূটনীতির মধ্যে আমরা নেই।’
সবাই একই কথা বলে। এখানে নয়, ওখানে নয়, সেখানে নয়,—তবে কোন্খানে? চুক্তি হয়েছিল, এ তো আলবত; সে চুক্তি পাঁঠাদের তরফ থেকে যদ্দূর সম্ভব বজায় রাখা হয়েছে। এখন টাকা দেবার বেলায় এইভাবে দায় এড়ানোর অপচেষ্টা আমার আদপেই ভালো লাগে না। এ যেন আমার একুশ হাজারের দাবি না মিটিয়ে টাকাটা মেরে দেবার মতলব! আমাকেই দাবিয়ে মারার ফিকির।
পরদিন জেনারেল পোস্টাপিসের দরজায় গিয়ে হাজির হলাম। পোস্টমাস্টার জেনারেল তখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মোটরের সম্মুখে গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়লাম।
‘কী চাও বাপু, চাকরি?’ গাড়ির জানালা দিয়ে তিনি মুখ বাড়ালেন—’দুঃখের বিষয়, এখন কিছুই খালি নেই।’
‘আজ্ঞে না চাকরি নয়।’
ভরসা পেয়ে তখন তিনি আরো একটু মুখ বাড়ান, ‘তবে কী চাই?’
‘আজ্ঞে ১৭৭৭ সালের ১লা এপ্রিল তারিখে—’
‘১৭৭৭ সাল?’ ঈষৎ যেন ভ্রূকুঞ্চিত হলো ওঁর— ‘সে তো এখানে নয়, ডেড লেটার আপিসে। সেখানে খোঁজ করো গিয়ে।’
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মোটর দিল ছেড়ে।
এরপর আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। যেমন করে পারি এই বিলের কিনারা করবই, এই আমার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা হলো। যদি প্রাণ যায় সেই দুশ্চেষ্টায়, সেও স্বীকার। হয় বিলের সাধন, নয় শরীর পাতন। বিল নিয়ে আমি দিগ্বিদিকে হানা দিতে লাগলাম; একে-ওকে ধড়পাকড় শুরু করে দিলাম তারপর।
কোথায় না গেলাম? ক্যাম্বেল হাসপাতাল, গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল, ডেড লেটার আপিস, কমার্শিয়াল মিউজিয়াম, মেডিক্যাল কলেজ, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি, টেকস্টাইল ডিপার্টমেন্ট, টেঙ্ট্বুক কমিটি, পলতা ওয়াটার ওয়ার্কস—কত আর নাম করব? আলিপুরের আবহাওয়াখানা থেকে আরম্ভ করে (অ্যাসপ্ল্যানেডের ট্রাম ডিপোর আপিস ধরে) বেলগাছের ভেটারিনারি কলেজ পর্যন্ত কোনখানে না ঢুঁ মারলাম। এক কথায়, এক জেলখানা ছাড়া কোথাও যেতে আর বাকি রাখলাম না।
ক্রমশ আমার বিলের ব্যাপারে কলকাতার কারু আর অবিদিত রইল না। টাকাটা কেউ দেবে কি না, কে দেবে এবং কেনই বা দেবে, আর যদি সে না দেয় তাহলেই বা কী হবে, এই নিয়ে সবাই মাথা ঘামাতে লাগল; খবরের কাগজে কাগজেও হৈচৈ পড়ে গেল দারুণ। এক হাজার পাঁঠা আর একুশ হাজার টাকা—সামান্য কথা তো নয়। ভাবতে গেলে আপনা থেকেই জিহ্বা লালায়িত আর পকেট বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
অবশেষে একজন অপরিচিত ভদ্রলোকের অস্বাক্ষরিত পত্রে একটু যেন আশার আলোক পাওয়া গেল।
তিনি লিখেছেন—’আমি আপনার ব্যথার ব্যাথী। আপনার মতোই ভুক্তভোগী একজন। আমারও এক পুরনো বিল ছিল, এখন তা খালে পরিণত হয়েছে। এখন আমি সেই খালে সাঁতার কাটছি, কিন্তু কতক্ষণ কাটব? কতক্ষণ কাটতে পারব আর? আমি তো শ্রীবোকা ঘোষ নই! শিগগিরই ডুবে যাব, এরূপ আশা পোষণ করি। যাই হোক, আপনি সরকারি দপ্তরখানাটা দেখেছেন একবার?’
তাই তো, ঐটেই তো দেখা হয়নি। গোলেমালে অনেক কিছুই দেখেছি—দেখে ফেলেছি, কেবল ঐটা বাদে। খোঁজখবর নিয়ে ছুটলাম। দপ্তরখানায় গিয়ে সোজা একেবারে সেখানকার বড়বাবুর কাছে আমার সেলাম ঠুকলাম।
‘মশাই, বিগত ১৭৭৭ সালের ১লা এপ্রিলে বিক্রমপুরে স্বর্গীয়—’
‘বুঝতে পেরেছি, আর বলতে হবে না! আপনি সেই পাঁঠা তো?’
‘আজ্ঞে, আমি পাঁঠা…? আমি…’ আমতা আমতা করি আমি— ‘আজ্ঞে, পাঁঠা ঠিক না হলেও পাঁঠার তরফ থেকে আমার একটা আর্জি আছে। বিগত ১৭৭৭ সালের পয়লা—’
‘জানি, সমস্তই জানি। ওর হাড়হদ্দ সমস্তই আমার জানা। সব এই নখদর্পণে। কই, দেখি আপনার কাগজপত্র?’
এ রকম সাদর আপ্যায়ন এ পর্যন্ত কোথাও পাইনি। আমি উল্লসিত হয়ে উঠি। বলরামের আমলের বহু পুরনো চুক্তিপত্রটি বাড়িয়ে দিই। বাবুরামের আমলের বিলও। হাতে নিয়ে দেখেশুনে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এই কনট্রাক্টই বটে।’
তাঁর প্রসন্ন হাসি দেখে আমার প্রাণে ভরসার সঞ্চার হয়। হ্যাঁ, এতদিনে ঠিক জায়গায়, একেবারে যথাস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি বটে। তখন সেই ভুক্তভোগীটিকে আমি মনে মনে ধন্যবাদ জানাই।
তার পরই তিনি কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করলেন। এ-ফাইল সে-ফাইল, এ-দপ্তর, সে-দপ্তর। এর লাল ফিতা খোলেন, ওর লাল ফিতা বাঁধেন। দপ্তরিকে তলব দেন, আরো ফাইল আসে। আরো আরো ফাইল। গভীরভাবে দেখাশোনা চলে। আবার তলব, আরো আরো বহু পুরনো বান্ডিলরা এসে পড়ে।
হ্যাঁ, এইবার কাজ এগুচ্ছে বটে। আমারই কাজ। সমস্ত মন ভয়ানক খুশিতে ভরে ওঠে। সারা কড়িকাঠ জুড়ে যেন ঝমাঝম আওয়াজ শোনা যায় টাকার। এক্ষুণি সশব্দে আমার মাথায় ভেঙে পড়ল বলে। আমিও সেই দৈব দুর্ঘটনার তলায় চাপা পড়বার জন্যে প্রাণপণে প্রস্তুত হতে থাকি। হৃদয়কে সবল করি।
অনেক অন্বেষণের পরে বলরামী চুক্তিপত্রের সরকারি ডুপ্লিকেটের অবশেষে আত্মপ্রকাশ হয়। অর্থাৎ আত্মপ্রকাশ করতে বাধ্য হয়।
পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সব মিলিয়ে দেখে তিনি ঘাড় নাড়েন, ‘কাজ তো অনেকটা এগিয়েই রয়েছে, তা এতদিন আপনারা কোনো খবর নেননি। কেন?’
‘আজ্ঞে, আমি নিজেই এ বিষয়ের খবর পেয়েছি খুব অল্পদিন হলো।’
সরকারি দপ্তরের ডুপ্লিকেটটা সসম্ভ্রমে হাতে নিই। হ্যাঁ, এই সেই দুর্ভেদ্য চক্রব্যুহ, যার দরজায় মাথা ঠুকে আমার ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষ ইতিপূর্বে গতাসু হয়েছেন এবং আমিও প্রায় যাবার দাখিল! ভাবের ধাক্কায় আমার সমস্ত অন্তর যেন উথলে ওঠে—যাক, এই রক্ষে যে, আমাকে তাঁদের অনুসরণ করতে হবে না। এ আনন্দ আমার কম নয়! আমি তো বেঁচেই গেছি এবং আরো ঘোরতরভাবে বাঁচব অতঃপর—বালিগঞ্জের বড়লোকদের মধ্যে সটান নবাবি স্টাইলে। পুলকের আতিশয্যে কাবু হয়ে পড়ি আমি।
ভদ্রলোক সবই উল্টেপাল্টে দেখেন—হ্যাঁ, সুদর্শন তরফদার। সুদর্শনবাবুই তো কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছেন দেখছি। সাতটা সেরেস্তায় সই তাঁর সময়েই হয়েছে। তাঁর পরে এলেন—কী নাম ভদ্রলোকের। ভালো পড়াও যায় না। পুরন্দর পত্রনবিশ? হ্যাঁ, পুরন্দরই বটে, তা তিনিও তো ছটা সই বাগাতে পেরেছেন দেখছি। আর বাকি ছিল মাত্র চারটে সই। চারজন বড়কত্তার। তার পরের ভদ্রলোক তো আনন্দময় চৌধুরী। আপনার কে হন তিনি?’
‘আজ্ঞে তা ঠিক বলতে পারব না।’ আমি নিজের মাথা চুলকাই—’অনেকদিন আগেরকার কথা। তবে কেউ হন নিশ্চয়ই।’
‘তা, তিনিও দুটো সই আদায় করেছেন। বাকি ছিল আর দুটো সই। তিনি আর একটু উঠেপড়ে লাগলেই তো কাজটা হয়ে যেত। তা, তিনি আর চেষ্টা করলেন না কেন? এ রকম করে হাল ছেড়ে দিলে কি চলে?’
‘খুব সম্ভব তিনি আর চেষ্টা করতে পারলেন না। কারণ তিনি মারা গেলেন কিনা। চেষ্টা করতে করতেই মারা গেলেন।’
‘ও, তাই নাকি? কিন্তু তারপরে কাজ আর বিশেষ এগোয়নি। দুজন বড়কত্তার সই এখনো বাকিই রয়েছে। তবে এইবার হয়ে যাবে সব।’
আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম—’আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, যাতে একটু তাড়াতাড়ি হয়, অনুগ্রহ করে—’
তিনি বাধা দিয়ে বললেন, ‘দেখুন, তাড়াতাড়ির আশা করবেন না। এসব হচ্ছে সরকারি কাজ—দরকারি কাজ—বুঝতেই তো পারছেন? অতএব ধীরেসুস্থে হবে। স্লোলি, বাট শিওরলি। এর বাঁধাদস্তুর চাল আছে, সবই রুটিনমাফিক—একটু এদিক-ওদিক হবার জো নেই। একেবারে কেতাদুরস্ত।’ এই বলে মৃদ্যু হাস্যে তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন—’আস্তে আস্তে হয়ে যাবে সব, কিচ্ছু ভয় নেই আপনার।’
অভয় পেয়ে আমার কিন্তু হৃৎকম্প শুরু হলো। ‘তবু একটু স্মরণ রাখবেন অধমকে, যাতে ওর মধ্যেই একটু চটপট্—’ করুণ সুরে বলতে গেলাম।
‘বলতে হবে না, বলতে হবে না অত করে। সেদিকে আমাদের লক্ষ্য থাকে বৈকি। এতে বড় দপ্তরখানা তবে হয়েছে কী জন্যে বলুন? আর আমরাই বা এখানে বসে করছি কী? রয়েছি কী জন্যে? তবে আর একবার আগাগোড়া সব চেক হবে কিনা, সেইটুকু হলেই যথাসময়েই আপনি কল পাবেন। আপনাকে বারবার আসতে হবে না কষ্ট করে, আমরাই চিঠি দিয়ে জানাব আপনাকে। আর দুটো সই বৈ তো নয়। এ আর কী?’
অন্তরে বল সঞ্চয় করে বাড়ি ফিরি। তারপর একে একে দশ বছর কেটে যায়। খবর আর আসে না। বিলের ভাবনা ভেবে ভেবে চুল-দাড়ি সব পেকে ওঠে,—পেকে ঝরে ফাঁকা হয়ে যায় সব। কেবল থাকে—মাথার ওপরে টাক, আর মাথার মধ্যে টাকা; কিন্তু খবর আর আসে না।
বিলক্ষণ দেরি দেখে আর বিলের কোনো লক্ষণ না দেখে মাঝেমধ্যে আমি নিজেই তাড়া করে যাই, খবরের খোঁজে হানা দিই গিয়ে। ‘অনেকটা এগিয়েছে’, ‘আর একটু বাকি’, ‘আরে হয়ে এলো মশাই, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন’, ‘ঘাবড়াচ্ছেন কেন, হয়ে যাবে—হয়ে যাবে।’ ‘সময় হলেই হবে, ভাববেন না, ঠিক হবে!’ ‘সবুরে মেওয়া ফলে, জানেন তো?’ ইত্যাদি সব আশার বাণী শুনে চাঙ্গা হয়ে ফিরে আসি। তারপর আবার বছর ঘুরে যায়।
অবশেষে ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে শেষ সপ্তাহে বহুবাঞ্ছিত চিঠি এলো। তাতে পরবর্তী মাসের পয়লা তারিখে উক্ত বিল সম্পর্কে দপ্তরখানায় দেখা করার জন্যে আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানানো হয়েছে।
যাক, এত দিনে তাহলে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। আমি মনে মনে লাফাতে শুরু করে দিলাম। আর কী, মার দিয়া কেল্লা, কে আর পায় আমায়! সটান বালিগঞ্জ! কি সোজা নিউ ইয়র্ক! কিংবা হলিউডই বা মন্দ কী? জীবনের ধারাই এবার পাল্টে দেব বিলকুল—বিলের যখন কূল পেয়েছি? হ্যাঁ। আধঘণ্টা পরে পা মচ্কে বসে পড়ার পর খেয়াল হলো যে, ও হরি! কেবল মনেই নয়, বাইরেও লাফাতে শুরু করেছিলাম কখন!
পয়লা এপ্রিল তারিখে দুরু দুরু বক্ষে দপ্তরখানার দিকে এগোলাম। সতেরো শো সাতাত্তর সালের পয়লা এপ্রিল যে নাটক শুরু হয়েছিল, আজ উনিশ শো তিপান্ন সালের আর-এক পয়লা এপ্রিলে সেই বিরাট ঐতিহাসিক পরিহাসের যবনিকা পড়ে কিনা, কে জানে।
দপ্তরখানার সেই বাবুটি সহাস্যমুখে এগিয়ে আসেন: ‘ভাগ্যবান পুরুষ মশাই আপনি! কাজটা উদ্ধার করেছেন বটে!’ বলে সজোরে আমার পিঠ চাপড়ে দেন একবার।
‘একুশ হাজার পাব তো মশাই?’ ভয়ে ভয়ে আমি জিজ্ঞেস করি।
‘একুশ হাজার কী মশাই!’ এই দেড় শো বছরে সুদে-আসলে আড়াই লাখের ওপর দাঁড়িয়েছে যে! বলছি না—আপনি লাকি!’ তিনি বলেন।
‘আড়াই লাখ!’ আমার মাথা ঝিম ঝিম করে—’তা চেকটা আজই পাচ্ছি তাহলে তো?’
‘চেক? এখনই? তবে হ্যাঁ, আর বেশি দেরি নেই।’
‘বেশ, আমি অপেক্ষা করছি—সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত।’
‘না আজ হবার আশা কম। আপনি শুধু সই করে যান এখানে। পরে আমরা খবর দেব আপনাকে।’
অ্যাঁ, এখনো পরে? পরে খবরের ধাক্কায় তো দশ বছর কাটল—আবার পরে খবর? সসঙ্কোচে বলি—’আজ্ঞে, আজ আপনাদের অসুবিধেটা কী হচ্ছে জানতে পারি কি?’
‘এখনো একটা সই বাকি আছে কিনা!’ গূঢ় রহস্যটা অগত্যা তিনি ব্যক্ত করেন।
‘এখনো একটা সই বাকি।’ শুনে আমার মাথা ঘুরে যায়। এখনো আরো একটা! তবেই হয়েছে। ও আড়াই লাখ আমার কাছে তাহলে আড়াই পয়সার শামিল।
ক্যালেন্ডারে আজকের তারিখের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণে একটু হাসবার ভান করি—’পয়লা এপ্রিল বলে পরিহাস করছেন না তো মশাই?’
‘না-না, পরিহাস কিসের।’ তিনি গম্ভীরভাবেই বলেন—’শুধু সেই ফাইন্যাল সইটা হলেই হয়ে যায়।’
ততক্ষণে আমার মাথায় খুন চেপে গেছে; আমি বলতে শুরু করেছি—’তবে দিন মশাই, দিন আমাকে কাগজ-কলম! আমার এই বহুমূল্য সম্পত্তি আমি এই দণ্ডে আপনাকে ও ভগবানকে সাক্ষী রেখে উইল করে দিয়ে যাচ্ছি আমার জাতিকে, মানে—আমার দেশবাসীকে—অনাগতকালের যত ভারতীয়দের। দেখুন আমরা সব নশ্বর জীব। অল্প দিনের আমাদের জীবন, বেশিদিন অপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে অসাধ্য। বিল মানেই বিলম্ব—বিলক্ষণ বিলম্ব। কিন্তু জাতির পরমায়ু—কেবল সে-ই অপেক্ষা করতে পারে অনন্তকাল, মানে—যদ্দিন তার খুশি।’
এই কথা বলে সামনের টেবিল থেকে পেন্সিল-কাটা ছুরিটা তুলে আমূল বসিয়ে দিই আমার নিজের বুকে অম্লানবদনে।
‘উইল করে দিচ্ছি বটে, তবে আমার স্বদেশবাসী যেন না ভুল বোঝে যে, তাদের ওপর আমার খুব রাগ ছিল, তারই প্রতিশোধ নেবার মানসে এই বিল তাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলাম—আমাকে তারা যেন মার্জনা করে।’ এই বলে অবশেষে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস দিয়ে আমার অন্তিম বাণীর উপসংহার করি। আড়াই লাখের বিল আমার দেশবাসীকে বিলিয়ে দিয়ে সেই-ই আমার শেষ বিলাসিতা। বিল-আশীতার চরম!
মান্যবর, কর্নেল কূট সাহেবের ফৌজের রসদের জন্য এক হাজার পাঁঠা কিংবা খাসি প্রত্যেকটির মূল্য পাঁচ টাকা হিসেবে— ৫০০০ টাকা
মহীশূর পর্যন্ত তাদের যাতায়াত এবং খোরপোষের খরচা বাবদ ৬০০০ টাকা
একুনে মোট —২১০০০ টাকা
দেবতার জন্ম
বাড়ি থেকে বেরুতে প্রায়ই হোঁচট খাই। প্রথম পদক্ষেপেই পাথরটা তার অস্তিত্বের কথা প্রবলভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। কদিন ধরেই ভাবছি কি করা যায়।
সেদিন বাড়ি থেকে বেরুবার আমার তেমন কোনো তাড়া ছিল না, অন্তত ঐরূপ তীরবেগে অকস্মাৎ ধাবিত হব এমন অভিপ্রায় ছিল না আদৌ, কিন্তু পাথরটার সংঘর্ষ আমার গতিবেগকে সহসা এত দ্রুত করে দিল যে, অন্যদিক থেকে মোটর আসছে দেখেও আত্মসম্বরণ করতে অক্ষম হলুম কী ভাগ্যি, ড্রাইভারটা ছিলো হুঁশিয়ার—তাই রক্ষে!
সেদিন থেকেই ভাবছি কি করা যায়। আমার জীবন-পথের মাঝখানে সামান্য একটুকরো পাথর যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখা দেবে কোনোদিন এরূপ কল্পনা করিনি! তাছাড়া, ক্রমশই এটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে উঠছে, কেননা ধাবমান মোটর চিরদিনই কিছু আমার পদলনকে মার্জনার চোখে দেখবে এমন আশা করতে পারি না।
তাই ভাবছি একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, হয় ও থাকুক নয় আমি ও থাকলে আমি বেশিদিন। থাকব কিনা সন্দেহস্থলা তাই যখন আমার থাকাটাই, অন্তত আমার দিক থেকে বেশি বাঞ্ছনীয়, তখন একদা প্রাতঃকালে একা কোদাল যোগাড় করে লেগে পড়তে হলো।
একটা বড় গোছের নুড়ি, ওর সামান্য অংশই রাস্তার ওপর মাথা তুলেছিলা বহু পরিশ্রমের পর। যখন ওটাকে সমূলে উৎখাত করতে পেরেছি, তখন মাথার ঘাম মুছে দেখি আমার চারিদিকে রীতিমত জনতা। বেশ বুঝলাম এতক্ষণ এঁদেরই নীরব ও সরব সহানুভূতি আমার উদ্যমে উৎসাহ। সঞ্চার করছিল।
তাঁদের সকলের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনারা কেউ চান এই পাথরটা?
জনতার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল, কিন্তু কারু ঔৎসুক্য আছে কি নেই বোঝা গেল না। তাই আবার ঘোষণা করতে হলো—যদি দরকার থাকে নিতে পারেনা অনায়াসেই নিতে পারেনা আমার শ্রম তাহলে সার্থক জ্ঞান করব এবং আমি খুশী হব।
জনতার এক তরফ থেকে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে—এটা খুঁড়ছিলেন কেন? কোনো স্বপ্ন টপ্ন পেয়েছেন নাকি?
আমি লোকটার দিকে একটু তাকালাম, তারপর ঘাড় নেড়ে বললাম—না, যা ভাবছেন তা নয়। পাথরটাকে রাস্তার এক নিরাপদ কোণে স্থাপিত করা গেল। কিন্তু আমার কথায় যেন ওর প্রত্যয় হলো না, কয়েকবার আপনমনে মাথা নেড়ে সে আবার প্রশ্ন করলে—সত্যি বলছেন পাননি, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ?
—কিচ্ছু না।
লোকটার কৌতূহলকে একেবারে দমিয়ে দিয়ে ওপরে এসে মাকে বললাম, দু’কাপ চা তৈরী করতো আমার জন্যই দু’ কাপ পাথরটার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে কাতর হয়ে পড়েছিলাম প্রায় প্রস্তরীভূত হয়ে গেছলাম, বলতে কি!
এরপর প্রায়ই বাড়ি থেকে বেরুতে এবং বেড়িয়ে ফিরতে নুড়িটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় অনেক সময় হয় না, যখন অন্যমনস্ক থাকি। এখন ওকে আমি সর্বান্তঃকরণে মার্জনা করতে পেরেছি, কেননা আমাকে অপদস্থ করার ক্ষমতা ওর আর নেই। সে-দৈবশক্তি ওর লোপ পেয়েছে।
আমাদের মধ্যে একরকম হৃদ্যতা জন্মেছে এখন বলা যেতে পারে। এমন সময়ে অকস্মাৎ একদিন দেখলাম নুড়িটার কান্তি ফিরেছে, ধুলোবালি মুছে গিয়ে দিব্য চাকচিক্য দেখা দিয়েছে। যারা সকালে বিকালে হোস পাইপে রাস্তায় জল ছিটোয়, বোঝা গেল, তাদেরই কারুর স্নেহদৃষ্টি এর ওপর পড়েছিল। ওর চেহারার শ্রীবৃদ্ধি দেখে সুখী হলাম।
–ব্যাপার কিরকম বুঝচেন?
হঠাৎ পেছন থেকে প্রশ্নাহত হয়ে ফিরে তাকালাম সেদিনের সেই অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোক।
জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি কি সেই থেকে এখানে পাহারা দিচ্ছেন নাকি? না, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ পেলেন?
–না, তা কেন? এই পথেই আমার যাতায়াত কিনা।
ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হন, কিন্তু অল্পক্ষণেই নিজেকে সামলে নিতে পারেন।
–নুড়িটা দেখছি আছে ঠিক। কেউ নেবে না—কি বলেন?
প্রশ্নটা এইভাবে করলো যেন যে-রকম দামী জিনিসটা পথে পড়ে আছে অমন আর ভূভারতে কোথাও মেলে না এবং ওর গুপ্তশত্রুর দল ওটাকে আত্মসাৎ করবার মতলবে ঘোরতর চক্রান্তে লিপ্ত ছোঁ মেরে লুফে নেবার তালে হাত বাড়িয়ে সবাই যেন লোলুপা আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানালাম—না, না, আপনার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারত, সরকার বাহাদুর তাদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে রাঁচির অতিথিশালায় সযত্নে রেখে দিয়েছেন, তাছাড়া, আপনি নিজেই যখন এদিকে কড়া নজর রেখেছেন তখন তো চিন্তা করার কিছু দেখিনে।
সে একটু হেসে বলল—আপনার যেমন কথা! দেখেছেন এদিকে কারা ওর পূজার্চনা করে গেছে?
ভালো করে নিরীক্ষণ করি—সত্যিই, দেখিনি তো, এক বেলার মধ্যেই কারা এসে পাথরটার সর্বাঙ্গে বেশ করে তেলসিঁদুর লেপে দিয়ে গেছে।
আমি আনন্দ প্রকাশ করলাম—ভালোই হয়েছে। এতদিনে তবু ওর কান্তি ফিরলো এবং আরেকটি সমঝদার জুটলো!
পাথরটার সমাদরে পুলকিত হবার কথা, কিন্তু লোকটিকে বেশ ঈর্ষান্বিত দেখলাম। কপাল কুঁচকে সে বললে—সেই তো ভয়! সেই সমঝদার না ইতিমধ্যে ওটিকে সরিয়ে ফ্যালে!
পরদিন সকালে উঠে দেখি কোথাও পাথরটার চিহ্নমাত্র নেই। ওর এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশ্চর্য হলাম খুব। কে ওটাকে নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল, ইত্যাকার নানাবিধ প্রশ্নের অযাচিত উদয় হলো মনে কিন্তু সঠিক সদুত্তর পাওয়া গেল না। পাথরটার এরূপ অনুপস্থিতিতে এই পথে হরদম যাতায়াতকারী সেই লোকটি যে প্রাণে বেজায় ব্যথা পাবে অনুমান করা কঠিন নয়। একথা ভেবে লোকটার জন্য একটু দুঃখই জাগলো—কিম্বা, এ সেই তত্বজিজ্ঞাসুরই কর্মযোগ?
অনেকদিন পরে গলির মোড়ের অশথতলা দিয়ে আসছি—ও হরি! এখানে নুড়িটাকে নিয়ে এসেছে যে! নুড়ির স্কুল অঙ্গটা গাছের গোড়ায় এমন ভাবে পুঁতেছে যে, উপরের উদ্ধৃত গোলাকার নিটোল মসৃণ অংশ দেখে শিবলিঙ্গ বলে ওকে সন্দেহ হতে পারে। এই প্রয়োগনৈপুণ্য যার, তাকে বাহাদুরি দিতে হয়। নুড়িটার চারিদিকে ফুল বেলপাতা আতপচালের ছড়াছড়ি। সকালের দিকে এই পথে যে সব পুণ্যলোভী গঙ্গাস্নানে যায়, তারাই ফেরার পথে সস্তায় পারলৌকিক পাথেয় সঞ্চয়ের সুবর্ণসুযোগরূপে একে গ্রহণ করেছে সহজেই বোঝা গেল। যাই হোক, মহাসমারোহেই ইনি এখানে বিরাজ করছেন—অতঃপর এঁর সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কারু দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ নেই।
নুড়িটার এই পদোন্নতিতে আন্তরিক খুশি হলাম আমি একদিন ওকে মুক্তি দিয়েছি, এখন সবাইকে ও মুক্তি বিতরণ করতে থাক—ওর গৌরব, সে তো আমারই গর্ব। পৃথিবীর বুকে ওর জন্মদাতা আমি, এইজন্য মনে মনে পিতৃত্বের একটা পুলক অনুভব না করে পারলাম না! এবং কায়মনোবাক্যে ওকে আশীর্বাদ করলাম।
সেই লোকটাকে তার দেবতার সন্ধান দেব কিনা মাঝে মাঝে ভেবেছি। পথে ঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু পাথরটার কথা ও আর পাড়ে না। পাথরটার পলায়নে ভেবেছিলাম ও মুহ্যমান হয়ে পড়বে, কিন্তু উলটে ওকে প্রফুল্লই দেখা গেল। এত বড় একটা বিচ্ছেদ-বেদনা যখন ও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তখন আর ওকে উতলা করে তোলায় কি লাভ।
মাঝে মাঝে অশথতলার পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরি, লক্ষ্য করি, দিনকের দিন নুড়িটার মর্যাদা। বাড়ছে। একদিন দেখলাম, গোটাকতক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা গেড়েছে, গাঁজার গন্ধ এবং ববমবম শব্দের ঠেলায় ওখান দিয়ে নাক কান বাঁচিয়ে যাওয়া দুষ্কর। ঘ্রাণ এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের ওপরে দস্তুরমতই অত্যাচার।
যখন সন্ন্যাসী জুটেছে তখন ভক্ত জুটতে দেরি হবে না এবং ভক্তির আতিশয্য অনতিবিলম্বেই ইট-কাঠের মূর্তি ধরে মন্দিররূপে অভ্রভেদী হয়ে দেখা দেবো দেবতা তখন বিশেষভাবে বনেদী হবেন এবং সর্বসাধারণের কাছ থেকে তাঁর তরফে খাজনা আদায় করবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমী হয়ে দাঁড়াবে।
এর কিছুদিন পরে একটা চিনির কলের ব্যাপারে কয়েক মাসের জন্য আমাকে চম্পারণ যেতে হলো। অশথতলার পাশ দিয়ে গেলেও চলে, ভাবলাম, যাবার আগে দেবতার অবস্থাটা দেখে যাই। যা অনুমান করেছিলাম তাই, সন্ন্যাসীর সমাগমে ভক্তের সমারোহ হয়েছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের আলাপ আলোচনা অনুসরণে যা বুঝলাম তার মর্ম এই যে, ইনি হচ্ছেন। ত্রিলোকেশ্বর শিব, সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভু, একেবারে পাতাল ছুঁড়ে ফেঁপে উঠেছেন—এঁর তল নেই। অতএব এঁর উপযুক্ত সম্বর্ধনা করতে হলে এখানে একটা মন্দির খাড়া না করলে চলে না।
একবার বাসনা হলো, ত্রিলোকেশ্বর শিবের নিস্তলতার ইতিহাস সবাইকে ডেকে বলে দিই, কিন্তু জীবন-বীমা করা ছিল না এবং ভক্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে জানতাম, আর তা ছাড়া ট্রেনের বিলম্বও বেশি নেই ইত্যাদি বিবেচনা করে নিরস্ত হলাম। সেই লোকটাকে খবর না দিয়ে দেখলাম ভালোই করেছি, কেননা যতদূর ধারণা হয়, নুড়িটাকে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করাই তার অভিরুচি ছিল কিন্তু ইনি যে ভক্তের তোয়াক্কা না রেখেই স্বকীয় প্রতিভাবলে এবং স্বচেষ্টায় ইতিমধ্যেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন, এই সংবাদে সে পুলকিত কিম্বা মর্মাহত হতো বলা কঠিন।
কয়েক মাস বাদে যখন ফিরলাম তখন অশথতলার মোড়কে আর চেনাই যায় না। ছোটখাট একটা মন্দির উঠেছে, শঙ্খঘণ্টার আর্তনাদে কান পাতা দায় এবং ভক্তের ভিড় ঠেলে চলা দুরূহ। কিন্তু সে কথা বলছি না, সবচেয়ে বিস্মিত হলাম সেই সঙ্গে আরেক জনের আবির্ভাবে, কেবলমাত্র আবির্ভাব নয় কলেবর পরিবর্তন পর্যন্ত দেখো মন্দিরের চত্বরে সেই লোকটা—প্রথমতম, সেই আদি ও অকৃত্রিম উপাসকগেরুয়া, তিলক এবং রুদ্রাক্ষের চাপে তাকে আর চেনাই যায় না এখন!
—এ কি ব্যাপার?
আমিই গায়ে পড়ে প্রশ্ন করলাম একদিন।
—আজ্ঞে, এই দীনই শিবের সেবায়েত।
লোকটি বিনীত ভাবে জবাব দেয়।
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দিব্যি বিনিপুঁজির ব্যবসা ফাঁদা হয়েছে। এই জন্যেই বুঝি পাথরটার ওপর অত করে নজর রাখা হয়েছিল?
শিলাখণ্ডের প্রতি ওর প্রীতিশীলতা যে অহেতুক এবং একেবারেই নিঃস্বার্থ ছিল না, এইটা জেনেই বোধ করি অকস্মাৎ ওর ওপর দারুণ রাগ হয়ে যায়, ভারি রূঢ় হয়ে পড়ি।
কানে আঙুল দিয়ে সে বলল—অমন বলবেন না। পাথর কি মশাই? শ্রীবিষ্ণু! সাক্ষাৎ দেবতা যে। ত্রিলোকেশ্বর শিব!
উদ্দেশে সে নমস্কার জানায়।
আমি হেসে ফেললাম—ওর তল নেই, না?
এবার সে একটু কুষ্ঠিত হয়—ওরাই তো বলো
—তুমি নিজে কী বলো? ওরা তো বলে নিচে যতই কেন খুঁড়ে যাও না, টিউব-কলের মত ওই শিবলিঙ্গ বরাবর নেমে গেছে। কিন্তু তোমার কী মনে হয়?
–কী জানি! তাই হয়তো হবে।
কতদূর শেকড় নেবেছে খুঁড়ে দেখই না কেন একদিন?
জিভ কেটে লোকটা বলল—ওসব কথা কেন, ওতে অপরাধ হয়। বাবা রাগ করবেন—উনি আমাদের জাগ্রত।
–বটে? কিরকম জাগ্রত শুনি?
—এই ধরুন না কেন! এবার তো কলকাতায় দারুণ বসন্ত, টিকে নিয়ে কিছু করেই কিছু হচ্ছে না—
—য়্যাঁ, বলো কি, মহামারী নাকি, জানতাম না তো!
—খবরের কাগজেই দেখবেন কিরকম লোক মরছে। কর্পোরেশন থেকে টিকে দেবার ত্রুটি নেই অথচ প্রত্যেক পাড়াতেই কিন্তু আমাদের পাড়ায় এ-পর্যন্ত কারু হয়নি দেবতার কৃপায়। আমরা কেউ টিকেও নিইনি, কেবল বাবার চন্নামেত্ত খেয়েছি। এ যদি জাগ্রত না হয় তবে জাগ্রত আপনি কাকে বলেন?
এবার কি জবাব দেব তা চিন্তা করবার সময় ছিল না। আগে একবার এই রোগে যা কষ্ট পেয়েছিলাম এবং যা করে বেঁচেছিলাম তাতে বাবা ত্রিলোকনাথের মহিমা তখন আমার মাথায় উঠেছে। ‘আমি এখন চললুম। আমাকে এক্ষুনি টিকে নিতে হবে আরেকদিন এসে গল্প করব।’ বলে আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশে ধাবিত হলাম।
পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা দাঁড় করিয়ে সে বললে—আরে, কোথায় চলেছো এমন হন্যে। হয়ে?
—টিকে নিতে।
—টিকে নিয়ে তো ছাই হচ্ছে। টিকেয় কিসসু হয় না তুমি বরং দু’শ শক্তির ভেরিওলিনাম এক ডোজ খাও গে, কিং কম্পানির থেকে—যদি টিকে থাকতে চাও! পরের হপ্তায় ঐ আরেক ডোজ, তারপরে আরেকব্যাস, নিশ্চিন্দি। টিকে ফেল করেছে আকচার দেখা যায়, কিন্তু ভেরিওলিনাম নেভার!
–বলো কি? জানতাম না তো!
—জানবে কোত্থেকে? কেবল ফোঁড়াখুঁড়ি এই তো জেনেছো! অন্য কিছুতে কি আর তোমাদের বিশ্বেস আছে? আমি হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস ধরেছি, আমি জানি
—বেশ, তাই খাচ্ছি না হয়।
কিং কম্পানিতে গিয়ে এক ডোজ দু’শ শক্তির ভেরিওলিনাম গলাধঃকরণ করলাম। যাক, এতক্ষণে অনেকটা স্বচ্ছন্দ হওয়া গেল। হালকা হতে পারলাম।
এর পরেই পথ দিয়ে উপরি-উপরি কয়েকটা শবযাত্রা গেল নিশ্চয়ই এরা বসন্ত রোগেই মরেছে? কী সর্বনাশ, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে, ওদের থেকে এইভাবে কত লক্ষ লক্ষই না বীজাণু আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। ভেরিওলিনাম রক্তে পৌঁছতে না পৌঁছতেই এতক্ষণে এই সব মারাত্মক রোগাণুর কাজ শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়! হাত পা সিঁটিয়ে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসে—এই বিপদসংকুল বাতাসের নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
অতি সংক্ষিপ্ত এক টুকরো প্রাচীরপত্রে বিখ্যাত বসন্ত চিকিৎসক কোন এক কবিরাজের নাম দেখলাম। হোমিওপ্যাথি করা গেছে, কবিরাজিই বা বাকি থাকে কেন—যে উপায়েই হোক সবার আগে আত্মরক্ষা। বিজ্ঞাপিত ঠিকানায় পৌঁছতেই দেখলাম কয়েকজন মিলে খুব ধুমধাম করে প্রকাণ্ড একটা শিলে কী যেন বাঁটছেন। কবিরাজকে আমার অবস্থা বলতেই তিনি আঙুল দেখিয়ে বললেন—ওই যে বাঁটা হচ্ছে। কন্টিকারির শেকড় বেঁটে খেতে হয়। ওর মত বসন্তের অব্যর্থ প্রতিষেধক আর কিছু নেই মশাই!
ব্যবস্থামত তাই এক তাল খেয়ে রিক্সা ডেকে উঠে বসা গেল। গায়ে যেন জোর পাচ্ছিল।ম না, মাথাটা ঝিমঝিম করছিল, জ্বর-জ্বর ভাব—বসন্ত হবার আগে এই রকমই নাকি হয়ে থাকে। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম—আজ আর কিছু খাব না, মা। দেহটা ভালো নয়।
উদ্বিগ্ন মুখে মা বললেন–কী হয়েছে তোর?
–হয়নি কিছু বোধহয় হবে!…বসন্ত।
–বালাই ষাটা বলতে নেই। তা কেন হতে যাবে? এই হর্তুকির টুকরোটা হাতে বাঁধ দিকি। আমি তিরিশ বছর বাঁধছি, এই হাতে বসন্ত রোগীই তো ঘাঁটলাম, সেবা করলাম, কিন্তু বলতে নেই, এরই জোরে কোনোদিন হাম পর্যন্ত হয়নি— নে ধর এটা তুই।
মা তাঁর হাতের তাগাটা খুলে দিলেন।
–তিরিশ বছরে একবারো হয়নি তোমার? বলো কি? দাও, দাও তবে। এতক্ষণ বলোনি কেন? কিন্তু এই একটুকরোয় কি হবে? রোগ যে অনেকটা এগিয়ে গেছে। আমাকে আস্ত একটা হর্তুকি দাও যদি তাতে আটকায়।
হর্তুকি তো বাঁধলুম, কিন্তু বিকালের দিকে শরীরটা বেশ ম্যাজম্যাজ করতে লাগলো। নিজেকে রীতিমত জ্বরজড়িত মনে হলো। আয়না নিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম, মুখেও যেন দু’একটা ফুসকুড়ির মতো দেখা দিয়েছে। নিশ্চয়ই বসন্ত, তবে আর বাঁচন নেই, মাকে ডেকে দেখালামা
মা বললেন—মার অনুগ্রহ–নয় ব্রণ।
আমি বললাম—উঁহু। ব্ৰণ নয়, নিতান্তই মার অনুগ্রহ!
মা বললেন—অলক্ষুণে কথা মুখে আনিস নো ও কিছু না, সমস্ত দিন ঘরে বসে আছিস, একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে আয় গে।
এরকম দারুণ ভাবনা মাথায় নিয়ে কি বেড়াতে ভালো লাগে? লোকটা বলছিল, ওরা সবাই চরণামৃত খেয়ে নিরাপদ রয়েছে। আমিও তাই খাবো নাকি? হয়তো বা চরণামৃতের বীজাণুধ্বংসী কোনো ক্ষমতা আছে, নেই যে, তা কে বলতে পারে?…হ্যাঁঃ ওর যেমন কথা! ওটা স্রেফ অ্যাকসিডেন্ট কলকাতার সব বাড়িতেই কিছু আর অসুখ হচ্ছে না। তাছাড়া মনের জোরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি জন্মায়—মারীরও যেখানে মার—সেই মনের জোরই ওদের পক্ষে একটা মস্ত সহায়—কিন্তু ওই যৎসামান্য পাথরটাকে দেবতাজ্ঞান করার মতো বিশ্বাসের জোর আমি পাবো কোথায়?
এ সব যা-তা না করে সকালে টিকে নেওয়াই উচিত ছিল, হয়তো তাতে আটকাতো। এখুনি গিয়ে টিকেটা নিয়ে ফেলব নাকি? টিকে নিলে শুনেছি বসন্ত মারাত্মক হয় না, বড় জোর হাম হয়ে দাঁড়ায়। আর হামে তেমন ভয়ের কিছু নেই—ও তো শিশুদের হামেশাই হচ্ছে। নাঃ, যাই মেডিকেল কলেজের দিকেই বেরিয়ে পড়ি।
টিকে নিয়ে অশথতলার পাশ দিয়ে ফিরতে লোকটার সকালের কথাগুলো মনে পড়ল। হয়তো ঠিকই বলেছে সে সত্যিই এক জায়গায় গিয়ে আর কোনো জবাব নেই, সেখানে রহস্যের কাছে মাথা নোয়াতেই হয়। এই তো আজ বেঁচে আছি, কাল যদি বসন্তে মারা যাই তখন কোথায় যাবো? শেকসপীয়ারের সেই কথাটা—সেই স্বর্গমর্ত-হোরাশিও-একাকার-করা বাণী—না, একেবারে ফেলনা নয়। এই পৃথিবীর, এই জীবনের, সুদূর নক্ষত্রলোক এবং তার বাইরেও বহুধা বিস্তৃত অনন্ত জগতের কতটুকুই আমরা জানি? কটা ব্যাপারেই বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারি? যতই বিজ্ঞানের দোহাই পাড়ি না কেন, শেষে সেই অজ্ঞেয়ের সীমান্তে এসে সব ব্যাপারীকেই নতমুখে চুপ করে দাঁড়াতে হয়।
মন্দিরের সম্মুখ দিয়ে আসতে ত্রিলোকনাথের উদ্দেশে মনে মনে দণ্ডবৎ জানালামা প্রার্থনা করলাম, বাবা, আমার মূঢ়তা মার্জনা করো, মহামারীর কবল থেকে বাঁচাও আমাকে এযাত্রা।
খানিক দূর এগিয়ে এসে ফিরলাম আবার। নাঃ, দেবতাকে ফাঁকি দেওয়া কিছু নয়। মুখের ফুসকুড়িগুলো হাত দিয়ে আঁচ করা গেল—এগুলো ব্রণ, না বসন্ত?
এবার মাটিতে মাথা লুটিয়ে প্রণাম করলাম। বললাম—জয় বাবা ত্রিলোকনাথ! রক্ষা করো বাবা! বম বম!
উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখলাম কেউ দেখে ফ্যালেনি তো?
লাভের বেলায় ঘন্টা
ঘাটশিলার শান্তিঠাকুর বলেছিলেন আমায় গল্পটা… ভারি মজার গল্প।
দারুণ এক দুরন্ত ছেলের কাহিনী…
যত রাজ্যের দুষ্টবুদ্ধি খেলত ওর মাথায়। মুক্তিপদ ছিল তার নাম, আর দুষ্টুমিরাও যেন পদে-পদে মুক্তি পেত ওর থেকে। আর হাতে-হাতে ঘটত যত অঘটন!
এই রকম অযথা হস্তক্ষেপ আর পদক্ষেপের ফলে একদিন যা একটা কান্ড ঘটল…
গাঁয়ের শিবমন্দিরের ঘণ্টাটার ওপর ওর লোভ ছিল অনেক দিনের।
শিবঠাকুরের মাথার ওপর ঘণ্টাটা থাকত ঝোলানো। শিবরাত্রির দিন ওটাতে দড়ি বেঁধে দেওয়া হত। ভক্তরা সেই দড়ি ধরে টান মেরে একবার করে বাজিয়ে যেত ঘণ্টাটা।
কী মিষ্টি যে ছিল তার আওয়াজ!
শিবরাত্রির পর্ব ছাড়া আর কোনোদিন ওটা বাজানো হত না কিন্তু।
শিবঠাকুরের পাশেই ছিলেন পার্বতী দেবী। তাঁর মাথায় ঝকমক করত সোনার মুকুট। কিন্তু সেদিকে মুক্তিপদের মোটেই নজর ছিল না।
মুক্তিপদ তক্কে তক্কে থাকত কী করে ঘণ্টাটা হাতানো যায়।
একদিন সে দেখল পুজারি ঠাকুর কোথায় যেন বেরিয়েছে, মন্দির ফাঁকা পড়ে। চারধারে কেউ কোথ্থাও নেই।
সুবর্ণসুযোগ জ্ঞান করে সে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে সেঁধুল।
কিন্তু হাত বাড়িয়ে দ্যাখে যে ঘণ্টাটা তার নাগালের বাইরে। যদ্দূর তার হাত যায়, তার থেকেও এক হাত ছাড়িয়ে উপরে রয়েছে ঘণ্টাটা।
ওটাকে পাড়ার জন্য সে তাই শিবলিঙ্গের মাথার ওপরে খাড়া হল।
কিন্তু তখনও সেটাকে হাত দিয়ে পাকড়ানো যায় না, আঙুলে ঠেকে, কিন্তু মুঠোর মধ্যে আনা যায় না ঘণ্টাটাকে।
ভারি মুশকিল তো! কিন্তু এ কী…! শিবের মাথায় চড়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটল সেই অঘটনটা!
স্বয়ং শিবঠাকুর তার সম্মুখে আবির্ভূত! মুক্তিপদর পদক্ষেপেই দেবাদিদেব মুক্তি পেলেন নাকি?
‘বৎস, তোমার ভক্তিতে আমি প্রীত হয়েছি, তুমি বর প্রার্থনা করো।’
‘অ্যাঁ?’ হকচকিয়ে গেছে মুক্তিপদ।
‘ভয় খেয়ো না। তুমি কি আমায় চিনতে পারছ না?’
‘চিনব না কেন? তুমি শিবঠাকুর। দেখেই টের পেয়েছি। পটে দেখেছি তো। পটের সঙ্গে বেশ মিলে যায়।’
‘তোর মতন ভক্ত আর হয় না।’ শিবঠাকুর বলেন, ‘লোকে আমার মাথায় ফুল বেলপাতা চড়ায়, তুই নিজেকেই আমার ওপর চড়িয়েছিস। তোর সবটাই দিয়েছিস আমায়। তোর মতন ভক্ত আমি দেখিনি। এখন বল্ তুই কী চাস?’
‘কী আবার চাইব!’ থতমত খেয়ে সে বলে।
‘রাজা হতে চাস তুই?’
‘রাজা!’
‘অনেক লোক-লস্কর নিয়ে বিরাট রাজ্যের অধীশ্বর হবার বাসনা আছে তোর?’
মুক্তিপদ ভাবতে থাকে।
‘সে ভারি ঝামেলা!’ ভেবেচিন্তে সে জানায়: ‘রাজা হতে আমার প্রাণ চায় না। রাজ্যি চালানো আমার কম্মো নয়। কী করে রাজ্য চালায় তাই আমি জানিনে!’
‘তা হলে কী চাস বল? পরমাসুন্দরী এক রাজকন্যে?’
‘রাজকন্যে নিয়ে আমি কী করব?’
‘কেন বিয়ে করে সুখে ঘরকন্না করবি? আবার কী?’
‘বিয়ে! এখনই আমি বিয়ে করব কী! আমার গোঁফ বেরয়নি এখনও। তুমি বলছ কী ঠাকুর?’
‘তা হলে হাতি ঘোড়া কী চাস বল্ তুই!’ বর দিতে এসে এমন বিড়ম্বনা শিবঠাকুরের বুঝি কখনও হয়নি।– ‘আমি তোকে বর দিতে চাই। বর না দিয়ে আমি ছাড়ব না।’
‘হাতি ঘোড়া কি কেউ চায় নাকি আবার?’
‘টাকাকড়ি ধনদৌলত?’
‘রাখব কোথায়? বাবা টের পেলে মারবে না? একবার বাবার একটা টাকা সরিয়েছিলাম, তাইতেই এমন একখানা চড় খেয়েছিলাম যে!… এখনও আমার মনে আছে বেশ। না, টাকাকড়ি আমার চাইনে।’
‘তোর দেখছি কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি নেই। মুক্তপুরুষ মনে হচ্ছে। তা হলে তুই কী চাস– ভক্তি, মুক্তি?’
‘সে তো আমার পাওয়া গো! আমার নামই মুক্তি। আর আমার বাবার নাম ভক্তিপদ– ভক্তি মুক্তি তো না-চাইতেই পেয়ে গেছি।’
‘তা হলে তুই হয়তো চাস, মনে হচ্ছে, ত্যাগ, বৈরাগ্য, তিতিক্ষা–‘
‘সে তো বিবেকানন্দরা চায়। পড়েছি বইয়ে। আমি বিবেকানন্দ হতে চাই না।’
‘ভালো ফ্যাসাদ হল দেখছি!’ মহাদেব নিজের জটাজূট চুলকোন। ছেলেরা কী চাইতে পারে, কী তাদের চাওয়ানো যায়, কিছুই তিনি ভেবে পান না।
নিজের ছেলেবেলায় কী সাধ ছিল তাঁর? তাও কিছু তাঁর স্মরণ নেই এখন। সেই সুদূর অতীত বাল্যকালের কথা তাঁর মনেই পড়ে না আর। কবে যে তিনি দুগ্ধপোষ্য বালক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কি না কখনো– কিছুই তাঁর ঠাওর হয় না।
কী চাইতে পারে ছেলেটা? কী পছন্দ হতে পারে ছেলেটার? তিনি খতিয়ে দেখতে যান। তাঁর আর তার টান সমান হবার কথা নয়। আদ্যিকালের তিনি আর সেদিনকার এই ছোঁড়ার রুচি কি এক হবে? যে বস্তু তার প্রিয় ওর কাছে হয়তো তা মূল্যহীন। ছেলেটা এই বয়সেই চোখে ধুতরো ফুল দেখতে রাজি হবে কি? বিল্বফলের জন্যেও সাধ করে হাত বাড়াবে না নিশ্চয়?
মাথায় হাত দিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। কূল-কিনারা পান না কিছু।
হঠাৎ নিজের কপালের চাঁদে তাঁর হাত ঠেকে যায়। হাতে যেন চাঁদ পান তখন।
‘এই চাঁদ?’ তিনি উচ্ছ্বসিত হন– ‘এই চাঁদখানা তুমি পেতে চাও নিশ্চয়? এমন চাঁদ পাবার সাধ হয় না তোমার?’
প্রস্তাবটা শুনে মুক্তিপদ নাক সিঁটকোয়। চাঁদ নিয়ে সে কী করবে? মা যেমন খোঁপায় চুলদের আটকে রাখার জন্য চিরুনি লাগান, শিবঠাকুর তেমনি নিজের জটাজূট সামলাতে ঐ চাঁদটাকে লাগিয়েছেন।
মুক্তিপদর তো ঝাঁকড়া চুলের বালাই নেই, দিব্যি ব্যাক-ব্রাশ চুল তার। চাঁদকে মাথায় করে রাখবার শখ নেইকো মোটেই। চাঁদ না হয়ে চন্দ্রপুলি হলে না হয় দেখা যেত।
‘ও তো আধখানা চাঁদ, ও নিয়ে আমি কী করব? আপনি বুঝি আমায় অর্ধচন্দ্র দিচ্ছেন? ঘুরিয়ে অপমান করছেন আমায়?’ ফোঁস করে ওঠে সে– ‘আপনি সোজাসুজিই বলতে পারতেন, আমার মন্দির থেকে বেরিয়ে যাও।’
‘না না। তা বলব কেন? তা কি বলতে আছে?’ শিবঠাকুর শশব্যস্ত হন– ‘এত বড় ভক্ত তুমি আমার। তোমাকে আমি অমন কথা বলতে পারি কখনো? ভক্তাধীন ভোলানাথ, শোননি নাকি কথাটা?’
‘তাই বলুন!’
‘আমি ভাবছিলাম চাঁদের টুকরোটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে তুমি দেখতে যদি একবারটি। আর যদি তোমার পছন্দ হত…’
‘চাঁদে হাত দিতে যাব কেন আমি? আমি কি বামন নাকি যে…? বামনরাই তো চাঁদের দিকে হাত বাড়ায়। আমি বেশ ঢ্যাঙা, দেখছ না? এর মধ্যেই পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি। বাবা বলেছেন, আরো আমি ঢ্যাঙা হব। আমাদের বংশে সবাই নাকি তালগাছ!’
‘তা হলে তো তুমি এমনিতেই চাঁদ পাবে। তালগাছের মাথাতেও চাঁদ থাকে। দেখা যায় প্রায়। দেখোনি তুমি?’
‘পুকুরের জলের মধ্যেও দেখেছি। ডোবার মধ্যেও আবার।’
‘চাঁদের সঙ্গে আমাকেও তুমি ডোবালে দেখছি! ভারি ফ্যাসাদে ফেললে আমায়। বর দেব বলে কথা দিয়েছি, অথচ কিছুই তোমায় দিতে পারছি না। কিছুই তুমি চাও না। অথচ দিতেই হবে আমায় কিছু। না দিয়ে উপায় নেই। নইলে আমার কথাটা মিথ্যে হয়ে যায়। মিথ্যে কথা আমি বলি না আবার। কী মুশকিলে যে পড়লাম! আচ্ছা, তুমি কি কিছু খেতে চাও?’
খাবারের কথায় তার উৎসাহ দেখা দেয়– ‘কী খাওয়াবেন বলুন?’
‘কী খাওয়ানো যায় তোমায় ভাবচি তাই।’ শিবঠাকুর বলেন– ‘সত্যি বলতে, আমাকেই সবাই ভোগ দেয়, আমি কখনো কাউকে ভোগ দিইনি কোনো। এমনকি তোমার ওই পার্বতী ঠাকরুনকেও না। তোমার ভোগে কী লাগতে পারে ভেবে দেখি এখন…।’ তিনি ভাবতে থাকেন।
‘তারকেশ্বরের ডাব?’ হাতের কাছে প্রথমেই তিনি ডাবটা পান, সেটাই পাড়েন সবার আগে।
‘ডাব? ডাব কেন? আপনার সঙ্গে আমার তো আড়ি হয়নি যে ডাব দিয়ে ভাব পাতাতে হবে?’
‘তা হলে বৈদ্যনাথধামের প্যাঁড়া?… কাশীর মালাই-লচ্ছি? কৈলাসের ভাং?’
‘ভাংটা কী জিনিস?’ জানতে চায় মুক্তিপদ।
কিন্তু মহাদেব ওর বেশি ভাঙতে যান না। ছোট্ট ছেলের কাছে নেশার কথা পাড়াটা ঠিক হবে না তাঁর মনে হয়।– নন্দী ভৃঙ্গী ঘোঁটে, তারাই বানায়, তারাই জানে কী জিনিস।
তারপর ঘুরিয়ে বলেন কথাটা ‘ভাং মানে, এই সিদ্ধি আর কি– শুদ্ধ ভাষায়। তুমি কি সিদ্ধিলাভ করতে চাও?’
‘একদম না। ও তো সাধক লোকেরা চায়। আমি কি সাধক? যোগী ঋষি আমি? তাহলেও শুনি তো–‘
‘আমি খাই কেবল। মানে, আমি পান করি মাত্র।’
‘খেতে কেমন? সিরাপের মতন কি? আখের রস যেমনধারা হয়ে থাকে? খেতে মিষ্টি হলে দিতে পারেন আমায়।’
‘না, তা খেয়ে তোমার কাজ নেই। পানীয় তো আর খাদ্য নয়। ওতে পেট ভরে না। তোমাকে আর কী দেওয়া যায় দেখছি…’ মনে মনে তিনি দিগ্ধিদিক ঘোরেন, যে খাবারগুলো তার দিব্যনেত্রে দেখতে পান, আউড়ে যান…
‘মালদেহের খাজা খাবে? কেষ্টনগরের সরভাজা? বর্ধমানের মিহিদানা? রানাঘাটের ছানার জিলিপি? জনাইয়ের মনোহরা? পাঁশকুড়োর অমৃতি? নাটোরে দেদোমন্ডা…?’
‘গন্ডা গন্ডা?’ মুক্তিপদ বাধা দিয়ে জানতে চায়।
‘যত চাও! বাগবাজারের রসগোল্লা? ভীমনাগের সন্দেশ?…’ শিবঠাকুরের ফিরিস্তি আর ফুরোয় না: ‘চাই তোমার? কোনটা চাই বলো আমায়? না, সবগুলোই চাও তুমি?’
‘আমার জন্যে হয়রান হয়ে ঘুরে ঘুরে আপনি যোগাড় করবেন তা আমি চাই না, আপনার হাতের কাছে যা আছে তাই আমায় দিন।’
‘হাতের কাছে? পার্বতী দেবীর ঐ স্বর্ণমুকুটটা চাও বুঝি?’ তিনি দেবীর দিকে হাত বাড়ান।
‘না না। সোনার মুকুট নিয়ে আমি কী করব? ওটা তো পরাও যাবে না। পরতে গেলে লাগবে আমার মাথায়। তা ছাড়া মুকুট পরে বেরুলে পাড়ার ছেলেরাই-বা বলবে কী?’
‘তা হলে কী তোমার চাই বলো তাই।’
‘আপনার মাথার ওপরে ঐ যে ঘণ্টা। ওটাই আমি চাই– ওইটে আমায় পেড়ে দিন।!’
‘বাঁচালে!’ বলে হাঁপ ছেড়ে মহাদেব ওর হাতে ঘণ্টাটা তুলে দেন। দিয়েই অন্তর্ধান হন।
মুক্তিও ঘণ্টাটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসে।
ঘণ্টাটা তাকে কষ্ট করে বাজাতেও হয় না। ওর লাফঝাঁপের দাপটে সেটা আপনিই বাজতে থাকে।