‘আমি জানি। এগুলো থেকে কোনোভাবেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু আমি সবটা তো বলিনি এখনো। এরপর আমার জীবনে আরও গভীর কিছু জটিলতা দেখা দিতে শুরু করল। এমন কিছু জটিলতা, যেগুলো একেবারে হতবুদ্ধি করে দেয়।’
‘যেমন?’
যেমন ধরুন, মাসুদ এসে একদিন উপস্থিত হলো আমাদের বাসায়।’ বলে লোকটা চুপ করে গেল। যেন এটুকু বললেই আমি বুঝে যাব ঘটনার জটিলতা। )
‘মাসুদ কে?’
‘মাসুদ আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমার প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসমেট। কলেজ জীবন শেষে সে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। সেখানেই বসবাস করে। মাঝে মাঝে ফোন দেয়।’
‘তো মাসুদ এলে সমস্যাটা কী?’
‘সমস্যাটা হলো, আমাদের বাসায় এসে উঠল প্রাইমারি স্কুলের মাসুদ। ক্লাস ফোরে পড়া মাসুদ। হাফপ্যান্ট পরা। বয়স নয় কী দশ বছর।’
‘মাই গড।’
‘সে এসে আমার সঙ্গে থাকছে। আমার সঙ্গে এক টেবিলে খাচ্ছে। গল্পগুজব করছে। যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে অস্ট্রেলিয়ার মাসুদ ফোন করে। চিন্তা করুন দৃশ্যটা। আমি কথা বলছি আমার সমবয়সী ক্লাসমেট মাসুদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। ঠিক সে সময় দশ-বারো বছরের ওই মাসুদই আমার সামনে দুষ্টুমি করছে। এ রকম একের পর এক জটিল সব ঘটনা আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিতে শুরু করল। আমি যুক্তিবাদী মানুষ। কিন্তু এগুলোর কোনো মাথামুণ্ডু পাই না।’
আমার কফি শেষ হয়ে গেছে। মগটা নামিয়ে রাখলাম।
‘তবু বলব, এ থেকে প্রমাণ হয় না আপনি স্বপ্ন দেখছেন।’
‘সারা রাত আলো নিভিয়ে আমি বারান্দায় পায়চারি করি। ওখানে একটা বেতের সোফা আছে। তাতে বসে থাকি। মাঝে মাঝে আমি কান পাতলে কিছু কথোপকথন শুনি। অস্পষ্ট। তবে ভালো করে শুনলে বোঝা যায়। একদল লোক কথা বলছে। আমার মাথার ভেতরেই যেন কথা বলছে তারা।’
‘কী বলছে?’
‘সব কথা বুঝতে পারি না। দুয়েকটা শব্দ বা বাক্যের খণ্ডাংশ কানে আসে। “ঘুম” “স্বপ্ন”–এই সব শব্দ কানে আসে। মনে হয়, লোকগুলো আমাকে ঘিরে আছে। আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। একদিন একটা লোক আরেকটা লোককে জিজ্ঞেস করল, ‘এভাবে কত দিন ঘুমাবে?’ আমি টের পাই..কীভাবে টের পাই–জানি না, তবে টের পাই, এরা কেউ কেউ চিকিৎসক। আমি কোনো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। এবং ঘুমিয়ে আছি। গভীর ঘুম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নটা পাতলা হয়ে গেলে, মানে ঘুমটা পাতলা হয়ে গেলে আমি চারপাশের সত্যিকার জগতের কিছু শব্দ শুনতে পাই। মানে, ওই যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমি অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম, সম্ভবত কোমায় চলে গেছি, এরপর আর ঘুম ভাঙেনি আমার। আমি হাসপাতালে অথবা নিজের বাসার বিছানায় ঘুমিয়ে আছি। এইটাই সবকিছুর একমাত্র ব্যাখ্যা।’
লোকটা দম নেয়। কফির মগ রেখে পেছনে গা এলিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে সে যেন কিছুটা ক্লান্ত। প্রশ্নবোধক দষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি গলা খাঁকারি দিই। চেয়ার থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নিচে রাতের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এখনো ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে।
‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন না। এই জগক্টা ইস্যুশন নয়। খুব সহজ কয়েকটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন।
লোকটা অপেক্ষা করে।
‘অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া।’
‘মানে?’
‘আপনিই বলুন, কী মানে শব্দটার।’
‘আমি জানি না।’
‘অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া হলো এক বিশেষ ধরনের কালার ব্লাইন্ডনেস। এটা হলে লোকে কিছু বিশেষ কালার বা রং পিরসিভ করতে পারে না।’
‘কিন্তু এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’
‘সম্পর্ক নেই। আমি সেটাই তো বলছি। সম্পর্ক নেই। কথা হলো অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া শব্দটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটা জটিল। জারগন। আপনার এই শব্দ জানার কিংবা এর আগে শোনার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। তাহলে যে স্বপ্ন আপনি দেখছেন, সেই স্বপ্নের ভেতর এই শব্দটা উচ্চারিত হবে না, তাই না? অথচ দেখুন আপনার সামনে এই শব্দটা আমি উচ্চারণ করছি, করেই যাচ্ছি–অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া, অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া, অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া…’
আমি তোতাপাখির মতো শব্দটা বলতে থাকি।
লোকটা চুপ করে বসে থাকে।
‘আপনি স্বপ্ন দেখছেন মানেই হলো আমি আপনার স্বপ্নের একটা উপাদানমাত্র। মানে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আপনি এই ঘরে আসার আগে আমার অস্তিত্ব ছিল না। আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তাহলে আমার কোনো স্মৃতি থাকার কথা নয়। কিন্তু ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, গত ৪২ বছরের প্রায় পুরোটা স্মৃতি আমার মনে আছে। আমার এই মোবাইল ফোনে প্রায় সাড়ে চারশ নম্বর সেভ করা আছে। তারা আমার বন্ধু, পরিচিত। আপনি তাদের কারও নাম জানেন না, শোনেননি। আমার স্ত্রী এ মুহূর্তে এখান থেকে দেড় মাইল দূরে একটা সিনেমা হলের সামনে দুটি টিকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনি। এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র তারা সবাই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না।’
‘যাবে,’ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটা একরোখার মতো বলল।
‘আচ্ছা, আমি আপনাকে আরেকটা ব্যাখ্যা দিই। খুব সহজ, সাধারণ ব্যাখ্যা। ধরে নিলাম এই জগৎটা আসলে আপনার একটা কল্পনামাত্র, একটা ইস্যুশন, একটা কল্পলোক। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, কী ভীষণ ডিটেইল এই জগৎটা। এখানকার প্রতিটি জিনিস, প্রতিটা বস্তু অসম্ভব পুঙ্খানুপুঙ্খ। এই যে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। লক্ষ-কোটি বৃষ্টির ফোঁটা আলাদা-আলাদাভাবে পড়ছে, তার প্রতিটি আপনাকে আলাদাভাবে কল্পনা করতে হচ্ছে। সম্ভব? এই জানালার পর্দাটার দিকে তাকান। প্রতিটি সুতা আলাদাভাবে বোনা। সম্ভব?’