হতে পারে বানিয়ালুলুর ক্ষেত্রে এ রকম নিখুঁত রেট্রো এফেক্ট অর্জন করা সম্ভব হয়েছে ওই একই কালচারাল ডিজইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে মানতে হবে, বানিয়ালুলুকে ফিরিয়ে আনার আর কোনো সুযোগ নেই। দেশটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমরা বড়জোর মার্কিন সাংস্কৃতিক প্রক্ষেপগুলোর মধ্যে বানিয়ালুলুর ডিজইন্টিগ্রেটেড অস্তিত্বের পরোক্ষ কিছু আভাস খুঁজতে পারি মাত্র। এ জন্যে আমাদের পর্যবেক্ষণ শক্তিকে প্রখর ও শাণিত করতে হবে। অনুসন্ধানী চোখে তাকাতে হবে হলিউডের স্টুডিওগুলো থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর কাহিনি ও সংলাপের দিকে, কান পাততে হবে রক-অ্যান্ড-রোলের প্রতিটি ড্রাম বিটের মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র অবকাশবিন্দুতে, বার্নস অ্যান্ড নবলের প্রত্যেক তলার প্রতিটি নিউ অ্যারাইভালের প্রতিটি পাতার দুটি লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলোর বিন্যাস লক্ষ করতে হবে এবং এমনকি নিউইয়র্কের প্রতিটি সড়কের ফুটপাতে প্রতিটি ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দেওয়া কফির মগ লক্ষ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা বানিয়ালুলুর খুবই পরোক্ষ উল্লেখের কোনো কোনো আণুবীক্ষণিক টুকরো হয়তো মাঝে মাঝে শনাক্ত করতে সক্ষম হব।
র্যাট স্মেলারের প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। অনেকে তাঁর অনুপস্থিতিকে জবরদস্তিমূলক অন্তর্ধানের একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখেন। তবে আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও দুটি সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেওয়া যাবে না। বানিয়ালুলুর বিবরণ সরবরাহ করতে গিয়ে দেশটির ব্যাপারে ব্যাট স্মেলারের ক্রমবর্ধমান মুগ্ধতা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। হতে পারে, দেশটিতে পাড়ি জমানোর কোনো গোপন সুড়ঙ্গ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। অথবা তিনি আদৌ নিখোঁজই হননি। অজস্র তথ্য আর উল্লেখের মধ্যে বিশ্লিষ্ট হয়ে তিনি হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছেন ম্যানহাটানেরই রাস্তায় রাস্তায়, আমাদের পাশে পাশে।
০২. জাগার বেলা হলো
‘আমি এখন আর কোনো স্বপ্ন দেখি না, লোকটা বলল। এমনভাবে বলল, যেন অভূতপূর্ব কোনো কথা শোনাচ্ছে।
কথাটা বলে একটু দম নিল লোকটা। গভীর আর্তিভরা চোখে তাকাল আমার দিকে। আমার প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়।
আমার কোনো ভাবান্তর হলো না। বললাম, এ যুগে স্বপ্ন দেখা কঠিন। আমাদের কোনো স্বপ্নই তো আর অবশিষ্ট নেই।’ বলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম।
লোকটা আমাকে হতাশ করেছে। আমি আরও চমকপ্রদ কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। খুব গুপ্ত, গূঢ় কোনো কথা। এমন কিছু, যা শুনে আমার ভ্রু কুঁচকে যাবে। কৌতূহল জাগবে। অন্তত আমার সামনে বসার পর লোকটা শুরুতে এ রকমই তো আভাস দিয়েছিল। বলেছিল, অত্যন্ত জটিল আর বিস্ময়কর একটা সমস্যা নিয়ে সে আমার কাছে এসেছে। কিন্তু এখন দেখছি, সে অযুত-সহস্র হতাশাগ্রস্ত মধ্যবয়সীদের একজন। আমিও সে কারণেই তাকে একটা বাজারচলতি কিন্তু অর্থহীন সান্ত্বনাবাক্য বললাম।
‘আমি কিন্তু সে কথা বলিনি। স্বপ্ন দেখি না বলতে আমি বোঝাচ্ছি, আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না। ঘুমের মধ্যে আমি কোনো স্বপ্ন দেখি না।’
‘স্বপ্ন দেখেন। ঘুম ভেঙে মনে থাকে না যে আপনি স্বপ্ন দেখেছেন।’
‘আমি স্বপ্ন দেখি না,’ লোকটা জোর দিয়ে বলল। খুব জেদি আর গোঁয়ার ভঙ্গি তার গলায়।
‘সেই অর্থে আমরা কিন্তু কেউই স্বপ্ন দেখি না। ঘুম ভাঙার পর স্বপ্ন দেখার একটা ধোয়াটে স্মৃতি কেবল থাকে আমাদের। মানে বলতে চাচ্ছি, স্বপ্ন দেখাটা আসলে স্বপ্ন দেখার একটা স্মৃতিমাত্র, একটা অসম্পূর্ণ ক্ষয়িষ্ণু অপভ্রংশ স্মৃতি।’
আমি খুব দার্শনিক ভঙ্গি করে কথাটা বললাম। লক্ষ রাখলাম, বলার সময় যাতে আমার জ্ঞান আর প্রজ্ঞার ওজন প্রকাশ পায়।
লোকটা একটু বিরক্ত গলায় বলে, ‘আমি স্বপ্ন দেখি না, কেননা আমি ঘুমাই না।’
‘ও, আপনি তাহলে স্লিপ ডিজঅর্ডার নিয়ে এসেছেন! প্যারাসমনিয়া!’’
‘হতে পারে। আমি তো আর এসব শব্দ জানি না।’
কবে থেকে এই সমস্যা?
‘দুই বছর।’
‘মানে কি দুই বছর ধরে আপনি ঘুমান না?’
লোকটা মাথা নাড়ে। সে এবার একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে।
‘আপনি শব্দটা কী বললেন যেন, প্যারাসমনিয়া?”
‘হুম।’
‘আমি ইনসমনিয়া শব্দটা শুনেছি। এটা শুনিনি।’
‘শব্দ জানা জরুরি নয়। আপনি দুই বছর ধরে ঘুমান না?’
‘হ্যাঁ।’
‘সর্বনাশ। আপনি মারা যাবেন তো!’
লোকটা চুপ করে থাকে। ‘সমস্যা হয় না? ক্লান্তি?’
‘না, হয় না।’
হওয়ার কথা। ঘুমের ঘাটতি হলে প্রি-ফ্রন্টাল করটেক্স আর টেমপোরাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মগজের কতগুলো এলাকা। তখন যুক্তিশৃঙ্খল এলোমেলো হয়ে যায়, চিন্তাশক্তি কমে। যায়, কথাবার্তাও অসংলগ্ন হয়ে যায়।’
লোকটা মাথা নিচু করে থাকে। যেন বাধ্য ছাত্র, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া নিচ্ছে।
‘আপনি কোনো নিউরোলজিস্টের কাছে গেলে ভালো করবেন। এটা একটা নিউরোলজিক্যাল সমস্যা। আমি একজন সাইকোলজিস্ট। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি আমার বিদ্যা। আমার কারবার মন নিয়ে। আপনি আমার কাছে খামোখা এসেছেন।’
‘যাব,’ লোকটা অলসভাবে বলে।
মনে হলো, লোকটা এবার উঠবে। উঠুক। আমারও তাড়া আছে। অ্যাসিসট্যান্ট ছেলেটাকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি। আমিও এখনই উঠব। তার আগে ড্রাইভারকে ফোন দিতে হবে। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই।