লোকটা চুপ করে থাকে।
আমার একটু একটু করে জেদ চাপছে।
‘আচ্ছা, চিন্তা করে দেখেছেন, আপনার এই কল্পজগৎ সব সময় পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়ম নিখুঁতভাবে মেনে চলছে। নিউটনের বলবিদ্যা মানছে, থার্মোডাইনামিক্সের সব নিয়ম মানছে, ম্যাক্সওয়েল মানছে, আপনি যেসব নিয়ম-সূত্র এখনো জানেন না, সেগুলোও সবই মানছে। কেন মানছে?’
‘জানি না কেন মানছে।’
‘এই যে এখানে এই কাঠের পেপার ওয়েট। এটা আমি গত বৈশাখি মেলায় কিনেছি। এটা এই যে হাতে তুলে নিলাম। এখন আমি যদি এটা ছেড়ে দিই, এটা ভেসে থাকবে না। মাটিতে পড়ে যাবে। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মানবে এটা। আপনার কথা অনুযায়ী, এটা তো বস্তু নয়, একটা স্বপ্নের উপাদান। মাধ্যাকর্ষণের নিয়ম মানার কোনো বাধ্যবাধকতা তো নেই এটার। আছে? এই যে দেখুন। লক্ষ করুন।’
আমি পেপার ওয়েটটা ছেড়ে দিলাম। ঠকাস শব্দে সেটা মেঝেতে পড়ে গেল।
লোকটা চমকে উঠল। আমিও একটু চমকালাম। টের পেলাম আমি কিছুটা বেপরোয়া আচরণ করছি। পেপার ওয়েট তুলে আমি টেবিলে রেখে দিলাম।
লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘আমি কি এখন উঠব?’
‘হ্যাঁ। উঠবেন। আমার আসলেই তাড়া আছে। তবে আপনি কাল আবার আসবেন। আমার মনে হয়, আমাকে দরকার হবে আপনার।
‘নিউরোলজিস্টের কাছে যাব না?’ লোকটার কণ্ঠে কোথায় যেন একটা কৌতুক।
‘না, যাবেন না। আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন।’
লোকটা ওঠে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমরা হ্যান্ডশেক করি।
‘আমি অপেক্ষা করব। সিরিয়াল দিতে হবে না। আমি বলে রাখব। আসবেন, কেননা আপনি চলে গেলেও কিন্তু এই ঘরটা এ রকমই থাকবে।’
লোকটা দরজার দিকে পা বাড়ায়।
‘আপনি ছাতা এনেছেন?’
‘না।’
‘বাইরে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘আমি ভিজব না,’ বলল লোকটা, ঠোঁটে এমন এক লুকানো কৌতুক নিয়ে বলল, যেন কথাটার মধ্যে গভীর কোনো তাৎপর্য আছে।
লোকটা দরজার হাতলে হাত রেখেছে।
একবার, সেকেন্ডের একটা ভগ্নাংশের তরে মনে হলো আমার মনের কোথাও কেউ যেন খুব করে চাইছে, লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে না যাক। লোকটা যাওয়ামাত্র কোথাও কিছু একটা বদলে যাবে।
লোকটা চলে গেল।
এতক্ষণে সিনেমা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আমি দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। ড্রাইভারকে ফোন দিচ্ছি। ধরে না। গাড়ির ভেতর। ঘুমিয়ে গেছে বোধ হয়।
আমি দ্রুত ব্যাগটা কাঁধে নাই।
দরজার দিকে পা বাড়াই।
এ সময় একটা ঘটনা ঘটে।
আমার ব্যাগের একটা প্রান্ত গিয়ে লাগে টেবিলের ওপর রাখা পেপার ওয়েটের গায়ে। পেপার ওয়েটটা টেবিল থেকে গড়িয়ে যায়।
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
টেবিলের প্রান্ত পেরিয়ে গেলেও পেপার ওয়েটটা মেঝেতে পড়েনি।
কোনো অবলম্বন ছাড়া সেটা শূন্যে ভেসে আছে।
০৩. দুই শিল্পী
আমরা দুজন মিলে একটা ছবি আঁকছি। একটা ক্যানভাসে। আমরা দুই শিল্পী। আমাদের মধ্যে অমিলের শেষ নেই। দুটি ভিন্ন জগতে আমাদের অবস্থান। দুটি সমান্তরাল মহাবিশ্বে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কারণ, দুটি মহাবিশ্বের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কোনো এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে না দুই জগতের মধ্যে। কোনো টেলিযোগাযোগব্যবস্থা নেই। কোনো ধরনের যোগাযোগ কোনো দিন সম্ভবও না।
আমার মহাবিশ্বটা এগারো মাত্রার। অপরটা কত মাত্রার, আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, ছবি আঁকার এই ক্যানভাস ছাড়া দুটি জগতের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। এই ক্যানভাস যেনবা একটা সুড়ঙ্গ, একটা রঞ্জু, দুটি জগৎকে যা বেঁধে রেখেছে। বেঁধে না রাখলে জগৎ দুটি ভেসে আরও দূরে দূরে চলে যেত কি না, আমি জানি না। কেননা অপর জগৎ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কেউই কিছু জানে না। কিছু জানা সম্ভবও নয়। আমাদের সকল বিবরণ কেবল আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্য প্রযোজ্য।
আমি শুধু এটুকু জানি, আমার স্টুডিওর একটা বিশেষ ক্যানভাসের তলে দুটি সমান্তরাল জগৎ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে। এ যেন দুই যমজের জন্মমুহুতের নাভিরজ্জ্ব বা অ্যাম্বিলিকাল কর্ড। কিন্তু এই নাভির মধ্য দিয়ে কিছুই বাহিত হয় না, কিছু রঞ্জক পদার্থ বা পিগমেন্ট আর কিছু অবয়ব ছাড়া।
দেখতে অতি সাধারণ, অতি তুচ্ছ একটা ছবি আঁকার ক্যানভাস। আয়তাকার। আকারে খুব বড়ও নয়। তিন ফুট বাই সাড়ে চার ফুট। আমার স্টুডিওর বেশির ভাগ ক্যানভাসই তা-ই। বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকতে পারি না আমি।
কেরোসিন কাঠের ফ্রেমের ওপর মোটা মার্কিন কাপড় মুড়ে বানানো ক্যানভাসটাকে আলাদা করার জো নেই। কাপড়ের ওপর দু-দফায় সাদা কোটিং দেওয়া হয়েছে। সবগুলোতেই দেওয়া হয়। সেই একই দোকান থেকে এটা কিনেছি আমি, অন্যগুলো যেখান থেকে কেনা।
যেদিন প্রথম তুলি ছোঁয়াই ক্যানভাসে, মাস চারেক আগে, সেদিন এমন না যে আমার মাথায় বিশেষ কোনো চিন্তা কাজ করছিল। আনমনা ছিলাম আমি। একটা ধোঁয়াটে অবয়ব, একটা আকারহীন চিন্তা পাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। কিন্তু ঠিক সেটাকেই যে ক্যানভাসে আকার দেব, এমন ভেবে ঠিক করিনি। প্রথম। কয়েকটা তুলির আঁচড় আমি পরিকল্পনাহীনভাবেই দিই। সেই আঁচড় থেকে জন্ম নিতে থাকে অবয়ব আর চিন্তা আর পরিকল্পনার বীজ। সব সৃজনশীল কাজের বেলাতেই নিশ্চয় তা-ই হয়। শুরুতে সব সৃষ্টি থাকে আকস্মিক, তারপর ধীরে ধীরে পরিকল্পনার পরত পড়তে থাকে তার ওপর। ঢাকা পড়ে যেতে থাকে আকস্মিকতা। একসময় মনে হয়, পুরোটাই পূর্বনির্ধারিত।