এই ঘটনার কিছুদিন পর তারাশঙ্করের ডায়েরি প্রকাশিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের পটভূমিতে রচিত এ ডিটেকটিভ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরি হওয়ার পরপরই মইদুল ইসলামের শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটে। তিনি আর বেশি দিন বাঁচেননি।
আবুল খায়ের আর কখনোই তার আপত্তির কথা মুখ ফুটে উচ্চারণ করেননি। তবে তাঁর সন্দেহ থেকে তিনি মোটেও বিচ্যুত হননি। বরং তারাশঙ্করের ডায়েরি পড়ে তাঁর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এই ঘটনার বছর পাঁচেক পর আবুল খায়েরের সঙ্গে ঘটনাচক্রে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। মইদুল ইসলামের কথাসাহিত্য আমাদের মধ্যে হৃদ্যতার সেতু তৈরি করে থাকবে। আবুল খায়ের তার পুরোনো নিবন্ধটি আমাকে পড়তে দেন। মইদুল ইসলাম ও প্রণবেশ-সংক্রান্ত যেসব অনুপুঙ্খ বিবরণ এখানে আমি দিয়েছি, সেগুলো আবুল খায়েরের মুখ থেকে শোনা।
কোলন ক্যান্সারে আবুল খায়েরের মৃত্যুর পর তাঁর সিদ্ধান্তটি আমি বহুদিন ধরে বহুভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবেছি। যতই দিন গেছে, ততই তাঁর সঙ্গে আমি একমত হতে বাধ্য হয়েছি।
মইদুল ইসলামের নামে ছাপা হওয়া শেষ তিনটি উপন্যাস যে তার লেখা নয়, এ বিষয়ে কনভিন্সড হতে আবুল খায়েরের নিবন্ধটিই যথেষ্ট। আমি এটি আমার লেখার সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলাম।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে শেষ করব।
ওই তিন উপন্যাস যদি মইদুল ইসলামের না হয়ে থাকে, তবে সেগুলো কার লেখা?
এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। একবার সন্দেহটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জায়গা করে দিলে অনেকে এটির ওপর আলো ফেলতে পারবেন। তখন অনেকের আলোচনার ভেতর থেকে একটি নিশ্চিত সিদ্ধান্ত হয়তো বেরিয়ে আসবে।
এখানে আমি কেবল কয়েকটি সন্দেহের কথা বলতে পারি।
আবুল খায়ের নিজে মনে করতেন, এ তিন উপন্যাস আসলে প্রণবেশ মাইতির লেখা। প্রণবেশ তার যন্ত্রটিকে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন, যাতে তাঁর নিজের লেখাগুলো মইদুল ইসলামের লেখা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। এ কাজ করার পেছনে প্রণবেশের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, সেটার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা আবুল খায়ের আমাকে দিতে পারেননি। হতে পারে, সাহিত্যিক উচ্চাভিলাস ছিল তাঁর। কিন্তু নিজের লেখার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তার লেখাগুলোর প্রকৃত মূল্য যাচাই করার একটি কৌশল নিয়েছিলেন তিনি। আবুল খায়ের তার এ অনুমানের পক্ষে একটিই পরোক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে পেরেছিলেন। প্রথম জীবনে প্রণবেশ যখন লেখালেখিতে হাত পাকানোর চেষ্টা করছেন, সে সময়কার একটি গল্পের খসড়ায় ললিতা নামে একটি চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। মইদুল ইসলামের বেহুলার বাসর উপন্যাসের প্রধান চরিত্রটির নামও ললিতা। এটা এত সূক্ষ্ম একটা মিল যে দৈব ছাড়া আর কিছু বলে চালানোর উপায় নেই।
আমার নিজের অনুমান আরেকটু বিচিত্র। আমি মনে করি, প্রণবেশ মাইতির বানানো ওই যন্ত্রটিই আসলে শেষ তিন উপন্যাসের লেখক। হতে পারে, মইদুল ইসলামের প্রথম দুটি উপন্যাস এবং একটি উপন্যাসের শেষ অধ্যায় লিখে দেওয়ার সময় সেই যন্ত্রটি ফিকশন লেখার কলাকৌশল রপ্ত করে নিয়েছিল। তারপর শুরু করেছিল নিজে থেকে লিখতে।
সন্দেহ নেই এটি একটি উন্মাদ অনুমান। এটি সত্য হতে হলে নিজে থেকে চিন্তা করতে পারে–এ রকম একটি যন্ত্রের অস্তিত্ব কল্পনা করতে হবে আমাদের। বিজ্ঞানের লোক না হয়েও আমি জানি, এ রকম একটি ব্যাপারকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে ডাকা হয় এবং সে রকম কিছু আদৌ তৈরি করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানের রাজ্যে এখনো তর্ক শেষ হয়নি। বিশেষ করে প্রণবেশ মাইতির মতো কারও পক্ষে এ রকম একটি যন্ত্র বানানো যে সম্ভব ছিল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে এটা তো ঠিক যে, মইদুল ইসলামের চিন্তা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছিল যন্ত্রটি, এবং কোনো এক দুর্বোধ্য উপায়ে হয়তো এটি নিজেকে বিবর্তিত করে নিয়েছিল, সেই বিবর্তন জৈব বিবর্তনের নিয়ম মেনে হয়নি, হয়তো যন্ত্রের বিবর্তনের আলাদা কোনো কলাকৌশল থেকে থাকবে, অন্য কোনো ডারউইন যেটা একদিন আবিষ্কার করবেন। গোড়াতে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ছিল না যন্ত্রটির, মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের সঙ্গে এটির মিথস্ক্রিয়ায় কোথাও তৃতীয়। একটি মিথজীবী বুদ্ধিমত্তা তৈরি হয়ে গিয়ে থাকবে, মইদুল ইসলামের মস্তিষ্ক ছাড়া যেটির স্বাধীন সত্তা ছিল না এবং মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কটি এটির পোেষক দেহ হিসেবে কাজ করছিল, তার অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির ভান্ডার হয়ে উঠেছিল এটির খাদ্য। এ কারণে মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এই মধ্যবর্তী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
আমার অনুমানের ওপর কিছুটা আলো ফেলতে পারতেন প্রণবেশ মাইতি। কিন্তু আমরা গত নয় বছরে তার কোনো খোঁজ পাইনি। শুনেছি, আইরিশ স্ত্রীর অবিশ্বস্ত আচরণ তাঁকে দিনে দিনে উন্মাদপ্রায় করে তুলেছিল এবং নিজ বিছানায় স্ত্রীর তরুণ প্রেমিককে হত্যা করে তিনি স্থায়ীভাবে গা ঢাকা দিয়েছেন। আমি মনে করি না, শেষ তিনটি উপন্যাসকে তার রচনাবলি থেকে সরিয়ে ফেললে বাংলা সাহিত্যে মইদুল ইসলামের এত দিনকার আসনের খুব একটা ব্যত্যয় ঘটবে। ওই তিন উপন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু এখন তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোকেও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা শুরু হয়ে গেছে এবং মইদুল ইসলাম তার কাল্ট খ্যাতির সীমা ডিঙিয়ে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর সমাদর পেতে শুরু করেছেন। আমার প্রস্তাব, তার রচনাবলির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় একটি বাড়তি খণ্ড প্রকাশ করা হোক, যেখানে এই তিন উপন্যাসকে জায়গা দেওয়া হবে এবং সেখানে মইদুল ইসলামকে এই উপন্যাসগুলোর সহ-লেখক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হবে। অপর সহ-লেখকের ঘরটি ফাঁকা রাখা হোক, তত দিন পর্যন্ত, যত দিন না মানব সমাজ এই মধ্যবর্তী সত্তাটির যথাযথ একটি নাম খুঁজে পাচ্ছে।