আমার এই ভঙ্গি দেখে লোকটা উঠে দাঁড়ায়।
আমি বলি, ‘আচ্ছা, একটা কথা। আপনি ঘুমের সমস্যা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু শুরুটা করলেন স্বপ্নের কথা বলে। কেন?’
‘মানে?’
‘মানে আপনি “ঘুমান না” না-বলে বললেন, আপনি “স্বপ্ন দেখেন না”। কেন?’
লোকটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যেন একটা ভুলে যাওয়া কথা মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে সে আবার বসে পড়ে। এই সেরেছে, রে।
‘আমি তো সেই কথাটাই বলতে এসেছি। আপনি প্লিজ মনোযোগ দিয়ে আমার কথাটা শুনুন। প্লিজ।’
‘শুনব। কথা শোনাই আমাদের কাজ। কিন্তু আপনি কি সংক্ষেপে বলতে পারবেন? মানে আমার একটু তাড়া আছে।’
‘আমি খুবই সংক্ষেপে বলব। আপনি প্লিজ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।’
লোকটা নড়েচড়ে বসে। আমি তার মধ্যে কোনো তাড়া দেখি না। এ লোক সংক্ষেপে বলবে না।
‘আপনি একটু আগে বললেন না নিউরোলজিস্টের কাছে যেতে?’
‘বলেছি।’
‘ইনফ্যাক্ট ঢাকা শহরে এমন কোনো নিউরোলজিস্ট নেই, আমি যার কাছে যাইনি। গত দুই বছর ধরে এমন কোনো ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা নেই, আমাকে করানো হয়নি। কিছুই ধরা পড়েনি। কত রকম যে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি।’
আমি চুপ করে থাকি।
‘আমি নিজে অনেক চিন্তা করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি, সমস্যাটা কোথায়। অনেক ভেবে…অনেক ভেবে…বুঝেছেন… অনেক চিন্তাভাবনা করে অবশেষে আমি বের করে ফেলেছি, কেন আমার ঘুম হয় না।’
এটুকু বলে লোকটা থামে। থেমেই থাকে।
লোকটা আমার কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন আশা করছে।
আমি বলি, “তা, কেন ঘুম হয় না?’
লোকটা সামনে ঝুঁকে আসে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। ভারি নিশ্বাস পড়ছে। অত্যন্ত নিচু গলায়, প্রায় ফিসফিস করে লোকটা বলে, ‘আমার ঘুম হয় না, কারণ আমি আসলে ঘুমিয়ে আছি।’
বলেই লোকটা সোজা হয়ে বসে। পায়ের ভর পরিবর্তন করে। বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে।
আমি কিছু বলি না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি ঘড়ির ডায়ালের দিকে। সেকেন্ডের কাটাটা টিকটিক করে এগোচ্ছে।
‘আপনি কি কাল আবার আসতে পারবেন?’
‘আমি আর সামান্য কয়েকটা মিনিট সময় নেব। প্লিজ, আমাকে পুরোটা বলতে দিন।’
‘বলুন।’
‘আমি অনেক ভেবে দেখলাম, যে লোক ঘুমিয়ে আছে, সে আর ঘুমাবে কী করে! তার পক্ষে তো আর ঘুমানো সম্ভব নয়।’
‘ঠিক কথা। তাহলে আপনি ঘুমিয়ে আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
‘ঘুমিয়ে কথা বলছি না। আমি আসলে কথাই বলছি না। আমি স্বপ্ন দেখছি।’
‘দুর্দান্ত বলেছেন! আপনি স্বপ্নে দেখছেন যে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ। আমি আসলে একটা দীর্ঘ স্বপ্নের ভেতর আছি।’
‘আর এ কারণেই আপনি কোনো স্বপ্ন দেখেন না?’
‘ইয়েস।’
‘দারুণ! দারুণ!’ আমি এবার ঘর কাঁপিয়ে হো-হো করে হেসে উঠি।
আমার এই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত প্রতিক্রিয়া দেখে লোকটা অপ্রতিভ ভঙ্গিতে বসে থাকে।
‘আপনি স্বপ্নে দেখছেন যে আপনি এই মুহূর্তে এই ঘরে বসে আমার সঙ্গে কথা বলছেন?’
লোকটা চুপ করে থাকে।
‘তার মানে এই ঘরটা, এই যে টেবিল, এই যে ফুলদানি, ওই যে জানালা, জানালার পর্দা…দেয়ালে ক্যালেন্ডার, ক্যালেন্ডারের পাশে টিকটিকি…এগুলো…এই পুরা জগৎটা আপনার স্বপ্ন?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার মানে আপনার সামনে এই যে আমি বসে আছি, আমার কোনো অস্তিত্ব নাই? আমিও আপনার স্বপ্ন?’
লোকটা মাথা নিচু করে। যেন আমাকে স্বপ্নে পর্যবসিত করায় সে কিছুটা বিব্রত, লজ্জিত।
আমি বলি, ‘হুম। ইন্টারেস্টিং। কোয়াইট ইন্টারেস্টিং। কিন্তু দয়া করে বলবেন কি, ঠিক কী কারণে আপনার এই কথা মনে হলো? মানে আপনি কীভাবে এই সিদ্ধান্তে এলেন?
‘আমি পুরোটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেব। আপনি একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন আমার কথা।’
‘অবশ্যই শুনব। আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছে। আপনি সময় নিয়ে বলুন।’
‘আমাকে পাগল মনে হচ্ছে আপনার, তাই না?’’
‘মোটেই না। এক্কেবারে না। আপনি আমার কাছে এসেছেন। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনছি। আপনার প্রতিটি কথা আমি বিবেচনা করছি, আমার মতো করে।’
আমি উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। কাঁচের ওপারে নিচে রাতের শহর। ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। স্ট্রিট লাইটের হলুদ আলো কেমন ঝাপসা, ল্যাপটানো। গাড়ির হেডলাইটের আলো পিছলে যাচ্ছে রাস্তার পিচে।
‘আপনি কি কিছু খাবেন, চা, কফি?’
‘কফি দিতে পারেন।’
আমি কফি বানাই। মগটা তার হাতে দিয়ে আমার চেয়ারে বসি।
‘আপনি ম্যাট্রিক্স দেখেছেন?’
লোকটা কী যেন ভাবছিল। আমার প্রশ্নে চমক ভাঙে।
‘না। কী সেটা?’
‘একটা সিনেমা।’
‘ওহ।’
আমি আয়েশ করে বসে কফিতে চুমুক দিই, ‘এবার বলুন।’
‘কী বলব?’
‘বলুন, কীভাবে এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে এলেন যে, আপনি আসলে স্বপ্ন দেখছেন, দীর্ঘ একটা স্বপ্ন?’
‘বলছি,’ লোকটাও আয়েশ করে বসে। আমি ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি, ফার্স্ট অফিসার পদে। ছোট পোষ্ট। কাজ বেশি। থাকি পলাশীতে স্টাফ কোয়ার্টারে। বছর দুয়েক কি তারও বেশি আগের ঘটনা। আমার অফিসে একটা আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি। অনেক হইচই। একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক যেটা, তদন্তে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অথচ এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ নেই আমার। ব্যাপারটা আমার জন্য বিপর্যয়কর। আমি প্রচণ্ড মানসিক শক পাই। আমার শোবার ঘরের ড্রয়ারে দু-পাতা ইনকটিন ছিল।’