যন্ত্রটি মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পর প্রণবেশ আরও তিন দফা এসে সামান্য কিছু সংস্কার করে দিয়ে যান। এ উপলক্ষে সপ্তাহখানেক তিনি দেশে অবস্থান করেন এবং তারপর তার কর্মস্থল কেমব্রিজে ফিরে যান। এর দুদিন আগে থেকে কম্পিউটারের মনিটরে মইদুল ইসলামের নতুন উপন্যাস লেখা হতে থাকে। প্রথমটায় এই লেখার গতি অনেক ধীর ছিল। সম্ভবত নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে মইদুল ইসলামকে বেগ পেতে হচ্ছিল। দিনের বড় একটা সময়জুড়ে কম্পিউটারের পর্দা অনড় থাকত। এ সময় মইদুল ইসলাম ঘুমাচ্ছেন নাকি চিন্তা করছেন, বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তার চোখের পাতা চব্বিশ ঘন্টাই ঘুমন্ত ব্যক্তির মতো মুদিত থাকত। বিকেলের দিকে তিনি সামান্য কিছু লিখতেন। একটানা ছয়-সাতটি বাক্যের বেশি এগুতো না লেখা। কখনো কখনো একটি বাক্যের মাঝামাঝি এসে তিনি থেমে যেতেন। হয়তো তার মস্তিষ্ক অবসন্ন হয়ে পড়ত, অথবা লেখক হয়তো সে সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো চিন্তায় ডুবে যেতেন। হতে পারে, আসন্ন মৃত্যু ভাবনায় তার চিন্তার স্রোত মাঝে মাঝেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। এভাবে তিন সাড়ে তিন মাসে তৈরি হয় তার নতুন উপন্যাস ভেলভেট-এর পাণ্ডুলিপি।
এটা খুব অবাক হওয়ার মতো একটা বিষয় যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতিতে, অত্যন্ত অপরিচিত-অনভ্যস্ত এক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে লেখা সত্ত্বেও মইদুল ইসলাম তাঁর লেখনীর শুদ্ধতা পুরোপুরি বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এই সব বাইরের বিষয়’ তাঁর লেখার শৈলী ও বিষয়বস্তুর ওপর কোনো প্রভাবই রাখতে পারেনি। তার সুস্থাবস্থার লেখনীর সঙ্গে এ নতুন লেখাকে কোনোভাবে আলাদা করার জো ছিল না। এটি হয়তো তার লেখকসত্তার শক্তিমত্তা আর দৃঢ়তারই পরিচয় বহন করে।
এটা খুব লক্ষ্যণীয় যে ১৮৬ পৃষ্ঠার উপন্যাস ভেলভেট প্রকাশ হলে তাঁর পাঠক সমাজের মধ্যে এটি পূর্বের মতো একই মাত্রায় সীমিত সাড়া ফেলে।
ভেলভেটএর পর কিছুদিন বিরতি দিয়ে মইদুল ইসলাম তার অসমাপ্ত উপন্যাস ফেরারীর অষ্টাদশ ও শেষ অধ্যায় লিখে ফেলেন। এরপর তিনি লেখেন মাতুলালয় নামে এক জটিল রাজনৈতিক উপন্যাস। দীর্ঘ, সুপরিসর এ উপন্যাসে বেশ কিছু আত্মজৈবনিক উপাদান আছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
এরপর কম্পিউটারের পর্দা আমাদের একে একে উপহার দেয়। গিরগিটি, বেহুলার বাসর ও তারাশঙ্করের ডায়েরি মইদুল ইসলামের শেষ এবং বিতর্কিত তিন উপন্যাস। এগুলো সম্পর্কে শুরুতেই কিছু কথা বলেছি। এ স্থলে আরও কিছু কথা যোগ করতে চাই।
প্রথম দুটি উপন্যাস গিরগিটি ও বেহুলার বাসর বের হওয়ার পরপরই আবুল খায়ের নামে এক বিদগ্ধ পাঠক এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, এগুলো মইদুল ইসলামের লেখা নয়। মইদুল ইসলামের বাক্যের গঠন, তার ক্রিয়াপদের ব্যবহার, উপমা প্রয়োগের প্রবণতা ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আবুল খায়ের ওই নিবন্ধে তার সিদ্ধান্তের পক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেন। তবে আবুল খায়ের এটি কোথাও ছাপতে দেননি। এটি প্রকাশিত হলে সেটা যে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন কেলেঙ্কারির উপলক্ষ তৈরি করত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আবুল খায়ের ছিলেন মইদুল ইসলামের সেই ঘনিষ্ঠ ভক্ত চক্রের অংশ, যে চক্রটি তার প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভ করার সুযোগ পেত। প্রিয় লেখককে ঘিরে অযথা কোনো বিতর্কের জন্ম দেওয়া আবুল খায়েরের অভিপ্রায় ছিল না। তাই প্রথমটায় তিনি তার নিজস্ব গণ্ডির ভেতরে আপত্তি তুলতে শুরু করেন। শিগগিরই বিষয়টা মইদুল ইসলামের ভেতরের সার্কেলের (পরিবার, প্রকাশক এবং তার অ্যাসিসট্যান্ট কাম-লিটারারি এজেন্ট) কানে যায় এবং এক আসন্ন কেলেঙ্কারির আশঙ্কায় তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা আবুল খায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টা স্থায়ীভাবে ফয়সালা করার প্রস্তাব দেন। তত দিনে মইদুল ইসলামের শ্রবণশক্তি অটুট থাকার তথ্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে। অর্থাৎ জানা গেছে, বাইরের জগতের সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগহীন তিনি নন। কিছুটা পরোক্ষ হলেও তার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনে যাওয়া সম্ভব। ফলে সাব্যস্ত হয়, মইদুল ইসলামের কাছ থেকেই এই সন্দেহের জবাব চাওয়া হবে।
এই অভিপ্রায়ে এক ঘোর বৃষ্টির দিনে মইদুল ইসলামের শিয়রের কাছে এসে দাঁড়ায় পাঁচটি প্রাণি–আবুল খায়ের, মইদুল ইসলামের প্রকাশক, তার অ্যাসিসট্যান্ট এবং পরিবারের দুই বুজুর্গ সদস্য, যাদের একজন মির্জা একরামুল বাশার (ইনিই পরবর্তীকালে মইদুল ইসলামকে নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখবেন এবং সেটায় এই বিশেষ দিনটির প্রসঙ্গ পুরোপুরি চেপে যাওয়া হবে)। তাদের একজন, আমি জানি না কোনজন, কিছুক্ষণ গলা খাঁকারি দিয়ে মইদুল ইসলামের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, শেষ দুটি উপন্যাস তিনি লেখেননি বলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এই দুই উপন্যাস আসলেই তার লেখা কি না? শুনেছি, মইদুল ইসলাম এই প্রশ্নে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, সকলকে তিরস্কার করে তিনি ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। এমন মৌন তিরস্কারের উদাহরণ আর আছে কি না সন্দেহ–তার স্নিগ্ধ ঘুমজড়ানো মুখমণ্ডলে এর কোনো ছাপ পড়েনি।