মইদুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিতে গিয়ে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার একটি বিষয় লক্ষ্য করতে প্রায় সকলেই ভুলে যান কিংবা আমার ধারণা বিষয়টি সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। আর সেটি হলো, শেষ জীবনে মইদুল ইসলামের গুরুতর অসুস্থতা। বিষয়টিকে আমি মামুলি বলে উড়িয়ে দিতে চাই না। কেননা, মইদুল ইসলামের অসুখটি জটিল ছিল, একটি বিরল প্রাণঘাতী রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং এটা লক্ষ না করার কোনো কারণ নেই যে, আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যে তিন উপন্যাস, তার সব কটিই অসুস্থাবস্থায় লেখা। এগুলো লেখার সময় তিনি শুধু যে শয্যাশায়ী ছিলেন, তা-ই নয়, প্রায় সব অর্থে তিনি ছিলেন অথর্ব।
পরিবারের দিক থেকে যত গোপনীয়তা অনুসরণের চেষ্টাই করা হোক না কেন, এ কথা এখন আর কারও অজানা নয় যে, ৪২ বছর বয়সে মইদুল ইসলাম অ্যামাইয়োটোপিক ল্যাটারাল স্কেরোসিস বা সংক্ষেপে এএলএস নামে বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ ধরনের নিউরো ডিজেনারেটিভ অসুখ। তবে কোনোভাবেই এটি বংশগত নয়। এ রোগের পরিণতিতে মইদুল ইসলামের স্নায়ুতন্ত্রের মোটর নিউরোন কোষ শুকিয়ে যেতে থাকে। তার দেহের সকল পেশী একে একে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। রোগ শনাক্ত হওয়ার তিন মাসের মাথায় মইদুল ইসলাম লক্ষ করেন, তিনি তার দেহের কোনো অঙ্গই আর নাড়াতে পারছেন না। তাঁকে স্থায়ীভাবে শয্যা নিতে হয়। তাঁর বাকশক্তি পুরোপুরি লোপ পায়। বিছানায় অনড়ভাবে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা ছাড়া তাঁর আর কিছু করার ছিল না। আর সকলে জানতেন যে, সেই মৃত্যু খুব দূরাগত নয়। কেননা এ রোগ শনাক্ত হওয়ার পর রোগীর খুব। বেশি দিন বাঁচার ইতিহাস নেই।
এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মইদুল ইসলাম যখন পুরোপুরি অথর্ব অবস্থায় স্থায়ীভাবে শয্যা নেন, সে মুহূর্তে তিনি তার ত্রয়োদশ উপন্যাস ফেরারির সপ্তদশ অধ্যায় লিখছিলেন, যেটি (আমরা এখন জানি) ওই উপন্যাসের পেনাল্টিমেট চ্যাপ্টার। এই অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে মইদুল ইসলামের শেষ অবদান হওয়ার কথা ছিল এবং এখানেই তার দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের ইতি ঘটার কথা। কিন্তু তা হয়নি। ফেরারি উপন্যাসটি শুধু যে সমাপ্ত হয়ে ছাপা হয়ে বেরিয়েছে, তা ই নয়, এর পর আরও পাঁচটি উপন্যাস লিখেছেন মইদুল ইসলাম, বলাই বাহুল্য সব কটি ও রকম অথর্ব অবস্থায়।
এই বিস্ময়কর ঘটনার পেছনের মানুষটির নাম প্রণবেশ মাইতি। ইনি মইদুল ইসলামের লেখার জেহাদি ভক্তদের একজন। আশির দশকে ঢাকায় মইদুল ইসলামের ভক্তদের যে কটি পাঠচক্র গড়ে ওঠে, ইনি তার একটির উৎসাহী সংগঠক ছিলেন। অত্যন্ত উদ্যমী ধরনের এ মানুষটি পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য পশ্চিমে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তবে প্রবাসে থেকেও তিনি প্রিয় লেখকের লেখনীর নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন এবং শোনা যায়, যে-গুটিকয় ভক্ত মইদুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন, প্রণবেশ তাঁদের অন্যতম।
মইদুল ইসলামের এএলএস রোগ ধরা পড়া এবং তাঁর শয্যা নেওয়ার সময় পোসাম’ নামে একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরি করতেন প্রণবেশ। কেমব্রিজ-ভিত্তিক এই কোম্পানিটি ইলেকট্রনিক অ্যাসিসটিভ টেকনোলজি বা ইএটি ব্যবহার করে প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা রকম যন্ত্র তৈরি করে থাকে। এই সব যন্ত্র বাইরের জগতের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এখানে স্মরণ করিয়ে দিই, এই পোসাম কোম্পানির গবেষক ডেভিড ম্যাসন একদা এএলএস রোগে আক্রান্ত স্টিফেন হকিংকে একটি ইলেকট্রনিক ভয়েস সিনথাসাইজার বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেটি হকিং বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহারও করেছিলেন। এই সিনথাসাইজারের শ্লেষ্মজড়ানো, ভৌতিক কণ্ঠস্বরকেই আমরা হকিংয়ের মহাজাগতিক কণ্ঠস্বর হিসেবে চিনি। পোসাম কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে ডেভিড ম্যাসনের অধীনে কাজ করতেন প্রণবেশ। এক আইরিশ বিধবার সঙ্গে যেদিন তিনি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন, সেদিন বিয়ের আসরেই টেলিফোনে তিনি প্রিয় লেখকের রোগের সংবাদ পান। বিবাহ মুহূর্তের রোমান্টিক পরিবেশের কারণে সে সময় সম্ভবত বেশ কিছুটা আবেগপ্রবণ ছিলেন প্রণবেশ। তিনি প্রতিজ্ঞা করে বসেন, মইদুল ইসলামের লেখনীর অকালমৃত্যু প্রতিরোধে তিনি তাঁর সকল শক্তি ও মেধা ব্যয় করবেন।
আমি মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেকখানি সরে এসেছি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার বক্তব্য অনুধাবনে এইসব অনুপুঙ্খ তথ্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেই আমার বিশ্বাস। আশা করি পাঠক মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনবেন।
প্রণবেশ প্রথমটায় মইদুল ইসলামের জন্য একটি রেগুলার ভয়েস সিনথাসাইজার বানিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সে উদ্যোগ তাঁকে পরিত্যাগ করতে হয়। কেননা এই যন্ত্র ব্যবহার করতে হলে ব্যবহারকারীকে শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ (হাত বা পায়ের অন্তত একটি আঙুল) নাড়াতে সক্ষম হতে হবে। মইদুল ইসলামের সেই সক্ষমতাও ছিল না। তিনি সম্পূর্ণরূপে জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। বাকশক্তি হারানোর অল্প কিছুদিনের মধ্যে দৃষ্টিশক্তিও লোপ পেয়েছিল তাঁর। কেউ যেন সুসজ্জিত একটি ঘরের দরজা-জানালা এক এক করে বন্ধ করে দিচ্ছে। তবে তাঁর সব জানালা বন্ধ হয়ে যায়নি। মইদুল ইসলামের শ্রবণশক্তি শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল, যদিও সেটা জানা গিয়েছিল আরও পরে। সেই মুহূর্তে কেবল এটিই স্পষ্ট করে জানা গিয়েছিল যে কোনো এক অজ্ঞাত উপায়ে মধ্যবয়সী এই লেখকের মস্তিষ্কটি সম্পূর্ণ অনাহত আছে। তিনি স্বাভাবিক উপায়ে সবকিছু চিন্তা করতে পারছেন, এবং তাঁর স্মৃতিও অটুট আছে। প্রণবেশ এই তথ্যটি পেয়েছিলেন।