আজ থেকে ১১ বছর আগে প্রণবেশ মাইতি এক সংক্ষিপ্ত সফরে দেশে আসেন। সেটা শ্রবণ মাস ছিল। অঝর বৃষ্টিতে ঢাকার অধিকাংশ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। শাহজাহানপুর রেলগেটের এক কোনায় গাড়ি রেখে এক সহযোগী যুবককে সঙ্গে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পানি ডিঙিয়ে প্রণবেশ এসেছিলেন মইদুল ইসলামের বাসায়। দুজনের হাতে প্যাকেটবদ্ধ ভারি কিছু যন্ত্রপাতি। তাদেরকে লেখকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চারটি প্যাকেট খুলে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া লাগিয়ে তাঁরা যে যন্ত্রটি দাঁড় করান, সেটি দেখতে একটি আইবিএম ডেস্কটপ কম্পিউটারের মতো।
শুনেছি এই পুরো সময়টা একজন বেতনভূক পেশাদারের নিবিষ্ট উদাসীনতায় কাজ করে গেছেন প্রণবেশ মাইতি। পাশেই শয্যায় শায়িত খাকিরঙা একটি সিল্কের শাল দিয়ে শরীর ঢাকা প্রিয় লেখকের দিকে তিনি একবার তাকিয়েও দেখেননি। তাঁর পাশে দুবার কফি রাখা হয়েছিল, তিনি স্পর্শ করেননি। অচল রোগীকে ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন দেওয়ার জন্য পাড়াতো ডিসপেনসারি থেকে ডেকে আনা একজন ভাড়াটে মেডিক্যাল অ্যাসিসট্যান্টের মতো নির্লিপ্তি ছিল তার কর্মকাণ্ডে।
যন্ত্রটি দাঁড় করিয়ে ঘরের এক কোনায় রাখা একটি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছিলেন পরিশ্রান্ত প্রণবেশ, তারপর জোরে নিশ্বাস ছেড়ে একটি অচেনা বিদেশি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সম্ভবত ভেতরে ভেতরে তিনি কিছুটা উত্তেজিত থেকে থাকবেন। ঘরে আরও দুয়েকজন বয়স্ক লোকের উপস্থিতি ছিল। সকলের সামনে এভাবে সিগারেট ধরানো যে এ দেশে স্বাভাবিক রীতি-রেওয়াজের মধ্যে পড়ে না, সেটা তার না জানার কথা নয়। সিগারেট টানতে টানতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফিতে চুমুক দিচ্ছিলেন তিনি। প্রিয় লেখকের দিকে নয়, নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে ছিলেন সেগুন কাঠের একটি তেপায়া টেবিলের ওপর রাখা সদ্য বানানো যন্ত্রটির টিকে। তারপর ঘরের সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইংরেজিতে বলে উঠেছিলেন, ‘নাউ হি ক্যান রাইট’।
এভাবে মইদুল ইসলামের ‘মূল্যবান’ লেখনীকে আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখার একটি বন্দোবস্ত হয়েছিল। আর সেটা হয়েছিল তার ভক্ত পাঠক প্রণবেশ মাইতির বানিয়ে দেওয়া যন্ত্রটির কল্যাণে।
.
যন্ত্রটি কীভাবে কাজ করত, কীভাবে সেটা অথর্ব একজন লেখককে তার জড়জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিল, সেটার বিবরণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বিজ্ঞানের লোক নই। আমি কেবল এটির বহিরঙ্গের কিছুটা পরিচয় দেব।
মইদুল ইসলামের শয্যর পাশে একটি টেবিলে রাখা ছিল যন্ত্রটি : একটি এলসিডি মনিটর আর কালো প্লাস্টিকের কেসিংয়ে ভরা সিপিইউ সংবলিত যন্ত্রটিকে মামুলি ডেস্কটপ কম্পিউটার বলে মনে না করার কোনো কারণ ছিল না। তবে বলাই বাহুল্য, এটি সামান্য কোনো কম্পিউটার যন্ত্র ছিল না। এর সিপিইউর পেছন দিক থেকে বের হয়ে এসেছে চারটি ক্যাথোড় টিউব, যেগুলোর অপর প্রান্ত আঠা দিয়ে লাগানো ছিল মইদুল ইসলামের মাথার সঙ্গে। দুটি টিউব লাগানো ছিল লেখকের কপালের দুই টেম্পলে আর দুটি টিউব তার ব্রহ্মতালুর দুপাশে। এখানে বলে রাখি, এই ক্যাথোড টিউব লাগানো উপলক্ষে পূর্বেই মইদুল ইসলামের মস্তিষ্ক মুণ্ডন করা হয়েছিল এবং এ রকম মুণ্ডিত মাথায় তাকে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুঁকোর মতো দেখাচ্ছিল।
খুব সরলভাবে বললে যন্ত্রটির কাজের প্রকৃতি ছিল এ রকম : এটি মইদুল ইসলামের মস্তিষ্কের চিন্তাপ্রবাহ পড়তে পারত এবং এই চিন্তাপ্রবাহকে সেটি অজানা একটি ওয়ার্ড প্রসেসর ইন্টারফেসের মাধ্যমে মনিটরে লিখিত আকারে প্রকাশ করত। এভাবে বাক্যের পর বাক্য শুধু ‘চিন্তা করে’ মইদুল ইসলাম তার স্তব্ধ লেখনীকে আবার সচল করতে পেরেছিলেন। তবে এখানে বলে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না–এ প্রক্রিয়াটি যান্ত্রিকভাবে সমাধা করা যতটা না কঠিন ছিল, তার চেয়ে কোনো অংশে কম কঠিন ছিল না মানসিকভাবে সমাধা করা। কেননা মইদুল ইসলাম আগে সুস্থ। অবস্থায় যেভাবে লিখতেন (শুরুতে ফুলস্কেপ কাগজে বলপয়েন্ট পেন দিয়ে, পরে একটি জার্মান কোম্পানির টাইপরাইটারে ও আরও পরে একটি অ্যাপেল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে), তার সঙ্গে এবারের লিখন প্রক্রিয়ার কোনো মিল ছিল না। শব্দ ও বাক্য সুশৃঙ্খলভাবে চিন্তা করে একটির পর একটি সাজিয়ে একটি প্লটকে ফুটিয়ে তোলা খুব সহজ কাজ ছিল না। এই প্রক্রিয়ার জন্য মস্তিষ্ককে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে নেওয়ার ব্যাপার ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ কাজটি মইদুল ইসলাম অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর একটা কারণ, মইদুল ইসলাম গোড়া থেকেই গোছানো প্রকৃতির লেখক ছিলেন। একটা পূর্ণ বাক্য মনে মনে সাজিয়ে তারপর সেটি লিখতেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, একেকটি পর্বচ্ছেদ তার মাথায় আগে থেকেই সাজানো হয়ে থাকত। এ কারণে একবার একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর তাকে খুব একটা সম্পাদনা করতে দেখা যেত না।
প্রণবেশের যন্ত্রটি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যেটি ছিল, সেটি হলো চিন্তা ফিল্টার করা। একজন লেখক সারাক্ষণ উপন্যাসের শব্দ আর বাক্য চিন্তা করেন না। প্রতি মুহূর্তে অজস্র চিন্তার হোত একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে যেতে থাকে। এর অধিকাংশ শুধু যে অপ্রয়োজনীয় দৈনন্দিনতা, তা-ই নয়, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের অন্ধকার ফ্রয়েডিয়ান কুঠুরিতে এমন বহু চিন্তা অনবরত পাক খেয়ে উঠে আসে, যেগুলোর প্রকাশ তার ও তার পরিপার্শ্বের জন্য ভয়ানক বিব্রতকর হয়ে উঠতে পারে। এই সমস্যাটির ব্যাপারে প্রণবেশ গোড়া থেকেই সচেতন ছিলেন। আর এ জন্য তিনি তার যন্ত্রে চিন্তা ফিল্টার করার একটি বাড়তি ফাংশন রেখেছিলেন। কোন চিন্তাটি বা একটি চিন্তার কোন অংশটি চূড়ান্তভাবে মনিটরে প্রকাশ পাবে, তা নিয়ন্ত্রিত হতো এই ফিল্টারের মাধ্যমে আর এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল লেখক মইদুল ইসলামের হাতে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, শুরুতে এই ফিল্টারের নিয়ন্ত্ৰণ মইদুল ইসলাম পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেননি, যার পরিণতিতে এক অসতর্ক মুহূর্তে পরিবারের এক ঘনিষ্ঠ অল্পবয়সী আত্মীয়াকে ঘিরে মইদুল ইসলামের এমন সব চিন্তা মনিটরের পর্দায় প্রকাশ হয়ে পড়ে, যেটি তাঁদের পরিবারকে বেশ কিছুদিন আলোড়িত করে রেখেছিল।